৩০ জুন, বুধবার ১৯৭১
রাজশাহী থেকে ডাঃ এ. কে. খানের ট্রাঙ্কল পেলাম। উনি আগামীকাল ঢাকায় আসছেন।
সাতক্ষীরা থেকে আইনু ঢাকা এসেছে। ওর বড় ভাই শামু অর্থাৎ ডাঃ শামসুল হক আমেরিকার মিশিগানে থাকে। শামু আইনুকেমিশিগানে নিয়ে যাবার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।
আইনুর কাছে সাতক্ষীরার এবং ঢাকা আসার পথের বিভিন্ন জায়গায় পাক আর্মির নৃশংস অত্যাচারের অনেক কাহিনী শুনলাম। নতুনত্ব কিছু নেই–সেই ঠাঠাঠাঠা করে মেশিনগান চালিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীকে খুন করা, শিশু-কিশোর-বৃদ্ধকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে মারা, মেয়েদের অসম্মান করা, ঘরবাড়ি, গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া। কাহিনী পুরনো হলেও আইনুর কাছে তা অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য। নিজের চোখে এসব দেখে আইনুর স্তম্ভিত, উদ্ভ্রান্ত ভাব এখনো কাটে নি।
এগারোটার দিকে বদিউজ্জামানের ফোন পেলাম, আপা, আপনি মেহের আপাকে চেনেন তো?
মেহের আপা? মানে–
ঐ যে মিসেস দেলোয়ার হোসেন, ধানমন্ডি ছনম্বর রোডে বাসা।
হ্যাঁ হ্যাঁ চিনি, মোটামুটি জানাশোনা আছে। ওঁর মেয়ে তো ইয়াসমিন, ছেলে নাসিম–
হ্যাঁ উনিই। উনি আপনাকে খবর দিতে বলেছেন–আপনি যেন আজ সময় করে ওঁর সঙ্গে দেখা করেন।
দেখা করব? কি ব্যাপার।
রুমীর খবর! এটুকু বলে বদিউজ্জামান ফোন রেখে দিল।
রুমীর খবর!আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। এক্ষুণিযাব?নাকি বিকেলে? ঘড়ির দিকে তাকালাম–এখন সাড়ে এগারোটা বাজে। নাঃ, বিকেল পর্যন্ত থাকা যাবে না
এখুনিই যাই। জামীকে ডেকে দাদার কাছে থাকতে বলে, বারেক-কাসেমকে রান্নাঘরের সব বুঝিয়ে দিয়ে তক্ষুণিই একটা রিকশায় করে মিসেস হোসেনের বাড়ি চলে গেলাম।
মিসেস হোসেন দরজা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে বসালেন। কেমন আছেন, কি ইত্যাদি কুশল প্রশ্নাদি শেষ হবার আগেই হঠাৎ তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন। দ্রুত উঠে দাড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, আপা, শিগগির আমার সঙ্গে ও ঘরে চলুন। বলেই হাত ধরে টান দিলেন।
কিছুই না বুঝে হতভম্বের মতো ওঁর টানে টানে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। এ ঘরে ওঁর ছেলেমেয়েরা রয়েছে, দেখলাম। উনি ঘরের অন্য প্রান্তে ছোট ড্রেসিং রুমটায় আমাকে ঢুকিয়ে বললেন, এইখানে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন। আমি গেট দিয়ে এক ভদ্রমহিলাকে ঢুকতে দেখেছি। উনি আপনাকে দেখলে মুশকিল হবে। পরে সব বলব। বলেই আবার দ্রুত পায়ে বসার ঘরে চলে গেলেন।
আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। কি ব্যাপার? রুমীর খবর জানতে এসে কোন বিপদে পড়লাম না তো?
দশ-পনের মিনিট পরে মিসেস হোসেন এসে আমাকে ডেকে নিয়ে মেয়েদের এই শোবার ঘরটাতেই খাটে বসলেন। খুলে বললেন সব ব্যাপার।
তখন গেট খুলে মিসেস এম. ঢুকছিলেন। ভাগ্যিস, মিসেস হোসেন যেখানে বসেছিলেন, সেখান থেকে জানালা দিয়ে গেটটা দেখতে পেয়েছিলেন, তাই সময়মতো রক্ষা পাওয়া গেছে। মিসেস এম. আমার উপস্থিতি টের পান নি।
মিসেস এম. মিসেস হোসেন এবং ঢাকার আরোকিছু মহিলার অনেক দিনের পুরনো বান্ধবী। তবে গত বছর দুয়েক তেমন যাতায়াত ছিল না। হঠাৎ মাস দুই থেকে উনি আবার সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো বন্ধুত্ব ঝালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছে, উনি ইদানীং যে সব বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছেন, তার পরপরই সে সব বাড়ির কোনটাতে পাক আর্মির হামলা হচ্ছে বা কোন বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়ে যাচ্ছে। এতে এদের সবার সন্দেহ হচ্ছে যে, মিসেস এম. হয়ত গোপনে পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে কোনভাবে সহযোগিতা করছেন।
মিসেস হোসেন বললেন, বুঝলেন আপা, উনি আমি বহুবছরের পুরনো বন্ধু, অথচ আপনি নন। তাই আপনাকে আমার বাসায় দেখে উনি আসল ব্যাপারটা ঠিক বুঝে ফেলতেন। আপনার ছেলে যে মুক্তিযুদ্ধে গেছে–এটা উনি বের করে ফেলতেন।
মিসেস হোসেনের অনেক আত্মীয়ের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। এক বোনের দেওরের এক ছেলে সম্প্রতি ঢাকায় এসেছে। সে বলেছে রুমী আগরতলার কাছাকাছি এক ক্যাম্পে আছে, ট্রেনিং নিচ্ছে, ভালো আছে।
এইটুকুমাত্র খবর? যে ছেলে খবর এনেছে, তাকে পর্যন্ত দেখলাম না, তার মুখ থেকে নিজে কিছু শুনলাম না! মনটা ভীষণ দমে গেল। সেই ছেলের কাছে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। মিসেস হোসেন বললেন, সে ছেলে এখন খুব অসুস্থ অসুস্থ বলেই ঢাকা ফিরে এসেছে। এখন সেখানে যাওয়ার অসুবিধে আছে।
আমি খুব নিরাশ, খুব অতৃপ্ত মনে বাড়ি ফিরে এলাম।