রামের বাটীতে ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২৮শে সেপ্টেম্বর
মহাষ্টমীদিবসে রামের বাটীতে শ্রীরামকৃষ্ণ
[বিজয়, কেদার, রাম, সুরেন্দ্র, চুনি, নরেন্দ্র, নিরঞ্জন, বাবুরাম, মাস্টার ]
আজ রবিবার, মহাষ্টমী, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় প্রতিমাদর্শন করিতে আসিয়াছেন। অধরের বাড়ি শারদীয় দুর্গোৎসব হইতেছে। ঠাকুরের তিনদিন নিমন্ত্রণ। অধরের বাড়ি প্রতিমাদর্শন করিবার পূর্বে রামের বাড়ি হইয়া যাইতেছেন। বিজয়, কেদার, রাম, সুরেন্দ্র, চুনিলাল, নরেন্দ্র, নিরঞ্জন, নারাণ, হরিশ, বাবুরাম, মাস্টার ইত্যাদি অনেক উপস্থিত আছেন। বলরাম, রাখাল এখন বৃন্দাবনধামে বাস করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয় ও কেদার দৃষ্টে, সহাস্যে) — আজ বেশ মিলেছে। দুজনেই একভাবের ভাবী। বিজয়ের প্রতি) হ্যাঁগা, শিবনাথ? আপনি —
বিজয় — আজ্ঞা হাঁ, তিনি শুনেছেন। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে আমি সংবাদ পাঠিয়েছিলুম, আর তিনি শুনেওছেন।
ঠাকুর শিবনাথের বাড়ি গিয়াছিলেন, তাঁহার সহিত দেখা করিবার জন্য কিন্তু দেখা হয় না। পরে বিজয় সংবাদ দিয়াছিলেন, কিন্তু শিবনাথ কাজের ভিড়ে আজও দেখা করিতে পারেন নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়াদির প্রতি) — মনে চারিটি সাধ উঠেছে।
“বেগুন দিয়ে মাছের ঝোল খাব। শিবনাথের সঙ্গে দেখা করব। হরিনামের মালা এনে ভক্তেরা জপবে, দেখব। আর আটআনার কারণ অষ্টমীর দিনে তন্ত্রের সাধকেরা পান করবে, তাই দেখব আর প্রণাম করব।”
নরেন্দ্র সম্মুখে বসিয়া। এখন বয়স ২২/২৩। কথাগুলি বলিতে বলিতে ঠাকুরের দৃষ্টি নরেন্দ্রের উপর পড়িল। ঠাকুর দাঁড়াইয়া পড়িলেন ও সমাধিস্থ হইলেন। নরেন্দ্রের হাঁটুতে একটি পা বাড়াইয়া দিয়া ওইভাবে দাঁড়াইয়া আছেন। সম্পূর্ণ বাহ্যশূন্য, চক্ষু স্পন্দহীন!
[God impersonal and personal — সচ্চিদানন্দ ও কারণানন্দময়ী — রাজর্ষি ও ব্রহ্মর্ষি! ঈশ্বরকোটি ও জীবকোটি — নিত্যসিদ্ধের থাক ]
অনেকক্ষণ পরে সমাধি ভঙ্গ হইল। এখনও আনন্দের নেশা ছুটিয়া যায় নাই। ঠাকুর আপনা-আপনি কথা কহিতেছেন, ভাবস্থ হইয়া নাম করিতেছেন। বলিতেছেন — সচ্চিদানন্দ! সচ্চিদানন্দ! সচ্চিদানন্দ! বলব? না, আজ কারণানন্দময়ী! কারণানন্দময়ী! সা রে গা মা পা ধা নি। নি-তে থাকা ভাল নয় — অনেকক্ষণ থাকা যায় না। এক গ্রাম নিচে থাকব।
“স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ, মহাকারণ! মহাকারণে গেলে চুপ। সেখানে কথা চলে না!
“ঈশ্বরকোটি মহাকারণে গিয়ে ফিরে আসতে পারে। অবতারাদি ঈশ্বরকোটি। তারা উপরে উঠে, আবার নিচেও আসতে পারে। ছাদের উপরে উঠে, আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে আনাগোনা করতে পারে। অনুলোম, বিলোম। সাততোলা বাড়ি, কেউ বারবাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে। রাজার ছেলে, আপনার বাড়ি সাততোলায় যাওয়া আসা করতে পারে।
“এক একরকম তুবড়ি আছে, একবার একরকম ফুল কেটে গেল, তারপর খানিকক্ষণ আর-একরকম ফুল কাটছে তারপর আবার আর-একরকম। তার নানারকম ফুলকাটা ফুরোয় না।
“আর একরকম তুবড়ি আছে, আগুন দেওয়ার একটু পরেই ভস্ করে উঠে ভেঙে যায়! যদি সাধ্য-সাধনা করে উপরে যায়, তো আর এসে খপর দেয় না। জীবকোটির সাধ্য-সাধনা করে সমাধি হতে পারে। কিন্তু সমাধির পর নিচে আসতে বা এসে খপর দিতে পারে না।
“একটি আছে, নিত্যসিদ্ধের থাক্। তারা জন্মাবধি ঈশ্বরকে চায়, সংসারে কোন জিনিস তাদের ভাল লাগে না। বেদে আছে, হোমাপাখির কথা। এই পাখি খুব উঁচু আকাশে থাকে। ওই আকাশেই ডিম পাড়ে। এত উঁচুতে থাকে যে ডিম অনেকদিন ধরে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে ডিম ফুটে যায়। তখন ছানাটি পড়তে থাকে। অনেকদিন ধরে পড়ে। পড়তে পড়তে চোখ ফুটে যায়। যখন মাটির কাছে এসে পড়ে, তখন তার চৈতন্য হয়। তখন বুঝতে পারে যে, মাটি গায়ে ঠেকলেই মৃত্যু। পাখি চিৎকার করে মার দিকে চোঁচা দৌড়। মাটিতে মৃত্যু, মাটি দেখে ভয় হয়েছে! এখন মাকে চায়! মা সেই উঁচু আকাশে আছে। সেই দিকে চোঁচা দৌড়! আর কোন দিকে দৃষ্টি নাই।
“অবতারে সঙ্গে যারা আসে, তারা নিত্যসিদ্ধ, কারু বা শেষ জন্ম।
(বিজয়ের প্রতি) — “তোমাদের দুই-ই আছে। যোগ ও ভোগ। জনক রাজার যোগও ছিল, ভোগও ছিল। তাই জনক রাজর্ষি, রাজা ঋষি, দুই-ই। নারদ দেবর্ষি। শুকদেব ব্রহ্মর্ষি।
“শুকদেব ব্রহ্মর্ষি, শুকদেব জ্ঞানী নন, জ্ঞানের ঘনমূর্তি। জ্ঞানী কাকে বলে? জ্ঞান হয়েছে যার — সাধ্য-সাধনা করে জ্ঞান হয়েছে। শুকদেব জ্ঞানের মূর্তি অর্থাৎ জ্ঞানের জমাটবাঁধা। এমনি হয়েছে সাধ্য-সাধনা করে নয়।”
কথাগুলি বলিতে বলিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রকৃতিস্থ হইলেন। এখন ভক্তদের সহিত কথা কহিতে পারিবেন।
কেদারকে গান করিতে বলিলেন। কেদার গাইতেছেন:
(১) – মনের কথা কইব কি সই কইতে মানা।
দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না ৷৷
মনের মানুষ হয় যে-জনা,
ও তার নয়নেতে যায় গো চেনা, সে দুই-এক জনা,
ভাবে ভাসে রসে ডোবে, ও সে উজান পথে করে আনাগোনা ৷৷
(ভাবের মানুষ উজান পথে করে আনাগোনা।)
(২) – গৌর প্রেমের ঢেউ লেগেছে গায়।
তার হিল্লোলে পাষণ্ড-দলন এ-ব্রহ্মাণ্ড তলিয়ে যায় ৷৷
মনে করি ডুবে তলিয়ে রই,
গৌরচাঁদের প্রেম-কুমিরে গিলেছে গো সই।
এমন ব্যথার ব্যথী কে আর আছে
হাত ধরে টেনে তোলায় ৷৷
(৩) – যে-জন প্রেমের ঘাট চেনে না।
গানের পর আবার ঠাকুর ভক্তদের সহিত কথা কহিতেছেন। শ্রীযুক্ত কেশব সেনের ভাইপো নন্দলাল উপস্থিত ছিলেন। তিনি ও তাঁর দুই-একটি ব্রাহ্মবন্ধু ঠাকুরের কাছেই বসিয়াছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বিজয়াদি ভক্তদের প্রতি) — কারণের বোতল একজন এনেছিল, আমি ছুঁতে গিয়ে আর পারলুম না।
বিজয় — আহা!
শ্রীরামকৃষ্ণ — সহজানন্দ হলে অমনি নেশা হয়ে যায়! মদ খেতে হয় না। মার চরণামৃত দেখে আমার নেশা হয়ে যায়। ঠিক যেন পাঁচ বোতল মদ খেলে হয়!
[জ্ঞানী ও ভক্তদের অবস্থা — জ্ঞানী ও ভক্তদের আহারের নিয়ম ]
“এ অবস্থায় সব সময় সবরকম খাওয়া চলে না।”
নরেন্দ্র — খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে যদৃচ্ছালাভই ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — অবস্থা বিশেষে উটি হয়। জ্ঞানীর পক্ষে কিছুতেই দোষ নাই। গীতার মতে জ্ঞানী আপনি খায় না, কুণ্ডলিনীকে আহুতি দেয়।
“ভক্তের পক্ষে উটি নয়। আমার এখনকার অবস্থা, — বামুনের দেওয়া ভোগ না হলে খেতে পারি না! আগে এমন অবস্থা ছিল, দক্ষিণেশ্বরের ওপার থেকে মড়াপোড়ার যে গন্ধ আসতো, সেই গন্ধ নাক দিয়ে টেনে নিতাম এত মিষ্ট লাগতো। এখন সব্বাইয়ের খেতে পারি না।
“পারি না বটে, আবার এক-একবার হয়ও। কেশব সেনের ওখানে (নববৃন্দাবন) থিয়েটারে আমায় নিয়ে গিয়েছিল। লুচি, ছক্কা আনলে। তা ধোবা কি নাপিত আনলে, জানি না। (সকলের হাস্য) বেশ খেলুম। রাখাল বললে, একটু খাও।
(নরেন্দ্রের প্রতি) — “তোমার এখন হবে। তুমি এতেও আছ, আবার ওতেও আছ! তুমি এখন সব খেতে পারবে।
(ভক্তদের প্রতি) — “শূকর মাংস খেয়ে যদি ঈশ্বরে টান থাকে, সে লোক ধন্য! আর হবিষ্য করে যদি কামিনী-কাঞ্চনে মন তাকে তাহলে সে ধিক্।”
[পূর্বকথা — প্রথম উন্মাদে ব্রহ্মজ্ঞান ও জাতিভেদবুদ্ধি ত্যাগ — কামারপুকুর গমন; ধনী কামারিনী; রামলালের বাপ — গোবিন্দ রায়ের নিকট আল্লামন্ত্র ]
“আমার কামারবাড়ির দাল খেতে ইচ্ছা ছিল; ছেলেবেলা থেকে কামাররা বলত বামুনরা কি রাঁধতে যানে? তাই খেলুম, কিন্তু, কামারে কামারে গন্ধ১। (সকলের হাস্য)
“গোবিন্দ রায়ের কাছে আল্লামন্ত্র নিলাম। কুঠিতে প্যাঁজ দিয়ে রান্না ভাত হল। খানিক খেলুম। মণি মল্লিকের (বরাহনগরের) বাগানে ব্যান্নুন রান্না খেলুম, কিন্তু কেমন একটা ঘেন্না হল।
“দেশে গেলুম; রামলালের বাপ ভয় পেলে। ভাবলে, যার তার বাড়িতে খাবে। ভয় পেলে, পাছে তাদের জাতে বার করে দেয়। আমি তাই বেশি দিন থাকতে পারলুম না; চলে এলুম।”
[বেদ, পুরাণ, তন্ত্রমতে শুদ্ধাচার কিরূপ ]
“বেদ পুরাণে বলেছে শুদ্ধাচার। বেদ পুরাণে যা বলে গেছে — ‘করো না, অনাচার হবে’ — তন্ত্রে আবার তাই ভাল বলেছে।
“কি অবস্থাই গেছে! মুখ করতুম আকাশ-পাতাল জোড়া, আর ‘মা’ বলতুম। যেন, মাকে পাকড়ে আনছি। যেন জাল ফেলে মাছ হড়হড় করে টেনে আনা। গানে আছে:
এবার কালী তোমায় খাব। (খাব খাব গো দীন দয়াময়ী)।
(তারা গণ্ডযোগে জন্ম আমার)
গণ্ডযোগে জনমিলে সে হয় মা-খোকা ছেলে।
এবার তুমি খাও কি আমি খাই মা, দুটার একটা করে যাব ৷৷
হাতে কালী মুখে কালী, সর্বাঙ্গে কালী মাখিব।
যখন আসবে শমন বাঁধবে কসে, সেই কালী তার মুখে দিব ৷৷
খাব খাব বলি মা গো উদরস্থ করিব।
এই হৃদিপদ্মে বসাইয়ে, মনোমানসে পূজিব ৷৷
যদি বল কালী খেলে, কালের হাতে ঠেকা যাব।
আমার ভয় কি তাতে, কালী ব’লে কালেরে কলা দেখাব ৷৷
ডাকিনী যোগিনী দিয়ে, তরকারী বানায়ে খাব।
মুণ্ডমালা কেড়ে নিয়ে অম্বল সম্বরা চড়াব ৷৷
কালীর বেটা শ্রীরামপ্রসাদ, ভালমতে তাই জানাব।
তাতে মন্ত্রের সাধন, শরীর পতন, যা হবার তাই ঘটাইব ৷৷
“উন্মাদের মতন অবস্থা হয়েছিল। এই ব্যাকুলতা!”
নরেন্দ্র গান গাইতে লাগিলেন:
আমায় দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞানবিচারে।
গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর আবার সমাধিস্থ।
সমাধিভঙ্গের পর ঠাকুর গিরিরানীর ভাব আরোপ করিয়া আগমনী গাইতেছেন। গিরিরানী বলছেন, পু রবাসীরে! আমার কি উমা এসেছে? ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া গান গাইতেছেন।
গানের পর ঠাকুর ভক্তদের বলিতেছেন, “আজ মহাষ্টমী কিনা; মা এসেছেন! তাই এত উদ্দীপন হচ্ছে!”
কেদার — প্রভু! আপনিই এসেছেন। মা কি আপনি ছাড়া?
ঠাকুর অন্যদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া আনমনে গান ধরিলেন:
তারে কই পেলুম সই, হলাম যার জন্য পাগল।
ব্রহ্মা পাগল, বিষ্ণু পাগল, আর পাগল শিব।
তিন পাগলে যুক্তি করে ভাঙল নবদ্বীপ ৷৷
আর এক পাগল দেখে এলাম বৃন্দাবন মাঝে।
রাইকে রাজা সাজায়ে আপনি কোটাল সাজে ৷৷
আর এক পাগল দেখে এলাম নবদ্বীপের পথে।
রাধাপ্রেম সুধা বলে, করোয়া কীস্তি হাতে।
আবার ভাবে মত্ত হইয়া ঠাকুর গাহিতেছেন:
কখন কি রঙ্গে থাক মা শ্যামা সুধাতরঙ্গিণী!
ঠাকুর গান করিতেছেন। হঠাৎ “হরিবোল হরিবোল” বলিতে বলিতে বিজয় দণ্ডায়মান। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবোন্মত্ত হইয়া বিজয়াদি ভক্তসঙ্গে নৃত্য করিতে লাগিলেন।
১ ঠাকুর তাঁহার ভিক্ষামাতা ধনী কামারিনীর বাড়িতে গিয়াছিলেন।