নবম পরিচ্ছেদ
সেবক হৃদয়ে
সন্ধ্যার পূর্বে মণি বেড়াইতেছেন ও ভাবিতেছেন — “রামের ইচ্ছা” এটি তো বেশ কথা! এতে তো Predestination আর Free will, Liberty আর — Necessity এ-সব ঝগড়া মিটে যাচ্ছে। আমায় ডাকাতে ধরে নিলে “রামের ইচ্ছায়”; আবার আমি তামাক খাচ্ছি “রামের ইচ্ছায়”, আমি ডাকাতি করছি “রামের ইচ্ছায়। আমায় পুলিসে ধরলে “রামের ইচ্ছায়”, আমি সাধু হয়েছি “রামের ইচ্ছায়”, আমি প্রার্থনা করছি, “হে প্রভু আমায় অসদ্বুদ্ধি দিও না — আমাকে দিয়ে ডাকাতি করিয়ো না” — এও “রামের ইচ্ছা”। সৎ ইচ্ছা, অসৎ ইচ্ছা তিনি দিচ্ছেন। তবে একটা কথা আছে, অসৎ ইচ্ছা তিনি কেন দিবেন — ডাকাতি করবার ইচ্ছা তিনি কেন দিবেন? তার উত্তরে ঠাকুর বলেন এই, — তিনি জানোয়ারের ভিতর যেমন বাঘ, সিংহ, সাপ করেছেন; গাছের ভিতর যেমন বিষগাছও করেছেন, সেইরূপ মানুষের ভিতর চোর, ডাকাতও করেছেন। কেন করেছেন? কেন করেছেন, তা কে বলবে? ঈশ্বরকে কে বুঝবে?
“কিন্তু তিনি যদি সব করেছেন, Sense of responsibility তো যায়; তা কেন যাবে? ঈশ্বরকে না জানলে, তাঁর দর্শন হলে “রামের ইচ্ছা”, এটি ষোল আনা বোধই হবে না। তাঁকে লাভ না করলে এটি এক-একবার বোধ হয়; আবার ভূল হয়ে যাবে। যতক্ষণ না পূর্ণ বিশ্বাস হয়, ততক্ষণ পাপ-পুণ্য বোধ, responsibility বোধ, থাকবেই থাকবে। ঠাকুর বুঝালেন, “রামের ইচ্ছা”। তোতা পাখির মতো “রামের ইচ্ছা” মুখে বললে হয় না। যতক্ষণ ঈশ্বরকে জানা না হয়, তাঁর ইচ্ছায় আমার ইচ্ছায় এক না হয়, যতক্ষণ না “আমি যন্ত্র” ঠিক বোধ হয়, ততক্ষণ তিনি পাপ-পুণ্য বোধ, সুখ-দুঃখ বোধ, শুচি-অশুচি বোধ, ভাল-মন্দ বোধ রেখে দেন; Sense of responsibility রেখে দেন; তা না হলে তাঁর মায়ার সংসার কেমন করে চলবে?
“ঠাকুরের ভক্তির কথা যত ভাবিতেছি, ততই অবাক্ হইতেছি। কেশব সেন হরিনাম করেন, ঈশ্বরচিন্তা করেন, অমনি তাঁকে দেখতে ছুটেছেন, — অমনি কেশব আপনার লোক হলেন। তখন কাপ্তেনের কথা আর শুনলেন না। তিনি বিলাতে গিয়াছিলেন, সাহেবদের সঙ্গে খেয়েছেন, কন্যাকে ভিন্ন জাতিতে বিবাহ দিয়াছেন — এ-সব কথা ভেসে গেল! কুলটি খাই, কাঁটায় আমার কি কাজ? ভক্তিসূত্রে সাকারবাদী, নিরাকারবাদী এক হয়; হিন্দু মুসলমান, খ্রীষ্টান এক হয়; চারি বর্ণ এক হয়। ভক্তিরই জয়। ধন্য শ্রীরামকৃষ্ণ! তোমারই জয়। তুমি সনাতন ধর্মের এই বিশ্বজনীন ভাব আবার মূর্তিমান করিলে। তাই বুঝি তোমার এত আকর্ষণ! সকল ধর্মাবলম্বীদের তুমি পরমাত্মীয়-নির্বিশেষে আলিঙ্গন করিতেছ! তোমার এক কষ্টিপাথর ভক্তি। তুমি কেবল দেখ — অন্তরে ঈশ্বরে ভালবাসা ও ভক্তি আছে কিনা। যদি তা থাকে অমনি সে তোমার পরম আত্মীয় — হিন্দুর যদি ভক্তি দেখ, অমনি সে তোমার আত্মীয় — মুসলমানের যদি আল্লার উপর ভক্তি থাকে, সেও তোমার আপনার লোক — খ্রীষ্টানদের যদি যীশুর উপর ভক্তি থাকে, সেও তোমার পরম আত্মীয়। তুমি বল যে, সব নদীই ভিন্ন দিগ্দেশ হইতে আসিয়া এক সমুদ্রমধ্যে পড়িতেছে। সকলেরই উদ্দেশ্য এক সমুদ্র।
“ঠাকুর এই জগৎ স্বপ্নবৎ বলছেন না। বলেন, ‘তাহলে ওজনে কম পড়ে’। মায়াবাদ নয়। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ। কেন না, জীবজগৎ অলীক বলছেন না, মনের ভুল বলছেন না। ঈশ্বর সত্য আবার মানুষ সত্য, জগৎ সত্য। জীবজগৎবিশিষ্ট ব্রহ্ম। বিচি খোলা বাদ দিলে সব বেলটা পাওয়া যায় না।
“শুনিলাম, এই জগৎব্রহ্মাণ্ড মহাচিদাকাশে আবির্ভূত হইতেছে আবার কালে লয় হইতেছে — মহাসমুদ্রে তরঙ্গ উঠিতেছে আবার কালে লয় হইতেছে! আনন্দসিন্ধুনীরে অনন্ত-লীলাহরী! এ লীলার আদি কোথায়? অন্ত কোথায়? তাহা মুখে বলিবার জো নাই — মনে চিন্তা করিবার জো নাই। মানুষ কতটুকু! তার বুদ্ধিই বা কতটুকু! শুনিলাম মহাপুরুষেরা সমাধিস্থ হয়ে সেই নিত্য পরমপুরুষকে দর্শন করেছেন — নিত্য লীলাময় হরিকে সাক্ষাৎকার করেছেন। অবশ্য করেছেন, কেননা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও বলিতেছেন। তবে এ-চর্মচক্ষে নয়, বোধ হয় দিব্যচক্ষু যাহাকে বলে তাহার দ্বারা; যে দিব্যচক্ষু পাইয়া অর্জুন বিশ্বরূপ-দর্শন করেছিলেন, যে চক্ষুর দ্বারা ঋষিরা আত্মার সাক্ষাৎকার করেছিলেন, যে দিব্যচক্ষুর দ্বারা ঈশা তাঁহার স্বর্গীয় পিতাকে অহরহ দর্শন করিতেন। সে চক্ষু কিসে হয়? ঠাকুরের মুখে শুনিলাম ব্যাকুলতার দ্বারা হয়। এখন সে ব্যাকুলতা হয় কেমন করে, সংসার কি ত্যাগ করতে হবে? কই, তাও তো আজ বললেন না।”