নিছক খামখেয়ালে থিয়েটারের জগতে আসেনি অমরেন্দ্রনাথ, নিজেকে রীতিমতন প্রস্তুত করে নিয়েছে। বাল্যকাল থেকেই তার অভিনয়ের দিকে ঝোঁক, বাড়ির বৈঠকখানায় চৌকির ওপর মঞ্চ সাজিয়ে ভাই-বোনদের নিয়ে অনেক দুপুরে সে নাটক-নাটক খেলা খেলেছে। কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েই সে স্টার, এমারাল্ড, মিনার্ভায় প্রত্যেকটি নাটক দেখতে গেছে বারবার। বিলেত থেকে মাঝে মাঝে থিয়েটারের দল আসে, তাদের কোনও প্রযোজনাই সে বাদ দেয়নি। সাহেব পাড়ায় ঘুরে ঘুরে সে থিয়েটার বিষয়ে বহু বইপত্র সংগ্রহ করেছে, খুটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছে নট-নটীদের জীবনী।
ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা চাকরি-বাকরির কথা সে কখনও চিন্তাও করেনি, সতেরো বছর বয়েসেই সে ঠিক করেছিল, তার প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্র হবে রঙ্গমঞ্চ। শুধু অভিনয় নয়, পরিচালনা ও সম্পূর্ণ উপস্থাপনারও ভার নেবে সে। বিখ্যাত বংশের সন্তান হয়ে কারুর অধীনে থাকাও তার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই থিয়েটারেব মালিকও হতে হবে। এ রকম বাসনা সামান্য প্রকাশ করাতেই অমরেন্দ্রনাথ বড় দাদার কাছে ধমক খেয়েছিল। কত বিলাসী ধনী এর আগে থিয়েটার চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে, কোনও ভদ্র, বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনও ও পথে যায়?
তারপর থেকে অমরেন্দ্রনাথ ও বিষয়ে আর মুখ খোলেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইচ্ছেটি বদ্ধমূল হযেছে। নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে সে বহু রাত্রি জেগে থিয়েটার চালাবার হিসেব কষেছে। যেদিন সে একুশ বছরে পা দিল, সেদিনই সে স্বমূর্তি ধরল।
এখন সে সাবালক, পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেছে, নিজের অংশের টাকায় সে যা খুশি করতে পাবে। কোনও উপদেশ বা ভর্ৎসনা বা অনুরোধ সে গ্রাহ্য করল না। অর্ধেন্দুশেখর বিদায় নেবার পর আরও দু-একজন এমাবা থিযেটার চালাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, রঙ্গমঞ্চটি খালি পড়েছিল, অমরেন্দ্রনাথ সেটা লিজ নিয়ে নিল।
মাত্র একুশ বছর বয়েসের এক সদ্য যুবা, সবেমাত্র নাকের তলায় নবীন রোম গজিয়েছে, সে একা একটি থিয়েটার চালাবে যাবাই নাম-ডাক শুনে অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে, তার ওই অল্পবয়েসী ছোকবাটিকে দেখে প্রথমে থমকে যায়। অমরেন্দ্রনাথ তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে মস্কবা করে বলে, জানেন তো, আমার জন্ম হয়েছে পয়লা এপ্রিল, আমি সবাইকে এপ্রিল ফুল বানাব!
প্রত্যেকটি থিয়েটাবের নাড়ি-নক্ষত্রের সন্ধান রাখে অমরেন্দ্রনাথ, সে বেছে বেছে লোক ভাঙিয়ে আনতে লাগল। নৃতা-শিক্ষক, সঙ্গীত-শিক্ষক, রঙ্গভূমি-সজ্জাকর, রূপসজ্জাকর, কর্মসচিব। যথাসম্ভব প্রবীণদের এড়িয়ে অল্পবয়েসী অথচ যোগ্যতাসম্পন্নদের প্রতিই তার ঝোঁক। নট-নটী প্রায় সব নতুন। পুবনোদের মধ্যে কয়েকজনকে নিতেই হল, বড় বড় ভূমিকাগুলি চট করে নতুনদের শেখানো যাবে না। রিহার্সালের খুঁতখুঁতুনির জন্য অর্ধেন্দুশেখর মাসের পর মাস সময় নষ্ট করেছেন, নতুন নাটক নামাতে দেরি হয়েছে, খরচ বেড়ে গেছে অনেক, সেই জন্যই তিনি শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। অমরেন্দ্রনাথ সে ভুল করবে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে অভিনয় শুরু করে দিতে। চায়! একসঙ্গে চার-পাঁচখানা নাটকের মহড়া সে শুরু করে দিয়েছে।
খ্যাতিমান অভিনেতাদের মধ্যে একমাত্র মহেন্দ্র বসুকে নিতে হয়েছে, অধিকাংশ নাটকে দুটি প্রধান পুরুষ চরিত্র থাকে, অমরেন্দ্রনাথ নিজে অবশ্যই নায়ক সাজবে, দ্বিতীয় চরিত্রটির জন্য একটি পাকা অভিনেতার দরকার। অমরেন্দ্রনাথের পাশাপাশি মহেন্দ্র বসুকে দেখে দর্শকরাও বুঝৰে, সেকেলে অভিনয়রীতির সঙ্গে অমরেন্দ্রনাথ প্রবর্তিত নতুন ধারার কত তফাত।
প্রথম প্রথম থিয়েটারের ঝানু লোকেরা ভেবেছিল, আর একটি বড়মানুষের ছেলে মঞ্চে নায়ক সাজার লোভে আর অভিনেত্রীদের সঙ্গে ঢলাঢলি করার বাসনায় টাকা ওড়াতে এসেছে। সুতরাং এর মাথায় হাত বুলিয়ে যতটা পারা যায় আদায় করে নেওয়া যাক। কিন্তু কাছাকাছি আসার পর সবাই বুঝল, যতই কম বয়েস হোক, এ ছোকরার ব্যক্তিত্ব অসাধারণ। কেউ কোনও অসমীচীন কথা বললে অমরেন্দ্রনাথ বেশ কয়েক মুহূর্ত তার দিকে চুপ করে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘকায় রূপবান যুবা, পটল-চেরা চক্ষুর মণি দুটি যেন হীরকখণ্ড, মনে হয় যেন এক্ষুনি তার হাতে ঝলসে উঠবে তলোয়ার।
থিয়েটারের সব বিভাগের কাজ সে জানে ও বোঝে, সুতরাং তাকে ধাপ্পা দেওয়া সহজ নয়। যে-কোনও বিষয়ে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, তবু বড় বড় ব্যাপারগুলি ঠিক করার আগে সে সমস্ত কলাকুশলী ও নট-নটীদের এক জায়গায় ডাকে, সব বুঝিয়ে বলে। তারপর যোগ করে, আমি ঠিক যেমনটি চাই, তেমনটিই হওয়া চাই। যদি সার্থকতায় ভাসি, সেটা আমায় বুদ্ধিতেই হবে, আর যদি ব্যর্থতায় ডুবি তো নিজের বুদ্ধিতেই ডুবব। মনে রাখবেন, অন্য কারুর বুদ্ধিতে চলার পাত্র আমি নই।
রাত্রে বাড়ি ফেরারও সময় নেই, গ্রিনরুমে অমরেন্দ্রনাথের জন একটি খাট পাতা হয়েছে। সকাল থেকে মাঝ রাত্রি পর্যন্ত সে খুঁটিনাটি সব কিছুর তদারকি করে। রঙ্গমঞ্চটির খোল-নলচে পাল্টে যাচ্ছে একেবারে নতুন করে তৈরি হচ্ছে দর্শকদের আসন। ছারপোকার কামড় খেতে খেতে নাটক উপভোগ করা যায় না। আলোগুলি সব নতুন, সাজসজ্জা নতুন, পশ্চাৎপট নতুন। এতদিন পেছন দিকে একটা করে হাতে আঁকা দৃশ্য ঝোলানো থাকত, অমরেন্দ্রনাথ বিলিতি পত্রপত্রিকার ছবি দেখে দেখে ঠ্যালা সিন, কাটা সিন, বক্স সিন বানিয়েছে, এমনকী উইংস পর্যন্ত ঠেলে সরানো যায়। এক একটি অঙ্কের পর নেমে আসে কার্টেন যবনিকা। নাচের দৃশ্যে আলোগুলোকে নানা রঙের কাগজে মুড়ে তৈরি হয় স্বপ্নের পরিবেশ।
এতকাল মঞ্চের ওপর আসবাবপত্র দেখলেই বোঝা যেত যে সেগুলো নকল। প্যাকিং বঙ্গের ওপর কাপড় মুড়ে তৈরি হত খাট, আলমারি। অমরেন্দ্রনাথ সেই প্যাকিং বক্সগুলো লাথি মেরে মেরে বাইরে ফেলে দিল। চাঁদনিচক থেকে ভাড়া করে আনল আসল সোফা সেট, খাট, টেবিল-চেয়ার, নিজের বাড়ি থেকে ছবি আর আয়না এনে ঝুলিয়ে দিল দেয়ালে। একটা জ্যান্ত টিয়া পাখি সমেত খাঁচা দুলতে লাগল। একটি সত্যিকারের ঘোড়াও আনা হল। সেই ঘোড়ায় চেপে একটি দৃশ্যে অমরেন্দ্রনাথ মঞ্চে প্রবেশ করবে।
ক্লাসিক থিয়েটারে নাটক দেখতে এসে দর্শকরা প্রথম থেকেই চমকৃত হয়ে গেল। বাংলা রঙ্গমঞ্চে যে একঘেয়েমির ভাব এসে গিয়েছিল, একটি নবীন যুবক এসে যেন এক ফুয়ে তা উড়িয়ে দিয়েছে। সব কিছুই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। এখানকার নাটক বারবার দেখা যায়।
‘নল দময়ন্তী’ ও ‘বেল্লিক বাজার’ দিয়ে উদ্বোধন হল, একই সঙ্গে অমরেন্দ্রনাথ ‘হামলেট’, ‘রাজা-রানী’ ও ‘আলিবাবা’-র রিহার্সাল চালিয়ে যেতে লাগল। এক একটি নাটকের এক এক রকম স্বাদ। দর্শকরা ক্লাসিকে আসতে বাধ্য হবে, ক্লাসিকে আসা অভ্যেস হয়ে যাবে।
গিরিশবাবু যখন ‘ম্যাকবেথ’ নামিয়েছিলেন তখন চরিত্রগুলির মূল নামই রেখেছিলেন। সাজ-পোশাকও ছিল বিলিতি ধাঁচের, অর্থাৎ বাঙালি নট-নটীরা সাহে-মেম সেজেছিল। দর্শকরা সেই নাটক নেয়নি, অনেক দিন পর গিরিশবাবু স্বয়ং অভিনয় করতে নেমেছিলেন, সু তাঁর আকর্ষণেও টিকিট বিক্রি হত না। বালক বয়সে অমরেন্দ্রনাথ সেই নাটক দেখতে গিয়ে থলথলে চেহারার গিরিশবাবুকে সাহেবসাজা অবস্থায় দেখে হেসে ফেলেলি। নিজে সে সেই ভুল করবে না। ‘হ্যামলেট’ নাটকটি রূপান্তরিত করা হয়েছে ভারতেরই কোনও অঙ্গ রাজ্যের পটভূমিকায়, পাত্র-পাত্রীরাও দিশি, নাটকের নাম ‘হরিয়াজ’। মূল নাটকটি অবিকৃতই আছে, শুধু একটি পকি, টু বী অর নট টু বী, দ্যাট ইজ দা কোয়েশ্চেন এর সঠিক বাংলা হয় না, এর অনুবাদ করাও হয়নি। ওই পক্তিটি অমরেন্দ্রনাথ নিজেই মনে মনে বলে, মুখের অভিব্যক্তিতে ভাবটি ফুটিয়ে তুলতে চায়।
‘হরিরাজ’-এর রিহার্সাল চলছে টানা, সন্ধে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত, নারী চরিত্রগুলির অভিনয় অমরেন্দ্রনাথের পছন্দ হচ্ছে না। ধনী কন্যাদের মুখে একটা সারল্যের ভাব থাকে, তারা টাকা-পয়সার হিসেব বোঝে না, বাস্তবরুক্ষতার সঙ্গে পরিচয় না থাকার ফলে তাদের দৃষ্টি থাকে বিস্ময় ভরা, থিয়েটারের গরিব ঘরের মেয়েদের সেই ভাবটি বোঝাই সম্ভব নয়, খুব বড় অভিনেত্রী ছাড়া মুখে সেই ভাবটি অন্য কেউ আনতে পারে না।
এমারাল্ডে একটি অভিনেত্রীর মুখে একই সঙ্গে সারল্য ও তেজের ভাব দেখেছিল অমরেন্দ্রনাথ। নয়নমণি নামে সেই মেয়েটিকে পেলে কত ভাল হত। এমারাল্ড উঠে গেছে, তাকে পাওয়া স্বাভাবিক ছিল, এমারাল্ড সে মাইনে পেত একশো কুড়ি টাকা। অমরেন্দ্রনাথ তাকে দেড়শো টাকা বেতনের প্রস্তাব দিয়েছিল, তবু সে এল না। অর্ধেন্দুশেখর পেছন থেকে কী সব যেন কলকাঠি নেড়ে তাকে আটকাচ্ছে। কী চুক্তি আছে অর্ধেন্দুশেখবের সঙ্গে, তাও জানা যাচ্ছে না। যদি কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, তাতেও অমরেন্দ্রনাথ রাজি।
ক্লাসিকে যোগ দেওয়ার জন্য কত অভিনেতা-অভিনেত্রী লালায়িত, সকাল থেকে উমেদারদের ভিড় লেগে থাকে। এখন দ্বারবান দিয়ে তাদের আটকাতে হচ্ছে। আর অমরেন্দ্রনাথ নিজে থেকে যাকে চায়, সে-ই এল না!
দুদিন বাদে একজন লোক খবর নিয়ে এল, অর্ধেন্দুশেখরের পাত্তা পাওয়া গেছে, রামবাগানের এক শখের থিয়েটার দলে তিনি অবৈতনিক পরিচালক হয়েছেন, তাঁর এখন এমনই দুর্দশা। তিনি ওই নয়নমণির সঙ্গেও দেখা করেছিলেন, কিছু টাকা-পয়সা নিয়েছেন বোধ হয়, মেয়েটিকে চুক্তি থেকে মুক্তি দিয়ে গেছেন। গঙ্গামণির কাছ থেকে এ খবর জানা গেছে।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, তা হলে সে এখন আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে না কেন?
আশুতোষ বড়াল নামে লোকটি বলল, সেইটাই তো কথা, কারণটি শুনলে আপনি বাবু রাগ করবেন!
অমরেন্দ্রনাথ ভুরু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করল, টাকা বেশি চায়?
আশুতোষ বলল, না, ও মেয়ের টাকার আহিংকে নেই। কিন্তু নিজে থেকে সে আসবে না। আপনাকে আবার গিয়ে বলতে হবে।
তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে অমরেন্দ্রনাথ বলল, ঠিক আছে, যাব। থিয়েটার চালাতে এসেছি, ছেঁদো মান-সম্মানের কথা ভাবলে চলে? মনে করো, আর্ভিং যাচ্ছে এলেন টেরির কাছে। এক্ষুনি চলো।
অমরেন্দ্রনাথের নিজস্ব ভূত বৃন্দাবনকে ডাকা হল। সে বাবুর ধুতি বদল করে দেবে। অমরেন্দ্রনাথ নিজে ধুতি পরতে পারে না। তাদের পারিবারিক কেতা অনুযায়ী পায়ের জুতো জোড়া পর্যন্ত ভৃত্যরা পরিয়ে দেয়। এই সেদিনও অমরেন্দ্রনাথের চুল আঁচড়ে দিতেন তার বউঠান।
গঙ্গামণির বাড়ির সামনে জুড়িগাড়ি থেকে অমরেন্দ্রনাথ নামতেই অমর দত্ত এসেছে, অমর দত্ত এসেছে, বলে একটা শোরগোল পড়ে গেল সেই পল্লীতে। অনেক লোক তাকে দেখার জন্য ছুটে এল। এত অল্প সময়ের মধ্যেই যে এমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তা অমরেন্দ্রনাথ নিজেও জানে। ভিড়ের মধ্যে কেউ কে বলতে লাগল, আহা গো, কী রূপ, রাজপুর, রাষ্ট্রপুর।
গঙ্গামণি একেবারে বিগলিত হয়ে গিয়ে অমরেন্দ্রনাথকে বসাল একটি আরামকেদারায়। আজ সকালেই নয়নমণির সঙ্গে তার একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে। গঙ্গামণির দৃঢ় ধারণা ছিল যে অমরবাবুর মতন অত মানী একজন মানুষ একবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে, সে আর দ্বিতীয়বার আসবে না। সত্যিই সে এসেছে? নয়নমণির এত দেমাক কেন, তার নিজেরই এবার যাওয়া উচিত ছিল না? থিয়েটারের ম্যানেজার বা অ্যাক্টর বা রাইটার তো শুধু নয়, মালিক বলে কথা! মালিককে ভয়-ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখাতেই হয়।
দোতলায় নেমে এসে নয়নমণি দু হাত জোড় করে অমরেন্দ্রনাথকে নমস্কার জানাল। গঙ্গামণি চোখের ইশারায় বোঝাবারও চেষ্টা করল, প্রণাম কর, প্রণাম কর, তবু নয়নমণি তার থেকে বয়েসে ছোট এই যুবকটির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল না।
একটা কমলা রঙের শাড়ি পরে আছে নয়নমণি, মাথার চুল সব খোলা, শরীরে কোনও অলঙ্কার নেই। সোনার গয়না সে একেবারেই পরে না। অভিনয়ের সময় ছাড়া সে রুজ-পমেটম মাখে না মুখে। তবু তার শরীরের গড়ন ঝরে পড়ে লাবণ্য।
অমরেন্দ্রনাথ মুগ্ধভাবে কয়েক পলক চেয়ে দেখল নয়নমণির রূপ ও ব্যক্তিত্বের বিভা। তারপর পাশে কর্মসচিবকে বলল, আপনি সব জিজ্ঞেস করুন।
আশুতোষ বলল, হা গা বাছা, মুস্তাফি সাহেবের সঙ্গে তোমার কী সব চুক্তি ছিল, তা খারিজ হয়ে গেছে বলে আমবা শুনেছি। আমরা কি ভুল শুনেছি?
নয়নমণি বলল, না, আপনারা ঠিকই শুনেছেন।
—তা হলে তুমি ফ্রি? ক্লাসিকে যোগ দিতে কোনও বাধা নেই?
–আপনারা যদি চান, যোগ দিতে পারি।
—আমরা তোমার সঙ্গে লিখিত-পড়িত চুক্তি করব, তা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমার হুজ্জোত হবে না তত? মুস্তাফি সাহেব আবার ব্যাগড়া দেবেন না? ওনার সঙ্গে যে চুক্তিখানা ছিল, সেটা ছেঁড়া হয়ে গেছে?
–লিখিত কোনও চুক্তি ছিল না।
—বেশ বেশ। বেতনের কথাটা তো আগেই জানানো হয়েছে। মাস মাস দেড়শো টাকা পাবে। গাড়ি এসে তোমায় নিয়ে যাবে, পৌঁছে দেবে তো বটেই। মাঝে মাঝে হোল নাইট রিহার্সাল চলবে, অমরবাবুর প্রত্যেকটি কথা মানতে হবে।
এই সব কথা চলার সময় নিঃশব্দে বসে পা দোলাতে লাগল অমরেন্দ্রনাথ। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে গঙ্গামণির ঘবখানি। গঙ্গামণির বিভিন্ন বয়েসের বাঁধানো ফটোগ্রাফ ঝুলছে দেওয়ালে। অমরেন্দ্রনাথ গঙ্গামণিকে মঞ্চে কখনও দেখেনি।
চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর হবার পর আশুতোষ বড়াল দু হাত ঘষে পরিতৃপ্তির সঙ্গে বলল, যাক, সব পাকাপাকি হয়ে গেল, এখন আর কেউ তেণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করতে পারবে না। কাল থেকেই কাজ শুরু।
এবারে অমরেন্দ্রনাথ নয়নমণির চোখে চোখ রেখে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, নয়নমণি, তুমি আমাকে এখানে দু’বার আসতে বাধ্য করালে, নিজে যাওনি কেন আমার কাছে? তোমার চেয়ে আমার সময়ের দাম বেশি নয়?
নয়নমণি বলল, আপনার কাছে আমি যাইনি … লজ্জা করছিল!
অমরেন্দ্রনাথ বলল, লজ্জা? তুমি থিয়েটার করতে এসেছ, এর মধ্যে লজ্জার আবার স্থান কোথায়?
নয়নমণি বলল, প্রথমবারে আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। পরে ভেবেছি, নিশ্চয়ই আপনি রেগে আছেন। তাই ঠিক করেছিলাম, থিয়েটার না হয় আর না-ই হবে, তবু নিজে থেকে অমর দর সামনে গিয়ে আমি আর দাঁড়াতে পারব না।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, হুঁ, বুঝলুম। এর মধ্যে তুমি অন্য কোনও থিয়েটারে যোগ দেবার চেষ্টাও করোনি?
—না।
—কেন?
–কেন? ঠিক জানি না, এমনিই, ইচ্ছে হয়নি!
–তোমার বয়স কত?
—সাতাশে পা দিয়েছি।
গঙ্গামণি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না, না, ওর বয়েস তেইশ … ও কিছু জানে না।
নয়নমণি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, সে কী গো দিদি, আমি নিজের বয়েস জানব না? এই বৈশাখে আমার ছাব্বিশ পূর্ণ হয়ে গেছে।
অমরেন্দ্রনাথ উত্তেজিতভাবে বলল, না, না, তোমার সাতাশ হলে তো চলবে না। তোমার বয়েস একুশ। আমি বিজ্ঞাপনের হ্যান্ডবিলে লিখব ‘ষোড়শী রূপসী নায়িকা’।
নয়নমণির হাসি এবার সারা মুখে ছড়িয়ে গেল। সে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, তবে তো আমায় দিয়ে চলবে না। এত কমবয়েসী মেয়ের রোলে আমাকে মানাবে কেন!
গঙ্গামণি বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মানাবে, মানাবে। ভাল করে রূপটান দিলে কে বুঝবে যে ওর বয়েস বেড়েছে?
অমলেন্দ্রনাথ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সে আমরা বুঝব। শোনো নয়নমণি, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, তুমি বলবে তোমার বয়স একুশ।
নয়নমণি বলল, ওনা, তা কি হয়। সাতাশ বছরের মেয়েব বয়েস একুশ বললে লোকে বিশ্বাস কলবে কেন? আমি মিথ্যে কথাই বা বলব কী করে?
অমলেন্দ্রনাথ ধমকের সুরে বলল, আমার যে হিরোইন হবে, তার বয়স কি আমার চেয়ে বেশি হতে পারে? দশকলা মানবে কেন? আমার বয়েস আমি বাড়িয়ে বলব চব্বিশ, তোমাকে একুশ থাকতেই হবে।
আশুতোয় বলল, আ হা হা, অত কথা দরকার কী? উর্বশী, মেনকা, রম্ভাদের কি বয়েস বাড়ে? থিয়েটারে মেয়েদের ওই একই ব্যাপার। এমন মেক-আপ দেবে, ছাব্বিশকে ষোলো করা কিছুই না। বয়সের কথা আদৌ তোলার কোনও প্রয়োজন নেই। তা হলে এই ঠিক রইল। কাল বেলা এগারোটা গাড়ি আসবে, সারা দিন রিহাসৃলি।
নয়নমণি তবু লল, ভাল করে ভেবে দেখুন, আমাকে দিয়ে চলবে কি না। আরও তো কত মেয়ে আছে। আমার বয়েস কিন্তু সতি। সাতাশ। এখনও যদি চুক্তি ক্যানসেল করতে চান, আমি রাজি আছি।
অমরেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কী বললে, ক্যানসেল? মানাবে কি মানাবে না সেটা আমি বুঝব। ক্লাসিকের সঙ্গে কাৰুব চুক্তিব খেলাপ হতে পাবে না। মাসের পর মাস ঠিক মাইনে পেয়ে যাবে। কাল ঠিক বেলা এগারোটা।
তারপর গমণির দিকে ফিরে বলল, তোমার বাড়িতে এই নিয়ে দু’বার এলুম, তুমি একবারও কিছু যেতে দিলে–তো। হিব বাড়িতে অতিথি অভ্যর্থনার রীতি নেই?
গঙ্গামণি দারুণ লজ্জা পেয়ে, জিভ কেটে বলল, ও মা, সে কী কথা! আমি কোথা যাব গো! আপনি কত মানা বংশের লোক, বড় মানুষের ব্যাটা, আমাদের মতন হতভাগির বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছেন, এই কত ভাগ্যি। আমাদের হাতে ছোঁয়া খাবেন কি না।
অমরেন্দ্রনাথ খপ করে গঙ্গামণির একখানা হাত ধরে বলল, হাতের ছোঁয়ায় কি সন্দেশ রসগোল্লার স্বাদ পাল্টে যায় নাকি? আমরা থিয়েটারের লোক, আমাদের আবার জাত-পাত কী? থিয়েটারের লোক সবাই এক জাত। তা বলে এখন বাজারের খাবার আনতে পাঠিয়ো না। একদিন নিজের হাতে কিছু বানিয়ে খাওয়াবে।
গঙ্গামণি বলল, আমাদের নয়ন খুব ভাল রান্না করে। কই মাছ রাঁধে, দু’পিঠ দুরকম।
সে কথা না শুনে অমরেন্দ্রনাথ এগিয়ে গেল দেওয়ালের দিকে। কোনও এক নাটকের দৃশ্যের ফটোগ্রাফের সামনে দাঁড়াল। দুটি তরুণী হাত ধরাধরি করে নাচছে।
গঙ্গামণি ডান দিকের তরুণীটির দিকে আঙুল তুলে বলল, এইটে আমি। এখন কেউ চিনতেই পারবে না। আমিও যে এককালে ফিনফিনে রোগা ছিলুম, তা কেউ বিশ্বাসই করে না। আর এ পাশের জন বিনোদিনী। বিল্বমঙ্গল পালা—
অমরেন্দ্রনাথ বলল, ও, এই-ই বিনোদিনী! নামই শুনেছি, কখনও অ্যাকটিং দেখিনি। সে স্টেজ ছেড়ে দিল কেন?
গঙ্গামণি বলল, কী জানি, শ্বেতি না কুষ্ঠ কী যেন হয়েছে শুনেছি। বাড়ি থেকেই আর বেরুতে চায় না।
অমরেন্দ্রনাথ বলল, না, না, সে রকম কিছু নয়। গিরিশবাবুর সঙ্গে কী সব মান-অভিমান হয়েছিল … কেমন অভিনয় করত সে?
গঙ্গামণি বলল, তা বাবু মানতেই হবে, অ্যাকটিং-এ তার দাপট ছিল। নাচে-গানে সমতুল, ইচ্ছে করলেই ঝরঝর করে চক্ষু দিয়ে জল গড়াত।
অমরেন্দ্রনাথ ঘুরে দাঁড়িয়ে নয়নমণির দিকে চেয়ে বলল, ওকে তো আমি এমারান্ডে নাচতে-গাইতে দেখেছি। কী গো, তুমি বিনোদিনীকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না?