ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ১১ই অক্টোবর
দক্ষিণেশ্বরে বেদান্তবাগীশ — ঈশান প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে
আজ শনিবার, ১১ই অক্টোবর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ (২৬শে আশ্বিন, কৃষ্ণা সপ্তমী)। ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে ছোট তক্তপোশে শুইয়া আছেন। বেলা আন্দাজ ২টা বাজিয়াছে। মেঝের উপর মাস্টার ও প্রিয় মুখুজ্জে বসিয়া আছেন।
মাস্টার স্কুল হইতে ১টার সময় ছাড়িয়া দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে প্রায় ২টার সময় পৌঁছিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — যদু মল্লিকের বাড়ি গিয়াছিলাম। একেবারে জিজ্ঞাসা করে গাড়িভাড়া কত! যখন এরা বললে তিন টাকা দুইআনা, তখন একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করে আবার শুক্কুল ঠাকুর আড়ালে গাড়োয়ানকে জিজ্ঞাসা করছে। সে বললে তিন টাকা চারিআনা (সকলের হাস্য) তখন আবার আমাদের কাছে দৌড়ে আসে; বলে, ভাড়া কত?
“কাছে দালাল এসেছে। সে যদুকে বললে, বড়বাজারে ৪ কাঠা জায়গা বিক্রী আছে নেবেন? যদু বলে, কত দাম? দামটা কিছু কমায় না? আমি বললুম, ‘তুমি নেবে না কেবল ঢঙ করছ। না?’ তখন আবার আমার দিকে ফিরে হাসে। বিষয়ী লোকদের দস্তুরই; ৫টা লোক আনাগোনা করবে বাজারে খুব নাম হবে।
“অধরের বাড়ি গিছল তা আমি আবার বললাম, তুমি অধরের বাড়ি গিছিলে, তা অধর বড় সন্তুষ্ট হয়েছে। তখন বলে, ‘এ্যাঁ, এ্যাঁ, সন্তুষ্ট হয়েছে?’
“যদুর বাড়িতে — মল্লিক এসেছিল! বড় চতুর আর শঠ, চক্ষু দেখে বুঝতে পাল্লাম। চক্ষুর দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘চতুর হওয়া ভাল নয়, কাক বড় সেয়ানা, চতুর, কিন্তু পরের গু খেয়ে মরে!’ আর দেখলাম লক্ষ্মীছাড়া। যদুর মা অবাক্ হয়ে বললে, বাবা, তুমি কেমন করে জানলে ওর কিছু নাই। চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম।”
নারাণ আসিয়াছেন, তিনিও মেঝেয় বসিয়া আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (প্রিয়নাথের প্রতি) — হ্যাঁগা, তোমাদের হরিটি বেশ।
প্রিয়নাথ — আজ্ঞা, এমন বিশেষ ভাল কি? তবে ছেলেমানুষ —
নারাণ — পরিবারকে মা বলেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সে কি! আমিই বলতে পারি না, আর সে মা বলেছে! (প্রিয়নাথের প্রতি) — কি জানো, ছেলেটি বেশ শান্ত, ঈশ্বরের দিকে মন আছে।
ঠাকুর অন্য কথা পাড়িলেন।
“হেম কি বলেছিল জানো? বাবুরামকে বললে, ঈশ্বরই এক সত্য আর সব মিথ্যা। (সকলের হাস্য) না গো, আন্তরিক বলেছে। আবার আমাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়া কীর্তন শুনাবে বলেছিল। তা হয় নাই। তারপর নাকি বলেছিল, ‘আমি খোল-করতাল নিলে লোকে কি বলবে’। ভয় পেয়ে গেল, পাছে লোকে বলে পাগল হয়েছে।”
[ঘোষপাড়ার স্ত্রীলোকের হরিপদকে গোপালভাব — কৌমারবৈরাগ্য ও স্ত্রীলোক ]
“হরিপদ ঘোষপাড়ার এক মাগীর পাল্লায় পড়েছে। ছাড়ে না। বলে কোলে করে খাওয়ায়। বলে নাকি গোপালভাব! আমি অনেক সাবধান করে দিইছি। বলে বাৎসল্যভাব। ওই বাৎসল্য থেকে আবার তাচ্ছল্য হয়।
“কি জানো? মেয়ে-মানুষ থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়, তবে যদি ভগবান-লাভ হয়। যাদের মতলব খারাপ, সে-সব মেয়ে-মানুষের কাছে আনোগোনা করা, কি তাদের হাতে কিছু খাওয়া বড় খারাপ। এরা সত্তা হরণ করে।
“অনেক সাবধানে থাকলে তবে ভক্তি বজায় থাকে। ভবনাথ, রাখাল এরা সব একদিন আপনারা রান্না কল্লে। ওরা খেতে বসেছে, এমন সময় একজন বাউল এসে ওদের পঙ্ ক্তিতে বসে বলে, খাব। আমি বললাম, আঁটবে না; আচ্ছা যদি থাকে, তোমার জন্য রাখবে। তা সে রেগে উঠে গেল। বিজয়ার দিনে যে সে মুখে খাইয়ে দেয়, সে ভাল নয়। শুদ্ধসত্ত্ব ভক্ত — এদের হাতে খাওয়া যায়।
“মেয়ে-মানুষের কাছে খুব সাবধান হতে হয়। গোপালভাব! এ-সব কথা শুনো না। মেয়ে ত্রিভুবন দিলে খেয়ে। অনেক মেয়ে-মানুষ জোয়ান ছোকরা, দেখতে ভালো, দেখে নূতন মায়া ফাঁদে। তাই গোপালভাব!
“যাদের কৌমারবৈরাগ্য; যারা ছেলেবেলা থেকে ভগবানের জন্য ব্যাকুল হয়ে বেড়ায়, সংসারে ঢোকে না, তারা একটি থাক আলাদা। তারা নৈকষ্য কুলীন। ঠিক ঠিক বৈরাগ্য হলে তারা মেয়ে-মানুষ থেকে ৫০ হাত তফাতে থাকে, পাছে তাদের ভাব ভঙ্গ হয়। তারা যদি মেয়ে-মানুষের পাল্লায় পড়ে, তাহলে তার নৈকষ্য কুলীন থাকে না, ভঙ্গ ভাব হয়ে যায়; তাদের ঘর নিচু হয়ে যায়। যাদের ঠিক কৌমারবৈরাগ্য তাদের উঁচু ঘর; অতি শুদ্ধভাব। গায়ে দাগটি পর্যন্ত লাগে না।”
[জিতেন্দ্রিয় হবার উপায় — প্রকৃতিভাব সাধন ]
“জিতেন্দ্রিয় হওয়া যায় কিরকম ভাবে? আপনাতে মেয়ের ভাব আরোপ করতে হয়। আমি অনেকদিন সখীভাবে ছিলাম। মেয়েমানুষের কাপড়, গয়না পরতুম, ওড়না গায়ে দিতুম। ওড়না গায়ে দিয়ে আরতি করতুম! তা না হলে পরিবারকে আট মাস কাছে এনে রেখেছিলাম কেমন করে? দুজনেই মার সখী!
“আমি আপনাকে পু (পুরুষ) বলতে পারি না। একদিন ভাবে রয়েছি (পরিবার) জিজ্ঞাসা কললে — আমি তোমার কে? আমি বললুম, ‘আনন্দময়ী’।
“এক মতে আছে, যার মাইয়ে বোঁটা আছে সেই মেয়ে। অর্জুন আর কৃষ্ণের মাইয়ে বোঁটা ছিল না। শিবপূজার ভাব কি জান? শিবলিঙ্গের পূজা, মাতৃস্থানের ও পিতৃস্থানের পূজা। ভক্ত এই বলে পূজা করে, ঠাকুর দেখো যেন আর জন্ম না হয়। শোণিত-শুক্রের মধ্য দিয়া মাতৃস্থান দিয়া আর যেন আসতে না হয়।”