বিবাহিত মেয়েরা যেমন হয়
১. অধিকাংশ বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে আমি পনেরো সেকেন্ডের বেশি কথা বলতে পারি না। কারণ এরা কথা বলবার শুরুতেই সাধারণত স্বামী কি খেতে এবং পরতে পছন্দ করে তা-ই শোনায়। এছাড়া এদের নিজস্ব কোনও গল্প নেই। এসব গল্প করে এরা সমাজে টিকে থাকতে চায় কারণ এরা মনে করে টিকে থাকবার মত অন্য কোনও ব্যবস্থা এদের জন্য নেই।
সুতরাং স্বামী যদি ভালবেসে দামি শাড়ি কিনে দেয় কি সোনার গহনা গড়িয়ে দেয় কি আরও ভালবেসে জমির একটি দলিল ধরিয়ে দেয় হাতে—তবে আর রক্ষে নেই। এইসব বৈষয়িক সম্মোহনের কাছে দুর্বল মেয়েরা ক্রমশ পরাজিত হয়। কেউ পরাজিত হয় খুব দ্রুত, কেউ ধীরে। আসলে সংসারের এই সুখ নামক মোহটি একটি পাতকুয়োর মত। ব্যাঙ যেমন কুয়োটিকেই বিশাল দীঘি ভেবে আনন্দে লাফায় তেমন দুটো শাড়ি আর কানে নাকে ঝোলাবার কিছু ধাতব পদার্থ পেলেই নিজের সংসার কুয়োকেই এরা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড ভেবে ভুল করে। মানুষ ভুলে যায় যে স্বাধীনতা মানুষের সর্বপ্রথম অধিকার। নারী তার স্বাধীনতা বিক্রি করে একটি ঘরের কাছে। যদিও মানুষ । জানে ঘর কারও জগৎ নয়, ঘর হচ্ছে বিশ্রাম এবং নিতান্ত ব্যক্তিগত কাজকর্মের জন্য মানুষের । একটি নিজস্ব আড়াল। অথচ কোনও পুরুষ যখন বিয়ে করে, স্ত্রীকে সংসার এবং শেকল দুই-ই । উপহার দেয়। আসলে পুরুষ এককভাবে তা দেয় না। দেয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
সংসার কারও কর্ম হতে পারে, কারও বর্মও হতে পারে কিন্তু কারও ধর্ম হতে পারে না। যারা কারও ওপর এ জাতীয় ধর্ম চাপাতে চায় তারা আর যাই হোক ধামিক তো নয়-ই প্রকৃত মানুষও নয়।
২. বিজ্ঞাপনে নারীরা ব্যবহৃত হয়। কারণ কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারী তার আকর্ষণীয় দেহবল্লর ও সাজসজ্জা নিয়ে এমনভাবে উপস্থিত হয় যে পণ্যের চেয়ে প্রধান হয়ে ওঠে নারীই। আর সেই নারীর কারণে জনপ্রিয় হয় পণ্য। এতে ব্যবসায়িক লাভ হয় বটে কিন্তু যে নারী পণ্যের বিজ্ঞাপনের নামে পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় তার কী হয়? এদেশের যে কোনও পণ্যের বিজ্ঞাপনের নারীও এক ধরনের পণ্য। তার চোখ, ভুরু, চুল, নাক, ঠোঁটের হাসি, পীনোন্নত পয়োধর, তার সাত-পাক নৃত্যকে বাজারের পণ্যের চেয়েও বড় পণ্য হিসেবে বিচার করা হয়। এই বিজ্ঞাপনদাতা পণ্য-ব্যবসায়ীরা পণ্যের চেয়ে নারীকেই প্রধান করে তুলবার চেষ্টা চালায়। পুরুষের শেভিং-এর ব্লেড, সিগারেট, শার্টিং সুটিং, জুতো মোজা, শ্যাম্পু সাবান সব কিছুতেই অনাবশ্যক নারী এনে হাজির করা হয়। সেই নারীরা আসলে কোনও কাজ করছে না, তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এ সমাজে সম্ভবত ব্যবহৃত হওয়াই তার প্রধান কাজ।
৩. সেদিন এক কবরস্থানে ঢুকতে গিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে লেখা মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। এতকাল জেনে এসেছি প্রবেশ নিষেধ সাধারণত গরু ছাগলের জন্য হয়। এখন দেখি মহিলাদের জন্যও। সম্ভবত জন্তু ও মহিলাদের ক্ষেত্রেই যাবতীয় নিষেধ জারি হয়।
মৃত্যুই নারীকে কবরস্থানে ঢুকবার স্বাধীনতা দিতে পারে। তবে কি এই-ই সত্য যে নারীর না মরে মুক্তি নেই?
৪. এ নিয়ে দুবার তারা আমাকে জবেহ্ করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের স্বনামধন্য আলেম, ইসলামী রাজনীতির নেতৃবৃন্দ ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ। একবার সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস প্রসঙ্গে লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে বিবৃতি দেবার কারণে এবং দ্বিতীয়বার মেয়েদের পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রকাশের কারণে তারা জাতীয় দৈনিকে বিবৃতি দিয়েছেন যে আমাকে কতল করা ওয়াজিব।
এ আমি একেবারে অবিশ্বাস করি না যে, যে কোনওদিন তারা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে আমাকে জবেহ্ করতে পারেন। না, আমি এতটুকু ভয় পাচ্ছি না। সড়ক দুর্ঘটনা হতে পারে জেনেও কি আমি সড়কে নামি না? বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে মৃত্যু ঘটে বলে আমি কি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি না? করি। আমাকে এই সমাজের ভেতরই বাস করতে হবে, সমাজ আমাকে ফণা তুলে বারবার ছোবল দেবে জেনেও। আমি জানি না তাঁরা কেউ আছেন কি না যাঁদের কণ্ঠে এখনও মরচে ধরেনি, যাঁদের কলম এখনও আপসের ভাষা শেখেনি—নাকি তাঁরা আছেন, অনেকেই আছেন, কেবল আমি নারী বলে আমার পক্ষে দাঁড়াতে তাঁদের সঙ্কোচ হয়, যদিও তা সত্যের পক্ষে ।
সম্ভবত নিজেকে নিঃশব্দে কতল হতে দিয়ে আমাকে নারী-জন্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
৫. ইটালির প্রখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাসি বলেন—‘আমার ভেতরের ভ্রূণটিকে আমি বলেছি, প্রিয় শিশু জীবনটা হচ্ছে যুদ্ধ, নিরন্তর যুদ্ধ। জানতে চেয়েছি এই পুথিবীতে সে জন্ম নিতে চায় কি না। সে বলেছে, “নরকে যাও তুমি মা। আমি আর জন্ম নিচ্ছি না”।’