নৌকো থেকে যেখানে নামা হল, সেখানে অনেক লোক ভিড় করে আছে। খালের পাড়ে উঁচু মতন বাঁধ, পাহাড়ের মতন উঠতে হয়। সেই বাঁধের ওপর বহু লোক উন্মুখ ভাবে কী যেন দেখছে। আমি ভেবেছিলাম, এরা সবাই বুঝি আমাদের নিতে এসেছে। ওপরে উঠে বুঝতে পারলাম, সেখানে একটা সাপ মারা হয়েছে–তাই ও রকম জনতা।
গ্রামের মাটিতে পা দিয়ে সেই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। একটি সাপের মৃত্যু। সাপটা আমার শরীরের চেয়েও লম্বা, তখনও সে মরেনি, একটি বহুমুখী বল্লম–যার নাম ল্যাজা–তাই দিয়ে তার পেটের কাছে গাঁথা রয়েছে মাটিতে–তেজের সঙ্গে সাপটা ফণা তুলে রয়েছে–এক এক বার ক্রুদ্ধ ছোবল মারছে মাটিতে। তখন সবাই হেসে উঠছে হো হো করে।
সাপকে সবাই ভয় পায়, গ্রামের মানুষও ভয় পায়। এখন সেই ভয়ংকর প্রাণী ব্যর্থ আক্রোশে ফুঁসছে–এটাই খুব হাসির বিষয়। এ-ওর গা ঠেলাঠেলি করছে, কেউ কেউ হাসির দমকে দুলে দুলে উঠছে–সবাই অবশ্য নিরাপদ দূরত্বে।
ভিড় ঠেলেঠুলে আমি গিয়ে উঁকি মারলাম। সাপটা তখন মাটি থেকে প্রায় দেড় হাত উঁচু ফণা তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে–একসময় তার মাথাটা স্থির হয়ে গেল। আমার মনে হল, সাপটা ঠিক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির দৃষ্টি। একটু একটু বেরিয়ে। আসছে জিভ। ভয়ে আমার বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে গেল। আমার দিকেই শুধু ও রকম ভাবে তাকাচ্ছে কেন, আমি তো কিছু করিনি!
সাপটা আবার মাটিতে ছোবল মারল। অসম্ভব শক্তি থাকে ওদের–তার টানের চোটে বল্লমটা হেলে গেল, তখন একটা আতঙ্কের চিৎকার পড়ে গেল ভিড়ের মধ্যে ঠ্যালাঠেলি আর হুড়োহুড়ি, আমিও এক দৌড় মেরেছি। জোয়ান লোকেরা হাতের লাঠি সেটা নিয়ে ধপাধপ করে পেটাতে লাগল সাপটাকে। তারপর কী হল, আমি আর দেখিনি। সেদিন রাত্রে আমি ওই সাপটাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম–আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে।
আমাদের নিতে এসেছিলেন বড়মামা ও বাড়ির দু’জন মুনিশ। তারাও দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই ভিড়ের মধ্যে। বড়মামাকে আমি প্রণাম করার পর তিনি আদর করে আমার কাঁধে এমন একটা চাপড় মারলেন যে আমার হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। বড়মামার চেহারা বিশাল দৈত্যের মতন, কুচকুচে কালো রং। তিনি অতখানি লম্বা ছিলেন বলেই অনেকে তাকে ঠাট্টা করে বলতেন, শম্ভু, ঘরে বড় ঝুল জমেছে, তুমি হাত দিয়ে ঝুল পরিষ্কার করে দাও তো!
বড়মামা আমার বাবাকে এক ধমক দিয়ে বললেন, কী মশাই, কী চেহারার ছিরি করছেন? কইলকাতা শহরে খাইতে পান না?
বাবা কিছু দিন আগেই অসুখে ভুগে উঠেছেন বলে শরীর দুর্বল। বাবা ফ্যাকাশে ভাবে হাসলেন।
খালের বাঁধের ওপরে ওঠার পর যে-দৃশ্য দেখলাম, সেই আমার স্মৃতিতে আঁকা প্রথম গ্রামের দৃশ্য। অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো মাঠ, মাঝে মাঝে ঝুপসি ঝুপসি গাছ। মাঠের মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে–তার দু’পাশে সবুজ ধানের খেত–ধানগাছের রং তখন খুবই ফিকে সবুজ, এবং এক বিঘাতের বেশি বড় নয়। এ দিকে-ও দিকে ছড়ানো কয়েকটি খড়ের বাড়ি, তারই একটি বাড়ি থেকে নিয়মিত তালে ধুপ ধুপ শব্দ হচ্ছে।
অনেক দূরে যেখানে আকাশ নিচু হয়ে নেমে এসেছে মাঠের কাছে সেইখানে একটা দোতলা বাড়ি। আমরা ওইখানে যাব। ওই বাড়ির ছাদে উঠলে আকাশ ছুঁয়ে ফেলতে পারব আমি।
ওই গ্রামে পাকা বাড়ি খুব বেশি ছিল না আমার দাদুদের বাড়িটা রীতিমতন উল্লেখযোগ্যই বলা যায়। লোকে সেটিকে বাঁড়ুজ্যেবাড়ি বলে। চলতি ভাষায় বাঠুইজ্যাবাড়ি। সে বাড়িতে সাতখানা ঘর, কিন্তু লোকসংখ্যা তার পাঁচ গুণেরও বেশি। বাড়ির সামনের দিকে ঠাকুরদালান, দু’পাশে অনেকগুলি মাটির তৈরি টিনের চালাঘর। আমরা প্রথমে এসে পাকা বাড়ির দোতলায় একটি ঘরেই জায়গা পেলাম কিন্তু আমার দাদু বরদাকান্ত বরাবর একটি মাটির ঘরেই থাকেন।
আমার দাদু এ-গ্রামের একজন গণ্যমান্য লোক, পইতে গলায় খালি গায়ে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়ান, পায়ে খড়ম–তবু লোকজন তাকে দেখলেই যেন ভয় পায়। তিনি একজন। পণ্ডিত ব্যক্তি এবং যথেষ্ট বিষয়ী। দিন দিন বিষয়সম্পত্তি বাড়িয়ে চলেছেন কোন মন্ত্রবলে কে জানে।
আমার দাদুর সাত মেয়ে ও চার ছেলে–সবাই বিবাহিত এবং পুত্রকন্যা সমেত অনেকেই দেশের বাড়িতে থাকেন। প্রথম বার চাকরি হারিয়ে আমার বাবাও এ বাড়িতে বেশ কিছু দিন আশ্রিত ছিলেন। তা ছাড়াও দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন, অসহায় বিধবারা এসে এখানে জায়গা পেয়ে যায়। মনে হয়, এ বাড়িতে প্রত্যেক দিনই নেমন্তন্ন। রান্নাঘরের বারান্দায় সব সময়ই দেখা যায় একদল লোক বসে বসে খাচ্ছে।
আমার জন্ম এ বাড়িতে। পাঁচ বছর বয়সে এই বাড়ি থেকেই, ওই খালপার ধরেই কলকাতা চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেসব আমার অস্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে, কিংবা মনে পড়ে না। হঠাৎ একটা শিউলি গাছতলায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, এই জায়গাটা আমার চেনা। আগে দেখেছি। কিন্তু কবে? মনে হয়, যেন আগের জন্মে। আগের জন্মের মতন আবছা রহস্যময়।
পুকুরপাড়ে ঘাটলার একটা ভাঙা অংশ দেখে মনে হয়, আমি জানতাম, এখানে ভাঙা থাকবে। আমি ঠিক জানতাম। অথচ মামাদের মুখে শুনি, ও-জায়গাটা ভেঙেছে মাত্র, দেড় বছর আগে অর্থাৎ আমার জানার কথা নয়।
একটি বেশ বলিষ্ঠ চেহারার বুড়ি প্রথম দিন আমাকে দেখেই আমার দু’গালে হাত রেখে বলেছিলেন, ও মা, সোনা ভাই কত বড় হইয়া গেছে! প্যান্ট পইরা সাহেব হইছে!
সেই বুড়িকে আমি একদম চিনি না–অথচ তাঁকেই আমার সবচেয়ে বেশি চেনা উচিত ছিল। এঁর নাম গণেশের মা, ইনিই প্রথম আমার নাড়ি কেটে আমাকে কাঁদিয়েছেন। ইনি আমার ধাত্রী।
প্রায়ই শুনি সেই গল্প। উঠোনের মধ্যে হয়েছিল আঁতুড়ঘর, আমার জন্মের আগে কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! সকলেরই সে-দিন মনে হয়েছিল, সৃষ্টি একেবারে ভেসে যাবে। সবাইকে। খুব যন্ত্রণা দিয়ে জন্মেছিলাম এই পৃথিবীতে। তার পরেও বেশ কিছু দিন খুব ছিঁচকাঁদুনে ছিলাম। তাই আমাকে বলা হত বাদলা ছেলে।
প্রথম প্রথম কয়েক দিন ইস্কুলে যাবার কোনও ব্যাপার নেই, কোনও শাসন নেই। মামাবাড়ির আদর খাই আর যে-দিকে খুশি ঘুরে বেড়াই। মামাবাড়ির সীমানাটা বেশ বড়–তিনটি পুকুর, তার ও-দিকে বাগান। এক একটা বাগানকে মনে হয় অরণ্যের মতো গভীর। বাগান শুনলেই ফুলের কথা মনে পড়ে–কিন্তু এইসব বাগান ফলের–আম, জাম, নারকোল, লিচু–আর বাঁশঝাড় তো সব দিকেই।
বড় পুকুরটার ওপারে বাগানটায় শিয়াল আছে। সন্ধ্যার পরই তারা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। সবাই ওই বাগানে একা একা আমাকে যেতে বারণ করেছিল। তবু এক দিন গেলাম। তখন ঠিক দুপুরবেলা, ভূতে মারে ঢ্যালার সময়। বাগানের মধ্যে নিস্তব্ধতা ঝিম ঝিম করছে। মাঝে মাঝে শুকনো পাতা উড়ে যাচ্ছে আপন মনে। বাঁশঝাড়ে এমনি খড় খড় শব্দ হয়, কিছুই দেখা যায় না। আমি এক পা করে এগোই। হাতে একটা কঞ্চি। বুকের মধ্যে একটা ছমছমে ভয়। সেই ভয়টাই নেশার মতন–ফিরতে ইচ্ছে করে না। টুপটাপ করে খসে পড়ে পাতা, আর কোথাও হাওয়া নেই তবু নারকোল গাছের ডগাগুলো কাপে।
সেই নির্জন বাগান, সেই একাকিত্ব–এর মধ্যে একটা অদ্ভুত মায়া আছে। একটু একটু মন কেমন করে, একটু একটু ভালোও লাগে। মনে হয়, সেই বাগানটার কোনও শেষ নেই–অনেক অনেক গভীরে চলে যেতে পারি–সেখান থেকে আর কোনও দিন না ফিরতে হলে বেশ হয়। কী জানি কার ওপরে গুচ্ছের অভিমান আসে বুঝতে পারি না। চুপ করে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়ার শব্দ শুনি।
মনে হয়, এখান থেকে কলকাতা অনেক দূর। আর কোনও দিন সেখানে ফেরা হবে না। বিষ্ণু, জীমূত, রেণু ওদের সঙ্গে আর দেখা হবে না কখনও। সূর্যদা কোথায় হারিয়ে গেল।
প্রথম কয়েক দিন আমার কোনও বন্ধু হয়নি। একমাত্র বন্ধু হয়েছিল নাদের আলি। নাদের আলির বয়সের গাছপাথর নেই। কালো কুচকুচে চেহারা, চেহারা খুব বড়সড় নয়–কিন্তু মনে হয় যেন লোহার তৈরি, মুখখানা দেহের তুলনায় ছোট এবং অমন সুন্দর ভাবে হাসতে আমি আর কারওকে দেখিনি। হাসির কথা উঠলেই সে বাচ্চাদের মতন লজ্জায় মুখ নিচু করে হাসে।
আমার মামাদের কোথায় একটা বিলে খানিকটা জমিদারি আছে। নাদের আলিই সেটা দেখাশোনা করে। অনেক সময় সেখানেই সে মাসের পর মাস থাকে নৌকোর ওপরে।
নাদের আলি বলে, সেই বিলটার নাম তিনপ্রহরের বিল। সেখানে যা সব কাণ্ড ঘটে, সে রকম আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও নেই। সেখানকার জলে কুমির আছে, তারা নৌকোর পাশে পাশে ভাসে এঁটোকাটা ভাত পাবার আশায়, কারোকে কামড়ায় না। আদর করে তাদের পিঠের ওপর বৈঠা দিয়ে বাড়ি মারলে তারা মোষের মতন ঘরঘর শব্দ করে। সেখানে এক একটা পদ্মফুল ফোটে–সূর্যের চেয়েও বড় সাইজের। সেই পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর খেলা করে একসঙ্গে।
নাদের আলি আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে?
নাদের আলি আস্তে আস্তে দু’দিকে মাথা দোলায়। তাতে হাঁ কিংবা না–কোনটা ঠিক বুঝতে পারি না। নাদের আলির সঙ্গে ভর দুপুরবেলা পুকুরঘাটে বসে আমি তিনপ্রহরের বিল দেখতে যাবার ষড়যন্ত্র করি।