1 of 2

৩৯. দূর থেকে আসছে একটা মিছিল

দূর থেকে আসছে একটা মিছিল। ঠিক মিছিল নয়, বিশৃঙ্খল জনতা। নদীতে যেমন যাঁড়াষাঁড়ির বান আসে, তেমনি মাঠের ওপর দিয়ে ছুটে আসছে একটা উত্তাল ঢেউ। হ্যাঁ, ছুটেই আসছে মনে হয়, প্রিয়জনের দুঃসংবাদ শুনে মানুষ যে রকম ভাবে ছুটে আসে। এই জনতার কোনও কর্ণধার নেই, যেন মনে হয় চতুর্দিকের মাঠ ঘাট জঙ্গল নদী নালা পেরিয়ে মানুষ ছুটে আসছে এই দিকে, এই মন্তেশ্বর থানার দিকে। গতকাল এই থানার সামনে গুলি চলেছিল, মারা গেছে দু’জন মানুষ, আহত সাতজন, বন্দির সংখ্যা একশো তিন।

জনতা ছুটে আসছে। এর মধ্যে আছে শিশু, বৃদ্ধ ও নারী, ছেঁড়া, ময়লা পোশাক, অনেকেরই শরীরের অর্ধেকের বেশি নগ্ন, অনেকেই রোগা, হাড়-জিরজিরে চেহারা, ম্যালেরিয়া, অনাহার ও বৃটিশ শাসন যাদের ছিবড়ে করে ফেলেছে–আজ তারা ছুটে আসছে ভূতগ্রস্তের মতো। দুর্বল গলায় তারা চাচাচ্ছে, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে! বৃটিশ রাজ ভারত ছাড়ো! সমস্ত বন্দিদের মুক্তি চাই! চাই, চাই, চাই-ই-প্রতিধ্বনির মতন শোনায়।

বেলা এগারোটা। এই সময় এইসব মানুষের মধ্যে অনেকেরই খেত-খামারে থাকার কথা, কেউ ইস্কুলে, কেউ ডাক্তারখানায়, রান্নাঘরে, হাটে-বাজারে। আজ সে-সব কাজ ফেলে মানুষ এ-দিকে ছুটে আসছে চিৎকার করতে করতে। মাথার ওপরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর, অনাবৃষ্টিতে ফেটে ফেটে গেছে মাটি, গাছগুলোর পাতা বিবর্ণ।

একটা বড় অশত্থাগাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে সূর্য আর যোগানন্দ। যোগানন্দ একটা বিড়িতে ঘন ঘন টান দিচ্ছে আর পিচ পিচ শব্দ করে থুতু ফেলছে মাটিতে। সূর্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অগ্রসরমান জনতার দিকে। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার একটু দূরেই রেল লাইন–দু-তিন দিন ধরে ট্রেন বন্ধ।

যোগানন্দ তিক্ত গলায় বলল, এত লোক–এদের হাতে যদি একটা করে যে-কোনও অস্ত্র থাকত তা হলে ওই ক’টা পুলিশ রুখতে পারত ওদের? গান্ধীজী শেষ পর্যন্ত কুইট ইন্ডিয়া স্লোগান দিলেন আর এটা বুঝলেন না, মেরে না তাড়ালে ইংরেজ যাবে না। লোকজন যে রকম ক্ষেপে উঠেছে, কিছু অস্ত্র থাকলে অনায়াসে এক একটা অঞ্চল স্বাধীন করে ফেলা যেত।

সূর্য বলল, কালকে ইস্তাহারে পড়লাম বিহার ইউ পির কয়েকটা জায়গা স্বাধীন হয়ে গেছে –বৃটিশ শাসনের কোনও চিহ্ন নেই।

কিন্তু কদিনের জন্য?

চিরদিনের জন্য। যুদ্ধে হারতে বসেছে ইংরেজ, আর এ-দেশে ফিরতে পারবে না।

ব্রজগোপালদা, শংকরদাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হল না?

কে কোথায় আছে, কোনও ঠিক নেই।

দাদারা প্রায় সবাই গিয়ে এখন কংগ্রেসে ভিড়েছে। এ বছরই স্বাধীনতা এলে নাম হবে শুধু কংগ্রেসের। আমরা কেউ না। এক সুভাষবাবু যদি সৈন্য নিয়ে ঢুকে পড়তে পারেন, তা হলে উনি অন্তত আমাদের চিনবেন।

সুভাষবাবু আসছেন ঠিকই।

কিছুই তো বুঝতে পারছি না। একসঙ্গে আরম্ভ হবার কথা ছিল না? ওদিক থেকে সুভাষবাবু আসবেন, আর এদিক থেকে দেশের মধ্যে সব কিছু অচল করে দিয়ে–।

যাকগে, যা থাকে কপালে, আজ আমি মরব।

সূর্য থানার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমিও মরব, কিন্তু মেরে মরব। যোগানন্দ বলল, মরে যাওয়াই ভালো। এরপর নিজেদের মধ্যে কত রকম দলাদলি, কাটাকাটি দেখতে হবে কে জানে। আমি জীবনে একবার শুধু ভুল করেছি, কিন্তু বড় বড় নেতারা আরও অনেক বড় ভুল করেছেন।

সূর্য আর যোগানন্দ এখন দুদিকে ফিরে আছে। সূর্য নজর রেখেছে থানার দিকে। লাল রঙের থানার সামনে খানিকটা ফুলবাগান, গেটের দু পাশে কতকগুলো সাদা রং করা টব উলটে বসানো। গেটের বাইরে একটা জিপ, তার সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে আট জন পুলিশ। থানাটা ছোট, কিন্তু গতকাল একটা বড় রকমের কাণ্ড করে ফেলেছে।

জনতার ঢেউ এর মধ্যে এগিয়ে এসেছে অনেক কাছে। চিৎকার ও শোরগোল এখন স্পষ্ট–উত্তেজিত ও আর্ত চিৎকার, কোনও শব্দ বোঝা যায় না। অনেকেরই হাতে তেরঙ্গা ঝান্ডা। যোগানন্দ বলল, অমর, দ্যাখ দ্যাখ একজন বুড়িও পতাকা হাতে নিয়ে এসেছে মিছিলে।

সূর্যর গায়ে গেঞ্জি নেই। জামার মধ্যে দিয়ে হাত গলিয়ে সে তার নিজের বুকে হাত বুলোতে লাগল। শরীরটা শিরশির করছে। একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে–এই কটা বছর সে এরই প্রতীক্ষায় ছিল। হরকুমারের কাছে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, দেশের স্বাধীনতা আসার আগে সে অস্ত্র ছাড়বে না। তার আগে মরতে হয় তো মরবে। আজ কি সেই মৃত্যুদিন?

সূর্য বলল, এবার চলুন। আমরা খানিকটা পেছন দিকে থাকব!

সেই মানুষের জোয়ার অশ্বত্থাগাছটা পেরিয়ে যাবার পর সূর্যা আর যোগানন্দ পেছন দিক থেকে ওদের সঙ্গে মিশে গিয়ে খুব শান্তভাবে হাঁটতে লাগল। ওদের চোখে মুখে কোনও উত্তেজনা নেই, যেন ওরা আগে থেকেই জানে, এরপর কী ঘটবে।

থানার একটু দূরে পুলিশবাহিনী ওদের আটকাল। কিন্তু তরঙ্গে যেমন লাঠি দিয়ে আটকানো যায় না, সেই রকম একদল লোক ঠেলে ঢুকে যেতে চাইছে ভেতরে। ওদের ভয় ভেঙে গেছে। ওদের কারওর ভাই বা বাবা কাকা গতকালের ঘটনায় নিহত বা আহত বা বন্দি। কোনও পূর্বনির্দিষ্ট স্লোগান নেই, হাজার হাজার গলার চিৎকারে কারওর কথাই বোঝা যায় না। শুধু দেখা গেল, একজন লম্বা চেহারার প্রৌঢ় হাত তুলে পাগলের মতন ভাঙা গলায় চিৎকার করছে, বন্ধুগণ, বন্ধুগণ, বন্ধুগণ, আপনারা শুনুন

কেউ শুনছে না। সূর্য চিনতে পারল সেই প্রৌঢ়টিকে, তমোনাশ ডাক্তার। সূর্য আর যোগানন্দ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পেছনে। যেন তারা দর্শক মাত্র।

পুলিশরা লাঠিগুলো আড়াআড়ি করে নিয়ে ভিড় ঠেলছে। কারোকে আহত করার চেষ্টা করছে না। জনতার চেঁচামেচি ক্রমশ বাড়ছে। এই সময় থানার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো তিন জন অফিসার, তার মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ। ইনি জেলার এস. পি. কালকের ঘটনার পর দুর্গ রক্ষা করতে এসেছেন। এস. পি. সাহেব দারোগার কানে কানে কী যেন নির্দেশ দিলেন। দারোগাটি ভেতর থেকে একটা চোঙা নিয়ে এসে সেটা মুখে লাগিয়ে বলতে লাগলেন, আপনারা শুনুন, আপনারা শুনুন, থানার সামনে জমায়েত হওয়া বেআইনি।

এক প্রবল হইহইতে ঢেকে গেল দারোগার কথা। পুলিশরা এবার লাঠি উঁচাল মাথার ওপর। দারোগা আবার বললেন, আপনারা শুনুন, মাননীয় এস. পি. সাহেব এখানে উপস্থিত আছেন–আপনাদের যদি কোনও বক্তব্য থাকে–তা আপনাদের মধ্যে থেকে দু’জন প্রতিনিধি শুধু এসে আপনাদের কথা ওনাকে জানাতে পারেন। উনি সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছেন! আপনারা–

আবার প্রচণ্ড শোরগোল। মিনিট দুয়েক চিৎকার চ্যাঁচামেচিই চলল। এরই মধ্যে তমোনাশ ডাক্তার সেই জিপ গাড়িটার পাদানিতে উঠে পড়ে মৃগী রোগীর মতন হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করেছেন। হাওয়ায় উড়ছে তাঁর সাদা চুল, ঘর্মাক্ত মুখে রোদ পড়ে চকচকে, চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। বন্ধুগণ, বন্ধুগণ বলে অবিশ্রান্ত আওয়াজ করে যাচ্ছিলেন। জনতার শোরগোলের এক মুহূর্ত বিরতি পেতেই তিনি বলে উঠলেন, বন্ধুগণ, আবেদন নিবেদনের দিন শেষ হয়ে গেছে। আমরা কোনও আবেদন করতে চাই না। আমরা সমস্ত বন্দিদের মুক্তি চাই। আজই, এই মুহূর্তে। ইংরেজ সরকার যদি বন্দিদের মুক্তি না দেয়–আমরা এখানে আমরণ অনশন করব। আমরা শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহী। আমরা এদের দেখিয়ে দিতে চাই, বন্ধুগণ, আমরা এদের দেখিয়ে দিতে চাই যে ন্যায়ের শক্তি লাঠি-গুলির চেয়ে কত বেশি। একবার বলো ভাই, বন্দে মাতরম্।

জনতা গর্জন করে উঠল, বন্দে মাতরম্।

বলল ভাই ইংরেজ সরকার, ভারত ছাড়ো!

ভারত ছা-ড়ো!

তমোনাশ ডাক্তার জনতাকে খানিকটা সঙঘবদ্ধ করে ফেলতে পেরেছেন। তাঁর কণ্ঠস্বরের তীব্র আন্তরিকতা সকলকে স্পর্শ করে। তিনি আরও স্লোগান দিতে লাগলেন–জনতা ঠিক ঠিক সাড়া দিল। দু’জন সেপাই এসে হাত ধরে তাঁকে নামিয়ে দিতে এল জিপগাড়ি থেকে তমোনাশ ডাক্তার আবার উদবেল জনতার উদ্দেশে বললেন, ভাইসব, মনে রাখতে হবে, আমরা সত্যাগ্রহী, আমরা হিংসার আশ্রয় নেব না। মহাত্মাজি বলেছেন–

সূর্য আর যোগানন্দ এবার চোখাচোখি করল। তারপর ভিড় ছেড়ে আলাদা বেরিয়ে এসে মাঠ থেকে দুটো বড় বড় ইটের টুকরো তুলে নিয়ে অত্যন্ত সাবলীল ভাবে দৌড়ে গিয়ে সে-দুটো ছুঁড়ে মারল থানার দরজার সামনে দণ্ডায়মান অফিসারদের দিকে। অব্যর্থ লক্ষ্য, একটা ইট লেগেছে স্বয়ং এস. পি. সাহেবের কপালে। তিনি মাথায় হাত চেপে বসে পড়লেন। যোগানন্দ হিংস্র ভাবে চেঁচিয়ে উঠল, মার, মার, মার শালাদের!

এর পরই শুরু হয়ে গেল এক অভূতপূর্ব বিশৃঙ্খলা। দু-এক মুহূর্ত বিমূঢ় থাকার পর পুলিশ শুরু করে দিল লাঠি চালানো। জনতার মধ্যে বেশির ভাগ লোকই পেছন ফিরে দৌড় দিল–সূর্য আর যোগানন্দ তখন মেশিনের মতন ইট ছুড়ছে। তাদের দেখাদেখি। যোগ দিয়েছে আরও কয়েকজন যুবক। তমোনাশ ডাক্তার তখনও হাত তুলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বন্ধুগণ, বন্ধুগণ–। তাঁর মাথায় এক ঘা লাঠি না-পড়া পর্যন্ত তিনি থামলেন না।

ছত্রভঙ্গ জনতার মধ্যে অনেকেই কিছুদূর পালিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল, এবার কেউ কেউ বাঁশ বা গাছের ডাল ভেঙে এনেছে, ইটপাটকেল ছোঁড়ার দলে সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে। থানা থেকে বেরিয়ে এসেছে আর একদল পুলিশ। সূর্য আর যোগানন্দ ইট ছোঁড়া বন্ধ করে হাতের ধুলো ঝেড়ে পরস্পর আর একবার চোখাচোখি করে এগিয়ে গেল আরও সামনের দিকে।

দু’-এক মিনিটের মধ্যে সূর্যকে দেখা গেল থানার ছাদে–তার হাতে একটা তেরঙা ঝান্ডা। কী করে সে এত তাড়াতাড়ি ওখানে পৌঁছোল, বোঝাই যায় না। আসলে সবকিছুই ভয়ের সীমারেখা দিয়ে বাঁধা–সূর্য সেই সীমারেখাটা অবলীলাক্রমে পার হয়ে গেছে। সুতরাং তার তো আর কোনও অসুবিধে নেই। সূর্য ইউনিয়ন জ্যাকটা টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে সেখানে লটকে দিল তার হাতের পতাকা। সমস্ত জনতা এক মুহূর্ত নিশ্বাস বন্ধ করে সূর্যকে দেখল। সূর্য গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ইনকিলাব, জিন্দাবাদ। জনতার উদ্দেশে হাতের ইঙ্গিত করে আবার বলল, ইনকিলাব–।

সে-দিনের প্রথম গুলি চালানো হল সূর্যর দিকে। কোনও নির্দেশ না পেয়েই একজন সেপাই গুলি চালিয়েছে–আওয়াজ হবার সঙ্গে সঙ্গে সূর্য ছাদের পাঁচিলের ওপাশে পড়ে গেছে তাকে আর দেখা গেল না!

ইতিমধ্যে যোগানন্দ জিপগাড়িটার পেট্রল ট্যাঙ্ক খুলে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। যোগানন্দ নিজের গায়ের জামাটা খুলে সেই আগুনে ছুঁইয়ে মশালের মতো হাতে নিয়ে ছুটে গেল। একজন সেপাইয়ের লাঠির বাড়ি তার ঘাড়ে লাগতেই বাঘের মতন ঘুরে দাঁড়াল যোগানন্দ, তার বিশাল থাবা দিয়ে সেপাইটির মুখখানা চেপে ধরল।

যে-কোনও কারণেই তোক পুলিশ সেদিন দু’ রাউন্ডের বেশি গুলি চালায়নি। আগের দিন বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ার ফলে বোধহয় এই রকমই নির্দেশ ছিল। জনতার একটা বেশ বড় অংশ বেপরোয়া মরিয়া হয়ে লড়ল পুলিশের সঙ্গে, লাঠিধারী পুলিশরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার পর বন্দুকধারী পুলিশরা বেরিয়ে এসে আর কোনও সুযোগ পেল না–তখন জনতা ঢুকে পড়েছে থানার কম্পাউন্ডে–তাদের পায়ের চাপে ফুলবাগান লন্ডভন্ড। এস পি সাহেব রক্তাক্ত মুখে টলতে টলতে বেরিয়ে এসে উন্মাদের মতন চ্যাঁচাতে লাগলেন, ফায়ার ফায়ার! তাঁর নিজের হাতেও রিভলবার। এইসময় সূর্যকে আবার দেখা গেল থানার ছাদে, তার হাতে খোলা রিভলবার–সে লক্ষ্য ঠিক রেখে অত্যন্ত হিসেব করে গুলি চালাতে লাগল।

গুলিবিদ্ধ এস. পি. সাহেবের মুখে এত অসংখ্য পদাঘাত পড়ল যে মানুষটিকে আর কোনও দিন চেনা যাবে না। কয়েক জন সিপাহি সমেত দারোগাবাবু আত্মসমর্পণ করলেন, তিনজন সিপাহি এবং একজন এস আই মুমূর্ষ। জনতার মধ্যে যোলোসতেরো জনের অবস্থা সংকটজনক। তাদের মধ্যে একজন তমোনাশ ডাক্তার। ডাক্তারকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেবারও কেউ নেই।

কপাল ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে, খালি গা, যোগানন্দ বিজয়ীর মতন দাঁড়াল থানার সিঁড়িতে। তার এক হাতে একজন সিপাহির রাইফেল। জ্বলন্ত চোখে বলল, ভাইসব, কুত্তার বাচ্চারা হেরে গেছে। ঠিকমতো মুগুর দিয়ে পেটাতে পারলে সব কটা কুত্তাই মরবে কিংবা পালাবে। আমরা কারোকে ছাড়ব না। আজ থেকে আমরা এই অঞ্চলের লোক সবাই স্বাধীন। ইনকিলাব–

সমুদ্র গর্জন শোনা গেল, জিন্দাবাদ!

যোগানন্দ আবার বলল, ভাইসব, শুধু স্বাধীন হলেই হবে না, এই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। আপনারা জানেন কি না জানি না, সারা ভারত জুড়েই ইংরেজকে পেটানো শুরু হয়েছে অনেক জেলা স্বাধীন হয়ে গেছে। এই বেয়াল্লিশ সালেই ভারতে সব ইংরেজের কবর খোঁড়া হয়ে যাবে। তবে একথাও ঠিক, ভাইসব, শুনুন আমার কথা, আমরা এক্ষুনি সব বন্দিদের মুক্তি দেব–কিন্তু তার আগে, এক মিনিট ধৈর্য ধরে শুনুন, এই কুত্তার বাচ্চাদের শক্তি কম করে দেখলে চলবে না। যে-কোনও মুহূর্তে সৈন্যবাহিনী এসে পড়তে পারে। সেজন্য আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে। রেলে করে যাতে সৈন্যরা না আসতে পারে, সেইজন্য উপড়ে ফেলতে হবে রেললাইন, স্টেশনগুলি পুড়িয়ে দিতে হবে। টেলিগ্রাফে যাতে কোনও খবর না যায়, তাই ধ্বংস করে দিতে হবে সব পোস্ট অফিস। দেরি করার সময় নেই। এক্ষুনি আমাদের দুটো দল যাবে স্টেশন আর পোস্ট অফিসের দিকে। ভয় পেলে চলবে না। স্বাধীনতার জন্য যদি প্রাণও যায়–বলুন একবার, বন্দে মাতরম্–।

সূর্য থানার ভিতর ঢুকে পড়েছে–তার হাতে মস্ত একটা চাবির গোছা। এত কাণ্ডের পরও সে আশ্চর্য রকম অক্ষত রয়েছে–শুধু তার জামাটা ছিঁড়ে গেছে ফালাফালা হয়ে। হাজতঘরে তালা খুলে সে মুক্তি দিচ্ছে বন্দিদের–এত চিৎকার, আনন্দ, কান্নাকাটি– এর মধ্যেও তার মুখ নির্বিকার। একটুও রেখা বদলায়নি তার মুখের, কোনও উত্তেজনার চিহ্নমাত্র নেই।

সে যখন বেরিয়ে এল থানার বাইরে–তখনও যোগানন্দ বক্তৃতা দিয়ে চলেছে। সূর্যকে দেখে যোগানন্দ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জনতাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল, আপনারা দেখুন এই বীর যোদ্ধাকে–আজকের লড়াইয়ে ইনি–

সূর্য তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে রূঢ় গলায় বলল, এখন চলুন!

