7 of 11

৩৯.০২ নিষ্কামকর্ম ও শ্রীরামকৃষ্ণ — ফল সমর্পণ ও ভক্তি

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

নিষ্কামকর্ম ও শ্রীরামকৃষ্ণ — ফল সমর্পণ ও ভক্তি

মাস্টার — অধ্যয়ণ শেষ হলে আর অনেকদিন সাধনের পর ভবানী ঠাকুর প্রফুল্লের সঙ্গে আবার দেখা করতে এলেন। এইবার নিষ্কামকর্মের উপদেশ দিবেন। গীতা থেকে শ্লোক বললেন —

তস্মাদসক্তং সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্‌ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।[1]

অনাসক্তির তিনটি লক্ষণ বললেন —

(১) ইন্দ্রিয়সংযম। (২) নিরহংকার। (৩) শ্রীকৃষ্ণে ফল সমর্পণ। নিরহংকার ব্যতীত ধর্মাচরণ হয় না। গীতা থেকে আবার বললেন —

প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।।[2]

তারপর সর্বকর্মফল শ্রীকৃষ্ণে সমর্পণ। গীতা থেকে বললেন, —

যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যৎ তপ্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্‌।।[3]

নিষ্কামকর্মের এই তিনটি লক্ষণ বলেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এ বেশ। গীতার কথা। কাটবার জো নাই। তবে আর-একটি কথা আছে। শ্রীকৃষ্ণে ফল সমর্পণ বলেছে; শ্রীকৃষ্ণে ভক্তি বলে নাই।

মাস্টার — এখানে এ-কথাটি বিশেষ করে বলা নাই।

[হিসাব বুদ্ধিতে হয় না — একেবারে ঝাঁপ ]

“তারপর ধনের কি ব্যবহার করতে হবে, এই কথা হল। প্রফুল্ল বললে, এ-সমস্ত ধন শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ কল্লাম।

“প্রফুল্ল — যখন আমার সকল কর্ম শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিলাম, তখন আমার এ-ধনও শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করিলাম।

ভবানী — সব?

প্রফুল্ল — সব।

ভবানী — ঠিক তাহা হইলে কর্ম অনাসক্ত হইবে না। আপনার আহারের জন্য যদি তোমাকে চেষ্টা হইতে হয়, তাহা হইলে আসক্তি জন্মিবে। অতএব তোমাকে হয় ভিক্ষাবৃত্ত হইতে হইবে, নয় এই ধন হইতেই দেহরক্ষা করিতে হইবে। ভিক্ষাতেও আসক্তি আছে। অতএব সেই ধন হইতে আপনার দেহরক্ষা করিবে।”

মাস্টার (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি সহাস্যে) — ওইটুকু পাটোয়ারী।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, ওইটুকু পাটোয়ারী, ওইটুকু হিসাববুদ্ধি। যে ভগবানকে চায়, সে একেবারে ঝাঁপ দেয়। দেহরক্ষার জন্য এইটুকু থাকলো — এ-সব হিসাব আসে না।

মাস্টার — তারপর আছে, ভবানী জিজ্ঞাসা কল্লে, ধন নিয়ে শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ কেমন করে করবে? প্রফুল্ল বললে, শ্রীকৃষ্ণ সর্বভূতে আছেন। অতএব সর্বভূতে ধন বিতরণ করব। ভবানী বললে, ভাল ভাল। আর গীতা থেকে শ্লোক বলতে লাগল, —

যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি।
তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি।।
সর্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ।
সর্বথা বর্তমানোঽপি স যোগী ময়ি বর্ততে।।
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোঽর্জুনঃ।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।।[4]

শ্রীরামকৃষ্ণ — এগুলি উত্তম ভক্তের লক্ষণ।

[বিষয়ী লোক ও তাহাদের ভাষা — আকরে টানে ]

মাস্টার পড়িতে লাগিলেন।

“সর্বভূতে দানের জন্য অনেক শ্রমের প্রয়োজন। কিছু বেশবিন্যাস কিছু ভোগবিলাসের ঠাটের প্রয়োজন। ভবানী তাই বললেন, কখন কখন কিছু ‘দোকানদারী’ চাই।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিরক্তভাবে) — “দোকানদারী চাই”। যেমন আকর তেমনি কথাও বেরোয়! রাতদিন বিষয়চিন্তা, লোকের সঙ্গে কপটতা এ-সব করে করে কথাগুলো এইরকম হয়ে যায়। মূলো খেলে মূলোর ঢেঁকুর বেরোয়। দোকানদারী কথাটা না বলে ওইটে ভাল করে বললেই হত, “আপনাকে অকর্তা জেনে কর্তার ন্যায় কাজ করা”। সেদিন একজন গান গাচ্ছিল। সে গানের ভিতরে ‘লাভ’ ‘লোকসান’ এই সব কথাগোলো অনেক ছিল। গান হচ্ছিল, আমি বারণ কল্লুম। যা ভাবে রাতদিন, সেই বুলিই উঠে!

————————–
১ অতএব অনাসক্ত হইয়া সর্বদা কর্ম কর। কারণ অনাসক্ত হইয়া কার্য করিলে পুরুষ সেই শ্রেষ্ঠ ভগবৎ পদ লাভ করেন। [গীতা, ৩।১৯]
২ সমুদয় কর্মই প্রকৃতির গুণসমূহের দ্বারা কৃত হইতেছে। কিন্তু অহংকার-বিমুগ্ধ ব্যক্তি আপনাকে কর্তা বলিয়া মনে করে। [গীতা, ৩।২৭]
৩ যাহা কিছু কর, যাহা খাও, যে হোম কর, যাহা দান কর, যে তপস্যা কর, তাহাই আমাতে সমর্পণ কর। [গীতা ৯।২৭]
৪ যে ব্যক্তি সর্বত্র আমাকে দেখিয়া থাকে এবং সকল বস্তুকে আমাতে দেখিয়া থাকে, তাহার নিকট আমি কখন অদৃষ্ট থাকি না, সে কখনও আমার দৃষ্টির দূরে থাকে না। যে ব্যক্তি জীব ও ব্রহ্মে অভেদদর্শী হইয়া আর্বভূতস্থিত আমাকে ভজনা করে, যে কোন অবস্থাতেই থাকুক না, সেও যোগী আমাতেই অবস্থান করে। হে অর্জুন, সুখই হউক, দুঃখই হউক, যিনি নিজের তুলনায় সকলের প্রতিই সমদর্শন করেন, সেই যোগীই আমার মতে সর্বশ্রেষ্ঠ। [গীতা, ৬।৩০, ৩১, ৩২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *