1 of 2

৩১. নুরজাহানকে যেদিন উদ্ধার করা হল

৩১

নুরজাহানকে যেদিন উদ্ধার করা হল তার পরের পরের দিন সকালে, কাগজ খুলে পৃথু একেবারে থ। প্রথম পাতায় বাঁদিকে বিরাট হেডলাইন। “নটোরিয়াস ড্যাকয়েট গ্যাংগস কনফ্রন্ট ইচ আদার। ফোর কিলড। রিচ বিজনেস ম্যানস কিডন্যাপড সান, ওলসো মারাডারড”। তার নীচেই মৃত ডাকাত এবং লালটু সিং-এর শবের ফোটো। কুখ্যাত ডাকাত মগনলালের দলের চারজন ডাকাতকে খুন করে গেছে ডাকু শের সিং-এর দল চিলপির পথের এক পরিত্যক্ত বনবাংলোয়। তবে, ডাকু মগনলাল নিজে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। সেও ছিল দলে। মনে হয় মগনলালের দলই হাটচান্দ্রার বড় বানিয়া ভগয়ান শেঠ-এর ছেলে লালটু সিংকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছিল। পরে র‍্যানসম আদায় করার জন্যে। শের সিং ডাকু, তার দুজন সাকরেদ মোটেলাল এবং সাঁওয়া এই তিনজনেই মগনলালের দলের চারজনকে খতম করে গেছে। দলের দুজনকে মারা হয়েছে নৃশংসভাবে জবাই করে। ছুরি দিয়ে। অনুমান করা যাচ্ছে যে, এ নিশ্চয়ই মোটেলালের কাজ। কারণ, মোটেলাল এ কাজে সিদ্ধহস্ত। ইচ্ছে করলে ছুরি দিয়ে নাকি সে জ্যান্ত বাঘও জবাই করতে পারে। এখন যা দেখা যাচ্ছে তাতে আশা হয় যে, এই দুদল নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে নিজেরাই শেষ হয়ে যাবে। হাটচান্দ্রা এবং তার লাগোয়া চারদিকের এলাকাতেই এতদিন ডাকাতের উৎপাত একেবারেই ছিল না। এই শান্তিপূর্ণ এলাকাতেও, এই সব ঝামেলা আরম্ভ হল যে, এটা বড়ই দুঃখের।

খবরের কাগজওয়ালা এই খবর পেয়েছেন ভোপালের পুলিশ হেডকোয়াটার্সের মুখপাত্র মারফত।

পৃথু বিছানাতে তড়াক করে উঠে বসল। ভাল করে দু চোখ কচলাল। তারপর দুখীকে ডেকে কাগজটা পাঠিয়ে দিল রুষার কাছে, খাওয়ার টেবলে রোজ যেমন দেয়। রুষা, কুক লছমার সিংকে সারাদিনের রান্নার ইনস্ট্রাকশন দিতে দিতে খাওয়ার টেবলে বসেই চা খায়।

কিছুক্ষণ পর রুষাও দৌড়ে ঘরে এল। বলল, দেখেছ। কী কাণ্ড। হাটচান্দ্রাতেও এই সব শুরু হল। এই ব্যাপারের সঙ্গে তোমাদের শামীম মিঞার মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই তো?

পৃথু বলল, কার সঙ্গে কার সম্পর্ক? তবে, নুরজাহানকে তো আমরা পথের পাশে গাছতলায় পেয়েছি, জঙ্গলের মধ্যে। দু দলের কোনও একদল ডাকাতরাই যদি তাকে ফেলে গিয়ে থাকে তবে অন্য কথা। তা মেয়েটাই তো বোবা হয়ে গেছে। এসব কথা জানা আর যাবে কী করে?

কী সর্বনাশ! তোমরাও তো পড়তে পারতে ডাকাতদের মুখোমুখি। কী হত তাহলে?

কী আবার হত? আমরাও তো ডাকাই। পড়লে, তাদের দুদলকেই শিক্ষা দিয়ে দিতাম।

তোমার শেষ এমনি করেই হবে কোনওদিন। যেমন তোমার চেলা-চামুণ্ডা বন্ধু-বান্ধব! আ ম্যান ইজ নোন বাই দ্যা কম্পানী হী কীপস।

তা ঠিক। পৃথু বলল। অ্যাবসলুটলি রাইট।

কারখানায় যাওয়ার আগেই ফোন এল একটা। পৃথুর টেলিফোন বড় একটা আসে না বাড়িতে। এলেও, ও নিজে লেখাপড়া নিয়েই নিজের ঘরে বুঁদ থাকে বলেও এতো দূর হেঁটে এসে ড্রইংরুমে ফোন ধরতে ইচ্ছাও করে না। চিন্তার জালও ছিঁড়ে যায়। তবু, আজকের কাগজের খবর এবং ভুচুর হঠাৎ ফোন! তাই-ই অগত্যা উঠে গিয়ে ধরতেই হল।

পৃথুদা।

ও পাশ থেকে ভুচুর উত্তেজিত গলা ভেসে এল।

দেখেছ?

হুঁ।

অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত জবাব দিল পৃথু। ক্যাজুয়ালি।

রুষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল পৃথুর মুখের দিকে।

কি হুঁ?

বিরক্ত গলায় বলল ওপাশ থেকে ভুচু।

আরে, বললামই তো গাড়িতে কোনওই ডিফেক্ট নেই।

পৃথু বলল।

বলছটা কী তুমি? খবরের কাগজ পড়োনি?

উত্তেজিত হয়ে ভুচু আবার বলল।

তা আর বলতে, তোমার গ্যারাজের মতো ভাল কাজ হাটচান্দ্রাতে আর কোনও গারাজেই হয় না। তোমার মিস্ত্রিরা সব এক-একটি জিনিয়াস! আমরা কি আর জানি না সে কথা।

তোমার কি মাথা-টাথা খারাপ হয়েছে নাকি? কী সব যা-তা বলছ।

মাথা খারাপ! ওটা একটা ফ্যাকটরই নয়। তোমার বিল তো খুবই রীজনেবল। আমার অফিসে চলে এসো এগারোটা নাগাদ, বিল পাস করে দেব।

কি হচ্ছেটা কি, পৃথুদা?

হবে হবে। নিশ্চয়ই হবে। ঠিক এগারোটায় এসো। আমি আমার ঘরেই থাকব।

বলেই, খটাং করে ফোন রেখে দিল পৃথু।

রুষা ভুরু কুঁচকে বলল, আমি জানতাম। এতো পৃথুদা পৃথুদা করে কি এরা এমনি এমনি? সবই স্বার্থ। একশো টাকার কাজ করে পাঁচশো টাকা বিল করে নিচ্ছে। কোম্পানির অ্যাকাউন্ট। তোমারই বা কি আর তোমার ব্লু-আইড বয় ভুচুরই বা কী?

পৃথু, হঠাৎ রুষার দিকে ফিরে বলল, তা ঠিক। কোম্পানির হয়তো কিছুই নয়, আমাদের দুজনেরও কিছু নয়। বাট ইটস নান অফ ইওর বিজনেস আইদার।

মনটা বড়ই উচাটন হয়েছে। খবরের কাগজ পড়ে। এখানের পুলিশই শুধু নয়, ভোপালের পুলিশ হেডকোয়াটার্সেও এই খবর পৌঁছেছে। পুলিশ কি তাদের চিনে ফেলেছে? না কি অপদার্থ পুলিশ সত্যকে খুঁজে বের করতে না পেরে এই সহজ মিথ্যা চাল চালল? কাগজে যাই-ই ছাপা হয়, তাই-ই তো আর সত্যি নয়। হয়তো কমটুকুই সত্যি।

একটু তাড়াতাড়ি সেদিন বেরুল পৃথু। কারখানায় পৌঁছে একটা চক্কর লাগিয়ে এসে অফিসে বসল।

অফিসের বারান্দাতে ইতোয়ারিন বসেছিল। গুগ্গার বউ। গুগ্গা প্রেস-মেশিনে সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েছিল। হাসপাতালে ছিল মাসখানেক। ছাড়া পেয়ে বাড়িতে গেছে। তাও এক মাস হতে চলল।

ওর বউকে দেখে ডাকল পৃথু।

কী হল রে? ইতোয়ারিন?

ওর শরীরটা ভাল নেই সাহাব।

ঘা সারেনি এখনও?

ঘা সেরেছে। কিন্তু বুকে একটা ব্যথা ব্যথা হচ্ছে।

ডাগদার দেখালি না কেন?

ডাগদারবাবু তো বাড়ি যাবেন না। কম্পাইন্ডারবাবুকে নিয়ে গেছিলাম। ওষুধ দিয়েছেন একটা। মিকচার। তাতেও ভাল হল না। আপনাকে একবার দেখতে চেয়েছে সাহাব। আজ-কালের মধ্যেই একবার যেতে বলেছে আপনাকে। জঙ্গলে জঙ্গলে মোটে দু মাইলের তো পথ। হেঁটেই যেতে হবে। গাড়িটাড়ি যায় না আমাদের বস্তিতে। পথ নেই। যখনই বলবেন, আমি এসে নিয়ে যাব।

তোমার নিয়ে যেতে হবে না। বস্তির নামটা কী যেন, ভুলে গেছি।

সাজাতারি।

হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে পড়েছে। সাজাতারি। আমার চিনতে অসুবিধে হবে না। দু-একদিনের মধ্যেই যাব আমি।

হ্যাঁ। সাহাব।

ঠিক আছে। পৃথু বলল।

আরেকটা কথা।

কী?

ক’টা টাকা লাগবে সাহাব। দু মাস হল তো মাইনে পায় না গুগ্গা। আমিও ওকে দেখাশুনা করতে বাড়িতেই থেকেছি এতদিন। নিজেও কিছু কামাতে পারিনি। বাড়িতে একদানা গমও নেই। জিনৌর বা মকাই পর্যন্ত নেই।

পৃথু কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল ইতোয়ারিন-এর দিকে। তারপর উঠে গিয়ে ক্যাশিয়ারকে বলে, নিজের নামেই দুশোটা টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে এসে ইতোয়ারিনকে দিল। কোম্পানি থেকে গুগ্গাকে কিছু দেওয়া যাবে না।

টাকাটা পেয়ে ইতোয়ারিনের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, যাচ্ছি সাহাব। আসবেন কিন্তু।

ঠিক এগারোটায় ঝড়ের বেগে ধুলো উড়িয়ে জিপ চালিয়ে এসে ঢুকল ভুচু কম্পাউন্ডে। জিপটাকে পার্কিং লট-এ পার্ক করিয়ে প্রায় দৌড়েই এল। খাকি, ন্যারো ট্রাউজার পরেছে একটা। উপরে জিনের ফুলশার্ট। তার উপরে হালকা নীল-রঙা একটি ফুল-হাতা সোয়েটার। পামেলা বুনে দিয়েছে। গায়ে যোধপুরী। ভারী সুন্দর দেখে পৃথু, এই সেল্ফ-মেড ছেলেটাকে। পামেলার বোনা সোয়েটার তো নয়, যেত তার দুটি নরম ভালবাসার হাতই জড়িয়ে রয়েছে ভুচুকে এই সুন্দর শীতের সকালে। ওর দিকে তাকিয়ে পৃথু ভাবছিল, দূরের আধো-পরিচয়ের ভালবাসা, কোর্টশিপ-পিরিয়ডের ভালবাসা ভারী সুন্দর। কাছে এলেই ভালবাসার রকমটা বদলে যায়। এমন হালকা-নীল থাকে না বোধ হয় আর তার রঙ।

ভুচু ঘরে ঢুকেই উল্টোদিকের চেয়ার টেনে বসল। বসেই একটা সিগারেট ধরাল। তারপর পকেট থেকে শালপাতার দোনায়-মোড়া পান বের করে দিল পৃথুর জন্যে।

পৃথু উঠে ঘরের জানলার পর্দাগুলোকে পুরো সরিয়ে দিল পেলমেন্ট-এর দুই প্রান্তে। বলল, চা, না কফি?

কিছুই না।

কেন? রাগ কেন এতো? ভুচুবাবু?

সবসময় ইয়ার্কি ভাল লাগে না। তার আগে বল সকালে ফোনে তুমি অমন হেঁয়ালি করলে কেন?

শখ করে করিনি। তোমার ইন্টেলিজেন্ট বউদি হাঁ করে এই ইডিয়টের মুখের দিকে চেয়েছিল, সোয়াবিন একস্ট্রাকশান প্লান্ট-এর মতো আমার সবটুকু তেল শুষে নেবে বলে। ডাকাত-ফাকাত-এর কথা কি সবার সামনে আলোচনা করা উচিত?

কী ব্যাপার বলত পৃথদা? এতো আচ্ছা বিপদেই পড়লাম দেখছি, পরের ভাল করতে গিয়ে।

পরের ভাল এই জন্যেই করা উচিত নয় কখনও। করলেই বিপদ! তবে, পরের মন্দও কিছু কিছু করেছি আমরা। নির্ভেজাল ভাল আর করা গেল কোথায়?

ছাড়ো তো! একশোবার করেছি। একটা বড় ভালর জন্যে অনেক ছোট মন্দ কাজ করা চলে। তাছাড়া মন্দই বা কেন? পুলিশ যা করত, আর্মি যা করত, আমরাও তাই-ই করেছি। আমি আর মৌলভী।

এমন সময় ইম্যাটেরিয়াল ম্যানেজার শর্মা এসে ঘরে ঢুকল।

পৃথু দাঁড়িয়ে উঠে গুডমর্নিং করল।

পৃথু বলল, ওর বিল-টিল নিয়ে তাগাদা করতে এসেছে ভুচু।

ইমম্যাটেরিয়াল ম্যানেজার কথা না বলে ইশারায় ভুচুর কাছ থেকে একটা সিগারেট চাইল। ভুচু, সিগারেট দিয়ে, তাতে আগুনও ধরিয়ে দিল। একটান ধোঁয়া গিলে শর্মা বলল, ইয়ে জাগা বড়া খতরনাগ হোতে চলতা হ্যায়।

পৃথু বলল, ছিলই তো! যেখানে তোমার মতো খতরনাগ মানুষ বাস করে সে জায়গা তো প্রথম থেকেই খতরনাগ।

দেখো, ঘোষ সাহাব। মজাক মত উড়াও। সাচমুচ ইয়ে জায়গাভি ডাকু-এরিয়া বন চুকে হ্যায়।

যার কাছে পয়সা, ধনদৌলত তারা খুব সাবধান।

পৃথু বলল, শর্মাকে চোখ মিটকে।

লাও। ফিন মজাক উড়া রহে হেঁ।

একটু চুপ করে থেকে শর্মা বলল, মগনলালের নাম তো শুনে আসছি বহুদিন। তার মাথার উপর তো প্রাইজও আছে। কিন্তু এই মগনলালেরও পায়জামা উতর দিল, এই নয়া ডাকুটি কে? শের সিং? কঁহা কঁহা সে ঈলোগ আতা হিঁয়া, হামারা প্রশান্তি নষ্ট করনে কা লিয়ে, কওন জানে!

তুমি শর্মা সাহেব। একবারে প্রশান্ত মহাসাগরই বটে। প্রশান্ত! ভালই বলেছে কথাটা।

নেহি তো ক্যা? দিল হামরা বিলকুল প্রশান্ত। ডাল-রোটি খাও, অনেস্ট-লাইফ লিড করো; প্রশান্তিকা কম্মি কেয়া?

একটু পর শর্মা চলে গেল। শর্মার ভণ্ডামিতে পৃথু পুলকিত বোধ করল, উদ্বিগ্নতার মধ্যে।

ভুচু সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজতে গুঁজতে উঠে পড়ে বলল, নাঃ এখানে হবে না। যত সব কাবাবমে হাড্ডি। তুমি সন্ধেবেলা গারাজে এসো। নিরিবিলি কথা বলা যাবে।

আজ যে গিরিশদার বাড়ি যাব ভাবছি। একটা ভিজিট ওভারডিউ হয়ে গেছে। আগেই যাওয়া উচিত ছিল। ডেকেছিলেন উনি।

তাহলে কাল।

হ্যাঁ কাল।

মৌলভীকেও ডাকব না কি?

না। একদম না। বেশ কিছুদিন আমাদের সকলকে তো বটেই দুজনকেও যেন কেউ না দেখে একসঙ্গে। কী ব্যাপার হল তা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

নুরজাহানকে যে আমরা ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করে এনেছি এমন কথা কেউ বলে দেয়নি তো!

না না। যে বলবে, সে আমাদের সকলেরই মওত ডেকে আনবে। আমরা তো ঠিকই করে নিয়েছিলাম যে, সবাইকেই বলা হবে পথের পাশেই আমরা নুরজাহানকে ওই অবস্থায় কুঁড়িয়ে পেয়েছি। আমাদের অন্য কোরও সঙ্গেই দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।

মৌলভির কুর্তার রক্ত কেউ দেখে ফেলেনি তো?

সে তো নুরজাহানের পা থেকে লেগেছে। সে কথাও তো ঠিক করা ছিল।

দ্যাখো এখন! কেউ বেঁফাস কিছু বলে না ফেলে।

তেমন তো হওয়ার কথা নয়। এমনকি শামীমকে পর্যন্ত বলা হয়নি কোনও কথা। আমরা তিনজন ছাড়া দ্বিতীয় আর কারওই কিছু জানার কথা নয়।

কী জানি! দেওয়ালের কান আছে। জঙ্গলের তো আছেই।

চলি পৃথুদা।

ভুচু দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, তাহলে পরশু?

পরশু।

সন্ধের মুখে গিরিশদার বাড়ি গিয়ে পৌঁছল পৃথু। অনেকদিন আসেনি এদিকে। গিরিশদার ড্রাইভার শ্রীকৃষ্ণকে কথা দিয়েছিল পরশু দিন যাবে বলে।

গিরিশদা বাড়ি ছিলেন না। মুনেশ্বর বলল, বাজারে গেছেন, এই এসে পড়লেন বলে। আপনি এসে ফিরে গেছেন শুনলে খুব রাগ করবেন আমার উপর। বসুন। বাবুর লেখা-পড়ার ঘরেই বসুন। বসবার ঘর এখনও আমার ডাস্টিং করা হয়নি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

আসলে, মুনেশ্বর কথা বলার লোক পায় না। গিরিশদা নিজে ব্যাচেলর হলে কী হয়, মুনেশ্বরের বউ ছেলেমেয়ে সবই আছে। বলছিল তাদের সঙ্গে দেখা হয় বছরে দেড় বছরে একবার। বাবুকে ছেড়ে যেতে পারে না। গত তিরিশ বছর হল মুনেশ্বর সঙ্গে-সঙ্গেই আছে। যে-কোনও কারণেই হোক মুনেশ্বর পৃথুকে খুবই পছন্দ করে। হয়তো বাবু আর সাহেবদের মধ্যে ওকে মানুষ বলে সমানে সমানে দেখে এমন লোক কমই জানে মুনেশ্বর। তাইই।

তোমার কাকেরা কেমন আছে? পৃথু শুধোল, গিরিশদার স্টাডিতে বসে।

নেই।

নেই মানে?

বাবু দিন পনেরো আগে সকালে খাঁচা খুলে সবগুলোকে একসঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছেন। কাকেরা গেছে। বদলে, শেয়াল এসেছে।

শেয়াল? অনেকগুলো না কি? সে আবার কী?

না। একটা। একটাই যথেষ্ট। জ্বালিয়ে খেল!

খায় কী?

মাংস। মাঝে মাঝে শামীম সাহেব খরগোস শিকার করে এনে দেয় বাবুর বন্দুক নিয়ে। ইঁদুর ধরে দিই আমি। বাবুকে নিয়ে আর পারি না। বাপের জন্মে শুনিনি কোন ভদ্রলোকে শেয়াল পোষে। বাবু বলেন, একে নাকি উনি অ্যালসেসিয়ান কুকুরের মতো ট্রেনিং দেবেন। সস্তায় কাজ সারবেন। বাবুর চিরদিনই এমন। বগলের তলা দিয়ে হাতি চলে যায় যে তা তাঁর চোখে পড়ে না।

কোনও উন্নতি হল? শেয়ালের?

কিসের উন্নতি? হ্যাঁ। একটা উন্নতি হয়েছে। প্রথম প্রথম সন্ধের সময় ও তারস্বরে ঘড়ি-ঘড়ি আকাশের দিকে মুখ করে হুক্কা-হুয়া করত। জঙ্গল-টাঁড়ের শেয়ালরা ডাকলে তো আর কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে গলা মেলাত। আর সে কী গলা! দিল-ধড়কানো ডাক। জঙ্গলে টাঁড়ে লেজ তুলে ডাকে, সে একরকম হয়। ভদ্রলোকের বাড়ির মধ্যে থেকে শেয়াল ডাকলে পিলে তো চমকে ওঠেই! উন্নতির মধ্যে এইই যে, হুক্কা-হুয়া ডাকটা দিনকয় হল বন্ধ করেছে। এখন বাইরের শেয়ালের ডাক শুনলে গলা দিয়ে হু হু হু করে একটা চাপা আওয়াজ করে শুধু।

এটা একটা বজ্জাত শেয়াল। পৃথু বলল। যে নিজের জাতের দোষ গুণ এত সহজে ভুলে যায়, সে বজ্জাতই শুধু নয় বেজাত; বেজন্মাই।

মুনেশ্বর পৃথুর কথা শুনে হেসে উঠল ফোকলা দাঁতে। সুইট।

বলল, ভালই বলেছেন। শেয়ালের আবার জাত, তার আবার জন্ম বেজন্ম!

পরপরই বলল, আপনি বসুন। আমি ততক্ষণে বসবার ঘরটা ডাস্টিং করে ফেলি।

গিরিশদার এই ঘরটি সত্যিই দেখবার মতো। কত আর কতরকমের যে বই ঘরটিতে! যে কোনও মানুষের স্টাডিতে ঢুকলেই মানুষটি সম্বন্ধে এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধেও একটি ধারণা করা যায়। গিরিশদা হচ্ছেন, যাকে বলে একজন মেনি-স্পেলনডার্ড পার্সন। দোষের মধ্যে একটিমাত্র। কবিতা লেখা। কবিতা যদি কবিতা না হয়ে ওঠে, গান যদি গান না হয়ে ওঠে তবে যাদের তা শুনতে হয় চাঁদমুখ করে, তাদের বড়ই কষ্ট। কিন্তু নিজে ভাল কবি বা ভাল গায়ক না হলেই যে তিনি কবিতা বা গান বুঝবেন না, এমন কথা নেই। গুণের সঙ্গে গুণগ্রাহিতার কোনওই সম্পর্ক নেই। বরং বেশি সময়ই দেখা যায় যে, গুণীরা নিজেরা নন, শুধু গুণগ্রাহীরাই কোনও বিশেষ গুণকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন।

টেবলে একটি প্যাড। প্যাডের উপর বন্ধ করা কলম। একটি শায়ের লেখা আছে। সেটি পড়ে চমকে গেল পৃথুর।

কুছ খাফাজ কি তিঁলীয়োঁসে ছান রাহা

হ্যায় নুরসা

কুছ ফিজা কুছ হাসরাতে পরওয়াজ কি

বাঁতে করো।

দ্যাখো জ্যোতিরই মতো, জেলখানার গরাদ থেকে কী যেন আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসছে। এসো, কিছু পারিপার্শ্বিকতা আর কিছু পালাবার ইচ্ছার কথা বলাবলি করি আমরা।

এ কোন গরাদের কথা এই কবি বলছেন কে জানে? তবে এই গরাদ বা গরাদ চুঁইয়ে আসা এই জ্যোতি অথবা এই অজানা কয়েদ থেকে পালাবার ইচ্ছার মধ্যে কোনও বিশেষ সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনের বিরুদ্ধে এক প্রচ্ছন্ন সংগ্রামই যেন স্ফুরিত হয়েছে। চেঁচিয়ে কিছু বলা হয়নি, রাগ করেও নয়; তবু বলা হয়েছে অনেকখানিই। কবিতা বোধহয় একেই বলে।

এমন সময় গাড়ির শব্দ কানে এল। গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধ করার শব্দও হল। তারপরই মুনেশ্বরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গিরিশদা ঘরে এসে ঢুকলেন।

কতক্ষণ এলে ভায়া?

বোসো বোসো। জামাকাপড় ছেড়েই আসছি। চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর এই সব চোগা-চাপকান পরলেই দম একেবারে বন্ধ হয়ে আসে। শুধু চাকরি থেকেই নয়, চাকরির গন্ধ আছে এমন সমস্ত কিছু থেকেই রিটায়ার করেছি আমি। একজন মানুষের সত্যিকারের জীবন বোধ হয় রিটায়ার করার পরই শুরু হয়। কী বল? তুমি হয়তো শুনলে অবাক হবে, আমার ভাইপো দিব্যেন মনট্রিয়াল থেকে লিখেছে যে, কানাডাতে প্রফেশনাল মানুষেরা যেমন ডাক্তার আর্কিটেক্ট উকিল অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইত্যাদি সবাই পঁয়তাল্লিশ বছরে রিটায়ার করেন। স্বেচ্ছায়। তার পর যাঁর কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয় তিনি কবিতা লেখেন, যাঁর গান গাইবার ইচ্ছে তিনি গান গান, কেউ ছবি আঁকেন, কেউ শিকার করেন, কেউ প্রেম করেন আবার কেউ বা শুধুই কুঁড়েমি করেন।

কানাডা বলেই পারেন গিরিশদা। পৃথু বলল। এ দেশে যা অবস্থা হয়ে এসেছে, টাকার দাম এবং মানুষের সঞ্চয়ের আসল মুল্য যেভাবে কমে আসছে তাতে চাকুরিজীবীই বলুন আর প্রফেশনাল লোকই বলুন সকলকেই মৃত্যুদিন অবধি, তাঁরা যা করছিলেন, তাই-ই করে যেতে হবে। হয়তো স্বর্গে গিয়েও ধান ভানতে হবে। নইলে, সংসার চলবে না। আপনার মতো সংসারে যাঁরা ফেঁসে যাননি তেমন ভাগ্যবান আর কজন?

সেটা অবশ্য একটা কথা। সঞ্চয় থেকে যা রোজগার তার উপর ট্যাক্স দেওয়ার পর নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতোই অবস্থা সকলের। বাবার কিছু না থাকলে ব্যাচেলর হয়েও আমার অবস্থাও শোচনীয় হত। ইনকাম ট্যাক্স ওয়েলথ ট্যাক্স। গিফট ট্যাক্স। মরে গেলেও নিস্তার নেই এস্টেট ডিউটি। এবার শুনছি এক্সপেন্ডিচার ট্যাক্সও বসবে।

আপনার টেবলে একটি কবিতা দেখলাম। কার ওটি?

গিরিশদা টেবলের কাছে গেলেন। দেখলেন সেদিকে। তারপর বললেন, তোমার প্রিয় কবির। ফিরাখ গোরখপুরি।

ওমা! তাই-ই?

হ্যাঁ। বলেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই স্বগতোক্তির মতো আবৃত্তি করনে।

“জারা ভিসাল কে বাদ আইনা এ দেখ দোস্ত

তেরে জামাল কে বাদ দোশীজগী নিখার আয়ি।”

অর্থাৎ এই পরশের পর আয়নাতে তো দ্যাখো একবার বন্ধু, দ্যাখো : তোমার কৈশোরের কুঁড়ি কেমন পরিপূর্ণতার ফুল হয়ে ফুটে উঠেছে।

কৈশোর কেন? উনি কি?…

হ্যাঁ। উনি তো সমকামী ছিলেন। অনেকেই বলে।

“খর্জ কে খাত দিয়ে জিন্দাগী কী দিন অ্যা দোস্ত

উও তেরী ইয়াদমে হো ইয়া তুঝে ভুলানে মে।”

বন্ধু বলতে গেলে, আমার সমস্ত জীবনটাই হয় তোমাকে চেয়ে অথবা তোমাকে ভুলতে চেয়েই কাটিয়ে দিলাম।

কেমন? ভাল না? এক মিনিট। পায়জামা পাঞ্জাবি পরে এলাম বলে।

দারুণ!

উনি ফিরে এলে পৃথু বলল, আপনি মনে হচ্ছে ফিরাখ সম্বন্ধে অনেকই জানেন।

অনেক জানি না। কোনও কবি সম্বন্ধেই কেউ অনেক জানে না। কারণ নিজেকে পুরোপুরি জানতে দেওয়াটা কবি-ধর্মের মধ্যে পড়ে না। তবে ফিরাখ আমার প্রিয় কবি, তাই-ই একটু খোঁজখবর রাখি। এই-ই বলতে পার। এলাহাবাদের এক সম্ভ্রান্তহিন্দু কায়স্থ পরিবারে রঘুপতি সহায় ফিরাখ-এর জন্ম। উর্দু সাহিত্য সম্বন্ধে এক তীব্র উৎসাহ, তাঁর পারিবারিক আবহাওয়াতেই ছিল। ফিরখ-এর বাবা ছিলেন মুনশি গোরাখ প্রসাদ। তখনকার এলাহাবাদের একজন নামী উকিলও ছিলেন তিনি। আরবি এবং ফারসিতেও অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তা ছাড়াও ইব্রাত ছদ্মনামে তিনি উর্দু কবিতাও লিখতেন।

ওঁর কবিতায় কী অন্য কোনও কবির প্রভাব ছিল? জানেন?

যাঁরা জানেন, তাঁরা বলেন যে, মোমিন, মুশতাফি, আমিয়ের, মীনাই ইত্যাদি বিখ্যাত উর্দু কবিদের প্রভাব ছিল ফিরাখ-এর উপর। বিশেষত তাঁর প্রথম জীবনে। ফিরাখ আই-সি-এস’এর পরীক্ষা পাশ করার পর ডেপুটি-কালেক্টর হয়ে চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু সেই সুখের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন কংগ্রেসের সভ্যও ছিলেন। জেলও খাটেন। কিন্তু রাগের কবিতা লেখেননি কখনওই। তাঁর সমস্ত কবিতাতেই প্রচ্ছন্নতা ভাস্বর ছিল। ঊনিশশো সাতাশ সনে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরিজিতে প্রথম হন এম-এ পরীক্ষাতে। তারপর এখানেই অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সবচেয়ে মেধাবি এবং সবচেয়ে মিশুকে অধ্যাপক হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর। গর্বিত ছিলেন তিনি তাঁর কবিতার গুণ সম্বন্ধে। ওঁর একটি শায়েরী আছে, তাতে বলছেন :

“কেহতে হ্যাঁয় মেরি মওত পর

উসকে ভি ছিন হি লিয়া

ঈশক কো মুদাতোঁ কী বাদ

একমিলা থা তরজুমাঁ।”

আমার মৃত্যুর পর লোকে বলবে, অনেক অনেকদিন পর প্রেম যদি বা একজন তর্জমাকারীকে পেয়েছিল : তাকেও মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিল। হায়!

নিজের উপর বিশ্বাসও ছিল খুব গভীর। আরেকটি কবিতায় তিনি সগর্বে বলছেন :

“আনেওয়ালি নাসলেঁ, তুম পর রাশখ

করেঙ্গি হাম আসরোঁ

যব, ইয়ে ধিয়ান আয়েগা, উন কো, তুমনে

ফিরাখ কো দেখা হ্যায়।”

ভবিষ্যতের প্রজন্মর সকলেই আজকের তোমাদের ঈর্ষা করবে, যখন তারা জানতে পারবে যে, তোমরা ফিরাখকে দেখেছিলে; জেনেছিলে।

পৃথু বলল, ওঁর নিশ্চয়ই কবিতা সংকলন আছে দু একটি?

দু একটি কেন? অনেকই আছে। কয়েকটি বিখ্যাত সংকলনের নাম মনে আছে আমার। যেমন ‘রাঙ্গা নূর’, ‘গুলে নাজমা’, ‘রুহে ক্যায়নাৎ’, ‘মশ-আল’, ‘শাবনামিস্থান’, ‘শোলা-ওসাজ’—এসব তাঁর বিখ্যাত কবিতা সংকলন। উর্দুটা শিখে নাও পৃথু। উর্দুর মতো শক্তিশালী, সম্পদময় ভাষা ভারতীয় ভাষার মধ্যে কমই আছে।

কবিতা ছাড়া অন্য কিছু লেখেননি ফিরাখ?

হ্যাঁ। তাও লিখেছেন। সমালোচনা-সাহিত্যে বিখ্যাত তাঁর বই “আন্দাজে”, “উর্দুকি ঈশকিয়া”, “শ্যয়রি” এবং “হাশীয়ে। রুবাই হচ্ছে উর্দু সাহিত্যের শেষ কথা। ফিরাখ তাঁর রুবাই সংকলন ‘রূপ’-এও তাঁর সেই উৎকর্ষের প্রমাণ রেখেছেন। ফিরাখ গোরখপুরীর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বোধহয় এই-ই যে তাঁর অধিকাংশ পাঠকের কাছেই, ফিরাখ-এরকবিতা, শুধু আনন্দ পাবার জন্যেই নয়, তা এক প্রচণ্ড টোটাল ইনভলভমেন্টের ব্যাপার! মানে কবিতা নিয়েই বেঁচে থাকা। এইখানেই তো একজন কবির সার্থকতা। মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে আশ্চর্য এক সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতাতে।

পৃথুর খুব ভাল লাগছিল শুনতে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে গিরিশদাকে শুধোন, আপনি তো দেখছি ফিরাখকে গুলে খেয়েছেন। সত্যি! আপনার মতো যদি উর্দুটা জানতাম!

কোনও কবিকেই গুলে খাওয়া যায় না পৃথু। খেলেও তা হজম হয় না। কবিতা, মানুষের নাভিরই মতো। আগুনেও পোড়ে না। এমন বদহজমের জিনিসই আর নেই।

হেসে বললেন গিরিশদা।

ফিরাখ-এর কোন কবিতাটি সবচেয়ে প্রিয় আপনার?

আমার? বলেই, ভাবলেন একটু গিরিশদা। তারপর বললেন, একটি নয়, দুটি কবিতা সমান প্রিয়। অবশ্য আমার প্রিয় হলেই যে সকলের কাছে প্রিয় হবে এমন কথা নেই। এটা নিজের নিজের ভাললাগার ব্যাপার।

কবিতা দুটি শোনান না গিরিশদা।

তা শোনাচ্ছি। কিন্তু কবিতা শুনে গায়ে জোর এবং মনে আনন্দ করে নাও। এরপর তোমার সঙ্গে আমার কিছু নিরানন্দর কথাও আছে। যে কথা, তোমার পছন্দ হবে না। এবং যা বলব তা কবিতাও নয়। শোনো এখন :

“থী মুনতাজার সি দুনিয়া খামোশ থী।

ফিজায়েঁ।

আঈ যো ইয়াদ উনকি চালনে লাগে হাভায়েঁ।”

বুঝলে তো? মানে, পৃথিবী একেবারেই নিশ্চুপ ছিল। যেই মনে পড়ল তোমার কথা, অমনি হাওয়া দিল ঝুরুঝুরু।

বাঃ। বাঃ। বহত খুউব।

পৃথু বলল। এবার শেষেরটা।

কবিতা কখনও আশ-মিটিয়ে শুনতে নেই। কারও কবিতাই নয়। আশ মিটে গেলে যেমন প্রেমে আর প্রেম থাকে না, কবিতার আশও মিটে গেলে কবিতা কবিতা-রহিত হয়ে যায়। শেষেরটা অন্যদিন শোনাব। প্রথম করে দেব সেদিন শেষকে।

ঠিক আছে।

বলল, পৃথু। তারপরই কথা ঘুরিয়ে বলল, শেয়াল পুষলেন এবার? কাকগুলোকে আকাশে নির্বাসন দিলেন? এমন টাইমমতো কানকো আর কুকুরের ছাঁট কোথায় পাবে আর বেচারারা।

না-খেয়ে মারা যাবে যে! এমন স্পয়েল করে ছেড়ে দেওয়াটা অন্যায়।

সে তাদেরই ব্যাপার। কাক-শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে যাবার পর আর কাক পোষার ঝামেলা করিনি। শেয়ালটার নাম দিয়েছি পণ্ডিত। মানুষেরা সকলেই আজকাল শেয়াল হয়ে উঠেছে, শেয়ালেরই মতো ধূর্ত, সাবধানী; চোর-চোর। সত্যি শেয়ালরা হয়তো কোনওদিন মানুষদের উপর ঘেন্না আর অভিমানে মাস-সুইসাইড করে বসবে। কে জানে? থাকুক আমার কাছে একটি স্পেসিমেন। শেয়ালমাত্রই তো পণ্ডিত হয়। কুমীরের বাচ্চা-খেকো সব। তাই-ই এ-ব্যাটারও নাম রেখেছি পণ্ডিত।

তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ দুজনেই।

গিরিশদা বললেন, হুইস্কি তো খাবে একটা, না কি?

নাঃ! থাক আজকে। ভাল লাগছে না।

শ্যুওর?

শ্যুওর।

এবার তাহলে বলো, সেদিন তোমার কী হয়েছিল? শেষে, ওই মহল্লাতে গেলে? তাও, শ্রীকৃষ্ণকে সাক্ষী রেখে? ছিঃ ছিঃ। তোমার বড়ই অধঃপতন হয়েছে পৃথু।

পৃথুর মনে হল তারাশংকরের ‘দুই পুরুষ’-এর সুশোভনের ডায়ালগ। কোট করে বলে : পতন তো চিরকাল অধোলোকেই হয় গিরিশদা, কে আর কবে ঊর্ধলোকে পড়েছে বল?

কিন্তু কিছুই না বলে চুপ করে রইল।

হল কী? কথা বলছ না যে?

কী বলব, তাই-ই ভাবছি।

আসলে বলার কিছুই নেই। তুমি একবারও ভাবলে না যে, তোমার স্ত্রী, বা ছেলেমেয়েরা কী ভাববে? তুমি এতবড় কোম্পানির এতবড় অফিসার, তোমার অফিসের লোকেরা জানতে পেলে কী ভাববে তোমাকে?

অন্যরা আমাকে কী ভাবল না ভাবল তা নিয়ে ভাবি না আমি গিরিশদা।

তুমি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে পৃথু।

এড়িয়ে যাইনি।

গেছ। সমাজের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। তোমার স্ত্রী রুষা জানলে কী ভাববে বা কী করবে, ভেবেছ একবারও তুমি? যদি কোনওভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে কথাটা?

ভাবার কোনও অবকাশই রাখিনি। রুষাকে সবই বলে দিয়েছি।

বলে দিয়েছ? তুমি নিজেই?

হ্যাঁ। সত্যিই তুমি পাগল। ক্কি! কী বললেন তিনি?

বললেন, ইচ্ছে করলে যেয়ো। শরীরের প্রেমে কোনও দোষ নেই। দোষ, মনের প্রেমের। সেই প্রেমকেই ভয়!

আশ্চর্য! রাগ করলেন না তোমার উপর?

না।

দ্যাখো পৃথু, যতদিন আমরা তোমাকে দেখছি হাটচান্দ্রাতে, তাতে তুমি তোমার ভিজে-বেড়ালের মতো ব্যবহারে নিজের সম্বন্ধে এমন একটা ইমেজ গড়ে তুলেছ আমাদের সকলের কাছেই যে, আমরা সকলেই ভেবে নিয়েছিলাম, তোমার স্ত্রীই খারাপ আর তুমিই একটি অত্যাচারিত গোবেচারা-মানুষ। সেই মহিলাকেই সকলে আমরা খারাপ বলে ভেবেছি। তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করেন ভেবে নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করেছি। আজ দেখছি, তিনিই মহীয়সী।

অথচ! এমন মহিলার কথা তো শুধু নাটক-নভেলেই পড়েছি। জীবনেও কারও কী এমন স্ত্রী থাকে?

নাটক-নভেল তো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি গিরিশদা! যে নাটক-নভেল জীবন-সম্পৃক্ত নয়, তা কী থাকে? না তা পড়ে মানুষে?

জানি না। তবে, তুমি দেখছি অবাকই করলে! তা, হঠাৎ মহল্লায় গেছিলেই বা কেন? গেছিলে কার কাছে?

বিজ্‌লীর কাছে গেছিলাম। কেন যে গেছিলাম, তা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমি নিজেও জানি না।

জানি, জানি গান শুনতে গেছিলে। তা গান শুনতে ইচ্ছে করলে তো আমাকেই বলতে পারতে। বাড়িতে ম্যায়ফিল বসাতাম। যাকগে। এ প্রসঙ্গ থাক। থাক। থাক। তোমার নিজেরই যখন অনুশোচনা হচ্ছে তখন আমার আর বলার কিছু নেই।

অনুশোচনা কেন হবে? খুবই ভাল লেগেছিল। তাছাড়া শুধু গানই শুনিনি। আমি…ভবিষ্যতে আবারও হয়তো যাব। মানে যেতে পারি।

ক্কি-কি-কি? বলছ কী তুমি? আবার যাবে? রাণ্ডী-বাজ হবে তুমি? ছ্যাঃ ছ্যাঃ। মেয়েটা জাদু করেছে তোমাকে।

আমাকে জাদু করা মুশকিল। নিজে থেকে জাদু হতে রাজি না থাকলে কেউই যে জাদু করবে আমাকে এমনটি হবার জো নেই।

কী সব বলছ তুমি, এসব আমার বুদ্ধিরও বাইরে।

আপনি নিজে কখনও, যাকে বলে “কাম-তাড়িত”, তা হয়েছেন কী গিরিশদা? কখনও!

গিরিশদা একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, হব না কেন? আমি তো ভগবান নই।

যাই-ই বলো। বিবাহিত মানুষের এমন উদ্ভট কাম থাকাটা স্বাস্থ্যের লক্ষণ আদৌ নয়।

পৃথু বলল, ঠিক উল্টো। যে বিবাহিত পুরুষরা ভিটামিন বা প্রোটিন ডেফিসিয়েন্সীতে ভোগে তাদের কথা জানি না। তাছাড়া বিবাহিত পুরুষরা কী পুরুষজাতের কলঙ্ক? সে বেচারিদের এমন করে চিহ্নিত করাটাও ঠিক নয়। কাম এমন কিছু খারাপ রিপুও নয়। আপনি যাইই বলুন। অবদমিত কামই বরং সর্বনাশা। পুরিত-কাম ভাল করে। সকলেরই। যাকে-তাকে না কামড়ালেই হল।

তুমি কামকে ভাল বলছ এত, সেদিন শামীমের মেয়ে নুরজেহানকে যারা ধরে নিয়ে গেছিল তাদেরও হয়তো ভাল বলবে তুমি!

মেয়েটা বোবা হয়ে গেছে। জানো তো?

পৃথু হঠাৎই বলল, আমি এবার উঠি গিরিশদা।

গিরিশদা ও ভাবনাতে ডুবে ছিলেন। চমকে উঠে বললেন, উঠবে? এত তাড়াতাড়ি?

হ্যাঁ। উঠি আজকে। রাত হল। খুব কম সময়ও কাটালাম না!

শ্রীকৃষ্ণই পৌঁছে দিয়ে আসুক তোমাকে। ও তো আছেই। এতখানি পথ হেঁটে যাবে কেন? এই ঠাণ্ডার মধ্যে রাতের বেলা?

অনেকদিন একা হাঁটিনি গিরিশদা। রাতের জঙ্গলে হাঁটলে মাথা পরিষ্কার হয়। স্নায়ুগুলো সব সজীব হয়ে ওঠে। ভাবতে ভাবতে, একা একা জঙ্গলে হাঁটতে বড় ভাল লাগে।

যা ভাল মনে করো। তোমার রকমসকমই আলাদা। আর একটা কথা। আর কাউকে বোলো না রুষা তোমাকে কী বলেছে না বলেছে। বুঝেছ। সকলেই আমি নই।

তা জানি। আপনি বলেই বললাম।

তারপর বলল, শ্রীকৃষ্ণ কোথায়? ওর সঙ্গে দরকার আছে আমার একটু।

মুনেশ্বরকে ডেকে গিরিশদা শ্রীকৃষ্ণকে খবর দিতে বললেন। পৃথু উঠে পড়ল।

শ্রীকৃষ্ণ বাইরের দরজার কাছে এসে গলা খাঁকরে জানান দিল সে এসেছে।

পৃথু গিরিশদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরল। গেট থেকে বেরিয়েই টর্চটা জ্বালল। শ্রীকৃষ্ণের মুখে পড়ল আলোটা। মাথার পেছনে জ্যোতি ফুটে উঠেছে বলে মনে হল পৃথুর। শ্রীকৃষ্ণরই মতোই। দুটি দশ টাকার নোট ওর পাঞ্জাবির পকেটে-ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, চা খেয়ো শ্রীকৃষ্ণ।

শ্রীকৃষ্ণ কথা না বাড়িয়ে সেলাম করে চলে গেল আউট হাউসে, তার কোয়ার্টারের দিকে।

গিরিশদার বাড়ির সামনেটুকু পেরিয়েই জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ল পৃথু। শিশিরে ভিজে পুটুস-এর গায়ের উগ্র গন্ধ বেরুচ্ছে। হরজাই গাছেদের গায়ের গন্ধ, ধুলোর গন্ধ, বুনোফুলের গন্ধ সব মিলেমিশে এক আশ্চর্য গন্ধর মেঘ চাঁদের আলোর সঙ্গে মিশে নীলচে-হলুদ নাইলনের মশারিরই মতো ঝুলে আছে যেন জঙ্গলের সবুজে-কালো চাঁদোয়া থেকে। পথের বাঁ পাশ থেকে পেঁচা ডাকছে। সামনে, দূরে, ডানদিকের জঙ্গল থেকে চেঁচিয়ে পেঁচানী সাড়া দিচ্ছে সে ডাকের। বনপথের স্তব্ধতায় বাদুরের গায়ের গন্ধ। হাওয়ায়-ঝরা শুকনো পাতার মুচমুচে গন্ধ এখন শিশিরে নেতিয়ে ওডিকোলোনের গন্ধের মতো মৃদু হয়ে গেছে।

শামীম নাকি বলেছে গিরিশদাকে যে মৃত ডাকাতদের শনাক্তকরণও করেনি কেউ। তাদের সকলের মৃতদেহই পোস্ট মর্টেমের জন্যে পাঠানো হয়েছিল ট্রাকে করে মান্দলাতে। লালটু সিং-এর মৃতদেহ ফিরিয়ে এনেছে ওরা। ডাকাতদের মৃতদেহ মর্গেই রয়ে গেছে। ঠাণ্ডা ঘরে।

কে জানে, লোকগুলোর বাড়ি কোথায় ছিল? বাড়িতে কে কে আছে তাদের? জানোয়ারেরা যেখানে মরে, অসুখে হোক, গুলি খেয়ে হোক, সেই জায়গাটাই তাদের বাড়ির ঠিকানা হয়ে যায়। শুধু মানুষেরই নিস্তার নেই ঠিকানার হাত থেকে। মরে গিয়ে তার শেষ ঠিকানায় তাকে পৌঁছতেই হয়। পৃথু তাই বেঁচে থাকাকালীনই তার মৃত্যুতে যাতে এই নিয়ম না মানা হয় সে সম্বন্ধে ফতোয়া জারি করে যেতে চায়।

কাল রাতে বারবার লালটু সিং-এর মুখটা মনে পড়ছিল। বারবার। ঘুম হচ্ছে না ভাল পৃথুর একদিনও। বাচ্চা ছেলে নাদুস-নুদুস চেহারা। পান-বাহার আর জর্দা-দেওয়া পান খেয়ে খেয়ে ঠোঁট ফেটে লাল হয়ে ছিল। গলায় সোনার হার। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, হিরের বোতাম লাগানো। মিহি ধুতি। বাঁ হাতে সোনার রোলেক্স ঘড়ি। ছেলেটার কোঁকড়া চুল ভরা মাথার উষ্ণতাটা এখনও পৃথুর দু হাঁটুর মধ্যে মাখামাখি হয়ে আছে। রাতে ঘুমোতে গেলেই পৃথুর মাথার মধ্যে পেঁচারা কেবলই ঝগড়া করছে। কিঁচিকিঁচিকিঁচর—কিঁচি-কিচর।

মাথাটা কেমন ফুটো হয়ে গেল গুলিটাতে! নারকেলের-এর চেয়েও অনেক কম শক্ত। মানুষের মাথার খুলি হাত দিয়ে জোরে টিপেও বোধহয় ভেঙে দেওয়া যায়। অথচ এই মাথাই মানুষকে যা কিছু দেওয়ার মতো তা দিয়েছে। একটা মানুষকে মেরে ফেলল উত্তেজনা নেই; অনুশোচনা নেই। আশ্চর্য!

এই লালটু সিং বাচ্চা ছোকরা পৃথুকে ঘুষ অফার করেছিল গত বছর। ওর অফিসে। পৃথু তারপর থেকেই ভগয়ান শেঠদের সঙ্গে কারখানার সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিল, ইমম্যাটেরিয়াল ম্যানেজার শর্মার অনেক অনুরোধের পরও। ক্ষতি হয়েছিল বছরে হাজার পঞ্চাশেক টাকা ভগয়ান শেঠ-এর। আর হয়তো হাজার পাঁচেক টাকা ইমম্যাটেরিয়াল ম্যানেজারের।

মাঝে মাঝেই টর্চ জ্বালতে জ্বালতে, হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল পৃথু। নুরজেহানের নগ্ন, শায়িত অসহায় হাত বাঁধা চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে মনে চোখ সরিয়ে নিল তক্ষুনি। পৃথু ঘোষ নিজেই মারতে চেয়েছিল লালটু সিংকে। না, পৃথুকে সে চিনে ফেলেছিল বলে নয়। নিজের নিরাপত্তা সম্বন্ধে জীবনের সব ক্ষেত্রেই ওর এক আশ্চর্য উদাসীনতা ছিল চিরদিনই। মারতে চেয়েছিল এই কারণে যে, কোনও মানুষের মধ্যেই ও নীচতা সহ্য করতে পারে না। মানুষ যদি অমানুষই হয় তাকে জানোয়ারের মতো নিজে হাতে গুলি করে মারতে ওর কোনও দ্বিধা নেই, ছিলও না কোনওদিন। কিন্তু মারতে দিল না মৌলভীই। ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেই…। পৃথু পারত কি সত্যিই?

একটা হায়না ওর সামনে দিয়ে শিশির-ভেজা লাল-ধুলোর রাস্তাটা পার হল। রাতের অস্পষ্ট আলোয় বড় হায়নাটাকে, গায়ের ভোরাগুলোর জন্যে প্রথম দেখায় বাঘ বলে ভুল হয়েছিল। এক দৌড়ে পথ পার হয়েই বুক-কাঁপানো ডাক ডেকে উঠল সে।

দূরে, দোকানের আলো দেখা যাচ্ছিল। সাইকেল-রিকশার প্যাঁক-প্যাঁক, ক্রিং ক্রিং, আকাশটা আলোর আভায় ভরে গেছে।

পানের দোকান থেকে সরে এসে ভাবছিল, সাইকেল-রিকশা নেবে একটা ঠিক সেই সময়ই একটা জীপ তাকে প্রায় চাপা দিতে দিতেও না-দিয়ে গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। গিয়ে, রাস্তাটা যেখানে অপেক্ষাকৃত নির্জন, ছায়াচ্ছন্ন, সেইখানে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। পানের দোকানি অদৃশ্য ড্রাইভারের উদ্দেশে গালাগালি করল অশ্লীল। এঞ্জিন বন্ধ করে দিল ড্রাইভার।

পৃথুর খুবই রাগ হল ড্রাইভারের উপর। এসব ছোটখাটো ব্যাপার সে উপেক্ষা করে। আজ মনে হল, ড্রাইভার ইচ্ছা করে তাকে অপমান করার জন্যেই এমন করল। কিন্তু দাঁড়িয়েছে অন্ধকারে। পৃথুকেও যেতে হবে ওইখান দিয়েই। ঠাণ্ডাও পড়েছে জোর। দুধিয়ালির মোড়ে না গেলে সাইকেল-রিকশা পাওয়াও মুশকিল। ফাঁকা রিকশা নেই পথে। হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার জায়গাটাতে গিয়ে পৌঁছতেই জীপের ভিতর থেকে কেউ নড়ে চড়ে উঠল।

অভ্যাস বশে কোমরে হাত দিল পৃথু। নেই। আনেনি।

ফিসফিস করে কে যেন বলল, পৃথুদা। আমি! জীপ আরও আগে নিয়ে যাচ্ছি। এক্কেবারে সান্নাটা জায়গাতে। তুমি এসে উঠে পড়। কেউ যেন দেখে না। কথা আছে, জরুরি।

পৃথুকে ফেলে, জীপটা আবার এগিয়ে গেল। মিনিট পাঁচেক লাগল পৃথুর পৌঁছতে। জীপের পৌঁছতে লেগেছিল এক মিনিট।

পৃথু উঠে বসতেই ভুচু জীপ স্টার্ট করে দিল।

কী ব্যাপার হল?

ভুচু ফিসফিস করেই বলল, মৌলভীকে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে।

মানে?

মানে কিডন্যাপড আমরাও হতে পারি যে-কোনও সময়। সঙ্গে রাখবে সবসময়। বাড়িতেও। শোওয়ার সময় বালিশের নীচে নিয়ে শোবে।

মানে? কিসের কথা বলছ?

আঃ! পিস্তলটা। লোডেড পিস্তল আজ থেকে সবসময়ই কোমরে রাখবে। একস্ট্রা ম্যাগাজিনও রাখবে।

পৃথু হেসে উঠল খিক খিক করে।

ভুচু চমকে উঠল।

কী হল? হল কী তোমার? হাসার কী আছে? পাগল-টাগল হলে নাকি?

ড্যাশবোর্ডের আলোতে ভুচুর চোয়াল নিষ্ঠুর দেখাল।

পৃথু বলল, যাত্রা তাহলে জমে গেছে বলো?

বেশ আছ তুমি। অজীব আদমী!

সত্যিই বেশ আছি। বুঝেছ ভুচু। কাল তো কারখানা ছুটি, তেওহারের জন্যে। তোমার জীপটা একটু ধার দেবে?

কোথায় যাবে?

যাব এক জায়গায়। দেবে কি না বলো?

দেব।

তাহলে সকালে এসে নিয়ে যাব।

এসো। তোমাকে বুঝতে পারি না আমি। তোমার প্রাণে কী ভয় ডর বলে…

আমার প্রাণে অনেকই ভালবাসা আছে। ভালবাসায় প্রাণ আমার ভরপুর। ভয়ডর সব মুদিদের জন্যে। হিসেবিদের জন্যে।

আমার ওখানে যাবে নাকি? হুইস্কি ছিল।

কবে?

কবে আবার? এখন।

না।

কোথায় নামবে পৃথুদা?

সামনের মোড়ে নামাও।

জীপটা থামিয়ে ভুচু বলল, সত্যিই! এখন কিছুদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা না হওয়াই ভাল।

পৃথু জীপ থেকে নেমে হেসে বলল, যাঃ। তা কি হয়? মন খারাপ করবে যে বড়!

ইয়ার্কি কোরো না পৃথুদা। সীরিয়াসলি বলছি। তোমার সত্যিই ভয় ডর কিছু নেই!

ভয়? কেন? না ভুচু। ভয়-টয় আমার সত্যিই নেই।

একটু থেমে বলল, পামেলার কাছে যাও।

জীপটা চলে গেল।

পৃথু মনে মনে বলল, যাও ভুচু। যাও। এখন না গেলে কাল ভোরে যাও। তুমি শান্ত হয়ে যাবে।

বাড়ি এখনও অনেক দূরে। পা টেনে টেনে হেঁটে চলেছে পৃথু।

“কুছ খাফাজ কী তিলীয়োঁসে ছান রাহা হ্যায় নুরমা/কুছ ফিজা কুছ হাসরাতে পরওয়াজ কী বাঁতে করো।”

জেলখানার গরাদ থেকে জ্যোতি চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসছে। এসো, কিছু পারিপার্শ্বিকতা আর কিছু পালাবার ইচ্ছার কথা বলাবলি করি আমরা।

ফিরাখই জানেন এ কোন গরাদ? কোন্ জেলখানা? আর কেমন পালানো এ?

বাংলোর কাছে প্রায় পৌঁছেই গেছিল পৃথু। বাসিয়ার জঙ্গলের শালবনের শিশিরভেজা গায়ে চাঁদের আলো পড়ে চিকচিক করছে। সেদিকে একবার চেয়ে আবার সামনে চাইল ও। এমন সময় দেখল, একটি জীপ হেটলাইট জ্বেলে আসছে তার বাংলোরই দিক থেকে। জীপটা তার পাশে এসেই থেমে গেল। দুজন লোক লাফিয়ে নেমেই তাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সামনের সীটে তাদের মধ্যে বসাল। এবং একজন লোক পেছন থেকে আলোয়ানের আড়াল করে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে রাখল তার পিঠে।

পৃথু বলল, কী ব্যাপার? আপনারা কারা?

বলব। সময় মতো। জায়গা মতো।

জীপটা চিলপির দিকে চলতে লাগল। মনে হল যেন সেই ভাঙা বন-বাংলোর দিকেই যাবে। মনেই হল। আরও এগোলে বোঝা যাবে। ডাইভার্সনটা পেরিয়ে যদি বাঁদিকে না গিয়ে ডাইনে যায় তবেই জানা যাবে।

ওদিকে কী?

পৃথু আবার শুধোল।

পাশের লোকটি বলল, জানবেন স্যার। সময় মতো।

স্যার?

অবাক হল পৃথু।

মৌলভী গিয়াসুদ্দিনকেও নিয়ে এসেছেন আপনারাই?

হ্যাঁ।

আপনারা কোন ডাকাতের দল? সর্দার কে আপনাদের?

যে ছিপছিপে লোকটি গাড়ি চালাচ্ছিল সে হেসে উঠল। বলল, ডাকু ইন্দারজিৎ লাল।

সে আবার কে?

জানবেন স্যার!

তারপর দীর্ঘ পথ চুপচাপ। শীতের হাওয়ার থাপ্পড় চোখে মুখে।

পৃথুর মনে হচ্ছিল, এরা যারাই হোক, পৃথু বা মৌলভীর কোনও ক্ষতি করবে না। তাহলে এতক্ষণে ব্যবহারেই বোঝা যেত। তবু…

জীপটা থামল এসে একেবারে বন-বাংলোটার সামনেই। পৃথু জীপ থেকে নামতেই একজন সুদর্শন, অল্পবয়সী আই-পি-এস অফিসার বেরিয়ে এসে পৃথুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। বললেন, আই অ্যাম লাল। ডি আই জি। ড্যাকয়টি সেল। আই মাস্ট কংগ্রাচুলেট উ্য অল ফর হোয়াট ড্য হ্যাভ ডান মিঃ ঘোষ।

পৃথু বলল, কী করেছি?

কী করেছেন তা না বোঝার মতো বোকা আমরা নই মিঃ ঘোষ। যা করেছেন তার জন্যে আপনাদের প্রত্যেককে আমরা ডেকরেট করতাম। অবশ্য অন্যভাবে দেখতে গেলে বলতে হয় আপনারা যা করেছেন তা আইনের চোখে গর্হিত অপরাধও। ফাঁসিতে লটকানোই উচিত ছিল আপনাদের। কিন্তু না জেনে আপনারা এমন কিছু করে ফেলেছেন যে, আইনের রক্ষক হয়েও আমরা ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করে রয়েছি। এবং উ্য হ্যাভ মাই ওয়ার্ডস, যে ভবিষ্যতেও থাকব। আমরা আপনাদের সাহায্য চাই।

ব্যাপারটা খুলে তো বলবেন।

ভিতরে চলুন।

কেয়ার ফর আ ড্রিঙ্ক? এটাও আইন-বহির্ভূত। কিন্তু আমার যে কাজ করতে হয় তাতে সবসময় আইন মানলে চলেও না। আজ ঠাণ্ডাটাও জোর পড়েছে।

পৃথু ঘরে ঢুকে দেখল যে ভিতরে দুটি ফোল্ডিং খাট। একটি ফোল্ডিং টেবল। বাংলোর চারপাশে আর্মড-গার্ডস। হঠাৎ আবিষ্কার করল যে চেক-চেক লুঙি আর কুর্তার উপরে বেগুনি-রঙা র‍্যাপার চাপিয়ে মৌলভী বসে আছে। ‘পা-তুলে’ একটি চৌপাইতে। পৃথুর দিকে চেয়ে বলল, সেলাম ওয়ালেকুম।

লালসাহেব পিটার-স্কট-এর বোতল থেকে একটা হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে ওয়াটার-বটল থেকে জল মিশিয়ে দিলেন। উনি নিজেও একটা নিলেন। মৌলভীর বিড়ি ছাড়া আর কোনও নেশা নেই। বিড়ি আর প্রত্যহ মোরগা-নিধন।

হুইস্কিতে একটি চুমুক দিয়ে পৃথু বলল, এবার বলুন মিঃ লাল।

হ্যাঁ। মন দিয়ে শুনুন। আপনারা না জেনে ডাকু মগনলালের দলের উপর চড়াও হয়ে তাদের শিক্ষা দিয়েছেন। মগনলালও দলে ছিল। কিন্তু দারুন ধূর্ত সে। সময় বুঝে গা-ঢাকা দিয়েছিল। খুব সম্ভব ও আপনাদের দেখেছে আড়াল থেকে। নাও দেখে থাকতে পারে। তবে, লালটু সিং একমাত্র আপনাকেই চিনেছিল এবং আপনার নামও বলেছিল। ঘোষ সাহেব, ম্যানেজার। যদি এই কথাকটিও মগনলাল শুনে থাকে তাহলে আপনার খুবই বিপদ।

সেকথা বুঝলাম। এখন আপনি কেন এখানে নিয়ে এলেন আমাকে এমন পাকড়াও করে তা ভাল করে বুঝিয়ে বলুন।

আমরা, মানে ভোপালের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স মগললালের এই এলাকাতে আসাটাতে খুবই কনসার্নড হয়ে পড়েছি। গোয়ালিয়র, ভিন্দ, মোরেনা এবং বেহড়ের মানুষরা সব সময়ই সব কিছুইর জন্যে তৈরি থাকে। কিন্তু এই সব অঞ্চল এখন পর্যন্ত পুরোপুরি শান্তিপূর্ণই ছিল। কাছেই মালাঞ্জ খণ্ড এবং মোগাঁও। এই সব জায়গায় মগনলালের দল একবার দৌরাত্ম্য শুরু করলে তা বড়ই মুশকিলের হবে। যুদ্ধে যেমন শত্রু একসঙ্গে একাধিক ফ্রন্ট ওপেন করলে তাকে জুৎ করতে বড়ই অসুবিধা হয়, এই ব্যাপারেও তাইই। বড়কর্তারা জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন। তাঁদের নির্দেশেই আমার এখানে আসা। এই দেখুন আপনার নামে আই জি সাহেবের নিজের হাতে লেখা অনুরোধপত্র। এ চিঠি টাইপ পর্যন্ত করা হয়নি, সিকিওরিটির কারণে।

পৃথু চিঠিটা খুলে পড়ল। তারপর ফেরৎ দিল লালসাহেবকে।

বল পয়েন্ট পেন বের করে লাল সাহেব বললেন এক লাইন লিখে দিন যে, চিঠিটি আপনি দেখেছেন।

পৃথু লিখল। সীন। থ্যাঙ্কস।

এইবারে শুনুন, আমরা মগনলালকে এবং তার দলকে যদি এলিমিনেট করতে নাও পারি, তবু এ অঞ্চল থেকে হটিয়ে বা তাড়িয়ে যেখানে আমাদের ফোর্স আছে সেইদিকে নিয়ে যেতেই চাই।

ডাকাতদের, এমন একটা প্রোপাগাণ্ডা আমরা দিতে চাই। আসলে এ কারণেই কাগজগুলোতে বেরিয়েছিল যে মগনলালকেও সাহস এবং নিষ্ঠুরতায় ম্লান করে দিয়ে অন্য এক ডাকাতের দল তার দলের লোকের উপর বদলা নিয়েছে গোপনে। ব্রিফিং করে দিয়েছিলাম প্রেসকে এইভাবেই। মৃত ডাকাতদের ছবিও ছাপা হয়েছিল রিপোর্টের সঙ্গে, আমাদের ব্রিফিং মতো, মগনলাল পুলিসের হাত থেকে যদি বা বাঁচে, বাঁচতেও পারে, কিন্তু এই দলের হাতে তার নিস্তার নেই।

বাঃ। পৃথু বলল। আর কী বলবে ভেবে না পেয়ে এক ঢোঁকে হুইস্কিটা শেষ করে।

কী হল?

না। লোকে বাগী হয়ে বেহড়ে চলে গিয়ে ডাকাত হয়, আর আপনারা আমাদের জোর করেই ডাকাত বানাচ্ছেন।

লালসাহেব আরেকটা হুইস্কি ঢেলে দিলেন পৃথুকে। বললেন, উই হ্যাভ নো চয়েস। অ্যাণ্ড মে বী, উ্য হ্যাভ নান্‌, আইদার! বিলিভ মী, মিঃ ঘোষ। উই রিয়ালী হ্যাভ নান। মিঃ ঘোষ, মৌলভাই যে লালটু সিংকে ওঁর বন্দুক দিয়ে মেরেছেন তা থার্মাল নাইট্রেট টেস্ট করে এক্ষুনি প্রমাণ করতে পারি আমরা। কিন্তু তা আমরা করব না। দেশের মানুষ যদি সাহসী না হয়, যারা অত্যাচারিত, লুণ্ঠিত তাদের নিজেদের মধ্যে থেকে যদি রেজিস্ট্যান্স না আসে তবে মধ্যপ্রদেশের ডাকাতির সমস্যার সমাধান কোনওদিনও হবে না। আপনাদের সাহায্য আমাদের খুবই দরকার। ইটস আ ম্যাটার অফ ন্যাশানাল ইন্টারেস্ট।

পৃথু হতবাক হয়ে আরেকটি চুমুক দিল গ্লাসে। মৌলভী গিয়াসুদ্দিন ইয়া আল্লা! বলে শুয়ে পড়ল চৌপাইয়ে।

লাল সাহেব বললেন, মিস্টার ঘোষ, আপনার নাম দেওয়া হয়েছে ডাকু শের সিং। ডাকাত দলের সর্দার।

পৃথু হেসে ফেলল। বলল, নো ডাউট, ইটস দা জোক অফ দা ইয়ার।

মৌলভীর নাম মোটেলাল। ভুচু, মোটর মেকানিকের নাম সাঁওয়া। আপনার দলে আর যারা আছে তাদের নাম আপনি ইচ্ছেমতো দিয়ে দেবেন। সেদিনের কাগজে শের সিং, মোটেলাল এবং সাঁওয়ার নাম বেরিয়েছিল। স্থানীয় লোকজন আঁতকে উঠেছিল। মগনলাল এবং তার দলবলও তাই। বেচারা মাথার চুল ছিঁড়ছে এখন কে এই ডাকু শের সিং? এই গবেষণায়। শের সিং-এর যা প্রোপাগাণ্ডা হয়েছে তাতে মগনলাল ভয়েই না পালায়! বুঝতেই পারছেন ঘোষ সাহেব, অনেকখানি ঝুঁকিই নিয়ে ফেলেছি, জানি না কী হবে?

এমন সময় তাঁবুর দরজার সামনে থেকে একজন কে যেন ঘরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন।

কাম-ইন পাণ্ডে। লালসাহেব বললেন।

ভুচু এসে ঢুকল। পাণ্ডে নামের এ-এস-আই ভুচুকে সঙ্গে করে নিয়ে ঢুকলেন তাঁবুতে।

পৃথু বলল, এসো, ডাকু সাওঁয়া সিং।

ভুচু বিরক্ত গলায় বলল, মানে?

লালসাহেব হেসে উঠলেন। পৃথুও।

পৃথু বলল, পরে সব বলব। তার আগে একটা হুইস্কি খাও। ভীষণ শীত আজকে। যা বলব, সব শুনলে আরও শীত করবে। মানেন তো আপনি যে, আজকাল মেডিয়া সব কিছুই করতে পারে? পঙ্গুকে দিয়ে গিরিলঙঘন অথবা গুণীকে নির্গুণ? মেডিয়ার মাধ্যমে শের সিং-এর মীথকে আমরা রিয়ালিটি করে তুলব।

আপনাদের সবাইকে আমার জীপই পৌঁছে দিয়ে আসবে। সাবধানে থাকবেন সবাইই। কোনও বিপদ বা বিপদের সম্ভাবনা দেখলেই আমাকে ফোন করবেন। ডায়রেকটলি। হাটচান্দ্রার থানার থ্রতে নয়। আমার বাড়ি এবং অফিসের নাম্বার দিলাম, এই যে! সকলের কাছেই রাখবেন। কোনও দ্বিধা না করে দিনে রাতের যে কোনও সময়ই ফোন করবেন দরকার মনে করলেই। সঙ্গে সঙ্গে সবরকম সাহায্য আমি করব। আপনাদের সঙ্গে একটা ওয়্যারলেস সেটও দিয়ে দেব।

আচ্ছা, এবার এগোন আপনারা। গুড লাক। গুড হান্টিং।

এই খামটা রাখুন। আর একটা বাক্স রাখা আছে জীপে অ্যামুনিশন আছে তাতে। আপনাদের পিস্তলের এবং শট-গানের। এটুকু অন্ততঃ আমাদের করতে দিন, প্লীজ।

পৃথু বলল, ওগুলো তুমি তোমার গারাজে নামিয়ে রেখো ভুচু।

জীপ স্টার্ট করার আগে মিঃ লাল হুইস্কির বোতলটা দিয়ে দিলেন ভুচুকে। আর জলের বোতল এবং গ্লাসও। হেসে বললেন, দেরি করে বাড়ি ফেরার সবচেয়ে ন্যাচারাল একসপ্লানেশান হচ্ছে, কোথাও জমে গেছিলেন, তাই না? বাড়িতেও যেন কেউ সন্দেহ না করেন। ভুচুর দিকে ফিরে বললেন, নট ইভিন মিস্ পামেলা।

বলেই, মুখ গাড়ির ভিতরে করে ফিসফিসে গলায় বললেন, চারটে খামে মগনলাল এবং তার দলের দশ জনের ফোটো আছে। মুখগুলো ভাল করে চিনে রাখবেন। পোশাক নয়। ওরা যখন তখন ভেক বদল করে।

পৃথুকে যখন নামিয়ে দিয়ে গেল জীপ তখন অনেক রাত। রুষাও ঘুমিয়ে পড়েছে। দুখী ছিল। হটকেস থেকে খাবার বেড়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *