বালিকা বধূটিকে কোন স্কুলে পাঠানো হবে, তাই নিয়ে সরলা ও বিবির মধ্যে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। সরলা পড়ে বেথুন স্কুলে, বিবি লোরেটা হাউজে। দু’জনেরই ধারণা, যার যার নিজের স্কুলটিই বেশি ভালো। বেথুন স্কুল বাঙালি পাড়ায় বাংলা-মাধ্যম, আর লোরেটো হাউজ সাহেব পাড়ার ইংরেজি স্কুল, সেখানে বাঙালি ছাত্রীর তুলনায় ফিরিঙ্গি ছাত্রীই বেশি। বেথুনের অনেক ছাত্রী এখন সমাজের নাম-করা মহিলা। এই তো গত বছরেই বেথুনের একটি ছাত্রীকে নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে অবলা দাস নামে মেয়েটি ঠিক করেছিল ডাক্তারি পড়বে। কিন্তু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্রীদের নেয়া হয় না। কিন্তু অবলার দাবি, কেনো সে ডাক্তারি পড়তে পারবে না? শেষ পর্যন্ত তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মাদ্রাজের মেডিকেল কলেজে। অবলার জেদ দেখে বাঙলা সরকার তার জন্য কুড়ি টাকার মাসিক বৃত্তিরও অনুমোদন করেছে। দেশের কোথায় কি আন্দোলন হয়, বেথুন কলেজে তার প্রভাব পড়ে। ইলবার্ট বিলের সময় সাহেবরা যখন এ দেশীয় মানুষদের বিদ্যে-বুদ্ধি নিয়ে যা-তা করা প্রচার করতে লাগল, তখন কামিনী সেন নামে একটি তেজস্বিনী ছাত্রীর নেতৃত্বে বেথুনের মেয়েরা বিক্ষোভ জানিয়েছিল। সুরেন বাড়ুজ্যের যেদিন জেল হল, সেদিন বেথুনের সব ছাত্রী হাতে কালো ফিতে বেধে এসেছিল স্কুলে।
লোরেটো হাউজে এসব কিছুই হয় না। সেখানে স্বদেশিয়ানা নিষিদ্ধ। প্রভু যিশুর জয়গান করে নিয়মিত প্রার্থনা করতে হয়। ছাত্রীরা ভালো ইংরেজি শেখে। বিলিতি আদব-কায়দায় রপ্ত হয়, পাস করার পর তারা বড় বড় ব্যারিস্টারের পত্নী হিসেবে বেশ মানিয়ে যায়।
বিবির বয়েস এখন দশ বছর, সরলার এগারো। এই মামাতো-পিসতুতো দুই বোনের মধ্যে যেমন বেশ ভাব, তেমন মাঝে মাঝে তর্কও হয় খুব। এই বয়েসেই সরলার মনে ইংরেজ শাসন সম্পর্কে রাগ-রাগ ভাব এসেছে। প্রায়ই সে আবৃত্তি করে, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়।
নতুন বউ ওদেরই বয়েসী, কিন্তু এই পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী তাকে কাকিমা বা মামী বলতে হবে। এক এক সময় বিবি আর সরলা তার কাছে ছুটে গিয়ে দু’জনে দুই হাত ধরে বলে, তুমি কার ইকুলে ভর্তি হবে বলো! আমারটা ভালো নয়।
নতুন বউয়ের আড়ষ্টতা এখনও কাটেনি। এমনকি তার বিবাহ-উত্তর নাম যে মৃণালিনী তাও মনে থাকে না, এখনও যেন সে যশোরের গ্রাম মেয়ে ভবতারিণী। এত বড় একটা প্রাসাদ, এত মানুষজন, এত দাস-দাসী, এর মধ্যে তার দিশেহারা অবস্থা। ঠিক যেন রূপকথার মতন, কুঁড়েঘর থেকে সে রাজবাড়ির বধূ হয়ে চলে এসেছে। রাজপুত্রেরই মতন রূপবান তার স্বামী, তবু তার সঙ্গে এখনও ভালো করে ভাবই হল না। হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ীর কাছে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, নীপময়ী তাকে এ বাড়ির রীতিনীতি শেখাচ্ছেন।
বিয়ের দিনের পরেও কয়েকদিন উৎসবের রেশ থাকার কথা, কিন্তু বাড়িতে এখন শোকের ছায়া। রবির বিবাহের রাত্রেই শিলাইদহে তার বড় সারদাপ্রসাদ গাঙ্গুলির হঠাৎ হৃদরোগে মৃত্যু হয়। বড় দিদি সৌদামিনী রবির প্রায় মায়ের মতন, তিনিই এই সংসারের কর্ত্রী। তিনি আবার এই সময়টায় ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের কাছে, খবর পেয়ে তিন দিন আগে পৌঁছেছেন। মূৰ্ছা যাচ্ছেন ঘন ঘন। বাড়িতে সবাই এখন ফিসফিস করে কথা বলে। একমাত্র বাচ্চারাই-এ নিয়ম মানে না।
রবির স্ত্রী কোথায় শিক্ষা গ্ৰহণ করবে, তা নিয়ে বিবি-সরলার তর্কের তো কোনও মূল্যই নেই। আসল সিদ্ধান্ত নেবেন। জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি নিয়েও ফেলেছেন। এবারে তাদের জন্য সার্কুলার রোডে আরও বড় একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে, মৃণালিনী সেখানেই তাঁর কাছে থাকবে। সে বাড়ি থেকে লোরেটো হাউজ বেশি দূর নয়, বিবির সঙ্গেই যেতে পারবে এক গাড়িতে। শাড়ি-টাড়ি চলবে না, উত্তম বিলিতি কাপড় কিনে স্কার্ট বানানো হতে লাগল তার জন্য।
এ ব্যবস্থা অনেকেরই মনঃপূত হল না।
কাদম্বরীর বড় সাধ ছিল স্ত্রী তার সঙ্গিনী হবে। তিনি তাঁর মনের মতন করে মেয়েটিকে গড়ে তুলবেন। রবির জন্য আলাদা একটি মহল নির্দিষ্ট হয়েছে। সাজানো-গোছানোও হয়েছে বেশ সুন্দরভাবে, নতুন বউ সেখানে না থেকে অন্য বাড়িতে চলে যাবে কেন? বেথুন স্কুল এ বাড়ির আরও তিনটি মেয়ে পড়তে যায়, এখানে থেকে ওই স্কুলে পাঠানোর তো কোনও অসুবিধে ছিল না। জ্ঞানদানন্দিনীর নিজের ছেলে-মেয়ে আছে, কাদম্বরীর যে আর কেউ নেই, রবির বউকেও কেড়ে নেবেন জ্ঞানদানন্দিনী?
বাড়ি ভর্তি মানুষ এখন গমগম করছে, রবির সঙ্গে নিভৃতে কথা বলার সুযোগ নেই। অন্যদের সামনেই কাদম্বরী রবিকে সহজভাবে জিজ্ঞেস করলেন, রবি, ছোট বউকে বেথুনে পড়ালেই ভালো হত না? তুমি বাংলার কবি, তোমার বউ যাবে ইস্কুলে?
রবি বিব্রতভাবে বললে, মেজ বউঠান যে ঠিক করলেন…
নীপময়ীও সেখানে উপস্থিত। তিনি বললেন, ও রবি, তোর বউ যে একটি অক্ষরও ইংরেজি জানে না। আমি কথা বলে দেখছি তো, প্রাইমারী ইকুলে বাংলা একটু-আধটু শিখেছে বটে, ইংরেজির অক্ষরজ্ঞানও নেই। ও লোরেটোর ফিরিঙ্গি মেয়েদের সঙ্গে বসে পড়াশুনো করতে পারবে? এক্ষুনি ইস্কুলে পাঠাবারই বা দরকার কী? আমাদের কাছেই থাক না, আমরাই প্রথমটা শিখিয়ে-পড়িয়ে দেব।
রবি বলল, তোমরা একটু মেজ বউঠানকে বুঝিয়ে বলো না। এ কথা?
নীপাময়ী ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, তোর বউয়ের ব্যাপারে আমরা বলতে যাব কেন রে? তুই নিজের বলতে পারিস नां।
রবির মুখ দেখেই বোঝা গেল, জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে এরকম প্রস্তাব তোলার সাহস সে সঞ্চয় করতে পারবে না। কাদম্বরী নিঃশব্দে একটা ছায়ার মতন সরে গেলেন সেখান থেকে।
বেথুন ইস্কুল বাংলার গর্ব। কত বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে ও এদেশের মেয়েদের শিক্ষার জন্য এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বিদ্যাসাগর মশাই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ তাঁর এক কন্যাকে এখানে ভর্তি করে দিয়ে এসেছিলেন।
সেই দেবেন্দ্রনাথও এখন জ্ঞানদানন্দিনীর ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাহ্য করেন না। রবির বিয়ের সময় তিনি আসেননি, কিন্তু বড় জামাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তিনি চলে এলেন শান্তিনিকেতন থেকে। সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা করতে হবে। কনিষ্ঠ পুত্রবধূর মুখ দেখলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। বাড়িতে পৌঁছনো মাত্ৰই, কই রবির বউ কই, এরকম চাঞ্চল্য প্রকাশ করা তাঁর স্বভাব নয়। পৌঁছবার দ্বিতীয় দিনে তিনি গোধূলির আলোয় নিজের ঘরের আরামকেদারায় বসে খবর পাঠালেন। রবি তাঁর নবোঢ়া পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে এসে বাবামশাইকে প্ৰণাম করল।
দেবেন্দ্রনাথ ভয় ও লজ্জায় জড়সড় বালিকাটির হাতে চারটি মোহর দিলেন। এই তাঁর যৌতুক, পুত্রবধূর রূপ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করলেন না, হাত তুলে, চক্ষু বুজে আশীর্বাদের একটি মন্ত্র পাঠ করলেন। তারপর রবিকে জিজ্ঞেস করলেন, বধূমাতার শিক্ষার কী ব্যবস্থা করেছ?
রবি মৃদুকণ্ঠে বলল, মেজ বউঠান ব্যবস্থা করেছেন। খ্রিষ্টমাসের ছুটির পরে লোরেটো হাউজে ভর্তি করে দেওয়া হবে।
দেবেন্দ্রনাথ কয়েক মুহূর্ত নীরবে চিন্তা করার পর বললেন, বেশ! সেই ভালো। তবে, প্রথমেই কি অন্যান্য বালিকাদের সঙ্গে বসে পাঠ নিতে পারবে? ব্যবস্থা করো, কিছুদিন ওই বিদ্যালয়ে ছোট বধূমাতাকে যেন পৃথকভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষিকারা শুধু ওকেই পড়াবেন। এর জন্য যা খরচ লাগে খাজাঞ্চিখানা থেকে নেবে। আমি বলে দিয়ে যাচ্ছি। এর থেকে ভালো ব্যবস্থা আর হয় না।
দেবেন্দ্রনাথ আজকাল আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকতে চান না। এ কালের ছেলেমেয়েদের পোশাক-আশাক, আচার-ব্যবহার সব তাঁর মনঃপূত হয় না, আবার এটাও বোঝেন যে কঠিন নিষেধের গণ্ডি টেনে এত বড় পরিবারের সকলকে বেঁধে রাখা যাবে না। তাই তিনি দূরে চলে গিয়ে সংসার থেকে খানিকটা বিযুক্ত থাকেন। চুঁচড়োয় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে দুদিন পরেই আস্তানা নিলেন সেখানে।
বাইরে থেকে যারা এসেছিল, তারাও ক্রমে ফিরে যেতে লাগল। সত্যেন্দ্রনাথ সপরিবারে চলে গেলেন সার্কুলার রোডের অট্টালিকায়। সরলা তার মা-বাবার সঙ্গে ফিরে গেল কাশিয়াবাগানের বাড়িতে।
জ্ঞানদানন্দিনী শুধু নববধূকেই সঙ্গে নিলেন না, রবিকেও বললেন, কিছুদিন তাদের সঙ্গে গিয়ে থাকতে। রবি বাধ্য ছেলের মতন চলে গেল। মৃণালিনীকে ভর্তি করে দেওয়া হল লোরেটো হাউজে, সেখানে তাকে শুধু ইংরেজি শিক্ষায় নয়, পিয়ানো বাজনা ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত শেখানোরও ব্যবস্থা হল। বাড়িতে জ্ঞানদানন্দিনী প্রতি পদে পদে তাকে বোঝাতে লাগলেন, কিভাবে লোকজনের সামনে হাঁটতে হয়, কি ভাবে দাঁত না দেখিয়ে হাসতে হয়, কি ভাবে সুলুপ সুলুপ শব্দ না করে চা খেতে হয়। এত শিক্ষার চাপে বালিকাটির নিশ্বাস ফেলারও অবসর রইল না।
রবির নতুন কবিতার বই বেরুবে, তার প্রুফ দেখা নিয়ে সেও ব্যস্ত। এই কাব্যটির নাম দিয়েছে সে ‘ছবি ও গান’।
সাধারণত জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িতেই আড্ডার টানে সন্ধেবেলা অনেকে আসে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের তো প্রতিদিন একবার আসা চাই-ই। কিন্তু সম্প্রতি আড্ডার কেন্দ্রটি স্থানান্তরিত হয়েছে অনেক দূরে, উল্টোডাঙ্গায়, স্বর্ণকুমারীর বাড়িতে।
দেবেন্দ্রনাথের কন্যারা বিবাহের পর বাপের বাড়িতেই থাকে, তাদের স্বামীরা ঘড়-জামাই, এটাই রেওয়াজ। একমাত্র ব্যতিক্রম স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল। নদীয়ার জয়রামপুরের জমিদার বংশের সন্তান জানকীনাথ তেজস্বী পুরুষ। প্রথম যৌবনেই তিনি রামতনু লাহিড়ী ও যদুনাথ রায় প্রমুখের সংস্পর্শে এসে জাতিভেদ প্রথাকে অস্বীকার করে উপবীত ছিঁড়ে ফেলে দেন। তাঁর বাবা এজন্য তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ একবার কৃষ্ণনগরে গিয়ে এই সুদৰ্শন যুবাকে দেখে তাঁর এক কন্যার সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। তাঁর কন্যা স্বর্ণকুমারীও অসাধারণ রূপসী। জানকীনাথ রাজি হলেন, কিন্তু শর্ত দিলেন যে তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকবেন না। এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেবেন না।
শ্বশুরবাড়ির অদূরে সিমলে পাড়ায় সংসার পেতেছিলেন জানকীনাথ। এর মধ্যে তাঁর পিতার সঙ্গে সদ্ভাব হয়ে গেছে। আবার তিনি জমিদার-তনয়। কাঞ্চন-কৌলীন্য অব্যাহত রইল। ধনী-কন্যা স্বর্ণকুমারীকে কোনও অভাবের মধ্যে পড়তে হলনা।
ওদের এক পুত্র, তিন কন্যা। পরিণত বয়েসে জানকীনাথ বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গেলেন। সেই সময় স্ত্রী-পুত্রকন্যাদের রেখে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে। তাঁর কনিষ্ঠা কন্যাটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ্যের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর খুব ন্যাওটা হয়ে ওঠে। সে সব-সময় কাদম্বরীর কাছেই থাকত। নিঃসন্তান কাদম্বরীও তাকে বুকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। কিন্তু একদিন তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ছ’বছরের বালিকাটি পা পিছলে পড়ে গেল, মাথায় গুরুতর আঘাত লাগায় সে অনেক চিকিৎসাতেও বাঁচল না। লন্ডনে জানকীনাথ তখন ব্যারিস্টারির অনেকগুলি পরীক্ষাই পাস করেছেন, কিন্তু শেষ পরীক্ষা দেওয়া হল না, কন্যার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তড়িঘড়ি দেশে ফিরে এলেন।
আবার যাবেন ভেবেছিলেন, তা আর হয়ে উঠল না, কিন্তু নানাবিধ সামাজিক কর্মে দিয়ে জানকীনাথ কলকাতার এক বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে গণ্য হলেন। কাশিয়াবাগানে তাঁর বাগানবাড়িটি একটি স্থান এক বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তির সমাগম হয় সেখানে।
স্বর্ণকুমারী এক বিচিত্র রমণী। তাঁর রূপ ও ব্যবহারে মহারানী, মহারানী ভাব, ব্যক্তিত্বময়ী, তা ছাড়া তাঁর শিক্ষার গর্ব আছে। তিনি স্বশিক্ষিতা। পিত্ৰালয়ে এবং স্বামীগৃহে এসেও তিনি যথেষ্ট পড়াশুনাে করেছেন, বিজ্ঞানের প্রতিও তাঁর আগ্ৰহ আছে। লেখনী ধারণ করেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন, ভারতী পত্রিকায় তার রচনা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারীর ধারণা, লেখক-লেখিকাদের সংসারের প্রতি মনোযোগ দেওয়া মানায় না। চাল-ডাল-তেলের হিসেব রাখেন না। তিনি, রান্নাঘরের খবর জানেন না। কয়েকটি পুত্রকন্যার জন্ম দিয়েছেন বটে কিন্তু তাদের নিয়ে আদিখ্যেতা করার পক্ষপাতী নন। তিনি। প্রতিটি সন্তানের জন্য একজন করে পরিচারক বা পরিচারিকা নিযুক্ত আছে। তারাই সৰ্বক্ষণ ছেলেমেয়েদের ওপর নজর রাখে। অন্য জননীদের মতন সময়ে সময়ে ছেলেমেয়েদের কাছে ডাকা, তাদের গায়ে হাত বুলোনো বা চুমো খেয়ে আদর করা, ওসব স্বর্ণকুমারীর ধাতে নেই। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতিদিন তাঁর দেখাও হয় না।
একবার, তার তৃতীয় কন্যা সরলা যখন বেশ ছোট, ছাদের মার্বেল সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে গড়াতে পড়ে গিয়েছিল একতলায়। মুখের দুটো দাঁত ভেঙে রক্তারক্তি কাণ্ড, সারা বাড়িতে হইচই, সরলার নিজস্ব দাসীটি কেঁদে কেটে বলতে লাগল, তার কোনও দোষ নেই…। ওপরতলার এক ঘরে বসে তখন সাহিত্য রচনা করছিলেন স্বর্ণকুমারী, তিনি একটুক্ষণ কান পেতে শুনলেন ও কোলাহলের কারণটা বুঝলেন, তবু নীচে নেমে মেয়েকে দেখতে গেলেন না। সাহিত্য রচনা এক প্রকার সাধনা, যখন-তখন মনঃসংযোগ নষ্ট করলে এ সাধনার ফল পাওয়া যায় না। মেয়ে আহত হয়েছে তো কী এমন ব্যাপার, তাকে দেখার জন্য একগাদা কর্মচারী রয়েছে, যদি চিকিৎসার দরকার হয় তার ব্যবস্থা করবেন বাড়ির পুরুষ মানুষটি, তাঁর স্বামী।
কাশিয়াবাগানের এই বাগানবাড়িটি বিশাল। দেওয়াল দিয়ে ঘেরা প্রায় পাঁচ বিঘের চৌহদ্দি, গৃহটির সামনে-পিছনে উদ্যান, এক পাশে একটি মিষ্টি জলের পুকুর। এই পুকুরটি এমনই বিখ্যাত যে পাড়া-প্রতিবেশীরা এখান থেকে কলসি ভরে খাবার জল নিয়ে যায়, জানকীনাথ তাতে আপত্তি করেন না। কাছেই উল্টোডাঙ্গার খাল, পূর্ববঙ্গ থেকে চাল নিয়ে বড় বড় নৌকো এখানে এসে ভেড়ে, একটা ছোটখাটো গঞ্জের পরিবেশ। এ বাড়িতে প্রতি অপরাহ্নেই আত্মীয়-বন্ধু সমাগম হয়, সাহিত্য আলোচনা চলে, স্বর্ণকুমারী নিজের নতুন রচণা পাঠ করে শুনান। এরকম পরিবেশ তিনি পছন্দ করেন। তাঁর দুই ভাই জ্যোতি ও রবির মতন সাহিত্যজগতে তাঁর অগ্রগমন অব্যাহত।
রবির বিয়ের কিছুদিন পরই কাশিয়াবাগানের এ বাড়িতে আর একটি বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। ঘোষাল পরিবারে জ্যেষ্ঠ কন্যা হিরণ্ময়ীর বিবাহ, পাত্রটি পূর্ব পরিচিত। হিরণ্ময়ীর পিসেমশাইয়ের ভাই ফণিভূষণ মুখুয্যে এ বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া-আসা করত, দুজনেই পরস্পরকে পছন্দ করেছে। পাত্রটিও উচ্চ শিক্ষিত।
সাধারণ, সংসারী, কন্যার মায়েদের মতন, বিয়ের সময় কী কী শাড়ি কেনা হবে, কত সেট গয়না আসবে কিংবা নিমন্ত্রিতদের তালিকা কতটা দীর্ঘ হবে, এ নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে চান না। স্বর্ণকুমারী। ওসব তো ঠিকই হয়ে যাবে। বিয়ের উৎসবটা কী ভাবে অভিনব করা যাবে, তা নিয়েই তাঁর প্রধান চিন্তা। সে রাতে একটা নাটকের অভিনয় করলে কেমন হয়। তাঁর এই প্রস্তাবে অনেকেই সম্মতি জানাল। তবে বেশি দিন দেরি নেই, সংলাপ মুখস্থ করার, রিহার্সালের তত সুযোগ পাওয়া যাবে না। গীতি-নাট্য হলে বেশ হয়। সংলাপ মুখস্থ করার চেয়ে গান শেখা সহজ। তা ছাড়া কিছু কিছু গান তো আড়াল থেকেও গেয়ে দেওয়া যায়।
কে রচনা করবে গীতি-নাটক? সময় সংক্ষেপের জন্য সবাই মিলে লিখলেই তো হয়। একবার যেমন “বাল্লীকি প্রতিভা” তৈরি হয়েছিল অনেকের গান নিয়ে। যে-যে গান লিখতে পারে লিখে ফেলবে, একসঙ্গে বসে সুর দেওয়া হবে, আর গানগুলি জুড়ে দেবার জন্য একটা ক্ষীণ কাহিনীসূত্র থাকলেই হল। স্বর্ণকুমারী স্বয়ং গান রচনা করেন, আছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, পিয়ানোয় বসে নতুন নতুন সুর তৈরি করায় তার জুড়ি নেই, রবিকে বললেই সেই সুরে কথা বসিয়ে দিতে পারে, তা ছাড়াও ডেকে আনা হল কবি অক্ষয় চৌধুরীকে।
বৈঠকখানাঘরে প্রতিদিন বসতে লাগল। গান-রচনার আসর। গৃহকর্ত্রী এখানেই ব্যস্ত থাকেন, বিয়ের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করছেন তার স্বামী। গান রচনায় বড় আমোদ। কখনও কখনও এক একটি পঙক্তি অতি ব্যক্তিগত হয়ে যায়, তখন হাসির হার-রা ওঠে। নতুন নতুন সুরের একটা মায়া আছে। ক্লান্তি আসে না। আসর ভাঙতে ভাঙতে অনেক রাত হয়ে যায়। এর মধ্যে অবশ্য পানাহারের বন্দোবস্ত থাকে ঠিকই।
বয়স্কদের আড্ডায় ছোটরা কক্ষনও ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না, স্বর্ণকুমারী এরকম কঠোর নির্দেশ আছে। কিন্তু এখন সেই নির্দেশ শিথিল করা হয়েছে। হিরণ্ময়ীর বন্ধু ও ঠাকুরবাড়ির অন্য মেয়েরাই তো অভিনয় করবে। বয়স্করা থাকবেন অন্তরালে। এক একটা গান তৈরি হলে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের। অন্য কোনও নামের বদলে এই নাটিকার নাম রাখা হয়েছে ‘বিবাহোৎসব’।
রবিকে সব দিন এখানে পাওয়া যায় না।
‘ছবি ও গান’ বইটি ছাপা নিয়ে রবি বেশ ব্যস্ত। নির্ভুল করার জন্য সে প্রেসে গিয়ে প্রুফ দেখে। কবিতার একটি শব্দও ভুল ছাপা হলে কবির শরীরে যেন ছুরির আঘাত লাগে। সামান্য একটা আকার বা-ইকার বাদ গেলেও যে ছন্দপতন হয়, তা তো পাঠকদের ডেকে ডেকে বোঝানো যায় না।
‘ছবি ও গান’ ছাপা শেষ হয়ে গেল, এখন উৎসর্গপত্র বাকি। কাকে উৎসর্গ করবে, রবি ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। ‘প্ৰভাতসঙ্গীত’ দিয়েছে বিবিকে। এই বইখানি কি নিজের স্ত্রীকে দেওয়া উচিত? সে এই কবিতাগুলির মর্ম কী বুঝবে? তা ছাড়া এত তাড়াতাড়ি নিজের স্ত্রীকে কাব্য উৎসর্গ করলে সবাই যদি তা নিয়ে বিদ্রূপ করে?
আসলে রবির সবকটি বই-ই শুধু একজনকে দিতে ইচ্ছে করে। সে-ই তো তার প্রতিটি কবিতা পড়ে, প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়, আবার অপছন্দের কথা জানাতেও দ্বিধা করে না! মান-অভিমান, রঙ্গ-কৌতুকে সে-ই তো এতদিন মাতিয়ে রেখেছে, এই কাব্যটির প্রায় প্রতিটি কবিতা রচনার সঙ্গে রয়েছে তার ব্যক্তিগত স্মৃতি। কিন্তু একাধিক বই তাকে উৎসর্গ করলেও যদি অন্য কেউ কিছু মনে করে। “ভগ্নহৃদয়ে’র শ্ৰীমতী হে যে কে, তা অনেকেই বুঝে ফেলেছে।
কিন্তু এই বইখানি আর কারুকেই দেওয়া যায় না।
রবি প্রথমে লিখল, ‘গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার বসন্তে মালা গাঁথিলাম।‘
একটু ভেবে সে আবার যোগ করল, “যাহার নয়ন কিরণে প্রতিদিন প্রভাতে এই ফুলগুলি একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, তাহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম।”
বাঁধোবার পর প্রথম কপিটি তো তার হাতেই তুলে দিতে হবে।
ব্ৰাহ্মসমাজ প্রেস থেকেই রবি সোজা চলে এল জোড়াসাঁকোয়। ফেব্রুয়ারি মাস, শীত শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু বসন্ত টের পাওয়া যায় না, এর মধ্যেই গরম পড়তে শুরু করেছে। বিকেলবেলায় আকাশে দেখা যায়, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে বিদেশি হংস।
কাদম্বরীর ঘরের দরজা খোলা। তিনি একটা জানলার পাশে বসে আছেন বাইরে তাকিয়ে। ঘর একটু একটু অন্ধকার, কিন্তু বাইরে এখনও শেষ সূর্যের আলো আছে। এই জানলা দিয়ে বাগানের অনেকখানি দেখা যায়। একেবারে কাছেই একটা বড় বকুল গাছ, সেখানে কিচির-মিচির করছে অসংখ্য পাখি, বাগানের অন্য গাছের তুলনায় এই গাছটাকে পাখিরা বেশি পছন্দ করে।
রবি ডাকল, নতুন বউঠান!
কাদম্বরী ফিরে তাকালেন। কিন্তু ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালেন না, ছুটে রবির হাত ধরলেন না, তার নামে কোনও অনুযোগ করলেন না, কিছুই না। শুধু একবার তাকালেন মাত্র।
– রবি কয়েক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমার শরীর ভালো আছে।
কাদম্বরী মাথা হেলিয়ে বললেন, হ্যা।
রবি আবার জিজ্ঞেস করল, ঘরে বাতি জ্বলোনি?
কাদম্বরী উত্তর না দিয়ে এমনভাবে চেয়ে রইলেন, যাতে মনে হয়, বাতি জ্বালা না-জ্বালায় কিছু আসে যায় না। রবি বলল, নতুন বউঠান, এই আমার ছবি ও গান।
কাদম্বরী হাত বাড়িয়ে সেটা নিলেন। অলসভাবে ওলটালেন কয়েকটি পৃষ্ঠা, উৎসর্গের লেখাটি পড়ে শুধু বললেন, গত বৎসর। তারপর রেখে দিলেন। বইটি এক পাশে।
এর আগে রবির অন্য যে-কোনও বই পেলে তিনি উৎফুল্ল হয়ে প্রথমেই গন্ধ শুঁকতেন। প্রতিটি পৃষ্ঠা দেখতেন, কেন কোন কবিতাটি আগে দেওয়া হয়েছে, কোনটি শেষে, তা নিয়ে প্রশ্ন করতেন। এখন যেন তাঁর কোনও উৎসাহই নেই।
কেন যে এই অনাসক্তি, তার কারণটা রবি জানে, সেইজন্যই প্রশ্ন করতে সাহস করল না। জ্ঞানদানন্দিনী যে এঁর কাছ থেকে জোর করে রবিকে সরিয়ে নিচ্ছেন। এঁর স্বামীকে নিজের দিকে টেনেও নিরস্ত হননি, রবিকেও তার চাই। কাদম্বরীকে নিঃসঙ্গতার শাস্তি দিয়েই তাঁর আনন্দ। নতুন বউঠানেরও দোষ আছে, তিনি শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকেন কেন, স্বামীর সঙ্গে বেরুতে পারেন না?
নতুন বউঠান দিনের পর দিন এই ঘরে একা বসে থাকবেন, প্রতিদিন এরকম বিকেল-সন্ধেবেলা রবি কি তাকে সঙ্গ দিতে পারে এখন? তার ইচ্ছে থাকলেও পারবে না। সারা বাড়িতে ফিসফাস শুরু হয়ে যাবে। তা ছাড়া রবিরও তো এখন বাইরে অনেক কাজ। আগের মতন, কাদম্বরীর অভিমান ভাঙাবার মতন অনন্ত অবসর যে তার নেইই। চন্দননগরে মোরান সাহেবের বাগানবাড়ির দিনগুলি এখন নিতান্তই এক সুখস্বপ্ন!
রবি বলল, নতুন বউঠান, এখন স্বর্ণদিদির বাড়িতে রোজ কত মজা হয়, কত গান হয়, তুমি সেখানে আস না কেন?
কাদম্বরী ক্লিষ্ট স্বরে বললেন, ওখানে আমার যেতে নেই। আমি যে অপয়া।
রবি তীব্র প্রতিবাদ করে বলল, যাঃ, এ কী বলছ, তুমি, ছিছিছি!
কাদম্বরী বললেন, ঠাকুরঝি’র মেয়ে উৰ্মিলা, আমার কাছে আসত, আমার হাতে খেত, আমরা এখানেই শুয়ে থাকত। আমি তাকে মেরে ফেলেছি। সবাই বলে, আমি আঁটকুড়ী, তাই হিংসেয় আমি স্বর্ণদিদির মেয়েটাকেও খেয়ে ফেলেছি!
রবি বলল, ইস, ছিছি, এমন কথা কক্ষনও আর উচ্চারণ করবে না। ওটা তো একটা দুর্ঘটনা। তোমার নামে অমন কথা কেউ কক্ষনও বলে না।
কাদম্বরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বলে না বুঝি? কী জানি! আমি যেন সৰ্বক্ষণ শুনতে পাই, আমার আড়ালে এ বাড়ির সবাই গুজগুজ করে বলছে, অপয়া। অপয়া। ওই বউটা অপয়া!
রবি কাতরভাবে বলল, ভুল, ওটা তোমার মনের ভুল! তুমি সৰ্বক্ষণ ঘরে বসে থাক. বাইরে বেরোও, সবার সঙ্গে মিশে দেখো, কতজন তোমাকে ভালোবাসে, স্বর্ণদিদির বাড়িতে গান-বাজনার মধ্যে গিয়ে পড়লে তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে!
কাদম্বরী বললেন, যদি ওরা আমাকে… আমার যেতে ইচ্ছে করে না রবি, আমার মন চায় না। তুমি যাও—
তিনি আবার জানলার বাইরে চোখ ফেরালেন। এখন বাইরেও প্রায়ান্ধকার।
রবি কাছে এসে কাদম্বরীর কাঁধে হাত রেখে ব্যাকুল হয়ে বলল, নতুন বউঠান, চলো, আমার সঙ্গে চলো, তোমাকে দেখলে সবাই খুশি হবে।
রবিকে হাত দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে কাদম্বরী ঠাণ্ডা গলায় বললেন, তুমি যাও, রবি! তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
রবির পক্ষে সত্যি আর থাকার উপায় নেই। এখানে আর কাকুতিমিনতি করেও লাভ হবে না বোঝা যাচ্ছে। ওখানে দেরি হলে সে কী কৈফিয়ত দেবে?
কাশিয়াবাগানের বাড়িতে সেই সন্ধ্যায় সবাই বিশেষ করে রবির জন্য অপেক্ষা করছে। নাটকের এক জায়গায় একটা মোচাড়ের জন্য, নায়িকাকে দেখে নায়কের মোহিত হয়ে যাওয়া বোঝাবার জন্য একটা গান দরকার। কোনও গানই পছন্দ হচ্ছে না। স্বর্ণকুমারী বা অক্ষয় চৌধুরী দু’-চার লাইন বলেছেন, তা বাতিল করে দিচ্ছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বসেছেন পিয়ানোতে। মেঝেতে কার্পেট পাতা, তাতে বসেছে। হিরণ্ময়ীর সমবয়েসী আট দশটি মেয়ে। স্বর্ণকুমারী ও অক্ষয়চন্দ্র বসেছেন দুটি সোফায়। সবার সামনে সামনে খাবারের প্লেট।
রবি ঢুকতেই সবাই হইহই করে উঠল।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, কোথায় ছিলি, রবি? আমরা চাতক পাখির মতন তোর জন্য বসে আছি! জুতো-মোজা খুলে রবি কার্পেট এসে বসল। ছোটরা তাকে পছন্দ করে। তার গান বেশি ভালোবাসে, কারণ, রবির গান সহজ, সবাই বুঝতে পারে। অন্যদের গানের কথা বড় খটোমটো।
স্বর্ণকুমারী অক্ষয়চন্দ্রকে আদেশ করলেন, ওকে সিচুয়েশানটা বুঝিয়ে দিন।
জোড়াসাঁকো থেকে উল্টোডাঙ্গা পর্যন্ত আসতে আসতে রবির চোখের সামনে শুধু একটাই ছবি ভেসে আছে। মন ভরে গেছে বিষাদে। তার পক্ষে অন্য ভাব আনা এখন সম্ভব নয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পিয়ানো ছেড়ে এস্রাজ নিয়ে বললেন, এই মিশ্র খাম্বাজের সুরাটা কেমন দেখ তো?
রবি আচ্ছন্নের মতন বলল, ওই জানলার কাছে বসে আছে, করতলে রাখি মাথা…তারপর এস্রাজের সুরের সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে যেতে লাগল। :
…চোখের উপরে মেঘ ভেসে যায়,
উড়ে উড়ে যায় পাখি
সারাদিন ধরে বকুলের ফুল
ঝড়ে পরে থাকি থাকি
রবির চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমন আর কখনও হয়নি, নতুন বউঠান একা বসে আছেন, সে তাঁর পাশে বসে সঙ্গ দিতে পারল না। কিছুদিন আগেও এটাই তো ছিল তার শ্ৰেষ্ঠ আনন্দ। অন্য সব কাজ তুচ্ছ। অন্যে কে কী ভাববে, এমন কথা তো তার আগে কখনও মনে আসেনি। আজ নতুন বউঠান তাকে দূরে ঠেলে দিলেন। সেও তো চঞ্চল হয়ে চলে এল।
এখানে সবাই কত আনন্দ করছে, কেউ তো একবারও জিজ্ঞেস করে না, কাদম্বরী আসে না কেন? জ্যোতিদাদা জাহাজ নিয়ে সারা দিন ব্যস্ত, সেখান থেকে সরাসরি চলে আসেন এ বাড়িতে। গাড়ি পাঠিয়েও তো নতুন বউঠানকে আনানো যেত, কারুর মনে পড়ে না। সে কথা! তিনি অন্ধকার ঘরে চুপ করে একা বসে আছেন।
ওই জানলার কাছে বসে আছে, করতলে রাখি মাথা…