1 of 2

৩২. ব্রজগোপাল সূর্যকে নিয়ে নামলেন

ব্রজগোপাল সূর্যকে নিয়ে নামলেন খড়গপুর স্টেশনে, তখন অনেক রাত। ট্রেন আসার সময় প্ল্যাটফর্মে ক্ষণিক চাঞ্চল্য জেগেছিল, ট্রেন চলে যাবার পরই সব দিক আবার নিঝুম। অন্য যাত্রীরা বেরিয়ে যাবার পরেও ব্রজগোপালরা বেশ খানিকক্ষণ বসে রইলেন একটা বেঞ্চে। দু’জনে একটাও কথা বলাবলি হল না। ব্রজগোপাল নিঃশব্দে সিগারেট টানতে লাগলেন।

তারপর একসময় উঠে দাঁড়িয়ে ব্রজগোপাল বললেন, চল, হাঁটতে পারবি?

সূর্য জিজ্ঞেস করল, কত দূর?

খুব বেশি হবে না, পাঁচ-সাত মাইল বড়জোর। চল না, বেড়াতে বেড়াতে চলে যাব।

স্টেশনের বাইরে দু’-একখানা ঘোড়ারগাড়ি তখনও রয়েছে। ঘোড়াগুলো ও গাড়োয়ান সবাই ঘুমোচ্ছে। ব্রজগোপাল সে-দিকে গেলেন না। সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন। লোকালয় ছাড়িয়ে এসে পড়ল গ্রামের পথ। অন্ধকার। ওদের কাছে টর্চও নেই।

ব্রজগোপাল বললেন, এ-দিকে অনেক টিকটিকি ছড়িয়ে আছে। একজন ধরা পড়লে আর একজনকে পালাতে হবে–এই হচ্ছে কথা। তখন কেউ কারোকে চিনি না, বুঝলি?

সূর্য কোনও সাড়া শব্দ করল না।

ব্রজগোপাল এবার আপশোসের সুরে বললেন, এইসময় হরদা নেই। আমরা এখন সত্যিকারের লড়াই শুরু করছি, হরদা দেখে যেতে পারলেন না। হরদার ওপর সুভাষবাবুর অনেকখানি আস্থা ছিল।

দু’-একখানা গোরুরগাড়ি মাঝে মাঝে দেখা যায়। অনেকক্ষণ বাদে বাদে একজন-দু’জন লোকও চলে যায় পাশ দিয়ে। যে-কোনও রাত্রির রাস্তাতেই এ রকম দু’-এক জন উদাসীন ধরনের লোক চোখে পড়বেই। ওরা ওই সময় কোথা থেকে আসে, কোথায় যায় কে জানে। হয়তো ওরাও ব্রজগোপাল আর সূর্য সম্পর্কে ওই কথাই ভাবছে।

জোর হেডলাইট জ্বেলে একটা গাড়িকে আসতে দেখে ওরা পুলিশের গাড়ি মনে করে রাস্তা থেকে মাঠে নেমে গেল। গাড়িটা পুলিশের নয়, মিলিটারি। গাদাগাদি করা সোলজার চেঁচিয়ে গান গাইছে।

এখন ওরা ধরল মাঠের ভেতরের কঁচা রাস্তা। পরিষ্কার জ্যোৎস্না রাত, পথ চিনতে তেমন অসুবিধে হয় না।

ব্রজগোপাল সূর্যর কাঁধে হাত রেখে বললেন, সূর্য, তোর মনে আছে, আমাদের হাজারিবাগের আস্তানায় তুই যেদিন প্রথম এসেছিলি? হরদা না আটকালে আমরা। বোধহয় তোকে মেরেই ফেলতাম। আমি তোকে খুব জোরে একটা চড় মেরেছিলাম না রে?

সূর্য বলল, ভীষণ জোরে মেরেছিলেন।

তখন আমরা স্পাইয়ের ভয়ে খুব সন্ত্রস্ত ছিলাম। তোর বয়সি ছেলেরাও স্পাই হয়।

কেন হয়?

এদের কত রকম কায়দা আছে। কত রকম লোভ দেখায়! মানুষের কি আর লোভের শেষ আছে? পরাধীন দেশ, এই দেশের লোকও রায়বাহাদুর হয়, তাই নিয়ে আবার গর্ব করে। দেখ না, যোগানন্দ আমাদের কতখানি সর্বনাশ করে গেল। শুধু শুধু ডাকাতির বদনাম নিলাম। অতগুলো টাকা–দলও ভেঙে গেল। শংকর তো ভিড়ল জয়প্রকাশ নারায়ণজির সোস্যালিস্টদের দলে।

যোগানন্দ সম্পর্কে কিন্তু আমার এখনও ঠিক বিশ্বাস হয় না।

আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তো ব্যাপার নেই। অতগুলো টাকা নিয়ে স্রেফ উধাও হয়ে গেল। বড়লোকের ছেলে, বাড়িতে অভাব নেই–আমাদের সঙ্গে থেকে কম কষ্ট সহ্য করেনি, আমরা খুব বিশ্বাস করতাম ওকে–তবু টাকার লোভ সামলাতে পারল না। আমি কোনও দিন টাকাপয়সা ভোগ করিনি, ওর যে কী টান তাও জানি না।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ব্রজগোপাল বললেন, আমার বাবা ছিলেন পোস্টাফিসের কেরানি-চিরকাল টানাটানির সংসার। সবাই ভেবেছিল, আমি লেখাপড়া শিখে বাড়ির দুঃখু ঘোচাব। দেশের দুঃখু ঘোচাবার কথা আর ক’জন ভাবে বল। সবাই নিজের সংসারের দুঃখই ঘোচাতে চায়। আমি একটা ইস্কুল মাস্টারিও নিয়েছিলাম, বেশি দিন পোষাল না। হেডমাস্টারটি ছিল ইংরেজের মার্কামারা গোলাম। ওকে যদি কোনও দিন বিলেতে নিয়ে যাওয়া হয়, ও তা হলে বোধহয় বিলেতের মাটি চাটবে। সব ছেড়েছুঁড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কত দিন বাড়ির কোনও খবরও রাখি না–আমিও কোনও খবর দিই না, আমার জন্য তারা বিপদে পড়তে পারে। ছোট ভাইটা আছে–

ব্রজদা, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?

চল না। ভালো ভাবেই থাকবি। তোর বাবাকে কিছু বলে এসেছিস?

বলেছি বিশেষ কাজে বাইরে যাচ্ছি।

কোনও আপত্তি করেননি?

সূর্য চুপ করে রইল। বড়বাবুকে সে জানিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু মতামতের জন্য সে অপেক্ষা করেনি। বড়বাবুও আজকাল ওর কোনও কাজে বাধা দেন না। একদিন তিনি সূর্যকে মেরেছিলেন, সেই একদিনই। তিনি বোধহয় বুঝেছিলেন, মারধর বা বকুনি দিয়ে এ-ছেলেকে ঠান্ডা করা যাবে না।

ব্রজগোপাল বললেন, সবারই বাবা-মা আছেন। সব বাবা মা-ই ছেলের জন্য চিন্তিত থাকে। ক্ষুদিরাম কিংবা ভবানীর মা বাবা ছিল না? তোর তো মা নেই–তোর বন্ধন অনেক কম। শোন, তোকে এখানে দুটো কাজ করতে হবে। এখানকার মানুষজনের সঙ্গে মিশবি, লোককে দেশের কথা বোঝবি। সতীশ সামন্ত মশাই এ-জেলায় অনেক কাজ করেছেন, তার দলের ছেলেদের সঙ্গে পারলে যোগাযোগ করে নিবি–কিন্তু নিজের কথা বিশেষ কিছু ভাবি না। অ্যাকশানের সময় আমি তোকে খবর পাঠাব।

তোর আর একটা কাজ হবে যোগানন্দকে খুঁজে বার করা। আমি খবর পেয়েছি, সে এ-দিকেই কোথাও আছে।

যদি খুঁজে পাই?

প্রথমে ভাব জমাবার চেষ্টা করবি। এমন ভাবে কথা বলবি, যেন তুইও দলটল ছেড়ে দিয়ে এদিকে লুকিয়ে আছিস। আমাদের নামে যত পারিস নিন্দে করবি ওর কাছে। তারপর ওর বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে একদিন সুযোগ বুঝে শেষ করে দিবি। তখন যেন গুলি চালাতে হাত না কাপে একটুও। বিশ্বাসঘাতকদের কোনও ক্ষমা নেই। এদের মেরে দেশের লোকের কাছে একটা দৃষ্টান্ত রাখা দরকার।

মারার আগে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করব না?

ব্রজগোপাল থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, শোন সূর্য, কোনও মানুষকে যদি মারতে যাস, তা হলে তার কাছ থেকে যুক্তি বা স্বীকারোক্তি শোনার আশা করিস না। ওসব শুনলে তাকে আর শেষ পর্যন্ত মারতেই পারবি না। সেই হিসেবে একজন ইংরেজকেও মারা যায় না। মানুষ যত দোষই করুক, মৃত্যু কখনও তার শাস্তি হতে পারে না। আমরা ভারতীয়, মানুষের প্রাণ নষ্ট করার ব্যাপারে আমাদের মন কখনও ঠিক সায় দেয় না। ইংরেজ আজ শুধু অস্ত্রশক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমাদের ওপর প্রভুত্ব করছে। জ্ঞান, বুদ্ধি, নিষ্ঠা–কোন দিকে ওরা শ্রেষ্ঠ? এই অত্যাচারীকে আঘাত হানবার জন্যই আমাদের অস্ত্র ধরতে হয়েছে। কোনও ব্যক্তিবিশেষের ওপর আমাদের হিংসে নেই।

এককালে স্কুলে পড়াবার জন্যই বোধহয় ব্রজগোপালের আন্তরিক কথাগুলোও বক্তৃতার মতন শোনায়। সূর্য বিনা মন্তব্যে নীরবে শুনে গেল।

দূরে কয়েকটা মিটমিটে আলো দেখে বোঝা যায় সামনে কোনও গ্রাম আসছে। ব্রজগোপাল সে-গ্রামটিও পার হয়ে গেলেন নিঃশব্দে। আর একখানা মাঠ পেরোবার পর আবার একটি গ্রাম। ব্রজগোপাল সেই গ্রামের শেষ প্রান্তের একটি বাড়ির সামনে দাঁড়ালেন।

বাড়িটিতে মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালা দেওয়া পাশাপাশি কয়েকটি ঘর। উঠোনের এক পাশে গোয়ালঘর, সেখানে দুটি গোরুর চোখ অন্ধকারে বৃহৎ মণির মতন ঝকঝক করছে। গোটা বাড়িটাই ঘুমন্ত মনে হয়েছিল–ব্রজগোপাল দরজায় একটু আঘাত করতেই দরজা খুলে গেল। একজন মধ্যবয়স্ক লোক মুখ বাড়িয়ে বলল, দাদা নাকি?

ব্রজগোপাল বললেন, উপেন, আমি। খবর পেয়েছিলে?

হ্যাঁ দাদা। আজ বিকেলেই এক ছোকরাবাবু বলে গেল। দাঁড়ান, বাতি জ্বালি।

হারিকেন জ্বেলে লোকটি বাইরে বেরিয়ে এসে বারান্দায় মাদুর পাতল। আর একজন মহিলাও এলেন, লোকটির স্ত্রী মনে হয়।

আসেন, দাদারা বসেন এসে।

ব্রজগোপাল বারান্দায় উঠে বললেন, উপেন, এই ছেলেটিকে তোমার কাছে নিয়ে এলাম। একে কিছু দিন রাখতে হবে এখানে।

হারিকেনের আলোয় সূর্যর মুখ ভালো করে দেখে চমকে উঠে উপেন বলল দাদা, এ কাকে নিয়ে এসেছেন? এ যে দেখছি সাহেবের ছেলে

না, না।

বলেন কী? এই রং, এই চুল, কটা চোখ!

না হে, এ আমাদের বাঙালি ঘরেরই ছেলে। খুব ভালো ছেলে। একে কি লুকিয়ে রাখতে পারব? আমাদের এসব গাঁয়ের গরিবগুরবোলোক যে এনার দিকে হা করে চেয়ে থাকবে। এ রকম গৌরবর্ণ কি এদিকে কোথাও আছে? এ কি চাপা রাখা যায়।

ব্রজগোপাল হাসতে হাসতে বললেন, আরে, ও-সব ছাড়ো। কাল সকাল থেকে ওকে গামছা পরিয়ে মাঠে নামিয়ে দেবে। ও কি বসে বসে তোমার বাড়ির অন্ন ধ্বংস করবে ভেবেছ? রীতিমতন খাঁটিয়ে নেবে ওকে। দু-চার দিন রোদ-বৃষ্টিতে মাঠের মধ্যে কাজ করলেই ওসব গৌর বটন্ন কালি হয়ে যাবে।

বাড়ির অন্য অনেক লোকে ভিড় করে এসেছে। গুটি পাঁচেক ছেলেমেয়ে, লাজুক মুখ–অবাক ভাবে দেখছে এই দু’জন আগন্তুককে। সূর্য মুখ নিচু করে বসে আছে।

ব্রজগোপাল বললেন, উপেন, বড্ড খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়াবে?

উপেন কপালে করাঘাত করে বললে, হায়, হায়, এতক্ষণ না খেয়ে আছেন? এখন কী খাওয়াব আপনাদের? ভাত চড়িয়ে দেব?

সেসব খেলে কি পেট ভরে।

হায়, হায়, নিজের মুখে খেতে চাইলেন–আমার এত সৌভাগ্য, কী যে খাওয়াব–

তোমার যা আছে নিয়ে এসো না–

উপেন হাঁকডাক শুরু করে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেল থালা-ভরতি মুড়ির মোয়া আর বড় বড় মর্তমান কলা। ব্রজগোপাল আর সূর্য তৃপ্তির সঙ্গে খেতে লাগল সেগুলো।

খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরই ব্রজগোপাল যেতে চান। অনেক জেদাজেদি করেও তাকে আর রাখা গেল না। ভোরবেলাই তাকে কোথায় যেন যেতে হবে।

উপেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্রজগোপাল সূর্যকে একটু ডেকে নিয়ে বাইরে গেলেন। ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, সাবধানে থাকবি। এরা লোক ভালো। তোর কোনও অসুবিধে হবে না।

সূর্য তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চুপ করে রইল।

ব্রজগোপাল বললেন, আজকাল আমি একটু দুর্বল হয়ে গেছি। কারওর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলেই মনে হয়, আর দেখা হবে না। সূর্য, যদি আর দেখা না হয়, যদি আমি মরে যাই–তবু তুই থাকবি তো?

সূর্য বলল, থাকব।

ব্রজগোপাল আর কিছু না বলে হন হন করে মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *