1 of 3

৩৪. প্রিয় ঋতু

৩৪

স্কুলে এবং কলেজে বরাবর পরীক্ষায় সে একটা রচনার জন্য অপেক্ষা করেছে। তোমার প্রিয় ঋতু। রচনাটা কোনওকালেই আসেনি, এলে মণীশ যা লিখত তাতে নম্বর পাওয়া যেত কিনা তা সে জানে না, তবে একটা পুরো খাতা বোধ হয় শেষ করে ফেলত রচনা দিয়েই। শরৎকাল তাকে পাগল করে দেয়, যৌবন ফিরিয়ে আনে, শৈশব এসে হাত ধরে। লোকে বসন্তের গুণগান যে কেন করে তা বুঝে উঠতে পারে না সে। কালিদাসও করেছিল। আচ্ছা ছানিপড়া চোখ বাবা, এমন শরৎ ঋতুর কাছে কি বসন্ত লাগে? বসন্তের বিরুদ্ধে তার কোনও নালিশ নেই। কিন্তু শরৎ সবার উর্ধ্বে। চির শরতের কোনও দেশ থাকলে মণীশ সেখানকার সিটিজেনশীপ নিয়ে ফেলত।

আজ যখন তার দুই মেয়ে আর এক ছেলের মা অপর্ণা সকালবেলায় জানালা খুলে দিল তখন ঘুমচোখ বুজে থেকেই সে অনুভব করতে পারল শরৎ ঋতুকে।

অপু!

বলো।

আমি যেন শরৎ ঋতুতে মরি।

মা গো! সকালে উঠেই মরণের কথা মুখে এল? তুমি কী গো?

মণীশ উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। ডাকল, অপু, আমার কাছে এসো, এখানে দাঁড়াও।

অপর্ণা বিছানাটা দ্রুত হাতে পাট করছিল। বলল, আসছি।

এক্ষুনি।

অপর্ণা এল। পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল, কী গো?

এই শরৎকালকে কেমন লাগে বলো তো তোমার?

আহা, কেমন আবার লাগবে! আমি কি তোমার মতো ভাবের মানুষ? ঋতু কোথা দিয়ে চলে যায় টেরই পাই না।

বেশ বেরসিক আছে কিন্তু। পৃথিবীটাকে কেন অনুভব করো না বলল তো?

আমাকে অনুভব করার মতো অবস্থায় রেখেছে কিনা! যা খেলা দেখালে কয়েকদিন। ভয়ে আধমরা হয়ে ছিলাম।

তুমি এখনও শকটা কাটিয়ে উঠতে পারোনি, না? কেন অপু? বিপদ-আপদ তো আসতেই পারে।

তুমি তো জানো না, তুমি কতখানি জুড়ে আছে আমার ভিতরটা। আমাদের তুমি ছাড়া আর কী আছে বলো।

মণীশ হাসল, বলল, এটা তো ভালবাসার কথাই অপু। কিন্তু একটু স্বার্থপরতার গন্ধ আছে তোমার জগতে মোট চারজন লোক। আমি, বুবকা, ঝুমকি আর অনু। তার বাইরে আর কেউ নেই, না?

একটু গম্ভীর হতে গিয়েও অপর্ণা হাসল, এই বুঝি আমাকে চিনেছো? তুমি কি ভাবো আমি আর কারও জন্য চিন্তা করি না?

করো? তাহলে তোমার ভালবাসার একটু কণা আজ এই শরৎ ঋতুকেও দাও। কলকাতায় প্রকৃতি নেই, তবু দেখ, রোদে কী এক অদ্ভুত সোনার মতো রং। আকাশ কী রকম অলৌকিক নীল!

অপর্ণা মুখ তুলে দীর্ঘকায় মণীশের দিকে চেয়ে বলে, প্রকৃতি দেখতে চাও? তাহলে চলো রবিবার আমাদের জমিটা দেখে আসি। কত গাছপালা আপনা থেকেই হয়েছে। আমার লাগানো গাছগুলো কুটিপাটি হচ্ছে ফুলে। চুরি হয়ে হয়েও রাশি রাশি শিউলি ফুল ছড়িয়ে থাকে ঘাসে।

ওঃ, তোমার সেই কৃপণের চার কাঠা জমি?

