1 of 2

৩৫. এই এলাকায় তমোনাশ

এই এলাকায় তমোনাশ ডাক্তারের বেশ প্রতিপত্তি আছে। লোকে আড়ালে তাঁকে পাগলা ডাক্তার বলে, কিন্তু সামনে বেশ সমীহ করে এবং আড়ালের ডাকটির মধ্যেও রয়েছে অনেকখানি ভালোবাসা। তমোনাশ ডাক্তারের মানুষের শ্রদ্ধা অর্জনের পদ্ধতিটি সূর্য লক্ষ করে। দেখা গেল, ডাক্তারের জীবনের কোনও গোপন অংশ নেই, তার কোনও ব্যক্তিগত জীবন বলেই কিছু নেই। এ রকম মানুষকে বোঝা সকলের পক্ষে সহজ। কোনও রকম আব্রু রাখেননি বাড়িতে, যে যখন ইচ্ছে ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে, সারা দিনই উনুন জ্বলে-কে কখন এসে খেয়ে যায় তার ঠিক নেই। অনেক সময় খেতে বসে দেখা যায় পাতে খাবার নুন নেই, তমোনাশ ডাক্তার সামনের রাস্তা দিয়ে চলন্ত যে-কোনও লোককে ডেকে বলেন, ওহে অমুক, দু’পয়সার নুন কিনে দিয়ে যাও তো। ঝটপট এসো বাবা, খিচুড়ি জুড়িয়ে যাচ্ছে। নুন নিয়ে এসে সেই লোকটিও খেতে বসে যায়, না খেতে চাইলেও ডাক্তার তাকে খাওয়াবেনই, নিজের এঁটো খিচুড়ি তুলে দেবেন অন্য একটি থালায়।

এই ধরনের আন্তরিকতায় সাধারণ লোকে মুগ্ধ হয়। সূর্য বুঝতে পারে, তার পক্ষে এই পদ্ধতিতে মানুষের মন জয় করা সম্ভব নয়।

ডাক্তারের ছেলে-মেয়েরা সকলের ফুটফরমাজ খাটে, ডাক্তারের স্ত্রী সকলেরই মাসিমা। মাঝে মাঝে ডাক্তার সপরিবারে গান গাইতে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়, পাড়া প্রতিবেশীদের যোগ দিতে বলেন। অনেক লোকই আসে। মাঠের মাঝখানে পতাকা তুলে তার নীচে দাঁড়িয়ে ডাক্তার সকলকে গান্ধীজির বাণী বুঝিয়ে দেন। মাঝে মাঝে হাত তুলে উত্তেজিত ভাবে চিৎকার করে বলেন, জেলে যেতে হবে! সকলকে জেলে যেতে হবে। ব্রিটিশের জেলখানা ভরিয়ে দেব–তাতেই ভেঙে পড়বে জেলখানার দেওয়াল। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে!

তারপরেই গান, ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে–’।

সূর্য দিন তিনেক পর পর গিয়েছিল ডাক্তারের বাড়িতে। তারপর সরে পড়ল। অন্য দলে আত্মগোপন করে মিশে থাকার নির্দেশ ছিল সূর্যর ওপর, কিন্তু সূর্য এখানে সুবিধে করতে পারল না। যতক্ষণ সে থাকে, নানা জনে নানা রকম প্রশ্নে তাকে একেবারে অস্থির করে তোলে। ডাক্তারের স্ত্রীর বিশেষ স্নেহ জন্মেছিল সূর্যর ওপর, তিনি এই অদ্ভুত প্রকৃতির ছেলেটির সমস্ত কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান। কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে হরেক রকম মিথ্যে কথা বলার ক্ষমতা সূর্যর নেই। সে বরং খুব সহজেই রুক্ষ ব্যবহার করতে পারে–কিন্তু একজন বর্ষিয়সী নিরীহ করুণাময়ী মহিলার সামনে সে রুক্ষতা বা মিথ্যাচার কোনওটাতেই সুবিধে করতে পারে না। সুতরাং সে গা-ঢাকা দেয়।

উপেন সামন্তর বাড়িতে সে বরং অনেক স্বস্তি বোধ করে। এখানে সে পরিবারের একজন হয়ে গেছে। সারা দিন মাঠের কাজ করে, পুকুরে দাপাদাপি করে সাঁতরায়, বাড়ির খেত থেকে তুলে আনা বেগুন পুড়িয়ে মোটা চালের ভাত ও ডালের সঙ্গে মেখে

সন্ধ্যাবেলা সে মুদির দোকানটার সামনে এসে বসে বসে গল্প বলে, ইতিহাসের গল্প। সিরাজউদ্দৌল্লার আমল থেকে শুরু করে। বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা তার নেই, টুকরো টুকরো ভাবে গল্প সে বলতে পারে। কয়েক দিন এদের কথা শুনেই বুঝেছে যে সাহেবদের সম্পর্কে এইসব মানুষদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও ভীতির ভাব রয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সম্পর্কেও কারওর কোনও ধারণা নেই, অনেকে অস্পষ্ট ভাবে শুনেছে যে কোথায় যেন কী একটা যুদ্ধ চলছে–সেটাও সাহেবে সাহেবে লড়াই–সেই যুদ্ধ বেশি ধুন্ধুমার হলেই পৃথিবীতে প্রলয়কাল এসে যাবে। ইতিমধ্যে একবার প্রলয়ের গুজবে এক রাত কেউ ঘুমোয়নি।

সূর্যর গল্প তারা হাঁ করে শোনে। চোখে অবিশ্বাস ও আতঙ্ক ফুটে থাকে। সিরাজউদ্দৌলার তাড়ায় একবার সাহেবরা কলকাতা ছেড়ে জাহাজে করে পালিয়েছিল–এ কাহিনী শুনে পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়, হুঁকোয় টান দিতে ভুলে যায়। একজন বৃদ্ধ সকলের মুখপাত্র হয়ে বলে, এ কী বলছ তুমি দাদা! শাস্ত্রে আছে কল্কি অবতার হবেন পীত রঙের। সাহেবরা কি পীত রঙের নয়? ওদের মধ্যেই আছেন কল্কি। অবতার–

সূর্য শাস্ত্রের খবর রাখে না। সে আস্তে আস্তে বলে, সাহেবরা এক হয়ে কাজ করতে জানে, আমরা জানি না। নইলে আমরা এ-দেশের তেত্রিশ কোটি লোক যদি সবাই মিলে একটা হাতের ধাক্কা দিই তা হলেই সব ক’টা ইংরেজ সমুদ্রে ডুবে মরতে পারে।

বৃদ্ধটি অদ্ভুত চোখে সূর্যর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে আসর ছেড়ে উঠে চলে যায়। সূর্য তবু হাল ছাড়ে না। অন্যদের আবার বোঝাবার চেষ্টা করে। এই লোকগুলোকে কিছুটা হাতে রাখা দরকার। আসল লড়াইয়ের সময় যে এদের কাছ থেকে খুব একটা সাহায্য পাওয়া যাবে, সূর্য সে রকম আশা করে না। কিন্তু এদের অন্তত নিরপেক্ষ করা দরকার। এর আগে অনেক বার দেখা গেছে যে পুলিশের তাড়া খেয়ে বিপ্লবীরা যখন পালাতে চেষ্টা করে, তখন সাধারণ গ্রামবাসীরাই তাদের ধরে ফেলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

মাঝে মাঝে তমোনাশ ডাক্তারের দলের ছেলেরা তাকে ডাকতে আসে। কখনও তাদের সঙ্গে থাকে ডাক্তারের নিজের লেখা চিঠি-সূর্য নানা ছুতো করে কাটিয়ে দেয়।

তার আর একটি কাজ লক্ষ্মী আর অন্নপূর্ণাকে লেখাপড়া শেখানো। প্রথমে এটা হাসিঠাট্টার ব্যাপার ছিল, ক্রমশ তারা মনোযোগী হয়। সূর্য দেখে, এদের সহজাত বুদ্ধি অন্য কারওর থেকে কম নয়, লেখাপড়ার সুযোগ পেলে এরা যে-কোনও শহরের মেয়ের মতনই শিখতে পারত।

বড় মেয়েটি, যার নাম লক্ষ্মী, তার গায়ের রং পুকুরের শ্যাওলার মতন। চামড়ায় মসৃণতা আছে। তার টানা টানা বড় বড় দুটি চোখ হঠাৎ শহরে আনলে বোকা বোকাই মনে হবে কিন্তু সেই প্রান্তর-মধ্যবর্তী মাটির বাড়ির আঙিনায় তারাময় আকাশের নীচে সেই চোখ স্নিগ্ধ সরল মনে হয়। সূর্যর সৌন্দর্যপিপাসু দৃষ্টি ওর মধ্যেই অনেকখানি রূপ আবিষ্কার করে ফেলে এবং রাত্তিরবেলা পুকুরে আঁচাতে যাবার সময় সে যখন লক্ষ্মীর পিঠে হাত রেখে হঠাৎ বলে, তোমাকে খুব সুন্দর দেখতে–তখন আসলে সে কোনও মিথ্যে কথা বলে না। সেই রাত্রি, ঝিঁঝির ডাক ও নিমপাতার হাওয়ার মধ্যে এক পঞ্চদশ বর্ষীয়া গ্রাম্য কিশোরী মুহূর্তে অপরূপা হয়ে উঠতে পারে। এ-মুহূর্তটির আলাদা কোনও মূল্য অনেকেই দেয় না, কেউ কেউ দেয়। লক্ষ্মীর ছোট্ট জীবনে এ রকম কথা কেউ কখনও বলেনি, বিশেষত তাদের বাড়িতে যে ছদ্মবেশী রাজকুমারটি অতিথি হয়ে আছে, তার মুখে এই কথা শুনে সে কেঁপে ওঠে লজ্জায়, এক ছুটে পালিয়ে যায় পুকুরঘাটে।

সূর্যর আচমকা মনে পড়ে যায় শ্রীলেখার কথা। ক্রুদ্ধ অজগরের মতন সে এদিক-ওদিকে তাকায়, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ে। এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়ায়, যেন তার পা মাটিতে গেঁথে গেছে। এই নির্জন গ্রাম্য নিশীথে একবার শ্রীলেখার নাম ধরে প্রচণ্ড ভাবে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে তার। শ্রীলেখা তাকে বড় দুঃখ দিয়ে গেছে। সূর্যর হাতে এখন অনেক কাজ, তার মধ্যে হরকুমারের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাই অগ্রগণ্য; নইলে সে শ্রীলেখাকে অত সহজে ছেড়ে দিত না।

একদিন সন্ধ্যা থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল, মাঝ রাতে চেপে বৃষ্টি এল। সূর্য যে-ঘরে শোয়, সে-ঘরের চাল দিয়ে টিপটিপ করে জল পড়ে। সূর্য প্রথম কয়েক বার বিছানাটা এদিক-ওদিক টেনে সরিয়ে নেয়। তারপর দেখা গেল, কোনও দিকেই নিষ্কৃতি নেই। তখন সে সমুদ্রে শয্যা পাতার মতন মনোভাব নিয়ে বিছানাটা ঘরের মাঝখানে রেখেই শুয়ে পড়ে হাত-পা ছড়িয়ে। পাশের গোয়ালঘরের গোরুটাও ভিজছে, তার ঘন ঘন গা ঝটপটানির শব্দ শোনা যায়।

এই সময় দরজার ঝাঁপ ঠেলে লক্ষ্মী ঢুকল ঘরে। নিবিড় বিস্ময়ে বলল, আপনি কি এই জলের মধ্যে শুয়ে আছেন?

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। সেই আলোয় ঝলসে উঠল লক্ষ্মীর মুখউদ্বেগ-মাখা দুটি চোখ, চিবুক দিয়ে জল ঝরছে, যেন নদীর স্রোতে ভেসে-আসা একটা নাম না জানা-ফুল। সূর্য একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। এই আর একটি মুহূর্ত।

বিনা বাক্যব্যয়ে সূর্য বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে লক্ষ্মীর কাঁধ দুটো চেপে ধরল। জিজ্ঞেস করল, এত রাত্তিরে তুমি এসেছ কেন? ঘুম ভেঙে গেল?

লক্ষ্মীর বিয়ের কথাবার্তা চলছে, তার সারা শরীরে লজ্জা। অবনত মুখে বলল, আমি জেগেই ছিলাম, ঘুম আসেনি।

সূর্য লক্ষ্মীর বুকের কাছে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে টান মারতে যাচ্ছিল।

এখন পৃথিবীর কোনও শক্তি তাকে থামাতে পারবে না। এই বৃষ্টির নেশাভরা রাত্রে একটি মেয়েকে নিরালায় দেখলে একটি মাত্র চিন্তাই তার মনে আসে। তার রক্তের গতিবেগ বেড়ে যায়। কিন্তু আর একবার বিদ্যুৎ ঝলকে লক্ষ্মীর মুখের দিকে তাকাতেই সূর্য থমকে গেল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত সরিয়ে নিল। এও আর একটা মুহূর্ত। সূর্যর মনে হল, মুখটি বড় অসহায়। এই মেয়েটি সূর্যকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে–এই স্বপ্ন ভেঙে যাবার যাতনা যে কত মর্মান্তিক তা ও জানে না।

সূর্য তাকে ধমক দিয়ে বলল, তুমি ঘরে যাও। আমি ঠিক থাকতে পারব।

সূর্যর সারা জীবনে এই একবার মাত্র সংযমের পরিচয়। সে দিকবিদিক চিন্তা করে না, ভবিষ্যতে কখনও আর সে এ রকম দুর্বলতার পরিচয় দেয়নি। লক্ষ্মীকে কেন সে ছেড়ে দিল তা সে নিজেই জানে না।

লক্ষ্মী তাকে কিছুতেই ওই চালাফুটো ঘরে থাকতে দিল না, জোর করে নিয়ে এল তাদের ঘরের বারান্দায়। এর দু’দিক খোলা হলেও মাথার ওপর দিয়ে জল পড়ে না পাশ দিয়ে ঝাঁপটা আসে শুধু। সেইখানেই বিছানা পেতে দিল সূর্যর জন্য। বার বার বিছানাপত্র নিয়ে আসার জন্য উঠোন দিয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে নিজেই বেচারা ভিজে গেল একেবারে। কিন্তু সূর্যর জন্য কিছু একটা করতে পারায় তার জীবন যেন ধন্য। সূর্য শুয়ে শুয়ে সারা রাত ভাবতে লাগল শ্রীলেখার কথা। সে শুনেছে, শ্রীলেখার শ্বশুরবাড়ি খড়্গপুরে। সময় পেলে সে সারা খড়্গপুর শহরটা একবার চষে বেড়াবে।

পরদিন তমোনাশ ডাক্তার নিজেই এলেন এ বাড়িতে। সূর্যকে ডেকে চোখগরম করে রাগত সুরে বললেন, আমি আসতে চাইনি। আমার ইস্ত্রি জোর করে পাঠালেন। তেনার ধারণা, তুমি রাগ করে নিজের বাড়ি থেকে চলে এসেছ। এখানে বেঘোরে মরবে, তাই তোমাকে সাবধান করে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।

উপেন শঙ্কিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, কেন ডাক্তারবাবু, কী হয়েছে? আমার দাদাটি কোনও অপরাধ করেছেন?

তমোনাশ ডাক্তার বললেন, কোথায় কী করে এসেছেন সে জানার আমার দরকার নেই। এদের আমি ভালো করেই চিনি। গোঁয়ার ডোকরা যত সব। এই একজনের জন্য। কি গ্রামসুষ্ঠু লোক বিপদে পড়তে চাও?

কেন? কেন?

পুলিশ একে ধরতে আসছে, পাকা খবর। আজই ও-বেলায় এসে পড়বে। তারপর পুলিশ কি তোমাকে ছাড়বে? বাড়ি সুষ্ঠু সবাইকে চালান করে দেবে বলে দিচ্ছি।

কেন, ইনি কী করেছেন?

জানো না? এ তো খুনে আর ডাকাতের দলের লোক। স্বদেশি করার নাম করে এইসব করে। আমি এত করে বললাম আমাদের পথে আসতে।

সূর্য বলল, আপনি আমাকে এই গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চান–সেটা আলাদা কথা–কিন্তু এইসব মিথ্যে কথা বলছেন কেন এঁদের।

শোনো ছোকরা! এসব আমি বলিনি, পুলিশের রিপোর্ট। পুলিশ তোমাকে শুধু সন্দেহ করে ধরছে নাবড় বাঁকিতে যে ডাকাতি হয়েছিল, তার সঙ্গে তোমার নাম জড়িয়েছে। মহকুমা থানায় আমাদের ইনফর্মার আছে, সে পাকা খবর এনেছে।

এসব মিথ্যে কথা।

সত্যি মিথ্যে আমি জানি না। তোমার দলের কে নাকি একজন ধরা পড়ে সব নাম ফঁসিয়ে দিয়েছে।

সূর্য দ্রুত চিন্তা করতে লাগল কে ধরা পড়েছে। ঠিক বুঝতে পারল না। ব্রজগোপালের পক্ষে ধরা পড়া অসম্ভব–তার আগে তিনি আত্মহত্যা করবেন। তা হলে কে?

তমোনাশ ডাক্তার এবার সুর নামালেন। সূর্যর মুখের দিকে অবিচল দৃষ্টি ফেলে বললেন, এই বয়স, এর মধ্যেই পুলিশের হাতে পড়লে একেবারে ছিবড়ে করে দেবে। আমার একটা কথা শুনবে?

বলুন।

এক্ষুনি জিনিসপত্তর গুছিয়ে নাও। আমার সঙ্গে চলো। আমার এক ভায়রা থাকে রাজগিরে–সেখানে তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখানে বিশেষ জনমনিষ্যি নেই, কেউ তোমার খোঁজ করবে না, তার কোয়ার্টারে থাকবে-বছর খানেক ডুব মেরে থাকো। আমার ভায়রা ভালো লোক–সে যত্ন করে রাখবে।

সূর্য একটুক্ষণ মাত্র চিন্তা করল। ব্রজগোপালকে কোনও খবর না দিয়ে সে কি এখান থেকে চলে যেতে পারে? দলের সবাই রয়েছে গোপনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে–সূর্য যদি হঠাৎ চলে যায় তা হলে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। সবাই কি ভাববে না যে, সে ভয় পেয়ে পালিয়েছে? বরং জেলে যাওয়ার চিন্তা তার মধ্যে খানিকটা উত্তেজনা জাগায়। জেলখানার অনেক গল্প সে শুনেছে–ভেতরটা কখনও দেখেনি।

মুখ তুলে সে বলল, না, আমার যাওয়া হবে না।

তারপর আধঘণ্টা ধরে তাকে বোঝানোর চেষ্টা হল। তমোনাশ আর উপেন তো সূর্যকে বেশি দিন ধরে চেনেন না–সুতরাং বুঝবেন কী করে যে এ-ছেলে একবার না বললে আবার হা বলানো কত শক্ত।

সূর্য জিদ ধরে রইল, সে এখান থেকে যাবে না। সে বরং গাঁয়ের বটতলায় বসে থাকবে; সেখানে পুলিশ এসে তাকে ধরে তো ধরুক। তা হলেও তার দলের লোক তার সন্ধান পাবে।

শেষ পর্যন্ত উপেন বলল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, মুর্শিদের চর? সেখানে ওনাকে রাখা যাবে না?

ডাক্তার একটুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, সেখানে ও থাকতে পারবে? খুব সাপখোপের উপদ্রব।

তা বলে কি এনাকে পুলিশের হাতে দেওয়া যায়?

ডাক্তার কম্পিত গলায় বললেন, এরা বেঘোরেই মরতে চায়। তুমি আমি কী করব বলো?

একখানা মাঠ ও খানিকটা জঙ্গল পেরিয়ে সূর্যকে তক্ষুনি নিয়ে যাওয়া হল মুর্শিদের চরে। অনেকখানি জলা জায়গার মধ্যে কিছুটা অংশ উঁচু হয়ে আছে, শর আর নলখাগড়ার। ঝাড় চতুর্দিকে। মাঝে মাঝে গর্ত ও কেঁচোর মাটি তোলা। দুটি ছাতিম গাছ পাশাপাশি। দুই বন্ধুর মতন দাঁড়িয়ে। তার নীচে চারটা খুঁটির ওপর খড়ের চালা, কোনও দেওয়াল নেই। মনে হয়, এইখানে আগে কখনও কেউ থেকেছে। সেইখানে একটা শতরঞ্চি ও বালিশ পেতে দেওয়া হল। উপেন বলল, পুলিশের বাপের সাধ্য নেই, আপনাকে এখান থেকে খুঁজে বার করে। থাকতে পারবেন তো দাদা?

সূর্য ঘাড় নেড়ে বলল, ঠিক আছে। আপনি আমাকে মাঝে মাঝে খবর দিয়ে যাবেন। ব্রজগোপালদা যদি আসেন–

উপেন বলল, মাঝে মাঝে মানে? আমি রোজ আসব। আপনার খাবার নিয়ে আমাকে আসতে হবে না?

উপেন চলে যাবার পর সূর্য কোমর থেকে রিভলবারটা বার করে হাতে নিয়ে জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *