চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২রা অক্টোবর
পূর্বকথা — লক্ষ্মীনারায়ণের দশ হাজার টাকা দিবার কথায় শ্রীরামকৃষ্ণের অচৈতন্য হওয়া — সন্ন্যাসীর কঠিন নিয়ম
শ্রীরামকৃষ্ণ (মারোয়াড়ীর প্রতি) — ত্যাগীর বড় কঠিন নিয়ম। কামিনী-কাঞ্চনের সংস্রব লেশমাত্রও থাকবে না। টাকা নিজের হাতে তো লবে না, — আবার কাছেও রাখতে দেবে না।
“লক্ষ্মীনারায়ণ মারোয়াড়ী, বেদান্তবাদী, এখানে প্রায় আসত। বিছানা ময়লা দেখে বললে, আমি দশ হাজার টাকা লিখে দোব, তার সুদে তোমার সেবা চলবে।
“যাই ও-কথা বললে অমনি যেন লাঠি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম!
“চৈতন্য হবার পর তাকে বললাম, তুমি অমন কথা যদি আর মুখে বলো, তা হলে এখানে আর এসো না। আমার টাকা ছোঁবার জো নাই, কাছেও রাখবার জো নাই।
“সে ভারী সূক্ষ্মবুদ্ধি, — বললে, ‘তাহলে এখনও আপনার ত্যাজ্য, গ্রাহ্য আছে। তবে আপনার জ্ঞান হয় নাই।”
“লক্ষ্মীনারায়ণ তখন হৃদের কাছে দিতে চাইলে, আমি বললাম, তাহলে আমায় বলতে হবে ‘একে দে, ওকে দে’; না দিলে রাগ হবে! টাকা কাছে থাকাই খারাপ! সে-সব হবে না!
“আরশির কাছে জিনিস থাকলে প্রতিবিম্ব হবে না?
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও মুক্তিতত্ত্ব — “কলিতে বেদমত নয় পুরাণমত” ]
মারোয়াড়ী ভক্ত — মহারাজ, গঙ্গায় শরীরত্যাগ করলে তবে মুক্তি হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞান হলেই মুক্তি। যেখানেই থাকো — ভাগাড়েই মৃত্যু হোক, আর গঙ্গাতীরেই মৃত্যু হোক জ্ঞানীর মুক্তি হবে।
“তবে অজ্ঞানের পক্ষে গঙ্গাতীর।”
মারোয়াড়ী ভক্ত — মহারাজ কাশীতে মুক্তি হয় কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কাশীতে মৃত্যু হলে শিব সাক্ষাৎকার হন। — হয়ে বলেন, আমার এই যে সাকার রূপ এ মায়িক রূপ — ভক্তের জন্য এই রূপ ধারণ করি, — এই দেখ্, অখণ্ড সচ্চিদানন্দে মিলিয়ে যাই! এই বলে সে রূপ অন্তর্ধান হয়!
“পুরাণমতে চণ্ডালেরও যদি ভক্তি হয়, তার মুক্তি হবে। এ মতে নাম করলেই হয়। যাগযজ্ঞ, তন্ত্রমন্ত্র — এ-সব দরকার নাই।
“বেদমত আলাদা। ব্রাহ্মণ না হলে মুক্তি হয় না। আবার ঠিক মন্ত্র উচ্চারণ না হলে পূজা গ্রহণ হয় না। যাগযজ্ঞ, মন্ত্রতন্ত্র — সব বিধি অনুসারে করতে হবে।”
[কর্মযোগ বড় কঠিন — কলিতে ভক্তিযোগ ]
“কলিকালে বেদোক্ত কর্ম করবার সময় কই?
“তাই কলিতে নারদীয় ভক্তি।
“কর্মযোগ বড় কঠিন। নিষ্কাম না করতে পারলে বন্ধনের কারণ হয়। তাতে আবার অন্নগত প্রাণ — সব কর্ম বিধি অনুসারে করবার সময় নাই। দশমূল পাঁচন খেতে গেলে রোগীর এদিকে হয়ে যায়। তাই ফিভার মিক্শ্চার।
“নারদীয় ভক্তি — তাঁর নামগুনকীর্তন করা।
“কলিতে কর্মযোগ ঠিক নয়, — ভক্তিই ঠিক।
“সংসারে কর্ম যতদিন ভোগ আছে করো। কিন্তু ভক্তি অনুরাগ চাই। তাঁর নামগুণকীর্তন করলে কর্মক্ষয় হবে।
“কর্ম চিরকাল করতে হয় না। তাঁতে যত শুদ্ধাভক্তি-ভালবাসা হবে, ততই কর্ম কমবে। তাঁকে লাভ করলে কর্মত্যাগ হয়। গৃহস্থের বউ-এর পেটে ছেলে হলে শাশুড়ী কর্ম কমিয়ে দেয়। সন্তান হলে আর কর্ম করতে হয় না।”
[সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম — সংস্কার থাকলে ঈশ্বরের জন্য ব্যাকুলতা হয় ]
দক্ষিণেশ্বর গ্রাম হইতে কতকগুলি ছোকরা আসিয়া প্রণাম করিলেন। তাঁহারা আসন গ্রহণ করিয়া ঠাকুরকে প্রশ্ন করিতেছেন। বেলা ৪টা হইবে।
দক্ষিণেশ্বরনিবাসী ছোকরা — মহাশয়, জ্ঞান কাকে বলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — ঈশ্বর সৎ, আর সমস্ত ব্রহ্ম অসৎ; এইটি জানার নাম জ্ঞান।
“যিনি সৎ তাঁর একটি নাম ব্রহ্ম, আর একটি নাম কাল (মহাকাল) । তাই বলে ‘কালে কত গেল — কত হলো রে ভাই!’
“ ‘কালী’ যিনি কালের সহিত রমণ করেন। আদ্যাশক্তি। কাল ও কালী, ব্রহ্ম — ব্রহ্ম ও শক্তি — অভেদ।
“সেই সৎরূপ ব্রহ্ম নিত্য — তিনকালেই আছেন — আদি অন্তরহিত। তাঁকে মুখে বর্ণনা করা যায় না। হদ্দ বলা যায়, — তিনি চৈতন্যস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ।
“জগৎ অনিত্য, তিনিই নিত্য! জগৎ ভেলকিস্বরূপ। বাজিকরই সত্য। বাজিকরের ভেলকি অনিত্য।”
ছোকরা — জগৎ যদি মায়া — ভেলকি — এ মায়া যায় না কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ — সংস্কার-দোষে মায়া যায় না। অনেক জন্ম এই মায়ার সংসারে থেকে থেকে মায়াকে সত্য বলে বোধ হয়।
“সংস্কারের কত ক্ষমতা শোন। একজন রাজার ছেলে পূর্বজন্মে ধোপার ঘরে জন্মেছিল। রাজার ছেলে হয়ে যখন খেলা করছে, তখন সমবয়সীদের বলছে, ও-সব খেলা থাক! আমি উপুড় হয়ে শুই, আর তোরা আমার পিঠে হুস্ হুস্ করে কাপড় কাচ।
[সংস্কারবান গোবিন্দ পাল, গোপাল সেন, নিরঞ্জন, হীরানন্দ — পূর্বকথা — গোবিন্দ, গোপাল ও
ঠাকুরদের ছেলেদের আগমন — ১৮৬৩-৬৪ ]
“এখানে অনেক ছোকরা আসে, — কিন্তু কেউ কেউ ঈশ্বরের জন্য ব্যকুল। তারা সংস্কার নিয়ে এসেছে।
“সে-সব ছোকরা বিবাহের কথায় অ্যাঁ, অ্যাঁ করে! বিবাহের কথা মনেই করে না! নিরঞ্জন ছেলেবেলা থেকে বলে, বিয়ে করব না।
“অনেকদিন হল (কুড়ি বছরের অধিক) বরাহনগর থেকে দুটি ছোকরা আসত। একজনের নাম গোবিন্দ পাল আর-একজনের নাম গোপাল সেন। তাদের ছেলেবেলা থেকেই ঈশ্বরেতে মন। বিবাহের কথায় ভয়ে আকুল হত। গোপালের ভাবসমাধি হত! বিষয়ী দেখলে কুণ্ঠিত হত; যেমন ইন্দুর বিড়াল দেখে কুণ্ঠিত হয়। যখন ঠাকুরদের (Tagore) ছেলেরা ওই বাগানে বেড়াতে এসেছিল, তখন কুঠির ঘরের দ্বার বন্ধ করলে, পাছে তাদের সঙ্গে কথা কইতে হয়।
“গোপালের পঞ্চবটীতলায় ভাব হয়েছিল। ভাবে আমার পায়ে হাত দিয়ে বলে, ‘আমি তবে যাই। আমি আর এ সংসারে থাকতে পারছি না — আপনার এখন অনেক দেরি — আমি যাই।’ আমিও ভাবাবস্থায় বললাম — Change this in doc ‘আবার আসবে’। সে বললে — ‘আচ্ছা, আবার আসব।’
“কিছুদিন পরে গোবিন্দ এসে দেখা করলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, গোপাল কই? সে বললে, গোপাল (শরীরত্যাগ করে) চলে গেছে।
“অন্য ছোকরারা কি করে বেড়াচ্ছে! — কিসে টাকা হয় — বাড়ি — গাড়ি — পোশাক, তারপর বিবাহ — এইজন্য ব্যস্ত হয়ে বেড়ায়। বিবাহ করবে, — আগে কেমন মেয়ে খোঁজ নেয়। আবার সুন্দর কি না, নিজে দেখতে যায়!
“একজন আমায় বড় নিন্দে করে। কেবল বলে, ছোকরাদের ভালবাসি। যাদের সংস্কার আছে — শুদ্ধ আত্মা, ঈশ্বরের জন্য ব্যকুল, — টাকা, শরীরের সুখ এ-সবের দিকে মন নাই — তাদেরই আমি ভালবাসি।
“যারা বিয়ে করেছে, যদি ঈশ্বরে ভক্তি থাকে, তাহলে সংসারে আসক্ত হবে না। হীরানন্দ বিয়ে করেছে। তা হোক সে বেশি আসক্ত হবে না।”
হীরানন্দ সিন্ধুদেশবাসী, বি.এ.পাস, ব্রাহ্মভক্ত।
মণিলাল, শিবপুরের ব্রাহ্মভক্ত, মারোয়াড়ী ভক্তেরা ও ছোকরারা প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।