একটু বাদেই সূর্য আর যোগানন্দের নেতৃত্বে দুটো দল আলাদা ভাবে চলে গেল পোস্ট অফিস আর স্টেশনের দিকে। পোস্ট অফিসে কোনও বাধাই পাওয়া গেল না–ক্রুদ্ধ জনতা সেখানে অগ্নৎসবে মেতে উঠল। রেল স্টেশনে দু’জন সেপাই ছিল পাহারায় মাত্র আধ ঘণ্টা খণ্ডযুদ্ধেই তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল রেল স্টেশনে–কিছু লোক লুটপাটের সুযোগও ছাড়ল না। সূর্যর তখনও অনেক কাজ বাকি কিন্তু জনতা অগ্নিকাণ্ডের সম্পূর্ণ দৃশ্যটা উপভোগ না করে তার সঙ্গে যাবে না। সূর্য তখন স্টেশনের কুলি কামিন ও বন্দি সেপাইদের বাধ্য করল রেললাইন খুঁড়ে তুলে ফেলতে। কিছুদূর অন্তর অন্তর রেললাইন অচল করে দেওয়া হল। মেদিনীপুরের একটি মহকুমা সত্যিই স্বাধীন হয়ে গেল সে-দিন–সে-তল্লাটে কোথাও আর বৃটিশ শাসনের চিহ্ন রইল না। সেদিন রাস্তায় রাস্তায় শুধু চিৎকার আর উল্লাস। যে-কোনও বাড়িতেই লোকেরা হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ে খাবার চাইছে। বাড়ির লোকেরাও সানন্দে এনে দিচ্ছে। তাদের যা-কিছু আছে। সূর্যকে কোন বাড়িতে খাওয়ানো হবে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে। গেল লোকের মধ্যে। খবর পাওয়া গেল যোগানন্দ তার দলবল নিয়ে পাশের গ্রামে চলে গেছে আঞ্চলিক কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য।

একটি বাড়ির উঠোনে খেতে বসেছে সূর্য, তাকে ঘিরে রয়েছে একদল মানুষ। অসংখ্য প্রশ্ন, অজস্র উচ্ছ্বাস। সূর্য কারওর কথার উত্তর দিচ্ছে না। মধ্যে মধ্যে খাওয়া থামিয়ে সে চুপ করে বসে থাকছে, তার দু চোখে জলের পাতলা পরদা। আজ সে একজন মানুষ। খুন করেছে, বিদেশি শত্রু-কিন্তু আনন্দের বদলে তার বুক কাঁপছে। এতক্ষণ চেতনা ছিল না–এখন বার বার চোখে ভাসছে ছবিটা। সূর্য একদিন দেবী সরস্বতাঁকে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নের মধ্যে ম্লান ছিল সরস্বতীর মুখ। তার বুক থরথর করে কেঁপেছিল সেই সময়। আজও এই হত্যা ও রক্তের দৃশ্যে তার বুক সেই রকম কেঁপেছে। জীবনে এই শুধু দু’বার।

অনেকেই সূর্যকে বার বার ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। সেসব দিকে মন না দিয়ে সূর্য ওদের বলতে গেল যে রাত্তিরবেলা পাহারা দেবার জন্য একটা দল তৈরি করতে হবে। যে-পাঁচটি রাইফেল পাওয়া গেছে–সেগুলি কার কার হাতে থাকবে–এখন থেকেই ঠিক করা দরকার। গ্রামে আর কারওর কাছে যদি অস্ত্র থাকে–সেগুলোও জড়ো করতে হবে।

কিন্তু এত কথা বলতে পারল না সূর্য। খেতে খেতে হঠাৎ উঠে গিয়ে উঠোনের এক কোণে সে বমি করতে বসল। গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে তার গলা দিয়ে। কোনও এক সময় একটা প্রচণ্ড লাঠির ঘা লেগেছিল তার বুকে–বাইরে থেকে কোনও আঘাত বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে কিছু গণ্ডগোল হয়ে গেছে। থু থু করে মাটিতে রক্ত ছিটিয়ে মুখ ফিরিয়ে সূর্য অন্যদের উদ্দেশ্য করে বলল, বিশেষ কিছু হয়নি। এটা আমার পুরনো অসুখ।

.

এগারো পেরিয়ে বারোতে পা দেবার পর বাদলের পইতে হয়ে গেল। উপনয়নের পরই সে প্রকৃত ব্রাহ্মণ হল। অর্থাৎ তার দ্বিতীয় জন্ম। ভারতের একটি সুপ্রাচীন, আদর্শবান, বুদ্ধিজীবী, সুচতুর ও স্বার্থপর সম্প্রদায়ের অঙ্গীভূত করার চেষ্টা হল তাকে।

পইতের অনুষ্ঠান বড় কষ্টকর। এ রকম কষ্ট নাকি সহ্য করতেই হয় সবাই তাকে শোনাল, ব্রাহ্মণ হবার জন্য বিশ্বামিত্রকে আরও কতগুণ বেশি কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল। বেল কাঠের ধোঁয়া চোখে লাগিয়ে প্রায় সারা বেলা ধরে যজ্ঞ করতে হল তাকে, গরম সুচ বিধিয়ে তার দু’কান ফুটো করে সুতো বেঁধে দেওয়া হল, মাথা তো ন্যাড়া হলই। কাঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হল গেরুয়া রঙের একটা ঝোলা, সেটা নিয়ে গুরুজনদের কাছে ভিক্ষা চাইতে হবে। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তাকে তিন দিন বন্ধ করে রাখা হল একটা অন্ধকার ঘরে–পাছে সে কোনও অব্রাহ্মণের মুখ দেখে ফেলে।

এর পরেও পুরো এক বছর নাকি সে বাড়ির বাইরে আত্মীয়-কুটুম্বের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও খাদ্যদ্রব্য মুখে দিতে পারবে না। বাড়িতে খাওয়ার সময়েও হঠাৎ একটা কথা বলে ফেললেই তাকে পাত্র ত্যাগ করে উঠে যেতে হবে। গায়ত্রী মন্ত্র মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে হল–প্রতিদিন দু’বেলা সন্ধ্যা আহ্নিক বাধ্যতামূলক।

কলকাতায় বড়বাবুর আওতায় থেকে ওদের এসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। বড়বাবু নাস্তিক, তিনি এসবের ধার ধারতেন না। কিন্তু বাদলের দাদামশাই গোঁড়া পণ্ডিত, সনাতন ধর্মের সবকিছুই তাঁর চোখে পবিত্র। তিনি প্রতিদিন ভোরবেলা তাকে ডেকে তুলে আহ্নিক করতে বসাতে লাগলেন এবং দুপুরে রাত্তিরে খেতে বসে তীক্ষ্ণ নজর রাখলেন বাদল খাওয়া শুরু করার আগে থালার পাশে পাঁচটি ভাত ঠাকুরকে উৎসর্গ করেছে কি না। শুধু তাই নয়, ভাতের থালা দেবার আগে নিজের হাতে মাটিতে জল ছিটিয়ে আঙুলের গাঁট দিয়ে ওঁ লিখতে হবে খাওয়া শেষ করার পর থালায় জল ঢেলে সেই জল এক আঙুলে তুলে জিভে ঠেকিয়ে মন্ত্র পড়তে হবে। এবং যে-আসনে সে বসেছিল–সেটা একটুখানি সরিয়ে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। যদি কোনও বেড়াল দৈবাৎ সেই আসন ডিঙিয়ে ফৈলে তা হলেই তার মহা পাপ।