মোটেই কৃপণের জমি নয়। সস্তায় কিনেছি বলে কি দোষ হয়েছে? একদিন দেখো ওই চার কাঠার কী দাম হয়।

তোমাকে নিয়ে আর পারি না। সব জিনিসেরই দামটাই কেন তোমার মনে আসে? এই যে শরতের দারুণ মোহময় একটা সকাল এর কি কোনও দাম হয়?

তোমার হল ফটোগ্রাফারের চোখ। তোমার মতো করে কি সব কিছু আমি দেখতে পাই?

না অপু, এই যে আলোটা, এই যে চারদিকের বাতাবরণে একটা ম্যাজিক্যাল চেঞ্জ, কোনও ফটোগ্রাফারের সাধ্য নেই তা ছবিতে ফুটিয়ে তোলে। কোনও মহৎ শিল্পীও পারে না, কবিও পারে না, কেউ পারে না। যে পারে সে ওই প্রকৃতি। তার মতো আর্টিস্ট আর কে আছে বলো!

একটা পাগলকে নিয়ে আমার ঘর। উঃ, শরৎকাল আমারও ভাল লাগে বাপু, তা বলে তোমার মতো পাগল হয়ে যাই না।

কেন হও না অপু? কিছুতেই কেন কখনও তুমি পাগল হও না?

অপর্ণা হেসে ফেলল, বলল, বাড়িতে একটা পাগলই কি যথেষ্ট নয়? পাগল বাড়লে সংসারটা কি চলবে? তবে ভেবো না, তোমার পাগলামির অনেকটাই তোমার ছেলেমেয়েরাও পেয়েছে।

খুব ভাল অপু। সবাই মিলে তোমাকেও একটু পাগল করব এবার থেকে।

করতে হবে না। পাগল হতে আর বাকিই বা কী? শোনো, আজ অফিসে জয়েন করবে মনে রেখো, নটা পনেরোতে পুল কার চলে আসবে। তৈরি হতে থাকো। বাথরুমে ঢুকলে তো চল্লিশ মিনিট।

মণীশ হতাশায় মাথা নেড়ে বলে, নাঃ, তোমাকে পাগল করা যাবে না অপু। ইউ আর এ স্টাবোর্ন পারসন।

মণীশ বাথরুমে গেল।

অপর্ণা ধীর পায়ে মণীশের ঘর ছেড়ে ঢুকল বুবকার ঘরে। ছেলেটা পাশ-বালিশ আঁকড়ে ধরে গভীর ঘুমে ঢলে আছে। মাথাটা বালিশ থেকে পড়ে গেছে নিচে। অপর্ণা ছেলের ঘুমন্ত মুখের দিকে একটু চেয়ে থাকে। ওপরের ঠোঁটের সীমানায় কোমল গোঁফ। গালে সামান্য দাড়ি, এখনও শেভ করতে শুরু করেনি। এবার করবে। আদরের কোলের ছেলেটা বড় হল। হোক। অপর্ণার চিন্তা অন্য জায়গায়। বোকা ছেলেটা স্কুলের বাইরে সেদিন মারপিট করে এসেছে। ড্রাগ বিক্রি করে যারা তাদের সঙ্গে। এ সব কি ভাল? আপাই বা কেন ওসব ষণ্ডাগুণ্ডাদের পিছনে লাগতে গিয়েছিল? যদি এবার তারা উল্টে মারে? যদি মেরেই ফেলে? অপর্ণার জীবনে এইসব কারণেই কোনও শান্তি নেই।

ঘটনাটা সে মণীশকে বলেনি। মণীশ আকণ্ঠ ভালবাসে ছেলেকে। শুনলে টেনশন হবে।

বুবকাকে খুব বকেছিল অপর্ণা সব শুনে। বুবকা তাকে এখনও সব কথা বলে। বকুনির পর বুবকা অবোধ শিশুর মতো জিজ্ঞেস করল, তাহলে কি করা উচিত ছিল মা? আপাকে ওরা যে মারছিল! আমার কি চুপচাপ চলে আসা ভাল হত?

অপর্ণা এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে পারেনি। শুধু বলেছিল, তোমাদের উচিত ছিল আপাকে জোর করে আটকানো, ওর এত সাহস কেন?

সাহসের জন্যই তো আপা হল আপা। আমরা কেউ আপার মতো নই কেন মা?

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে অপর্ণা বলল, আজকাল দিন ভাল নয় বাবা, গুণ্ডারা বোমা মারে, পিস্তল চালায়, ছোরা বসিয়ে দেয়। আমি বড় ভয় পাই, তুই বরং ওই ইস্কুল ছেড়ে দে।

তুমি একদম পাগলী আছে। স্কুল ছাড়ব কেন? আমরাও পাল্টা গুণ্ডামি করব।

অপর্ণা অবাক হয়ে বলে, গুণ্ডামি করবি? ও কথা বলতে আছে?

ভেবে দেখেছি মা, গুণ্ডামি ছাড়া কিছু করার নেই। আমরা অলরেডি স্কুলে একটা প্রতিরোধ বাহিনী তৈরি করেছি।

আতঙ্কিত অপর্ণা বলল, না বাবা, না। তুমি ওসবের মধ্যে থেকো না। আমি আপাকেও বলব তো। ও কেন এই গণ্ডগোল পাকাল!

আপা কিছু খারাপ তো করেনি মা!

করেছে। ও তুমি বুঝবে না। ওকে আসতে বলিস তো!

বুবকা হাসল, আপা আমাদের সঙ্গে রাগ করে কথাই বলে না। ও বলছে আমরা নাকি ওর মিশনটাই নষ্ট করে দিয়েছি। আপাটা একটা ভূত।

কিছুক্ষণ বুবকার শান্ত মুখখানার দিকে চেয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এল অপর্ণা। অনেক কাজ। মণীশ আজ প্রথম অফিসে যাচ্ছে দীর্ঘ ছুটির পর।

মণীশ স্নান করে যখন তৈরি হয়ে এসে টেবিলে বসল তখন তাকে খাবার বেড়ে দিতে দিতে অপর্ণা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, আপা মেয়েটাকে তোমার কেমন লাগে বলো তো!

আপা! শী ইজ এ ক্লাস বাই হারসেল্‌ফ্‌। কেন?

এমনিই। জানো, ও নাকি ওদের স্কুলে কয়েকজন ড্রাগ অ্যাডিক্টকে ধরেছে। তাদের বাঁচাতে ড্রাগ পেডলাররা এসে আপাকে অ্যাটাক করেছিল।

মণীশ বিস্মিত মুখে বলে, সর্বনাশ! কবে?

কয়েকদিন আগে।

তারপর?

স্কুলের ছেলেরা গিয়ে পেডলারদের মেরে তাড়ায়।

দ্যাটস গুড। তাড়াল কেন? মেরে আধমরা করে পুলিশে দেওয়া উচিত ছিল। এমন কি মেরে ফেললেও ক্ষতি ছিল না। দে ডিজার্ভ ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট।

ছেলেদের দলে যে বুকাটাও ছিল।

ছিল? আই ফিল প্রাউড ফর হিম। দরকার হলে আমাকেও দলে নিতে পারে।

তুমি মারপিট করবে?

আলবাৎ। এক সময়ে আমি সেন্ট্রাল ক্যালকাটায় অলিতে গলিতে মারপিট করতাম। সিনেমা হল-এ, বাসে, ময়দানের খেলার লাইনে।

ওঃ, তাই বললা। সেইজন্যই ছেলে সেটা পেয়েছে।

কেন, তুমি কি জাননা না নাকি?

জানি। তবে মনে ছিল না।

শান্ত গৃহস্থ হয়ে গেছি সখি, কিন্তু ভিতরে এখনও আগুনটা নিবে যায়নি। খুঁচিয়ে তুললে আবার গনগনে আঁচ উঠবে।

তুমি ছেলেকে সাপোর্ট করছো?

একটু করছি। তবে আহাম্মকি বা গোঁয়ার্তুমি ভাল নয়। ড্রাগ পেডলাররা অর্গানাইজড ক্রিমিন্যালস। ওদের সঙ্গে লাগতে গেলে নিজেদেরও অর্গানাইজড হতে হবে।

শোনো, আমি বলি কি, বুবকার স্কুলটা চেঞ্জ করে দাও।

কেন বলো তো! এত ভাল স্কুল!

বিপদ হতে কতক্ষণ?

শোনো অপু, আমি কিন্তু কোনওদিন ভয়টয় পাইনি। তোমাকে উদ্ধার করেছিলাম পুলিশের গুলির মুখে দাঁড়িয়ে। মনে আছে?

ওগো, ওসব কথা ভুলে যাও। বুবকা আমার একটা মাত্র ছেলে।

বুবকা আমারও একটা মাত্র ছেলে।

তাও ওকথা বলছ?

মণীশ শান্ত গলায় বলে, ভয় পেও না অপু। পুলিশের এক বড় কর্তা আমার বিশেষ বন্ধু। তাকে আজই একবার লালবাজারে ফোন করব। আমি যখন ফ্রিল্যান্স ফটো জার্নালিস্ট ছিলাম তখন থেকে বন্ধু।

কে বলল তো!

বিনয় মিত্র। তুমি চিনবে না। নর্থ বেঙ্গলের ছেলে। স্পোর্টসম্যান ছিল। সে অ্যাকসন ভালবাসে।

উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। পুলিশ কি আজকাল কিছু করতে পারে? অর্গানাইজড ক্রাইমের কথা তো তুমিই বললে। যারা অর্গানাইজড তারা কি পুলিশকে ভয় পায়? পুলিশ তো তাদেরই লোক হয়ে যায়।

এ লোকটা পারচেজেবল নয়। অন্তত তিনচার বছর আগেও ছিল না।

দোহাই তোমার, এর মধ্যে পুলিশকে টেনে এনো না। তাহলে ভিমরুলের চাকে ঢিল মারা হবে।

মণীশ একটু হাসল। বলল, মন্দ বলোনি। আমার চেয়ে তোমার প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধি বরাবর বেশি ছিল। আচ্ছা, বুবকাকে আমি একটু সাবধান করে দেবোখন।

এখনই দাও। আমি ওকে ডাকছি।

আচ্ছা বাবা, আচ্ছা।

বুবকা এল। ঘুম-চোখে বাবার কাছটিতে এসে দাঁড়িয়ে অনেকটা শিশুর মতোই বলল, কি বাবা?

বোস। কী হয়েছে, ব্রিফলি বল তো!

ইস্কুলের ব্যাপারটা? নাথিং মাচ।

মারপিট করেছিস?

একটা লোককে হকি স্টিক দিয়ে মেরেছি।

খুব জোরে মেরেছিস?

খুব জোরে। লোকটা খোঁড়াচ্ছিল।

আমি হলে মাথায় মারতাম। অজ্ঞান করে দিতাম।

আমি এই প্রথম একজনকে মারলাম বাবা, অ্যান্ড আই এনজয়েড ইট।

আই নো। কিন্তু একটা কথা।

কী কথা বাবা?

মারপিট একবার শুরু হলে সহজে থামে না। আজ মেরেছো, কাল কিন্তু মার খেতে হবে। আর ইউ রেডি ফর দ্যাট?

হ্যাঁ বাবা। আমরা এখন স্কুলের চারদিকে নজর রাখি। দল বেঁধে বেরোই।

কখনও একা বেরোবে না।

কিন্তু টিউটোরিয়াল থাকলে? তখন তো সব বন্ধুকে পাওয়া যাবে না।

তাহলে প্রবলেম। আমি কিন্তু ভয় পাই না। মা ভয় পায়।

ভয় পাওয়া ভাল নয়। তবে বিচক্ষণ হওয়া ভাল। স্কুলের অথরিটি কী করছে?

কি করবে? তারা তো আর মারপিট হলে ঠেকাতে পারবে না।

তুই আমাকে ভাবিয়ে তুললি। মুশকিল কি জানিস, এ দেশে বাস করে কয়েক কোটি ভেড়া আর কয়েকটা বাঘ। এক লক্ষ ভেড়াও একটা বাঘ দেখলে পালায়। তোকে রাস্তায় যদি গুণ্ডারা মারে রাস্তার অন্য লোকেরা মুখ ফিরিয়ে পালাবে।

বুবকা হাসল, আমি কিন্তু ভেড়া নই।

সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তুই ভেড়ুয়া হলেই তোর মা বেশি নিশ্চিন্তে থাকতে পারত।

অপর্ণা চোখ বড় বড় করে দুজনের কথোপকথন শুনছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা, তুমি কী গো? কোথায় তোমাকে বললাম ওকে একটু বুঝিয়ে বলতে যাতে বিপদের মধ্যে না যায়, আর তুমি ওকে গুণ্ডামি করতেই উৎসাহ দিচ্ছো?

মণীশ অপর্ণার দিকে ঠাণ্ডা চোখে চেয়ে বলল, দুনিয়াটা তো ওরও। বিপদ-আপদের মধ্যেই ওকে বেঁচে থাকতে হবে। আমরা যেমন করে শেখাবো সেরকম শিখলে ওর হয়তো চলবে না। দুনিয়াটা পাল্টে যাচ্ছে অপু।

দুনিয়ার অনেক কিছু পাল্টায়, কিন্তু অনেক কিছু আবার কোনওদিনই পাল্টায় না। সেটা হল মা আর ছেলের সম্পর্ক। বুঝলে? আরও একটা জিনিস পাল্টায় না, সেটা হল গুণ্ডামি করাটা যে খারাপ সেই বোধটা।

মণীশ ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলে, ঠিক আছে বুকাবাবু, আপনি আর মারপিটের মধ্যে যাবেন না। লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবেন।

বুবকা শিশুর মতো মুখ করে মায়ের দিকে চেয়ে বলে, মা, তুমি তো দেখনি যখন গুণ্ডারা আপাকে মারছিল। যদি দেখতে তাহলে তুমিও হকি স্টিক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আপা একটা রোগা ভাল মেয়ে, তাকে ওরকম মারতে পারে কোনও মানুষ? আর কী সব খারাপ গালাগাল করছিল!

অপর্ণা আদর মাখানো গলায় বলে, আচ্ছা, তুই বল তো, আমি কি গুণ্ডাদের সাপোর্ট করছি? আপাকে মারা তো খুবই খারাপ হয়েছে। কিন্তু তোরা ওদের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠবি না। ওরা খুনে।

বুবকা ফের তার সরল মুখখানা তুলে বলল, মা, ব্যাপারটা আরও খারাপ। ওরা শুধু গুণ্ডা নয়, ওরা ছেলেদের ড্রাগ ধরিয়ে দিচ্ছে। আমাদের স্কুলের কত ছেলে ড্রাগ নিচ্ছে জানো? ওদের কি নন-ডায়োলেন্স দিয়ে ঠেকানো যায়?

অপর্ণা ঝাঁঝালো গলায় বলে, তার জন্য পুলিশ আছে। তোমাদের কী দরকার আইন হাতে নেওয়ার?

আমরা জাস্ট রেজিস্ট করছি। এটা আমাদের প্রোটেস্ট। পুলিশ যতক্ষণ না অ্যাকশন নিচ্ছে ততক্ষণ তো নিজেদের প্রোটেক্ট করতে হবে।

পুলিশ কি অ্যাকশন নেয়নি?

নিয়েছে। পরশু থেকে দেখছি, পুলিশ পোস্টিং হয়েছে। কয়েকজনকে আশপাশের গলি থেকে ধরে নিয়ে গেছে।

তাহলে?

তাহলে কী মা? প্রিন্সিপালকে কারা যেন ফোন করে ভয় দেখাচ্ছে, পুলিশ কেস উইথড্র করতে বলছে।

অপর্ণা কাঁদো কাঁদো হয়ে মণীশের দিকে চেয়ে বলল, শুনলে? হুমকি দিচ্ছে। এবার ঠিক বুবককে মারবে।

অত সোজা নয় মা। আমাদের অনেকের গার্জিয়ানই খুব ইনফ্লুয়েনসিয়াল মানুষ। তারা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে অ্যালার্ট করেছে। ভয় পেও না মা, ওরা কিছু করতে পারবে না।

আপা যে কেন এসব করতে যায়! বলে অপর্ণা রাগ করে মুখ ফিরিয়ে নিল।

মণীশ খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে বলল, আমার যদি আপার মতো একটা মেয়ে থাকত তাহলে বুক ফুলিয়ে বেড়াতাম। আপা ইজ এ জেম।

