৩. ফুলিয়া
সংলগ্ন মানচিত্র দেখে তোমরা হয় তো ভাববে যে, আমি ভাগীরথীর তীর ছেড়ে তোমাদের নিয়ে চলেছি দক্ষিণপূর্ব দিকে। বাস্তবে তা নয়। যে আমলের গল্প তখন ভাগীরথী ঐ ফুলিয়া কিনার ঘেঁষেই বইত।
আদি কবি নিজেই যে লিখে গেছেন তাঁর গ্রামের পরিচয় :
“গ্রামরত্ন ফুলিয়া জগতে বাখানি।
দক্ষিণে পশ্চিমে বহে গঙ্গা তরঙ্গিনী।”
কাকতালীয় ঘটনা যদি বল তবে তাই সই। জন্ম : 1440 খ্রীষ্টাব্দে সরস্বতীপুজার দিনে, মাঘী শুক্লা শ্রীপঞ্চমীতে। পিতার নাম বনমালী ওঝা, মায়ের নাম মালিনীদেবী। ‘ওঝা’ নবাবী খেতাব। আসলে ওঁরা মুখটি ব্রাহ্মণ। গুরুগৃহে শিক্ষা শেষ করে কৃত্তিবাস রাজপণ্ডিত হওয়ার মনোবাসনা সমেত রওনা দিলেন গৌড়েশ্বরের সভায়। কেউ বলেন, গৌড়েশ্বর নন, বাস্তবে তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, কেউ বলেন রাজা গণেশ। মোট কথা, স্বরচিত পাঁচটি শ্লোক তিনি শুনিয়েছিলেন সেই রাজার দরবারে। রাজা অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, আমি তৃপ্ত। বলুন, কী পুরস্কার দেব?
এই তো মুকিল ঐসব আধ-পাগ্লা কবিগুলোকে নিয়ে। যায় রাজকবি হওয়ার বাসনা নয়ে, বেমক্কা চেয়ে বসে : রাজকণ্ঠের মালা! তাও সোনার নয়, ফুলের।
কৃত্তিবাস তা চাননি। পরিতৃপ্ত ভূস্বামীকে জানালেন তাঁর মনোবাসনা। বাল্মীকি রামায়ণ তো দেশের সাধারণ লোক পড়তে পারে না, তাই সাদা বাঙলায় উনি সারা জীবনভর একটি ভাষা-রামায়ণ’ রচনা করতে ইচ্ছুক।
রাজা বললেন, তথাস্তু। আপনার মাসোহারা বন্দোবস্ত করে দেওয়া হবে। লিখুন, যা মন চায়।
বাঙলা ভাষায় রামায়ণ রচনা যে একটা অবাস্তব প্রস্তাব সে-কথা আর ঐ পাগলটাকে স্পষ্টাক্ষরে জানালেন না!
সারাজীবনে, বাংলার আদি কবি কৃত্তিবাস রচনা করলেন তাঁর ‘ভাষা রামায়ণ’।
না, বাল্মীকি রামায়ণের হুবহু অনুবাদ নয়। অন্যান্য পুরাণ, ভাগবৎ থেকে কাহিনী চয়ন করে তিনি রচনা করলেন ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’। অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। যেমন শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধন—বাল্মীকির কী গরজ দশভুজা দুর্গার মহিমা প্রচারে? অথচ বাংলার জলহাওয়ায় মানুষ ঐ ওঝা পণ্ডিত কি দুর্গাপূজাকে বাদ দিতে পারেন? হনুমান কর্তৃক রাবণের মৃত্যুবাণ-হরণও এক সংযোজন, যেমন মহীরাবণ বধ। সবচেয়ে সুন্দর সংযোজন লবকুশের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্রের যুদ্ধ ও পরাজয়। হয়তো এতে কবি কালিদাসের শকুন্তলা কাব্যের প্রভাব পড়েছে; কিন্তু কাব্য হিসাবে ঐখানটা যে কী পরিমাণে উৎরেছে তা তোমরা বুঝবে না, দিদিভাই! দাদু-দিদাদের জিজ্ঞেস কর—তাঁরা দেখেছেন শিশির ভাদুড়ীর ঐ অংশের অভিনয়। বুঝিয়ে বলে দেবেন তোমাদের।
স্মৃতিস্তম্ভটি প্রতিষ্ঠা করেন স্যার আশুতোষ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে।
রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা চতুষ্কোণ মঠ-প্রতীক, ঊর্ধ্বাংশ সমচতুষ্কোণ শঙ্কু আকারের। মর্মরফলকে উৎকীর্ণ করা আছে :
“মহাকবি কৃত্তিবাসের
আবির্ভাব—1440 খ্ৰীষ্টাব্দ, মাঘমাস, শ্রীপঞ্চমী, রবিবার
হেথা দ্বিজোত্তম
আদি কবি বাঙ্গলার ভাষা রামায়ণকার
কৃত্তিবাস লভিলা জনম,
সুরভিত সুকবিত্বে ফুলিয়ার পুণ্যতীর্থে
হে পথিক, সম্ভ্রমে প্রণম।
শ্রীযুক্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সরস্বতী কর্তৃক ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হইল। ২৭ শে চৈত্র, ১৩২২ বঙ্গাব্দ।”
সৌভাগ্য আমার–চাকরির প্রথম পর্যায়ে ফুলিয়াতে বদলী হয়েছিলাম। বারে বারে ঐ স্মৃতিস্তম্ভটির সামনে নতমস্তকে দাঁড়াবার সুযোগ পেয়েছি। পাশেই ‘কৃত্তিবাস কূপ’, অনতিদূরে ‘কৃত্তিবাস স্মৃতি বিদ্যালয়’। এসব তো মানুষের কীর্তি। প্রকৃতিও ঐ সঙ্গে যোগ করেছে তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ : একটি অতি বিশাল বটবৃক্ষ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে অভ্রংভেদী মহিমায় দণ্ডায়মান।
যেন প্রকৃতি-রোদ্যা কৃত্তিবাস-বালজাকের মূর্তি গড়েছেন!
কৃত্তিবাসের জন্মভিটার অনতিদূরে যবন হরিদাসের ‘গোফা’।
মহাপ্রভুর ভক্তদের মধ্যে ‘হরিদাস নামের কিছু বাড়াবাড়ি। বড় হরিদাস, ছোট হরিদাস, তার উপর আবার এই যবন হরিদাস। এঁর আদি নাম ব্রহ্ম ঠাকুর। হরির ভক্ত ছিলেন বলে নাম হয় ‘হরিদাস’। কেউ বলেন ইনি মুসলমান পিতার সন্তান, আবার কেউ বলেন, তা নয়—আসলে বাল্যকালে তিনি এক সহৃদয় মুসলমানের গৃহে পালিত হয়েছিলেন। এঁর অসাধারণ হরিভক্তির কথা শুনে কাজী ক্ষেপে যান। মুসলমান হয়ে এ কী ধাষ্টামো! দিবারাত্র শুধু—হরিবোল? হরিবোল?
গ্রেপ্তার হলেন যবন হরিদাস। মুসলমান ফৌজদার আর কাজী মিলে ফতোয়া জারী করলেন ওঁদের এলাকায় বাইশটি হাটে বন্দীকে ক্রমান্বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে; আর হাটে-বাজারে লোক যখন জমজমাট, তখন বন্দীকে বেত্রাঘাত করা হবে। যাতে ভবিষ্যতে কোনও মুসলমান এ জাতীয় ‘পাপ’ কাজ না করে।
যবন-হরিদাস প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ, ‘হরিদাস-গোফা’, ফুলিয়া
যবন হরিদাস বাইবেল পড়েছেন বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু প্রতিবার তিনি বাইবেল থেকে নির্ভুল উদ্ধৃতি শুনিয়ে গেলেন : প্রভু! এরা জানে না, এরা কী অন্যায় করছে। তুমি ওদের ক্ষমা কর। হরিবোল! হরিবোল!
অবশ্য তথ্যটা আমরা পাই ছন্দবদ্ধ পদে :
“এ সব জীবেরে প্রভু করহ প্রসাদ।
মোরে দ্রোহে নহু এ সবার অপরাধ।।”
বাইশ-বাজারে যবন হরিদাসকে দণ্ডভোগ করতে হয়নি, এটাই রক্ষে। দু-চার হাট পার করেই কোতোয়াল এসে জানিয়ে গেল শাস্তিদানের কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে? কাজী আর সুবেদারকে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বলছে ‘জোড়া-পাষণ্ড’; আর হরিদাস হয়ে উঠছেন সবার প্রণম্য! শহীদ! অবতার!
বন্ধ হল অত্যাচার। বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হল। ফিরে এলেন নিজের গোফায়। প্রতিষ্ঠা করলেন ছোট এক সারি বিগ্রহ—বলরাম, রেবতী, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকা। অপূর্ব!