৩৮
নিমাইচরণ আছে নাকি? ও নিমাইচরণ!
নিমাই ঘরেই ছিল। মাটির মেঝেতে মেলা গর্ত হয়েছে, ধসে বসেও গেছে কিছু জায়গা। মাটি কুপিয়ে এনে ভরাট করছিল গলদ্ঘর্ম হয়ে। শাবলটা রেখে দরজার কাছে এসে দেখে, সনাতন দাঁড়িয়ে আছে। রোগা, কালো, ছোটখাটো সনাতনের সঙ্গে নিমাইয়ের নিজের একটা ভারি মিল আছে।
ক্ষেত কোপাচ্ছিলে নাকি হে! কাদামাটি মেখে বসে আছে যে!
নিমাই হাসল, না। বর্ষার পর দেখছি ঘরে মেলা গর্ত হয়ে আছে। পোকামাকড়ের তো অভাব নেই। মাটি ঠাসছি।
বীণাপাণি নেই বুঝি ঘরে?
না। এসো, ঘরে এসে বোসো।
দুনিয়াতে ভাল লোকের বড় অভাব যাচ্ছে। খুব টানাটানি। সনাতনকেও তাই তেমন ভাল লোক বলা যায় না। আজকাল পেটের দায়ে লোকে নানা ধান্দা আর ফিকিরে ঘোরে। টাকাটা সিকেটার জন্য জলের মতো মিছে কথা কয়। একসময়ে পগার সঙ্গে সাঁট ছিল সনাতনের। তবে ভাগীদার নয়, সঙ্গে সঙ্গে ফিকির নিয়ে ঘুরত। পগা খুন হওয়ার পর কাকার দল এর ওপরেও হামলা চালিয়েছিল, যদি চুরি-হওয়া ডলারের সন্ধান পাওয়া যায়। সনাতন ভাল লোক না হতে পারে, তবে নিমাইয়ের সঙ্গে বেশ বনিবনা আছে। একটা জায়গায় একটু অমিল। নিমাই এক বিয়ের বউ নিয়েই হিমসিম খায়, সনাতনের তিনখানা বিয়ে। সনাতন কিছু লাখোপতি লোক নয়, টানাটানির সংসারে তিনখানা বউ নিয়ে থাকতে বুকের পাটা লাগে। সনাতনের ওইটেই আছে। আর বিশেষ কিছু নেই।
রবারের চটিজোড়া বাইরে ছেড়ে সাবধানে ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক চেয়ে সনাতন বলল, বসার ব্যবস্থা নেই দেখছি।
নিমাই উদার গলায় বলে, বিছানাতেই বোসো না। জলচৌকি আর মোড়া উঠোনে, ডালের বড়ি রোদে দেওয়া হয়েছে। তা কি খবর-টবর বলো।
খবর বিশেষ কিছু নেই। দোকানখানা বেচে দিতে হল। চলছিল না তেমন।
নিমাই একটু অবাক হয়ে বলে, বেচে দিলে! এখন দোকানই হল বাঁধা লক্ষ্মী। আমি কতকাল ধরে চেষ্টা করেও দোকান দিতে পারলাম না আজও। আর তুমি বেচে দিলে!
বাজারে বা জমাটি জায়গায় দোকান হলে কি বেচতাম নাকি! তেমন আহাম্মক পাওনি। পাড়ার মধ্যে ছোট্টো কারবার। বাকি না দিলে দোকান চলে না, আদায় উসুল করতে নাভিশ্বাস ওঠে। ডিমসুতো থেকে জ্বর পেট-খারাপের অ্যালোপ্যাথি ওষুধ অবধি রাখতে হত। মাল কিনবার পয়সাটা কোথেকে আসবে বলে! তার ওপর ঘরে তিনখানা চামুণ্ডা খাঁড়া হাতে সর্বদা আমার মুণ্ডু খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই দিলাম বেচে। যা দাম উঠল তা ভাগ বাঁটোয়ারা করে দিয়ে দিয়েছি। এখন ঘরে খানিক শান্তি হয়েছে। মেয়েমানুষের মন্তর হল টাকা। যখনই লাফঝাঁপ করবে কিছু টাকা ফেলে দাও, মুখে কুলুপ।
তা নয় বুঝলুম, কিন্তু তোমার এখন চলবে কিসে?
আরে, সেই পরামর্শেই তো আসা তোমার কাছে। হাত পা ধুয়ে বোসো জুত করে। একটু বুদ্ধি বের করি দুজনায়।
নিমাইয়ের মনটা প্রসন্ন হল। তার সঙ্গে পরামর্শ খুব কম লোকই করে। সে হাতমুখ ধুয়ে গামছায় কষে হাত পা মুছে আলগোছে বিছানায় বসল। বলল, তারপর বলো।
সনাতন খুব নিবিষ্ট হয়ে ভাবছিল। বলল, দুনিয়ায় মেলা লোক করে-কর্মে খাচ্ছে, চোখের সামনে সব ধাঁ করে বড়লোক হয়ে যাচ্ছে, দেখছো তো! কিন্তু নিমাইচরণ, আমরা কমতিটা কিসে বলতে পারো? আমাদের কিছু হচ্ছে না কেন!
সকলের কি সব হয়? না সয়?
তুমি একটা সাধু-বোষ্টম মানুষ, ওকথা বলতে পারো। কিন্তু আমার অত বৈরাগ্য নেই। আমার দুটো পয়সার মুখ দেখতে ইচ্ছে যায়। তিনখানা সংসার বলে নয়, একটু মনের মতো থাকব—এ আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। কিন্তু কি করলে যে হবে, তা বুঝতে পারি না।
এক আহাম্মক এলেন আর এক আহাম্মকের কাছে বিষয়বুদ্ধি নিতে। সে বুদ্ধি থাকলে আমিই কি বসে থাকতাম নাকি!
সেইটে ভাবি বলেই তো তোমার কথাই আমার মনে পড়ে সবসময়ে। ভাবি কি জানো, আমারও ভিতরে মাল আছে, তোমারও ভিতরে আছে। একবার তেড়েফুঁড়ে লাগলে আমরাও কম যাই না। কি বলো?
গামছাখানা কোল থেকে তুলে নিমাই নিজের মুখটা মুছে বলে, কী করতে চাও বলো তো!
দোকান-টোকান আর করে লাভ নেই ভায়া। বড় ভ্যাদভ্যাদে কাজ। পয়সাও নেই, তার ওপর রোজ লোকজনের সঙ্গে আদায় উসুল নিয়ে ঝগড়া-কাজিয়া হচ্ছে। ও আমার আর ভাল লাগে না। একটু বড় কিছু ফাঁদতে না পারলে জীবনটাই বৃথা।
নিমাই একটু চুপ করে থেকে বলে, বড়লোক হতে সাধ হয়েছে বুঝি? কাজটা শক্ত।
সনাতন তার সরু মুখখানা ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে এগিয়ে এনে বলে, শক্তটা কিসের? আমাদের কোন জিনিসটা নেই বলো তো!
আমার কথা বলতে পারি। আমার টাকা নেই, বড় হওয়ার তেমন তেজালো ইচ্ছেও নেই। সেইজন্যই বীণার হাতে-তোলা হয়ে বসে আছি। মনে হচ্ছে আমাকে দিয়ে তেমন কিছু হবে না।
সনাতন একথায় যেন বসে বসেই নেচে উঠল, কেন হবে না? বুদ্ধি করে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে, ঠিকমতো টাকা খাটালে না হবে কেন? চারদিকে দুনিয়াটা ধাঁ-ধাঁ করে বেড়ে উঠছে, আমি যেন পিছিয়ে পড়ছি। অথচ ভেবে দেখেছি, আমার কিছু কমতি নেই। তোমারও নেই।
বললাম যে, আমার টাকা নেই। টাকা হলে ভেবে দেখতাম।
তোমার বউয়ের কিন্তু টাকা আছে।
তোমার মাথা! বউ কত টাকা মাইনে পেত জানো? বড়লোকের কুকুরের পিছনেও তার চেয়ে ঢের বেশী খরচ হয়। এই সবে দুদিন হল কাকা অন্য একটা কাজে লাগিয়েছে, কিছু বেশী পাচ্ছে।
নুন-পাস্তার জোগাড়টুকু তো আছে। তাই বা কম কিসে? আমি বলি কি এরকম জড়ভরত হয়ে থাকার চেয়ে কিছু একটাতে নেমে পড়ি চল।
কিসে নামবে? ভেবেছো কিছু?
না। তোমার সঙ্গে সেই নিয়েই কথা। কিছু একটা ঠিক করো তো! এভাবে আর পারা যায় না।
দোকান বেচে কত টাকা পেলে?
ও দোকানের দামই বা কী? মালের দাম সমেত দোকানঘরের জলেরই দাম ধরো।
কে কিনল?
লটারিওলা পন্টু। পাড়ার মধ্যে দোকান বলে দরটাও উঠল না।
না বেচলেই ভাল করতে।
ও কথা বোলো না। বাজারে চার হাজারেরও বেশী অনাদায়ী টাকা পড়ে আছে। মাল তুলতে পারছিলাম না। আদ্দেকের ওপর বাকির খদ্দের। পন্টু কিনল দোকান করবে বলে নয়। সে অন্য কারবার ফাঁদবে। এটাকে গুদামঘর করবে। তা তার যা-খুশি করুকগে। আমার আর ওসব ছোটখাটো কারবারের দিকে নজর নেই। তুমি কথাটা গ্রাহ্য করছে না কিন্তু!
করছি। কিন্তু মাথায় বুদ্ধি খেলছে না। সময় লাগবে।
সময় কি আর বসে থাকবে ভায়া! বয়সও বসে পান-তামাক খাবে না, জিরোবে না। কলঘড়ি টিকটিক করে খরচ হয়ে যাবে। আয়ুতে বেড় পাই এমন জিনিস করতে হবে।
আমার বিষয়বুদ্ধিতে মেলা ফাঁক। আমাকে দিয়ে বড় কিছু হওয়ার নয়। বীণা মনোহারি দোকানের কথা বলে, তাইতেই আমি ভয় খাই। ছোটখাটো একটা ফল-পাকুড়ের দোকান অবধিই আমার দৌড়।
ফলের দোকান থেকে ক’ পয়সাই বা পাবে? একটু বড় কিছু ভাবো। ঠিকাদারি-টারি করলে হয় বা একটা কারখানা গোছের কিছু।
উরেব্বাস! তোমাকে নির্ঘাৎ ভূতে পেয়েছে।
কেন? কী এমন বললাম?
আমি এক ঠিকাদারের চৌকিদার ছিলাম, তাতে টাকার খেলা বড় কম দেখিনি। গোডাউনে দেড় দু’লাখ টাকার মাল সবসময়ে থাকত। পাঁচ-সাতটা ট্রাক রোজ খেপ মারত। পঞ্চাশটা কর্মচারী আর শ’খানেক কুলির বেতন, ইঁট, পাথর, সিমেন্ট, কাঠ কত কি জোগাড় করতে হত, হিসেব রাখতে হত! ও সে এক গন্ধমাদন ব্যাপার।
সনাতন একটু যেন দমে গেল। তারপর বলল, আচ্ছা, প্লাস্টিকের ব্যাগের কারবারটা কেমন? ধরো যদি নিজেরা তৈরি করে বেচি?
সব ব্যবসাই ভাল। সব কিছুরই বাজার আছে। তবে অন্ধিসন্ধি জানা চাই।
কে একজন বলছিল সেদিন, এ তল্লাটে দেশলাই তৈরির কারখানা নেই। সেটা করলেও তো হয়।
হয় তো বটেই। ফেল কড়ি, মাখো তেল। দেশলাই করতেও কম হাঙ্গামা নাকি?
তুমি সব কথাতেই জল ঢেলে দিচ্ছো! সকালবেলাটায় তোমার কাছ থেকে দুটো ভাল কথা শুনতে এলাম।
নিমাই হেসে বলে, ভাল কথা আজকাল আর পেটে আসতে চায় না। ভাল কথা মানেই মিছে কথা। মন-রাখা কথা। কথা দিয়ে কীই বা হয়! তা বাড়ির অবস্থা কী তোমার? ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে না তাহলে?
সনাতন একটা ভ্যাংচানি দেওয়ার মতো মুখ করে বলে, আমাদের সংসারে ঝগড়া দিয়ে দিন শুরু হয়, ঝগড়া দিয়েই শেষ হয়। ঘুম ভাঙল কি লেগে পড়ল। মানুষ যে মানুষের এত শক্র হয়, তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। ভাবি, একটা কাজকারবার নিয়ে মেতে থাকলে সংসার থেকে একটু তফাতে থাকতে পারতাম।
সংসার মানেই ভেজাল। ও নিয়ে ভেবে কী হবে?
আজকাল আর ভাবি না। টাকাপয়সা দিয়ে দিয়েছি, এখন নিজের নিজের আখের দেখুক।
নিমাই হাসল, ওটা একটা কথা হল? সংসার যদি এত জঞ্জাল তবে তিন তিনটে বউ ঘাড়ে নিলে কেন?
সনাতন চুপ করে রইল। কৃতকর্মের জন্য দুঃখেই বোধ হয়। তারপর বলল, একটা বড় রকমের কিছু আমাকে করতেই হবে। তখন তোমাকেও সঙ্গে নেবো।
নিও। বেকার বসে আছি, কোনও কাজে লাগলে ভালই হবে। তবে হঠাৎ করে বড় লাফ দিও না। মাজা ভাঙবে।
তা ভাঙুক। তেমন বড় করে না ফাঁদতে পারলে বেঁচেই বা কী সুখ হচ্ছে বলো তো! তোমার কাছে দুদণ্ড বসলে মনে বেশ শান্তি পাই।
সনাতন আরও খানিক আগডুম বাগডুম বলে বিদায় নিল। দোকানে গিয়ে এখন সময় কাটছে না তার।
নিমাই হাতের কাজ সারতে ফের উঠে পড়ল। ঘরের পিছন দিকটার ভিত ক্ষয়ে গেছে অনেক। বেড়ার নিচে বেশ বড় গর্ত। চোর এলে আর সিঁদ কাটতে হবে না। সেখানটায় মাটি চেপে বসানো কঠিন কাজ। অনেকটা সময় লাগল নিমাইয়ের। ঘরে আর একটা গর্ত বেরোলো মাটির একটা জালার নিচে। সেটায় মাটি ঠাসতে গিয়ে ভিতরে সাদামতো কী একটা নজরে পড়ে গেল তার। প্লাস্টিকে মোড়া একটা টিফিন বাক্সের মতো।
নিমাই হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা টেনে বের করল। তারপর অবাক হয়ে দেখল, সাদা রঙের খুব বড় একটা টিফিন বাক্সই। কিছুদিন আগে তাকে দিয়েই এটা কিনিয়ে এনেছিল বীণা। বাক্সটা খুলে সে আরও হাঁ হয়ে গেল। ভিতরে বেশ একটা মোটাসোটা প্যাকেট। ওজন আছে। প্যাকেটটা খুলে এত হতভম্ব হয়ে গেল নিমাই যে, পাক্কা দশ মিনিট চেয়ে বজ্রাহতের মতো বসে রইল। দরজা জানালা হাট করে খোলা। সেটা খেয়াল ছিল না নিমাইয়ের। তার মনে তো পাপ নেই। মৃদু একটা গলা খাঁকারির শব্দে একবার চেয়ে দেখল, সনাতন ফিরে এসেছে। দরজার বাইরে থেকে হাঁ করে দেখছে তাকে। কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে সে পট করে ঘুরে পা চালিয়ে চলে গেল।
এই সেই জিনিস যার জন্য এত খুনখারাপি, এত অশান্তি! এল কোথা থেকে? না, বেশী বুদ্ধি খাটাতে হল না তাকে। দুইয়ে দুইয়ে যোগ করলে যে চার হয় এটা এ যুগে কে না জানে?
নিমাই প্যাকেটটা সাবধানে মুড়ে ফের গর্তের মধ্যেই রেখে দিল। ওপরে মাটি ঠেসে দিল ভাল করে। গোবর মাটি গুলে সারা ঘর নিকিয়ে দিল। আজ রোদ উঠেছে চড়চড়ে। তাড়াতাড়ি ঘর শুকিয়ে যাবে।
উঠোনে কলমের আমগাছটার তলায় বসে নিমাই আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতে লাগল। অনেক কথাই মনে পড়ল তার। বীণা তাকে একদিন বলেছিল, হঠাৎ লটারির টাকা পেলে সেটা অধর্ম হবে কিনা! আরও অনেক কিছু।
বীণার নতুন চাকরিটা হওয়ার পর থেকে দিনের বেলাটায় নিমাইকেই রাঁধতে হয়। বীণা সময় পায় না। কাকার কারবার দু’মাস ঝিমিয়েছিল, এখন আবার রমরম করে চলছে। বীণার এখন অনেক কাজ।
রান্না সামান্যই হয়। একটা ঝোল আর ভাত। বড় জোর তার সঙ্গে কিছু একটা সেদ্ধ। নিমাই সেটা করে ফেলল। স্নান করে চুপচাপ বসে রইল ফের গাছতলায়।
বীণা ফিরল দুপুর গড়িয়ে। মুখখানা বেশ হাসিখুশি। নতুন চাকরিতে নতুন রকমের সুখ আছে। শোনা যাচ্ছে স্মাগলিংটা ঠিকমতো চললে বিশ্ববিজয় অপেরার পালাও নামবে। সেটা পুজোর মধ্যেই।
খেতে বসে বীণা বলল, কী গো, মুখখানা আজ অমন কেলে হাঁড়ির মতো কেন? কী হল আবার?
বলতে সাহস হয় না।
বীণা একটু অবাক হয়ে বলে, কী এমন কথা!
জিজ্ঞেস করলে সত্যি কথা বলবে তো?
বলব না কেন? কী হয়েছে?
আজ ঘর মেরামত করতে গিয়ে জালার নিচের গর্তে একটা জিনিস পেলাম। একটা প্যাকেট। তাতে মেলা ডলার আর পাউন্ড।
বীণার মুখখানা হঠাৎ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। চোখের পলক নেই।
এ কি পগার সেই জিনিস বীণা?
বীণা মাথাটা ধীরে নামিয়ে নিল। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলল, হ্যাঁ।
সে রেখে গিয়েছিল তোমার কাছে?
হ্যাঁ।
বলোনি তো!
বললে তুমি রাখতে দিতে আমার কাছে?
না। কিন্তু সে পরের কথা। বললানি কেন?
বলিনি, তোমাকে বিপদে ফেলতে চাইনি বলে।
নিমাই দুঃখে ছলোছলো চোখে বলে, পরের জিনিস ফিরিয়ে দিলে না কেন? ওতে যে কত সর্বনাশ হয়ে গেল!
কাকে ফিরিয়ে দিতাম বলল তো! কার টাকা ওটা? পগা রেখে গিয়েছিল। সে খুন হল তো টাকার ওয়ারিশ কে? কাকে গিয়ে বলব যে, এই হল পগার টাকা, আপনি নিন?
কাকা যখন এল তখন দিলে না কেন?
ওকে দেব কেন? ও টাকা তো কাকার নয়, পাপা সিং-এর কিনা তাও ঠিকমতো জানি না। তবে পাপের টাকা, এটা ঠিক। তাই ভাবলাম, এ টাকা আসলে কারও নয়। যে পাবে তার। কাউকে বলিনি, লুকিয়ে রেখেছি। তবে তোমাকে বলতে চেয়েছি অনেক বার। কিন্তু তুমি অবুঝ মানুষ, সাধুসন্ত মানুষ, তুমি সংসারী মানুষের মাথা দিয়ে চিন্তা করবে না। তাই সাহস হয়নি।
টাকাটা আমাদের তো নয় বীণা।
তাই বা বলছো কি করে? টাকার গায়ে কি কারও নাম লেখা আছে? পগা তো আমাকে বলে যায়নি এ টাকা কাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। বলে গেলে দিতাম।
কিন্তু দুটো লোক যে খুন হল!
খুন হয়েছে তার আমি কী করব বলো? এক-আধবার ইচ্ছে হয়েছে কাকাকে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসি। পরে ভেবেছি, সময়মতো দিইনি, এখন দিলে হয়তো লোকটা রেগে যাবে, আমাকেও আর বিশ্বাস করবে না। সংসারে চলতে অনেক কূটবুদ্ধি চাই গো। শুধু ভালমানুষী নিয়ে চলা কঠিন।
নিমাই মাথা নেড়ে বলে, কথাটা মানতে পারি না। টাকাটা যখন আমাদের নয় তখন ওটা লুকিয়ে রেখে নিজের অশান্তি বাড়াতে গেলে কেন?
তোমাকে বলব বলে ভেবেছিলাম। তবে আরও পরে। আমাদের যা অবস্থা তাতে চলে না। ভেবেছিলাম তোমাকে সব খুলে বলে এ টাকা দিয়ে তোমাকে একটা ভাল দোকান করে দেবো। তারপর নাটক-ফাটক সব ছেড়ে দিয়ে সংসার করব।
এরকম ভাবতে পারলে বীণা!
জানি তো, তুমি মানবে না। তবু টাকাটা ঘরে আছে বলে একটু যেন জোর পাই। আগে বলো, টাকাটা কি সরিয়ে ফেলেছো?
না বীণা। সরাবো কেন? যেখানে ছিল সেখানেই আছে।
আমাকে তোমার ঘেন্না হচ্ছে?
নিমাই সবেগে মাথা নেড়ে বলে, তোমাকে ঘেন্না করার সাধ্যিই আমার নেই। কিন্তু বড় মায়া হয়, দুঃখ হয়। লোভের জালে পড়লে মানুষের বড় কষ্ট।
তোমার কেবল ওই কথা!
আমি যা বলি তা যদি মানতে না পারো মেনে না। কিন্তু কথাটা বড় খাঁটি। তবে কিনা আমার মুখে মানায় না।
আমি তো বলছি তুমি ভাল লোক। তোমাকে কোনও পাপ করতে হবে না। পাপ শুধু এই পাপীয়সীই করুক। তুমি বাধা না দিলেই হল।
তাহলে কি তুমি আমার কেউ নও? সম্পর্কটা কি এমন যে, তোমার মন্দ হলেও চুপ করে থাকব?
চুপ করে না থাকলে যে আমাদের উপায় নেই!
নিমাই কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে বলে, টাকাটা নষ্ট করে ফেলবে বীণা?
বীণা চমকে উঠে বলে, বলো কী! লক্ষ্মী সেধে ঘরে এসেছেন, নষ্ট করে ফেলব কেন?
নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, লক্ষ্মী চোরাপথে এলে আর লক্ষ্মী থাকে না কিনা। টাকাটা বড়ই অলক্ষুণে। পগা গেল, আর দু-দুটো তরতাজা লোক চলে গেল। সেই খুন-হওয়াদের একজনের চাকরিতেই তুমি ঢুকেছো। কেমন যেন অসোয়াস্তি হচ্ছে। লক্ষণ কিছু ভাল দেখছি না।
বীণা একটু নরম হয়ে বলল, টাকাটা নিয়ে তুমি যে অশান্তি করবে তা জানতাম। শোনো, ও টাকা যেমন আছে থাক, আমি ওটাতে হাত দেবো না। টাকাটা আমাদের ঘরে ঘুমিয়ে থাকবে। তাহলে তোমার আপত্তি নেই তো?
নিমাই কাহিল মুখে বীণার দিকে চেয়ে থেকে বলে, কিসে পাপ হয়, কোথা থেকে কোন ফুটো দিয়ে কর্মফল এসে ঢোকে, তা কে জানে! আমি বোকাবুদ্ধির মানুষ। সাদামাটা কী বুঝি জানো? ওসবের মধ্যে জড়াতে নেই! রাস্তায় পয়সা পড়ে থাকলেও আমি কখনও কুড়োই না। পয়সা বড় মারাত্মক জিনিস।
তুমি ভয়েই মরলে। ভয়-ভয় ভাব সবসময়ে থাকলে মনটা দুর্বল হয়ে যায়। অত ভয় পেয়ো না তো! আমরা গরিব মানুষ, আমাদের অত খুঁটিনাটি পাপ ভগবান ধরবেন না। গরিবের পাপ তাপ ভগবান মকুব করে দেন।
ওরকম বুদ্ধি ভাল নয় বীণা। পয়সা জিনিসটাই খারাপ। কত লোভী, পাপী, খুনী, কৃপণের হাত ফেরতা হয়ে তবে আমাদের হাতে আসে। আমার কী মনে হয় জানো? পয়সার মধ্যে ওসব মানুষের ছাপ থেকে যায়। এক একটা টাকা যেন অনেক লোভ পাপ দীর্ঘশ্বাস ধরে রাখে।
তোমাকে যে পাগলামিতে ধরেছে গো!
তা হবে। আমার মনটা বড় খারাপ। তার ওপর সনাতনটাও দেখে গেল।
বীণা ভয়ঙ্কর চমকে উঠে বলল, সনাতন দেখে গেল মানে?
আজ সকালে এসেছিল বুদ্ধি পরামর্শ করতে। নতুন কারবার খুলতে চায়। সে চলে যাওয়ার পর ঘর সারতে গিয়ে বাক্সটা পেলাম। পেয়ে যখন মাথায় হাত দিয়ে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি, তখন কী মনে করে সনাতন ফিরে এসেছিল। দরজার বাইরে থেকেই নজর করেছে বোধ হয়। কিছু না বলে তাড়াতাড়ি চলে গেল।
সর্বনাশ!
নিমাই মাথাটা বুঝদারের মতো নেড়ে বলে, সর্বনাশেরই কথা কিনা! টাকা বড় সর্বনেশে জিনিস। তার ওপর এ হল বেওয়ারিশ টাকা, অধর্মের জিনিস। যতক্ষণ ঘরে থাকবে ততক্ষণ তোমাকে ভয়ের বাঘে খাবে, লোভের ভালুক এসে সাপটে ধরবে। সনাতন জেনে গেল বলে ভয় পাচ্ছো, হক্কের টাকা হলে ভয়ের কিছু ছিল, বলো?
তুমি ভাষণটা একটু থামাবে? কত বড় বিপদ ডেকে আনলে বলল তো! আহাম্মকের মতো সব বের করে বসেই বা ছিলে কেন? এখন কী হবে!
নিমাই মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, আমি তো জন্ম-আহাম্মক। আমার কথা বাদ দাও।
বীণা কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, পল্টুও খানিকটা জানে। একবার ওকে কয়েকটা ডলার বেচে যে কী বোকামিই করেছি! নাঃ, বনগাঁয়ে আর থাকা যাবে না। হ্যাঁ গো, পালপাড়ায় যাবে?
পালপাড়া! সেখানে গিয়ে কী হবে?
হবে কিছু একটা।
পালাতে চাইছো নাকি? ওতে সুবিধে হবে না। পালপাড়া তো আর তেমন দূরের জায়গা নয়। এদের পাল্লার মধ্যেই।
বীণা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, তাহলে কী হবে? আমার যে সব গেল। কাকার কানে কথাটা গেলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
নিমাই খুব শান্ত ঠাণ্ডা গলায় বলল, মানুষ ভয় পেলে নানা আগড়ম বাগড়ম ভাবতে থাকে, উল্টোপাল্টা সব চিন্তা আসে। বীণাপাণি, ভয়টাকে যে কেন ঘরে পুষে রেখেছো সেটা ভাল করে ভেবে দেখ।
সব নষ্টের গোড়া তো তুমি! কেন যে মাটি খুঁড়ে বের করলে লুকোনো জিনিসটা!
নিমাই মাথা নেড়ে বলে, সব ভবিতব্য। আমার তো ও বস্তুর খোঁজ পাওয়ার কথাই নয়। কিন্তু দেখ ভবিতব্য এমন যে, তুমিই আমাকে ক’দিন ধরে কেবলই বলে যাচ্ছো, ওগো, ঘরদোর যে গেল, গর্তগুলো. এবার বুজিয়ে ফেল। জানোই তো ঘর সারতে গেলে ওটা চোখে পড়ে যেতে পারে। মাটির নিচে যে তোমার প্রাণভোমরা রয়েছে সে তো আমার জানার কথা নয়! খুলে দেখে তো আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
বড্ড বকো তুমি। অত কথা বললে মানুষের পেটে কথা থাকে না। তোমার জন্যই আমার একদিন মরণ লেখা আছে কপালে। কেবল নীতিকথা কইলে পেট চালাই কি করে? শোনো, ও টাকা কারও হক্কের টাকা নয়। কেউ ওর ওয়ারিশও নয়। আমার হাতে যখন আছে তখন ওটা আমার। কাউকে দানছত্তর করতে পারব না, মা-লক্ষ্মীকে তাড়াতেও পারব না। ওসব অলক্ষুণে চিন্তা মাথা থেকে তাড়াও। ও টাকাকে রক্ষা করতে হলে কী করতে হবে, সেইটে ভেবে দেখ পালপাড়ায় গেলে আপাতত হয়তো কথা উঠবে না।
উঠবে। কাকার চাকরি ছেড়ে পালপাড়ায় যেতে হলে জুতসই একটা অজুহাত চাই।
অত সব খুঁটিনাটি নিয়ে ভাববার সময় নেই। আমি টাকাটা এমন ভাবে লুকিয়ে ফেলতে চাই যাতে কেউ মাথা খুঁড়েও সন্ধান না পায়। কিন্তু এ বাড়িতে সেটা হবে না। বড্ড খোলামেলা বাড়ি।
নিমাই মৃদুস্বরে বলল, টাকাটার ফাঁদে ভাল করেই জড়িয়ে পড়লে বীণা!
আচ্ছা, তুমি কেমনধারা মানুষ বলো তো! জীবনে এত দুঃখকষ্ট সয়েছো, এত হেনস্থা হয়েছে, তবু তোমার একটুও লোভ হয় না কেন? হ্যাঁ গো, তোমার মাথার ব্যামো নয়তো এটা!
নিমাই এই গুরুতর পরিস্থিতিতেও এ কথা শুনে হাসল। বলল, পাগল বলতে চাইছো তো! সে তো অনেকবার শুনেছি।
সনাতন দেখে ফেলেছে, এখন আমার বড় ভয় হচ্ছে। সনাতনটা ভীষণ পাজি।
অত ঘাবড়ে যেও না। সনাতন দেখেছে বটে, কিন্তু বুঝেছে কিনা তা এখনও জানি না। কথা হোক তখন যদি টানেটোনে কিছু বলে তো বোঝা যাবে।
পল্টুও বুঝেছে। বনগাঁ আমার পক্ষে বিপদের হয়ে উঠছে।
পল্টু তেমন লোক নয়। সনাতনের দোকানটা কিনেছে, জানো তো! পন্টুর হাতে এখন মেলা টাকা। ও নিজের কারবার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তোমাকে নিয়ে ভাবছে না।
কি করে বুঝলে?
আমার ভীষণ ভাব যে ওর সঙ্গে। খুব খাতির করে। সে পেট-পাতলা লোক নয়।
কাউকে বিশ্বাস নেই গো। বনগাঁয়ে যা সব লোক থাকে।
নিমাই ফের মাথা নেড়ে বলে, বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।
আচ্ছা, আমি নয় খারাপ। পচে গেছি, নষ্ট হয়ে গেছি। তবু এই দুর্দিনে দয়া করে আর শত্রুতা কোরো না। আমি পাপ করি, তাপ করি, নরকবাস তো আমিই করব। তুমি তো করবে না!
শক্রতা কিছু করলাম নাকি?
ওটাই শক্রতা। ওই যে আমাকে ভয় দেখাচ্ছো, টাকা নষ্ট করে ফেলতে বলছে, ওটাই এক ধরনের শত্রুতা।
আমি সাত দিন সাত রাত ভেবেও ঠিক পাবো না, কথাটা বলায় শত্রুতা হল কি করে!
সে তুমি ভাবো গে। এখন শোনো, ওই সনাতন শয়তানটা কী দেখেছে আর কী আঁচ করেছে সেটা বুঝবার চেষ্টা করো। হুটপাট কোরো না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কথা বলে দেখো। হয়তো মুখ বন্ধ রাখতে ঘুষ চাইবে।
তাও দেবে?
না, দেবো না।
আমার মাথা গরম হওয়ার কারণ নেই বীণাপাণি। কিন্তু তুমি বড় উচাটন হয়ে পড়েছো। সনাতন আমার মতোই অপদার্থ লোক। বুদ্ধি নেই, চার চোরকো চালাকও নয়। সবচেয়ে বড় কথা ভীতু মানুষ। কিছু দেখে থাকলেও এখনই অস্থির হওয়ার কিছু নেই। শান্ত হও বীণাপাণি। খাও।
খাওয়া! তাই তো! দুজনে ভাত পাতে বসে আছি সেটাই যে খেয়াল ছিল না এতক্ষণ!
তাই দেখছিলাম। সব ঠাণ্ডা মেরে গেল। ঝোলটা কেমন হয়েছে?
তুমি তো সুন্দর রাঁধো।
আজ স্বাদ পাচ্ছো?
পাচ্ছি গো।
বীণাপাণি কয়েক গ্রাস ভাত খেল। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল যে জোর করে খাচ্ছে। তার খিদে নেই বা রুচি হচ্ছে না।
নিমাই হঠাৎ বলল, তোমার সবচেয়ে বেশী ভয় কাকে বীণাপাণি? সবচেয়ে অবিশ্বাস করো কাকে? সে কি আমি?
বীণাপাণি অবাক হয়ে বলে, ওমা! সে কি কথা?
সেইজন্যই না ওসব কথা চেপে রেখেছিলে! আমাকে তুমি বিশ্বাসও করো না, না?
মোটেই তা নয়। আসলে তুমি দূর্বল লোক বলে তোমাকে সব কথা বলতে ভয় পাই।
বুঝেছি। ঠিকই করো। আমাকে বিশ্বাস করা বোধ হয় ঠিকও নয়।
আহা, আবার অভিমান করছে দেখ। আমার মন ভাল নেই, এখন অমন মুখ গোমড়া করে থেকো না তো! একটু বল-ভরসা দাও।
নিমাই বীণাপাণির দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, তোমার-আমার সম্পর্কটা ঠিক এরকম হওয়ার কথা নয় বীণাপাণি। এ যেন, সে আর লালন একখানে রয়, লক্ষ যোজন ফাঁক।