তোমরা আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না কোনদিন।

শান্তি একটা বোগাস জিনিস অপু। নার্সিংহোমে থেকে সেটা আমি বুঝেছি।

তুমি নিজেই তো একটা গুণ্ডা। সেইজন্যই তোমার শান্তি ভাল লাগে না।

তা নয় অপু। তোমরা যে শান্তির কথা ভাবো সেটা হল নিস্তরঙ্গতা, নিশ্চেষ্টতা, নিথরতা। আমি যখন কোমার মধ্যে ছিলাম তখন তো আমার ওইরকম শান্তিই ছিল! চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, ফ্রিকশন নেই, টেনশন নেই। মরে গেলে তো আরও চমৎকার শান্তি, একদম ঠাণ্ডা। বেঁচে থাকাটা কিন্তু নিছক শাস্তি নয়। নিরন্তর সূক্ষ্ম বা স্থূল কিছু-না-কিছু ফ্রিকশন হয়েই যাচ্ছে। তুমি ভার্সাস তোমার পারিপার্শ্বিক। তুমি ভার্সাস তোমার আইডিয়াজ। তুমি ভার্সাস তোমার অতীত ও বর্তমান। তুমি ভার্সাস ভাল অথবা মন্দ। যদি জীবন-বিমুখ হয়ে একটা কোটরের মধ্যে নিজেকে ভরে রাখতে পারো, তাহলে তুমি তোমার মতো শান্তি পেয়ে যাবে। আর যদি খোলা জীবনের মধ্যে এসে দাঁড়াতে চাও তাহলে সংঘর্ষ হবেই।

বড্ড লেকচার দাও তুমি। আমার কিছু ভাল লাগছে না।

দূর বোকা মেয়ে! বুবকার ঘটনাটাকে অত বড় করে দেখছো কেন? ও যাদের মেরেছে তারা স্মল টাইম ক্রুক্‌ষ। ওরা তেমন কিছু করবে বলে মনেও হয় না। আর যদি কিছু করেই তাহলেও বুবকরা তো তৈরি আছে। তাই না? বুবকা আছে, তার বন্ধুরাও আছে। সকলের কথাই ভাবো। শুধু বুবকাকে আড়াল করতে চাইছো কেন? ওকে কাপুরুষ হতে বোলো না। তাতে বন্ধুদের কাছে ওর সম্মান থাকবে না, ওর নিজের কাছেও না। ওর আত্মধিক্কার আসবে। বুঝেছো?

অপর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

বুবকা কোমল গলায় বলে, এবার একটু বাথরুমে যাবো, মা?

যাও। বলে অপর্ণা উঠে গেল।

পুল কার আসার সময় হয়নি। মণীশ একটু বাইরে এসে দাঁড়াল। আজকাল সিগারেট খাওয়া ছেড়েছে বলে অনেক সময় বড্ড ফাঁকা আর অর্থহীন লাগে। এখন লাগছিল। সিগারেট চিরকালের মতো ছেড়ে গেল তাকে। আর কী কী ছেড়ে গেল? হিসেব করতে হবে, ভাবতে হবে। মনে হয় আরও অনেক কিছু তাকে ছেড়ে গেছে।

কিন্তু শরতের এই সকালবেলাটা তার বড় ভাল লাগছিল। আজ তার অনেকদিন পর এই প্রথম বাইরে যাওয়া। যেন দীর্ঘ রাত্রির পর ভোর।

মণীশ কখন চলে গেছে তা আজ টের পেল না অপর্ণা। এ রকম কদাচিৎ হয়। মণীশের অফিসে যাওয়ার সময়টায় বরাবর কাছে থাকে অপর্ণা। কিছু কথা থাকে না, কোনও ভাবপ্রবণতাও নয়। হয়তো নিছক অভ্যাস। আজ অপর্ণা শূন্য শোওয়ার ঘরটায় চুপচাপ নিজের মনের মধ্যে ডুবে বসে আছে। খড়কুটোর মতো কত কী ভেসে যাচ্ছে মাথার ভিতর দিয়ে।

পৃথিবীটা কেন এত খারাপ? কেন এত নিষ্ঠুর? কেন চারদিকে সবসময়েই এত বিপদ আপদ? এত সব ঝামেলা আর গণ্ডগোলের মধ্যে কী করে বেঁচে থাকবে অপর্ণার ছেলে আর মেয়েরা? কই, অপর্ণার ছাত্রীজীবনে তো এরকম খারাপ ছিল না পৃথিবীটা!

মা!

অপর্ণা ধীরে মুখ ফেরাল। দরজায় দাঁড়িয়ে বুবকা। লম্বা, পুরুষালি চেহারা। আরও বাড়বে। লম্বা চওড়া হবে। এখনও নাবালকত্ব গভীরভাবে বসে আছে চোখে আর মুখে। এখনও শিশুর মতো সরল।

আয়। বলে হাত বাড়ায় অপর্ণা।

বুবকা তার কাছে এসে বসে, তোমার মনটা খারাপ মা? আর ইউ ইন টেনশন?

ভীষণ। বলে ছেলের মাথাটা কাঁধে চেপে ধরে সে।

বুবকা তার নিস্পাপ গলায় বলে, তুমি এত ভাবো কেন মা? কত ছেলে দুনিয়া জুড়ে কত কী করছে! বারো বছরের ছেলে প্লেন চালাচ্ছে, যোলো বছরের ছেলে রাইফেল কাঁধে যুদ্ধে যাচ্ছে, কেউ আটলান্টিক পেরোচ্ছে নৌকোয়। আমি তো তেমন কিছুও করিনি। একটা বদমাশকে একটু মেরেছি।

তোমার আর বীর হয়ে কাজ নেই বাবা। আমার কোল জুড়ে থাকো।

কোল! হিঃ হিঃ, কী যে বলো মা!

তোর বাবা যে গুণ্ডা ছিল তা জানিস?

জানি। তুমি অনেকবার বলেছো। বাবা তোমাকে একটা অদ্ভুত সেমিকনশাস অবস্থা থেকে রেসকিউ করেছিল। তুমি পুলিশের গুলিতে চোখের সামনে একটা লোককে মরতে দেখে একদম বুরবক হয়ে গিয়েছিলে।

তা ছাড়াও আছে। তোর বাবা ট্যাক্সিওয়ালাদের ত্যাঁদড়ামি দেখলে মার লাগাত, পুলিশের গাড়িতে ইট ছুঁড়ত। এই তো এক বছর আগেও একজন দোকানদারকে কিসের দাম জিজ্ঞেস করায় সে একটা তেড়িয়া জবাব দিয়েছিল, তোর বাবা তাকে কলার ধরে এমন ঝাঁকুনি দিয়েছিল!

তারপর কী হল মা?

খুব হাঙ্গামা হল। অন্য দোকানদাররা ছুটে এল, জোট বাঁধল। তোর বাবা ভয় পেল না। এমন চেঁচামেচি বাঁধিয়ে দিল যে, ভয়ে মরি। তবে কথার তোড় আছে, গলার জোরও আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খদ্দেরদের এককাট্টা করে ফেলল। তখন দু’দলে এই লাগে কি সেই লাগে।

বাবা তো ঠিক কাজই করে মা, তাহলে বাবাকে গুণ্ডা বলছো কেন?

একে গুণ্ডাই বলে। অত সাহস কি ভাল?

তুমি মা, এক নম্বরের ভীতু।

অপর্ণা মুখে কিছু বলল না। কিন্তু সকালটা আজ বড় ভারী হয়ে রইল বুকের মধ্যে। শরৎ ঋতু নাকি দারুণ সুন্দর! অন্তত মণীশ তো তাই বলে। কিন্তু আজ সকালের এত রোদেও যেন আলো খুঁজে পেল না অপর্ণা।

বিকেলে ডোরবেল বাজতেই অপর্ণা দরজা খুলল গিয়ে। সামনে বুবকা। তার পিছনে আপা। তার পিছনে আরও কয়েকটা ছেলে আর মেয়ে।

এসো, এসো। বলে অপর্ণা দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়।

বুবকা একগাল হেসে বলে, ওদের নিয়ে এলাম মা। ওরা তোমার ভয় ভাঙাতে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *