অন্ধকার উঠোন ভরতি জোনাকি পোকার নীলচে আলো নেচে বেড়াচ্ছে। আলোর তালে ডাকছে ঝিঝি পোকা। দুটো-একটা গাস্থ্যের শব্দ ছাড়া চারদিকে বড়ই নিঝুম।
বারান্দায় মুখোমুখি বসা পুরুষ ও রমণীটিকে হঠাৎ কারও চোখে পড়লে ভাববে, স্বামী-স্ত্রী ঘনিষ্ঠ বিশ্বস্ততায় পরস্পরের উত্তাপ নিচ্ছে। কত ভুল দৃশ্যই না রচিত হয় এইভাবে।
শ্রীনাথ তৃষার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে অন্ধকার দেখছে। তৃষা নিচু হয়ে তার খাতার পাতা ওলটাচ্ছে। অনেকক্ষণ আর কেউ কোনও কথা বলল না। পরস্পরের গুপ্ত ক্ষত দুর্বলতা আর পাপের কথা তারা জানে। তাই আহত হওয়ার ভয়ে মুখোমুখি তারা পরস্পর আজকাল কদাচিৎ আক্রমণ করে।
শ্রীনাথ সামান্য তিক্ত গলায় বলে, দীপু আমার ছোেট। অনেক ছোট। ওকে আমাদের ঘরসংসারের খবর জানানোটা কি ভাল?
তৃষা খুবই ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, খবরটা জানাল কে? তোমার কি সন্দেহ আমি?
দীপু আজ অনেক কথা কইল। সবটা কানে ভাল ঠেকল না। কেউ নিশ্চয়ই জানিয়েছে।
কী কথা?
তোমার আমার কথা। গরমিলের কথা।
সে তো এ বাড়ির কাকটাও জানে।
দীপু তো এ বাড়ির লোক নয়। সে জানল কেমন করে?
কেউ বলেছে হয়তো।–উদাস গলায় তৃষা বলে, বললেই বা দোষ কী? কে কার পরোয়া করে?
আফটার অল দীপু আমার ছোট ভাই। সে কিছু বললে আমার অপমান হওয়ার কথা।
হওয়ার কথা, কিন্তু হয়েছে কি?
নিশ্চয়ই হয়েছে। নইলে এলাম কেন?
এখনও যে অপমানের বোধ একটু হলেও আছে সেটা ভাল।
আমি ঝগড়া করতে আসিনি।
ঝগড়া কেউ করছে না।
শ্রীনাথ উষ্ম চেপে আবার ঠান্ডা গলায় বলল, তোমার খেলা তুমি খেলবে, আমার খেলা আমি খেলব। এর মধ্যে কোনও সালিশি ডেকে আনা উচিত নয়।
সালিশি কেউ ডাকেনি। তবে খেলার কথা কী বলছ তাও আমি বুঝতে পারলাম না। কিসের খেলা?
তৃষা খেলা বোঝেনি দেখে যেন খুবই অবাক হল শ্রীনাথ। তৃষার দিকে তাকাতেই আবার তার নির্ভুল নজরে পড়ল, তৃষার বয়স। এই সেদিনও ভারী কচি ঢলঢলে চেহারা ছিল তৃষার। এখন হঠাৎ যেন বয়সের ভার নেমেছে চেহারায়। মুখে ভাঁজ পড়েনি, শরীরে খাঁজ পড়েনি, চামড়া ঢিলে হয়নি, তবু কোথাও না কোথাও পুরনো হওয়ার আভাস ধরা পড়ছে চেহারায়।
শ্রীনাথ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তার ছোট বিড়ি ধরাল। বলল, খেলাটা তুমি ঠিকই বোঝো, স্বীকার করো বা না-করো।
তবু তুমিও একটু বুঝিয়ে বলল না, শুনি।
দরকার নেই। বলেছি তো ঝগড়া করতে আসিনি।
ঝগড়া কি আমিই করছি? শুধু জানতে চাইছি মাত্র।
জানানোর মতো রহস্য কিছু যদি থাকত। যাকগে, বলছিলাম দীপুটা এসব না জেনে সুখেই আছে। এসব না জানলে সুখেই থাকবে।
কে কাকে কী জানায় তা আমি কী করে বলব? রেসের মাঠে তো আমি তোমাকে দেখিনি, দীপু দেখেছে। মদের দোকানে বসেছ, সে খবর দিয়ে গেল পাঁচু রিকশাওয়ালা। মিনার হলে একটি মেয়ের সঙ্গে সিনেমা দেখছিলে তা চোখে পড়েছে সিদ্ধেশ্বরবাবুর। আমি খবর দিই না, খবর পাই।
খুব শান্তভাবেই কথাটা শুনল শ্রীনাথ। তারপর বলে, খবর আমিও কিছু রাখি, কিন্তু সেগুলো বলতে গেলে চেঁচামেচি হবে, খবর আরও ছড়াবে। ওসব কথা থাক।
কথাগুলো কি বটতলার মিটিং-এর জন্য জমিয়ে রাখছ? নোক জড়ো করে না বললে সুখ নেই?
শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, বলার এখনও অনেক বাকি। ঠিকই বলেছ, তোক জড়ো করে না বললে সুখ নেই।
তবে দীপু জানল বলে আর দুঃখ করার কী? তুমিই তো ঢোল সহরত করতে বেরিয়ে পড়েছ।
শ্রীনাথ অন্ধকারের দিকে চেয়ে বিড়িটায় শেষ টান দিয়ে বলল, দীপুর কথা আলাদা। আমি পাবলিককে যা-ই বলে থাকি দীপুকে বলিনি। তুমি যদি বলতে থাকে তবে আমাকেও লাজ-লজ্জার বালাই ঝেড়ে ফেলে বলতে হবে।
বলো না। বাকি থাকে কেন?
সব বলব?
সব বলতে কী? আর কিছু বাকি আছে নাকি?
আছে। পাবলিককেও আমি সব বলিনি। বলতে বলছ?
তৃষা মুখ তুলে খুব সহজভাবে তাকাল। চোখে বেড়ালের মতো জুলজুলে চাউনি নেই। কিছু ক্লান্তি কি? অন্তত গলায় একটা পরিশ্রান্ত স্বর ফুটল, তুমি কী করতে না করতে তুমিই জানো। ছেলেপুলেরা ঘরদোর নোংরা করেই, মেয়েরা তা ঝেটিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। আমারও সারা জীবন তাই করতে হবে। দুঃখ কিসের?
সব আবর্জনা কি যাবে তাতে?
চেষ্টা তো করতেই হবে।
নোংরা কি তুমিই কিছু কম করেছ এই সংসারকে?
এবার ঝগড়ার কথা কে বলছে শুনি!
শ্রীনাথ সামলে নিল। বাস্তবিক তৃষার সঙ্গে আর ঝগড়া করার কোনও মানেই হয় না। সামলে নিয়ে সে বলল, তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব। দেবে?
চাইবে?–তৃষা অবাক হয়ে বলে, কী চাও বলো।
খুব দূরে কোথাও এক ফালি জমি কিনে চাষবাস করব ভেবেছিলাম। তুমি তাতে বাগড়া দিয়েছ। জমির কোনও খবরই পাচ্ছি না। যদি বাধা না দাও তবে আমি একটু জমি কিনে চাষবাস নিয়ে থাকতে পারি।
আমি বাগড়া দিইনি।
দিয়েছ। শোনো ওসব করে লাভ নেই। আমি ঠিক করেছি, জমি যদি কিনতে নাই পারি তবে অন্তত কলকাতায় একটা মেসে গিয়ে উঠব। সেটা কি আটকাতে পারবে?
আটকাব কেন?
কেন তা আমি কি জানি? হয়তো তোমার কোনও এক্সপেরিমেন্টের জন্য আমার মতো একটা গিনিপিগ দরকার।
ওসব তোমার নিজের মনের কথা? আমি বাধা দেব না। দিইওনি। তোমাকে নিয়ে আমার কোনও এক্সপেরিমেন্টও করার ইচ্ছে নেই।
আমি দূরে গেলে তোমারই সুবিধে। পাবলিককে ঘরের কথা বলার কেউ থাকবে না।
পাবলিককে নিয়ে তো আমি ভাবছি না। তারা তোমাকেও চেনে, আমাকেও চেনে। আমি ভাবছি তোমার বাবার কথা, তোমার ছেলেমেয়ে এবং সংসারের কথা। তুমি গেলে এদের কে দেখবে?
একটু অবাক হয়ে শ্রীনাথ বলে, এদের এতকাল কি আমি দেখাশুনো করতাম নাকি?
না, এতকাল আমিই করেছি। কিন্তু আমারও তো ক্লান্তি আছে, বয়স আছে। আমি বরং বলি, এতকাল তো আমিই দেখলাম, এবার তুমি দেখো, আমি যাই।
কোথায় যাবে?
এ প্রশ্ন তো তোমাকে আমি করিনি। তবে তুমিই বা করছ কেন? কোথাও যাব।
শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, এ সম্পত্তি আমার নয়, তোমার। এখানে এসব আগলে আমি থাকতে যাব কেন?
তৃষা একটা বড় শ্বাস ফেলে বলে, সম্পত্তির সুখ কীরকম তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তুমি যদি চাও তো তোমার নামে লিখে দিতে পারি।
আমার নামে লিখে দেবে কেন? আমি নেবই বা কোন লজ্জায়?
উদাস মুখে তৃষা বলে, সেসব জানি না। সম্পত্তি না নিলে বলার কিছু নেই, কিন্তু সংসারের দায়িত্ব আমি একা নিতে পারব না।
এসব তোমার সাজানো কথা। তুমিও জানো, আমিও জানি, দায়িত্ব আমার কোনওকালে ছিল না, আজও নেই। তুমি আমাকে দায়িত্ব দাওনি, আমিও নিইনি।
এতকালের কথা দিয়ে কী হবে? আমি বলছি এখনকার কথা। এতকাল অন্যরকম ছিল বলে চিরকালই তাই থাকবে নাকি?
শ্রীনাথ বিমর্ষ মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি জানি তৃষা, তুমি আমাকে আটকে রাখতে চাও। যদিও আমাকে তোমার আর প্রয়োজন নেই।
এরকমভাবে যারা ভাবে তাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি ওভাবে ভাবি না।
তোমার মনের খবর রাখি না। কিন্তু এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আমি এ বাড়িতে ভারচুয়ালি কয়ে রয়েছি।
কেউ তোমাকে কয়েদ রাখেনি।
না, দরজায় তালা দিয়ে কয়েদ তো তুমি করোনি। তুমি শুধু আমার বেরিয়ে যাওয়ার পথগুলো আটকে দিয়েছ।
তৃষা হাঁটু তুলে তার ওপর থুতনি রেখে কী যেন ভাবল একটু। তারপর বলল, তুমি কলকাতার মেসে থাকবে?
থাকব।
তাতে বাধা কোথায়?
বাধা যে নেই তাও নয়। মেসে আমি বহুকাল থাকতে পারব না। তুমি জেনে গেছ যে, গাছপালা ছাড়া আমি আজকাল থাকতে পারি না। হাতে পায়ে মাটি না লাগালে আমার স্বস্তি নেই। কলকাতায় গেলে আমি ছটফট করে মরব। সেই জনাই যদি আমি কলকাতার মেসে যেতে চাই তবে তুমি বাধা দেবে না, আমি জানি।
আমি তোমাকে নিয়ে অত খুঁটিয়ে ভাবিনি। মিছিমিছি তুমি আমাকে এক মস্ত শত্রু মনে করে বসে আছে। যদি আমি শত্রু হতাম তবে অনেক কিছু করতে পারতাম।
তাও জানি। তোমার অপার করুণা।
ঠাট্টা কোরো না। এখন আর ওসব ভাল শোনায় না।
শ্রীনাথ বাঁকা হাসি হেসে বলে, শত্রুতার বদলে বরং আমার কিছু উপকারই করতে চেয়েছ। স্টেশনের স্টলে সরিৎকে লেলিয়ে দিয়ে কয়েকটা ছেলেকে মার খাইয়েছ। আমাকে নিয়ে ওরা মশকরা করত সেটা তোমার সহ্য হয়নি।
বড় বড় চোখে চেয়ে তৃষা বলে, তোমার মান-অপমানবোধ নেই জানি। তা বলে তোমার পরিচয়টা তো মুছে যায়নি। তোমার অপমানে এই পরিবারেরও অপমান, সেটা ভুলতে পারিনি। মনে রেখো, এই পরিবারটা কিন্তু আমার বাপের বাড়ির পরিবার নয়, তোমারই পরিবার। আমি সঙ্গে করে আনিনি।
শ্রীনাথ বিষ-হাসি হেসে বলে, সেটা কি আর জানি না? কিন্তু আমি জানলে কী হবে? পাবলিক জানে, এই পরিবার শ্রীনাথ চাটুজ্জের নয়, তৃষা চাটুজ্জের। তুমি সর্বেসর্বা। আমাকে কেন আর নাম-কোবাতে জড়ানো!
তোমার কি কোনও অপমানই আর গায়ে লাগে না?
না। আমার আবার মান-অপমান কী? সংসারকে যদি একটা বড় গাছ বলে ভাবো তবে আমি হচ্ছি সেই গাছের একটা পোকায় খাওয়া বুড়ো পাতা। খসে পড়লে কেউ টেরও পাবে না।
সেটা তোমার মনের দোষ। আমি তোমাকে সংসারেব বাড়তি লোক বলে ভাবি না। তুমি নিজে থেকেই নিজেকে বাড়তি লোক করে তুলেছ। এখানে আসার পর থেকে কখনও তুমি সংসারের সঙ্গে জড়াতে চাইলে না, আলগা-আলগা গা বাঁচিয়ে থাকলে। আমার পাশে এমন একজন পুরুষমানুষ ছিল না যে সব দেখাশোনা করবে। বাধ্য হয়েই আমাকে পুরুষের কাজ করতে হয়েছে।
কাজটা তুমি যে-কোনও পুরুষের চেয়েও ভাল ভাবে করেছ। সবাই বলে, তুমি নাকি এ তল্লাটের সব জমিই প্রায় নামে-বেনামে কিনে নিয়েছ। এমনকী আমার নামেও জমি কেনা হয়েছে, অথচ আমি জানি না।
তুমি যদি সম্পত্তি দেখাশোনা করতে তাহলে বুঝতে পারতে, কত কী করে তবে সব বজায় রাখতে হয়। কতকাল সাজিনি, বেড়াইনি, সিনেমা দেখিনি! সব ছেড়ে শুধু এই ছাইমাটি আগলে যক্ষীবুড়ির মতো বসে আছি। তবু তো তোমাকে খুশি করতে পারিনি।
আমার সুখের অন্ত নেই। যার বউ এত গুণের, তার সুখের অভাব কী?
আবার ঠাট্টা করছ? করো। তোমার দিন পড়েছে।
তাই নাকি? তুমি তাই মনে করো?
করব না কেন? তোমার তো ফুর্তির কোনও ভাঁটা পড়েনি। দেখছি, মুখ বুজে আছি।
শ্রীনাথ একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে আর কেউ না জানলেও আমি জানি তৃষা। আমার কাছে ওসব ভাল সেজো না। তোমাকে মানায় না। তুমিও আমাকে শেষ করার চেষ্টা করছ, আমিও তোমাকে শেষ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি দুর্বল, তোমার মতো ধূর্তও নই। বুঝতে পারছি আমি হেরে যাব। তোমার সঙ্গে কেউ কখনও পেরে ওঠেনি। তবু লড়াই তো লড়তেই হবে।
তুমি বোধ হয় আজকাল খুব বেশি নেশা-টেশা করছ।
করছি। সেটাও লড়াইয়েরই কৌশল।
এত কথা হচ্ছে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে। কেউ গলা তুলছে না, চেঁচাচ্ছে না। প্রায় মৃদু প্রেমের কথা বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছে বুদবুদের মতো। দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে, দু’জনে আসলে নিজেদের অস্ত্র ও ঢাল নিয়ে আক্রমণ ও আত্মরক্ষার এক প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছে।
তৃষা মৃদু স্বরে বলে, তোমার লড়াই তুমি করো গে বাতাসের সঙ্গে। তোমার সঙ্গে আমার কোনও লড়াই নেই।
নেই? তবে আমার পিছনে কেন তোমার গোয়েন্দারা ঘোরে? কেন গোপনে আমার ঘরের ড়ুপ্লিকেট চাবি তৈরি হয়? কেন বদ্রীকে ডেকে ভয় দেখানো হয় জমির খবর না দেওয়ার জন্য?
তৃষা একটু থতমত খেয়ে গেল। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সব প্রশ্নেরই সঠিক জবাব আছে। একদিন মাথা ঠান্ডা করে শুনো। সেদিন বুঝতে পারবে, আমি তোমার কোনও ক্ষতি করতে চাইনি। রামলাখনের ঘরে ফুর্তি করতে যাও বা আর যেখানেই যা করে বেড়াও, আমি বাধা দেব না। দিতে আমার আত্মসম্মানে লাগে। কিন্তু আমার ক্ষতি করতে গিয়ে নিজের নাম ডোবাচ্ছ কেন?
শুধু আমার নাম নয়, সেই সঙ্গে তোমার নামও। কিন্তু মুশকিল কী জানো?
আমি ওসব জানতে চাই না।
তবু জেনে রাখো। এককালে, অর্থাৎ ত্রিশ-চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর আগে মদ খেলে বা মেয়েমানুষের কাছে গেলে নিলে হত। লোকে সন্দেহের চোখে দেখত, এড়িয়ে চলত। আজকাল দান উলটে গেছে। এখন বারো আনা ভদ্রলোকই মদ খায়, মেয়েমানুষেও আজকাল আর তেমন দোষ ধরে না কেউ। এই গাঁ-গঞ্জে কিছু লোক এখনও শুনলে একটু চমকে ওঠে বটে, কিন্তু তা নিয়ে বেশি একটা হই-চই করতে যায় না। যদি করত তবে এতদিনে তোমার বা আমার নামে ঢি ঢি পড়ে যেত। তুমি সেটা জানো বলেই কোনও বাধা দাওনি আমাকে। তোমার বুদ্ধি অনেক বেশি।
তৃষা জবাব দিল না। হাঁটুতে থুতনি রেখে চেয়ে রইল। মুখে কোনও আফসোস নেই, উদ্বেগ নেই। কেবল এক ঠান্ডা হিসেব-নিকেশ রয়েছে।
শ্রীনাথ দাঁড়াল না। সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নেমে এল। একবার ফিরে তৃষার দিকে চাইল। একটু বয়সের ছাপ পড়ল নাকি? বয়স হল বুঝি এতদিনে।
বৃষ্টির পর ভারী ভ্যাপসা গরম পড়েছে। তবু এ জায়গাটা ফাঁকা বলে তেমন খারাপ লাগে না। দীপনাথ খানিকক্ষণ বাবার সঙ্গে কথা বলল বসে বসে। তারপর বেরোল সরিতের সঙ্গে বাজার দেখতে। একটু একটু করে বুঝতে পারছিল বড়দা মল্লিনাথ যা সম্পত্তি রেখে গিয়েছিল বউদি তার ওপরেই নির্ভর করে নেই। নানা দিকে সম্পত্তি বেড়েছে, আয় বেড়েছে। সবটাই হয়তো আইন মেনে নয়। কিন্তু তবু বেড়েছে তো।
ত্রয়ীর কাউন্টারে রমরমা ভিড়। দোকানের স্টক দেখে তাজ্জব মানে দীপনাথ। কম করেও হাজার পঞ্চাশেক টাকার জিনিস রয়েছে। দিনে অন্তত দু’-তিন হাজার টাকার বিক্রি।
ফেরার সময় সে একটা শ্বাস ফেলে বলল, না হে, বউদি জানে। কীভাবে ব্যাবসা করতে হয় তা ওই বউদির মতো অনেক পুরুষেরও জানা নেই।
এককথায় সরিৎ খুব খুশি হয়। মেজদিকে তারও বড় ভক্তি। সে বলল, দিদি রুখে না দাঁড়ালে মল্লিদার সম্পত্তি ভূতে খেত।
তুমি কি হাসকিং মিল দেখছ?
না, সবই দেখতে হয়। তবে মেইনলি হাসকিং মিলটা।
বউদির জমি কত বলো তো?
তা কম নয়। সব তো নামে নেই।
জানি। পুলিস বা সরকার থেকে ঝামেলা হয় না?
বন্দোবস্ত আছে।
এখানকার লোকেরা কেমন?
ভাল নয় খুব একটা। আগে নানা রকম গোলমাল করেছে। তবে এখন মেজদিকে সবাই সমঝে চলে।
ভয় পায়?
পায়। সমীহ করে আর কী।
দীপনাথ মৃদু হেসে বলল, মেজদাকে আমি ভালই জানি। মেজদা এত সব করতে পারত না।
সরিৎ সতর্ক গলায় বলে, জামাইবাবু একটু অন্য রকম হয়ে গেছেন।
কী রকম বলো তো?
অন্য রকম। খুব স্বাভাবিক নয়।
সেটাও বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন?
কে বলবে?
দীপনাথ মৃদু স্বরে বলে, মেজদা কিন্তু মানুষ খারাপ ছিল না কোনওদিন।
সে আমি জানি। বিয়ে হওয়ার পর প্রথম প্রথম দেখেছি তো। দারুণ লোক। কিন্তু এখন কেমন ম্যান্তামারা হয়ে গেছেন।
তোমরা মেজদার ওপর নজর রাখো। মানুষটার কোথাও একটা গভীর ক্ষত আছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না সেটা কেন। কিন্তু আছে।
উনি তো কাউকে বলবেন না। কী করে আমরাই বা জানব বলুন?
তোমাদের কথা নয়। দীপনাথ গম্ভীর হয়ে বলে, এ কাজ করতে পারে একমাত্র বউদি।
দিদির সঙ্গে উনি কথাই বলেন না।
একটু বিরক্ত হয়ে দীপনাথ বলে, তাও জানি। কিন্তু বুঝি না। যাকগে, বউদির সঙ্গেই কথা বলে দেখব।
আমরা চাই জামাইবাবু আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠুন। উনি কিন্তু তা হচ্ছেন না। এ জায়গার লোকেদের কাছে উনি মেজদির নামে যা-তা বলে বেড়াচ্ছেন।
তাই নাকি? বলে বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ে দীপনাথ। কী রকম?
এই তো সেদিন কলকাতা থেকে আমি আর মেজদি ফিরছি। দেখি বটতলায় লোক জড়ো করে যা-তা বলছেন। মেজদি আমাকে বলল, যা গিয়ে চুপি চুপি শুনে আয় কী বলছে।
তুমি শুনলে?
শোনা যায় না, শোনা উচিতও নয়। মেজদির হুকুমে শুনতে হল, কিন্তু সে মুখে আনতে পারব।
দীপনাথ খুবই বিষণ্ণ বোধ করে। আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে সে অনেকক্ষণ ধরে ভাবে। শ্রীনাথ এরকম নয়। তাদের বংশে ইতরামো বড় একটা কারও মধ্যে নেই। তবে মেজদার এটা হল কী?
দীপনাথ অনেকক্ষণ বাদে বলল, তোমার জামাইবাবুকে তোমরা কী চোখে দেখো সরিৎ?
আমরা জামাইবাবুকে নিয়ে আর ভাবি না। ভেবে লাভ নেই।
কিন্তু একটা মানুষ কেন এরকম পাগলের মতো কাজ করছে তা ভেবে দেখবে না?
আমাকে জামাইবাবু পছন্দ করেন না। আমার নামেও লোককে যা-তা বলেন। আমি তাই বেশি কাছে ঘেঁষি না।
দীপনাথ আর কিছু বলল না। বাড়ি পৌঁছে চুপচাপ হাত-মুখ ধুল। তারপর খেতে বসে অন্যমনস্কভাবে টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলল। খাওয়ার ঘরে শ্রীনাথ নেই। পাশাপাশি সরিৎ, সে আর সজল।
নিজের শোবার ঘর তাকে ছেড়ে দিয়ে তৃষা শোবে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। বালিশ বিছানা ঠিক করতে যখন এল তখনই দীপনাথ বলল, বউদি, মেজদা কেমন আছে বলো তো?
দেখছই তো ভাই।
তবু তোমার মুখে শুনি।
তোমার মেজদা ভাল নেই।
কেন ভাল নেই? শরীর খারাপ?
শরীরের খবর তো জানি না।
কেন জানো না?
তৃষা বড় বড় চোখে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, উনি জানতে দিচ্ছেন কই?
যদি হুট করে মেজদা আজ নিজের ঘরে গলায় দড়ি দেয় তাহলে?
কী যা-তা বলছ?
একটা শাস ফেলে দীপনাথ বলে, মেজদার মনের ব্যালান্স নষ্ট হয়ে গেছে বউদি। তোমার সাবধান হওয়া উচিত।