পঁয়ত্রিশ
সেই রাত্রে মহীতোষের আবার বাড়াবাড়ি হল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, জিভ শক্ত। সন্ধ্যেবেলায় অর্ক ডাক্তারকে ডেকে এনেছিল। কিছুক্ষণ বসে থেকে ভদ্রলোক মাথা নেড়ে চলে গেছেন।
জলপাইগুড়িতে সন্ধ্যের পর যে বিদ্যুৎ জ্বলে তাতে মানুষের মুখই স্পষ্ট দেখা যায় না। এই বিশাল বাড়িটা তাই ছায়ামাখা। শীত শীত হাওয়া চলছে। বাড়ির গাছপালাগুলো শব্দ করছে খুব। হেমলতাকে দেখা যাচ্ছে না। ছোটমা ঘরের এক কোণে পাথরের মত স্থির। অনিমেষ লক্ষ্য করছিল এই মুহূর্তেও তিনি মহীতোষের পাশে এসে বসেননি। সেখানে মাধবীলতা, সেই দুপুর থেকে ঠায় রয়েছে। তার একটা হাত মহীতোষের বুকে আলতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। অর্ক এতক্ষণ এই ঘরে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আর কোন কথাবার্তা হচ্ছে না।
মহীতোষ অস্ফুটে কিছু উচ্চারণ করলেন। বোঝা যাচ্ছে কষ্ট হচ্ছে। বিছানার অন্য পাশে বসে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল সামান্য ঝুঁকে, ‘বাবা, কষ্ট হচ্ছে?’ মহীতোষ সে-কথা শুনতেই পেলেন না। তাঁরা চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। জিভ যেন সামান্য নরম হয়েছে। প্রচণ্ড চেষ্টা করছেন কথা বলতে।
মাধবীলতা ধীরে ধীরে ছোটমার কাছে উঠে এল, ‘আপনি একটু পাশে যান।’
‘উনি কিছু বলবেন বোধহয়।’
‘আমি বুঝতে পারব না।’
অনিমেষের কানে কথাটা যাওয়ামাত্র সে চমকে মুখ ফেরাল। এ বাড়িতে ঢোকামাত্র সে জেনেছিল বাবাকে একমাত্র ছোটমা-ই বুঝতে পারেন। আর তখনি মহীতোষের অস্পষ্ট উচ্চারণ শোনা গেল, ‘এসো বাবা, এসো।’
মুখ অর্কর দিকে ফেরালো। সে অলসভঙ্গীতে দাঁড়িয়েছিল, এবার সচকিত হয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল। অনিমেষ ইঙ্গিতে তাকে কাছে এগিয়ে আসতে বলল। অর্ক মাধবীলতার জায়গায় আসামাত্র মহীতোষ বললেন, ‘বাবা, তোমার পেছনে কে? মাধুরী?’
এবার উচ্চারণে জড়তা নেই বললেই চলে। অর্ক পেছন ফিরে তাকাল। আর সেই সময় ছোটমা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। এবং সেই কান্নাটাকে সঙ্গী করে ছিটকে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মহীতোষ মাথা নাড়লেন, ‘ঘরে এত লোক কেন? জানলায় বসে আছে সব। ঝাড়ি, তুই আবার কখন এলি? বাবা, অনি কলকাতায়। আপনি বসুন বাবা। ঘোমটা দিয়ে কে দাঁড়িয়ে? মা?’
মাধবীলতা আড়ষ্ট পায়ে এসে দাঁড়াল অর্কর পাশে। আর তখনই চিৎকার করতে করতে ছুটে এলেন হেমলতা। দরজায় দাঁড়িয়ে তীব্র গলায় বললেন, ‘কোথায় বাবা, মহী আপনাকে দেখতে পাচ্ছে যখন তখন নিশ্চয়ই এসেছেন। বলুন, কেন এমন হল? কেন আমি পড়ে আছি? দুই মা গেল, মাধু গেল, আপনি ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন, মহী যাচ্ছে, তাহলে আমি পড়ে থাকব কেন? এই ভূতের বাড়ি কার ভোগে লাগবে বলে বানিয়েছিলেন? বলুন। জবাব দিয়ে যান, আমি দরজা ছেড়ে নড়ছি না।
অনিমেষ হেমলতার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। পিসীমার এমন ভীষণ মূর্তি সে কখনও দ্যাখেনি। মাধবীলতার একটা হাত অর্কর কনুই আঁকড়ে ধরেছিল। তার গায়ে কাঁটা উঠেছে। অর্ক বুঝতে পারছিল না এঁরা কাদের সঙ্গে কথা বলছেন!
মহীতোষ তখন বলছেন, ‘ওই লাল ডুরে শাড়ি পরেছে কে? মুখ দেখতে পাচ্ছি না।’
ঘরে লাল শাড়ি কেউ পরে নেই। ব্যাপারটা হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে যেতেই অর্ক শিউরে উঠল। এই ঘরে এখন মরে যাওয়া মানুষেরা এসে দাঁড়িয়েছে নাকি?
অনিমেষ চাপা গলায় মাধবীলতাকে বলল, ‘পিসীমাকে ধরো।’
হেমলতা তখন ঘরের প্রতিটি স্থানে সতর্ক চোখ রেখেছেন, ‘আপনি মহীকে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি কোথায় থাকব? আমাকে নিয়ে যান বাবা।’
মাধবীলতা দরজার কাছে গিয়ে হেমলতার হাত ধরল, ‘পিসীমা!’
‘ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে। বাপ না শয়তান! মহী ওর আপন হল, আমি কেউ না? বারো বছর বয়সে বিধবা হয়ে পর্যন্ত ওর দাসী হয়ে ছিলাম। কি করেছে আমার জন্যে! শোন, তোমাকে বলছি, এই পুরুষজাতটা হল বড় বেইমান, আমাদের চুষে চুষে খেয়ে আঁঠি করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। একটুও ভাবে না। সে স্বামী হোক, ছেলে হোক আর বাবাই হোক।’ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠতেই হেমলতাকে জড়িয়ে ধরল মাধবীলতা।
সারা রাত আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন মহীতোষ। কোন সাড়া শব্দ নেই। অনিমেষ বারংবার এসে দেখে যাচ্ছিল। এ বাড়ির কেউ ঘুমায়নি। সকালবেলায় জোর করে ছোটমা পাঠালেন মাধবীলতাকে। সারারাত সে ঠায় বসে ছিল। মুখে হাতে জল দেওয়ার দরকারটাও যেন ভুলে থাকতে চাইছিল।
নিজের ঘরে অনিমেষ তখন অর্ককে বলছিল, ‘এখানে কাছে পিঠে কোন চায়ের দোকান দেখতে পেয়েছিলি?’
‘এদিকটায় নেই। ওদিকে একটা রাস্তা গেছে ওখানে আছে কিনা জানি না। দেখে আসব?’ ভোরবেলায় অর্ক খানিকটা ঝিমিয়েছিল, চোখ ফোলা।
‘একটা কেটলি বা ওইরকম কিছু নিয়ে যা। তোর কাছে পয়সা আছে?’
‘আছে।’
‘এত পয়সা পাস কোত্থেকে কে জানে। ওহো, জেলা স্কুলের কাছেই তো কয়েকটা চায়ের দোকান ছিল। এখনও আছে কিনা জানি না। ওদিকেই যা।’
অর্ক গায়ে জামা গলাতেই মাধবীলতা ঘরে ঢুকল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘চা আনতে।’
‘চা আনতে?’ মাধবীলতা যেন অবাক হয়ে গেল। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ বাড়িতে বাইরে থেকে চা আনিয়ে কখনও খাওয়া হয়েছে?’
অনিমেষ একটু বিরক্ত হল, ‘বাজে বকো না তো। কখনও হয়নি বলে কোনদিন হবে না এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। সবাই রাত জেগেছে তাই চা আনানো হচ্ছে।’
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘থাক, আমি করে দিচ্ছি। তুই শুধু চিনি নিয়ে আয়। কালই দেখেছিলাম ওটা শেষ হয়ে গেছে।’
‘কত আনবো? পাঁচশো?’ অর্ক জিজ্ঞাসা করল।
মাধবীলতা হাসল বিষন্নভঙ্গীতে, ‘তাই আন।’
অর্ক চলে গেলে অনিমেষ বলল, ‘তুমি কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি করছ!’
মাধবীলতা সিঁটিয়ে গেল যেন, তারপর বলল, ‘কিসে?’
‘আমি এ বাড়ির ছেলে সেই কথাটা ভুলে যাচ্ছ। এখানে আমি যা করছি নিজের দায়িত্ব নিয়ে করছি। সারারাত জেগে তুমি চা তৈরি করতে যাচ্ছ, এতে প্রশংসা পাওয়া যায় নিশ্চয়ই কিন্তু কারো কারো খারাপ লাগবে তা ভাবো না কেন?’
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘সত্যি, ভাবিনি।’
অনিমেষকে যেন কথা বলার নেশায় পেয়েছিল, ‘আসলে একা কষ্ট ভোগ করার একটা প্রবণতা আছে তোমার মধ্যে। পাঁচজনে শুনলে ভাববে, আহা এমন মেয়ে হয় না, সারাজীবন শুধু কষ্ট করে গেল। আমি এটাকেই বাড়াবাড়ি বলছি।’
আলনায় রাখা কাপড়জামা তুলে নিয়ে মাধবীলতা বলল, ‘ঠিক আছে। এত কথা আর বলতে হবে না। আমি চা করছি না।’
অনিমেষ হাঁ হয়ে গেল, ‘যাচ্চলে! তুমি খোকাকে চিনি আনতে বলে এখন যদি চা করব না বল তাহলে আবার ওকে পাঠাতে হয়!’
‘তার মানে তুমি আমাকে চা করতে বলছ?’ মাধবীলতা এমন ভঙ্গীতে এই কথাটা বলল যে অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল। তার মনে এক ধরনের পরাজিত মনোভাব কাজ করছিল। এই সক্কাল বেলায় এত সব কথা না বললেই হতো।
মাধবীলতা বলল, ‘শোন, এটাও বাড়াবাড়ি কিনা জানি না, তবে মনে হচ্ছে আজকের দিনটা কাটবে না। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভাল। মৃত মানুষদের দেখার পর কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে আছেন।’
অনিমেষ বলল, ‘ডাক্তার বলেছে কিছুই করার নেই। এর পর কোন হাসপাতাল নেবে না। তাছাড়া শেষ সময়টায় আর টানাটানি করে কি হবে? ওঘরে এখন কে আছেন, তুমি চলে এলে—|’
‘ছোটমা ছিলেন। তুমি চা খেয়ে ওঘরে গিয়ে বসো।’ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাধবীলতা দরজায় দাঁড়াল, ‘আচ্ছা, কাল তোমার সঙ্গে দেখা করতে কে এসেছিল? একবার শুনলাম খুব উত্তেজিত গলায় কথা বলছ! অবশ্য বাড়াবাড়ি মনে করলে উত্তরটা দিতে হবে না।’
অনিমেষ হতাশভঙ্গীতে কাঁধ নাচাল। মাধবীলতার আগে এই অভ্যেসটা ছিল না। কথায় কথায় এমন করে খোঁটা দিত না। কিন্তু হজম করল সে। দোষটা তার। তখন কথাটা না বললেই হত। সে কাঁধ নাচানোর জন্যেও আফসোস করল। এসব সময় কিছুই হয়নি এমন ভাব করা উচিত। যতটা পারে সহজ গলায় অনিমেষ বলল, ‘ওর নাম জুলিয়েন।’
‘জুলিয়েন! নামটা যেন শোনা শোনা মনে হচ্ছে!’ মাধবীলতা স্মৃতি হাতড়াচ্ছিল। এই কয়বছরে অনিমেষের মুখে শুনে শুনে ওর এখানকার পরিচিত মানুষজন এবং ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সে পরিষ্কার জেনে গিয়েছে।
অনিমেষ বলল, ‘জুলিয়েন স্বৰ্গছেঁড়ায় প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন করতো। পরে আমাদের সঙ্গে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেয়। একটা অ্যাকশনের পরে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না।’
‘জুলিয়েন। ও, সেই খৃষ্টান মদেশিয়া না কি যেন?’
হ্যাঁ। মদেশিয়া। চা-বাগানের পত্তনের সময় রাঁচি হাজারিবাগ থেকে ওদের পূর্বপুরুষদের ধরে এনেছিল আড়কাঠিরা। মিশনারিরা তখন খৃষ্টান করে দিয়েছিল ওদের অনেককেই। ডাক্তারবাবুর মুখে খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছেন।’
ডাক্তারবাবুর কাছে খবর পেল কি করে?’
‘যোগাযোগ আছে।’
কথাটা শোনামাত্র মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘কেন এসেছিল?’
‘দেখা করতে, আবার কেন?’
‘একজন তোমার খোঁজে কয়েকবার এসেছিল, এই কি সেই?’
‘বোধহয়।’ অনিমেষের মনে হল মাধবীলতার কণ্ঠস্বর পাল্টে যাচ্ছে।
‘তোমাদের কি নিয়ে তর্ক হচ্ছিল?’
অনিমেষের ভেতরটা আচমকা গুটিয়ে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে সব কথা বলতে হয়। হঠাৎ তার মনে হল সব কথা মাধবীলতাকে খুলে বলা এই মুহূর্তে উচিত হবে না। ওর গলার স্বর স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে জুলিয়েনকে পছন্দ করতে পারছে না। সে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘নানান বিষয় নিয়ে। ওরা দেশের সম্বন্ধে নতুন করে ভাবনা চিন্তা করছে, এই আর কি!’
মাধবীলতা এবার স্পষ্ট বলল, ‘লোকটার সঙ্গে তুমি যোগাযোগ রেখ না।’
‘কেন?’ অনিমেষ যেন কোন শিশুর আবদার শুনছে এমন মুখ করল।
‘আমার ভাল লাগছে না।’
‘কেন?’ মাধবীলতাকে ঠাট্টার গলায় বলতে গিয়েও সুর পাল্টালো অনিমেষ, ‘তুমি ভাবতে পারো কাল জুলিয়েন কি বলেছে? ওর কাছে আমাদের অ্যাকশনের প্রচুর টাকা গচ্ছিত ছিল। এত বছর পরে নিজে এসে সেই টাকার খবর দিচ্ছে। আমার সঙ্গে দেখা না করলে আমি কোনদিনই টাকাগুলোর কথা জানতে পারতাম না। এরকম লোককে খারাপ ভাবার কোন কারণ নেই।’
অনিমেষের দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাধবীলতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
এই রাস্তায় অর্ক গতকাল হাঁটেনি। এখন সদ্য ভোর। মাটিতে রোদ নামেনি। চারধারে একটা শান্ত ছায়া ঘন হয়ে রয়েছে। ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের মত বাতাস বইছে। সারারাত জেগে শেষের দিকে যে ঝিমুনি এসেছিল তাতে শরীর বেঠিক হয়ে রয়েছে। তবু কয়েক পা ফেলার পর অর্কর ভাল লাগছিল।
রাস্তায় একটিও মানুষ নেই। চমৎকার সরু পিচের রাস্তা। দুদিকে গাছপালাওয়ালা বাড়ি। দোকানপাট চোখে পড়ছে না। অথচ বাবা বলল এদিকেই চায়ের দোকান ছিল। আরো খানিকটা এগোবার পর একটা বন্ধ দোকান চোখে পড়ল। ছোট্ট ঝাঁপ দেওয়া দোকান। তারপর রাস্তাটা বাঁক নিতেই সে চায়ের দোকানটাকে দেখতে পেল। টিনের দেওয়াল এবং দরমার ঝাঁপ দেওয়া। তিন চারজন মানুষ মাটিতে পোঁতা বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে। পাশাপাশি আরও চারটে দোকান আছে কিন্তু সেগুলো এখনও খোলেনি। অর্ক চায়ের দোকানটার সামনে দাঁড়াল। দোকানদারের হাত খালি হওয়ায় বিড়ি খাচ্ছিল। তার দিকে একটু উৎসুক চোখে তাকাল লোকটা। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে মুদির দোকান আছে?’
‘আছে, কিন্তু খোলে নাই।’
‘কখন খোলে?’
‘টাইম হইসে।’ লোকটা বিড়ি মুখে রেখে কথা বলছিল। এবার তার খদ্দেররা মুখ ফিরিয়ে অর্ককে দেখল। একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘নতুন মনে হচ্ছে?’
অর্ক ঘাড় নাড়ল।
‘কোন বাড়ি?’
‘ওই দিকে।’ অর্ক দিক দেখাল। যে লোকটা প্রশ্ন করছিল তার গলার হনুটা বেশ বড়। চোখ গর্তে বসা এবং মুখ শুকনো। মাথায় চুলও নেই তেমন। লোকটা নাছোড়বান্দা ধরনের, বলল, ‘ওটা তো দক্ষিণ দিক। কার বাড়ি? কোথায় থাকা হয়? কখনও দেখিনি তাই বলছি।’
আর একজন বৃদ্ধ খদ্দের ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, ‘আজকালকার ছোকরাদের প্রশ্ন করে সুখ নেই। এমন জবাব দেয় যে—।’ কথাটা শেষ করলেন নাক থেকে ছুঁড়ে দেওয়া বিকট শব্দ দিয়ে। অর্কর মেজাজ তেতো হয়ে যাচ্ছিল। আগে হলে এই অবস্থায় সে যা করত এখন তার বিপরীত ব্যবহার করল, ‘আমার দাদুর নাম মহীতোষ মিত্র। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি।’
সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল টেকো লোকটা। ওর গর্তে বসা চোখ বিস্ফারিত উত্তেজনায় গলার হনু দুটো নেচে উঠল কয়েকবার। তারপর সুড়সুড় করে এগিয়ে এল অর্কর সামনে, ‘মহীকে দেখতে আসা হয়েছে?’
লোকটার আচমকা পরিবর্তনে অবাক হয়েছিল অর্ক। এখনও চোখ জ্বলছে, ঠোঁট কাঁপছে।
সে একটু বিব্রত ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
লোকটা জিজ্ঞাসা করল এবার, ‘নাম কি?’
‘অর্ক।’
‘অর্ক! হুম। অনিমেষের ছেলে? এত বড়?’ নিজেকেই যেন জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে, দৃষ্টি আর অর্কর ওপর নেই। অর্ক বুঝতে পারল লোকটা তাদের চেনে। অন্তত বাবার নামটা তো স্পষ্ট বলতে পারছে। এই সময় সেই বৃদ্ধ চা শেষ করে বলল, ‘কি হে, আপনজন মনে হচ্ছে? কবে এল?’
‘হ্যাঁ, আপনজন। বড় আপনজন। সর্বনাশের জোঁক। কিন্তু এত বড় ছেলে কি করে হবে তাই মাথায় আসছে না। গোলমাল আছে, বহুৎ গোলমাল আছে। জোচ্চুরি!’
অর্ক এবার কাঁধ ঝাঁকালো, ‘কি যা তা বকছেন। আপনার কাছে চিনি পাওয়া যাবে?’ সে সরাসরি এগিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল।
‘সিনি! উঁহু, আমার ইস্টক কম আস্-এ।’
অর্ক হতাশ চোখে লোকটাকে দেখল। বুঝল চাঅলা চিনি দেবে না। অতএব ওই মুদির দোকান খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে আবার রাস্তায় চলে এল। আসবার সময় লক্ষ্য করল টেকো লোকটাও তখনও তাকে খুঁটিয়ে দেখছে লোকটা কে? অর্কর মনে হল কিছু একটা গোলমাল আছে। তাকে সর্বনাশের জোঁক বলল কেন? আজ অবধি কখনও সে লোকটাকে দ্যাখেনি। আগে হলে এই কথাটা বলার জন্যে ওর বারোটা বাজিয়ে দেওয়া যেত। ভদ্রলোক হতে গেলে অনেক অন্যায় চুপচাপ সহ্য করতে হয়। নিশ্চয়ই কোন খার আছে।
এখন দু তিনটি লোক রাস্তায়। আর একটু এগোতেই সে একটা বিরাট খেলার মাঠ আর স্কুল দেখতে পেল। এত বড় জায়গা নিয়ে স্কুল হয় তার ধারণায় ছিল না। রাস্তাটা চলে গিয়েছে বাঁধের দিকে। এখন লোকজন দেখা যাচ্ছে। অর্ক লক্ষ্য করল কিছু মানুষের চেহারা অন্যরকম। ঠিক বাঙালি নয়। মুখের ছাঁদটা সামান্য আলাদা। তাদের পোশাক বলে দেয় মানুষগুলো গরীব। কিন্তু বেশ সরল ভঙ্গী। এই সময় পেছন থেকে কেউ তাকে ডাকছে বুঝতে পারল সে। মুখ ফেরাতেই দেখল টেকো মাথা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে। অর্ক শক্ত হয়ে দাঁড়াল। এবার যদি লোকটা আনসান বকে তাহলে সে ঝাড়বে।
লোকটা কাছে এসে হাসল, ‘চিনি খুঁজতে এদিকে চললে কোথায়?’
অর্ক শক্ত গলায় বলল, ‘কেন, তাতে আপনার কি দরকার?’
‘আহা, রাগ করছ কেন? বুড়ো মানুষ, মাথার ঠিক নেই, কি বলতে কি বলে ফেলেছি, এসো এসো, আমি তোমার চিনির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কত লাগবে?’
‘পাঁচশো।’ শব্দটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।
‘আড়াইশো হলে চলবে? চালিয়ে নাও। বাড়িতে চিনি নেই বুঝি? তা বেলা হলে না হয় বাড়তিটা নিয়ে যেও।’ লোকটি অর্কর হাত ধরল।
এই পরিবর্তনে ধাতস্থ হতে সময় লাগল অর্কর। চিনি যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন খামোকা কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মা চায়ের জল গরম করে বসে আছে নিশ্চয়ই। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন দোকানে চিনি পাওয়া যাবে!’
‘দোকান তো এখনও খোলেনি ভাই। ও আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তোমার জন্যে।’
অর্ককে নিয়ে হাঁটতে লাগল লোকটা।
এবার অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি আমাদের চেনেন মনে হচ্ছে।’
‘চিনি। হাড়ে হাড়ে চিনি।’ বলেই বুড়ো মানুষটা জিভ কাটলো, ‘কিছু মনে করো না, আমার কথা বলার ধরনটাই এ রকম। এত বেফাঁস কথা বলি যে—! যাক! চিনি বইকি।’
‘আমার বাবার সঙ্গে আলাপ আছে?’
‘তোমার বাবা? আরে ওকে তো জন্মাতে দেখেছি। তা তোমার বয়স কত হল?’
‘পনের।’
‘অ্যাঁ? পনের? দেখে তো মনে হয় না।’
অর্ক হাসল। তাকে যে বড় দেখায় সে জানে এবং কেউ তা বললে ভাল লাগে।
‘তোমার মা এসেছেন?’
‘হ্যাঁ। দাদুর শরীর খারাপ তাই—।’
‘পনের বছরে আর আসার সুযোগ পাওনি, না?’
অর্ক লোকটার দিকে তাকাল। কথাটার মধ্যে যে খোঁচা আছে তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু লোকটা এখন ভাল ব্যবহার করছে, আসল ধান্দাটা কি?
‘কলকাতায় তোমরা কোথায় থাকো?’
‘বেলগাছিয়ায়। ঈশ্বরপুকুর লেনে।’
‘সেটা কোথায়?’
‘শ্যামবাজারের কাছে। আপনি কলকাতায় যান কি?’
‘বেশী না। তা তোমার মায়ের বাড়ি?’
‘না।’
‘তোমার মামা মাসীরা কোথায়?’
‘ওরা কেউ নেই।’
‘হুম্ম্।’
ওরা চায়ের দোকানের সামনে এসে পড়েছিল। এখন লোকজন বেড়েছে। অর্ককে দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটা খদ্দেরদের ডিঙ্গিয়ে দোকানদারকে কিছু বলল। মিনিট খানেক কথা চালাচালির পর একটা ঠোঙা নিয়ে এল লোকটা, ‘দুটো টাকা দিয়ে দাও ওকে, একটু বেশী পড়ল, কি করা যাবে।’
অর্ক চটপট দুটো টাকা বের করে হাতে দিচ্ছিল, কিন্তু সবেগে মাথা নাড়ল লোকটা, ‘না না, টাকা পয়সার মধ্যে আমি নেই। যার জিনিস তাকে দাও।’
খদ্দেরদের ফাঁক গলে অর্ক দোকানদারকে টাকাটা দিয়ে আসতেই লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘মহী এখন কেমন আছে?’
‘ভাল না।’ ঠোঙাটার ওজন বড় জোর দুশো হবে। অর্ক বুঝতে পারছিল সে ঠকেছে কিন্তু কিছুই করার নেই। এখন আর কোথায় চিনি পাওয়া যাবে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, আপনার নাম জানতে পারি?’
‘নাম? হুম্। বলেই দিই। আমার নাম পরিতোষ মিত্তির। চেনা চেনা লাগছে?’
অর্ক এই নামের কাউকে চিনতো না। শুধু পদবীতে সামান্য খটকা লাগল। সে মাথা নাড়ল, ‘না।’
‘কখনও শোননি? কেউ বলেনি?’ পরিতোষের চোখ ছোট হয়ে গেল।
‘না। আপনি কি আমাদের কেউ হন?’
‘হুম। আমি তোমার বাবার জ্যাঠামশাই।’
এবার খেয়াল হল অর্কর। দাদুর বাড়ি নিয়ে নাকি মামলা চলছে। বাবার জ্যাঠামশাই নাকি দাদুর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সরাসরি এসব কথা কেউ তাকে বলেনি কিন্তু মা-বাবার আলোচনায় সেটা জেনেছিল সে। বাবার দাদু নাকি একে দেখতে পারতো না। তাই সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিল। কিন্তু কত বয়স হবে লোকটার? নিশ্চয়ই সত্তরের অনেক বেশী। চেহারা দেখলে অবশ্য সেটা বোঝা যায় না। কেমন খেকুঁড়ে দেখতে। কেন তখন এই লোকটা তাকে জোঁক বলেছিল তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এর ওপর রাগ করা উচিত, এর সঙ্গে কথা না বলাই শ্রেয় যেহেতু মামলা করেছে কিন্তু সেটা করতেও যে সে পারছে না। অর্ক সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, “আপনি আমাদের বাড়িতে যান না?’
‘যাই। গিয়ে দিদির সঙ্গে কথা বলি। মহীর বউটা মহাপাজী। গেলেই ট্যাঁক ট্যাঁক করে কথা শোনায়। অবশ্য কেস ফাইল করার পর যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। বাড়িটা ছাড়া তো আর কিছুই নেই, ছিবড়ে হয়ে গেছে।’
ইতিমধ্যে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। মুদির দোকানটা এখনও খোলেনি। অতএব এই দেরির পেছনে খানিকটা যুক্তি আছে। অর্কর মনে হচ্ছিল লোকটার সঙ্গে কথা বলা দরকার। বাবার জ্যাঠামশাইকে ও কোন সম্মানজনক সম্বোধন করতে পারছিল না। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কোথায় থাকেন?’
‘আমি? সেনপাড়ার ভেতরে। চল্লিশ টাকায় ভাড়া আছি। তোমায় কি বলব, খেতে পাই না বাপ। এই শরীর নিয়ে তো আর কাজকর্ম করতে পারব না। তোমার ঠাকুমা বাতের রুগী। ছেলেমেয়েরা এক একটা হাড়হারামজাদা, ছোটটা বাদে। শিলিগুড়িতে থাকে। তার টাকায় বেঁচে আছি। আর মহী বাপের টাকায় তৈরি বিশাল প্রাসাদে পা নাচিয়ে আছে। আরে বাপ কি তোর একার?’
‘উনি অসুস্থ।’
‘হবে না? ধম্মের কল বাতাসে নড়ে। কিন্তু আমি ছাড়ছি না, ওবাড়ির ভাগ চাই।’
‘আপনি ওখানে গিয়ে থাকবেন?’
‘মোটেই না। বিক্রি করে দেব। বিক্রি করে শেষ কটা দিন আরামে থাকব। ও ভূতের বাড়িতে কে থাকতে যাবে।’
‘কিন্তু শুনেছি মামলা করার অনেক খরচ। আপনি পারছেন?’
‘না পারছি না। ধার ধোর করতে করতে চালাচ্ছি। উকিল আমার বন্ধুলোক, টাকাকড়ি নেয় না, তাই বাঁচোয়া। তোমার বাবা কি ল্যাংড়া?’
অর্কর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল কথাটা শুনে। তবু সে শান্ত গলায় বলল, ‘উনি হাঁটতে পারেন না ক্রাচ ছাড়া।’
‘মহী মরলে তো ওকেই কেস লড়তে হবে। পারবে?’
‘সেটা ওঁকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন।’
পরিতোষ বলল, ‘কিছুদিন আগে প্রিয় এসেছিল। আমেরিকায় থাকে, সাহেব মানুষ। তার মুখেই শুনলাম। তা এত করে বললাম আমায় কিছু দে, দিল না। যৌবনে একটু এধার ওধার করেছি বলে বাবা খচেছিল। তা তার জের এখনও চলবে? তোমাকে কিন্তু আমার ভাল লাগছে। তুমি কি কর?’
‘কিছু না।’
‘পড়াশুনা কর না?’
‘না। আমাদের পাড়ায় একটা মাস্তানদের দল আছে, তাদের সঙ্গে মিলে ওসব করায় আর পড়াশুনা করতে ইচ্ছে হয়নি।’
‘অ্যাঁ? তুমি মাস্তান?’ আঁতকে উঠল পরিতোষ।
‘সবাই তাই বলে। খুর চালাতে পারি। পেটো আর পাইপগানে এক্সপার্ট। গতকালই এখানকার দুটো ছেলেকে পেঁদিয়েছি। এ পাড়ায় শানু বলে একটা ছেলে আছে তাকে জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবেন। লাসটাকে ফেলে দেওয়া আমার কাছে জলভাত। একশ আটটা খিস্তি জানি।’
‘তুমি, তুমি ডেঞ্জারাস। বাবা বেঁচে থাকলে তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দিত না। অত্যন্ত কঠোর, আদর্শবান মানুষ ছিলেন, শুধু আমার বেলায় যা কিছু ভুল হয়েছিল। তিনি তোমাকে—। আঃ।’ পরিতোষ তার নিজের পেট খিমচে ধরল।
অর্কর খুব হাসি পাচ্ছিল। লোকটার মুখে ভয় সেঁটে বসেছে! সে আর একটু তাতিয়ে দেওয়ার জন্যে বলল, ‘মামলা ফামলা করে কি করবেন? এত যে মার্ডার ফার্ডার হয় কেউ শাস্তি পায়? তার চেয়ে আসুন, ওসব নকশা না করে ফয়সালা করে ফেলি!’ শেষ সংলাপটায় ও একটু খুরকি টান দিয়ে দিল।
‘নকশা? আমি নকশা করছি? এ কি ভাষা?’
‘এখন এটাই চলে। আজ বিকেলে চলে আসুন। বাবাকে বলে রাখব। চিনির জন্যে ধন্যবাদ।’ অর্ক আর দাঁড়াল না। পরিতোষ যে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা সে বুঝতে পারছিল।
গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে অর্ক দেখল দরজাটা আধ-ভেজানো। চার ধারে পাখির ডাক আর ফুলের গন্ধ। রোদের রঙ পাল্টেছে। বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে ওর পরিতোষের বলা ভূতের বাড়ি কথাটা মনে পড়ল। সত্যি, মনে হয় এখানে কোন মানুষ থাকে না। ওদের ঘরে উঁকি মেরে দেখল কেউ নেই। ভেতরের ঘর পেরিয়ে রান্নার ঘরের কাছে এসে দেখল উনুন জ্বলছে, কিন্তু সেটাও ফাঁকা। ঠাকুরঘরেও কেউ নেই। চারজন মানুষ এখানে নানাভাবে থাকার কথা কিন্তু কাউকে খুঁজে পেল না সে। দু’ তিনবার সে মা মা বলে ডাকল। তারপর আবার ভেতরের ঘরে ঢুকল। একটাও শব্দ নেই বাড়ির মধ্যে শুধু একটানা ঘুঘুর ডাক কানে আসছে। অর্ক ভেতরের দিকে ফিরল। তারপর মহীতোষের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল।
দাদু শুয়ে আছেন। দাদুর পায়ের কাছে বাবা বসে। মুখ নিচে নামানো। দাদুর পাশে খাটে শরীরের সামান্য অংশ রেখে ছোটমা লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর মুখ দাদুর বুকের ওপর। শরীরটা কাঁপছে, শব্দহীন। দাদুর মাথার পাশে খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে মা। পাথরের মত। খাটের ওপাশে ধুতির আঁচল গলায় জড়িয়ে বড়দিদা এক দৃষ্টিতে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
সে দরজা ছাড়াতেই যে শব্দ হয়েছিল তাতে ছবিটা ভাঙ্গল না। শুধু বড়দিদা অকম্পিত গলায় বললেন, ‘এসো বাবা, তোমার দাদু এইমাত্র মহাপ্রয়াণ করলেন।’