1 of 3

৩৭. চপলা বাড়িতে পা দেওয়ার পর

॥ ৩৭ ॥

চপলা বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকে বঙ্গময়ী পারতপক্ষে ভিতর বাড়িতে আসে না। রোজ সকালে হেমকান্তকে একবার দেখা দিয়ে যেত, তাও এখন বন্ধ। কলঙ্কের আর কোনো ভয় নেই রঙ্গময়ীর। এ জীবনে সেটা যথেষ্ট হয়েছে। এমনও নয় যে, চপলা তাকে দেখলে অসন্তুষ্ট হবে বা অপমান করবে, তবু যে আসে না, তার কারণ কনককান্তি।

কনক তার চেয়ে বয়সে খুব একটা ছোটো নয়। মেরে কেটে দু-এক বছর। এক সময়ে কনককে সে কোলেপিঠে করেছে। বড় হয়ে একসঙ্গে খেলেছেও। কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর যখন বুঝসমঝ হল তখন থেকেই কনককান্তি তাকে একদম পছন্দ করে না। সম্ভবত নলিনীকান্ত এবং পরবর্তীকালে হেমকান্তর সঙ্গে তাকে জড়িয়ে যেসব কথা রটেছে তার জন্যই। কনককান্তি কলেজে পড়ার সময় রঙ্গময়ীকে তার পুরো পরিবার সমেত এ বাড়ি থেকে উচ্ছেদের জন্য চেষ্টা করেছিল খুব। তাতে কাজ হয়নি বটে, কিন্তু কনককান্তি সেই থেকে তাদের প্রতি এক তীব্র ঘৃণা ও রাগ পোষণ করে আসছে। এটা রঙ্গময়ী টের পায়।

কনককান্তিকে ভয় পাবে রঙ্গময়ী তেমন মেয়ে নয়। সে শুধু হেমকান্তকে কোনো অপ্রতিভ অবস্থায় ফেলতে চায় না। হেমকান্ত দুর্বল প্রকৃতির মানুষ, তার মন নরম ও ভরা, অবাস্তবতায় কোনো সংকট, বিবাদ, বিতর্ক বাঁধলে হেমকান্ত ভারী মুশকিলে পড়ে যান। রঙ্গময়ী মানুষটাকে সেই অবস্থায় ফেলতে চায় না।

অনেকদিন আগে নলিনীকান্ত তাকে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছিল। বলেছিল, যে দুর্বল প্রকৃতির মানুষটি তার প্রিয় তাকে যেন সর্বদা বিপদ-আপদ থেকে সে বাঁচিয়ে চলে। অনেকটা এ ধরনেরই কথা। তখন ঠিক বুঝতে পারেনি রঙ্গময়ী। সেই ভয়াবহ রাত্রে তার মাথার ঠিক ছিল না। পরে ধীরে ধীরে অনেক দিন ধরে চিন্তা করে সে বুঝেছে, কথাটা তাকে আর হেমকান্তকে জড়িয়েই বলা। অথচ নলিনীকান্তর জানার কথাই নয়, তার হৃদয়ের গভীর প্রদেশে কোন গাছে সে জলসিঞ্চন করছে। বাইরে কোনো প্রকাশ তো ছিল না রঙ্গময়ীর!

তিন দিন হেমকান্তর সঙ্গে রঙ্গময়ীর দেখা হয়নি। মানুষটা কেমন আছে কে জানে! লোকজনের কাছে অবশ্য সে সব খবরই পায়। কৃষ্ণ আসে, চাকর-বাকররা আসে। শরীর নিশ্চয়ই ভাল। কিন্তু হেমকান্তর শরীর ভাল থাকলেই যে রঙ্গময়ার চিন্তা ঘুচল তা তো নয়। হেমকান্তর অতি স্পর্শকাতর মনটিই তাঁকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট দেয়। সে কথা হেমকান্ত পাঁচজনকে বলতেও পারেন না। একা একা এক অন্ধকূপের মধ্যে তলিয়ে যান। তখন হয়তো পৃথিবীর আর কোনো আত্মজন বা সুহৃদকে নয়, রঙ্গময়ীকেই মনে পড়ে তাঁর। সব কথা নয়, কিন্তু মাঝে মাঝে কোনো কোনো হৃদয়বেদনার কথা হেমকান্ত বলেন মাত্র রঙ্গময়ীকেই।

দাদা লক্ষ্মীকান্ত সকালে পূজো করে যাওয়ার পর রঙ্গময়ী এসে চুপ করে ঠাকুর বাড়ির দালানের সিঁড়িতে বসে ছিল। এখান থেকে হেমকান্তদের বাড়িটা গাছপালা সমেত অনেকটাই দেখা যায়। কারা এল আর কারা গেল তা সবটাই নজরে পড়ে। ঠাকুরবাড়ির এই দরদালানে বসেই কনকপ্রভা এককালে কুটিল চক্ষুতে এ বাড়িতে লোকের গতায়াত নজরে রাখত, আর জটিল মন দিয়ে তার নানারকম বিশ্লেষণ করত। বালবিধবাদের মানসিকতা যে জটিল ও কুটিল হয় তা অভিজ্ঞতা বলে জানে রঙ্গময়ী। বিশেষ করে যারা বাপের বাড়িতে অনাদর আশ্রয়ে জীবন কাটায়। কনকপ্রভা সেইরকমই একজন। তবে আজকাল হেমকান্তদের পরিবারের লোক কমে যাওয়ায় তেমন ঘটনা কিছুই ঘটে না। কনকপ্রভা তাই তার ক্ষেত্র বিস্তার করেছে বাইরের সমাজ সংসারে। রঙ্গময়ী ভাবে, বালবিধবা আর চিরকুমারীদের মানসিকতা একইরকম নয় তো! সেও কি আরো বুড়ো বয়সে ওরকম হয়ে উঠবে? বড় ভয় করে।

দালানের সিঁড়িতে বসে জমিদার বাড়িতে নানা মানুষের যাতায়াত লক্ষ্য করতে করতে রঙ্গময়ী নিজের মনেই একটু হাসল। না, সে বিশেষ কাউকে লক্ষ্য করে না। কোনো ঘটনা আঁচ করার চেষ্টা করে না। সে চাতকিনীর মতো বসে আছে বটে, এক বুক পিপাসাও তার আছে। কিন্তু সে শুধু হেমকান্তর জন্য। লোকটা কেমন আছে? তার মন!

কারো ভালমন্দর জন্য এত গভীর পিপাসা হেমকান্তর নেই, জানে রঙ্গময়ী। সে জানে হেমকান্তর সাধ্যই নেই রঙ্গময়ীর ভালবাসার ঋণ শোধ করে। কিন্তু রঙ্গময়ী তো অতটা আশাই করতে পারে না। তাই চায়ওনি কোনোদিন।

আজ ঠাকুরবাড়ির দালানে বসে থেকে রঙ্গময়ী বুঝতে পারে, দুটো দিনও মানুষটাকে একবার চোখের দেখা দেখতে না পাওয়ার শূন্যতা কতখানি। ভালই আছে, ছেলে এসেছে, বউ এসেছে, নাতি-নাতনী নিয়ে জমজমাট বাড়ি। ভাল না থাকার কথা তো নয়। তবু সামনে পেলে রঙ্গময়ী শুধু একবার জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছো? সে বলবে, ভাল। রঙ্গময়ী শুধু তার মুখের ডৌল ও রেখাগুলি লক্ষ করবে, চোখের দৃষ্টি কেমন তা পরখ করবে। তার যদি মনে হয় ভাল, তবে ভাল। যদি মনে হয়, না ভাল নয়, তবে প্রশ্ন করবে, লুকোচ্ছো না তো!

রঙ্গময়ীকে কোনোদিনই ফাঁকি দিতে পারেননি হেমকান্ত। যে এত ভালবাসে তাকে কি ফাঁকি দেওয়া যায়?

কৃষ্ণর এখন গরমের ছুটি। একটু আগে মাষ্টার পড়িয়ে গেল। রঙ্গময়ী অপেক্ষা করছে। এ সময়টায় কৃষ্ণ তার ছোট্ট ঘোড়ায় চেপে এক-আধদিন বেরোয়। দেখা পেলে কৃষ্ণকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করত একটু।

কিন্তু কৃষ্ণ বেরোলো না, রঙ্গময়ী শুনেছে, বউদি চপলার সঙ্গে তার ভারী ভাব হয়েছে। সারাদিন বউদির সঙ্গে সঙ্গে ঘুরঘুর করে। ভাল। খুব ভাল। কৃষ্ণর মা নেই, বউদির মধ্যে যদি মাকে খুঁজে পায়!

রঙ্গময়ীদের বাসস্থান মন্দিরের উত্তর দিকটায়। কয়েকটা কামরাঙা আর করমচা গাছের ছায়ায় শ্যাওলায় সবুজ খানিকটা মাটি। অল্প ঘাস। পুরোনো পচা দরমার বেড়া ভেঙে পড়ছে। তার আড়ালে গোটা তিনেক কুঠুরি। অন্ধকার, ঘুপসি, হতশ্রী চেহারা। সেইদিক থেকে বিনোদচন্দ্র লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে বেরিয়ে আসেন। এই গরমেও গায়ে একটা চাদর জড়ানো। রোগে ভুগে ইদানীং বিনোদচন্দ্র বড্ড রোগা হয়ে গেছেন। স্থায়ী কফের দোষ। হাঁপানির টানও আছে। রোগা শরীর বলেই বোধহয় হাওয়া বাতাস, ঠাণ্ডা জল কিছুই সহ্য হয় না। পায়ে বৌলওলা খড়ম। একবার রঙ্গময়ীর দিকে তাকালেন, অক্ষম বাপের যেভাবে অনূঢ়া বয়স্কা কন্যার দিকে তাকানো উচিত সেইরকম অপরাধী চোখে।

বাপের জন্য রঙ্গময়ীর তেমন কোনো মমতা নেই। লোকটা লোভী, কিছু পরিমাণে অসৎ, ধর্মের ব্যবসা এবং দারিদ্র্য এই দুই-ই তাঁর চরিত্রকে নষ্ট করেছে।

রঙ্গময়ী চোখ ফিরিয়ে নিল।

বিনোদচন্দ্র কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন, লাঠির ডগা দিয়ে রাস্তা থেকে কিছু একটা সরিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। এ বাড়িতে আর পুরোহিতের তেমন দরকার নেই। হেমকান্ত ঠাকুরবাড়িতে আসেন না। তেমন জাঁকজমকের পুজো পার্বণও কিছু হয় না। বিনোদচন্দ্র এখন খুবই অবহেলিত এক ব্যক্তি। তাঁকে কোনো প্রয়োজন নেই এ-বাড়ির, তবু পুষতে হচ্ছে।

রঙ্গময়ী উঠল। তাদের গরুটাকে কাছারির পিছনের মাঠে খোঁটায় বেঁধে রাখা হয়েছে। এই গরমে রোদে চরতে চরতে জলতেষ্টা পেয়েছে বোধহয়। ডাকছে।

রঙ্গময়ী একটা আধলা ইঁট দিয়ে খোঁটাটা নড়িয়ে টেনে তুলল। গরুটা টেনে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। ছেড়ে দিলেই সোজা গোয়ালে গিয়ে গামলায় মুখ দেবে। রঙ্গময়ী গরুটাকে ছেড়ে পায়ে পায়ে হেমকান্তর কুঞ্জবনে ঢুকল।

ভাঙা ঘোড়ার গাড়িটা পড়ে আছে আগাছার জঙ্গলে। এই গরমে সাপখোপ বেরিয়ে এসে বাসা বাঁধতে পারে ভিতরে। হেমকান্তকে বলবে একটু দেখেশুনে যেন বসে এসে।

অবশ্য আজকাল হেমকান্ত কুঞ্জবনে আসছেন না, সময় পান না বোধহয়। রঙ্গময়ী তার আঁচল দিয়ে পা-দানীটা ঝেড়ে দিল। এখানেই তো বসে এসে লোকটা।

কালবৈশাখীর কয়েকটা ঝাপটায় বাগানটা অনেক সতেজ হয়েছে। ফন ফন করছে ঢেঁকী শাকের জঙ্গল। লজ্জাবতী লতা বিছিয়ে আছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে।

রঙ্গময়ী ঘোড়ার গাড়ির পাদানীতে একটু বসল। চারদিকে গাছগাছালির ঘেরাটোপ। এখানে বসে থাকলে বাইরে থেকে কারো বোঝার উপায় নেই। চারদিকে কাকের উত্তাল কা-কা রব। বহু কাক।

রঙ্গময়ী কৌতূহলী হয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাল। কাক উড়ছে। কোনো কাক মরলে বা চোট পেলে কাকেরা কোমর বেঁধে এসে বিলাপ করতে থাকে বটে। একটু তাকিয়ে থেকে রঙ্গময়ী ফের নিজের মধ্যে ডুবে গেল। শশিভূষণের কথা তার খুব মনে পড়ে। খুব। ঠিক ছোটো ভাইটি। এরকম যদি কোনো ভাই থাকত তার তবে কত না ভাল হত। চারদিকে ছোটো মনের, ছোট স্বার্থের মানুষজনের মধ্যে অহরহ বাস করতে করতে আচমকা এরকম হাওয়ায় ভেসে আসা বনফুলের গন্ধের মতো আশ্চর্য সৌরভযুক্ত মানুষকে পেলে জীবনটা অন্য রকম হয়ে যেতে চায়।

ওর ফাঁসী হবে!

রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শশিভূষণকে বরিশাল জেল-এ চালান দেওয়া হয়েছে। মামলা উঠল বলে। সেই মামলায় শশিভূষণের পক্ষ নিতে শচীন যাচ্ছে। কী হবে কে জানে!

আনমনা রঙ্গময়ী চেয়ে ছিল এক দিকে। বাসক পাতার একটা ঝোপের আড়াল থেকে একটা বন্দুকের নল খুব ধীরে ধীরে একটা জামরুল গাছের দিকে উঁচু হয়ে উঠছিল।

রঙ্গময়ী চেঁচিয়ে উঠল, কে রে?

বন্দুকের নলটা চট করে নেমে গেল।

রঙ্গময়ী টপ করে উঠে এগিয়ে যেতেই ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে কৃষ্ণ, পিসি!

রঙ্গময়ী অবাক হয়ে বলে, কী করছিস ওখানে?

হি হি, কাক মারছি।

কাক! এ মা!

কৃষ্ণ তার হাতের এয়ার গানটা দেখিয়ে বলে, এটা দিয়ে কিছু মারা যায় না কাক ছাড়া। একটা মেরেছি।

দে ওটা! দে! রঙ্গময়ী হাত বাড়িয়ে চোখ পাকিয়ে বলে।

কেন?

কাক মারতে হবে না।

কৃষ্ণ কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, কী করব তাহলে? প্র্যাকটিস করতে হবে না?

কিসের প্র্যাকটিস?

চাঁদমারি, হাত সেট করতে হবে। বউদির সঙ্গে কমপিটিশন।

বউদির সঙ্গে! বলিস কী রে?

আসল বন্দুক দিয়ে।

কিসের কমপিটিশন?

কাল আমরা বয়রায় শিকার করতে যাচ্ছি।

আমরা বলতে কে কে?

আমি, বড়দা, বউদি। বউদি সব বন্দুক তেল দিয়ে পরিষ্কার করেছে।

রঙ্গময়ী গম্ভীর হতে গিয়েও হেসে ফেলল। বলল, ক’টা বন্দুক আছে তোদের?

এগারোটা। চারটে দোনলা। দুটো রাইফেল। তিনটে এক নলা, দুটো গাদা বন্দুক।

এত?

পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।

রঙ্গময়ী অবিশ্বাস ভরে মাথা নেড়ে বলল, এতগুলো বন্দুক ছিল আমি তো জানতামই না।

আমিও না।

জানলে কবে স্বদেশীদের দিয়ে দেওয়া যেত।

স্বদেশীদের?

তারা ছাড়া আর কার বন্দুক দরকার? তোরা তো পাখি মারবি ফুর্তি করতে।

আর ওরা?

ওরা পেলে কাজের কাজ করত। আর কাক মারিস না। মারতে নেই।

কৃষ্ণ কাছে এসে বন্দুকটা ঘোড়ার গাড়ির গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে বলল, বউদির হাতে দারুণ টিপ, জানো?

গেছো মেয়ে বাবা। মেয়েছেলেরা বন্দুক চালায় জন্মে শুনিনি।

বউদির বাবা যে শিকারী।

সে আর জানি না!

বউদিকে গেছো মেয়ে বলবে না।

কৃষ্ণর গম্ভীর মুখচোখ দেখে হেসে ফেলে রঙ্গময়ী বলে, ঘাট হয়েছে বাপধন, আর বলব না। হ্যাঁরে, বউদিকে পেয়ে কি আমাদের ভুলে গেলি?

কৃষ্ণ একটু লাজুক হেসে বলে, না পিসি। তোমার কাছে আসার সময় পাচ্ছি না, বউদির সঙ্গে সারাদিন নানারকম প্ল্যান হচ্ছে তো!

কিসের প্ল্যান?

সে অনেকরকম। বেড়ানো, চড়ুইভাতি, জলসা, শিকার।

কোথায় বেড়াতে যাবি?

চাটগাঁ আর ঢাকা।

ও বাবা!

চাটগাঁ থেকে সমুদ্র দেখা যায়, জানো?

জানি। জলসা আবার কিসের রে?

জলসা কাকে বলে জানো না?

সে খুব জানি। গান-বাজনা হয়। কিন্তু তোদের বাড়িতে তো এসবের চল ছিল না।

এবার চল হবে। বউদি বলেছে, জলসায় বাবাও এসরাজ বাজাবে।

রঙ্গময়ী চোখ গোল গোল করে বলে, তোর বাবা বাজাবে? রাজি হয়েছে?

না। বউদি বলেছে তোমাকে দিয়ে বাবাকে বলাবে।

আমি? আমি কেন? রঙ্গময়ীর গলায় অকপট বিস্ময়।

তোমার কথা বাবা শোনে যে।

বউদি তাই বলল বুঝি?

তুমি বলবে না বাবাকে?

রঙ্গময়ী কৃষ্ণর দিকে চেয়ে আবার হেসে ফেলে। তারপর বলে তোর বাবা সকলের সামনে বসে এসরাজ বাজাচ্ছে এ তো ভাবাই যায় না। তোরাই বলিস। আমি ওসব বলতে পারব না, তাহলে বাড়ি থেকে তাড়াবে।

ইস, তোমাকে তাড়ালেই হবে, বউদি বলে, এ বাড়ির আসল কর্ত্রী হলে তুমি।

বলে? কেমন বিবশ-অবশ লাগছিল রঙ্গময়ীর। তার আড়ালে তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। না, কলঙ্ককে আর ভয় নেই রঙ্গময়ীর। তবে তার অন্য আর এক ধরনের ভয় দেখা দিচ্ছে। হেমকান্ত যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন কিছু হবে না, কিন্তু হেমকান্ত যখন ইহলোকে থাকবেন না তখন বোধহয় এবাড়ি থেকে সপরিবারে বিনোদচন্দ্রের উচ্ছেদ আটকানো যাবে না।

রঙ্গময়ী ধরা গলায় বলল, না, আমি কর্ত্রী হতে যাব কেন? পরগাছারা কখনো কি কর্এী হয়?

কৃষ্ণকান্ত রঙ্গময়ীর এই ভাবান্তর লক্ষ করে। খুবই বুদ্ধিমান ছেলে। পিসির সঙ্গে যে তার রক্তের সম্পর্ক নেই এবং এরা যে এ বাড়ির কর্মচারী মাত্র তা বড় হয়ে সে বুঝেছে। কিন্তু কোনো মানুষকেই তার খুব পর বলে মনে হয় না। তবে দাদা বা বউদি কেউই এদের খুব পছন্দ করে না। এ সম্পর্কে দাদা আর বউদির কিছু কথা তার কানে এসেছে। কথাগুলো ভাল নয়। বউদির ধারণা, মনুপিসি তার মায়ের অনেক গয়নাগাঁটি চুরি করেছে। দাদার সন্দেহ, তার বাবাই মনুপিসিকে গয়না বা টাকা পয়সা দেন।

কৃষ্ণকান্ত জানে এসব সত্য নয়। মনুপিসি এ বাড়ির আয়পয় দেখে, কখনো কোনো জিনিস জায়গা থেকে নড়চড় হয় না। তবু সে দাদা বউদিকে কিছু বলেনি। কিন্তু দরকার হলে সে বলবে, যা সে শুনেছে তা আড়াল থেকে, তার সামনে কেউ কিছু বলেনি।

কৃষ্ণকান্ত রঙ্গময়ীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, তোমার গায়ে সবসময় একটা শশা শশা গন্ধ কেন, বলো তো!

শশার গন্ধ! দূর! বলে রঙ্গময়ী তাড়াতাড়ি নিজের হাত আর শাড়িটা শুঁকে দেখে বলে, যাঃ, কী যে সব অদ্ভুত কথা বলিস।

কৃষ্ণকান্ত মাথা নেড়ে বলে, শশা বাতাসা এই সবের গন্ধ। আর চন্দনবাটা।

রঙ্গময়ী চোখ পাকিয়ে বলে, আজকাল খুব গন্ধের বাতিক হয়েছে, না?

বউদির গায়ে কিরকম গন্ধ জানো?

তোর বউদি বড়লোকের মেয়ে, বড়লোকের বউ, তার গায়ে আতরের গন্ধই হবে।

মোটেই না, বউদির গায়েও তোমার মতো শশা-শশা গন্ধ। সব মেয়ের গায়ের গন্ধই কি এরকম!

রঙ্গময়ী শ্বাস ফেলে বলে, পাগলা।

পরদিন সবাই বয়রায় শিকার করতে চলে গেল। সঙ্গে গেল জনা দুই চাকর আর একজন দাসী।

বজরাটা নিশ্চিত ঘাট ছেড়ে মাঝ দরিয়া ধরে অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার পর রঙ্গময়ী ঠাকুরবাড়ির দালান থেকে নেমে এল। বয়ঃসন্ধির মেয়ের মতো তার বুক কাঁপছে। ঠোঁট গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি সে অন্দরমহলে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এল।

দক্ষিণের বারান্দায় হেমকান্ত চোখে চশমা এঁটে একটা বেতের টেবিলে বিস্তর কাগজপত্র বিছিয়ে বসে নিবিষ্টমনে কী দেখছেন।

রঙ্গময়ী সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে অপলক চোখে নীরবে দৃশ্যটা খানিকক্ষণ দেখল। কত দূরের মানুষ। দীর্ঘ বিরহের পর এখন এক চৌম্বক আকর্ষণ রঙ্গময়ীকে ওই মানুষটির দিকে টানছে। কিন্তু সে জানে, বৃথা। মাঝখানে অসংখ্য অদৃশ্য বাধা।

রোজকার মতো নয়, আজ দীন ভিখারিণীর মতো সংকুচিত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল রঙ্গময়ী। চক্ষু নত। আঁচলে গা ভাল করে ঢাকা।

আচমকা রঙ্গময়ীকে দেখে একটু যেন অপ্রতিভ হন হেমকান্ত। সহাস্যে বলেন, আরে মনু! এসো!

কেমন আছো?

ভালই। কয়েকদিন তোমাকে দেখিনি।

তাতে কী! কোনো অসুবিধে তো হয়নি।

না, তা নয়। হেমকান্ত একটু দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ব্যাপার কী জানো! আমার বেশী লোক সহ্য হয় না।

ওমা! ও কী অলুক্ষণে কথা! লোক আবার কি? তোমারই ছেলে, বউ, নাতি-নাতনী।

হেমকান্ত হাসলেন, তোমাকেও কি সব ব্যাখ্যা করে বলতে হবে? তুমি কি জানো না, পৃথিবীতে আমার আপনার লোক খুব কমই আছে!

সে হিসেবে ধরলে কম কেন, আপনার লোক তোমার কেউ নেই।

হেমকান্ত কথাটা একটু ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, তাই বোধহয়।

এত কাগজপত্র নিয়ে বসেছো যে! কী ব্যাপার?

হেমকান্ত একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সেটাই তো সমস্যা মনু। এক সময়ে কাগজপএ দেখতাম। তারপর সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলাম। জমিদারী লাটে উঠলে উঠুক, আমার একটা জীবন কেটে যাবে। ছেলেরা যদি বুঝে নিতে চায় তো নিজেদের গরজেই নেবে। কিন্তু তা আর এরা হতে দিচ্ছে কই?

কনক কিছু বলেছে বুঝি?

হ্যাঁ, ওরা ভাগ বুঝতে চায়।

ভাগ করে দেবে সম্পত্তি?

উপায় কী? এস্টেটের একটা এস্টিমেট করে দিয়েছে শচীন। দলিল-টলিল সব দেখছি।

ভাল। দেখ।

প্রস্তাবটা কি তোমার পছন্দ হল না?

আমার পছন্দ অপছন্দে কী আসে যায়!

তোমার যায় আসে না জানি, কিন্তু আমার যায় আসে।

কেন? আমি তোমার কে?

হেমকান্ত হঠাৎ ভারী গভীর ও মায়াবী দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন রঙ্গময়ীর দিকে।

রঙ্গময়ীর পা থেকে মাথা অবধি বিদ্যুৎ খেলে যেতে লাগল। থরথর করে কাঁপছে তার অভ্যন্তর। মাথা আবছা হয়ে যাচ্ছে। সে যে মরে যাবে আবেগে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *