চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৫ই অক্টোবর
শ্রীরামকৃষ্ণ, কেশব ও ব্রাহ্মসমাজ — সমন্বয় উপদেশ
The Universal Catholic Church of Sree Ramkrishna
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — আচ্ছা, লোক যে এত আকর্ষণ হয়ে আসে এখানে, তার মানে কি?
মণি — আমার ব্রজের লীলা মনে পড়ে। কৃষ্ণ যখন রাখাল আর বৎস হলেন, তখন রাখালদের উপর গোপীদের, আর বৎসদের উপর গাভীদের, বেশি আকর্ষণ হতে লাগল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — সে ঈশ্বরের আকর্ষণ। কি জানো, মা এইরূপ ভেলকি লাগিয়ে দেন আর আকর্ষণ হয়।
“আচ্ছা, কেশব সেনের কাছে যত লোক যেত, এখানে তো তত আসে না। আর কেশব সেনকে কত লোক গণে মানে, বিলাতে পর্যন্ত জানে — কুইন (রানী ভিক্টোরিয়া) কেশবের সঙ্গে কথা কয়েছে। গীতায় তো বলেছে, যাকে অনেকে গণে মানে, সেখানে ঈশ্বরের শক্তি। এখানে তো অত হয় না?”
মণি — কেশব সেনের কাছে সংসারী লোক গিয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, তা বটে। ঐহিক লোক।
মণি — কেশব সেন যা করে গেলেন, তা কি থাকবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেন, সংহিতা করে গেছে, — তাতে কত নিয়ম!
মণি — অবতার যখন নিজে কাজ করেন, তখন আলাদা কথা। যেমন চৈতন্যদেবের কাজ।
শ্রীরামকৃষ্ণ — হাঁ, হাঁ, ঠিক।
মণি — আপনি তো বলেন, — চৈতন্যদেব বলেছিলেন, আমি যা বীজ ছড়িয়ে দিয়ে গেলাম, কখন না কখন এর কাজ হবে। কার্ণিশের উপর বীজ রেখেছিল, বাড়ি পড়ে গেলে সেই বীজ আবার গাছ হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আচ্ছা, শিবনাথরা যে সমাজ করেছে, তাতেও অনেক লোক যায়।
মণি — আজ্ঞা, তেমনি লোক যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — হাঁ, হাঁ সংসারী লোক সব যায়। যারা ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুল — কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করতে চেষ্টা করছে — এমন সব লোক কম যায় বটে।
মণি — এখান থেকে একটা স্রোত যদি বয়, তাহলে বেশ হয়। সে স্রোতের টানেতে সব ভেসে যাবে। এখান থেকে যা হবে সে তো আর একঘেয়ে হবে না।
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান — বৈষ্ণব ও ব্রহ্মজ্ঞানী ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — আমি যার যা ভাব তার সেই ভাব রক্ষা করি। বৈষ্ণবকে বৈষ্ণবের ভাবটিই রাখতে বলি, শাক্তকে শাক্তের ভাব। তবে বলি, ‘এ কথা বলো না — আমারই পথ সত্য আর সব মিথ্যা, ভুল।’ হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান — নানা পথ দিয়ে এক জায়গায়ই যাচ্ছে। নিজের নিজের ভাব রক্ষা করে, আন্তরিক তাঁকে ডাকলে, ভগবান লাভ হবে!
“বিজয়ের শাশুড়ি বলে, তুমি বলরামদের বলে দাও না, সাকার পুজোর কি দরকার? নিরাকার সচ্চিদানন্দকে ডাকলেই হল।
“আমি বললাল, ‘অমন কথা আমিই বা বলতে যাব কেন — আর তারাই বা শুনবে কেন?’ মা মাছ রেঁধেছে — কোনও ছেলেকে পোলোয়া রেঁধে দেয়, যার পেট ভাল নয় তাকে মাছের ঝোল করে দেয়। রুচিভেদ, অধিকারীভেদে, একই জিনিস নানারূপ করে দিতে হয়।”
মণি — আজ্ঞা, হাঁ। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সব আলাদা রাস্তা। তবে যে রাস্তা দিয়েই যাওয়া হোক না কেন, শুদ্ধমন দিয়ে আন্তরিক ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তবে তাঁকে পাওয়া যায়। এই কথা আপনি বলেন।
[মুখুজ্জেদের হরি — শ্রীরামকৃষ্ণ ও দান-ধ্যান ]
ঘরের ভিতর ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়া আছেন। মেঝেতে মুখুজ্জেদের হরি, মাস্টার প্রভৃতি বসিয়া আছেন। একটি অপরিচিত ব্যক্তি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বসিলেন। ঠাকুর পরে বলিয়াছিলেন, তাঁহার চক্ষুর লক্ষণ ভাল না — বিড়ালের ন্যায় কটাচক্ষু।
ঠাকুরকে হরি তামাক সাজিয়া আনিয়া দিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হুঁকা হাতে করিয়া, হরির প্রতি) — দেখি তোর — হাতদেখি। এই যে যব রয়েছে — এ বেশ ভাল লক্ষণ।
“হাত আলগা কর দেখি। (নিজের হাতে হরির হাত লইয়া যেন ওজন করিতেছেন) — ছেলেমানষি বুদ্ধি এখনও আছে; — দোষ এখনও কিছু হয় নাই। (ভক্তদের প্রতি) — আমি হাত দেখলে খল কি সরল বলতে পারি। (হরির প্রতি) — কেন, শ্বশুরবাড়ি যাবি — বউর সঙ্গে কথাবার্তা কইবি — আর ইচ্ছে হয় একটু আমোদ-আহ্লাদ করবি।
(মাস্টারের প্রতি) — “কেমন গো?” (মাস্টার প্রভৃতির হাস্য)
মাস্টার — আজ্ঞা, নতুন হাঁড়ি যদি খারাপ হয়ে যায়, তাহলে আর দুধ রাখা যাবে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) — এখন যে হয় নাই তা কি করে জানলে?
মুখুজ্জেরা দুই ভাই — মহেন্দ্র ও প্রিয়নাথ। তাঁহারা চাকরি করেন না। তাঁহাদের ময়দার কল আছে। প্রিয়নাথ পূর্বে ইঞ্জিনিয়ারের কর্ম করিতেন। ঠাকুর হরির নিকট মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়ের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হরির প্রতি) — বড় ভাইটি বেশ, না? বেশ সরল।
হরি — আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — ছোট নাকি বড় সন (কৃপণ)? — এখানে এসে নাকি অনেক ভাল হয়েছে। আমায় বললে আমি কিছু জানতুম না। (হরিকে) এরা কিছু দান-টান করে কি?
হরি — তেমন দেখতে পাই না। এদের বড়ভাই যিনি ছিলেন — তাঁর কাল হয়েছে — তিনি বড় ভাল ছিলেন — খুব দান-ধ্যান ছিল।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ওদেহের লক্ষণ — ৺ মহেশ ন্যায়রত্নের ছাত্র ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার প্রভৃতিকে) — শরিরে লক্ষণ দেখে অনেকটা বুঝা ঝায়, তার হবে কি না। খল হলে হাত ভারী হয়।
“নাক টেপা হওয়া ভাল না। শম্ভুর নাকটি টেপা ছিল। তাই অত জ্ঞান থেকেও তত সরল ছিল না।
“উনপাঁজুরে লক্ষণ ভাল না। আর হাড় পেকে — কনুয়ের গাঁট মোটা, হাত ছিনে। আর বিড়াল চক্ষু — বিড়ালের মত কটাচোখ।
“ঠোঁট — ডোমের মতো হলে — নীচবুদ্ধি হয়। বিষ্ণুঘরের পুরুত কয়মাস একটিং কর্মে এসেছিল। তার হাতে খেতুম না — হঠাৎ মুখ দিয়ে বলে ফেলেছিলুম, ‘ও ডোম’। তারপর সে একদিন বললে ‘হাঁ, আমাদের ঘর ডোম পাড়ায়। আমি ডোমের বাসন চাঙ্গারী বুনতে জানি’।
“আরও খারাপ লক্ষণ — এক চক্ষু আর ট্যারা। বরং এক চক্ষু কানা ভাল, তো ট্যারা ভাল নয়। ভারী দুষ্ট ও খল হয়।
”মহেশের (৺ মহেশ ন্যায়রত্নের) একজন ছাত্র এসেছিল। সে বলে, ‘আমি নাস্তিক’। সে হৃদেকে বললে, ‘আমি নাস্তিক, তুমি আস্তিক হয়ে আমার সঙ্গে বিচার কর’। তখন তাকে ভাল করে দেখলাম। দেখি, বিড়াল চক্ষু!
“আবার চলনেতে লক্ষণ ভাল মন্দ টের পাওয়া যায়।
পুরুষাঙ্গের উপর চামরাটি মুসলমানদের মতো যদি কাটা হয়, সে একটি খারাপ লক্ষণ। (মাস্টার প্রভৃতির হাস্য) (মাস্টারকে সহাস্যে) তুমি ওটা দেখো — ও খারাপ লক্ষণ।” (সকলের হাস্য)
ঘর হইতে ঠাকুর বারান্দায় বেড়াইতেছেন। সঙ্গে মাস্টার ও বাবুরাম। শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — একজন এসেছিল, — দেখলাম বিড়ালের মতো চক্ষু। সে বলে, ‘আপনি জ্যোতিষ জানেন? — আমার কিছু কষ্ট আছে।’ আমি বললাম, ‘না, বরাহনগরে যাও, সেখানে জ্যোতিষের পণ্ডিত আছে।’
বাবুরাম ও মাস্টার নীলকণ্ঠের যাত্রার কথা কহিতেছেন। বাবুরাম নবীন সেনের বাটী হইতে দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া আসিয়া কাল রাত্রে এখানে ছিলেন। সকালে ঠাকুরের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরে নবীন নিয়োগীর বাড়িতে নীলকণ্ঠের যাত্রা শুনিয়াছিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণ, মণি ও নিভৃত চিন্তা — “ঈশ্বরের ইচ্ছা” — নারাণের জন্য ভাবনা ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও বাবুরামের প্রতি) — তোমাদের কি কথা হচ্ছে?
মাস্টার ও বাবুরাম — আজ্ঞা নীলকণ্ঠের যাত্রার কথা হচ্ছে, — আর সেই গানটির কথা — ‘শ্যামাপদে আশ, নদীর তীরে বাস।’
ঠাকুর বারান্দায় বেড়াইতে বেড়াইতে হঠাৎ মণিকে নিভৃতে হইয়া বলিতেছেন — ঈশ্বরচিন্তা যত লোকে টের না পায় ততই ভাল। হঠাৎ এই কথা বলিয়াই ঠাকুর চলিয়া গেলেন।
ঠাকুর হাজরার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।
হাজরা — নীলকণ্ঠ তো আপনাকে বলেছে, সে আসবে। তা ডাকতে গেলে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ — না, রাত্রি জেগেছে, — ঈশ্বরের ইচ্ছায় আপনি আসে, সে এক। বাবুরামকে নারাণের বাড়ি গিয়া দেখা করিতে বলিতেছেন। নারাণকে সাক্ষাৎ নারায়ণ দেখেন। তাই তাকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন। বাবুরামকে বলিতেছেন — “তুই বরং একখান ইংরাজী বই নিয়ে তার কাছে যাস।”