নির্বাচিত কলাম – মেয়েদের ‘চরিত্র’
ছেলের দুর্নামের চেয়ে মেয়ের দুর্নামের প্রকৃতি ও পরিণতি খুব ভয়ঙ্কর হয়। ধরা যাক একটি ছেলে খানিকটা উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির, যেমন নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই, ঘরে মন বসে না, বাইরে টো-টো করে ঘোরে। এই শব্দাবলি একটি ছেলের চরিত্র বর্ণনে ব্যবহৃত হলে ছেলেটির জন্য মানুষের মায়া হয়, কিন্তু একটি মেয়ের বেলায় তা ব্যবহৃত হলে অধিকাংশ মানুষ নাক সিঁটকোয়।
মেয়ে মাত্রই সময়মত নাওয়া-খাওয়া করতে হবে। গায়ের ময়লা ঘষে-মেজে সাফ করতে হবে। খেতে বসে বড় বড় মাছ-মাংস পাতে তুললে খারাপ দেখায়। লক্ষ্মী মেয়ের মত অল্প খেয়ে উদর পূর্তি না হোক, হৃদয় পূর্তি করতে হবে। মন বসাবার উপাদান না থাকলেও ঘরে মন বসাতে হবে। নিয়মিত রান্নাবান্না, সেলাই-কর্ম ইত্যাদির পাশাপাশি সংসারের সৌন্দর্য বর্ধনে সক্রিয় হতে হবে। এই না হলে কী মেয়ে।
একটি ছেলের যদি ঘরে মন না বসে, তাতে অন্যায় নেই, কিন্তু একটি মেয়ের যদি তা হয়—তবে আর মুখরক্ষা হয় না। ছেলেদের বিকেল-সন্ধ্যা আড্ডা দেওয়া খুব গ্রহণযোগ্য ঘটনা। একটি মেয়ের যদি সারা বিকেল আড্ডা দেবার অভ্যাস হয় তবে ঘরে বাইরে তার আর সম্মান থাকে না।
প্রায় ছেলেই ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়ে দেখে। আমি একবার রাস্তায় একটি সুদর্শন ছেলেকে বার বার পিছন ফিরে দেখছিলাম। আমার সঙ্গের আত্মীয়টি এতে ছিছি করে উঠল, বলল—মেয়েদের এমন ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলে দেখতে হয় না। লোকে খারাপ বলে। আমি বললাম—ছেলেরা যে আমাদের দেখে ?
আমার আত্মীয় বলল—ওরা দেখলে ক্ষতি নেই। ওরা ছেলে।
ওরা ছেলে বলে সাত খুন মাফ। আমি মেয়ে বলে চমৎকার সুদর্শন একটি ছেলের দিকে বার কয়েক তাকাতে পারব না।
ছাদে দাঁড়িয়ে যে কিশোরী পাশের ছাদের ছেলের সঙ্গে হেসে কথা বলে, পাড়ায় সেই ছেলের নামে নয়, কিশোরীর নামে টি-টি পড়ে যায়। ছেলের কাছ থেকে দু’দিস্তা কাগজের চিঠি পেয়ে যদি মেয়ে একটি চিরকুট লেখে, সেই লেখার জন্য ছেলে হয়ত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়, কিন্তু মেয়ের কপালে জোটে অভিভাবকের চড়-থাপড়। উদ্যানে হাঁটাহাঁটি করে ছেলে যে উদ্যমে ঘরে ফিরতে পারে, মেয়ে তা পারে না। তার পদক্ষেপ হ্রস্ব ও নিঃশব্দ হয়, তার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, কারণ জানাজানি হয়ে গেলে পাড়ায় আর মুখ দেখানো যাবে না।
ছেলে এবং মেয়ের কোথাও রাত্রিবাস ঘটলে ছেলে খুব সহজেই নিস্তার পায়, মেয়ের দুর্নাম কলের কালো ধোয়ার মত বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। সেই মেয়ের তখন সমাজ-সংসার সব যায়।
ছেলে ও মেয়ে যদি আবেগে ঘনিষ্ঠ হয়, তবে সামাজিক দুর্ভোগ তো আছেই শারীরিক দুর্ভোগও ওই মেয়েকে একাই ভোগ করতে হয়। অর্থাৎ মেয়েটি গর্ভবতী হয়। ঘটনার সঙ্গী তখন ঝাড়া হাত-পা। কোনও দায় নেই, দায়িত্ব নেই।
দু’জনের একই কর্মে, একই ঘটনায় হয় ভিন্ন ফলাফল। ছেলের গায়ে ধুলোবালির মত যা লেগে থাকে তা ঝেড়ে ফেললেই পরিষ্কার, আর দুর্নামের যে কালি মেয়ের মুখে পড়ে, সামাজিক কোনও সাবান নেই তা ধোবার।
প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে তা জানি। প্রতিক্রিয়ার পার্থক্য হয় বিভিন্ন বস্তুতে। কিন্তু সে যদি জড় না হয়ে জীব হয়, যদি সে পশু না হয়ে মানুষ হয়—তবে মানুষে মানুষে প্রতিক্রিয়ার এত পার্থক্য কেন। দুর্নাম কেন মেয়ের একার, ছেলের নয় ?
একবার এক মাতাল ও বহুগামী স্বামীর সংসার ত্যাগ করে চলে আসে এক মেয়ে, মেয়েটি ভেবেছিল সমাজ তাকে আশ্রয় দেবে। অভিভাবকেরা মেয়েটিকে খাবার শোবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু সংসার ত্যাগের জন্য যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি, বক্রোক্তি, ব্যঙ্গোক্তি—এসব থেকে তাকে রেহাই দেয়নি। মেয়েদের ঘর থেকে ঘর বদলানোই একরকম নিরাপত্তা বলে ভাবা হয়। তাই নিরাপত্তার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সকল কর্তাব্যক্তিরা তাকে কায়দা করে দ্বিতীয়বার ঘর করতে পাঠায়।
মেয়েদের বিয়ে লটারির মত একটি ব্যাপার। স্বামী একগামী কি বহুগামী, স্বামী মদ্যপ কি মদ্যপ নয়, স্বামী বউ পেটাবে কি পেটবে না, স্বামী সন্তান জন্মে সক্ষম কি অক্ষম ইত্যাদি কিছুই না জেনে একটি মেয়ে সারা জীবনের জন্য তাকে গ্রহণ করে। ওই মেয়েটির দ্বিতীয় স্বামী অর্থলোলুপ, বর্বর, হীনমন্য নপুংসক এক লোক। মেয়েটি বেরোতে চায় সকল শৃঙ্খল ভেঙে। মেয়েটি বাইরের আলো-বাতাসে এসে বাঁচবার নিঃশ্বাস নিতে চায়। নারকীয় জীবন থেকে মেয়েটি মুক্তি চায়। কিন্তু পারে না। পারে না দুর্নামের ভয়ে। কারণ ঘর থেকে বেরোলেই দুর্নাম হবে মেয়ের, ছেলের নয়।
কোনও পশু-স্বভাবী পুরুষ নারীকে যত অত্যাচার করুক, দোষ হয় না। দোষ হয় অত্যাচারিতের। কারণ পুরুষ যত অত্যাচারীই হোক, তার সাত খুন মাফ।