আটত্রিশ
মহীতোষের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মাধবীলতা কথাটা তুলল।
দুপুরবেলায় এখানে ঘুঘুরা বড্ড বেশী হল্লা করে। নারকেল গাছের পাতাগুলো নরম হাওয়ায় তিরতিরিয়ে কাঁপে। আর কোন শব্দ নেই, কাঁপন নেই এ বাড়িতে। মাধবীলতার দুপুর এখন বারোটাতেই শুরু হয়ে যায়। তার মধ্যে রান্নাবান্না শেষ, খাওয়া চুকে যায়। ছোটমা আর হেমলতা এখন একসঙ্গে খান। তাঁদের উনুনে কয়লা পড়ে রোদের রঙ খোলসা হলে। খেতে খেতে ছায়া ছড়িয়ে যায় বাগানে। অবেলায় ভাত তো রাত শুরু হলে মুড়ি। পেট ভরতি আছে এই বাহানায় দিব্যি উনুন না ধরালে চলে। বিধবা হবার পর ছোটমার খাওয়ার খরচ দুম করে কমে গেছে। মাধবীলতা ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এ নিয়ে সে কোন কথা বলেনি। শোক যখন দগদগে তখন মানুষ নিজেকে যে কোন উপায়েই হোক বেশী কষ্ট দিতে ভালবাসে। সে সময় আপত্তি জানালে হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কা বেশী সারাদিনে ছোটমা আর হেমলতার কণ্ঠস্বর শোনা যায় কিনা বলা মুশকিল। অদ্ভুত গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেদের ওঁরা। মাধবীলতা যেচে কথা বললে উত্তর দেন। মাধবীলতাকে তাই খবর রাখতে হয় ওঁদের প্রয়োজনগুলো কি এবং কখন।
অতএব সারাটা দিন চুপচাপ শুয়ে বসে থাকা। শীতের টান এসে গেছে এর মধ্যে। বিকেল তিনটেই কেমন ছমছমে হয়ে যায় চারপাশ। অনিমেষ দুপুরে ঘুমোয় না, মুখ দেখলেই বোঝা যায় আকাশ পাতাল ভাবছে। খাওয়া দাওয়ার পর অর্কর পাত্তা পাওয়া যায় না। এতদিন ছেলেটা বেকার বসে আছে। দুপুরে ঘুমোবার কথাও বলা যায় না, পড়াশুনা করার কথা বলে কোন লাভ নেই। মাধবীলতা ওর দুটো বই সঙ্গে এনেছিল, সময় পেলেই সে-দুটো গুলে খেয়েছে অর্ক। অতএব ঘুরুক সে যেখানে ইচ্ছে। আজ দুপুরে বড় বাড়ির নির্জন ঘরে বসে মাধবীলতা কথাটা তুলল, ‘আমার ছুটি ফুরিয়ে গেল।’
অনিমেষ মুখ ফেরাল, ‘কি বললে?’
মাধবীলতা আবার শব্দগুলো উচ্চারণ করল। অনিমেষ এবার জবাব দিল না, নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তারপর স্থির দৃষ্টিতে মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল।
মাধবীলতা খুব সহজ ভঙ্গীতে বলল, ‘এখানে এসেই ছুটি বাড়িয়েছিলাম। ক’দিনের জন্য এসেছিলাম আর কতদিন থেকে গেলাম। এরপর আর ছুটি দেবে না। এখন না গেলে চাকরিটাকে খোয়াতে হয়।’
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘হুঁ।’
মাধবীলতা আবার বলল, ‘তাছাড়া ছুটি নিয়ে নিয়ে তো অনন্তকাল চলতে পারে না। আমাকে তো এক সময় যেতে হবেই।’
অনিমেষ এবারও মাথা নাড়ল, তারপর যেন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘কি করা যায়!’
মাধবীলতা এবার অন্যরকম গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি আমাকে কি করতে বল?’
অনিমেষ যেন আরও অপ্রতিভ হল, তারপর বলল, ‘বাস্তবকে মানতেই হবে।’
মাধবীলতা বলল, ‘আমার খুব খারাপ লাগছে এঁদের এখানে এইভাবে ফেলে যেতে। আমি বুঝতে পারি এঁদের কেউ নেই, বেঁচে থাকতে গেলে এঁদের একটা অবলম্বন দরকার। তোমার বাবা অসুস্থ ছিলেন হয়তো কিন্তু তিনি আছেন এই বোধটুকুই এদের অবলম্বন ছিল। এখন তার কেউ রইল না এখানে।’
অনিমেয় বলল, ‘আর এখান থেকে তো ওদের সরানোও যাবে না।’
‘মাথা খারাপ। এই বাড়ি ছেড়ে ওঁরা কোথাও থাকতে পারবেন? কলকাতায় কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলবে তুমি? ঈশ্বরপুকুরের বস্তিতে?’
একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল অনিমেষ, ‘শোভাবাজারের বাড়িটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। কপালটা সত্যি খারাপ।’
দিন তিনেক আগে পরমহংসের চিঠি এসেছে। সেই বাড়িঅলা নাকি বেশী টাকা পেয়ে অন্য জায়গায় ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। পরমহংস জানিয়েছে তার অফিসে নাকি এখন খুব গোলমাল চলছে। এ সময় তার পক্ষে কলকাতা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে সে অন্য বাড়ির সন্ধানে রয়েছে। খবরটা শোনার পর সবচেয়ে বেশী মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল অর্কর। চিঠিটা নিজে আর একবার পড়ে বলেছিল ‘তাহলে আর আমাদের ঈশ্বরপুকুর ছাড়া হল না।’ মন খারাপ হয়েছিল মাধবীলতারও, কিন্তু এখন এ নিয়ে হা-হুতাশ করে লাভ নেই। জীবনে যা ঘটবে তার মুখোমুখি হওয়াই যখন নিয়ম তখন এ নিয়ে বেশী চিন্তা করার কোন মানে হয় না।
মাধবীলতা চুপচাপ বসেছিল। অনিমেষ খাট ছেড়ে নেমে ক্রাচ দুটো টেনে নিল, ‘ঠিক আছে, যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এভাবে তো অনন্তকাল থাকা যায় না। আমি ভাবছিলাম তোমার জন্যে যদি এখানকার স্কুলে একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যেত!’
‘এখানকার স্কুলে?’
‘হুঁ। তাহলে কোন সমস্যাই থাকতো না। ছোটমা, পিসীমা আমাদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন আর আমরাও ওই বস্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম। তাছাড়া, তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ খোকা এখানে আসার পর বেশ পাল্টে গিয়েছে। বেলগাছিয়ার ওই পরিবেশে খোকা খিস্তি আর মাস্তানি ছাড়া কিছু শিখতো না। এখানকার জীবন খুব শান্ত, ও যদি এখানে পড়াশুনা করে তাহলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। না, তোমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতেই হবে।’
মাধবীলতা হেসে ফেলল, ‘তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যে এখনই আমার জন্যে চাকরি খুঁজতে বের হচ্ছ! আজকাল স্কুলে চাকরি পাওয়া অত সোজা নয়। এই বয়সে আর নতুন স্কুলে চাকরি হবে না।
অনিমেষ বলল, ‘চেষ্টা করলে সব হয়। কিন্তু আমার যে তেমন কারো কথা মনে পড়ছে না। দেখা যাক, দেখা যাক।’
‘তাহলে অর্ককে টিকিট কাটতে দিই? তুমি ওদের বুঝিয়ে বলবে।’
