1 of 2

৩৫. ঠায় সাত ঘণ্টা এক জায়গায়

ঠায় সাত ঘণ্টা এক জায়গায় চুপচাপ বসে রইল আনন্দ।

তার চোখের সামনে একটু একটু করে বাচ্চাটা সহজ হচ্ছে, জল এবং ওষুধ যে কাজ করছে তা জানার পর থেকেই এক ধরনের উত্তেজনা যেন নেশার মত পেয়ে বসেছিল তাকে। পরে সে এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছে। শরীরের লক্ষণ বিচার করে অসুখের স্বরূপ নির্ধারণ করা হয়। বিশেষজ্ঞরা তা চিকিৎসকদের জন্যে করে গেছেন। সেই নির্দেশ অনুযায়ী সঠিক বুঝে নিয়ে ওষুধ দেওয়া হয়। মানব শরীরের জটিল জগতের গোলমেলে জায়গাটায় ঠিক ওষুধ পড়লেও যে সব সময় প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক হবে এমন ভাবার কারণ নেই। কারণ সব মানুষই এক নিয়মে চলে না। যদি ওষুধে চমৎকার কাজ করে তাহলে সেই মুহূর্তে চিকিৎসক প্রায় ঈশ্বরের সমতুল্য হয়ে যান রোগীর চোখে। আর সাফল্যের আনন্দ তাঁকেও উৎসাহিত করে। কিন্তু যদি ওষুধ মাথা ঠোকে তাহলে তার অবস্থা হয় অত্যন্ত করুণ। হাতড়াতে হাতড়াতে কোনরকমে ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে তখন। অর্থাৎ মানুষের শরীরের কর্মকাণ্ড চোখের আড়ালে রেখেও প্রখর অনুমান শক্তির সাহায্যে সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। এইভাবে একটা দেশের অসুখ সারাবারও চেষ্টা চলেছে। কিন্তু মুশকিল হল প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনুমান ভুল হয়ে যাওয়ায় ওষুধ কোন কাজেই লাগে না। বিশেষজ্ঞরা মানুষের মুক্তির যেসব ফর্মুলা তৈরি করে দিয়েছেন তাও ওই শরীরের মতই দেশে দেশে একইভাবে কাজে লাগে না। সেদিন যেভাবে বাচ্চাটার ঘাড় নরম হয়েছিল, একটু একটু করে জ্বর কমেছিল এবং সাত ঘণ্টার পরে সহজ হয়ে হেসেছিল সেইভাবে যদি একটা দেশকে সুস্থ করা যেত!

পালদেম ওর হাত চেপে ধরল। ওর মুখ চোখে কৃতজ্ঞতা। পালদেমের স্ত্রী একটা পোড়াটে মোটা রুটি আর জল এনে সামনে রাখল। খবরটা চারপাশে ছড়িয়েছে। এর আগে পালদেম আস্তানা থেকে আনন্দর অংশের খিচুড়ি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সেটা ছোঁয়া হয়নি। এখন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত বোধ করল সে। কাল রাত্রের রুটির অভিজ্ঞতায় ওই ঠাণ্ডা শক্ত হয়ে যাওয়া খিচুড়ি অনেক শ্রেয়। কিন্তু পালদেমের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সে রুটি তুলে নিল। সত্যিই অখাদ্য কিন্তু বালির অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চাটা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। আনন্দ পালদেমের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল দিনের চিহ্ন কোথাও নেই। পালদেমদের ঘরে দিনরাত এখন কাঠের আগুন জ্বলছে। কেরোসিনের ব্যবহার এই গ্রামে নেই। কিন্তু লাঠির গায়ে এক ধরনের ছাল শক্ত করে জড়িয়ে সেটাকে মশালের মত ব্যবহার করা হয়।

কনকনে ঠাণ্ডায় আনন্দ আর পালদেম হাঁটছিল। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, সেই মেয়েটা কেমন আছে এখন?

পালদেম জবাব দিল, নিশ্চয়ই মারা যায়নি। তাহলে জানতে পারতাম।

আনন্দ বলল, পালদেম, আমরা যদি এখানে কিছুদিন থাকি তাহলে তোমাদের আপত্তি হবে?

কথাটা শুনে পালদেম অবাক হয়ে বলল, এখানে থাকতে যাবে কেন? এখানে খুব কষ্ট!

জানি। কষ্ট পৃথিবীর সব জায়গায় আছে তবে এক এক রকম। আমি কথা দিচ্ছি আমাদের কাছ থেকে তোমাদের কোন বিপদ আসবে না।

আনন্দর কথায় কোন জবাব দিল না পালদেম। চুপচাপ তাকে আস্তানা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বলল, আমার ছেলের জন্যে তুমি যা করেছ তা আমি মনে রাখব। তারপর চলে গেল।

দরজায় শব্দ করতে সুদীপ সেটা খুলল, কেমন আছে?

ভাল। কিছু খেতে দিবি? আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। আনন্দ ভেতরে এসে নিজের বিছানায় সেঁধিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করল। সে ঢোকার সময় দেখেছিল এই ঘরেও ওই মশাল জ্বলছে। জয়িতা নেই। কল্যাণ শুয়ে আছে। সুদীপ এসে ডাকতেই আনন্দ চোখ খুলে চমকে উঠল, এ কিরে!

তার সামনে খানিকটা শক্ত খিচুড়ি আর একটা মুরগীর ঠ্যাং, সম্ভবত পোড়ানো। সুদীপ বলল, স্মাকড চিকেন। পালদেমের বাড়ি থেকে পাঠিয়েছিল মুরগীটা। একটু ধোঁয়ার গন্ধ হয়ে গেছে গুরু কিন্তু টেস্ট দারুণ। বাপের জন্মে এমন রাঁধব কে ভেবেছিল!

খাবার শেষ করে তৃপ্ত আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, জয়িতা কোথায়?

ও সেই মেয়েটার কাছে গিয়েছে। তোরা দুজন যা আরম্ভ করেছিস!

কিন্তু ওখান থেকে এত রাত্রে একা ফিরবে কি করে?

বিকেলে আমি গিয়েছিলাম খবর নিতে। বলল, রাত হয়ে গেলে ওখানেই থেকে যাবে। মেয়েটার ঘা আমি দেখেছি। কিস্যু করার নেই। কেন যে ছাই আগ বাড়িয়ে উপকার করতে গেলাম। সুদীপ ট্রানজিস্টার বের করল।

আনন্দ দেখল কল্যাণ চোখ বন্ধ করে মড়ার মত পড়ে আছে। সকালে ও পালাতে চেয়েছিল। রাগের বদলে ওর জন্যে কষ্ট হচ্ছিল আনন্দর। কিন্তু এখন কিছু বলতে যাওয়া মানে সেটা খুব বানানো শোনাবে। হয়তো সেটা ওর ভালও লাগবে না। ঠিক তখনই কিছু বিচিত্র শব্দ বের করার পর অত উচ্চারণে বাংলায় খবর শুরু হল, জোট নিরপেক্ষ দেশগুলি একযোগে ব্রিটেনের বৈদেশিক নীতির সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মিসেস মার্গারেট থ্যাচারকে আজ হিথরো এয়ারপোর্টে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন যে, তাঁর সরকার ব্যাপারটি নজরে রেখেছেন। আমাদের নয়াদিল্লিস্থ সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের সংসদে ঘোষণা করেছেন, যে কোন বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিকে তার সরকার কঠোর হাতে দমন করবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, গোখাল্যান্ডের দাবী মানার কোন প্রশ্ন ওঠে না। আমাদের সংবাদদাতা আরও জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ধ্বংসাত্মক কাজের জন্যে চারজন বিপথগামী তরুণকে দায়ী করেছেন। এরা এখন ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে নেপালে আশ্রয় নিয়েছে বলে তার কাছে খবর আছে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এবার আসুন আপনাদের নিয়ে যাই লন্ডনের বইমেলায়। শব্দটাকে কমিয়ে দিয়ে সুদীপ চিৎকার করল, শুনেছিস?

আনন্দ নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোন্ স্টেশন রে?

ভয়েস অফ আমেরিকা অথবা বি বি সি। হ্যাঁ, বি বি সি।

যাক, আমরা তাহলে আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে গেলাম। আনন্দ আবার চোখ বন্ধ করল।

তাতে কোন্ স্বর্গ পাওয়া গেল। আচমকা কল্যাণ কথাগুলো বলে উঠতেই দুজন ওর দিকে মুখ ফেরাল। কল্যাণ বলল, ওরা এখন টের পেয়ে গেছে আমরা এখানে এসেছি। এটা এমন একটা জায়গা

যে পালিয়ে বাঁচার রাস্তা খোলা নেই। এখন ওরা আমাদের গলা টিপে মারবে। উঃ!

অদ্ভুত শোনাচ্ছিল ওর গলা। আনন্দ উঠে বসল, ওরা এখনও জানে না আমরা কোথায় আছি।

সেই আনন্দেই থাক। ওয়াংদে নিশ্চয়ই ফিরে গিয়ে সব বলে দিয়েছে। আমি এখন কি করি?

সুদীপ এবার কথা বলল, কাল পালদেমকে বলব তোকে ফালুটের পথে পৌঁছে দেবে।

তা তো বলবিই। আমাকে মেরে ফেলতে পোরা চাইবিই।

কেন? আনন্দ বিস্মিত হল। তাদের কেউ এইরকম কথা বলছে ভাবতে পারছে না সে।

আমি তোদের সঙ্গে সুর মেলাতে পারছি না। আমি ওষুধপত্র জানি না, কোন ফালতু কাজ করতে চাইছি না, আমার জন্যে তোদের খাবার নষ্ট হচ্ছে। সুদীপ আর জয়িতা অবস্থাপন্ন, তুই মধ্যবিত্ত আর আমি বিত্তহীন। আমাকে তোরা পাত্তা দিবি কেন? শেষের দিকে কল্যাণের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল। যেন আর একটু হলেই তার পক্ষে কেঁদে ফেলা অসম্ভব নয়।

সুদীপ বলল, তুই মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছিস কল্যাণ। তোর সম্পর্কে কেউ কিছু ভাবছে না। আমরা একসঙ্গে বেরিয়েছি, আমরা কেউ কারও শত্রু নই। তুই ঘুমিয়ে পড়।

আনন্দ কোন কথা বলছিল না। তার মনে পড়ল হোস্টেলের একটি ছেলের কথা। ও এসেছিল রায়গঞ্জ থেকে। খুবই গরীব। কারও সঙ্গে কথা বলত না। কলেজ ছাড়া কোথাও যেত না। দুবেলা হোস্টেলের খাবার ছাড়া অন্য কিছু খাওয়ার সামর্থ্য বোধ হয় ছিল না। কিন্তু সব সময় মনে করত অন্যান্য ছেলেরা বোধ হয় তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। মনে মনে ব্যাপারটা বানিয়ে নিয়ে সে ক্রমশ এমন কমপ্লেক্সে ভুগতে শুরু করল যে বেচারার পড়াশুনাটাও হল না। এই ছেলেটার সঙ্গে কল্যাণের কথাবার্তা মিলে যাচ্ছে। অক্ষমতা মানুষকে অভিমান দেয় কিন্তু অভিমান কি সব সময় আত্মহননে সাহায্য করে? কিভাবে কল্যাণকে সাহায্য করা যায়?

এই সময় বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টির সঙ্গে ঠাণ্ডা বাড়ছিল। ওরা আর কেউ কথা বলছিল না।

আনন্দরই ঘুম ভাঙল প্রথমে। মশালটা নিবে গেছে। ঘর অন্ধকার। শুধু মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কোন আওয়াজ কানে আসছে না। অর্থাৎ বৃষ্টি থেমে গেছে। এই ঠাণ্ডায় শরীর বাইরে বের করা কঠিন ব্যাপার কিন্তু তলপেটের চাপ বাড়ায় আনন্দকে বেরুতে হল। হাতড়ে হাতড়ে সে দরজার কাছে পেীছে গেল। সেটা খুলতেই মনে হল সমস্ত শরীর জমে যাবে। দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে সে ভারমুক্ত হল। তারপর ছুটে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার চোখ বিস্ফারিত।

সূর্য উঠছে। আকাশ এখন পরিষ্কার। সমস্ত চরাচরে অন্ধকারের পাতলা মশারি এখনও টাঙানো। কিন্তু পর্বতশৃঙ্গের (এই শব্দটি ছাড়া আনন্দর ওই মুহূর্তে অন্য কিছু মনে হল না) ওপর সূর্যের আলো পড়েছে। সূর্যটাকে কিন্তু এখনও দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু শৃঙ্গগুলোয় আমোর খেলা চলেছে মারাত্মকভাবে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে নিশ্চয়ই অনেক আগে। এখন শেষ মুহূর্ত, একটু বাদে তিনি প্রকাশিত হবেন। শৃঙ্গগুলো লক্ষ্য করল আনন্দ। ছামলা, বারুণৎসে, নাপসে, লোহসে, মাকালু, ছোমা এবং সবার পেছনে মহান উদ্ধত এভারেস্ট। সমস্ত রেঞ্জটা সাদা কমলায় মাখামাখি। আনন্দ চিৎকার করে বন্ধুদের ডাকল। ওদের উঠতে যত সময় লাগছে তত আলোর রঙ পালটাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সুদীপ এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই বলল, আঃ!

আনন্দ দেখল কল্যাণ আসেনি। সে দ্রুত ভেতরে ঢুকল। কল্যাণ জেগেছে কিন্তু এখনও চুপচাপ শুয়ে আছে। আনন্দ ওর হাত ধরল, উঠে পড়। কি দারুণ সূর্যোদয় হচ্ছে।

তাতে আমার কি? নির্লিপ্ত গলায় বলল কল্যাণ।

সেটা না দেখলে বুঝবি না। আমি তোকে হুকুম করছি উঠতে।

যেন বাধ্য হল কল্যাণ। তারপর নিতান্ত অনিচ্ছায় ধীরে ধীরে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ঠিক সেই মুহূর্তে সুর্যের মুখ দেখা যেতেই কল্যাণ আচমকা শব্দ করে কেঁদে উঠল।

সুদীপ এবং আনন্দ চমকে উঠল। নিজেকে দ্রুত সামলে নিতে চাইছিল কল্যাণ। তারপর যেন একটা কৈফিয়ৎ দেওয়ার ভঙ্গিতেই বলল, কি অদ্ভুত সুন্দর, না!

ওরা কেউ জবাব দিল না। যতক্ষণ শৃঙ্গগুলো সাদা না হয়ে যায় ততক্ষণ সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সুদীপ আনন্দকে বলল, আমাদের একবার জয়িতার খোঁজ নেওয়া উচিত।

আনন্দ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। কল্যাণ, তুই সুদীপের সঙ্গে গিয়ে দেখে আয়। আমি চা করছি।

ওরা চলে গেলে আনন্দ কাঠের সিঁড়ির ওপর বসে পড়ল। যতই ঠাণ্ডা বাড়ক সেটাকে শরীর ঠিক সইয়ে নিতে পারে সময় পেলে। এবং তখনই আনন্দর নজরে পড়ল কাছাকাছি সব উঁচু জায়গা সাদাটে হয়ে গেছে, এমনকি ঘাসের ওপরেও কুচি কুচি বরফ। অর্থাৎ কাল রাত্রের বৃষ্টির পরে এই কাণ্ডটি ঘটেছে। শীত আসছে। ক্রমশ সমস্ত চরাচর সাদা বরফে ঢেকে যাবে। সময় বেশি নেই, যা করবার এখনই করতে হবে। কিন্তু কিভাবে, সেটাই প্রশ্ন।

আর তখনই তার নজরে পড়ল দুটো মানুষ এগিয়ে আসছে। ওদের হাঁটার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। একটু কাছাকাছি হতে সে বুঝল দুজনের একজন নারী, পুরুষটিকে সে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। আনন্দ অপেক্ষা করল। হাত দশেক দূরে পৌঁছে ওরা দাঁড়াল। পুরুষটি সোজা হতে পারছে না। বোঝাই যাচ্ছে লোকটা বেশ অসুস্থ। নারীটি হাত নেড়ে আনন্দর দিকে তাকিয়ে অনর্গল কিছু বলে পুরষটিকে দেখাল। ওদের পায়ের তলায় ঘাসে কুচি কুচি বরফ অথচ পুরুষটি সেখানেই বসতে চাইছে দেখে আনন্দ উঠে দাঁড়িয়ে ইঙ্গিত করল বারান্দায় উঠে আসতে। ওরা কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে বসে পড়ল। এবার আনন্দ বুঝল দুজনেরই বেশ বয়স হয়েছে। সমস্ত শরীর ছেড়া গরম কাপড়ের আড়ালে থাকায় এতক্ষণ বোঝা যাচ্ছিল না। বৃদ্ধ মাথা গুঁজে বসে আছে। মাঝে মাঝে তার শরীর কেঁপে উঠছে। বৃদ্ধা দুহাত তুলে আনন্দকে অনুনয় করছিল। ভাষা বুঝতে না পারলেও বক্তব্য জানতে অসুবিধে হল না। পরে পড়ল আনন্দ। বৃদ্ধের কি হয়েছে সে বুঝতে পারছে না। বা বুঝলেও কোন্ ওষুধ দেওয়া উচিত এবং তা সঙ্গে নাও থাকতে পারে। সে হাঁটুমুড়ে বসে বৃদ্ধের কপালে হাত রাখল। না, জ্বর নেই কিন্তু শরীর কাঁপছে। এবং তখনই তার গলগণ্ডটি নজরে এল। ওই কারণেই শরীর অসুস্থ কিনা কে জানে? পেটের যন্ত্রণাও হতে পারে, কারণ মাঝে মাঝেই বৃদ্ধের মুখ কুঁচকে যাচ্ছিল। বারংবার কানে ঘষার পর অচেনা শব্দও চেনা হয়ে যায়। আনন্দ বৃদ্ধাকে ইঙ্গিত করল বৃদ্ধকে শুইয়ে দিতে। তারপর ঘরে ঢুকে ওষুধের বাক্সটার দিকে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। নিজেকে ভীষণ নির্বোধ মনে হচ্ছিল। এক্ষেত্রে ওষুধ দিলে যদি বিপরীত প্রতিক্রিয়া হয়? চিকিৎসার এক্তিয়ার একমাত্র চিকিৎসকের। কিন্তু এক্ষেত্রে সে কি করতে পারে? বোঝাই যাচ্ছে পালদেমের ছেলের সুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে এরা অনুপ্রাণিত হয়েছে। আনন্দ একটা অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট এনে বৃদ্ধার হাতে দিয়ে খাইতে দিতে বলল। এমন কি তাকে ট্যাবলেটটাকে কাগজমুক্ত করে জলের ব্যবহারের কথাও বলতে হল।

ওদের ওখানে রেখে সে ভিতরে ঢুকল। কেরোসিন পোড়াতে আর সাহস হচ্ছে না। সে আবার বাইরে বেরিয়ে এসে উনুনটার সামনে কেটলি রাখল। কাঠ নেই। আশেপাশে তাকাল আনন্দ। সুদীপ গতকাল কোথায় কাঠ পেয়েছিল? এই সময় বৃদ্ধা বারান্দা থেকে নেমে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে হাসল। পৃথিবীর সর্বত্র বোধ হয় স্নেহের হাসি একরকম হয়। বৃদ্ধা হাত নেড়ে যা বলল, তার মানেটা বোধ হয় এই রকম, তুমি সরে যাও, যা করার আমিই করছি। কৃতজ্ঞ আনন্দ উঠে এল ওপরে। বৃদ্ধ চুপচাপ শুয়ে আছে। তার চোখ খোলা কিন্তু শরীর কাঁপছে না আগের মত। নিজেকে একটি প্রতারক বলে মনে হচ্ছিল। চিকিৎসাশাস্ত্রের বিন্দুমাত্র না জেনে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করার ফল হাতে হাতে পাওয়া যাবে। হয়তো যা দরকার তার বিপরীত ওষুধ বৃদ্ধকে দেওয়া হল। ও মারা গেলে এখন তাকেই নিমিত্তের ভাগী হতে হবে। সে বৃদ্ধের পাশে বসল। তারপর কপালে হাত রাখল। ধীরে ধীরে বৃদ্ধের মুখে হাসি ফুটল। অজস্র শিরা ওঠা কাঁপা হাতে বৃদ্ধ আনন্দর হাত ধরল। কে বলে শুধু যৌবনেই উত্তাপ থাকে!

 

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক বাড়তে লাগল। এখন আকাশ পরিষ্কার। রোদ আছে কিন্তু তার তেজ নেই। ওদের আস্তানার সামনে এখন অন্তত সত্তরজন মানুষ। প্রত্যেকেই অসুস্থ। প্রত্যেকেই ওষুধ চায়। অথচ কেউ কথা বলছে না। এই রকম মূক অসুস্থ মানুষদের মুখোমুখি হয়ে ওরা হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। জয়িতাকে নিয়ে সুদীপরা ফিরে এসেছিল এর আগে। মেয়েটির অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। জয়িতার ধারণা ঘা ওর পাজরার ভেতরে চলে গেছে। বড় হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ছাড়া এই মেয়েটিকে বাঁচানো মুশকিল। ওরা যে ওষুধ দিচ্ছে তাতে ওপরে ওপরে কাজ হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার, এই বিকট ঘা নিয়ে মেয়েটি কি করে এতদিন হেঁটে চলে বেড়াতো? সুদীপের যুক্তি হল ওটা অনেকটা ক্যানসারের মত। বেশ আছে, হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে, যেই বায়োপসি করা হল, খোঁচানো হল, অমনি দুদ্দাড় করে বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রোগী বিছানায়, যন্ত্রণার শুরু।

ওরা চা খেয়েছে। বৃদ্ধাকেও দিয়েছে। বৃদ্ধ এখন ঘুমাচ্ছে। বৃদ্ধা মাঝে মাঝে দেখে যাচ্ছে তাকে। তার মুখের উদ্বেগ এখন অনেক কমে গেছে। আনন্দর আনা আটা হাতে মেখে সে তালি দিয়ে দিয়ে রুটির আকারে নিয়ে গিয়ে উনুনের ওপর ফেলে দিচ্ছে সেঁকার জন্যে। আর এই সব কাজ বৃদ্ধা করছে আনন্দিত হয়েই। তার পাশে আরও কয়েকটি মেয়ে ভিড় করেছে। তারা অবশ্য সুদীপদের দিকে তাকিয়ে মন্তব্যসহযোগে হাসছিল। সেই হাসি উঁচুতে উঠলে বৃদ্ধার গলায় ধমক বাজছিল। কিন্তু চারজনের লক্ষ্য ওদিকে ছিল না। এতগুলো মানুষ অসুস্থ হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে অথচ।

আনন্দ পালদেমকে বলল, আমাদের কাছে এত ওষুধ নেই, কি করি বল তো? তাছাড়া প্রত্যেকের এক এক রকম রোগ। সব রোগের কি ওষুধ হবে তাও আমরা জানি না।

পালদেম বলল, আমি ওদের দুবার বলেছি কিন্তু কেউ কথা শুনতে চাইল না। এদের ধারণা তোমরা দেবদূতের মত এখানে এসেছ এবং ওদের সারিয়ে তুলতে পার।

মিথ্যে কথা। আমরা চিকিৎসার কিছুই জানি না। অর্কপটে বলল আনন্দ।

পালদেম হাসল, একথা কেউ শুনবে না। তোমরা আমার ছেলেকে সারিয়েছ।

আনন্দ মাথা নাড়ল, কিন্তু আমাদের বন্ধু বলছে মেয়েটিকে বাঁচানো হয়তো সম্ভব হবে না।

পালদেম চুপ করে গেল। ওর মুখ খুব শক্ত দেখাচ্ছিল। আনন্দ বলল, ওর কিছু হলে তো তোমরা আমাদের ছাড়বে না। কেন আর বিপদ বাড়াব বল!

পালদেম সময় নিল কথা বলতে, মেয়েটার মা বলেছে, তোমাদের বন্ধু যা করেছে তার তুলনা নেই। কিন্তু মেয়েটার মরণ ঘা হয়েছে। এদের কি বলবে এখন?

আনন্দ চুপচাপ লোকগুলোকে দেখল। জয়িতা বলল, ফালতু এক্সপেরিমেন্ট করে ওদের বিপদ বাড়িয়ে লাভ নেই। লেট দেম সাফার ইন দেয়ার ওন ওয়ে।

হঠাৎ দ্বিতীয় একটা পথ দেখতে পেল আনন্দ। সে পালদেমকে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কেউ ফালুট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবে আমাদের?

ফালুট! ফালুটে আমরা কেউ কখনও যাইনি। কেন?

রাস্তাটা তত চেনো। তোমরা আমাদের ওই পর্যন্ত পৌঁছে দিলে আমরা চেষ্টা করব দার্জিলিং যেতে। দার্জিলিং-এর কোন ভাল ডাক্তারকে যদি প্রত্যেকটা লোকের অসুখের বর্ণনা দেওয়া যায় তিনি নিশ্চয়ই কোন ওষুধ দরকার বলে দেবেন। সেগুলো কিনে ফালুটে ফিরে এলে তোমাদের লোক আবার পথ চিনিয়ে এখানে আসবে। এ কাজের জন্যে বড় জোর সাতদিন সময় লাগতে পারে। কিন্তু লোকগুলোর অসুখে ঠিকঠাক ওষুধ পড়বে।

আনন্দ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলতে পালদেম ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকাল, তোমরা কজন যাবে?

আনন্দ বলল, একজন। সে প্রশ্নটায় সন্দেহের গন্ধ সহজেই পেল।

মাথা নাড়ল পালদেম, ঠিক আছে।

সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেল চারজন। চারটে কাগজে আলাদা করে প্রতিটি মানুষকে পালদেমের সাহায্যে জিজ্ঞাসা করা হল, তার কি কষ্ট হচ্ছে, রোগের উপসর্গ কি, ব্যথা কোথায়, জ্বর আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগল সব জেনে নিতে। পালদেম তাদের বলে দিল সাতদিন পরে ওষুধ পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষগুলোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ গুঞ্জনের পর তারা ঢালু পথ বেয়ে চলে গেল যে যার ঘরে। এই সময় বৃদ্ধা এসে দাঁড়াল আনন্দর সামনে। বৃদ্ধর দিকে হাত বাড়িয়ে সে অভিমানের সুরে কিছু বলে আনন্দর হাতের কাগজটি দেখাল। হেসে ফেলল আনন্দ। তারপর পালদেমের সাহায্যে বৃদ্ধকেও জেরা করে করে উত্তরগুলো লিখে নিতে বৃদ্ধা খুশী হল।

আজ পালদেম এবং বৃদ্ধা ওদের সঙ্গে খেল। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে পালদেম বলল, সামনের চাদের পর এখানে রোজ বরফ পড়বে। তখনই হবে মুশকিল।

মুশকিল কেন? জয়িতা প্রশ্ন করল।

প্রত্যেক বছর এই সময় ব্যাপারী আসে খচ্চর নিয়ে। এ বছর এখনও এল না ওরা। ওদের কাছেই শীতের জন্যে জিনিসপত্র পাই আমরা। পালদেম উঠে দাঁড়াল, তোমাদের মধ্যে কে যাবে বাইরে?

আনন্দ মাথা নাড়ল, আমি।

তাহলে এখনই রওনা হও। আমি একটি ছেলেকে দিচ্ছি তোমাদের সঙ্গে। সে অল্প অল্প হিন্দী বলতে পারে। আমার ছেলের অসুখ না হলে আমি নিজেই যেতাম।

এখন রওনা হলে ফালুটে পৌঁছাবার অনেক আগেই রাত নামবে না?

নামুক। পাহাড়ে রাত কাটানোর জায়গা পাবে। দেরি করে কি লাভ! পালদেম যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল, আমি মিনিট পনেরোর মধ্যে ওকে নিয়ে আসছি।

সুদীপ এবার কথা বলল, দার্জিলিং-এ যাচ্ছিস, কতটা রাস্তা হাঁটতে হবে খেয়ালে আছে?

এছাড়া কোন উপায় নেই। আনন্দ উঠে কিছু জিনিসপত্র সঙ্গে নিল। সেই সঙ্গে টেন্টটাও। নিয়ে বলল, মানেভঞ্জনের মাড়োয়াড়ি দোকানদারটা তো আমাকে ছিঁড়ে খাবে টেস্টের জন্যে। দুটোই নিয়ে নিই, কি বল?

সুদীপ বলল, দুটো টেস্টের দাম আর কত হবে! ওগুলো আমাদের কখন লাগবে ঠিক নেই। তুই বরং দাম দিয়ে দিস।

সুদীপ আর জয়িতা আর একটা লিস্ট তৈরি করল। যতটা সম্ভব ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় জিনিস ফেরার সময় আনতে বলল। সুদীপ আনন্দর হাতে পনেরো হাজার টাকা দিল, টাকাটা সাবধানে নিয়ে যাবি। একা যাচ্ছিস, সঙ্গে অস্ত্র নেই।

কল্যাণ এতক্ষণ চুপচাপ ওদের লক্ষ্য করছিল। এবার উঠে দাঁড়াল, আনন্দ, তোর যাওয়ার দরকার নেই, আমি দার্জিলিং-এ যাব।

তিনজনেই চমকে উঠল, আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তুই যাবি?

হ্যাঁ।

কিন্তু।

কিন্তু কি? আমি কোন কাজ করতে পারি না? যা করার তোরাই করবি? চমৎকার! এতটা অপদার্থ ভাবার কোন কারণ নেই। আমিই যাচ্ছি। কল্যাণ উঠে নিজের জিনিস গুছিয়ে নিল।

সুদীপ বলল, কিন্তু কল্যাণ–।

না সুদীপ, আমি পালাব না। পালিয়ে যাবই বা কোথায়? এখানকার অসুস্থ মানুষদের জন্যে কিছু করতে পারলে আমার ভাল লাগবে। সে নিজের হাতটা তুলে ধরল, এটা কেটে দে।

কল্যাণের হাতের প্ল্যাস্টার এখন কালো হয়ে যেন চামড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। ওদের নজরেও পড়ত আলাদা করে। একটা ধারালো ছুরি দিয়ে সেটাকে কাটতে অনেক সময় লাগল। নীরক্ত সাদা হাত বেরিয়ে এলে কল্যাণ সেটা ঘুরিয়ে দেখল। কোন কোন জায়গায় ঘা-এর মত হয়ে গেছে। প্ল্যাষ্টারটা তুলে সে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ওটার মধ্যে ছারপোকার বাসা হয়ে গিয়েছে।

এই সময় পালদেম একটা অল্পবয়সী ছেলেকে নিয়ে ফিরে এল। বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি যতটা সম্ভব তার সেরা সাজ পরে এসেছে। তার পিঠে একটা কিছু দড়ি দিয়ে বাঁধা। আনন্দ শেষবার চেষ্টা করল, কল্যাণ, এখনও ভেবে দ্যাখ।

ভাবনার কিছু নেই। তোরা তো আমাকে একটাও বোমা ছুঁড়তে দিলি না। মানুষ না মারতে পারি মানুষ বাঁচাবার কাজে লাগি। আমি সাতদিনের মধ্যে ফিরে আসব, টাকাটা মেরে দিয়ে পালিয়ে যাব না, কথা দিচ্ছি। কল্যাণকে খুব সিরিয়াস, খুব স্থির মনে হচ্ছিল।

জয়িতা এবার কাছে এগিয়ে এল, কল্যাণ, তোর নেচার আমি জানি, তুই এই কষ্ট সহ্য করতে পারবি না। ওটা তোর কাজ নয়।

ভাগ। কল্যাণ জিনিসপত্র তুলে নিচ্ছিল।

জয়িতা বলল, তাছাড়া পুলিশ আমাদের জন্যে ওয়েট করছে। ধরা পড়লে কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছিস? তুই একটু চিন্তা করে দ্যাখ।

ও! আনন্দ গেলে পুলিশ জামাই আদরে দার্জিলিং-এ খেতে দেবে, না? আসলে তোরা আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিস! আমি তো কথা দিয়েছি, বিশ্বাস কর না।

অতএব আনন্দ কল্যাণকে সুদীপের টাকাটা দিয়ে দিল। লিস্টগুলোও সে নিয়ে নিল। পালদেম জিজ্ঞাসা করল, তুমি যাচ্ছ না কেন?

আনন্দ বলল, আমাদের এই বন্ধু যাচ্ছে বলে। ছেলেটাকে বলে দাও যেন সন্ধ্যের মধ্যে একটা ভাল আস্তানা খুঁজে নেয়। ও যদি দার্জিলিং পর্যন্ত যায় তাহলে ভাল হয়।

না, আমরা কেউ বড় শহরে যাই না। সান্দাকফুর কাছে ওকে ছেড়ে দিয়ে ছেলেটা অপেক্ষা করবে সাতদিন। আমরা পাহাড়ের মানুষ ঠিক থেকে যেতে পারি পাহাড়ে। তোমার বন্ধুকে বলে দাও যেন সাতদিনের মধ্যে ওই জায়গায় ফিরে আসে।

নতুন করে বলার কিছু ছিল না। কিছু চাল ডাল আলু সঙ্গে নিল কল্যাণ। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঢালু পথে নামল। ওরাও সঙ্গ নিল। খানিকটা দূরে যাওয়ার পর দেখল গ্রামের অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। ছেলেটির মা এসে গায়ে হাতে হাত বুলিয়ে খানিকটা কথা বলে নিল। জয়িতার মনে হল সবাই জানে কল্যাণ কেন যাচ্ছে। প্রত্যেকেই চাইছে ওরা নিরাপদে ফিরে আসুক। এই সময় কাহুনকে দেখা গেল দুজন শিষ্য নিয়ে এগিয়ে আসতে। ওদের দাঁড় করিয়ে দু-মিনিট মালা ঘুরিয়ে মন্ত্রপাঠ করে কাহুন সশিষ্য নীরবে ফিরে গেল।

ওরা এগিয়ে চলল সেই জায়গা পর্যন্ত যেখানে এসে প্রথম দিন ওরা গ্রামটাকে দেখতে পেয়েছিল। জয়িতার কেবলই মনে হচ্ছিল কল্যাণের সঙ্গে তার এই শেষ দেখা। শেষ পর্যন্ত সবাই যখন দাঁড়িয়ে পড়ল তখন ওরা দল ছেড়ে এগোল। হঠাৎ জয়িতা একা দৌড়ে কল্যাণের কাছে পৌঁছাল, সাবধানে যাস।

তুই ভাল থাকিস জয়ী। কল্যাণ ওর গালে আঙুল রাখল এক মুহূর্ত। তারপর হন হন করে হাঁটতে লাগল পাহাড় ভেঙে। কয়েক পলকের মধ্যে ওরা চোখের আড়ালে চলে গেলে জয়িতা আবিষ্কার করল তার চোখ ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল কল্যাণকে রিভলভারটা দিয়ে দিলে হত। কিন্তু সেই সময় একটা উল্লাসের চিৎকার উঠল জনতার মধ্যে।

জনতার থেকে আলাদা একা দাঁড়িয়ে জয়িতা দেখল দূরে সাদা পাহাড়ের পটভূমিতে কয়েকটা কালো বিন্দু দেখা যাচ্ছে। বিন্দুগুলো গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *