সপ্তম পরিচ্ছেদ
শ্রীরামকৃষ্ণ সংকীর্তনানন্দে
ত্রৈলোক্য আবার গান গাহিতেছেন। সঙ্গে খোল-করতাল বাজিতেছে। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রেমে উন্মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছেন। নৃত্য করিতে করিতে কতবার সমাধিস্থ হইতেছেন। সমাধিস্থ অবস্থায় দাঁড়াইয়া আছেন, স্পন্দহীন দেহ, স্থিরনেত্র, সহাস্যবদন; কোন প্রিয় ভক্তের স্কন্ধদেশে হাত দিয়ে আছেন। আবার ভাবান্তে মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় নৃত্য। বাহ্যদশা প্রাপ্ত হইয়া গানের আখর দিতেছেন:
“নাচ মা, ভক্তবৃন্দ বেড়ে বেড়ে;
আপনি নেচে নাচাও গো মা;
(আবার বলি) হৃদিপদ্মে একবার নাচ মা;
নাচ গো ব্রহ্মময়ী সেই ভুবনমোহনরূপে।”
সে অপূর্ব দৃশ্য! মাতৃগতপ্রাণ, প্রেমে মাতোয়ারা সেই স্বর্গীয় বালকের নৃত্য! ব্রাহ্মভক্তেরা তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া নৃত্য করিতেছেন — যেন লোহাকে চুম্বুকে ধরিয়াছে! সকলে উন্মত্ত হইয়া ব্রহ্মনাম করিতেছেন; আবার ব্রহ্মের সেই মধুর নাম, — মা নাম করিতেছেন। অনেকে বালকের মতো “মা, মা” বলিতে বলিতে কাঁদিতেছেন।
কীর্তনান্তে সকলে আসন গ্রহণ করিয়াছেন। শ্রীরামকৃষ্ণও আসীন। সম্মুখে বিজয়। বিজয়ের শাশুড়ী ঠাকুরানী ও অন্যানা মেয়েভক্তেরা তাঁহাকে দর্শন করিবেন ও তাঁহার সঙ্গে কথা বলিবেন বলিয়া সংবাদ পাঠাইলে, তিনি একটি ঘরের ভিতর গিয়া তাহাদের সঙ্গে দেখা করিলেন।
কিয়ৎ পরে ফিরিয়া আসিয়া বিজয়কে বলিতেছেন, “দেখ, তোমার শাশুড়ীর কি ভক্তি! বলে, সংসারের কথা আর বলবেন না। এক ঢেউ যাচ্ছে, আর-এক ঢেউ আসছে! আমি বললুম, ওগো, তোমার আর তাতে কি! তোমার তো জ্ঞান হয়েছে। তোমার শাশুড়ী তাতে বললেন, আমার আবার কি জ্ঞান হয়েছে। এখনও বিদ্যা-মায়া আর অবিদ্যা-মায়ার পার হই নাই, শুধু অবিদ্যার পার হলে তো হবে না, বিদ্যার পার হতে হবে, তবে তো জ্ঞান হবে; আপনিই তো ও-কথা বলেন।”
এ-কথা হইতেছে এমন সময় শ্রীযুক্ত বেণী পাল আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
বেণী পাল (বিজয়ের প্রতি) — মহাশয়, তবে গাত্রোত্থান করুন, অনেক দেরি হয়ে গেছে উপাসনা আরম্ভ করুন।
বিজয় — মহাশয়, আর উপাসনা কি দরকার। আপনাদের এখানে আগে পায়েসের ব্যবস্থা, তারপর কড়ার ডাল ও অন্যান্য ব্যবস্থা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিয়া) — যে যেমন ভক্ত সে সেইরূপ আয়োজন করে। সত্ত্বগুণীভক্ত পায়স দেয়, রজোগুণীভক্ত পঞ্চাশ ব্যঞ্জন দিয়ে ভোগ দেয়, তমোগুণীভক্ত ছাগ ও অন্যান্য বলি দেয়।
বিজয় উপাসনা করিতে বেদীতে বসিবেন কিনা ভাবিতেছেন।