1 of 3

৩২. থানায় যাওয়ার আগে ধ্রুব

॥ ৩২ ॥

থানায় যাওয়ার আগে ধ্রুব কয়েক মিনিট সময় নিয়েছিল। রওনা হয়েও ফটকের ওপাশ থেকে ফিরে এল। পুলিশ অফিসারটিকে বাইরের ঘরে বসিয়ে খুব দ্রুত রেমির হাত ধরে টেনে আনল শোওয়ার ঘরে। চাপা জরুরী গলায় বলল, সোরাব-রুস্তম! বুঝলে? সোরাব-রুস্তম!

রেমি বুঝল না। দিশাহারা হয়ে ধ্রুবর মুখের দিকে চেয়ে বলল, তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে? তোমাকে!

ধ্রুব একটু ফিচেল হাসি হেসে বলল, তুমিও তো এরকমই একটা কিছু করবে বলেছিলে! বলোনি, থানায় যাবে?

বলেছি। কিন্তু সত্যিই তো আর যেতাম না।

তুমি যাওনি, কিন্তু অন্য একজন গেছে। ফল একই।

কে গেছে?

বললাম যে, সোরাব-রুস্তম।

তার মানে কী?

বসে বসে ভাবো, ঠিক বুঝতে পারবে।

না পারব না। আমার মাথা গুলিয়ে গেছে।

মিনিস্টারের বাড়িতে পুলিশ তার ছেলেকে ধরতে আসে, ব্যাপারটা এদেশে একটু অস্বাভাবিক নয় কি?

রেমি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। শ্বশুরমশাই থাকতে—

শ্বশুরমশাইয়ের মুখখানা ভাল করে লক্ষ করেছো?

খুব বিচলিত মনে হচ্ছিল।

বিচলিত ঠিক নয়, একটু নারভাস। তবে সেটা পুলিশের ভয়ে নয়।

তবে?

আমার ভয়ে।

তোমার ভয়ে? তোমাকে উনি ভয় পান নাকি?

এমনিতে পান না। কিন্ত পচা শামুকেও তো পা কাটে।

বুঝলাম না।

তোমার আই কিউ অ্যাভারেজের চেয়ে কম।

বুঝিয়ে বলল, তোমাকে উনি ভয় পাবেন কেন?

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল, থাক না, সবটুকু আমি বুঝিয়ে নাই বা দিলাম। আমি থানায় যাচ্ছি, তুমি বসে বসে বরং ধাঁধাটার জবাব খুঁজে বের করো। ধাঁধাটার সূত্র ওই একটাই, সোরাব ভারসাস রুস্তম।

থানায় কি এখন তোমাকে আটকে রাখবে?

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, আরে না। আটকানোর আইনই নেই। তবে রাতটা ইনটারোগেশনের নামে কাটিয়ে দিতে পারে। চলি, গুডনাইট।

ধ্রুব ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পিছু পিছু রেমি।

ধ্রুব ঘর থেকে বেরিয়েই বাঁ দিকে বাইরের ঘরে যেতে দু পা এগিয়েই হঠাৎ থমকে গেল। তারপর আচমকা পিছু ফিরে রেমিকে বলল, ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দাও। তুমি কিছু দেখনি, কিছু শোনোনি।

রেমি আঁতকে উঠে বলে, তার মানে? কী করবে তুমি?

ধ্রুব চাপা গলায় বলল, ঘরে যাও রেমি। মজাটা আর একটু জমিয়ে দিই। যাও, কেউ জিজ্ঞেস করলে কিছু বোলো না। বোলো, তুমি জানো না।

রেমি কম্পিত বুকে দরজা বন্ধ করল।

পরমুহূর্তেই দরজায় টোকা পড়ল আবার।

রেমি; রেমি!

রেমি দরজা খুলে বলে, কী গো?

হাতের কাছে একটা ব্যাগট্যাগ কিছু আছে?

আছে।

গোটাকয়েক শাড়ি আর যা পারো গুছিয়ে নাও। আমারও গোটাকয়েক জামাপ্যান্ট। কুইক! প্রশ্ন কোরো না। সময় নেই।

রেমি উদ্‌ভ্রান্তের মতো পাগলের আদেশ পালন করল। দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই গোছানো হয়ে গেল। কারণ ধ্রুবর টুর থাকে বলে একটা ফাইবারের সুটকেস গোছানোই থাকে। রেমি শুধু নিজেরটা গোছালো। দরজায় ধ্রুব পাহারা দিচ্ছে।

রেমি বুঝতে পারছিল, ধ্রুব তাকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে এবং সেটা খুব বিধিসঙ্গতভাবে যাচ্ছে না। সম্ভবত শ্বশুরমশাই খবরটা জানবেন না এবং বাইরের ঘরের পুলিশ অফিসারও কিছু টের পাবেন না। সাধারণ অবস্থায় রেমি নিশ্চয়ই ধ্রুবর এই প্রস্তাবে রাজি হত না। কিন্তু এখন তার মনের অবস্থা স্বাভাবিক নয়। সকাল থেকে তার চারদিকে এমন সব ঘটনা ঘটছে যে তার মাথা গুলিয়ে গেছে। এই অ্যাডভেনচার হয়তো সে মনে মনে চাইছিল।

সুটকেস আর ব্যাগটা হাতে নিয়ে ধ্রুব পিছনের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পিছু পিছু রেমি। চাকরবাকররা দেখল, কিন্তু কেউ উচ্চবাচ্য করল না। তারা ধ্রুবকে চেনে।

পিছন দিককার ছোট্ট বাগানের ফটক দিয়ে বেরোলে একটা গলি পাওয়া যায়। নোংরা গলি। কখনো রেমি এ গলিতে পা দেয়নি। গলিটা পেরিয়ে রাস্তায় উঠে ধ্রুব চট করে একটা মিটার নামানো ট্যাকসিকে ধরল। এ তল্লাটের ট্যাকসিওয়ালারা ধ্রুবকে মোটামুটি চিনে রেখেছে। তারা বেগরবাঁই করে না।

হাওড়া স্টেশনে এসে ধ্রুব মাত্র আধ ঘণ্টার প্রয়াসে পুরীর দুটো বার্থ রিজার্ভ করে ফেলল।

ট্রেনে ওঠার পর রেমি দম নিচ্ছিল। এইরকম হুটোপাটা করে কোথাও যাওয়া তার জীবনে এই প্রথম! বিবাহিত জীবনে শ্বশুরমশাইয়ের অনুমতি না নিয়ে ঘর থেকে বেরোনোও এই প্রথম। কাজটা কেমন হল তা সে বুঝতে পারছে না।

ধ্রুব ফার্স্ট ক্লাসের টিকিটই করেছে, কিন্তু কুপে নয়। আরো দুজন যাত্রী আছে। তারা প্রবীণ এক দম্পত্তি। তাদের তুলে দিয়ে যেতে ছেলেমেয়ে নাতিনাতনীরা এসেছে। কামরায় বেশ ভীড়।

জড়োসড়ো হয়ে রেমি একধারে বসে ছিল। ধ্রুব গেছে খাবার আনতে। বাইরে বেরোনোর পোশাক অবশ্য তার পরাই ছিল। বদলানোর সময় পায়নি। তাই একদিক দিয়ে রক্ষে।

নানারকম দুশ্চিন্তার মধ্যেও তার হঠাৎ একটু হাসি পেল। তাদের বাইরের ঘরে বসে পুলিশ অফিসার ভদ্রলোকটি এখন কী করছেন? হাই তুলছেন কি?

গাড়ি ছাড়ার মুখে ধ্রুব খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে এসে উঠল। তার মুখে বিশ্বজয়ীর হাসি।

গাড়ি ছাড়লে কামরাটি অপেক্ষাকৃত নির্জন হয়ে গেল।

ধ্রুব বেমির কাছ ঘেঁষে বসে বলল, একটা জিনিস খুব মিস হয়ে গেল, বুঝলে:

কী মিস হল?

মাল। একটা বোতলও যদি সঙ্গে থাকত।

প্রৌঢ় দম্পতি দুজনেই ওদের আড়চোখে লক্ষ করছিলেন। রেমি ছোট্ট একটা চিমটি দিয়ে বলল, চুপ। শুনবে।

ধ্রুব কানে কানে বলল, বুড়োটা মালের পার্টি। নাকটা দেখেছো? লাল। এর কাছে জিনিস আছে।

রেমি লজ্জায় সিঁটিয়ে গিয়ে বলল, চুপ করবে কিনা!

করছি। অ্যাডভেনচারটা কেমন লাগছে?

কী করছি তা বুঝতেই পারছি না।

তোমাকে বুঝতে হবে না। যা করেছি আমি করেছি। মিনিস্টারের গুহা থেকে তোমাকে বের করে এনেছি। দুঃখ শুধু, তর্জন গর্জনটা শুনতে পাবো না।

তোমার ভয় করছে না?

কীসের ভয়?

পুলিশ যদি ক্ষেপে যায়!

পাগল! পুলিশের বড় দায় পড়েছে কিনা।

যদি হুলিয়া বের করে!

করবে না।

রেমি কাঁচুমাচু মুখে বলল, আমার বাবা আর জয়ন্ত মিলে এটা করেছে। কেন যে করল! ওরা কি জানে না তোমাকে পুলিশে ধরলে ওদেরও অপমান!

নিশ্চয়ই জানে। তার চেয়েও বড় কথা আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিলে ওদের অন্যরকম বিপদও হতে পারে। সেই মিস্টিরিয়াস জীপগাড়ি আর সেই লোকগুলো তো খুব সোজা পাত্র নয়। তাই জয়ন্ত বা তোমার বাবা একাজ করেননি।

রেমি বলে, তাহলে কে করল?

বুঝতে পারোনি? সোরাব-রুস্তম।

সব সময়ে হেঁয়ালি ভাল লাগে না। তুমি বলতে চাইছো শ্বশুরমশাই নিজে তোমাকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন?

এতক্ষণে মাথা খেলছে তোমার।

যাঃ, কী যে বাজে কথা বকো না।

লোকটাকে তুমি চেনো না রেমি।

রেমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। চিন্তা করল। তার ছোট্ট মাথায় এত চিন্তা ধরতে চায় না। কেমন ঝিম ঝিম করে।

হঠাৎ চোখ চেয়ে বলল, তাই পালিয়ে এলে! পুলিশের ভয়ে?

ধ্রুব মাথা নাড়ল, পুলিশকে আমার ভয় নেই। ওরা আমার বিরুদ্ধে কেস দিতে পারত না। দিলেও টিকত না। একটু হ্যারাস করত হয়তো।

তাহলে?

কৃষ্ণকান্ত চৌধুরীকে একটু পাল্টি দিচ্ছি।

কিন্তু তুমি যে পরিবারের কোনো প্রথা ভাঙতে চাও না। তবু শ্বশুরমশাইকে না বলে আমাকে নিয়ে এলে কেন?

ওইটাই তো হ্যারাসমেন্ট, আমি একা পালালে মন্ত্রীমশাই খুব একটা গা করতেন না, কিন্তু পুত্রবধূকে লোপাট করলে গা করবেন।

তুমি একটা পাগল।

সে কথা অনেকবার বলেছো।

রেমি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার মনে হয়েছিল, বুঝি আমাকে নিয়ে আলাদা একটা হানিমুন করার ইচ্ছে হয়েছে তোমার।

তাও হয়তো হয়েছে। ধরে নাও এটা হানিমুন দ্বিতীয় পর্ব।

ও বাবাঃ, প্রথম পর্ব যা গেছে, দ্বিতীয় পর্বে আর দরকার নেই।

কেন, প্রথমটা কি খুব খারাপ হয়েছিল? শুধু প্রেম তো একঘেয়ে ব্যাপার। তার সঙ্গে একটু রহস্য রোমাঞ্চ আর মারদাঙ্গা যোগ হওয়ায় ব্যাপারটা জমে গিয়েছিল না?

আমার আর জমার দরকার নেই।

আচ্ছা, এবার আর ওরকম হবে না।

কদিনের জন্য যাচ্ছি?

বেশীদিন নয়। টাকা ফুরোলেই ফিরে আসব।

আমি কি তোমার হোসটেজ?

এ কথায় আচমকা সবাইকে চমকে দিয়ে হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে ধ্রুব। বলে, বাঃ, দারুণ বলেছো তো! হোসটেজ! মাইরি, তোমার মাথাটা তো তেমন নীরেট নয়!

রেমি প্রৌঢ় দম্পতির দিকে চেয়ে একটু সংকুচিত হয়ে বলল, এই, কী হচ্ছে!

ধ্রুব নিজেকে সামলে নেয়।

আশ্চর্য এই যে, ধ্রুবর অনুমান ঠিক। প্রৌঢ় লোকটি একটু পরেই তার সুটকেস থেকে এক হুইস্কির বোতল বের করে ফেলে। লোকটার চেহারায় বেশ আভিজাত্য আর অহংকারের ছাপ আছে। কর্তৃত্ব করতেই অভ্যস্থ বোঝা যায়। খানিকটা বোধ হয় কৃষ্ণকান্তের ছায়া।

ধ্রুব চট করে ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল।

চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া রেমির আর কিছুই করার ছিল না। তবে প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা রেমিকে খানিকক্ষণ সঙ্গ দিলেন। ধ্রুব আর প্রৌঢ় ভদ্রলোক বোতলে জমে গেল!

ধ্রুবর সঙ্গে বাস করে রেমির একটা জ্ঞানলাভ ঘটেছে। বোতল জিনিসটা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ লুপ্ত করে দেয়।

পুরীতে রেমি নতুন নয়। আগে আরো বার দুই এসেছে। ধ্রুবর সঙ্গে অবশ্য এই প্রথম। আর কী আশ্চর্য! ধ্রুব সঙ্গে আছে বলেই বোধহয় তার কাছে পুরী এবার সবচেয়ে মনোরম মনে হল।

সমুদ্র কি এরকম উত্তাল ছিল আগের বার? এত বিপুল, বিশাল! আকাশ কি এরকম নীল ছিল! রেমি মুগ্ধ হয়ে গেল। সম্মোহিত হয়ে গেল। যেসব সমস্যা ও সংকট পিছনে রেখে তারা চলে এসেছে তা ভুলে গেল রেমি।

ধ্রুব ঈশ্বর মানে কিনা তা রেমি আজও জানে না। তাকে কোনোদিন কোনো ঠাকুর দেবতা প্রণাম কবতে দেখেনি সে। আবার নাস্তিকতার সপক্ষেও কোনোদিন কিছু বলেনি।

কিন্তু ধ্রুবকে এসব বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয় না। রেমি সর্বদা যেন একটি অতি অনুভূতিশীল জ্যান্ত বিস্ফোরক নিয়ে কারবার করছে। একচুল ভুলচুক হলেই সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটবে। তাই আজকাল ধ্রুবর সঙ্গে সে একটু হিসেব করে কথা বলতে শিখেছে। সে জেনে গেছে, তার স্বামীটির জন্ম যে রাশি বা লগ্নে সেই বাশি বা লগ্নের লোকেরা ইহজন্মে স্ত্রীর বশ্যতা স্বীকার করে না। তাই সেই চেষ্টাও আর করে না রেমি। ধীরে ধীরে সে ধ্রুবর ব্যক্তিত্বহীন ছায়ায় পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে। বোধ হয় এছাড়া উপায়ও নেই।

দুটো দিন ধ্রুব শুধু সমুদ্র স্নান ছাড়া আর তেমন কিছু করল না। ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ল। কয়েকটা বই কিনে আনল কোথা থেকে। তাও পড়ল। কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে গেল না।

রেমি তৃতীয় দিন সকালবেলায় বলল, জগন্নাথের মন্দিরে যাবে?

তুমি যাও, ঘুরে এসো।

তুমি চল না।

একদম ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও।

একা! যদি আমার কিছু হয়?

কী হবে?

ধরো কেউ যদি পিছুটিছু নেয়!

ধ্রুব হেসে বলল, বদমাইশী হচ্ছে! আমাকে বডিগার্ড বানিয়ে নিয়ে যেতে চাও?

তুমি তো আমার বডিগার্ডই।

তা বটে, কিন্তু আত্মিক উন্নতির ব্যাপারটায় সব মানুষই একা। একাই ভাল।

আমি না তোমার সহধর্মিণী!

সেটা হলফ করে বলা মুশকিল।

কেন?

আমার ধর্ম অন্যরকম। সে ধর্ম তুমি মেনে নিতে পারবে? ধরো যদি তোমাকে একটু মালটাল খেতে বলি, খাবে?

কী যে বর্বর হয়েছে না।

তাই তো বলছি, বর্বরের ধর্ম আলাদা। তার সহধর্মিণী হতে নেই। জাস্ট বী মাই ওয়াইফ। নো রিলিজিয়াস কানেকশন। ভয় পেও না, আমাদের পরিবারের নিজস্ব পাণ্ডা আছে। তাকে খবর দিলেই আসবে। খুব গার্ড দিয়ে নিয়ে যাবে তোমাকে।

রেমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তবে জগন্নাথের মন্দিরেও সে গেল না।

তাঁদের হোটেলটা স্বর্গদ্বারের ওপর। বেশ বড়, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সামনেই সমুদ্র এবং তার অবিরাম শব্দ। রেমি সমুদ্রে নামে না। ভয় পায়। তবে জলের ধার ধরে ধরে বেড়াতে ভালবাসে। ঝিনুক কুড়িয়ে জড়ো করে অনেক। একা। ধ্রুব প্রায় সময়েই তার সঙ্গে থাকে না।

দুপুরে রেমি সমুদ্রের ধার থেকে বেড়িয়ে ফিরে আসতেই ধ্রুব বলল, আরে, তুমি কখনো সমুদ্রে স্নান করো না কেন বলো তো!

আমার বাথরুমই ভাল।

সে তো জানি। কিন্তু বাথরুমের সীমাবদ্ধতা থেকে সমুদ্রের অসীমে একটু অবগাহন করে নিলে আয়ুটা বাড়ত।

আমার দরকার নেই।

আমি সঙ্গে থাকলেও ভয়?

ও বাবা! আমি সাঁতার জানি না।

হাঁটুজলে সাঁতার জানার কী দরকার! চলল, আজ ধ্রুব নুলিয়া তোমাকে স্নান করাবে। দুটো টাকা দিয়ে দিও বখশিশ।

বখশিশ এখনিই দিচ্ছি। স্নান করাতে হবে না।

তাই কি হয়! নুলিয়ারা কাজ না করে বখশিশ নেয় না, চলো।

না না, আতঙ্কে রেমি তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকবার চেষ্টা করে।

ধ্রুব করাল যমের মতো রাস্তা আটকায়। তারপর জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিয়ে দুটো ঘুরপাক খাইয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে, ভয় পেও না। ডুবলে দুজনেই ডুবব। একই যাত্রার যাত্রী তো। চলো।

ভয় পাই যে।

ভয়টাই তো ভাঙা দরকার। ঢেউ যত বিরাট তত ভয়ংকর নয়। মানুষ বাইরেটা দেখে ভয় পায়। বুঝলে! যেমন মন্ত্রীমশাই।

তাঁকে আবার কেন?

তাঁর সঙ্গে মিল আছে। বেশ করাল চেহারার একটি ঢেউ, কিন্তু ভিতরে ঢুকে গেলে দেখা যায়, ফোঁপরা।

মোটেই নয়।

আচ্ছা, ওটা নিয়ে বরং পরে ডিবেটে বসা যাবে। এখন চলো। সমুদ্রে নামবার মতো পোশাক আছে?

না। মোটে তো কয়েকটা শাড়ি নিয়ে এসেছি।

শাড়িতেই হবে। একটু শক্ত করে গাছকোমর বেঁধে নাও।

ভয় করছে যে!

বললাম তো ডুবলে দুজনেই ডুববো। তাছাড়া জানালা দিয়ে চেয়ে দেখ, তোমার মতো কত মহিলা স্নান করছে। কত ধুড়ি বুড়ি ছুঁড়ি। দেখছ?

দেখেছি।

চলো তাহলে।

দুরু দুরু বুকে অগত্যা যেতেই হয় রেমিকে।

ঢেউ দেখে যত পা এগোয় তার দ্বিগুণ পিছিয়ে যায় রেমি। ও বাবা, সে বাঁচবে না নামলে। দুম দাম শব্দে জল এসে ফাটছে বালুর ওপর।

কিন্তু ধ্রুব ছাড়ার পাত্র নয়। শক্ত করে হাত চেপে ধরে বলল, যদি না নামো তাহলে আজই আমি ব্রেকিং পয়েন্ট পেরিয়ে চলে যাবো।

তার মানে?

আর ফিরব না। আমার জানের পরোয়া নেই, জানো তো?

কী যে সব বলো না।

রেমি প্রায় ঢেউয়ের ধাক্কাতেই পড়ে যাচ্ছিল। কী প্রলয়ংকর ব্যাপার! যেন এক পাহাড় এসে ভেঙে পড়ল মাথার ওপর। কান বন্ধ হয়ে গেলে। মুখে ঢুকে গেল নুন আর বালি মেশানো জল। হাঁপসে সে অস্থির।

তবে ভেসে গেল না রেমি। ধ্রুব ধরে ছিল তাকে।

প্রথম ঢেউটা সরে যাওয়ার পর দম নেওয়ার একটু অবকাশ পেতে না পেতেই দ্বিতীয় ঢেউটা দোতলা বাড়ির সমান হয়ে ধেয়ে এল।

রেমি চেঁচাল, বাবা গো!

কিন্তু তার কোমর ধরে দুটো সবল হাত তাকে ওপরে তুলে দিল। ঢেউয়ের ওপরে। চমৎকার এক নৃত্যপর দোলাচল। পড়ে গেল রেমি, কিন্তু ধ্রুব তাকে ছাড়ল না। টেনে তুলে নিল। পায়ের নীচে সরষেদানার মতো বালি সরে যাচ্ছে। এক শিরশিরে অনুভব।

ভয় ভেঙে গেল তৃতীয় ঢেউটার পর।

ধ্রুব বলল, ডুব দিও না। মুখোমুখি ঢেউটাকে কনফ্রণ্ট কোরো না। কাত হয়ে দাঁড়াও। লাফাও।

রেমি তাই করল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে সমুদ্রের গভীর ভালবাসায় পড়ে গেল। বাঃ, এরকম তার জীবনে কিছুই তো ঘটেনি আগে!

ঘন্টার পর ঘণ্টা কাটাল দুজন জলে। জীবনে যত ক্ষোভ ছিল রেমির, যত অভাববোধ তা এক মহাসমুদ্রের ঢেউ এসে ধুয়ে মুছে নিয়ে যেতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *