1 of 2

৩৪. চিঠিটা পড়া শেষ করে

৩৪

রাইনা/১৯–১২

পৃথুদা,

ডিসেম্বরের শেষে আমরা ভোপাল, ভীমবৈঠকা, আর ইন্দোর যাচ্ছি।

ওর কী সব কাজ পড়েছে ওদিকে। বলছিল। ভোপালের হেভী ইলেকট্রিকালস্-এ আর ইউনিয়ন কার্বাইড-এর কারখানার পারচেজ ম্যানেজারদের সঙ্গে দেখা করবে।

আমি বলেছি, সঙ্গে যাব। আপনি কি যেতে পারবেন? তাহলে মাণ্ডুতেও যেতাম। ছোটবেলার পর আর যাইনি। আপনার সঙ্গে যেতে পারলে খুবই ভাল লাগত।

আমার বেরসিক স্বামীর সঙ্গে বেড়িয়ে সুখ নেই। হোটেলের ঘরে বসে শুধুই মদ খাবে আর গুচ্ছের খাবার। ঘরের বাইরে প্রতিমুহূর্ত যে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, ভাঙছে গড়ছে অনুক্ষণ, সে সব ওর জানার জগতের একেবারেই বাইরে। ও খুব বেশি করলে, হোটেলেই গুটিকয় যাচ্ছেতাই ধরনের লোক জুটিয়ে নিয়ে তাস খেলতে বসবে।

করুক গে ও ওর যা-খুশি, আপনি যদি যান, তাহলে আমরা দুজনে বেড়িয়ে বেড়াতাম পুরনো দিনের মতো। সত্যি! পুরনো দিনের মতো।

আমার তো মনে হয় পুরনো দিনের কিছুমাত্রই হারায়নি। অবশ্য একথাও সত্যি যে, মাঝে মাঝে মনে হয় সব কিছুই হারিয়ে গেছে নিঃশেষে। তবু, মনে মনে এই ভেবেই খুশি থাকি যে, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’।

যাবেন?

আমার খুউব, খুউব, খুউব ভাল লাগবে তাহলে। আজকাল কেন জানি না, কিছুতেই আর ভাল লাগে না। আগে কত সহজে সুখী হতে পারতাম। শরতের শিউলিতলায়, বসন্তের ভোরের হাওয়ায়, শ্রাবণের ঘন সবুজ গহন কদম গাছের নীচের, চাপ চাপ গাঢ়-গন্ধ বৃষ্টিভেজা ঘাসের মাঠে দাঁড়িয়ে ফড়িং ওড়া দেখলে তখন মনে হত জীবনের সবটুকুই বুঝি সুখ। শুধুই সুখ। মনে মনে দুশ্চিন্তা হত যে, এত সুখ রাখব কোথায়?

বাবা একদিন বলেছিলেন, “তোকে একটা গডরেজের আলমারী কিনে দেব কুর্চি! তোর মা বলছিলেন সুখ রাখার নাকি জায়গার অকুলান তোর?”

কী করব! আজকাল সত্যিই কিছুতেই আর ভাল লাগে না। শুধু আপনি যখন আসেন, আপনাকে যখন একটু কাছে পাই তখন ছাড়া। তখন মনে হয় আমার সব শরতের শিউলি আর বৈশাখের ভোরের হাওয়া একই সঙ্গে এসে আমার ঘর ভরিয়ে দিল। আপনি চলে যাবার পরও আপনার গায়ের আতরের গন্ধ, পান-জর্দার গন্ধ আর ব্যক্তিত্বের গন্ধে আমার বসার ঘর, মনের ঘর, সব ভরে থাকে। ব্যক্তিত্বর সত্যিই গন্ধ থাকে আলাদা আলাদা। কোনও বদবু মানুষ এসে চলে গেলে ঘরে হায়নার গায়ের গন্ধর মতো গন্ধ লেগে থাকে আর আপনার মতো খুশবুদার কেউ এলে…। আমার নাক গন্ধ চেনে। মানুষও।

খুব মজা লাগে ভাবলে যে, সেই ব্যক্তি স্বয়ং নিজেই তার ব্যক্তিত্বর গন্ধ চেনে না। যে তাকে ভালবাসে, শুধু সেই-ই তা চেনে। কী যে চুরি হয়ে যায় আপনার, যতবারই আসেন আমার কাছে; তা আপনি নিজেই জানেন না। আপনি চলে গিয়েও রেখে যান আপনাকে আমার কাছে। অনেকক্ষণ!

একজন না-পসন্দ মানুষের সঙ্গে আমার সব ভাললাগা না-লাগা যে এমন করে জড়িয়ে যাবে কখনও ভাবিনি তা। আপনি ভীষণই খারাপ। নিজের জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি তো খেললেনই, আমার জীবনটাও নষ্ট করে দিলেন।

ভালই খাই; মোটামুটি ভালই পরি। আমার মতো সাধারণ মেয়ের এর চেয়ে বেশি আশা করা অনুচিত। আমার মোটা, সাদাসিধে বর আমাকে তার মতন করে ভালও বাসে। প্রত্যেক মানুষের ভালবাসার রকমই তো আলাদা আলাদা। ছেলেমেয়ে নেই বলে আমার কোনও কষ্টও নেই। ভালই তো আছি একদিক দিয়ে। ঝাড়া হাত-পা। ইটার্নাল হানিমুনও করা যেত, কিন্তু…

চাঁদ তো থাকেই। প্রতি মাসেই ঘুরে আসে পূর্ণিমা। কিন্তু আমার জীবনের চাঁদ থেকে চাঁদ কবে যেন চুরি হয়ে গেছে। আমাদের ছেলেবেলার চাঁদ তো নেইও আর। স্পেসস্যুট পরে, স্পেস শ্যু পরে চাঁদে হেঁটে বেড়ায় মানুষ। ভাবলেও খারাপ লাগে। মানুষের এই বাড়াবাড়ি কি সত্যিই খুব দরকার ছিল?

এখন শুধুই টক চাঁদ, নোনা চাঁদ, ঝাল চাঁদ, অ্যামেরিকার চাঁদ, রাশিয়ার চাঁদ! চরকা বুড়ির সেই রহস্যময়ী চাঁদই ভাল ছিল আমাদের।

দেখুন! আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন কি না এই কথা জানতে কলম ধরে কত কী আবোল-তাবোল লিখে ফেললাম। আসলে, আমার কথা একবার শুরু করলে আর ফুরোয় না।

মনে আছে? আপনি একবার বলেছিলেন যে, কোনও একটি চিঠিতেও যদি ‘পুনশ্চ’ না লিখি তাহলে আমাকে একটি বালুচরী শাড়ি আনিয়ে দেবেন ওয়েস্ট বেঙ্গলের বিষ্ণুপুর থেকে। আমি প্রায় পেয়েই গেছিলাম শাড়িটা যদি না সেই নিখুঁত চিঠিটির শেষে পুনশ্চ দিয়ে লিখতাম যে, “দেখলেন তো একটা পুনশ্চ নেই এইবারে”!’

আসলে বালুচরী শাড়ির কপাল আমার নয়। আমার কপালের সঙ্গে বালুচরের মিল থাকায়ই এই বিপত্তি!

আবারও বলছি, আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন কি না তা অবশ্যই জানাবেন। তখন ওকে বলে ওর কাছ থেকে নিমন্ত্রণপত্র পাঠাব আপনার কাছে। ফর্ম্যালী।

কী বিপদ! কীরকম স্বাধীন দেখুন তো আমরা! যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে, যেহেতু স্বামীর পয়সায় খাই-পরি, সেইহেতু সতীত্বের পরীক্ষাতে সবসময় ফারস্ট ক্লাস হতে তো হবেই, উপরন্তু সতী থেকেও নিজের যাকে সবচেয়ে ভাল লাগে, তাকেও সঙ্গে করে কোথাও যেতে, স্বামী স্বয়ং সঙ্গে থাকলেও তার পারমিশান নিতে হবে।

আমাকে একটা চাকরি দেবেন? পৃথুদা। না। চাকরি থাক। স্বাধীন ব্যবসা করব। সেলাইটা ভাল করে শিখি তারপর রাইনার বাজারে একটা দর্জির দোকান দেব। শুধু মেয়েরাই কাজ করবে। শুধু একজন পুরুষ। বুড়ো, নিরাপদ, মুসলমান দর্জি রাখব। মাস্টার। বুড়ো অশক্ত, খুকখুকে কাশির মানুষ খুঁজে না পেলে রাখা যাবে না। ভাঁটু ভাববে, সে বিপজ্জনক। আপনাদের বলিহারী। খোজা প্রহরী থেকে কত কীই যে আপনাদের মাথা থেকে বেরুল আজ অবধি আমাদের দখলে রাখতে!

সত্যি! বিংশ শতাব্দীর শেষে এসেও, এই দেশের পুরুষরা আমাদের খাইয়ে-পরিয়ে রেখে যে প্রচণ্ড প্রগতি দিয়েছেন তা বাড়ির কুকুর অথবা কাকাতুয়াদেরও হাসির ব্যাপার। ধন্য আপনাদের উদারতার! জয় আপনাদের মহত্বর! দীর্ঘজীবী হোক আপনাদের এই অশেষ ঔদার্য।

যেতে পারবেন কিনা তাড়াতাড়ি জানাবেন। নইলে আড়ি। —আপনার কুর্চি।

চিঠিটা পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ বসে থাকল পৃথু। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে।

খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের সাদা ধবধবে যুবক অ্যালসেশিয়ান কুকুরটাকে নিয়ে তাঁর কালো কুচকুচে যুবতী আয়া জঙ্গলের দিকে চলে গেল।

প্রকৃতির মধ্যেই মানব এবং মানবীর প্রকৃত মুক্তি নিহিত আছে।

একমাত্র প্রকৃতিরই মধ্যে।

পৃথু এক টিপ নস্যি নিল। একসময়ের সাহেব পৃথু শেষ। তারপর কাগজ কলম নিয়ে বসল।

কুর্চি যা লিখেছে তা ঠিকই। তবে এমন অনেক স্ত্রীকেও পৃথু জানে যে, তাঁরা এই পরাধীনতাকে, খেতে পরতে পেয়েই, সন্তান পালনেই যে সুখ, সেই সুখটাকেই বড় মনে করেন। কেউ কেউ তা মনে না করলেও এই পরাধীনতার গ্লানিটা স্বীকার করতে পুরোপুরিই লজ্জিত হন। এবং হন বলেই প্রচণ্ড শব্দর সঙ্গে এর প্রতিবাদ করেন। বলেন, এই-ই হচ্ছে ভারতীয় স্ত্রীদের সনাতন ধর্ম। মহান ভারতীয় নারীর ফর্টে। আবার কুর্চির মতো অনেকে আছে। ইচ্ছে আছে, সাহস নেই। প্রচণ্ড দুরন্ততায় বাঁচতে ইচ্ছা যায় যাদের অথচ রূপোর চেনে বাঁধা ঘুমপাড়ানো কুকুরীরই মতো তাঁরাই বিত্তবান স্বামীর স্থূল দম্ভর মোজাইকটাইলস বা মার্বেলের বারান্দায় নেতিয়ে পড়ে থাকেন। যুগের পর যুগ। ঘটনা এটাই।

পৃথুর চিঠি লেখার বহর দেখে ভুচু প্রায়ই বলে, তুমি দাদা একটা এক নম্বরের পাগল হচ্ছ। চিঠি লিখে এই ভাবে সময় নষ্ট কেউ করে! চিঠির যুগ তামাদি হয়ে গেছে। আজকাল কার্ড, টেলিফোন, এবং টেলেক্স-এরই দিন। এত লম্বা লম্বা চিঠি পড়ার সময়ই বা কার আছে? তুমি লেখো বটে, কিন্তু আমার মনে হয়, যারা তোমার চিঠি পায় তারা সোজা ওয়েস্ট-পেপার বাজেটে তা ছিঁড়ে ফেলে দেয়।

কী জানি! পৃথু ভাবে। হয়তো ভুচু ঠিকই বলে। যে-প্রজন্মর মানুষ ও হয়তো সেই প্রজন্মটাই তামাদি হয়ে গেছে। সে কারণেই পৃথুদের মানসিকতাও তামাদি হয়ে গেছে। পুরোপুরি।

চিঠির মধ্যে দিয়ে আমরা যতখানি স্পষ্ট করে নিজেদের প্রতিবিম্বিত করতে পারি, নামাতে পারি আমাদের ভারকে তা আর অন্য কিছু দিয়ে পারা যায়? ঘরে আগল তুলে দিয়ে মনের আগল খুলে ফেলে চিঠির মধ্যে নিঃশেষে নিজেকে ঢেলে দিতে খুব ভাল লাগে পৃথুর। পৃথুদের প্রজন্মে, ভাল চিঠি লিখতে পারার ক্ষমতার সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষারও একটা সাযুজ্য ছিল বলে মনে করা হত।

আর এখন…?

কে জানে? চিঠিই যদি না-লেখে মানুষ-মানুষী তবে কি গিরিশদার বাঁদর সুখময় আর তার বউ লিখবে?

কুর্চি,

তোমার চিঠি হঠাৎ এই শীত-সকালে একরাশ উষ্ণতা বয়ে আনল।

পাতা ঝরে যাচ্ছে সামনের শালবনে। বিবাগী হচ্ছে ভোগী। রিক্ততার দিন আসছে সামনে। এরই মধ্যে তোমার চিঠি যৌবনের দূতীর মতো এল এক ঝাঁক টিয়ার উল্লাসী সমবেত সবুজ চিৎকারের মতো। দুর্বোধ্য আপাত কর্কশ শব্দমঞ্জরীও কী দারুণ মুগ্ধতা বয়ে আনে কখনও কখনও, কী দারুণ ভাবে সঞ্জীবিত করতে পারে অন্যকে।

তাই নয়?

তার মানে এই নয় যে, তোমার চিঠি দুর্বোধ্য। উপমার খুঁত ক্ষমা করে দিয়ো।

কেমন আছ তুমি? জানতে চাইলেও জানতে পাই কই?

সকাল থেকেই তোমাকে আজ খুব সুন্দর একটি চিঠি লিখতে ইচ্ছা করছিল। ঘুম ভাঙার পর থেকেই তোমার কথা মনে পড়ছিল খুবই। আজকে ঘুমও ভাঙল বড় সুন্দর এক চমকে। একজোড়া পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। যে পাখিদের ডাক বড় একটা শুনিনি এদিকে। কম্বল ছেড়ে দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি একজোড়া স্কার্লেট মিনিভেট এসে বসেছে আমগাছের মাথায়। তাদের গলানো-মোরগঝুঁটি লাল-এর পিচকিরি ছুঁড়ে দিল তারা উৎসাহে নীল আকাশে, দিয়েই, হারিয়ে গেল নীলের মধ্যে। আমার ঘুম ভাঙানিয়া পাখিরা। আহা! রোজই যদি আসত।

কেন এল কে জানে। সালিম আলির বইয়ে পড়েছিলাম ওদের দেখা দেওয়ার কথা এদিকে বর্ষাতে। তবু, এসে তো ছিল। কী সুন্দরভাবে রাত পোয়াল আজ বলো তো?

আর তারপরই তোমার এই চিঠি। দিন আজকে ভাল যাবে আমার।

বলছিলাম যে, সকাল থেকেই তোমাকে সুন্দর একটি চিঠি লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু সুন্দর সুখের যা-কিছু ইচ্ছা, তা দমন করার মধ্যেও বোধহয় এক ধরনের গভীরতর সুখ নিহিত থাকে। থাকে না?

আজ চিঠি লিখব না তোমাকে। তার বদলে একটি স্বপ্নহার পাঠাচ্ছি, লেখক, কবি না। তবুও, তাঁর নাম গোপনই থাক।

কল্পনা করেই খুব ভাল লাগছে যে, তুমি আমার চিঠি কোলে নিয়ে বসে আছ, জানালার পাশে। যে-মানুষটি তোমার মিষ্টি-গন্ধ কোলের পরশ পায়নি কখনও, পাবেও না কোনওদিন, তার চিঠি সেই পরশে গর্বিত হয়ে উঠেছে যে, এই ভেবেই কত সুখ!

আমার চিঠি পড়তে পড়তে তোমার সুন্দর মুখে এক আশ্চর্য প্রসন্নতমাখা প্রেম-ছবি ফুটে উঠছে, অস্ফুট চাপা, গোপন কাম-ভাব? মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি আমি।

কী যে দেখেছিলাম তোমার ওই মুখটিতে কুর্চি! এত যুগ ধরে কত মুখই তো দেখল এই পোড়া চোখ দুটি। কিন্তু এমন করে আর কোনও মুখই তো আমার সর্বস্বকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেনি। ভাল না-বাসলেই ছিল ভাল।. বড় কষ্ট গো ভালবাসায়। ভাল তো কাউকে পরিকল্পনা করে বাসা যায় না, ভালবাসা হয়ে যায়; ঘটে যায়। এই ঘটনা ঘটার অনেক আগে থেকেই মনের মধ্যে প্রেমপোকা কুরতে থাকে তারপর হঠাৎই এক সকালে এই দুঃখে-সুখের ব্যাধি দুরারোগ্য ক্যানসারেরই মতো ধরা পড়ে। তখন আর কিছুই করার থাকে না। অমোঘ পরিণতির জন্যে অশেষ যন্ত্রণার সঙ্গে শুধু নীরব অপেক্ষা তখন।

কেউই যেন কাউকে ভাল না বাসে। জীবনের সব প্রাপ্তিকে এ যে অপ্রাপ্তিতেই গড়িয়ে দেয়। যা-কিছুই সে মানুষটি দীর্ঘদিনের চেষ্টা, পরিশ্রম, মননশীলতা দিয়ে গড়ে তুলেছিল, যা-কিছু ছিল তার গর্বর, পরিচয়ের, শ্লাঘার, তার সবকিছুই হঠাৎ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। যাকে ভালবাসে তাকে নইলে তার আমিত্বই অনস্তিত্বে পৌঁছোয়। হুঁশ থাকলে এমন মুর্খামি কেউ কি করে? বল?

সেই জন্যেই বোধহয় হুঁশিয়ার মানুষদের কপালে ভালবাসা জোটে না। যারা হারাবার ভয় করে না কিছুতেই, একমাত্র তারাই ভালবেসে সব হারাতে পারে। অথবা, অন্য দিক দিয়ে দেখলে মনে হয়, যা-কিছুই সে পেয়েছিল বা তার ছিল; সেই সমস্ত কিছুকেই অর্থবাহী করে তোলে ভালবাসা। যে ভালবাসেনি, তার জীবনও বৃথা!

তবুও…বড় কষ্ট ভালবাসায়।

এমন মহাবোধ আর কী আছে? আমার মতো একজন সাধারণ মানুষ তোমাকে ভালবেসে আমার নিজের সন্তা-আমার কাছে কত যে দামি, কত মহার্ঘই যে হয়ে উঠি তা আমিই জানি। এইটেই কি কম পাওয়া? বলো?

জানো কুর্চি, এই মুহূর্তে নিধুবাবুর একটি গানের কথা মনে পড়ে গেল। গৌড়-মল্লারে বাঁধা গানখানি। তোমাকে শোনাব একদিন। কত গানই তো শোনাতে ইচ্ছে করে। সময় কোথায় তোমার? যখনই তোমার কাছে যাই, হয় রান্না করছ, নয় সেলাই করছ, নয় ঘর গুছোচ্ছ, সময় কোথায় তোমার আমাকে দিয়ে সময় নষ্ট করবার?

“কী হল আমার সই বল কি করি?

নয়ন লাগিল যাহে কেমনে পাশরি?

হেরিলে হরিষচিত না-হেরিলে মরি

তৃষিত চাতকী যেন থাকে আশা করি

ঘন মুখ হেরি সুখী, দুখী, বিনে বারি।”

কি সুন্দর কথা। তাই না?

তুমি জানো না গো। এক মুহূর্তও তোমাকে ভুলতে পারি না আজকাল। সত্যিই কী যে হল আমার, প্রায়-চল্লিশে এসে। এখন তো থিতু হবার সময়। কী যে করি। কেন যে তুমি ফিরে এলে রায়নায়!

স্বপ্নহার, তোমায় পাঠাই…নীল নদীটির নিবিড় পারে, ঘুম-পাওয়া রোদ চমকে চেয়ে অলস পায়ে, যখন হাঁটে মাঘী মাঠের ন্যাবা-ধরা শূন্যতাতে ঠিক তখনই আমার বুকের গভীর থেকে স্বপ্নগুলো ঝাপটে-ডানা অস্ফুটে কী কইতে কইতে নড়ে চড়ে!

স্বপ্ন ওড়ে।

স্বপ্নে দেখি, নীড়ের পাখি আসছে নীড়ে। অনেক পাহাড় মাঠ পেরিয়ে ভালবাসা ঠোঁটে করে আসছে ফিরে। পাখি আমার নীড়ের পাখি।

স্বপ্নগুলো খুব ভীতু হয়, আমার স্বপ্ন; স্বপ্ন সবার।

তবুও আমি স্বপ্ন দেখি। রূপের রাজা, গুণের গুণিন, মুঠির মাঝে মুক্তো-মলিন, সব পাখিদের মুগ্ধ-করা মন্ত্র নিয়ে আসব ফিরে বারে বারে। আসব ফিরেই, অবহেলার হেলাফেলার শোধ নেবো ঠিক হিসেব করে।

কোনও পাখিই বশ মানেনি আমার দাঁড়ে। এই জনমে। একটিও নয়। বুনো পাখির সঙ্গে তারা কেউ ওড়েনি।

গায়নিকো গান মিষ্টি গলায় শিউলি-ভোরে। গায়নিকো গান সাঁঝবেলাতে হাসনুহানার। সকাল ও সাঁঝ হারিয়ে গেছে নিরুপায়, পাখির গায়ের ওম্-এর গন্ধ এবং চোখের চিকনতার বস্‌রা গোলাপ হারিয়ে গেছে, পাখি আমার, নীড়ের পাখি। চিরচেনা অচিন পাখি এলেবেলে খেলায় মাতে আলস ভরে। চোখ দিয়ে সে মারত চাবুক আমায় একা। কল্‌জে নিয়ে বাটত সে যে গাবুক-গুবুক। পানা-পড়া দিনগুলোকে চমকে দিয়ে লাফিয়ে যেত ত্রস্ত পায়ে; মেঘ-দুপুরের ডাহুক যেন!

আমার কিছু স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন দিয়ে মালা গাঁথি। স্বপ্নমালা।

তোমায় নিয়ে ঘুরে বেড়াই বনে বনে। মনে মনে। কাল রাতেতে স্বপ্নবেয়ে গিয়েছিলাম কানহার মাঠে। শিশির-ভেজা লাল ঘাসেতে দেখে এলাম আমরা দুজন; চুপিসাড়ে পা-পা করে হাঁটছে হরিণ; যেমন করে শিশু হাঁটে। রোদের সঙ্গে ছায়ার বিয়ে, আলোর সঙ্গে দেয়ালা করে কালো। হাতে হাতে হাত মিলিয়ে, শব্দ আর গন্ধরা সব যুগলবন্দী খেলে। থাবার চড়ে রোদের ঝালর ঝাপটে ছিঁড়ে লাফিয়ে ওঠে চিতা। শিহর তুলে হরিণ ওড়ে শিশির-ভেজা হীরে-মানিক ভোরে। চমকে বেড়ায় চিকণ চিতা, চিকুর-তোলা চিল। আলো-ছায়া সাপের খেলা, অনন্য; কিলবিল।

ছিপছিপে সেই মেয়ে। ছিপছিপে সে, শ্যামলাবরণ, পেঁয়াজখসী শাড়ি; তার স্বপনপুরে বাড়ি। আমার সঙ্গে আড়ি।

পায়েতে তার চুমু দিতেই কামেতে জরজর, চুমোয় হল পায়া-ভারী, গুমোর-ভরা জোর। দেমাক ভরে দাঁড়িয়ে থাকে। স্বপ্নে-দেখা নারী, পেঁয়াজখসী শাড়ির আঁচল, ঠোঁটের কোণের তিল, স্বপ্নমালায় গেঁথে গেল হরিণ, চিতা; চিল।

স্বপ্নে আমি ভেবেছিলাম, অনেক কিছুই। ভেবেছিলাম, এটা করব, সেটা করব, বাড়ি করব পাহাড়চুড়োয় স্বপ্ন এবং সুখের কুটো দিয়ে। পায়ের কাছে বইবে নদী, নারীর মতে, সাধের নারী, বাধ্যতা আর নাব্যতাতে নীল। ভেবেছিলাম, লিখব আমি গানের মতো; গান গাইব যেমন করে লিখি। আঁকব ছবি খুন করে রঙ, রঙের রক্ত ছেনে। মধ্যবুকের সব ব্যথাকে আনব টেনে টেনে।

বিকেল হল, বিকেল হল, স্বপ্ন মরে আছে পড়ে পায়ের কাছে শীত বিকেলের ঝড়ের ফুলের মতো। নরম, কিন্তু স্থির। মৃতর চেয়ে মৃত। বিকেল হল, বিকেল হল। হয়নি কিছুই, পায়নি কিছুই স্বপ্ন ঘোরে দল ছেড়ে সেই দল ছেড়ে সেই মূঢ় মানুষ একলা তবু হাঁটে। পায়ে পায়ে, ধুলোয় ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে, উচ্চগ্রামের স্বর ফুলিয়ে, হাত উঁচিয়ে, ভয়-দেখিয়ে, যুথবদ্ধ পথিকেরা উল্লাসেতে মাতে। দূরে দূরে একলা হাঁটে স্বপ্ন-পাগল, শাপলা বিলের আলে আলে একলা-ওড়া টিটি পাখির সাথে। গান গেয়ে যায় খালি গলায়, পাহাড়তলির আলেয়াকে সুরের ঘরে ডাকে।

সন্ধে হলে জোনাক জ্বলে বাঁট পাহাড়ে। হুক্কা-হুয়ার শেয়াল দোলে নকশী-কাঁথার মাঠ পেরিয়ে নগ্ন-নির্জন-নীল-কুয়াশায় উথালচুলের উড়াল-গন্ধ কনকচাঁপার রাতে, আগল-খোলা বোকা-পাগল কাঁপা-গলায় গান গেয়ে যায় স্বপ্নমালা হাতে।

নীল নদীটির নিবিড় পারে ঘুম-পাওয়া রোদ চমকে চেয়ে অলস পায়ে যখন হাঁটে মাঘী মাঠের ন্যাবাধরা-শূন্যতাতে, ঠিক তখন আমার বুকের গভীর থেকে স্বপ্নগুলো ঝাপটে-জানা অস্ফুটে কী কইতে কইতে নড়ে চড়ে।

স্বপ্ন ওড়ে।

স্বপ্ন ওড়ে। বারে বারে।

কুর্চি দেখি কী করতে পারি, তোমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার। ইচ্ছে তো কত কিছুই করে। এ জীবনে ক’টি ইচ্ছে আর পূর্ণ হল বলো?

কারই বা হয়? এমনিতেই আমার অনেকই কষ্ট। এমন করে ডাক পাঠিয়ে কষ্ট আর বাড়িও না। রুষা এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকদিনই যাইনি বাইরে। ওদের ফেলে একা একা মজা করতেও বিবেকে লাগে। যার বিবেক বেঁচে থাকে; তার সুখ মরে যায়। সুখী হবার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেক, বিবশ হলেই বাঁচি!

ভাল থেকো। তোমার পৃথুদা—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *