শহরের সমস্ত লোক যেন বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে সন্ধেবেলা। সকলেরই মুখে বিস্ময়। এ কি সত্যি, এ কি সম্ভব?
সাধারণ মানুষ ভোটের ফলাফল নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। সেই তো থোড়বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-ঘোড়। এর চেয়ে আর উনিশ-বিশ কী হবে? কংগ্রেসের দু-চারটে আসন কমবে কিংবা বাড়বে, এ ছাড়া তো আর কিছু না!
দুপুর থেকেই হঠাৎ রটে গেল যে কংগ্রেস এবার গো-হারান হারছে। রাস্তা দিয়ে জিপ গাড়ি নিয়ে হুল্লোড় করতে করতে যাচ্ছে অল্পবয়েসী ছেলেরা। বিকেলের দিকে বেরিয়ে গেল টেলিগ্রাম। কংগ্রেসে সত্যিই ইন্দ্রপতন ঘটে গেছে, বড় বড় নেতারা ডুবেছেন প্রায় সবাই। পূর্ব ভারতে কংগ্রেসের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা, প্রতিটি ভোটযুদ্ধে যিনি সার্থক সেনাপতি, সেই অতুল্য ঘোষ নিজেই হেরে গেছেন সি পি আই-এর এক প্রায় অপরিচিত প্রার্থী জিতেন্দ্রমোহন বিশ্বাসের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে হারালেন তাঁর আজীবন সহকর্মী ও বন্ধু, বর্তমানে কংগ্রেস-বিরোধী নেতা অজয় মুখার্জি। বেয়াল্লিশ সালের খ্যাতনামা বিপ্লবী, কিছুদিনের জন্য ব্রিটিশ শাসন থেকে মেদিনীপুরের খানিকটা অংশকে মুক্তাঞ্চল করেছিলেন যিনি, সেই অজয় মুখার্জিকে কিছুদিন আগে চরম লাঞ্ছনার সঙ্গে বিতাড়ন করা হয়েছিল কংগ্রেস অফিস থেকে, আজ তিনি তার প্রতিশোধ নিলেন।
বর্ষীয়ান নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্য রেষারেষি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন হলেও কংগ্রেসের এতখানি বিপর্যয় সত্যি বিস্ময়ের। কারণ বিরোধী দলগুলি শেষ পর্যন্ত এককাট্টা হতে পারেনি। বিরোধীদের মধ্যেও আলাদা দুটি ফ্রন্ট। অনেক আসনে লড়াই হয়েছে ত্রিমুখী। কংগ্রেসের সংগঠন অনেক বড়, সরকারি শাসনযন্ত্র তাদের হাতে এবং ভোটের জন্য টাকা খরচ করার ক্ষমতাও অনেক বেশি, তবু যে কংগ্রেস হারলো তাতেই প্রমাণ হয় যে জনসাধারণ কতটা বিরক্ত হয়েছিল তাদের প্রতি।
নামতে নামতে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা এসে থামলো ১২৭-এ। বিধানসভায় ২৮০টি আসনের মধ্যে সরকার গড়ার মতন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কংগ্রেসের রইলো না। ওদিকে মার্কসবাদী কমুনিস্ট দল পেয়েছে ৪৪টি, সি পি আই ১৬, ফরোয়ার্ড ব্লক ১৩, বাংলা কংগ্রেস ৩৪, বাকিগুলি অন্যান্য ছোট ছোট দলের। তা হলে সরকার গড়বে কারা?
দ্বিধাবিভক্ত বিরোধীদের এ দুই ফ্রন্টে একতা এসে গেল চট করে, তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও মার্কসবাদী কমুনিস্ট পার্টি মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি ছেড়ে দিল, সেই সম্মান দেওয়া হলো বাংলা কংগ্রেসের নেতা অজয় মুখার্জিকে, তাঁর আহত-অপমানিত ভাবমূর্তি কংগ্রেসকে ভাঙতে অনেকটাই সাহায্য করেছে।
ঠিক তিরিশ বছর পর কংগ্রেস আবার বসলো বিরোধীদের আসনে। স্বাধীনতার আগে, ১৯৩৭ সালে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে ফজলুল হকের দলের সঙ্গে হাত মেলায় নি কংগ্রেস। গড়তে দিয়েছিল লীগ মন্ত্রীসভা। এবারেও কংগ্রেস বিরোধীদের হাতে ছেড়ে দিল সরকার।
স্পীকারের বাঁ পাশে বসে বিরোধী দল, তাই তাদের নাম বামপন্থী; অনেকে বলাবলি করতে লাগলো, তাহলে কি আগের বামপন্থীরা এখন শাসক দলে গিয়ে দক্ষিণপন্থী হয়ে গেল?
পরাজয়ের পর যেন খানিকটা শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি ফিরে পেল কংগ্রেস। ১২৭টি আসন পেয়েও সরকার গড়ার লোভ ছেড়ে দিল কংগ্রেস, খুচরো খুচরো দলগুলো থেকে ১৩-১৪ জন এম এল এ কি তারা টাকা দিয়ে কিনে নিতে পারতো না? সে রকম উদ্যোগ না নিয়ে তারা গণতন্ত্রের মান রক্ষা করেছে। তা ছাড়া আগে, বিরোধীরা অতুল্য ঘোষ-প্রফুল্ল সেনদের নামে বহু কুৎসা রটিয়েছে, লোকে তা বিশ্বাসও করেছে। অতুল্য ঘোষ, প্রফুল্ল সেনরা চুরি করেছেন কোটি কোটি টাকা, ডালহাউসি স্কোয়ারে অফিস পাড়ায় বেনামীতে কিনেছেন বিশাল অট্টালিকা, খবরের কাগজে ছাপা হতো এইসব কাহিনী। ক্ষমতাচ্যুত হবার পর দেখা গেল, এদের ব্যক্তিগত ধন সম্পদ তেমন নেই। তবে কংগ্রেস দলের মধ্যে দুর্নীতি যে তাঁরা রোধ করতে পারেন নি, সে দায়ভাগ তাদের নিতেই হবে।
এ বছর সারা ভারতেই কংগ্রেসের অবস্থা শোচনীয়। পশ্চিমবাংলা ছাড়াও কংগ্রেসের হাত ছাড়া হয়ে গেছে কেরল, পাঞ্জাব, রাজস্থান। এবং উড়িষ্যা, বিহার, মাদ্রাজ ও উত্তর প্রদেশেও কংগ্রেসের টলমল অবস্থা। কেন্দ্রের লোকসভায় ৫২২টি আসনের মধ্যে ২৭৬টি পেয়ে ইন্দিরা গান্ধী কোনো রকমে সরকার গড়তে পেরেছেন। সাধারণ মানুষ কংগ্রেসকে খানিকটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু এতটা হীনদশা চায়নি, এখনো অনেকের ধারণা কংগ্রেস দলটা ভেঙে পড়লে এতবড় দেশ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
স্বাধীনতার পর পশ্চিমবাংলায় এই প্রথম শুরু হলো কংগ্রেস-বিরোধী এক পাঁচমিশেলি যুক্ত ফ্রন্টের শাসন।
ঠিক তার কয়েকদিন পরেই উত্তর বাংলায় নকশালবাড়ি থানার অধীনে একটি গ্রামে একটি জমি দখলের ঘটনা ঘটে গেল। একদল আদিবাসী কৃষক তীরধনুক, বর্শা, লাঠি-সোঁটা নিয়ে হৈ করে ছুটে এসে বসে পড়লো জমির ওপর, জমির মালিক বিশেষ প্রতিরোধের সুযোগ পেল না। সেই জমির চারপাশে লাল পতাকা পুঁতে দিয়ে ঘোষণা করা হলো যে এই জমি এখন থেকে কিষাণ সভার সম্পত্তি।
ছোট্ট একটি ঘটনা, আপাতত এর তেমন গুরুত্ব নেই। জোর করে জমি দখল করার চেষ্টা বা ফসল কেটে নিয়ে যাওয়া এমন কিছু নতুন ঘটনা নয় পশ্চিম বাংলায়। এ বছর মার্চ মাস থেকে। উত্তরবঙ্গে ভূমিহীন কিষাণদের জন্য এরকম জমি জবর দখলের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিল কৃষাণ সভা। তখন অবশ্য কেউ কল্পনাও করেনি যে কংগ্রেসের হাত থেকে সরকারি ক্ষমতা চলে যাবে। হঠাৎ ঘটে গেল এক বিরাট পরিবর্তন, এখন পশ্চিম বাংলার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যোতি বসু, পুলিশ বাহিনী তাঁর হাতে।
তার ফলে উৎসাহ উদ্দীপনা অনেক বেড়ে গেল। পরবর্তী দশ সপ্তাহে কাছাকাছি তিনটি থানার অধীনে এরকম জমি দখলের ঘটনা ঘটলো ৬০টি, কোথাও কোথাও সংঘর্ষ হলো সামান্য, কিন্তু জয় হলো কিষাণ সভার নেতৃত্বে সশস্ত্র কৃষকদের।
কিষাণ সভা শুধু জমি দখলেই আন্দোলন সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু শিলিগুড়ির নেতা চারু মজুমদারের ধারণা অন্যরকম। তিনি চিন্তা করছেন সশস্ত্র বিপ্লবের, যার প্রথম ধাপ এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা দখল। চাষী মজুরদের নিত্য ব্যবহার্য অস্ত্র দিয়েই ছোট ছোট এলাকা দখল করে বিপ্লবকে ছড়িয়ে দিতে হবে।
২৫শে মে ঐ নকশালবাড়ি থানার অধীনেই একটি গ্রামে জয়ের স্বাদ পাওয়া উগ্র কৃষক মজুরদের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো একটি পুলিশ বাহিনীর। পুলিশেরা তেমন তৈরি ছিল না। আহত হলো বেশ কয়েকজন পুলিশ, তাদের মধ্যে একজন ইন্সপেক্টর ওয়াংদি দুদিন পরে মারা গেলেন হাসপাতালে। ওয়াংদি যেদিন মারা যান, সেদিনই আর একটি পুলিশ দলকে ঘেরাও করলো উত্তেজিত জনতা। আজ পুলিশের বাহিনী তৈরি, তাদের চোখে জ্বলছে সহকর্মী হত্যার প্রতিহিংসার আগুন, গুলি চালালো সামান্য প্ররোচনাতেই। দশজন নিহতের মধ্যে সাতজন নারী এবং দুটি শিশু! যেন একটা ছোটখাটো জালিয়ানওয়ালাবাগ!
এই প্রথম নকশালবাড়ি নামে উত্তরবঙ্গের একটি অকিঞ্চিৎকর জায়গার নাম উঠলো খবরের কাগজে। ঘটনার বিবরণে সবাই স্তম্ভিত! মার্কসবাদী কমুনিস্ট পার্টির নেতার হাতে এখন পুলিশ দফতর। এই দল বরাবরই কৃষক ও মজুরদের ওপরে পুলিশের গুলি চালনার বিরোধী, সেই দলেরই আমলে পুলিশের হাতে মারা যায় সাতজন গ্রামের মহিলা ও দু’জন শিশু? মার্কসবাদী কমুনিস্ট দলও এই ঘটনায় সাংঘাতিক বিব্রত, তারা সরকারি শাসনযন্ত্র পরিচালনায় এখনও তেমন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা থেকে নির্দেশ দেওয়া হলো, ঐ রকম ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেই জন্য যেখানে কৃষকরা বেশি সংঘবদ্ধ, যেখানে তারা বেশি ক্ষুব্ধ, সেখানে আপাতত আর পুলিশ পেট্রল পাঠাবার দরকার নেই।
পুলিশের ঐ গুলি চালনার পর জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির কিছু তরুণ শপথ নিয়েছিল, নারী ও শিশুদের ঐ রক্তপাত ও প্রাণদান বৃথা যাবে না, প্রতিশোধ নিতে হবে।
কিছু কিছু এলাকা এখন পুলিশের টহল মুক্ত। সেখানে সরকারি শাসন নেই। এতে চারু মজুমদারের তত্ত্বই যেন সমর্থিত হলো। এই ভাবেই তো ছোট ছোট অঞ্চলের ক্ষমতা দখল করা যায়। বিদ্রোহী মজুররা এইভাবেই জয়ের স্বাদ পেতে পারে!
হঠাৎ একমাস বাদে পিকিং রেডিও এক অদ্ভূত ঘোষণা করলো। নকশালবাড়িতে নাকি মাও সে তুঙ-এর নির্দেশিত পথে বিপ্লবী ভারতীয় কমুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ দেখা দিয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে তিনটি পুলিশ স্টেশন, নিহত হয়েছে এগারো জন পুলিশ, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে লড়াই, পুলিশ এখন অনেক গ্রামে ভয়ে যায় না। চীনের জনগণের অনুসরণে ভারতের মানুষ সে দেশের প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের উচ্ছেদ করবে। আগে গ্রামে গ্রামে তৈরি হবে বিপ্লবের ঘাঁটি, তারপর গ্রাম থেকে ঘিরে ফেলা হবে বড় বড় শহরগুলি, সেই পথেই আসবে বিপ্লবের বিজয়!
কয়েকদিন পর চীনের পিপলস্ ডেইলি পত্রিকায় প্রকাশিত হলো এক প্রবন্ধ, ‘ভারতের ওপর বসন্ত-বজ্র’। তাতেও বলা হলো যে ভারতের কমুনিস্ট পার্টির একটি বিপ্লবী অংশ সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করে দিয়েছে। সেই বিপ্লব কোন পথে গেলে সার্থক হবে, তারও নির্দেশ দেওয়া হলো ঐ প্রবন্ধে। উগ্রপন্থীদের সমর্থন করে, ভারতের দুটি কমুনিস্ট পার্টিকে তীব্র শ্লেষ, বিদ্রূপ ও নিন্দেও করা হলো। এক দেশের কমুনিস্ট পার্টির অন্যদেশের কোনো কমুনিস্ট পার্টির ওপর এরকম আক্রমণ অভূতপূর্ব। ভারতের কমুনিস্ট পার্টিগুলি তৈরি থাক বা না থাক, এখনই ভারতে একটা। বিপ্লব শুরু করিয়ে দেবার ব্যাপারে চীন খুব ব্যস্ত।
ছাত্র ও তরুণদের মধ্যে বেশ কিছু অংশ সারা দেশের ক্রম-অধোগতি দেখে দেখে ফুঁসছে ভেতরে ভেতরে। সম্পূর্ণভাবে এই সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে না পারলে এ দেশের মানুষের মুক্তির কোনো আশা নেই এবং একমাত্র সর্বাত্মক বিপ্লবই আনতে পারে সেই পরিবর্তন। এবারের নির্বাচনের পর বামপন্থীরাও গণতান্ত্রিক পথ আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছে। দেখে তারা আরও ক্ষুব্ধ। এই গণতন্ত্রে গ্রামের মানুষ চলে যাচ্ছে দারিদ্র্য সীমার নীচে, ক্রমশ আরও নীচে, শুধু শহরে শহরে চলছে রাজনীতির কচকচি। এই সময় হঠাৎ চীনের কাছ থেকে এই বিপ্লবের ডাক সেই তরুণদের মনে জাগিয়ে তুললো আগুন!
কলকাতার দেয়ালে দেয়ালে দেখা গেল নকশালবাড়ির সংগ্রামের সমর্থনে পোস্টার। মাও সে তুঙ-এর লাল বই থেকে উদ্ধৃতি, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, এই ঘোষণা। প্রেসিডেন্সি কলেজের ভালো ছাত্ররা অসীম চ্যাটার্জির নেতৃত্বে শুরু করলো সরকার-বিরোধী মিছিল ও সংগঠন।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়া ছিল খুবই প্রত্যাশিত। শুধু কংগ্রেস বিরোধিতা নিয়েই বাঁধা হয়েছে বিভিন্ন দলগুলির মধ্যে গাঁটছড়া, তাছাড়া আর কোনো আদর্শের মিল নেই। অজয় মুখার্জির বাংলা কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসেরই বি-টিম। জাতীয়তাবাদ ও ধনতন্ত্রের সঙ্গে আপোসনীতি তাদের মর্মে গেঁথে আছে। চীন তাদের চোখে ভারতের আগ্রাসনকারী তো বটেই, তাছাড়া পাকিস্তানের বন্ধু। সেই চীনের সমর্থনে পোস্টার এবং বিপ্লবের ডাক দেখে তাদের গাত্রদাহ হবেই।
বাংলা কংগ্রেস ও অন্যান্য শরিকদের চোখে উত্তরবঙ্গের হাঙ্গামাকারীরা সবাই মার্কসবাদী কমুনিস্ট দলের লোক। চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল এরা তো ঐ দলেরই সদস্য। কলকাতার শক্তিশালী মার্কসবাদী নেতা পরিমল দাশগুপ্তও নকশালবাড়ির সমর্থক। এদিকে মার্কসবাদী কমুনিস্ট দল সরকারের অংশীদার, পুলিশ দফতর তাদের হাতে, অথচ তারাই বেআইনী জমি দখল ও আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতিশ্রুতি দেবে, এ কী করে হতে পারে; গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে জিতে সংবিধানের শপথ নিয়ে তারা মন্ত্রিসভায় এসেছে, তবু তাদেরই দলের এক অংশ বিপ্লবের ডাক দিচ্ছে, এ যে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর।
মার্কসবাদী কমুনিস্ট দলও এই রকম ঘটনায় বিব্রত অবস্থা কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজতে লাগলো। উত্তরবঙ্গের হঠকারী বিদ্রোহীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা হলো অনেক। চীনা বেতারের ক্রমাগত প্রচার বিভ্রান্তি ছড়ালো আরও। চীনা বেতারের খবর অনুযায়ী উত্তরবঙ্গের প্রকৃত বিপ্লবীরা সংগ্রাম শুরু করে দিয়েছে মাও সে তুঙ-এর চিন্তাধারায়, সুবিধাবাদী ও অনুগ্রহলোভী কমুনিস্ট দলগুলি তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না।
মাদুরাই-এ মার্কসবাদী কমুনিস্ট দলের সেন্ট্রাল কমিটি মিটিং-এ জবাব দেওয়া হলো চীনা বক্তব্যের। নকশালবাড়ির সামান্য একটা বিচ্ছিন্ন দলকে সমর্থন জানিয়ে ভ্রাতৃপ্রতিম কমুনিস্ট দলকে আক্রমণ কখনো মার্কসবাদী লেনিনবাদী নীতি সম্মত হতে পারে না। চীনের এই অপপ্রচারে ভারতের প্রতিক্রিয়াশীলদেরই মদত দেওয়া হচ্ছে। রুশ কমুনিস্ট পার্টির হস্তক্ষেপে এবং প্রচারে চীনারা এক সময় ক্ষিপ্ত হয়েছিল, আজ ভারতের ব্যাপারে চীনা কমুনিস্ট পার্টি তো সেই একই কাণ্ড করছে!
চারু মজুমদার ও তাঁর সমর্থকদের যখন কিছুতেই চুপ করানো গেল না তখন মার্কসবাদী কমুনিস্ট দল থেকে খারিজ করে দেওয়া হলো তাঁদের নাম। দার্জিলিং জেলা কমিটি ভেঙে দেওয়া হলো, দল থেকে বহিষ্কৃত হলো প্রায় এক হাজার জন উগ্রপন্থী, সৌরেন বোস, সরাজ দত্ত, এমনকি দেশহিতৈষী’র সম্পাদক সুশীতল রায়চৌধুরীর মতন প্রবীণ নেতাও বাদ গেলেন না। সরকারের অন্যান্য শরিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে উত্তরবঙ্গের হাঙ্গামায় মার্কসবাদী দলের সমর্থন নেই। এতদিন পুলিশকে নিবৃত্ত করা হয়েছিল, চীনের বেতারের মতে সেটাই সরকারি শক্তির পরাজয়, সশস্ত্র কৃষকদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পুলিশ বাহিনীর নেই, সুতরাং বিপ্লব সেখানে শুরু হয়ে গেছে।
এবারে পুলিশকে যতদূর সম্ভব কম রক্তপাত ঘটিয়ে ঢুকে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হলো গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায়। সুসংহত পুলিশবাহিনীর সামনে কৃষকরা প্রতিরোধে দাঁড়াতেই পারলো না। সংঘর্ষ হলো অতি সামান্য। বন্দী করা হলো প্রায় এক হাজার মানুষকে, পনেরো দিনের মধ্যে সব বিদ্রোহ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। জঙ্গল সাঁওতাল গ্রেফতার হলেন, কানু সান্যাল পলাতক। অসুস্থ চারু মজুমদার আটক হলেন নিরোধমূলক আইনে। বাংলার বিপ্লব তখনও শুধু গর্জন করতে লাগলো পিকিং বেতারে।
এরপরেও যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার ফাটলে জোড়াতালি দেওয়া গেল না। আজ যায়, কাল যায় অবস্থা। সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ এখন প্রতিদিন রাজনীতির আলোচনায় মত্ত। সরকারের মধ্যে দলাদলি ও কলহ বেশ একটা মুখরোচক বিষয়।
শিলিগুড়িতে চাকরি নিয়ে যাওয়ার পর সাত আট মাস কেটে গেছে, অতীন এর মধ্যে একবারও কলকাতায় আসে নি। সে চিঠিপত্তর দেয় বটে, তবু মমতার উদ্বেগ কমে না। এতদিন একটানা ছেলেকে না দেখার যে কষ্ট তা অন্য কেউ বুঝবে না। মমতা নিজেও যেন বুঝতে পারেন না। ছেলে বড় হয়েছে। সে তো বাইরে থাকবেই, লেখাপড়ার জন্য, চাকরির জন্য সন্তানদের আরও কত দূর দূর দেশে যেতে হয়। এ সব জেনেও তাঁর বুক টনটন করে কেন? ছেলেটা বড় হয়েছে ঠিকই, তবু ওর মধ্যে একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব রয়ে গেছে, যখন তখন মাথা গরম করে, পরে দুঃখও পায় সেজন্য। ছেলেটার মন যে কত নরম, তা শুধু মমতা জানেন, নতুন জায়গায় নতুন মানুষজনের সঙ্গে ও কি মানিয়ে নিতে পারবে? নর্থ বেঙ্গলে কী সব যেন গণ্ডগোল হচ্ছে, তা শুনে মমতার আরও আশঙ্কা হয়।
মমতার খুব ইচ্ছে একবার শিলিগুড়িতে গিয়ে বাবলুর থাকার জায়গাটা দেখে আসার। ছেলেটা কেমন ঘরে থাকে, দু বেলা ঠিক মতন খেতে পায় কি না, রাত্তিরে মশারি টাঙাতে ভুলে যায় কি না, এসব জানতে পারলে অনেক স্বস্তি হয়। বাবলু সে সব কিছু লিখতেই চায় না। প্রথম প্রথম একবার লিখেছিল, বেগুন ভাজতে গিয়ে গরম তেলের ছিটে লেগে তার বাঁ গালে একটা ফোস্কা পড়েছে। সে চিঠি পড়ে মমতা হেসেছিলেন। যে ছেলে কোনদিন এক কাপ চা তৈরি করে খায় নি, সে রান্না করতে শিখছে। তবু হোটেলের খাওয়ার চেয়ে নিজে রান্না করে খাওয়া ভালো।
এখন বাবলু আর বাড়ির কথা কিছু লেখে না। শুধু একটা পোস্টকার্ড পাঠায়। প্রতিবার প্রায় একই কথা, আমি ভালো আছি, তোমরা কেমন আছো? চিঠি লিখতে জানে না ছেলেটা, সেই তুলনায় তুতুল অনেক সুন্দর চিঠি লেখে। প্রথম বিদেশে গিয়ে বেশ বিপদে পড়েছিল তুতুল, এখন সামলে নিয়েছে অনেকটা। একটা চাকরিও পেয়েছে।
একটা ব্যাপারে খটকা লাগে মমতার। মা বাবার সঙ্গে দেখা করার গরজ না থাক, অলির সঙ্গে দেখা করার জন্যও ছেলেটা আর এলো না? এমন তো কিছু দূর নয়, কলেজের চাকরিতে ছুটিছাটাও থাকে অনেক। প্রত্যেকটা ছুটিতেই বাবলু দার্জিলিং, কুচবিহার, আলিপুরদুয়ারে বেড়াতে যাবার কথা লেখে।
ছেলের বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেননি মমতা। অলি আর বাবলু যে পরস্পরকে খুব পছন্দ করে, তা মমতা জানেন। অলি অত্যন্ত ভালো মেয়ে, বাবলুর মতন ছন্নছাড়া নয়, ওদের বিয়ে হলে বাবলুই ধন্য হয়ে যাবে। কিন্তু ওরা বিয়ে করতে চায় কিনা তা কী করে বোঝা যাবে? বাবলুর সঙ্গে এ সম্পর্কে কখনো কোনো কথা হয়নি মমতার। প্রতাপের কাছে দু একবার এই প্রসঙ্গ তুলেছেন, প্রতাপ পাত্তাই দেন নি। বিমানবিহারীর কাছে প্রতাপ কোনোক্রমেই এরকম প্রস্তাব দিতে পারবেন না। বিমানবিহারীরা তাদের চেয়ে অনেক বেশি অবস্থাপন্ন, তাঁরা কোথায় মেয়ের বিয়ে দেবেন, সে তাঁরা বুঝবেন। প্রতাপ কিছুতেই বন্ধুত্বের সুযোগ নিতে চান না।
মমতা ঠিক করেছেন, তিনি অপেক্ষা করবেন। অলির যদি অন্য কোথাও বিয়ের কথাবার্তা হয়, তখন তিনি লক্ষ করবেন তাঁর ছেলের প্রতিক্রিয়া। বাবলু যদি কষ্ট পায়, তা হলে তিনি নিজে গিয়ে অলির মা কল্যাণীর সঙ্গে কথা বলবেন।
মমতা একদিন প্রতাপকে বললেন, চলো না, আমরা কয়েকদিনের জন্য শিলিগুড়ি ঘুরে আসি। কতদিন কোথাও যাওয়া হয় না। সেই মা থাকার সময় তবু দেওঘর যাওয়া হতো, তারপর তো সে সব চুকেবুকে গেছে, এখন কলকাতায় একেবারে দম বন্ধ হয়ে আসে।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, বাবলু কি তোমাকে শিলিগুড়িতে যাবার জন্য একবারও লিখেছে?
মমতা বললেন, না, সে কথা লেখেনি। তবে, সে আমাদের নেমন্তন্ন করে নিয়ে যাবে তার কি মানে আছে? আমরা নিজের থেকে যেতে পারি না?
প্রতাপ বললেন, ছেলেদের কাজের জায়গায় মা বাবাদের হুটহাট করে যেতে নেই। তুমি কোথায় থাকবে, না থাকবে, তা নিয়ে বাবলু মুশকিলে পড়ে যেতে পারে!
–আমরা না হয় হোটেলে উঠবো!
–আমাদের বুঝি অঢেল টাকা পয়সা? মাসে মাসে ধার শোধ করছি। সামনের মাসে মুন্নির পরীক্ষার ফি দিতে হবে।
–আমি তোমায় একশো টাকা দিতে পারি।
–মমো, তোমার কাছে যদি একশো টাকা থাকে, সেটা বর্ষার দিনের জন্য জমিয়ে রাখো। আমার সব কটা সোর্স শুকিয়ে আসছে!
–তা বলে আমরা কোথাও একটুও বেড়াতেও যেতে পারবো না? কষ্ট করেও লোকে মাঝে মাঝে যায় বাইরে … বছরের পর বছর কলকাতায় এই একঘেয়ে জীবন।
–এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? ছেলেটাকে একটু সেটল করার সময় দাও। আমারও একবার দার্জিলিং ঘুরে আসার ইচ্ছে আছে।
একথায় মমতা সান্ত্বনা পেলেন না। মাঝে মাঝেই তিনি বাবলুকে স্বপ্ন দেখছেন। তুতুল নেই, বাবলু নেই, বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বাবলুর বন্ধুরাও কেউ আসে না।
মমতা ঠিক করলেন তিনি একাই যাবেন শিলিগুড়ি। অসুবিধের কী আছে, ট্রেনে চাপবেন, শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে বাবলু তাঁকে নিয়ে যাবে। এতগুলি বছর সংসার সামলাতে তিনি বাধ্য হয়ে ঘরকুনো হয়েছেন, কিন্তু প্রয়োজনে একা চলাফেরা করতে এখনো তাঁর অসুবিধে হয় না। প্রতাপ সময় পান না, বাবলু নেই, এখন প্রায়ই মমতাকেই বাজারহাট করতে যেতে হয়!
মুন্নির সামনেই পরীক্ষা, তাকে সঙ্গে নেওয়া যাবে না। টুনটুনিকে নিলে আরও অসুবিধে হবে। বরং মমতা চলে গেলে ওরা প্রতাপকে দেখাশুনো করতে পারবে। একা একা ট্রেনে করে অনেক দূরে যাওয়ার চিন্তাটা মমতাকে বেশ আরাম দেয়। কল্পনায় যেন মুক্তির বাতাস লাগে। এতখানি জীবনে তো নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কিছুই করা হলো না।
মমতা যেদিন শিলিগুড়ি যাওয়ার ব্যাপারে একেবারে মনস্থির করে ফেললেন, তার পরের দিনই একটা খামে চিঠি এলো বাবলুর। চিঠিটা পড়ে মমতা খুশী হলেন তো বটেই, আবার একটু একটু নৈরাশ্যও বোধ করলেন। সামনের সপ্তাহেই বাবলু কলকাতায় ফিরছে, মমতার আর যাওয়া হবে না। বাবলু লিখেছে :
মা,
আমাদের কলেজে একটা গোলমাল চলছে, ক্লাস বন্ধ, শিগগিরই খুলবে বলে মনে হয় না। আমার পক্ষে ভালোই হলো। প্রত্যেক মাসেই কলকাতায় একবার ফিরবো ফিরবো ভাবছিলুম, কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠছিল না। এই মাসে একসঙ্গে বেশ কিছু কলেজ ডি এ পেয়েছি। আগে প্রত্যেক মাসেই কিছু না কিছু জিনিসপত্র কিনতে হচ্ছিল। মাঝখানে আমাদের বাড়িতে চোর এসে বিছানা-বালিশ জামা-কাপড় সব নিয়ে গেছে। জলের কুঁজো দুটো ভেঙে দিয়ে গেছে। আমাকে একটা কম্বল কিনতে হলো, দু’বার দুটো ছাতা হারিয়েছি। কিন্তু এখানে ছাতা ছাড়া চলে না।
আমি ১২ তারিখ সোমবার কলকাতায় পৌঁছোবো। কৌশিক এসেছে, কৌশিকও আমার সঙ্গেই ফিরবে। মানিকদার হাঁপানি বেড়েছে, ওঁকেও নিয়ে যাবার চেষ্টা করবো। মানিকদা হয়তো কয়েকদিন আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। অনেকদিন নিজেদের রান্না খেয়ে খেয়ে মুখ পচে গেছে। অনেকদিন তোমার হাতের মুগের ডাল খাইনি। মানিকদাকে তুমি একদিন নারকেল চিংড়ি খাইয়ো। এদিকে চিংড়ি মাছ ভালো পাওয়া যায় না।
টুনটুনি পড়াশুনো করছে তো? মুন্নিরও পরীক্ষা এসে গেল। পিসিমাকে আমি আগে চিঠি দিয়েছি দুবার, পিসিমা একবারও নিজের হাতে উত্তর দেননি। পিসিমা ফুলদিকে চিঠি লেখেন, আমায় লিখতে পারেন না? বাবা ভালো আছেন নিশ্চয়ই! বাবার একজন বন্ধুর সঙ্গে এখানে আলাপ হয়েছে।
তোমরা আমার প্রণাম নিও।
বাবলু
বিছানার ওপর জোড়াসনে বসে চিঠিটা বারবার পড়ে যেতে লাগলেন মমতা। বাবলুদের ওখানে চুরি হয়ে গেছে? নিশ্চয়ই রাত্তিরে দরজা বন্ধ করতে ভুলে যায়। আজকাল চোরের উপদ্রব সব জায়গায়। মুগের ডাল খাবার শখ হয়েছে বাবলুর, আগে তো কোনোদিন বলেনি যে মুগের ডাল তার প্রিয়? এতদিন পর ছেলে আসছে, মমতার তো খুব খুশী হবারই কথা। তবু একটু একটু ক্ষোভও হচ্ছে, তাঁর আর একা একা ট্রেনে চেপে শিলিগুড়ি যাওয়া হলো না!