দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ
প্রথম পরিচ্ছেদ
দক্ষিণেশ্বরে মনোমোহন, মহিমা প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
চল ভাই, আবার তাঁকে দর্শন করিতে যাই। সেই মহাপুরুষকে, সেই বালককে দেখিব, যিনি মা বই আর কিছু জানেন না; যিনি আমাদের জন্য দেহধারণ করে এসেছেন — তিনি বলে দেবেন, কি করে এই কঠিন জীবন-সমস্যা পূরণ করতে হবে! সন্ন্যাসীকে বলে দেবেন, গৃহীকে বলে দেবেন! অদ্বারিত দ্বার! দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়িতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। চল, চল, তাঁকে দেখব।
“অনন্ত গুণাধার প্রসন্নমূরতি, শ্রবণে যাঁর কথা আঁখি ঝরে!”
চল ভাই, অহেতুক-কৃপাসিন্ধু, প্রিয়দর্শন, ঈশ্বরপ্রেমে নিশিদিন মাতোয়ারা, সহাস্যবদন শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করে মানব-জীবন সার্থক করি!
আজ রবিবার, ২৬শে অক্টোবর, ১৮৮৪; হেমন্তকাল। কার্তিকের শুক্লা সপ্তমী তিথি। দু’প্রহর বেলা। ঠাকুরের সেই পূর্বপরিচিত ঘরে ভক্তেরা সমবেত হইয়াছেন। সে ঘরের পশ্চিম গায়ে অর্ধচন্দ্রাকার বারান্দা। বারান্দার পশ্চিমে উদ্যানপথ; উত্তর-দক্ষিণে যাইতেছে। পথের পশ্চিমে মা-কালীর পুষ্পোদ্যান, তাহার পরই পোস্তা, তৎপরে পবিত্র-সলিলা দক্ষিণবাহিনী গঙ্গা।
ভক্তেরা অনেকেই উপস্থিত। আজ আনন্দের হাট। আনন্দময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঈশ্বরপ্রেম ভক্তমুখদর্পণে মুকুরিত হইতেছিল। কি আশ্চর্য! আনন্দ কেবল ভক্তমুখদর্পণে কেন? বাহিরের উদ্যানে, বৃক্ষপত্রে, নানাবিধ যে কুসুম ফুটিয়া রহিয়াছে তন্মধ্যে, বিশাল ভাগীরথী বক্ষে, রবিকর প্রদীপ্ত নীলনভোমণ্ডলে, মুরারিচরণচ্যুত গঙ্গা-বারিকণাবাহী শীতল সমীরণ মধ্যে, এই আনন্দ প্রতিভাসিত হইতেছিল। কি আশ্চর্য! সত্য সত্যই “মধুমৎ পার্থিবং রজঃ” — উদ্যানের ধূলি পর্যন্ত মধুময়! — ইচ্ছা হয়, গোপনে বা ভক্তসঙ্গে এই ধূলির উপর গড়াগড়ি দিই! ইচ্ছা হয়, এই উদ্যানের একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া সমস্ত দিন এই মনোহারী গঙ্গাবারি দর্শন করি। ইচ্ছা হয়, এই উদ্যানের তরুলতাগুল্ম ও পত্রপুষ্পশোভিত স্নিগ্ধোজ্জ্বল বৃক্ষগুলিকে আত্মীয়জ্ঞানে সাদর সম্ভাষণ ও প্রেমালিঙ্গন দান করি। এই ধূলির উপর দিয়া কি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পাদচারণ করেন! এই বৃক্ষলতাগুল্মমধ্যে দিয়া তিনি কি অহরহ যাতায়াত করেন! ইচ্ছা করে জ্যোতির্ময় গগনপানে অনন্যদৃষ্টি হইয়া তাকাইয়া থাকি! কেননা দেখিতেছি ভূলোক-দ্যুলোক সমস্তই প্রেমানন্দে ভাসিতেছে!
ঠাকুরবড়ির পূজারী, দৌবারিক, পরিচারকম সকলকে কেন পরমাত্মীয় বোধ হইতেছে — কেন এ-স্থান বহুদিনানন্তে দৃষ্ট জন্মভূমির ন্যায় মধুর লাগিতেছে? আকাশ, গঙ্গা, দেবমন্দির, উদ্যানপথ, বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, সেবকগণ, আসনে উপবিষ্ট ভক্তগণ, সকলে যেন এক জিনিসের তৈয়ারী বোধ হইতেছে। যে জিনিসে নির্মিত শ্রীরামকৃষ্ণ, এঁরাও বোধ হইতেছে সেই জিনিসের হইবেন। যেন একটি মোমের বাগান, গাছপালা, ফল, পাতা, সব মোমের; বাগানের পথ, বাগানের মালী, বাগানের নিবাসীগণ, বাগান মধ্যস্থিত গৃহ সমস্তই মোমের। এখানকার সব আনন্দ দিয়ে গড়া!
শ্রীমনোমোহন, শ্রীযুক্ত মহিমাচরণ, মাস্টার উপস্থিত ছিলেন। ক্রমে ঈশান, হৃদয় ও হাজরা। এঁরা ছাড়া অনেক ভক্তেরা ছিলেন। বলরাম, রাখাল, এঁরা তখন শ্রীবৃন্দাবনধামে। এই সময়ে নূতন ভক্তেরা আসেন যান; নারাণ, পল্টু, ছোট নরেন, তেজচন্দ্র, বিনোদ, হরিপদ। বাবুরাম আসিয়া মাঝে মাঝে থাকেন। রাম, সুরেশ, কেদার ও দেবেন্দ্রাদি ভক্তগণ প্রায় আসেন — কেহ কেহ সপ্তাহান্তে, কেহ দুই সপ্তাহের পার। লাটু থাকেন। যোগীনের বাড়ি নিকটে, তিনি প্রায় প্রত্যহ যাতায়াত করেন। নরেন্দ্র মাঝে মাঝে আসেন, এলেই আনন্দের হাট। নরেন্দ্র তাঁহার সেই দেবদুর্লভ কণ্ঠে ভগবানের নামগুণগান করেন, অমনি ঠাকুরের নানাবিধ ভাব ও সমাধি হইতে থাকে। একটি যেন উৎসব পড়িয়া যায়। ঠাকুরের ভারী ইচ্ছা, ছেলেদের কেহ তাঁর কাছে রাত্রিদিন থাকেন, কেননা তারা শুদ্ধাত্মা, সংসারে বিবাহাদিসূত্রে বা বিষয়কর্মে আবদ্ধ হয় নাই। বাবুরামকে থাকিতে বলেন; তিনি মাঝে মাঝে থাকেন। শ্রীযুক্ত অধর সেন প্রায় আসেন।
ঘরের মধ্যে ভক্তেরা বসিয়া আছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বালকের ন্যায় দাঁড়াইয়া কি ভাবছেন। ভক্তেরা চেয়ে আছেন।
[অব্যক্ত ও ব্যক্ত — The Undifferentiated and the Diffrentiated]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মনোমোহনের প্রতি) — সব রাম দেখছি! তোমরা সব বসে আছ, দেখছি রামই সব এক-একটি হয়েছেন।
মনোমোহন — রামই সব হয়েছেন; তবে আপনি যেমন বলেন, “অপো নারায়ণ”, জলই নারায়ণ; কিন্তু কোন জল খাওয়া যায়, কোন জলে মুখ ধোয়া চলে, কোন জলে বাসন মাজা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, কিন্তু দেখছি তিনিই সব। জীবজগৎ তিনি হয়েছেন।
এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর ছোট খাটটিতে বসিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণের সত্যে আঁট ও সঞ্চয়ে বিঘ্ন ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণের প্রতি) — “হ্যাঁগা, সত্যকথা কহিতে হবে বলে কি আমার শুচিবাঈ হল নাকি! যদি হঠাৎ বলে ফেলি, খাব না, তবে খিদে পেলেও আর খাবার জো নাই। যদি বলি ঝাউতলায় আমার গাড়ু নিয়ে অমুক লোকের যেতে হবে, — আর কেউ নিয়ে গেলে তাকে আবার ফিরে যেতে বলতে হবে। একি হল বাপু! এর কি কোন উপায় নাই।
“আবার সঙ্গে করে কিছু আনবার জো নাই। পান, খাবার — কোন জিনিস সঙ্গে করে আনবার জো নাই। তাহলে সঞ্চয় হল কিনা। হাতে মাটি নিয়ে আসবার জো নাই।”
এই সময় একটি লোক আসিয়া বলিল, মহাশয়! হৃদয়[১] যদু মল্লিকের বাগানে এসেছে, ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে; আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের বলিতেছেন, হৃদের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি, তোমরা বসো। এই বলিয়া কালো বার্নিশ করা চটি জুতাটি পরে পূর্বদিকের ফটক অভিমুখে চলিলেন। সঙ্গে কেবল মাস্টার। লাল সুরকির উদ্যান-পথ। সেই পথে ঠাকুর পূর্বাস্য হইয়া যাইতেছেন। পথে খাজাঞ্চী দাঁড়াইয়াছিলেন ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন। দক্ষিণে উঠানের ফটক রহিল, সেখানে শ্মশ্রুবিশিষ্ট দৌবারিকগণ বসিয়াছিল। বামে কুঠি — বাবুদের বৈঠকখানা; আগে এখানে নীলকুঠি ছিল তাই কুঠি বলে। তৎপরে পথের দুইদিকে কুসুম বৃক্ষ, — অদূরে পথের ঠিক দক্ষিণদিকে গাজীতলা ও মা-কালীর পুষ্করিণীর সোপানাবলিশোভিত ঘাট। ক্রমে পূর্বদ্বার, বামদিকে দ্বারবানদের ঘর ও দক্ষিণে তুলসীমঞ্চ। উদ্যানের বাহিরে আসিয়া দেখেন, যদু মল্লিকের বাগানে ফটকের কাছে হৃদয় দণ্ডায়মান।
———————–
১ হৃদয় মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে ঠাকুরের ভাগিনেয়। ঠাকুরের জন্মভূমি কামারপুকুরের নিকট সিওড়ে হৃদয়ের বাড়ি। প্রায় বিংশতি বর্ষ ঠাকুরের কাছে থাকিয়া দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে মা-কালীর পূজা ও ঠাকুরের সেবা করিয়াছিলেন। তিনি বাগানের কর্তৃপক্ষীয়দের অসন্তোষভাজন হওয়াতে তাঁহার বাগানে প্রবেশ করিবার হুকুম ছিল না। হৃদয়ের মাতামহী ঠাকুরের পিসী।