সেই বিকেলে অনিমেষ ভেতরের বারান্দায় এল। একগাদা ছাতার পাখি বুনো বাগানে হুটোপাটি করছে। কতখানি খালি জায়গা নষ্ট হচ্ছে এখানে। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল এখানে একটা ব্যবসা করলে কেমন হয়! বিরাট খাঁচা করে যদি মুরগির চাষ করা যায়! দেড় দুই হাজার টাকা কোন রকমে ব্যবস্থা করে যদি শুরু করা যায় তাহলে লেগে যেতে পারে! জলপাইগুড়িতে তো জিনিসপত্রের চাহিদা আছে। একশটা মুরগি কিনে তিন মাস অপেক্ষা করলে রোজ যদি পঞ্চাশটা ডিম পাওয়া যায় তাহলে মাসে সাড়ে সাতশ টাকা রোজগার। খরচ বাদ দিয়ে চারশোর মত থাকবে। মন্দ কি? তাছাড়া শীতকালে লোক দিয়ে আলু কপির চাষ করে ভাল টাকা পাওয়া যেতে পারে। মাধবীলতা যদি এখানকার স্কুলে চাকরি পায় তাহলে সে স্বচ্ছন্দে এসব করতে পারে। নিজেকে আর বেকার অকর্মণ্য মনে হচ্ছিল না চিন্তাটা মাথায় আসা মাত্র। ওর মনে হল কলকাতায় গিয়ে একটা জড় পদার্থ হয়ে থাকার চেয়ে এ ঢের ভাল। অবশ্য জুলিয়েন তাকে বলছে সে ইচ্ছে করলেই সক্রিয় হতে পারে। কিন্তু জুলিয়েনের নামটা মনে পড়তেই অনিমেষ যেন ধাক্কা খেল। সে মুরগি আর সবজির চাষ করছে এটা শুনলে জুলিয়েন নিশ্চয়ই হতভম্ব হয়ে যাবে! সুবিধেবাদী বলে ভাবতে শুরু করবে তাকে? এককালে যারা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের অনেকেই এখন আখের গুছিয়ে নিয়েছে। এই কাজটাকেও কি আখের গোছানোর মধ্যে ফেলবে জুলিয়েন? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই অনিমেষের হাসি পেল। সে কি জুলিয়েনকে ভয় পেতে শুরু করেছে? নাকি ওর আদর্শবাদ এবং আত্মত্যাগের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হওয়ায় এই রকম বোধ হচ্ছে!
এই সময় ছোটমা ঠাকুরঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। অনিমেষকে দেখে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘পিসীমা কোথায়?’
‘ওঁর শোওয়ার ঘরে।’
‘তুমি একটু ওখানে চল, তোমাদের দুজনের সঙ্গে আমার কথা আছে।’ অনিমেষ সহজ গলায় বলার চেষ্টা করল।
ছোটমার কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল না, প্রশ্ন করলেন, ‘কি কথা?’
‘এসোই না।’ অনিমেষ সাবধানে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে এল।
পিসীমার ঘরের বারান্দায় আসতেই অনিমেষের কানে সুরেলা স্বর ভেসে এল, ‘গুরুদেব দয়া কর দীন জনে।’ বাল্যকালে সে যখন এই বাড়িতে একা ছিল তখন লাইনটা প্রায় প্রতিদিন শুনতে হয়েছে। হায়, এতগুলো বছর পার হয়ে গেল তবু গুরুদেব পিসীমাকে দয়া করলেন না।
সে এক হাতে দেয়াল ধরে অন্যহাতে ক্রাচ সামলে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতেই সিমেন্টে খটখট শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে সুর গেল থেমে। হেমলতার গলা ভেসে এল, ‘হেই হেই, আ মলে যা, গরু ঢুকল নাকি এখানে!’
অনিমেষ তখন বারান্দায় উঠে পড়েছে। কলকাতায় থাকতে এইটে তার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার ছিল। অভ্যেসে কি না হয়। দরজার কাছে পৌঁছে সে হাসল, ‘আমি অনি, গরু কিনা তা আপনি জানেন।’
তক্তাপোশের ওপরে বাবু হয়ে বসেছিলেন হেমলতা। নাকের ডগায় চশমা, সামনে ছোট্ট জলচৌকির ওপর খাতা খোলা। অনিমেষকে দেখে খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘ওমা তুই। এখানে কেন এলি, খোঁড়া মানুষ, পড়ে গেলে—।’
অনিমেষ বলল, ‘না, এখন আর পড়ব না। অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। তা এই বিকেল বেলায় কি করছিলেন?’
‘ঠাকুর নাম করছিলাম। সন্ধ্যে হয়ে গেলে তো আর কিছু ভাল করে দেখতে পাই না। এই দ্যাখ না, এখনই সব ঝাপসা দেখছি, তোর মুখটা কেমন অচেনা অচেনা মনে হচ্ছে—’ হেমলতা নমস্কার করে খাতা বন্ধ করলেন।
অনিমেষের মনে পড়ল, পিসীমার নিত্যকাজ ছিল রোজ রাত্রে শোওয়ার আগে এক পাতা ঠাকুরের নাম লিখে রাখা। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাহলে আজকাল আর রাত্রে লেখালেখির কাজ করেন না?’
‘লেখালেখি? ও মা। কি হবে লিখে? এত বছর যা লিখেছি তাই এখন এক এক করে পড়ি। যা লিখেছি তা বোধহয় সব পড়ে যেতে পারব না।’
হেমলতা হেসে ফেললেন, ‘সেই বড় বন্যায় সব তো জলের তলায় গিয়েছিল। তবু যা রয়েছে তাতেই—।’ ঘরের কোণটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তিনি।
অনিমেষ এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। এবার চোখে পড়ল স্তূপ হয়ে থাকা খাতা। প্রতিটি পাতায় প্রত্যেকদিনের আন্তরিক ঈশ্বর-নাম লেখা হয়েছিল। আজ আর নতুন পাতা নয়, লিখে যাওয়া নামই ফিরে ফিরে দেখা।
এই সময় ছোটমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘কি বলবে বলে ডেকে আনলে?’
অনিমেষের খেয়াল হল। তারপর ঘরের মধ্যে এক পা এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘পিসীমা, এখানে বসব?’
তক্তাপোশের সেই ধারের জিনিসপত্র সরিয়ে হেমলতা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হেগো কাপড় না তো? না? তাহলে বস। কি ব্যাপার ছোট?’
‘সেটা আপনার ভাইপোকে জিজ্ঞাসা করুন।’ ছোটমা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। হেমলতার নজরে পড়তে তিনি আপত্তি করলেন, মেয়েদের ওরকম ভাবে দাঁড়াতে নেই, অকল্যাণ হয়, ঠিক হয়ে দাঁড়াও।’
ছোটমা চট করে সোজা হয়ে জবাব দিলেন, ‘আর কি কল্যাণ হবে?’
অনিমেষ এতক্ষণ নিজেকে তৈরি করছিল। এবার কোন রকমে বলে ফেলল, ‘পিসীমা অনেকদিন তো হয়ে গেল, ওর ছুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল তাও বাড়িয়েছে কিন্তু এবার না গেলে আর চাকরি থাকবে না যে!’
হেমলতা অনিমেষের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। ছোটমা কোন কথা বলছেন না। হঠাৎ যেন সব শব্দ আচমকা মরে গেল। অনিমেষের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে যেন খানিকটা জবাব দেওয়ার ভঙ্গীতেই বলল, ‘ওকে তো চাকরি করতেই হবে। তাছাড়া অর্কর পড়াশুনা রয়েছে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।’
এবার হেমলতার ঠোঁট নড়ল, ‘আমরা কার কাছে থাকব?’
খুব ধীরে ধীরে শব্দ চারটে উচ্চারিত হল কিন্তু অনিমেষ বুঝল সে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। এই প্রশ্নের জবাব সে কি দেবে! হেমলতা এখন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে, সে মাথা নাড়ল, ‘আমি বুঝতে পারছি না।’
কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর হেমলতা ছোটমাকে বললেন, ‘তুমি কি বল?’
এবার ছোটমা কথা বললেন, ‘যেতে হবে যখন তখন যাবে। ওরা যদি না আসতো, না ধরা দিত তাহলে আপনার ভাই চলে যাওয়ার পর কার কাছে আমরা থাকতাম? আপনি ভেবে নিন ওদের সঙ্গে আমাদের দেখাই হয়নি।’
‘ভেবে নেব?’ হেমলতাকে খুব জবুথবু দেখাচ্ছিল।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘এভাবে বলবেন না। আমি চেষ্টা করছি যাতে এখানে মাধবীলতার একটা চাকরি হয়, তাহলে আর সমস্যা থাকবে না।’
ছোটমা বললেন, ‘তুমি কি শুধু ওর চাকরির জন্যেই ফিরে যাচ্ছ?’
অনিমেষ কোন উত্তর দেবার আগেই হেমলতা চিৎকার করে উঠলেন, ‘তুই চলে গেলেই পরি এসে আমাকে জ্বালাবে, এ বাড়ি লিখে দাও এ বাড়ি লিখে দাও। সব যাবে, উচ্ছন্নে যাবে। তুই কেন এলি, কি দরকার ছিল তোর আসার? বেশ তো মেরে ফেলেছিলি আমাদের, নতুন করে নুনের ছিটে কেন দিতে এলি?’
ওই ছোট্ট শরীর থেকে যে এমন তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে আসতে পারে তা অনুমান করা অসম্ভব। অনিমেষ হতভম্বের মত তাকাল। হেমলতা চিৎকার শুরু করা মাত্রই ছোটমা দরজা থেকে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, ‘একি করছেন, চুপ করুন, চুপ করুন। এভাবে বলতে আছে?’
‘কত চুপ করব? কতদিন চুপ করে থাকব? সেই শৈশবে বিধবা হয়ে অবধি চুপ করে আছি। সারা জীবন বাপের সেবা করেছি চুপ করে। আর এই ছেলে, একে আমি—উঃ ভগবান, আর কত চুপ করতে হবে আমাকে!’ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন হেমলতা।
অনিমেষের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। নিজেকে তার খুব ছিবড়ে, অসহায় মনে হচ্ছিল। পৃথিবীর অনেক কষ্ট পাওয়া মানুষের জন্যে সে কিছু করতে গিয়েছিল, পারেনি। নিজের খুব কাছাকাছি দু’তিনজন মানুষের জন্যেও সে কিছু করতে পারছে না। এবং হঠাৎই তার মুখ থেকে শব্দগুলো বেরিয়ে এল। সে একটুও এর জন্যে তৈরি ছিল না। কোনরকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই অনিমেষ বলল, ‘আমার কথাগুলো কিন্তু আপনারা শুনলেন না।’
হেমলতা ফুঁপিয়ে যাচ্ছেন সমানে, ছোটমা বললেন, ‘তুমি কিছু মনে করো না, আসলে খুব অসহায় হলে মানুষ—। তোমাদের তো যেতেই হবে, যাও।’
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘ঠিক এই কথা আমি বলতে চাইনি। মাধবীলতার স্কুলে আর ছুটি নেই। বেঁচে থাকার জন্যে অর্থ দরকার। আমি কোন কাজ এতদিন করতে পারিনি বলে ওর ওপর চাপ পড়েছে। তাছাড়া অর্ককে মানুষ করতে হবে। এইজন্যেই ওরা যাবে।’
‘ওরা যাবে মানে?’ ছোটমার ভুরু কোঁচকালো।
‘মাধবীলতা আর অর্ক যাবে। আমার এখানে থাকা যা ওখানে থাকাও তা। কারো কোন উপকারে লাগতে পারছি না যখন তখন এখানে থাকাই ভাল। বাবার অসাড় শরীরের চেয়ে আমি অনেক বেশী জীবন্ত।’ অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, ‘এই হল কথা। আপনারা চিন্তা করবেন না, আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি।’ অনিমেষের খুব হালকা মনে হচ্ছিল নিজেকে।
ছোটমা উঠে এলেন হেমলতাকে ছেড়ে, ‘কি পাগলের মত কথা বলছ? ওরা কলকাতায় কার কাছে থাকবে? তুমি এখানে পড়ে রইলে আর মেয়েটা ওখানে রইল তা কি ভাল দেখাবে?’
‘কি আশ্চর্য কথা।’ অনিমেষ হাসবার চেষ্টা করল, ‘মাধবীলতা এত বছর ওখানে আছে, ওর অসুবিধে হবে না। তাছাড়া অর্ক বড় হয়ে গেছে এখন, এই নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।’
হঠাৎ হেমলতা অনিমেষকে পিছু-ডাকলেন, ‘অনি।’
এ কণ্ঠস্বর একদম অন্যরকম। একটু আগে যে বৃদ্ধ উন্মাদিনীর মত চিৎকার করছিলেন তিনি এখন হেমলতার শরীরে নেই। অত্যন্ত শান্ত, পাথরের মূর্তির মত বসে আছেন হেমলতা। অনিমেষ ফিরে তাকাতে বললেন, ‘তুই আর কবে বড় হবি!’
‘মানে?’ অনিমেষ কথাটা বুঝতে পারল না।
‘মেয়েটা তোকে পাগলের মত ভালবাসে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি এই পৃথিবীতে তুই হলি ওর সব। সেই মেয়েটাকে আবার কষ্ট দিবি?’
‘কষ্ট দিচ্ছি?’
‘দিচ্ছিস না? তোকে ছেড়ে থাকা, মানে ওর কি কষ্ট।’
অনিমেষ কথাটা শেষ করতে দিল না, ‘পিসীমা, অনেক বছর তো একসঙ্গে থাকলাম, এখন একটু আধটু ছেড়ে থাকলে খারাপ লাগবে না। তাছাড়া গরমের ছুটি পুজোর ছুটি তো রয়েছেই। আর এখানে যদি একটা চাকরি হয়ে যায় তো কথাই নেই।’
অনিমেষ বারান্দা থেকে নেমে ধীরে ধীরে বাগানের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। পাখিরা এখন গাছের মাথায়, রোদের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে ছিল এতক্ষণ এখন টুক করে তাতে ছায়া মিশল। হেমলতা এই বাগানের যে যে অংশে ফুল তুলতে যান সেটুকই পা ফেলার অবস্থায় রয়েছে। অনিমেষের খেয়ালে ছিল না সে পেয়ারা গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সময় তার নজর গেল সাপটার দিকে। সরু একটা হেলের বাচ্চা ভীরু ভঙ্গীতে এগোচ্ছে। প্রথমে একটু সচেতন হয়েছিল অনিমেষ, তারপর নির্লিপ্ত হয়ে সাপটাকে দেখতে লাগল। ঘাসের ফাঁক দিয়ে একটু এগোয় আর মুখ তুলে দ্যাখে। একসময় অনিমেষের কাছাকাছি চলে এল সাপটা। তারপর সন্দেহের চোখে অনিমেষকে দেখে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল। অনিমেষ একটুও নড়ছিল না। এই সাপ কামড়ালে মানুষ মরে না, বড় জোর সামান্য ঘা হতে পারে। সাপটা যেন নিশ্চিন্ত হল। তারপর খানিকটা এগিয়ে ক্রাচের কাছে চলে এসে ওটাকে জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের শরীরে একটা ঘিনঘিনে ঘেন্না পাক দিয়ে উঠতেই সে ক্রাচটাকে ওপরে তুলে ঝাঁকুনি দিতেই সাপটা ছিটকে শূন্যে উঠে গেল। আর তখনি অনিমেষ চমকে উঠল। নারকোল গাছের মাথায় ওপর থেকে সাঁ করে একটা কালো বড় ছায়া নেমে এল নিচে, সাপটা মাটিতে পড়ার আগেই সেটাকে ধরে ফেলে ছায়াটা উঠে গেল কাঁঠাল গাছের মাথায়। ওটা বাজ না ঈগল? কিন্তু সাপটাকে ঠোঁটে ধরে সে অনিমেষের দিকে একবার কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল।
এই সময় অর্কর গলা শুনতে পেল অনিমেষ। তাকে ডাকছে। ভেতরের বারান্দায় এসে অর্ক তাকে দেখতে পেল, ‘বাবা, জুলিয়েনবাবু এসেছেন।’
অনিমেষ মাথা নাড়তেই অর্ক ফিরে গেল। আজ সারাদিন তিস্তার চরে ঘুরেছে অর্ক। অদ্ভুত জায়গা। জল সেই ওপার ঘেঁষে। এদিকটা পুরো চর বটে কিন্তু সবটাই খটখটে নয়। মাঝখানে ভেজা ভেজা বালি আছে। তার একটায় পা দিতে দোলনার মত দুলে উঠেছিল। অনেকটা ভেজা কাদা কাদা বালি একসঙ্গে গোল হয়ে দুলছে পা ফেললেই। বেশ মজা লাগছিল। একটু একটু করে জল উঠছিল বালি চুঁইয়ে। অথচ চারধার শুকনো খটখটে। কিন্তু একবার পা ফেলতেই ওপরের বালির আস্তরণ কেটে গিয়ে পা বসে গেল ভেতরে। অর্কর আর একটা পা তখনও ভেজা বালির বাইরে কিন্তু ডুবে যাওয়া পা থেকে মুহূর্তেই যেন সব শক্তি উধাও হয়ে গেল। কিছুতেই সেটাকে টেনে তুলতে পারছে না। তার গোটানো প্যান্টের কাপড় ভিজে গেল শেষ পর্যন্ত। অর্কর মনে হচ্ছিল কেউ তাকে নিচ থেকে টানছে। আর সেটা মনে হতেই সে চিৎকার করে উঠেছিল।
ওই নির্জন বালির চরে কাশবন আর শুকনো বালি ছাড়া সেই চিৎকার শোনার জন্যে কারো থাকার কথা নয়। কিন্তু কাঠকুড়ানি এক মেয়ের দল সেটা আচমকাই শুনতে পেয়েছিল। আজকাল তিস্তার বুকে খুব অল্প স্বল্প কাঠ ভেসে আসে পাহাড় থেকে। তবু যদি আসে সেই আশায় এই মেয়ের দলগুলো ওত পেতে বসে থাকে। তাদের একদল ছুটে এল অর্কর কাছে। অর্ক তখনও চিৎকার করছে আর প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে ডুবে থাকা পা-কে টেনে তুলতে। মেয়েগুলো সেখানে পৌঁছেই হাসিতে ফেটে পড়ল। কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না অর্ককে সাহায্য করতে। একজন তো মুখ ভেংচে বলে বসল, ‘ঠিক আছে, মরু, মরু।‘ তারপর দলটা চলে গেল। অর্ক হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তাকে সাহায্য করার বদলে ওরা মরতে বলে গেল কেন? কিন্তু এ ব্যাপারে বেশীক্ষণ চিন্তা করার সময় তার ছিল না। এর মধ্যে হাঁটুর অনেকখানি ওপরে বালিজল চলে এসেছে। বেশী টানাটানি করলে পা আরো নিচে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সে শরীরটাকে কোনরকমে শুকনো বালির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করতে লাগল সাহায্যের আশায়।
মিনিট কয়েক বাদে দুজন লোক কাশবন সরিয়ে চলে এল কাছে। বোঝা যায় বেশ হাঁপাচ্ছে দুজনেই। এসেই একজন বলল, ‘ওঃ, ভেতরে ডোবেনি, আমি তো ভেবেছিলাম—, ধরো হাত দুটো।’
সঙ্গীটি বলল, ‘দাঁড়ান, আগে জিজ্ঞাসা করে দেখি।’ তারপর অর্কর কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, ‘কোথায় বাড়ি?’
অর্ক দেখল লোকটা মাঝবয়সী বাঙালি, কিন্তু ওর সঙ্গী যে তাকে তুলতে চেয়েছিল সে প্রৌঢ় এবং চেহারা দেখে মনে হয় অবাঙালি। অর্ক বাধ্য ছেলের মত জবাব দিল, ‘হাকিমপাড়ায়।’
‘এখানে রোজ আসো?’
‘না, আজ প্রথম এসেছিলাম।’
‘কেন এসেছিলে? মেয়েছেলে দেখতে?’
‘কি যা তা বলছেন?’ অর্ক রেগে গেল।
লোকটা বলল, ‘আবার মেজাজ দেখাচ্ছে দেখুন। তোমার মত ছেলেরা এখানে এসে ওই মেয়েদের বিরক্ত করে। বাবার নাম কি?’
অর্ক একবার ভাবলে জবাব দেবে কি না। কিন্তু সে এখন অসহায়। এরা যদি তাকে না তোলে তাহলে। সে শান্ত গলায় বলল, ‘অনিমেষ মিত্র।’ সঙ্গে সঙ্গে প্রৌঢ় লোকটি দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এল, ‘কি বললে? তুমি অনিমেষের ছেলে?’
‘হ্যাঁ। আপনারা আমার সম্পর্কে মিছিমিছি বাজে কথা বলেছেন।’
অর্কর গলা এবার আর শান্ত ছিল না।
প্রৌঢ় লোকটি এবার নিজেই অর্কর দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে টানতে শুরু করতে তার সঙ্গীও যোগ দিল। অর্ককে বালির ভেতর থেকে টেনে তুলতে ওদের বেশী কসরৎ করতে হল না। নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে প্রথমে মনে হয়েছিল পায়ে কোন সাড়া নেই। প্রৌঢ় মানুষটি তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন কেমন লাগছে?’
‘ঠিক আছে।’ অর্ক পা থেকে ভিজে বালি সরাচ্ছিল।
‘ওভাবে ওগুলো যাবে না, ধুয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু তুমি এখানে কি করতে এসেছিলে? এসব জায়গায় বেড়াতে আসে না কেউ। মাঝে মাঝেই এ ধরনের চোরাবালি ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া কিছু বাজে ছেলে এখানে ঘোরা ফেরা করে। ওই মেয়েগুলো যদি যাওয়ার পথে আমাদের না বলতো তাহলে সত্যি বিপদে পড়তে। রাত্রে এখানে নেকড়ে শেয়াল এখনও বের হয়। চল, পা ধুয়ে নেবে।’
সঙ্গীটি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘একে আপনি চেনেন?’
‘এখন চিনছি। এর বাবাকে আমি, হ্যাঁ, ঠিক এই বয়সেই প্রথম দেখেছিলাম। সেই চেহারার সঙ্গে খুব মিল আছে। তুমি অনিমেষের নাম অনেকবার শুনেছ।’
অর্ককে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রৌঢ় বলল।
‘অনিমেষ, মানে—কলকাতা থেকে—।’ সঙ্গীটি খোলসা করে বলতে চাইল না।
‘হ্যাঁ, ঠিকই।’ প্রৌঢ় লোকটি এবার অর্ককে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কি ভাই? তোমার বাবা আর আমি খুব ঘনিষ্ঠ।’
‘অর্ক।’
‘অর্ক। শব্দটার মানে কি?’
‘সূর্য।’
‘বাঃ, চমৎকার। খুব সুন্দর নাম। আমার নাম জুলিয়েন। আমি এখন কদিন ওই কাঠের বাড়িটায় আছি। ওখানে চল পা ধুয়ে নেবে। আমি এর মধ্যে একদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন কি তোমাকে দেখেছিলাম? মনে করতে পারছি না। আজকাল সব যেন ভুল হয়ে যায়।’
‘আমি আপনার নাম শুনেছি বাবার কাছে।’
‘শুনেছ?’ জুলিয়েন হেসে ফেলল, ‘চল, আজ তোমাদের বাড়িতে যাব। ভয় নেই, তোমার এই ডুবে যাওয়ার কথা অনিমেষকে বলব না। তবে তুমি এই চরে কখনও একা ঘুরবে না।’
হঠাৎ অর্ক প্রশ্ন করল, ‘আপনি এখন কি করেন?’
‘আমি? কিছু না, কিছুই না।’ তারপর কি ভেবে বলল, ‘একটা দেশ ওইরকম চোরাবালিতে আটকে পড়েছে, ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে। তুমি চেঁচাচ্ছিলে সাহায্যের আশায় কিন্তু এই দেশের মানুষগুলোর সেই শক্তিও নেই। যদি এই দেশটাকে টেনে তোলা যায় সেই পথটাই খুঁজছি ভাই।’
অর্ক বেশ অবাক হয়ে জুলিয়েনের দিকে তাকাল। এই মানুষটিকে তার হঠাৎ খুব ভাল লেগে গেল।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে জুলিয়েনের সঙ্গে আসতে আসতে অর্কর অনেক গল্প হল। জুলিয়েন কলকাতার খবর নিচ্ছিলেন। অর্ক তার পাড়ার বাইরে কোন খবর দিতে পারছিল না। কিন্তু জুলিয়েনের কথা শুনতে শুনতে সে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। বাড়িতে ঢুকে জুলিয়েনকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে সে ভেতরের বারান্দায় এসে অনিমেষকে ডাকল।
জুলিয়েনকে দেখে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কি খবর? হঠাৎ ডুব দিয়েছেন, ভেবেছিলাম এর মধ্যে আসবেন।’
জুলিয়েন বলল, ‘আপনার অনেক ঝামেলা গেল তাই বিরক্ত করতে চাইনি। আপনার ছেলের সঙ্গে হঠাৎ আলাপ হয়ে গেল আজ। তা এবার তো ফিরে যাওয়ার সময় হল। একদিন একটু বসা যাক।’
অনিমেষ হাসল, ‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? ওরা যাচ্ছে, আমি এখানেই থেকে যাচ্ছি।’
জুলিয়েন বিস্মিত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তাই?’