হাসপাতাল থেকে প্রায় জোরজার করেই গতকাল তুতুল ফিরে এসেছে গোল্ডার্স গ্রীনের অ্যাপার্টমেন্টে। তার মাথা জোড়া ব্যাণ্ডেজ, শরীর অত্যন্ত দুর্বল তো বটেই, কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে ঘুমে ঢলে পড়ে। তরল খাদ্য ছাড়া কিছুই সে খেতে পারে না, তাতেও তার রুচি নেই। আলম একই সঙ্গে তার ডাক্তার ও নার্স, এক মুহূর্তের জন্যও সে বাড়ি ছেড়ে বেরুচ্ছে না।
সন্ধের পরই ট্রাঙ্কুইলাইজার দিয়ে তুতুলকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কথা, কিন্তু তুতুল আজ কিছুতেই ঘুমোবে না। আলম তাকে ওষুধ খাওয়াতে এলে সে প্রত্যেকটা ওষুধ খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে, তাকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। আলম তাকে চিকেন স্টু জোর করে খাওয়াতে গেলেও সে দু’চুমুক দিয়ে রেখে দিয়ে বললো, আমাকে একটু ব্র্যাণ্ডি দেবে? তোমার যে রেমি মারার বোতল ছিল, তার থেকে একটুখানি?
আলম প্রসন্ন বিস্ময়ের সঙ্গে বললো, সেই বোতলটার কথাও তার মনে আছে? ডাক্তাররা। তাইলে তোর ব্রেনের খোপগুলো উল্টাপাল্টা কইরা দ্যায় নাই!
তুতুল ক্লিষ্টভাবে হেসে বললো, আমার সব মনে আছে।
অ্যালকোহল ততলের ঠিক সহ্য হয় না, স্বাদও পছন্দ হয় না। কোনো পার্টিতে অন্যরা জোরজার করলে সে কখনো-সখনো রেড ওয়াইনে দু’এক চুমুক দিয়েছে। আজ সে নিজে থেকেই ব্রাণ্ডি চাইছে কেন তা আলম জানে। খুব ছোট্ট একটা লিকিওর গ্লাসে খানিকটা ঢেলে এনে বিছানার পাশে বসে সে প্রথমে তুতুলের পাণ্ডুর ঠোঁটে একটা চুম্বন দিল, তারপর জিজ্ঞেস করলো, আমি খাইয়ে দেবো?
তুতুল বললো, না, আমাকে দাও! আমাকে একটু উঁচু করে তুলে দাও!
পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে তুতুলকে বসিয়ে দিল আলম। একটা সোনালি রঙের লেপ দিয়ে। তার শরীর ঢাকা। পাতলা মেঘের আড়ালে ডুবে যাওয়া চাঁদের মতন তার মুখোনি অস্পষ্ট। ঘরখানার চারদিকে সে একবার চোখ বোলালো। সব কিছুই তার এখন এত প্রিয় লাগছে। এমনকি হাতল-ভাঙা টি-পটটাও, আগে অনেকবার ভেবেছিল ওটাকে ফেলে দেবে, এখন মনে হচ্ছে, থাক, এটাও থাক হাসপাতাল থেকে তুতুল যে এ বাড়িতে আর কখনো ফিরে আসবে, তা যেন সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। যতদূর মনে হয়, এ যাত্রা সে বেঁচে যাবে। কিন্তু এই বেঁচে ওঠার মধ্যেও একটা বিষণ্ণতা বোধ আছে। তার জীবনের বিনিময়ে মৃত্যু যদি অন্য কিছু দাবি করে? পিকলুদা, জয়দীপ এরা যেন তুতুলকে তাদের আয়ু দিয়ে চলে গেছে। এরপর আলমের আবার কিছু হবে না তো? জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে আলম, আত্মবিশ্বাস ও কৌতুক মাখানো তার মুখ, সে এত ভালো, তার কোনোরকম ক্ষতি হলে তুতুল কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না!
আলমকে এই আশঙ্কার কথা বললেই সে হেসে উড়িয়ে দেয়।
তুতুল বললো, অলির আসতে এখনো তো কিছুটা দেরি আছে। তুমি আমাকে একটা প্যাড আর কলম দেবে? মা’কে চিঠি লেখা হয়নি অনেক দিন, কবে যেন শেষ চিঠিটা লিখেছি? ইস,
কাগজ-কলম নিয়ে এসে আলম বললো, তুই এখন চিঠি লিখতে পারবি? তুতুল বললো, হ্যাঁ, পারবো। মাকে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা করে লিখি মা চিন্তা করছে কত
–তোর হাতের লেখা নকল করে আমি লিখে দেবো?
–যাঃ! অন্য হাতের লেখা মা ঠিক বুঝে ফেলবে! তা হলে তো সাংঘাতিক ভয় পেয়ে যাবে না।
–এক লাইন লিখে স্যাম্পল দেখাচ্ছি তোকে। বেশ গোটা গোটা গোল গোল করে লিখবো
–আমার হাতের লেখা মোটেই গোল গোল না। এই, তুমি সবে যাও। আমি কী লিখছি, তুমি দেখবে না!
লিখতে গিয়েই তুতুল বুঝলো, তার হাতে একটুও জোর নেই, কলম কাঁপছে। তবু লিখতেই হবে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে এক চুমুক কনিয়াক খেয়ে নিল। তারপর প্যাডটা নিয়ে এলো বুকের কাছে।
মা,
তোমাকে গত সপ্তাহে চিঠি লিখতে পারিনি, সে জন্য রাগ করেছে নিশ্চয়ই। আমাকে হঠাৎ লন্ডনের বাইরে যেতে হয়েছিল…। ক লণ্ডন শব্দটা বাংলায় লিখতে তিনবার কাটলো তুতুল। কিছুতেই ‘ণ্ড’ লিখতে পারছে না, কলম একেবেঁকে যাচ্ছে। ইংরিজিতে লেখা সোজা। হাতের লেখা যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে আসছে হঠাৎ।
আবাব সে মনের জোর এনে লিখলো, আমরা চারজন গিয়েছিলাম। জায়গাটা দারুণ সুন্দর। এবার সমুদ্রে স্নান করলাম খুব। জানো তো, এখানে এসে আমি সাঁতার শিখেছি। তোমার শরীর, তোমার শরীর, তোমার শরীর আমি ত্রিদিবমামাকে বলেছি. কলকাতায় এখন আমি খুব ভালো আছি, আমার তিন পাউ, তিন পাউ, তিন পাউ ওজন বেড়েছে…তোমার শরীর তোমার শরীর একদিন স্বপ্ন…
একটু পরে আলম পেছন থেকে এসে প্যাড আর কলম সরিয়ে নিতে গেল। তুতুল ঘুমে ঢলে পড়েছে। আলমের ছোঁয়া পেতেই সে জেগে উঠে বললো, কী? কী হয়েছে?
আলম হাসতে হাসতে বললো, আরে এই চিঠি পড়লে তোর মা ভাববে তুই গাঁজা। খেয়েছিস! হাতের লেখাটা দ্যাখ, তুই নিজেই চিনতে পারবি না।
তুতুল চিঠিটা পড়তে গিয়ে হেসে ফেললো। তারপর বললো, দাও, ওটা ছিঁড়ে ফেলে আমি আর একটা লিখছি।
আলম বললো, ক্ষ্যামা দে, ছেমরী! পারবি না। এর থেকে আমার হাতের লেখা অনেকটা কাছাকাছি হবে। আমি তোর থেকে ভালো গল্প বানাতে পারবো। তুই আবার সমুদ্রে স্নান করলি কবে রে?
তুতুল বললো, থাক, কাল লিখবো। তুমি তোমার দাড়ি কামাবার আয়নাটা একবার দাও তো!
সেই আয়নায় তুতুল যেন নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না। তার মুখখানা রক্তশূন্য, চোখে জ্যোতি নেই, চামড়াও খসখসে হয়ে গেছে। সে আস্তে আস্তে বললো, আমার ঠোঁট দুটো শুকনো হয়ে গেল কী করে?
আলম ঝুঁকে এসে একটি আলতো চুম্বন দিয়ে বললো, এখন আর শুকনো নাই। তুতুল মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে বললো, এটা ঢাকা যায় না? যদি একটা স্কার্ফ বেঁধে রাখি?
আলম বললো, দাঁড়া তোকে আমি সাজিয়ে দিচ্ছি। স্নো-পমেটম লাগিয়ে একেবারে সিনেমার হিরোইন বানিয়ে দেবো!
একটা জাপানী সিল্কের স্কার্ফ এনে আলম এমনভাবে তুতুলের মাথায় বেঁধে দিল যে সত্যিই ঢাকা পড়ে গেল ব্যাণ্ডেজ। ঠোঁটে বুলিয়ে দিল হালকা করে লিপস্টিক। গালে রুজ লাগাতে গেলে তুতুল আপত্তি করলো, আলম শুনলো না।
আয়নাটা তুলে আলম বললো, এইবার দ্যাখ, আগের চেহারা ফিরে এসেছে কি না! আর একটু কনিয়াক খেয়ে নে, তাইলে গায়ে জোর পাবি।
তারপর একটু দূরে সরে গিয়ে তুতুলকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর আলম বললো, শোন, একটা কথা বলি। আমি বাইরে চলে যাবো? তোর দেশ থেকে চেনা মানুষ আসবে, সে তো আমার কথা কিছু জানে না।
তুতুল বললো, না, তুমি কোথায় যাবে? তোমার কথা আমি জানিয়ে দেবো। মা’কেও এবারের চিঠিতেই সব লিখবো। কিন্তু তুমি আমার অসুখের কথাটা বলো না, প্লীজ। মা দারুণ ভয় পেয়ে গিয়ে নিজেই একটা অসুখ বাধিয়ে বসবে।
একটু থেমে তুতুল আবার বললো, তুমি আমায় এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে যেও না।
অলি এলো ঠিক সাড়ে সাতটার সময়। তার সঙ্গে তার বাবার বন্ধুর মেয়ে বিশাখা। আলম তো দরজা খোলার সময়েই তুতুল কনিয়াকে শেষ চুমুক দিয়ে গেলাসটা নীচে ফেলে দিয়ে হাসি। মুখে বললো, আয় রে, অলি। দ্যাখ আমার কী অবস্থা! সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে আছাড় খেয়ে কোমরে চোট লেগেছে, উঠতে পারছি না বিছানা ছেড়ে! দু’দিন হয়ে গেল!
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, অল্প অল্প ভিজে এসেছে অলি। মাথার চুল খোলা। তুতুল প্রথমেই লক্ষ করলো, অলির সারা শরীরে ঝলমল করছে স্বাস্থ্যের দীপ্তি। অলির হাত ধরে সে বললো, তুই কী সুন্দর হয়েছিস রে, অলি! কতদিন পর তোকে দেখলাম।
অলি বললো, তুমি এত রোগা হয়ে গেলে কী করে, তুতুলদি? অবশ্য রোগা হলেও তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
–আমি বুঝি কোনোদিন মোটা ছিলাম? এ দেশে সবাই রোগা হবার সাধনা করে। আলাপ করিয়ে দিই। এই আমার স্বামী আলম! আর এই অলি, অলিকে আমি ওর বাচ্চা বয়েস থেকে চিনি, ফ্রক পরে খেলা করতে আসতো!
আলমের পরিচয় পেয়ে অলি অবাক হয়নি। লণ্ডনের বাঙালী মহলে তুতুল ও আলমের বিয়ের কথা অনেকেই জানেন। বাংলাদেশ যুদ্ধের জন্য প্রচার ও চাঁদা তোলার অনুষ্ঠানের একজন প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে আলমের নাম বেশ পরিচিত, এই বিবাহ-কাহিনীটি বহু-আলোচিত। অলিও লণ্ডনে পা দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনেছে।
উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে অলি বললো, আপনি তা হলে আমার জামাইবাবু!
বিশাখা বললো, ওরা বলেন দুলাভাই, তাই না?
বিশাখা অনেক কম বয়েস থেকে রয়েছে এ দেশে, তার উচ্চারণে খানিকটা জড়তা থাকলেও সে মোটামুটি বাংলা বলতে পারে। সে একটি স্কুলে পড়ায়। আলম তাকে বললো, আসুন আমরা একটু অন্য জায়গায় বসি, ওরা দু’জনে তো এখন কলকাতার গল্প করবে!
তুতুল বললো, কেন, তোমাদের বুঝি কলকাতার গল্প শুনতে ইচ্ছে করে না? আগে আমার মায়ের কথা বলো, অলি। আসবার সময় আমার মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
মিথ্যে কথা বলতে অলির আর দ্বিধা নেই। প্রতাপকাকাও তাকে মিথ্যে বলার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। সে বললো, হ্যাঁ, আসবার দিন বিকেলেই তো পিসিমণির সঙ্গে দেখা হয়েছে। পিসিমণি ভালো আছেন। তুমি আজকাল কম চিঠি লেখো বললেন!
তারপর প্যাকেট খুলে বললো, এই নাও, তোমার জন্য শাড়ী পাঠিয়েছেন পিসিমণি। আর তোমার ঘি আর আচার। মুন্নি তোমার জন্য পাঠিয়েছে দুল। দুলাভাই, আপনার জন্য কিন্তু কিছু নেই, আপনারা বিয়ের কথা এখনো জানাননি।
আলম বললো, এমন বিয়াই করলাম, জামাই আদর আর কোনোদিন ভাগ্যে জুটবে না!
-–কেন, আপনারা কলকাতায় যাবেন না?
তুতুল বললো, এই সেপ্টেম্বরেই যাবো ঠিক করেছি রে! এবার ঠিক যাবো। এতদিন যাবো যাবো করে কিছুতেই যাওয়া হয়নি!
আলম বললো, আমাকেও নিয়ে যেতে চাও? তারপর শাশুড়ি যদি আমার দিকে ঝাঁটা নিয়ে তেড়ে আসেন?
অলি বললো, যাঃ, কী বলছেন? পিসিমণি মোটেই সেরকম মানুষ নন।
আলম হাসলো। তুতুল যখন তার মাকে প্রথম তার মনোনীত মুসলমান স্বামীর কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিল, তার উত্তরে তিনি লিখেছিলেন যে মুসলমান বিয়ে করলে তিনি জীবনে আর মেয়ের মুখ দেখবেন না। সে চিঠি আলম দেখেছে। এরপর যে তুতুলের মায়ের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটেছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তুতুল তবু জোর দিয়ে বললো, এবার আমরা কলকাতা যাবোই!
বিশাখা এখনো বিয়ে করেনি। তার একজন ঘনিষ্ঠ পুরুষ বন্ধুও মুসলমান, তবে সে আলজিরিয়ার লোক। তার সঙ্গে মেলামেশার সময় সে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্যের ব্যাপারটা কিছুই বোঝেনি, অথচ দেশের লোকদের মুখেই শুধু এই ধরনের কথা শোনা যায়। আলম-তুতুলের বিয়ে নিয়ে তাদের বাড়িতেও অনেক কথা হয়েছে, তার মা এর বিপক্ষে। অথচ তার আলজিরিয়ান বন্ধু হামিদের মা তাকে খুব পছন্দ করেন। হিন্দু-মুসলমানের যত দ্বন্দ্ব কি শুধু ইণ্ডিয়া-পাকিস্তানে? অবশ্য আলজিরিয়ায় হিন্দু নেই।
অন্যান্য গল্প হতে হতে তুতুল এক সময় জিজ্ঞেস করলো, তুই কবে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছিস রে, অলি? এখান থেকে বাবলুকে ফোন করেছিস?
অলি বললো, না, ফোন করিনি। আমি এখানে চারদিন থাকবো।
–লণ্ডনে পৌঁছে একবারও ফোন করিসনি? এখন কর, আমাদের এখান থেকেই কর, তা হলে আমিও কথা বলবো! আলম, লাইনটা ধরে দাও না। দ্যাখো, বস্টনের নম্বর লেখা আছে।
তুতুল বললো, পার্সন টু পার্সন কল করো। অলির গলা শুনে একেবারে চমকে যাবে। ছেলেটা!
অলির একটু একটু লজ্জা করছে। এখানে এতজনের সামনে সে বাবলুদার সঙ্গে কী কথা। বলবে? সে কবে-কখন নিউইয়র্ক পৌঁছোচ্ছে, সে খবর তো বাবলুদা জানেই। তার মৃদু আপত্তি কেউ শুনলো না।
আলম বললো, খুব ভালো হবে, একটা প্লেজান্ট সারপ্রাইজ হবে। শুধু তাকে এখন বাড়িতে পেলে হয়।
টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে আলম বললো, আমাদের বিয়ের রাত্তিরেই অতীন ওখান থেকে ফোন করেছিল। ভেরি নাইস অফ হিম। তুতুল, তোমার ভাইয়ের পদবীটা যেন কী?
অন্য তিনজন কথা থামিয়ে উৎকর্ণ হয়ে রইলো। আলম কথা বললো অপারেটরের সঙ্গে, একটুক্ষণ ধরে রইলো, তারপর বললো, নট অ্যাট হোম। জানি তো, আমেরিকায় ইয়াং ছেলে-পুলেরা বাড়িতে প্রায় থাকেই না! কাল রাতেও সে নাকি বাড়িতে ফেরে নি।
অলি আস্তে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বললো, তুতুলদি, আজ বিশাখা আমাদের জন্য সিনেমার টিকিট কিনেছে, বেশীক্ষণ থাকতে পারছি না।
তুতুল বললো, ওমা, আজই সিনেমায় যাবি? কিছুই তো শোনা হলো না। আলম তাদের চা-ও খাওয়ালো না।
আলম বললো, সন্ধ্যার পর চা খাওয়া ভালো না। ব্যাড ফর হেলথ। যদি ওয়াইন-টোয়াইন। খেতে চাও…
অলি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, না, না, ওসব কিছু খাবো না। আজ তা হলে যেতে হয়।
তুতুল বললো, সিনেমা তো সব জায়গাতেই দেখতে পাবি। লণ্ডনে দু’একটা থিয়েটার দেখে যা। ব্রিটিশ মিউজিয়াম আর টেট গ্যালারিতে অবশ্যই একবার যাবি। আমার হঠাৎ এই কোমরে ব্যথা না হলে আমিই তোকে নিয়ে যেতে পারতাম।
.
অলি বললো, বিশাখাই আমাকে অনেক জায়গায় ঘোরাচ্ছে। ওর স্কুল এখন ছুটি। আজই। তো টেট গ্যালারি আর মাদাম টুসো দেখলম। কাল যাচ্ছি স্টার্ট ফোর্ড অন আভন।
তুতুল অলির চোখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বললো, অলি, সত্যি কথা বল। তো, আমার মায়ের শরীর কেমন আছে? একদিন স্বপ্নে দেখলাম…
.
অলি জোর দিয়ে বললো, পিসিমণি এখন সত্যি বেশ ভালো আছেন। মাঝখানে কিছুদিন সর্দি কাশিতে ভুগেছিলেন, সে মাসখানেক আগে। উনি আমার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে একতলার দরজা পর্যন্ত নেমে এলেন। আমার হাত ধরে বললেন, মেয়েটা আজকাল আর বেশী চিঠি লেখে না, তুই গিয়েই একটা খবর দিবি–
তুতুল বললো, তুই যেন আমার কোমরে ব্যথার কথাটা মাকে লিখতে যাস না। দু’দিনেই ভালো হয়ে যাবো। কালকেই মাকে চিঠি লিখবো। আমার বিয়ের কথাটা এবারে জানাবো। আমিই জানাবো, তোর লেখার দরকার নেই।
–সেই ভালো! তুতুলদি, আমি যাবার আগে পারলে আর একবার আসবো!
আলম ওদের এগিয়ে দিতে গেল লিফট পর্যন্ত। সে একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটের ধোঁয়ায় যদি হঠাৎ তুতুলের হাঁচি আসে, তাতে তার খুব ক্ষতি হবে, সেই জন্য আলম ঘরের মধ্যে সিগারেট খায় না।
অলি জিজ্ঞেস করলো, অপারেশন তো সাকসেসফুল হয়েছে? আর কোনো ভয় নেই, তাই না?
আলম তার বিস্ময়ের চমকটা লুকোতে পারলো না। তার দু’চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল।
বিশাখা বললো, মিঃ আলম, আপনারা দু’জনে একটি রোমান্টিক কাপল হিসেবে লণ্ডনে বেশ। ফেমাস। মিসেস আলমের যে ব্রেইন টিউমার অপারেশান হয়েছে, তাও অনেকে জানে। বিয়ের পরেই এরকম একটা অসুখ…
.
আলম বললো, আপনি বুঝতে পেরে গেছেন? আপনার চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য তুতুলকে কত রকম মেক আপ দেওয়া হলো।
অলি বললো, মেয়েদের চোখ ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। সত্যি কী হয়েছিল এবার বলুন।
আলম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, অসুখের সিমটম দেখা গিয়েছিল। বিয়ের আগেই। খুবই সাকসেসফুল অপারেশান হয়েছে। রিকভার করতে খানিকটা সময় লাগবে, কিন্তু আর ভয়ের কিছু নেই।
অলি বললো, তুতুলদি ভালো হয়ে যাবেন। নিশ্চয়ই ভালো হয়ে উঠবেন।
আলম বললো, আই মাস্ট থ্যাঙ্ক ইউ। আপনি যে বুঝতে পেরেছেন বা জানেন, সেটা ওকে একবারও বুঝতে দেননি।
অলি বললো, আমি ওঁর মাকে কিছু লিখবো না। চিন্তা করতে বারণ করবেন। এই সময় চিন্তা করা খুব খারাপ। কলকাতার সবাই ভালো আছে, আপনি বুঝিয়ে বলবেন ওঁকে।
তুতুলদিকে সবাই ভালোবাসে, তার কোনো কাজে কেউ রাগ করবে না।
অলিরা চলে যাবার পর আলম সিগারেটটা অর্ধেক অবস্থাতেই ফেলে দিয়ে ফিরে এলো ঘরে। তুতুল চোখ বুজে ছিল, শব্দ শুনে চোখ মেলে, ফ্যাকাসেভাবে হেসে জিজ্ঞেস করলো, আমি কেমন অভিনয় করলাম?
আলম বললো, যেমন ফুটফুটে সুন্দরী দেখাচ্ছে, তেমনই দুর্দান্ত অভিনয়, তোরে এবার সিনেমায় নামাতেই হবে দেখছি!
আলমকে বিছানার কাছে ডেকে বসিয়ে তুতুল বললো, অলিকে দেখে আমার এমন মন কেমন করলো কলকাতার জন্য। মাঝে মাঝে জোর করে কলকাতার কথা ভুলে থাকতে চেষ্টা করি! অলি আগে খুব লাজুক ছিল, এখন বেশ স্মার্ট হয়েছে। তোমার ওকে ভালো লাগেনি?
আলম বললো, হুঁ, বেশ স্মার্ট। এবার তুই ঘুমা। ওষুধগুলা দেই?
–আমার আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না। আর একটু গল্প করি। আলম, এই সেপ্টেম্বরে কিন্তু সত্যিই একবার দেশে যাবো।
–তোমার দেশে তুমি যেতে পারো। আমি তো ঢাকায় যেতে পারবো না। কতদিনে আমাদের যুদ্ধ শেষ হবে কে জানে!
–তুমিও কলকাতায় যাবে। মা এখন ঠিকই বুঝবে। তোমাকে দেখলেই মা সব রাগ ভুলে যাবে।
–আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। এখন কিন্তু তোমারে ঘুমাইতেই হবে। ত্রিদিববাবুর আজ আসার কথা আছে একবার। ফোন করেছিলেন। তখনই তুমি ঘুমায়ে থাকলেও ক্ষতি নেই। আমি ওনার সাথে কথা বলবো।
–তুমি কিন্তু ত্রিদিবমামাকে আজ মদ খাওয়াবে না। মদ খেলে উনি উঠতেই চান না, বড্ড রাত করে দেন।
–উনি যে স্কচ খান, তা রাখিই নাই আমার কাছে।
–উনি তো নিজেই নিয়ে আসেন। তুমি গেলাস দেবে না। ঘরের মধ্যে চুরুট খাওয়াও অ্যালাউ করবে না।
–ঠিক আছে, ঠিক আছে, অতশত ভাবতে হবে না। তুমি এবার চোখ বুজে শুয়ে থাকো।
আলম তুতুলকে পর পর কয়েকটা ওষুধ খাওয়ালো। জল খাওয়াবার পর ঠোঁট মুছিয়ে দিয়ে বললো, এইবার একখান ঘুমপাড়ানি গান করবো? আয় ঘুম যায় ঘুম দত্ত পাড়া দিয়ে, দত্তদের বউ পান খেয়েছে এলাচদানা দিয়ে…
ঝনঝন করে বেজে উঠলো টেলিফোন। অল্প একটুক্ষণ কথা বলে আলম ফিরে আসার পর তুতুল জিজ্ঞেস করলো, কে? বাবলু?
–না। ভারি মজার ব্যাপার। শাজাহান সাহেব, তিনি কাছেই এক জায়গায় আছেন, একবার আসতে চান। একেই বলে বোধহয় নিয়তি।
–কেন, নিয়তি কেন?
–যে দিন তোমার ত্রিদিবমামা আসেন, সে দিনই শাজাহান সাহেবও এসে হাজির হয়ে যান। অথচ ওনারা দু’জন যে পরস্পরকে পছন্দ করেন না, তা তো বোঝাই যায়। আমি আর কী করবো, শাজাহান সাহেব আসতে চাইলে তো না বলতে পারি না।
–এবার আমার সত্যি ঘুম পেয়ে গেল। ওরা দু’জন এলে তুমি বেশী ঝুত করো না। আর একটা কথা শোনো। কাল থেকে তুমি সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকবে না আমার জন্য। তুমি তোমার কাজ করতে যাবে। তোমার এখন কত কাজ!
–এই যে একটু আগে কইলা যে আমি যেন এক মুহূর্তের জন্যও তোমারে ছেড়ে না যাই।
–সেটা অন্য। তুমি দূরে থাকলেও আমাকে ছেড়ে যাবে না।
শাজাহানই এলেন ত্রিদিবের আগে। যথারীতি তাঁর নিখুঁত পোশাক, হাতে এক গুচ্ছ ফুল। এর আগে তিনি হাসপাতালেও তুতুলকে দেখতে গিয়েছিলেন। তুতুলকে ঘুমন্ত দেখে তিনি নিঃশব্দে চলে এলেন জানলার ধারে। আলমকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন খবরাখবর।
তুতুল একবার চোখটা একটু খুলে জিজ্ঞেস করলো, কে?
শাজাহান এগিয়ে এসে ব্যগ্রভাবে বললেন, কেমন আছো, বহিশিখা? আমি শাজাহান। তুতুল অস্ফুট গলায় বললো, ভালো আছেন, শাজাহানভাই?
শাজাহান বললেন, আমরা তো ভালো আছিই। আমরা তোমার জন্য তুমি খুব জলদি সেরে উঠলেই আমাদের আনন্দ…
তুতুল আর কথা বললো না, তার চোখ বুজে গেল, সে ফিরে গেছে তার জগতে।
তুতুলের একটা হাত তুলে নিয়ে সামান্য চাপ দিলেন শাজাহান। তারপর আবার জানলার কাছে এসে আলমকে বললেন, এরপর ওকে নিয়ে একবার সুইজারল্যাণ্ড ঘুরে আসো বরং। তাড়াতাড়ি ওর শরীর সারবে সেখানে। যদি বলো, আমি জুরিখে থাকার জায়গার বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।
আলম বললো, আর কয়েকটা দিন যাক। ও যেতে চাইবে কি না…
এরপরেই এসে পড়লেন ত্রিদিব। যারা আট-দশ বছর আগে ত্রিদিবকে দেখেছে কলকাতায়, তারা এই মানুষটিকে চিনতেই পারবে না। সেই অতিমাত্রায় ভদ্র, সুরুচি সম্পন্ন, ছিমছাম চেহারার ত্রিদিব এখন অন্য মানুষ। হঠাৎ অতিরিক্ত মোটা হয়ে গেছেন, শুধু মোটা নয়, শরীরে একটা থলথলে ভাব, হাঁটেন থপথপ করে। কলকাতা বা দিল্লিতে যিনি এক ফোঁটা মদ স্পর্শ করতেন না, আজ তিনি অ্যালকোহলিক। বেশী মদ খেলেই তিনি বেশী কথা বলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে যেন পশ্চিম দিগন্তের মেঘলা সূর্যাস্ত। শেষ বর্ণাঢ্য ভাবুটাও নেই।
তিনি ঘরে ঢুকলেনই শেকপীয়ারের কোনো ট্র্যাজেডির চরিত্র হয়ে। প্রায় ছুটে তুতুলের বিছানার কাছে গিয়ে বললেন, তুতুল! তুতুল কেমন আছে? জ্ঞান ফেরেনি?
তারপর দু’হাত তুলে হাহাকার করে বলে উঠলেন, কর্ডেলিয়া, কর্ডেলিয়া, স্টে আ লিটল!
ত্রিদিব তুতুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন, আলম শেষ মুহূর্তে তাঁকে ধরে ফেলে মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় বললো, এ দিকে আসুন। ওকে ডিসটার্ব করবেন না।
ত্রিদিবের মুখে জ্বলন্ত চুরুট, আজ তিনি ক্ষমতার অতিরিক্ত পান করে ফেলেছেন। তিনি খানিকটা টলে গিয়ে, কান্না কান্না গলায় বললেন, তুতুলের জন্য আমার এত কষ্ট হয়, ওর সার্জন মিঃ রবিনসন আমায় বললেন সে দিন, খুবই ক্রিটিক্যাল কেস, ইউ হ্যাভ টু কিপ ইয়োর ফিংগার ক্রসড়! আমাদের তুতুল…
আলম বললেন, সে কথা উনি বলেছিলেন অপারেশানের আগে। কিন্তু অপারেশান সেন্ট পারসেন্ট সাকসেসফুল বলা যায়।
আলমের দু’কাঁধে হাত রেখে ত্রিদিব বললেন, আলম, তুই তুতুলের ভার নিয়েছিস, তুই অতি ভাগ্যবান রে। তুতুলের মতন এমন লক্ষ্মী মেয়ে আর হয় না!
ত্রিদিবের ঠোঁট থেকে চুরুটটা ছাড়িয়ে নিয়ে আলম বললো, আপনি বসুন।
ত্রিদিব তবু কাতর ভাবে বললেন, আলম, তুই আমাকে সত্যি কথা বল, ধোঁকা দিস না, ওর জ্ঞান ফেরেনি, তবু তুই ওকে হাসপাতাল থেকে কেন নিয়ে এলি?
শাজাহান বললেন, বহিশিখা ঘুমোচ্ছে, এ ঘরে এত গোলমাল না করে আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলতে পারি।
ত্রিদিব যেন এই প্রথম শাজাহানকে দেখলেন। তাঁর দিকে ঘোলাটে চোখ দুটো তুলে বললেন, তুমি এখানে এত ঘন ঘন আসো কেন বলো তো? আমি যখনই আসি, তোমাকে দেখি।
শাজাহান অতি ভদ্রভাবে বললেন, ইঁট মাস্ট বী আ কয়েনসিডেন্স। উল্টো করে বলা যেতে পারে, আমি যখনই আসি, সে দিনই তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
ত্রিদিব বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললেন, এসো না। তুমি এখন এই মেয়েটার কাছে এসো না। তুমি অপয়া।
শাজাহানের মুখখানা অপমানে রক্তাভ হয়ে গেল। তবু তিনি ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন না করে শান্ত গলায় বললেন, হোয়াট ডু ইউ মীন?
–তুমি এই মেয়েটার কাছে এত ঘন ঘন আসো কেন? সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তুমি আঠার মতন লেগে থাকো। স্পেয়ার তুতুল, প্লিজ, শাজাহান, আই বিসিচ ইউ…
–ইউ হ্যাভ গট আ ডার্টি মাইণ্ড, ত্রিদিব! আমি আসি, আমি আসি…তার আগে বলো, তুমি কেন আসো!
আলম দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললো, জেন্টেলমেন, আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, আমাকে একটা অপ্রিয় কথা বলতে হবে। আপনারা দু’জনেই এখন প্লিজ বাইরে যান।
ত্রিদিব তেড়িয়াভাবে বললেন, দ্যাখ আলম, তুই তুতুলকে বিয়ে করেছিল বলেই একেবারে মাথা কিনে নিসনি। সব সময় মনে রাখবি, এই তুতুল, প্রতাপ মজুমদারের অতি আদরের ভাগ্নী, জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু প্রতাপ, আমার ভগ্নিপতি, সে কখনো পরিবারের লোকজনকে তা বুঝতে দেয়নি। প্রতাপ, তার দিদি আশা করে আছে, বড় ডাক্তার হয়ে তুতুল একদিন দেশে ফিরবে, সকলের–
এই সময় তুতুল হঠাৎ চোখ মেলে ধড়মড় করে উঠে বসে বললো, ত্রিদিবমামা এসেছে? আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম এই মাত্র…
ত্রিদিব সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিরাট উল্লাসের চিৎকার করে বললেন, কর্ডেলিয়া, মাই কর্ডেলিয়া, শী ইজ ব্যাক!
ত্রিদিব আর একটু হলেই তুতুলের বিছানার ওপর পড়ে যেতেন, এবার শাজাহান আর আলম দু’জনেই তাঁকে ধরে ফেললেন। আলম প্রায় ধাক্কা দিয়েই ত্রিদিবকে সরিয়ে দিয়ে তুতুলের মাথায় হাত দিয়ে বললো, কিছু হয়নি। তুমি শুয়ে পড়ো। তুমি ঘুমোও!
তুতুল একজন ঘোরলাগা মানুষের মত বললো, আমি স্বপ্ন দেখলাম, সুলেখা মামীমাকে। আলম, তুমি সুলেখা মামীমার কথা জানো না! ত্রিদিবমামার বউ ছিলেন। কোথায় তিনি হারিয়ে গেলেন। হঠাৎ আমি সুলেখা মামীমাকে আজই স্বপ্নে দেখলাম কেন এই মাত্র!
–তুতুল, প্লীজ কথা বলো না। আবার শুয়ে পড়ো।
–না, আমার ঘুম চলে গেছে। ঐ তো ত্রিদিমামা! ত্রিদিবমামা, সুলেখা মামীমার কী হয়েছিল?
ত্রিদিব হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলেন। তুতুলকে প্রায় সুস্থভাবে কথা বলতে শুনেই তিনি যেন সংযত হয়েছেন। তিনি রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললেন, সুলেখার তো কিছু হয়নি। সে ভালো আছে। তুই সুলেখাকে স্বপ্ন দেখলি? তুই কি ভাগ্যবান, আমি একবারও দেখি না!
তুতুল বললো, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, তোমরা কথা বলছিলে, এই সময় আমি দেখলাম, সুলেখা মামীমা এসেছে, ঐ দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে।
ত্রিদিব বললেন, কী বলছিস তুই। সুলেখা এখানে আসবে কী করে? না, না, তুই এ সব কথা ভাবিস না! সুলেখা নেই, কোথাও নেই রে! আমি যেখানে থাকি, সেখানে তো সুলেখা কিছুতেই আসবে না। সে যে আমার ওপরেই বিষম অভিমান করে চলে গেছে। সেই জন্য একবারও স্বপ্নেও সে আমাকে দেখা দেয় না।
তুতুল এবারে পরিষ্কার সোজা হয়ে বসে জিজ্ঞেস করলো, স্বপ্ন নয়, যেন সত্যি সুলেখা মামীমাকে দেখলাম। ত্রিদিবমামা, বলো, কেন সুলেখা মামীমা চলে গিয়েছিল? কিসের অভিমান!
ত্রিদিব ধরা গলায় বললেন, এই শাজাহান জানে। ওকে বলতে বল! শাজাহান আকাশ থেকে পড়ার মতন ভঙ্গিতে বললেন, আমি? আমিও তো এত বছর ধরে সেই উত্তরটাই খুঁজছি!
জানলার কাচ খুলে বাইরের টাটকা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে ত্রিদিব বললেন, এই কথা নিয়ে আমি কারুর সঙ্গে এতদিন কোনো আলোচনা করিনি। তুতুল, তুই জিজ্ঞেস করলি…
আলম বললো, আজকের মতন এ সব আলোচনা বন্ধ রাখলে হয় না? আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা খুব মর্বিড় মনে হচ্ছে!
ত্রিদিব আলমের দিকে হাত তুললেন, তুতুল বললো, আলম, একটু শুনতে দাও, তারপর, আই প্রমিজ, ঘুমিয়ে পড়বো!
ত্রিদিব জানলার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালেন একজন অভিনেতার মতন। কোটের দু’পকেট চাপড়ে চুরুট খুঁজলেন। না পেয়ে কাঁধটা সামান্য ঝাঁকিয়ে তিনি বললেন, সুলেখা, এর মধ্যেই সে যেন কত দূরের মানুষ! কারুক্কে সুলেখার কথা বলিনি। তুতুল, তুই জিজ্ঞেস করলি, তোর এত অসুখ, তোর অনুরোধ ফেলতে পারি না। তাকে সেরে উঠতেই হবে রে! তোর মা, তোর মামা প্রতীক্ষা করে আছে তোর জন্য হ্যাঁ, সুলেখার কথা। জীবনে আমি সুলেখাকে একটাও রাগের কথা বলিনি। শুধু একবার, সেটাও কিন্তু রাগের কথা নয়। ভগবান শুধু সাক্ষী। আমি রাগ করে বলিনি, কেই বা তা বিশ্বাস করবে? ভগবান তো তার সাক্ষী দিতে আসে না কখনো।
শাজাহান বললেন, আমি আলমের সঙ্গে এক মত। আজ এ সব কথা থাক।
ত্রিদিব বললেন, শাট আপ! আমাকে বলতে দাও! জানিস তুতুল, আমার বউ সুলেখা, সে তার অ্যাডমায়ারার, ভক্ত আর প্রেমিকদের এড়াবার জন্য কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছিল দিল্লি। আমাদের কী সুন্দর দিন কাটছিল দিল্লিতে। আমরা প্রত্যেক উইক এণ্ডে নিজেদের নেমন্তন্ন করতুম, মনে আছে লোদি গার্ডেনসে, গরমের দিনে দুপুর রোদ্দুরে গেছি, ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ, আমরা ছায়া খুঁজছি, কতরকম ফুল ফুটেছে, কাঠবেড়ালিরা দৌড়োদৌড়ি করছে, এক জায়গায় সুলেখা তার জীবনে প্রথম ম্যাগনোলিয়া গ্র্যান্ডিফ্লোরা ফুল দেখলো, কী খুশি সে.তবু আমরা বাড়ি ফিরলেই দেখতুম, কলকাতা থেকে তার কোনো প্রেমিক এসে হাজির হয়েছে। এই শাজাহান কিংবা রাতুল! যেন দিল্লিতে তাদের কত কাজ! আমি ওদের আদর যত্ন করে আমার বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। কিন্তু ওরা তো আমার জন্য আসতো না। আসতো সুলেখার জন্য!
শাজাহান বললেন, ত্রিদিব, প্লীজ, এ সব কথা সত্যি নয়। উই ওয়ার গ্রেট ফ্রেণ্ডস! থ্রি অব আস!
ত্রিদিব সে কথা অগ্রাহ্য করে বললেন, একদিন, বুঝলে তুতুল, আমি বাড়িতে ছিলুম না। এই শাজাহান আর রাতুল বলে আমাদের আর এক বন্ধু মারামারি করলো, লাইক টু ডগস ফাইটিং ওভারে আ পিস অব মিট, সেই মাংসের টুকরোটা ছিল সুলেখা! যেন আমি কেউ নয়!
–ত্রিদিব, ইউ আর মিসটেকেন! আমি মারামারি করিনি। তোমাদের সেই বন্ধু রাতুল, সে একটা গোঁয়ার এবং বুট, সে-ই শুরু করেছিল, তোমরা যে কী করে তাকে প্রশ্রয় দিতে!
–চুপ করো, শাজাহান! আমরা সবাইকেই প্রশ্রয় দিতুম। আমি আর সুলেখা ছিলুম। ভদ্রতার কারাগারে বন্দী। আজ তুতুল জানতে চেয়েছে…সে দিন বাড়ি ফিরে ঘটনাটা শোনার পর, আই ফেল্ট সো স্যাড, আমার মনে হয়েছিল, আমি সুলেখার যোগ্য নই, আমি বিচালির গাদায় কুকুরের মতন সুলেখাকে শুধু শুধু আটকে রেখেছি। সারা পৃথিবী সুলেখাকে চায়। হঠাৎ সেই কথা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, ওনলি ওয়ান সেনটেন্স, একটি মাত্র বাক্য, দ্যাট রুইনড টু লাইভস, আমি বলেছিলুম, সুলেখা, আমি বোধহয় তোমাকে বন্দী করে রেখেছি, এবার আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম, তুমি যে-কোনো একজনকে বেছে নিতে পারো, পারহ্যাপস। শাজাহানের সঙ্গই তুমি নতুন জীবন শুরু করতে পারো। এ কথা শুনেই সুলেখা বুক হাটা আওয়াজ করলো, কী বললে? তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না? আমার যেন মনে হলো, সুলেখার সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরে গেছে আমার এ কথা শুনে, সে এমন ছটফট করতে লাগলো, যেন আগুন লেগেছে, আমি ছুটে তাকে ধরতে পারলুম না! তারপর এক সময় দেখি, সত্যিই তার সারা গায়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে.তুতুল, তোকে আমি…
ত্রিদিব আর কথা শেষ না করে দু’হাতে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলেন। শাজাহান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন নিঃশব্দে।
তুতুল একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আলম, আমাকে একটু ধরো। আলম আপত্তি করতে পারলো না। তুতুলকে বিছানা ছেড়ে উঠতে সাহায্য করলো। সে ভেবেছিল, তুতুলকে বাথরুমে নিয়ে যেতে হবে। বাড়িতে এসে তুতুল কিছুতেই বেড় প্যান। নিতে চায় না!
তুতুল টলটলে পায়ে এগিয়ে এসে ত্রিদিবের পিঠে হাত রেখে বললো, ত্রিদিমামা, এ তো অনেকদিন আগেকার ঘটনা। তবু তুমি এখনো এত কষ্ট পাও? নিজেকে একেবারে নষ্ট করে ফেলছো?
ত্রিদিব মুখ না তুলেই বললেন, আমি নিজেকে নষ্ট করছি না রে, তুতুল। আমার জীবনে আর কোনো উন্নতির আশাও কেউ করে না। আমি ভালোও নেই, খারাপও নেই। অথচ বেশ আছি! আমি সুলেখার কথা আর বিশেষ ভাবি না, সুলেখাও আমার জীবনে কিংবা স্বপ্নে ফিরে আসে না। তবু সে চলে যাবার পরেও হয়তো কোথাও আছে। আমি এখনো চলে যাইনি। কিন্তু আমি এখানেও নেই!
মুখ তুলে তিনি আলমকে বললেন, আমার চুরুটটা কোথায় ফেলে দিলে? একবার তুলে এনে দাও, প্লীজ! একটুও মদ নেই তোমার বাড়িতে? থাকলে একটু দাও, অন্তত দু’এক পেগও যদি থাকে…বড্ড তেষ্টা, বড্ড যন্ত্রণা! তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠো, তুতুল, আমাদের আয়ু। আমরা তোমাকে দেবো! তুমি ভালো হয়ে ওঠো! তুমি এত ভালো!