ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
অহংকার ও সদরওয়ালা
শ্রীরামকৃষ্ণ (সদরওয়ালার প্রতি) — আচ্ছা, অভিমান, অহংকার জ্ঞানে হয় — না, অজ্ঞানে হয়? অহংকার তমোগুণ, অজ্ঞান থেকে উৎপন্ন হয়। এই অহংকার আড়াল আছে বলে তাই ঈশ্বরকে দেখা যায় না। “আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল।” অহংকার করা বৃথা। এ-শরীর, এ-ঐশ্বর্য কিছুই থাকবে না। একটা মাতাল দুর্গা প্রতিমা দেখছিল। প্রতিমার সাজগোজ দেখে বলছে, “মা, যতই সাজো-গোজো, দিন দুই-তিন পরে তোমায় টেনে গঙ্গায় ফেলে দিবে।” (সকলের হাস্য) তাই সকলকে বলছি, জজই হও আর যেই হও সব দুদিনের জন্য। তাই অভিমান, অহংকার ত্যাগ করতে হয়।
[ব্রাহ্মসমাজ ও সাম্য — লোক ভিন্ন প্রকৃতি ]
“সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের ভিন্ন স্বভাব। তমোগুণীদের লক্ষণ, অহংকার, নিদ্রা, বেশি ভোজন, কাম, ক্রোধ — এই সব রজোগুণিরা বেশি কাজ জড়ায়; কাপড়; পোশাক ফিট-ফাট, বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বৈঠকখানায় কুইনের ছবি, যখন ঈশ্বরচিন্তা করে তখন চেলী-গরদ পরেম গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, তার মাঝে মাঝে একটি একটি সোনার রুদ্রাক্ষ; যদি কেউ ঠাকুরবাড়ি দেখতে আসে তবে সঙ্গে করে দেখায় আর বলে, এদিকে আসুন আরও আছে, শ্বেত পাথরের, মার্বেল পাথরের মেঝে আছে, ষোল-ফোকর নাটমন্দির আছে। আবার দান করে, লোককে দেখিয়ে। সত্ত্বগুণী লোক অতি শিষ্ট-শান্ত, কাপড় যা তা; রোজগার পেট চলা পর্যন্ত, কখনও লোকের তোষামোদ করে ধন লয় না, বাড়িতে মেরামত নাই, ছেলেদের পোশাকের জন্য ভাবে না; মান-সম্ভ্রমের জন্য ব্যস্ত হয় না, ঈশ্বরচিন্তা, দানধ্যান সমস্ত গোপনে — লোকে টের পায় না; মশারির ভিতর ধ্যান করে, লোকে ভাবে বাবুর রাতে ঘুম হয় নাই তাই বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছেন। সত্ত্বগুণ সিঁড়ির শেষ ধাপ, তারপরেই ছাদ। সত্ত্বগুণ এলেই ঈশ্বরলাভের আর দেরি হয় না — আর একটু গেলেই তাঁকে পাবে। (সদরওয়ালার প্রতি) — তুমি বলেছিলে সব লোক সমান। এই দেখ, কত ভিন্ন প্রকৃতি।
“আরও কত রকম থাক থাক আছে; — নিত্যজীব, মুক্তজীব, মুমুক্ষজীব, বদ্ধজীব, — নানারকম মানুষ। নারদ, শুকদেব নিত্যজীব, যেমন স্টীম বোট্ (কলের জাহাজ) পারে আপনিও যেতে পারে আবার বড় জীবজন্তু হাতি পর্যন্ত পারে নিয়ে যায়। নিত্যজীবেরা নায়েবের স্বরূপ; একটা তালুক শাসন করে আর-একটা তালুক শাসন করতে যায়। আবার মুমুক্ষ জীব আছে, যারা সংসার জাল থেকে মুক্ত হোয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে দুই-একজন জাল থেকে পালাতে পারে, তারা মুক্ত জীব। নিত্যজীবেরা এক-একটা সিয়ানা মাছের মতো; কখনও জালে পড়ে না।
“কিন্তু বদ্ধজীব — সংসারী জীব — তাদের হুঁশ নাই। তারা জালে পড়েই আছে, অথচ জালে বদ্ধ হয়েছি, এরূপ জ্ঞানও নাই। এরা হরিকথা সম্মুখে হলে সেখান থেকে চলে যায়, — বলে হরিনাম মরবার সময় হবে; এখন কেন? আবার মৃত্যুশয্যায় শুয়ে, পরিবার কিম্বা ছেলেদের বলে, ‘প্রদীপে অত সলতে কেন, একটা সলতে দাও; তা না হলে তেল পুড়ে যাবে’; আর পরিবার ও ছেলেদের মনে করে কাঁদে আর বলে, ‘হায়! আমি ম’লে এদের কি হবে।’ আর বদ্ধজীব যাতে এত দুঃখ ভোগ করে, তাই আবার করে; যেমন উটের কাঁটা ঘাস খেতে খেতে মুখ দিয়ে দরদর করে রক্ত পড়ে, তবু কাঁটা ঘাস ছাড়ে না। এদিকে ছেলে মারা গেছে, শোকে কাতর, তবু আবার বছর বছর ছেলে হবে; মেয়ের বিয়েতে সর্বস্বান্ত হল, আবার বছর বছর মেয়ে হবে; বলে, কি করব অদৃষ্টে ছিল। যদি তীর্থ করতে যায়, নিজে ঈশ্বরচিন্তা করবার অবসর পায় না। — কেবল পরিবারদের পুঁটুলি বইতে বইতে প্রাণ যায়, ঠাকুরদের মন্দিরে গিয়ে ছেলেকে চরণামৃত খাওয়াতে, গড়াগড়ি দেওয়াতেই ব্যস্ত। বদ্ধজীব নিজের আর পরিবারদের পেটের জন্য দাসত্ব করে — আর মিথ্যাকথা, প্রবঞ্চনা, তোষামোদ করে ধন উপায় করে। যারা ঈশ্বরচিন্তা করে, ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হয়, বদ্ধজীব তাদের পাগল বলে উড়িয়ে দেয়। (সদরওয়ালার প্রতি) মানুষ কত রকম দেখ; তুমি সব এক বলছিলে। কত ভিন্ন প্রকৃতি। কারু বশি শক্তি, কারু কম।”
[বদ্ধজীব মৃত্যুকালে ঈশ্বরের নাম করে না ]
“সংসারাক্ত বদ্ধজীব মৃত্যুকালে সংসারের কথাই বলে। বাহিরে মালা জপলে, গঙ্গাস্নান করলে, তীর্থে গেলে — কি হবে? সংসার আসক্তি ভিতরে থাকলে মৃত্যুকালে সেটি দেখা যায়। কত আবোল-তাবোল বলে; হয়তো বিকারের খেয়ালে ‘হলুদ, পাঁচফোড়ন, তেজপাতা’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। শুকপাখি সহজ বেলা রাধাকৃষ্ণ বলে, বিল্লি ধরলে নিজের বুলি বেরোয়, ক্যাঁ ক্যাঁ করে। গীতায় আছে মৃত্যুকালে যা মনে করবে, পরলোকে তাই হবে। ভরত রাজা ‘হরিণ’, ‘হরিণ’ করে দেহত্যাগ করেছিল, তাই হরিণ-জন্ম হল। ঈশ্বরচিন্তা করে দেহত্যাগ করলে ঈশ্বরলাভ হয়, আর এ-সংসারে আসতে হয় না।”
ব্রাহ্মভক্ত — মহাশয়, অন্য সময় ঈশ্বরচিন্তা করেছে, কিন্তু মৃত্যু সময় করে নাই বলে কি আবার এই সুখ-দুঃখময় সংসারে আসতে হবে? কেন, আগে তো ঈশ্বরচিন্তা করেছিল?
শ্রীরামকৃষ্ণ — জীব ঈশ্বরচিন্তা করে, কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই, আবার, ভুলে যায়; সংসারে আসক্ত হয়। যেমন এই হাতিকে স্নান করিয়ে দিলে, আবার ধুলা-কাদা মাখে। মনমত্তকরী! তবে হাতিকে নাইয়েই যদি আস্তাবলে সাঁধ করিয়া দিতে পার, তাহলে আর ধুলা-কাদা মাখতে পারে না। যদি জীব মৃত্যুকালে ঈশ্বরচিন্তা করে, তাহলে শুদ্ধমন হয়, সে মন কামিনী-কাঞ্চনে আবার আসক্ত হবার অবসর পায় না।
“ঈশ্বরে বিশ্বাস নাই, তাই এত কর্মভোগ। লোকে বলে যে, গঙ্গা-স্নানের সময় তোমার পাপগুলো তোমায় ছেড়ে গঙ্গার তীরের গাছের উপর বসে থাকে। যাই তুমি গঙ্গাস্নান করে তীরে উঠছো অমনি পাপগুলো তোমার ঘাড়ে আবার চেপে বসে। (সকলের হাস্য) দেহত্যাগের সময় যাতে ঈশ্বরচিন্তা হয়, তাই তার আগে থাকতে উপায় করতে হয়। উপায় — অভ্যাসযোগ। ঈশ্বরচিন্তা অভ্যাস করলে শেষের দিনেও তাঁকে মনে পড়বে।”
ব্রাহ্মভক্ত — বেশ কথা হল। অতি সুন্দর কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ — কি এলোমেলো বকলুম! তবে আমার ভাব কি জান? আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী; আমি ঘর তিনি ঘরণী; আমি গাড়ি তিনি Engineer; আমি রথ তিনি রথী; যেমন চালান তেমনি চলি; যেমন করান তেমনি করি।