দু-চার দিনের মধ্যেই বাদল পাকা বামুন ঠাকুরটি হয়ে উঠল। সব নিময়কানুন শিখে এমন বাড়াবাড়ি করতে লাগল যে বাড়ির সবাই অবাক। বাদলই তখন অন্যদের ভুল ধরে। দাদামশাই খুব খুশি। খুব মজার চেহারা হয়েছে বাদলের। হঠাৎ লম্বা হতে শুরু করায় হাফ প্যান্টের নীচে পাদুটো ধ্যাড়েঙ্গা দেখায়। কানের ফুটো দুটো একটু একটু পেকে সুতো আটকে গেছে–আর খোলা যায় না–কেউ খোলার চেষ্টা করলেই সে। বাবারে মারে চিৎকার করে। ফলে, তার দু’ কানে দুটো সুতোর টুকরো, গলায় মোটা পইতে। ন্যাড়া মাথায় খড়খড়ে চুল উঠেছে–বড়রা সুযোগ পেলেই মাথায় একবার করে হাত বুলিয়ে নেয়। ছোটরা বা সমবয়েসিরা চাঁটি মেরে দৌড়ে পালায় কেউ কেউ একটা ছড়াও বলে, ‘নাইড়া মাথা কইড়া থাল, টাক দিলে যায় বরিশাল’।

এই সময় বাদলের কিছু বিষয় সম্পত্তি হল। উপনয়ন অনুষ্ঠানে এইটুকুই আনন্দের দিক। মুষ্টিভিক্ষার সময় গুরুজনেরা চাল দেবার সঙ্গে সঙ্গে রুপোর টাকা দিয়েও ঝুলি ভরিয়েছেন। এ ছাড়া সে পেয়েছে একটা পেন, মাউথ অর্গান, সুটকেস, জ্যামিতির বাক্স, ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেট এবং অনেকগুলি বই। পেনকে তখন বলা হত ফাউন্টেন পেন, কারওর কারওর মুখে শোনা যেত ঝরনা কলম বাদল সেই প্রথম একটি ফাউন্টেন। পেনের মালিক হল। কলমটির নাম ওয়াটারম্যান প্যাঁচ ঘোরালে নিবটি ভেতরে ঢুকে যায়–একটি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। বাদল অবশ্য সেটি ব্যবহার করার অধিকার পেল না– কেন না ফাউন্টেন পেন দিয়ে লিখলে হাতের লেখা খারাপ হয়ে যায়–গুরুজনরা এই নির্দেশ দিলেন। টাকা পেয়েছে সে একশো বত্রিশটি–সেগুলি তার মা নিজের কাছে রেখে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাদল তাতে কিছুতেই রাজি নয়। তার যাবতীয় সম্পত্তি সে নিজের সুটকেসটিতে ভরে খাটের নীচে রেখে দেয় দিনের মধ্যে সাত-আট বার সেটি খুলে খুলে দেখে; মহাজনের মতন রূপোর টাকাগুলো ঠং ঠং করে গোণে।

নতুন বামুন হবার ফলে বাদলকে প্রায়ই নানা বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে হয়। প্রায়ই লোকের বাড়িতে তিন জন ব্রাহ্মণ বা এগারো জন ব্রাহ্মণকে ভোজন করাবার অনুষ্ঠান লেগেই থাকে বাদল তাদের মধ্যে অতি অবশ্য একজন। শুধু পেট পুরে খাওয়াই নয়, সেই সঙ্গে সে দক্ষিণা পায় পাঁচসিকে পয়সা, একটা নতুন পইতে। কখনও কখনও একটা মাটির কলসি এবং গামছা। এক এক জায়গা থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে খুদে বামুনটি যখন এইসব জিনিসপত্র দু হাতে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে তখন হাসির ধুম পড়ে যায়। সবাই মিলে তার ন্যাড়া মাথায় চাঁটি মেরে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।

বাদলের মামাবাড়ির সামনেই একটা দিঘি। দিঘিটা যেমন বড়, তেমনি সুদৃশ্য। দিঘির চার কোণে চারটি ছোট মন্দির, দু’ দিকে মস্ত বড় বাঁধানো ঘাট, কচুরিপানা-মুক্ত স্বচ্ছ জল। দিঘির যে দিকে বাদলদের বাড়ি, তার বিপরীত দিকে ফুলের বাগান–দূর থেকে সেটিকে অরণ্য বলেই মনে হয়। দিঘিটিতে অনেক মাছ আছে, তা ছাড়া স্থানীয় লোকের বিশ্বাস এই যে এটির ঠিক মাঝখানে মস্ত বড় গহ্বরে একটি রহস্যময় অতিকায় জলজন্তু আছে বছরে একবার মাত্র তাকে জলের ওপরে ঘাই মারতে দেখা যায়। এবং দুপুরের। দিকে, যখন চারদিক সুনসান, ঘাটে কেউ থাকে না–সেইসময় নাকি প্রাণীটি মাঝে মাঝে ভেসে উঠে হাওয়া খায়। একবার ওই দিঘির জলে একটা বেশ বড় গোসাপকে মরা অবস্থায় ভাসতে দেখে সকলেই সিদ্ধান্ত করেছিল–মাঝখানের সেই রহস্যময় প্রাণীটিই একে মেরেছে–কেন না গোসাপের মতন দুর্ধর্ষ প্রাণী এমনি এমনি মরবে কেন? অবশ্য সেই প্রাণীটি মানুষের কোনও দিন কোনও ক্ষতি করেনি–প্রত্যেক দিঘিতেই মাঝে মাঝে কেউ ডুবে মরে–কিন্তু এ-দিঘিতে সে রকম কখনও হয়নি। এমনকী, বহুদিন আগে এ-বাড়ির এক নতুন বউ এই দিঘিতে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে-ও বেঁচে ওঠে। পরে সেই বউটির মৃতদেহ পাওয়া যায় বাড়ির ছাদে, ভূতে তার ঘাড় মটকে দিয়েছিল।

এই দিঘির পাড়েই বাদলের দিনের অধিকাংশ সময় কাটে। এর মধ্যে তাকে মাছ ধরার নেশায় পেয়ে বসেছে। একটা ছোট ছিপ নিয়ে দিঘির ঘাটলায় এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে এবং একা থাকলেই সে নিজের সঙ্গে কথা বলে। জলের দিকে তাকিয়ে সে কখনও কখনও এত জোরে জোরে কথা বলে যে দূর থেকে শুনলে যে-কেউ ভাববে সে। বুঝি কারওর সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করছে। সে নিজের ডান ও বাঁ হাতের সঙ্গে কথা বলে, গাছ থেকে খসে পড়া শুকনো পাতার সঙ্গেও তার অনেক কথা আছে।

দিঘিতে লোকজন স্নান করতে এলে সে একটু বিরক্ত হয় তখন জলে ঢেউ ওঠে, তার ফাতনা নড়ে যায়। স্নান করতে নেমে সবাই এত গল্প করে যে মাছ আর ধারে কাছে। আসে না। বাদল রোজই কিছু কিছু মাছ পায়–পুঁটি, ট্যাংরা, চাঁদা মাছ সেই জলে অজস্র। একদিন সে একটা মাঝারি সাইজের কাতলাও ধরে ফেলেছিল, সেদিন সে বাড়ি ফিরেছে নাচতে নাচতে। মাছ ধরার আনন্দ যে কী, যে কখনও বঁড়শিতে মাছ ধরেনি, সে বুঝতে পারবে না। বাদলের মামাবাড়ির রান্নাঘরে প্রায় প্রতিদিনই রাজসূয় যজ্ঞ চলে– সেখানে অবশ্য ওই সামান্য মাছের কোনও মূল্যই নেই–ওগুলো বাদলকে আলাদা ভাবে ভাজা করে দেওয়া হয়, সে অমৃত আস্বাদের মতন মুখ করে খায়।

বাদল নিজে যখন স্নান করতে নামে, তখনও সে-ও ঘন্টা খানেকের কমে ওঠে না। সাঁতার সে আগে থেকেই জানত, এখন জলের পোকার মতন সাবলীল। জলের মধ্যে দাপাদাপি করে, অন্যদের সামনে সাঁতারের কায়দা দেখায়বাজি ফেলে এপার-ওপার করে। মা কিংবা মামাদের ধমক খেয়ে শেষ পর্যন্ত যখন ওঠে, তখন তার দু চোখ লাল।

দিঘির পাড়টা বাদল সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে দুপুরবেলা। জলের ধারের নির্জনতার মধ্যে একটা আলাদা গাম্ভীর্য আছে। প্রখর রোদ্দুরে ঝকঝক করে জল। অনেক সময় চোখ ধাঁধিয়ে যায়–আবার মেঘ এলেই চরিত্র বদলে যায় জলের। এক এক সময় হাওয়া কতকগুলো ছোট ছোট তরঙ্গকে অনেক দূর টেনে আনে আবার ভেঙে দেয়। নিজের খেয়ালে। বাদল চোখ টান করে চেয়ে থাকে দিঘির মাঝখানে যদি সেই রহস্যময় জন্তুটিকে দেখা যায়। একটা অজানা রহস্যকে জানার আগ্রহে টনটন করে তার বুক। কোথাও একটা মাছ জলের ঝাঁপটা দিলেই সচকিত হয়ে ওঠে সে, কোনও দিন কিছু দেখা যায় না বটে, কিন্তু সেই নির্জন দুপুর, সেই একা জলের ধারে বসে থাকা, রৌদ্র ও বাতাসের খেলার মধ্যে বারো বছর বয়সটা বড় মোহময় হয়ে ওঠে।

বিকেল শেষ হয়ে আলো কমে এলেও বাদল দিঘির ধার ছাড়তে চায় না, তার দিদি তাকে রোজ ডাকতে আসে। ছিপ গুটিয়ে মাছের খালুই হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরে বাদল। ঠাকুরদালানের পাশে দুটো গাছে ফুটে থাকে এক ঝাঁক সন্ধ্যামালতী ফুল। ফুল না ছিঁড়ে মুখটা অনেক নিচু করে বাদল গন্ধ নেবার চেষ্টা করে। তারপর দৌড়ে গিয়ে বাড়ির মধ্যে হাত-পা ধুয়ে এসেই আবার সে এসে পড়ে ঠাকুরদালানের সিঁড়িতে। প্রতিদিন পুজোর পর পুরুতমশাই ভেজা আতপ চাল আর কলা চটকে মাখা প্রসাদ দেন তাকে, তার অপূর্ব লাগে। খাঁটি বামুন হচ্ছে তো সে–তাই চালকলার ভক্ত হয়ে উঠেছে।

একদিন দুপুরে দিঘিতে স্নান করার সময় বাদলের পইতে হারিয়ে গেল। দিদিদের সে ডুবসাঁতারের খেলা দেখাচ্ছিল, কখন পইতেটা খুলে গেছে। নতুন বামুনের পইতে হারানো তো এক সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। যতক্ষণ না কোনও সদাবিপ্র নতুন পইতের গ্রন্থী দিয়ে দিচ্ছেন ততক্ষণ বাদল কথা বলতে পারবে না। ফ্যাকাশে মুখ করে সে উঠে এল জল থেকে তাকে দেখেই সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব মজা পেয়ে গেল। মামাতো ভাই-বোনেরা প্রাণের সুখে চাঁটি মারতে লাগল তার ন্যাড়া মাথায়। বাদল ইশারা ইঙ্গিত করছে আর হাত-পা ছুড়ছে–এমনকী তার কাঁদবারও উপায় নেই, তা হলে শব্দ বেরিয়ে যাবে। যেখানেই সে পালাতে যায়–ভাই-বোনেরা ঘিরে ধরে তাকে চাঁটি মারে। বাদলের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে আর সবাই হাসছে হো হো করে। তার মুখ দিয়ে শব্দ বার করার জন্য দু’-তিন জন তাকে চেপে ধরে কাতুকুতু দিতে লাগল। বাদল কোনওক্রমে তাদের হাত ছাড়িয়ে আশ্রয় নেবার জন্য ছুটে গেল তার মায়ের কাছে।

বাদলের মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নাদের আলির সঙ্গে কথা বলছিলেন। ছেলেকে দেখেই বললেন, এই বাদল, তোর নামে একটা চিঠি এসেছে!

বাদল বিস্মিত ভাবে বলল, কী?

মামাতো ভাই-বোনেরা পেছন পেছন এসেছে, তারা চেঁচিয়ে উঠল, এ মা, এ মা, কথা বলে ফেলছে। এ মা–!

বাদল লজ্জা পেয়ে গেল–কিন্তু একবার কথা বলাও যা, দু’বার কথা বলাও তা। সে আবার বলল, আমার চিঠি? কোথায়?

পইতে না-থাকা অবস্থায় কথা বলে ফেলার দোষে বাদলকে খাতার পাতায় একশো আটবার শ্রী শ্রী দুর্গা নাম লিখতে হয়েছিল কিন্তু চিঠি পাওয়ার আনন্দের তুলনায় সে কষ্ট কিছুই না। তার জীবনের প্রথম চিঠি। খামের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে তারই নাম লেখা–শ্রীযুক্ত বাদলরঞ্জন মুখোপাধ্যায়।

চিঠিখানা প্রথমে খুলতেই ইচ্ছে করে না। বাদল বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, গন্ধ শোঁকে। মনে মনে ভাববার চেষ্টা করে, কে লিখেছে? সূর্যদা কি তাকে চিঠি লিখবে? সূর্যদা সবার ওপর রাগ করে চলে গেছে সূর্যদার রাগ বড় সাঙ্ঘাতিক।

এক খামের মধ্যে দুটো চিঠি। ভাগলপুর থেকে লিখেছে বিষ্ণু আর রেণু। মছলন্দপুরের জলহাওয়া সহ্য না হওয়ায় রেণুরাও চলে এসেছে ভাগলপুরে। নিশ্চয়ই খুব মজা করছে ওরা।

বিষ্ণুর চিঠি তিন পাতা আর রেণুর চিঠি পৌনে এক পাতা মাত্র। বাদল সারা দিনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চিঠি দুখানি প্রায় দশ বার করে পড়লে–মুখস্থ হয়ে গেলেও তার আশা মেটে না। কত দূরে আছে তার বন্ধুরা–অথচ চিঠি পড়লে মনে হয় কত কাছে।

বিষ্ণু বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে শিখে গেছে এর মধ্যেই। সে তার পাহাড়ে ওঠা ও পাথর সংগ্রহ বিষয়ে লিখেছে অনেকখানি–ইতিমধ্যে ওরা একবার মণিহারিঘাটে বেড়াতে গিয়েছিল, সে-বিবরণও রয়েছে বিস্তৃত ভাবে–আর আছে তার নতুন পড়া বইয়ের কথা। ‘লে মিজারেবল’ বইখানি পড়তে পড়তে তার বার বার কান্না পেয়েছিল একথাও জানিয়েছে। বাদল কি পড়েছে বইখানা? না হলে, বিষ্ণু বইখানা পার্সেল করে পাঠাতে পারে। বাদলরা আর কত দিন থাকবে পাড়াগাঁয়ে? বিষ্ণুরা আর তিন সপ্তাহ বাদেই কলকাতায় ফিরবে?

রেণুর চিঠির অক্ষরগুলো আধ ইঞ্চি মাপের এবং কাটাকুটিতে ভরা। সে লিখেছে, বাদলদা, তুমি কেমন আছ? আমি ভালো আছি। আমি অনেক নদী দেখিয়াছি। নদীতে ঢেউ থাকে। আমরা এখানে খুব খেলা করি। মা বাবা ভালো আছেন। দাদা ভালো আছেন। ইলু খুব দুষ্টু। সে আমার কথা শোনে না। পুজ্যপদে প্রণাম। ইতি ইন্দ্রাণী।

পরবর্তীকালে রেণু বাদলকে যে কয়েক হাজার চিঠি লিখেছিল–এখানেই তার সূত্রপাত। রেণু লিখেছে ইল্লু বড় দুষ্ট্র–অথচ ইল্ল যে কে সে কথা জানাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। পরবর্তী কালেও রেণুর সব চিঠিতে এই রকম একটা কিছু রহস্যময় ব্যাপার দেখা গেছে।

বাদল রেণুকে লিখেছে এরও দ্বিগুণ সংখ্যক চিঠি। অধিকাংশ চিঠিই পরস্পরের হাতে হাতে দিয়েছে। কোনও কোনও দিন ওরা এক ঘণ্টা-দু’ঘণ্টা গল্প করার পরেও বাদল রেণুকে বলেছে, তোমার জন্য একটা চিঠি। দাও, বলে রেণু হাত বাড়িয়েছে। কখনও এমনও হয়েছে, বাদল রেণুকে বলেছে, কাল রাত্তিরে তোমাকে একটা চিঠি লিখেছিলুম, ছিঁড়ে ফেলেছি। রেণু দপ করে জ্বলে উঠে বলেছে, কেন? বাদল মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছে, তার মধ্যে অনেক আনসেনসরড কথা ছিল। রেণু তাও ধমকের সুরে বলেছে, আমাকে লেখা চিঠি ছিঁড়ে ফেলার কোনও অধিকার তোমার নেই।

এসব অনেক দিন পরের ব্যাপার। তখন ওরা পরস্পরের জন্য দুঃখ পেতে শুরু করেছে। সে দুঃখবোধ এখন জাগার কথা নয়। এখন বাদল সদ্য দ্বাদশবর্ষীয় বালক, তার জীবনের প্রথম চিঠি পেয়ে আনন্দে উতলা, বাড়ির আনাচেকানাচে একটু নিভৃত স্থান দেখলেই সেই চিঠি খুলে বসছে।

চিঠির উত্তর দেবার জন্য বাদলের পুরো দেড় দিন সময় লাগল। কত যে কাগজ সে ছিঁড়ল, তার ঠিক নেই। একটাও তার পছন্দ হল না। শেষ পর্যন্ত চিঠি খামে ভরে হাটতলার ডাকে ফেলবার জন্য দিল নাদের আলির হাতে এবং তার সঞ্চয় থেকে পুরো একটা টাকা দিয়ে ফেলল নাদের আলিকে। বাদলের চিঠি থেকে উদ্ধৃতি এখানে দেওয়া হল না! শুধু এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে তার দুটো চিঠিই মিথ্যে কথায় ভরা। বড় দিঘির রহস্যময় জলজন্তুটিকে সে সচক্ষে দেখার দাবি করেছে এবং তার বঁড়শিতে মাছগুলির আয়তন দু’হাত বিস্তার করে বোঝাতে হয় ইত্যাদি। তার কল্পনাশক্তির এই বহর দেখেই অনুমান করা যেতে পারে যে ভবিষ্যতে সে একজন লেখক হবে।

ইতিমধ্যে এখানেও বাদলের কয়েক জন বন্ধু হয়েছে। নাদের আলির সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব অনেক দানা বেঁধেছে–কিন্তু নাদের আলি শুধু তাকে গল্পই শোনায়–কিছুতেই তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যায় না। সে-প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই শুধু বলে, আর একটু বড় হও দাঠাকুর–আর একটু বড় হও!

বাদল এই নিয়ে কান্নাকাটি করেছে পর্যন্ত। গল্প শুনতে শুনতে তিন প্রহরের বিল তার কাছে স্বপ্নের দেশ হয়ে গেছে–সেখানে সত্যি সত্যি দেখা যায় সূর্যদেব জলে স্নান করতে নামছেন সন্ধ্যাবেলা, জলে গুলে যাচ্ছে তার গায়ের লাল রং, আর সেই মুহূর্তেই ডানা মেলে এক হাজার হাঁস ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই জলে-এ-দৃশ্য বাদল দেখবে না? নাদের। আলি মিথ্যে স্তোকবাক্য দেয়। যখন তার বিলে যাবার কথা থাকে তখন খুব ভোরবেলা বাদলকে কিছু না জানিয়ে চলে যায়।

বাদলের সমবয়সি বন্ধুবান্ধবও হয়েছে। মাস দেড়েক বাদে তাকে পুকুরঘাটের নিভৃত খেলা ছেড়ে স্কুলেও ভরতি হতে হল। এখানকার স্কুলে ক্লাস এইটে ভরতি হয়েও দেখা গেল সে অত্যন্ত ভালো ছাত্র হিসেবে মাস্টারমশাইদের প্রশংসা কুড়োচ্ছ। বাদলের পড়াশুনোর তেমন মনোযোগ কখনও দেখা যায়নি–কিন্তু কলকাতার স্কুলের শিক্ষার মানের তুলনায় এখানকার মান এতই নিচু যে সবাই বলতে লাগল, এ-ছেলে ম্যাট্রিকে ফার্স্ট হবে। আসলে সে মোটামুটি শুদ্ধ ভাবে ইংরেজি উচ্চারণ করতে পারে এতেই সবাই মুগ্ধ। এখানকার অধিকাংশ ছেলে অ্যাসিড-কে বলে এসিড আর গেটকে বলে গ্যাট। আর বার্ড কথাটা তো কেউই উচ্চারণ করতে জানে না–মাস্টারমশাইরাও না। এত প্রশংসা শুনে বাদল খুবই লজ্জা পেত যদিও কিন্তু এতে তার খানিকটা উপকারও হয়েছিল। প্রশংসার যোগ্য হবার জন্য সে সত্যিই পড়াশুনোর দিকে ঝুঁকল এবং প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের আলোর সামনে বই খুলে বসতে লাগল।

ইস্কুলের সুশিক্ষার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে কুশিক্ষাও হতে লাগল পাড়ার বন্ধুদের কাছে। মামাবাড়ির দিঘির পশ্চিম কোণে চক্রবর্তীদের বাড়ি, সে বাড়িতেও এক গাদা ছেলে-মেয়ে। ও-বাড়ির ছেলে পান্নালাল বাদলের চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হলেও পড়ে নিচু ক্লাসে। কিন্তু সে খেলাধুলোয় ওস্তাদ। এবং সে অবিকল বয়স্ক লোকদের মতন গলা করে কুৎসিত গালাগালি দেয়।

পান্না নিত্যনতুন খেলা উদ্ভাবন করে এবং তার খেলায় যোগদান না করে উপায় নেই। বস্তুত শিশু ও কিশোর মহলে সে একটা সাম্রাজ্য বিস্তার করে আছে-তার হুকুম অগ্রাহ্য করার সাহস কারওর নেই। তার গায়ে যে অসম্ভব জোর। পান্নার অধিকাংশ খেলাই শেষ হয় মারামারিতে। সে বাঁড়ুজ্যে ও চক্রবর্তী বাড়ির ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দুটি আলাদা দল করে ফেলে এবং কুরু-পাণ্ডবের মতন এই দলে যুদ্ধ ঘোষণা হয় প্রায়ই। আমবাগানের দু’পাশে দুটো দল জড়ো হয় ইটপাটকেল ও কঞ্চির তির-ধনুক নিয়ে। কিছুক্ষণ এসব ছোঁড়াছুড়ি হয় কিন্তু সবাই জানে শেষ পর্যন্ত পান্নার সঙ্গে কেউ পারবে না–পান্না এক এক জনকে ধরে ধরে সাঙ্ঘাতিক মারে–অল্পবয়স্ক ও দুর্বল ছেলেদের মারধর করে সে অসম্ভব আনন্দ পায়। তার মারার মধ্যে অনেক কায়দাও আছে। পরাজিত শত্রুকে সে প্রথমে বন্দি করে। তারপর বিচার হয়, তারপর শাস্তি। সে একাই সেনাপতি, বিচারক ও জল্লাদ। বাদলের কানের সুতো একটানে খুলে ফেলে সে একদিন রক্ত বার করে দেয়। আর একদিন বাদলকে সে মাটিতে কুড়ি হাত জায়গা নাকে খত দিতে বাধ্য করে। এ-নিয়ে কারওর কাছে নালিশ জানানো যাবে না। কারণ এসবই তো খেলা।

মার খেতে খেতে নাজেহাল হয়ে গিয়ে বাদল শেষ পর্যন্ত একটা ফন্দি বার করে ফেলল। সে পান্নালালের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল। এবং পান্নালালের প্রিয়পাত্র হওয়া মানেই তার সমস্ত কুকার্য সমর্থন করা। পান্নালালের হুকুমে বিড়ি কিনে আনতে হয় দোকান থেকে–এবং পান্নার এঁটো বিড়িতে টান লাগাতেও হয় তাকে। দু’-এক টান দিয়েই কাশতে কাশতে বাদলের চোখ লাল হয়ে যায়, জল পড়ে–তাই দেখে পান্নালাল হি হি করে হাসে। ভারী খুশি হয় সে। বাড়ি ফেরার আগে মুখের গন্ধ লুকোবার জন্য বাদল লেবুগাছের পাতা ছিঁড়ে চিবোয়।

একদিন আমবাগানের অনেকটা ভেতরে প্রায় জঙ্গলের মধ্যে কয়েক জন ছেলে মিলে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছিল–এই সময় সেখানে চিনু নামে একটি মেয়ে হঠাৎ হাজির হল। চিনুর মা একজন দুঃখী বিধবা বাদলের মামাবাড়িতেই আশ্রিতা। কিছু একটা আত্মীয়তাও আছে–কিন্তু ঝি-চাকরানির বেশি সম্মান নেই। চিনুও ঘর মোছর কাজ করে। চিনুকে দেখেই পান্না হুংকার দিয়ে উঠল, স্পাই! স্পাই! ও এখানে কেন?

মহাযুদ্ধের সুবাদে তখন স্পাই ও ফিফথ কলামিস্ট শব্দ গ্রামে গ্রামেও পৌঁছে গেছে। নানা রকম গুজব সব সময় বাতাসে ভাসে। সুতরাং খেলার যুদ্ধে একজন স্পাইকে পেয়ে ওরা খুব উৎসাহ পেয়ে গেল। স্বয়ং হিটলারের চেয়েও কড়া গলায় পান্না হুকুম করল, ওকে বেঁধে নিয়ে আয়।

চিনু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেরা লতা দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলল আষ্টেপৃষ্ঠে। টানতে টানতে তাকে নিয়ে এল পান্নার সামনে। পান্না জিজ্ঞেস করল, কে তোকে পাঠিয়েছে? বল?

চিনু বেচারা কিছুই বোঝে না। এমনিতেই সে একটু বোকাসোকা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। পান্না বাদলকে হুকুম করল, এই, ওকে মার তো এক থাপ্পড়! ওকে টর্চার করতে হবে। হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা সবাই মিলে ধপাধপ করে মারতে লাগল চিনুকে। চিনু ভ্যা করে কেঁদে উঠতেই পান্না তার চুলের মুঠি ধরে বলল, চুপ। একটা শব্দ শুনতে চাই না। যদি কারোকে কিছু বলবি তো, মেরে খুন করে ফেলব।

মাটিতে ফেলে সবাই মিলে চিনুকে আরও কিছুক্ষণ ধরে মারল। পান্না তার নিষ্ঠুরতার আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। বস্তুত সব বালকই নিষ্ঠুর, পান্না সেটা উসকে দিয়েছে মাত্র।

এরপর চিনু কয়েক দিন মরণাপন্ন অবস্থায় জ্বরে ভুগল। চিনুর মা কাঁদল নিজের ভাগ্যকে দোষ দিয়ে। আর বাদল চোরের মতন ঘুরতে লাগল সারা বাড়ি। যদি চিনু নাম বলে দেয়! চিনু কিছুই বলেনি। তবু একদিন মধ্যরাত্রে ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে উঠে বসল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আর থামে না। বাদলের মা তাকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন ব্যাকুল ভাবে, কী হয়েছে? কী হয়েছে? স্বপ্ন দেখেছিস? বাদল মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি আর কোনও দিন করব না, আমি আর কোনও দিন করব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *