দশম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ১১ই অক্টোবর
নিবৃত্তিমার্গ — ঈশ্বরলাভের পর কর্মত্যাগ
[ঈশানকে শিক্ষা — উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত — কর্মযোগ বড় কঠিন]
ঈশান হাজরার সহিত কালীঘরে গিয়াছেন। ঠাকুর ধ্যান করিতেছিলেন। রাত্রি প্রায় ৭।। টা। ইতিমধ্যে অধর আসিয়া পড়িয়াছেন ।
কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর মা-কালী দর্শন করিতে গিয়াছেন। দর্শন করিয়া পাদপদ্ম হইতে নির্মাল্য লইয়া মস্তকে ধারণ করিলেন — মাকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিলেন এবং চামর লইয়া মাকে ব্যজন করিলেন। ঠাকুর ভাবে মাতোয়ারা! বাহিরে আসিবার সময় দেখিলেন, ঈশান কোশাকুশি লইয়া সন্ধ্যা করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈশানের প্রতি) — কি, আপনি সেই এসেছ? আহ্নিক করছ। একটা গান শুন।
ভাবে উন্মত্ত হইয়া ঈশানের কাছে বসিয়া মধুর কন্ঠে গাইতেছেন:
গয়া গঙ্গা প্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়!
কালী কালী কালী বলে আমার অজপা যদি ফুরায় ।।
ত্রিসন্ধ্যা যে বলে কালী, পূজা সন্ধ্যা সে কি চায়।
সন্ধ্যা তার সন্ধানে ফেরে কভু সন্ধি নাহি পায়।।
দয়া ব্রত দান আদি আর কিছু না মনে লয়,
মদনেরই যাগযজ্ঞ ব্রহ্মময়ীর রাঙ্গা পায়।
“সন্ধ্যাদি কতদিন? যতদিন না তাঁর পাদপদ্মে ভক্তি হয় — তাঁর নাম করতে করতে চক্ষের জল যতদিন না পড়ে, — আর শরীর রোমাঞ্চ যতদিন না হয়।
রামপ্রসাদ বলে ভক্তি মুক্তি উভয়ে মাথায় রেখেছি,
আমি কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি।
“যখন ফল হয়, তখন ফুল ঝরে যায়; যখন ভক্তি হয়, যখন ঈশ্বরলাভ হয়, — তখন সন্ধ্যাদি কর্ম চলে যায়।
“গৃহস্থের বউর পেটে যখন সন্তান হয়, শাশুড়ী কাজ কমিয়ে দেয়। দশমাস হলে আর সংসারের কাজ করতে দেয় না। তারপর সন্তান প্রসব হলে সে কেবল ছেলেটিকে কোলে করে তার সেবা করে। কোন কাজই থাকে না। ঈশ্বরলাভ হলে সন্ধ্যাদি কর্ম ত্যাগ হয়ে যায়।
“তুমি এরকম ঢিমে তেতালা বাজালে চলবে না। তীব্র বৈরাগ্য দরকার। ১৫ মাসে এক বৎসর করলে কি হয়? তোমার ভিতরে যেন জোর নাই। শক্তি নাই। চিড়ের ফলার। উঠে পড়ে লাগো। কোমর বাঁধো।
“তাই আমার ওই গানটা ভাল লাগে না! ‘হরিষে লাগি রহরে ভাই, তেরা বন্ত বন্ত বনি যাই।’ বন্ত বন্ত বনি যাই — আমার ভাল লাগে না। তীব্র বৈরাগ্য চাই। হাজরাকেও তাই আমি বলি।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও যোগতত্ত্ব — কামিনী-কাঞ্চন যোগের বিঘ্ন ]
“কেন তীব্র বৈরাগ্য হয় না জিজ্ঞাসা করছ? তার মানে আছে। ভিতরে বাসনা প্রবৃত্তি সব আছে। হাজরাকে তাই বলি। ও-দেশে মাঠে জল আনে, মাঠের চারিদিকে আল দেওয়া আছে, পাছে জল বেরিয়ে যায়। কাদার আল, কিন্তু আলের মাঝে মাঝে ঘোগ। গর্ত। প্রাণপণে তো জল আনছে, কিন্তু ঘোগ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাসনা ঘোগ। জপতপ করে বটে, কিন্তু পেছনে বাসনা – ঘোগ দিয়ে সব বেরিয়ে যাচ্ছে।
“মাছ ধরে শট্কা কল দিয়ে। বাঁশ সোজা থাকবার কথা; তবে নোয়ানো রয়েছে কেন? মাছ ধরবে বলে। বাসনা মাছ তাই মন সংসারে নোয়ানো রয়েছে। বাসনা না থাকলে সহজে ঊর্ধ্বদৃষ্টি হয়। ঈশ্বরের দিকে।
“কিরকম জানো? নিক্তির কাঁটা যেমন। কামিনী – কাঞ্চনের ভার আছে বলে উপরের কাঁটা নিচের কাঁটা এক হয় না। তাই যোগভ্রষ্ট হয়। দীপশিখা দেখ নাই? একটু হাওয়া লাগলেই চঞ্চল হয়। যোগাবস্থা দীপশিখার মতো — যেখানে হাওয়া নাই।
“মনটি পড়েছে ছড়িয়ে — কতক গেছে ঢাকা, কতক গেছে দিল্লী, কতক গেছে কুচবিহার। সেই মনকে কুড়ুতে হবে। কুড়িয়ে এক জায়গায় করতে হবে। তুমি যদি ষোল আনার কাপড় চাও, তাহলে কাপড়ওয়ালাকে ষোল আনা তো দিতে হবে। একটু বিঘ্ন থাকলে আর যোগ হবার জো নাই। টেলিগ্রাফের তারে যদি একটু ফুটো থাকে, তাহলে আর খবর যাবে না। ”
[ত্রৈলোক্য বিশ্বাসের জোর — নিষ্কামকর্ম কর — জোর করে বল “আমার মা”]
“তা সংসারে আছ, থাকলেই বা। কিন্তু কর্মফল সমস্ত ঈশ্বরকে সমর্পণ করতে হবে। নিজে কোন ফলকামনা করতে নাই।
“তবে একটা কথা আছে। ভক্তিকামনা কামনার মধ্যে নয়। ভক্তিকামনা, ভক্তিপ্রার্থনা — করতে পার।
“ভক্তির তমঃ আনবে। মার কাছে জোর কর। —
“মায়ে পোয়ে মোকদ্দমা ধুম হবে রামপ্রসাদ বলে,
তখন শান্ত হবো ক্ষান্ত হয়ে আমায় যখন করবি কোলে।
“ত্রৈলোক্য বলেছিল, আমি যেকালে ওদের ঘরে জন্মেছি, তখন আমার হিস্যে আছে।
“তোমার যে আপনার মা, গো! এ কি পাতানো মা, এ কি ধর্ম মা! এতে জোর চলবে না তো কিসে জোর চলবে? বলো —
“আমি কি আটাশে ছেলে আমি ভয় করিনি চোখ রাঙ্গালে।
এবার করবো নালিস্ শ্রীনাথের আগে, ডিক্রি লব এক সওয়ালে।
“আপনার মা! জোর কর! যার যাতে সত্তা থাকে, তার তাতে টানও থাকে। মার সত্তা আমার ভিতর আছে বলে তাই তো মার দিকে অত টান হয়। যে ঠিক শৈব, সে শিবের সত্তা পায়। কিছু কণা তার ভিতর এসে পড়ে। যে ঠিক বৈষ্ণব তার নারায়ণের সত্তা ভিতরে আসে। আর এ সময় তো আর তোমার বিষয়কর্ম করতে হয় না। এখন দিন কতক তাঁর চিন্তা কর। দেখলে তো সংসারে কিছু নাই।”
ঠাকুর আবার সেই মধুর কণ্ঠে গাইতেছেন:
ভেবে দেখ মন কেউ কারু নয়, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে।
ভুলো না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হয়ে মায়াজালে।।
দিন দুই-তিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে,
সেই কর্তারে দেবে ফেলে, কালাকালের কর্তা এলে।।
যার জন্য মর ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে,
সেই প্রেয়সী দিবে ছড়া, অমঙ্গল হবে বলে।।
[সালিসী, মোড়লী, হাসপাতাল, ডিস্পেন্সারি করবার বাসনা — লোকমান্য, পাণ্ডিত্য, বাসনা — এ-সব আদিকাণ্ড — লালচুষি ত্যাগের পর তবে ঈশ্বরলাভ ]
“আর তুমি সালিসী মোড়লী ও-সব কি কচ্ছো? লোকের ঝগড়া বিবাদ মিটাও — তোমাকে সালিসী ধরে, শুনতে পাই। ও তো অনেকদিন করে আসছো। যারা করবে তারা এখন করুক। তুমি এখন তাঁর পাদপদ্মে বেশি করে মন দেও । বলে ‘লঙ্কায় রাবণ মলো বেহুলা কেঁদে আকুল হলো!’
“তা শম্ভুও বলেছিল। বলে হাসপাতাল ডিস্পেনসারি করব। লোকটা ভক্ত ছিল। তাই আমি বললুম, ভগবানের সাক্ষাৎকার হলে কি হাসপাতাল ডিস্পেনসারি চাইবে!
“কেশব সেন বললে, ঈশ্বরদর্শন কেন হয় না! তা বললুম যে, লোকমান্য, বিদ্যা, — এ-সব নিয়ে তুমি আছ কি না, তাই হয় না। ছেলে চুষি নিয়ে যতক্ষণ চোষে, ততক্ষণ মা আসে না। লালচুষি। খানিকক্ষণ পরে চুষি ফেলে যখন চিৎকার করে তখন মা ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে আসে।
“তুমিও মোড়লী কোচ্চ। মা ভাবছে, ছেলে আমার মোড়ল হয়ে বেশ আছে। আছে তো থাক।”
ঈশান ইতিমধ্যে ঠাকুরের চরণ স্পর্শ করিয়া বসিয়া আছেন। চরণ ধরিয়া বিনীতভাবে বলিতেছেন — আমি যে ইচ্ছা করে এ-সব করি তা নয়।
[বাসনার মূল মহামায়া — তাই কর্মকাণ্ড ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — তা জানি। সে মায়েরই খেলা! এঁরই লীলা! সংসারে বদ্ধ করে রাখা সে মহামায়ার ইচ্ছা! কি জান? ‘ভবসাগরে উঠছে ডুবছে কতই তরী।’ আবার — ‘ঘুড়ি লক্ষের দুটো একটা কাটে, হেসে দাও মা হাত চাপড়ি।’ লক্ষের মধ্যে দু-একজন মুক্ত হয়ে যায়। বাকী সবাই মার ইচ্ছায় বদ্ধ হয়ে আছে।
“চোর চোর খেলা দেখ নাই; বুড়ীর ইচ্ছা যে খেলাটা চলে। সবাই যদি বুড়ীকে ছুঁয়ে ফেলে, তাহলে আর খেলা চলে না। তাই বুড়ির ইচ্ছা নয় যে, সকলে ছোঁয়।
“আর দেখ, বড় বড় দোকানে চালের বড় বড় ঠেক থাকে। ঘরের চাল পর্যন্ত উঁচু। চাল থাকে — দালও থাকে। কিন্তু পাছে ইঁদুরে খায়, তাই দোকানদার কুলোয় করে খই মুড়কি রেখে দেয়। মিষ্ট লাগে আর সোঁধা গন্ধ — তাই যত ইঁদুর সেই কুলোতে গিয়ে পড়ে, বড় বড় ঠেকের সন্ধান পায় না! — জীব কামিনী-কাঞ্চনে মুগ্ধ হয়। ঈশ্বরের খবর পায় না।”