ট্রাম ধর্মঘট মিটলো দেড় মাস পরে। এতদিন ধরে ট্রাম চলেনি বলে ট্রাকগুলোতে মর্চে পড়ে গেছে। চৌরঙ্গির পাড়ায় সাউন্ড অফ মিউজিক সিনেমা দেখে অতীন বাড়ি ফিরলো ট্রামে চেপে। অনেকদিন পর ট্রামে চড়ায় তার বেশ নতুন নতুন লাগছে। মনটা বেশ ফুর্তিতে আছে তার। ফিল্মটা খুবই ভালো, আর একবার দেখার মতন, তা ছাড়া আজই অতীন শিলিগুড়ি কলেজ থেকে তার চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্টের চিঠি পেয়েছে।
ট্রামের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অতীন, ভেতরে ভিড়ের মধ্যে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। বুকফোলা একটা জহরকোট গায়ে সে ঠাণ্ডা বাতাস বেশ উপভোগ করছে। নর্থ বেঙ্গলে আরও অনেক বেশি ঠাণ্ডা হবে, এখন থেকেই সইয়ে নেওয়া ভালো। হঠাৎ সে যেন দেখতে পেল দিগন্তের গায়ে আঁকা পাহাড়ের শ্রেণী। জঙ্গল, কাঞ্চনজঙ্ঘা…সে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো, দা হিলস আর অ্যালাইভ উইথ দা সাউন্ড অফ মিউজিক…
ভবানীপুরের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে একবার ভাবলো, অলিদের বাড়িতে একবার নামবে,
নামবে না? অলিকে খবরটা দিতে হবে। অলি খুশি হবে খুব, অলি আগেই বলেছে, ছুটির সময় সে দার্জিলিঙ বেড়াতে যাবে, ততদিনে অতীন সব চিনে যাবে ওদিকটা। কিন্তু ভবানীপুর পেরিয়ে গেল, অতীনের নামা হলো না। অলির কাছে কাল আসবে, এখন রাত পৌনে ন’টা, বাবা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে থাকবেন তার যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য।
বাড়ির স্টপে নেমে অতীন দেখলো তাদের রাস্তার মোড়ের একটা মিষ্টির দোকান খুব আলো-টালো দিয়ে সাজানো হয়েছে, সেখানে মাইক বাজছে। কী ব্যাপার? বেশ কিছুদিন ধরে এই দোকানটা বেশ মনমরা হয়েছিল, প্রায় কিছুই পাওয়া যেত না। দোকানটা এখানে আছে কি নেই, সেটাই বোঝা যেত না।
দোকানটার সামনে বেশ ভিড়, দু’খানা বিরাট কাঠের পরাত ভর্তি ডাঁই করা সন্দেশ, লোকে চিলুবিলু করে কিনছে। ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে লোকজনের কথাবার্তা শুনে অতীন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আজ থেকে ছানার মিষ্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। আজ ময়রা ও মিষ্টি ব্যবসায়ীদের পক্ষে একটা বিরাট আনন্দের দিনই বটে। প্রফুল্ল সেনের খেয়ালে এই অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞায় কত মিষ্টির দোকানের কারিগর যে এতদিন বেকার হয়ে বসে ছিল তার ঠিক নেই। কয়েকজনের আত্মহত্যার খবরও বেরিয়েছে কাগজে।
আনন্দের চোটে আজ এই দোকানে সুস্তায় মিষ্টি দেওয়া হচ্ছে। চার আনা দামের বড় সাইজের সন্দেশ আজ এক টাকায় ছ’টা। অতীনও কিনে ফেললো দু’টাকার। এই প্রথম সে বাড়ির জন্য নিজে থেকে কিছু কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
সন্দেশের বাক্সটা হাতে নিয়ে অতীন মনে মনে হাসলো। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবার সন্দেশ খেতে দিচ্ছে সবাইকে। এদিকে বাজারে চাল নেই। ভাত খেতে না পাও তো সন্দেশ খাও; ফরাসী দেশের রানী মেরি আঁতোয়ানেৎ বলেছিল না, লোকেরা রুটি খেতে পাচ্ছে না, তাতে কি, তারা কেক খেতে পারে! দাঁড়াও না, একদিন এই ব্যাটাদেরও সবকটার গলা কাটা যাবে!
ট্রামের পর সন্দেশ। প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রায় চার মাস ধরে যে ধর্মঘট চলছে, সেটাও দু’একদিনের মধ্যেই মিটে যাবে শোনা যাচ্ছে। ভোটের আগে সরকারের এই সব তৎপরতা! ভোট! স্বাধীন ভারতের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচন। এবারে এখন অনেক তরুণ-তরুণী ভোট দেবে যাদের পরাধীন ভারতের কোনো স্মৃতি নেই। স্বাধীনতার দু’এক বছর আগে মাত্র জন্মেছে।
অতীন অবশ্য ভোট গ্রাহ্য করে না। শিলিগুড়িতে যেতে না হলেও সে ভোট দিত না। এ তো গাঁজাখোরদের ভোট। দেশের অর্ধেকের বেশি লোক খেতে পায় না, থ্রি ফোর্থ পপুলেশন নিজের নামটা পর্যন্ত পড়তে পারে না, এদের আবার গণতন্ত্র! ফুঃ! শুধু যারা খবরের কাগজ পড়ে, তারাই এ দেশের জনগণ’। জোতদার, জমিদার আর কালোবাজারিদের পেটোয়া পার্টি কংগ্রেস মুঠো মুঠো টাকা ছড়াবে আর প্রত্যেকবার জিতে যাবে। ছিটেফোঁটা পাবার আশায় শোধনবাদী বামপন্থীদলগুলোও এই ভোটের খেলায় মেতে আছে। পার্লামেন্ট একটা শুয়োরের খোঁয়াড়!
বাড়িতে পা দিয়েই বাবার মুখোমুখি হবার ইচ্ছে ছিল না অতীনের, কিন্তু প্রতাপ বসবার ঘরেই বসে আছেন আদালতের কাগজপত্র মেলে।
অতীনের বাইরের কলেজে চাকরি নেওয়ার ব্যাপারে প্রতাপ আপত্তিও করেননি, উৎসাহও দেখাননি। মমতার একটুও সম্মতি ছিল না। অতীন প্রায় জোর করেই দরখাস্ত পাঠিয়েছে। বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন বাইরে থাকার জন্য তার মন ছটফট করছে। বাড়িতে সে যেন কিছুতেই সাবালক হয়ে উঠতে পারছে না। বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকলেই মা আর পিসিমা মিলে তাকে এখনও বাচ্চা ছেলে করে রাখতে চায়।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অতীন বেশ কয়েক পলক বাবার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আজ সে তার জীবনের একটা খুব বড় সিদ্ধান্তের কথা জানাতে চলেছে। সেই একদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ি না ফিরে একা একা দোতলা বাসে চেপে দক্ষিণ কলকাতায় যাওয়া বাবার কাছে সেদিন সে খুব মার খেয়েছিল। হঠাৎ সেই দিনটার কথা মনে পড়লো। বাবা পরে বলেছিলেন, তুই আমাদের সব কথা বলিস না কেন। বাবলু, তুই আমাদের কাছে কিছু লুকোবি না…
–বাবা, আমি শিলিগুড়ি থেকে আজ অ্যাপয়েন্টমেন্টের চিঠি পেয়েছি। প্রতাপ এতদিন চশমা পরতেন না, এখন রিডিং গ্লাসের দরকার হয়। চোখ থেকে চশমাটা খুলে বাবলুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ও, পেয়েছিস চিঠি? কবে জয়েন করতে হবে?
–ফিফটিথ ফেব্রুয়ারির মধ্যে।
–পার্মানেন্ট পোস্ট? কত স্কেল দিয়েছে?
–আপাতত লীভ ভ্যাকেনসি। তবে সিদ্ধার্থ আমাকে বলেছে, যে-ভদ্রলোক ছুটিতে গেছেন, তিনি আর ফিরবেন না, খুব সম্ভবত বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এখন আমাকে একশো পঁচাত্তর দেবে।
–কই চিঠিটা দেখি?
–ভেতরে আছে। আমি একটু পরে এনে দেখাচ্ছি, বাবা, বাথরুম থেকে আসছি। একটু থেমে, সে আবার যোগ করলো, আমার প্রফেসার-গাইডকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি, ওখানে বসেও পি-এইচ ডি করা যাবে।
ভেতরে ঢুকে অতীন দেখলো, মায়ের ঘরে দু’জন অচেনা মহিলা বসে গল্প করছেন। সেই জন্যই প্রতাপকে অফিসের কাজকর্ম নিয়ে বাইরের ঘরে বসতে হয়েছে। সন্দেশের প্যাকেটটা সে রান্নাঘরে রেখে দিল।
খানিক বাদে বাথরুম থেকে জামা-কাপড় ছেড়ে বেরিয়ে সে দেখলো, বাবা ফিরে গেছেন নিজের ঘরে, সেখানে মায়ের সঙ্গে বাবার কী নিয়ে যেন উষ্ণ বাদানুবাদ চলছে। এখন আর চিঠিটা হাতে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। খিদে পাচ্ছে অতীনের, এখন কাকেই বা সে খাবার কথা বলবে, পিসিমা তো রাত্তিরে আর রান্নাঘরে ঢোকেনই না, তুতুল চলে যাবার পর তিনি কেমন যেন ঝিম মেরে গেছেন। অতীন নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে একটা বই খুললো।
ঠিক এক পাতা পড়ার পর মুন্নি এসে বললো, এই ছোড়’দা, মা তোমাকে ঐ ঘরে ডাকছেন। বিছানা থেকে ওঠবার আগে অতীন মুন্নিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললো, অ্যাই মুন্নি, আমার ঘরের এই ক্যালেন্ডারটা তোর খুব ভালো লাগে বলেছিলি, যা, নিয়ে যা।
মুন্নি বিনা বাক্যব্যয়ে দেয়াল থেকে ছ’খানা বিখ্যাত বিদেশী চিত্রকরদের ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডারটি খুলতে লাগলো। ছবি আঁকার দিকে মুন্নির খুব ঝোঁক। ছোড়দা কেন এই ভালো ক্যালেন্ডারটা তাকে দিয়ে দিচ্ছে, তা সে জানে।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটি হাতে নিয়ে অতীন গেল মায়ের ঘরে। প্রতাপ বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে একটি সিগারেট ধরিয়েছেন, তাঁর গেঞ্জি পরা বুকখানি বেশ প্রশস্ত। প্রতাপের শরীরের গড়নটি চওড়া ধরনের, তাঁর উচ্চতাও সাধারণ বাঙালীর তুলনায় ভালোই। মমতা বসে আছেন খাটের পাশের একটি চেয়ারে। এখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহের কোনো চিহ্ন নেই।
প্রতাপ হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে পড়তে লাগলেন, মমতা জিজ্ঞেস করলেন, তুই এই চাকরিটা নিবি ঠিক করেছিস, বাবলু?
অতীন বললো, বাঃ, নেবো না? চাকরি কি সহজে পাওয়া যায়?
–কেন, কলকাতায় চাকরি…আর দু’দিন অপেক্ষা করলে পাওয়া যেত না?
–কাগজে বিজ্ঞাপন দেখো না, সবাই অন্তত চার-পাঁচ বছরের এক্সপিরিয়েন্স চায়। এক্সপেরিয়েন্স কি এমনি এমনি হবে?
–এক্ষুনি চাকরিতে ঢোকার জন্য তাড়াহুড়ো করার কী ছিল তোর? কোয়ালিফিকেশান বাড়ালে লোকে ডেকে ডেকে চাকরি দেবে।
–মা, তোমাকে তো বলেইছি, বাড়িতে বসে থেকে শখের পিএইচ ডি করার একটুও ইচ্ছে নেই আমার।
প্রতাপ মুখ তুলে বললেন, ও তো যাবেই ঠিক করেছে, এখন আর এসব কথা বলে লাভ কী, মমো? ইচ্ছে যখন হয়েছে, বাইরে কিছুদিন থেকে আসুক না। একটা অভিজ্ঞতা হবে।
মমতা বললেন, ওখানে তুই কোথায় থাকবি তা ঠিক হয়েছে? কলেজ থেকে কি কোয়ার্টার দেয়?
অতীন বললো, না, কোয়াটার দেয় না, কয়েকজন অধ্যাপক মিলে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেস করে থাকে, মানে যারা বাইরে থেকে গেছে, সেখানে থাকতে পারি, কিংবা আলাদা বাড়ি ভাড়া করেও থাকা যায়।
–তোর বাবা তো যেতে পারবেন না বলছেন। আমি তোর সঙ্গে যাবো তা হলে!
–তুমি যাবে, কেন? তোমরা পরে বেড়াতে যাবে, আমি যখন বাড়ি-টাড়ি ভাড়া নেবো
–বাঃ, তুই একটা নতুন জায়গায় যাচ্ছিস,তোর জিনিসপত্র সব গুছিয়েস্টুছিয়ে দিয়ে আসতে হবে না? তুই কি আগে কখনো বাইরে থেকেছিস একা একা?
–তুমি কি পাগল হয়েছে মা? তুমি আমার জিনিস গুছিয়ে দিতে যাবে? ওখানকার সবাই হাসবে না? আমি কি ছেলেমানুষ? জিনিস গোছাবার আবার কী আছে? কত লোক বাইরে চাকরি করতে যাচ্ছে, তারা কি বাবা-মা’কে সঙ্গে নিয়ে যায়?
মমতা আড় চোখে তাকালেন প্রতাপের দিকে। বাবলুর বয়েসী ছেলেরা একা একা বাইরে গিয়ে থাকে, তা কি তিনি জানেন না? কিন্তু তাঁদের যে এই একটি মাত্র ছেলে! বাবলুটা শেষ পর্যন্ত সাঁতার শিখলোই না, হুট করে যদি জলে-টলে নামে…শিলিগুড়িতে কি পুকুর কিংবা নদী নেই? পরিবেশটা নিজের চোখে দেখলে, কাছাকাছি মানুষজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলে মমতা অনেকটা ভরসা পেতেন।
মমতা দৃঢ়ভাবে বললেন, তবু আমি যাবো তোর সঙ্গে!
অতীন বললো, মা, একটা কথা বলো তো, বাবারও তো একসময় মফস্বলে পোস্টিং ছিল, তখন কি ঠাকুদা-ঠাকুমা বাবার সঙ্গে যেতেন?
মমতা বললেন, তখনকার কথা ছিল আলাদা। চাকরির প্রথম বছরেই তোর বাবার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল!
মা ও ছেলের তকাতর্কির মাঝখানে বাধা দিয়ে প্রতাপ বললেন, তোমার এখন যাবার দরকার নেই, মমো! শিলিগুড়ি একটা শহর, সেখানে আরও পাঁচজনের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে, ও ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবে! বাবলু তো ঠিকই বলেছে, তোমরা কিছুদিন পরে বেড়াতে যেও!
বাবার প্রতি খুব কৃতজ্ঞ বোধ করলো অতীন। বাবা ঠিক বুঝেছেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে শিলিগুড়ি পৌঁছোলে অন্যান্য সহকর্মীদের কাছে তার লজ্জায় মাথা কাটা যেত!
একটু বাদে নিজের ঘরে এসে অতীন তার জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো। যদিও তার ‘ যাওয়ার অনেক দেরি। কত দিনের কত কাগজ জমে আছে, এক সময় সব কিছুই মনে হতো খুব জরুরী। এখন অনেকগুলোই ফেলে দেওয়া যায়। অলির চিঠি আছে কয়েকখানা। ওগুলো থাকবে। দাদার কবিতার খাতাটা? সে নিজে কবিতা বোঝে না, কৌশিক আর প্রভাতকে সে পড়িয়েছিল লেখাগুলো। দু’জনের মধ্যে মতভেদ হয়েছে। কৌশিকের মতে ওগুলো নিতান্তই রোমান্টিক, বুর্জোয়া সেন্টিমেন্টের কবিতা, এখনকার এই কঠিন সংক্রান্তির সময়ে ঐ সব কবিতার কোনো মূল্য নেই। প্রভাতের মতে, কবিতাগুলোর মধ্যে ভাষার খুব জোর আছে, রোমান্টিক কবিতার আবেদন চিরকালই থাকবে, বিপ্লবের সঙ্গে রোমান্টিকতার কোনো বিরোধ নেই।
কৌশিকই তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কৌশিক পরামর্শ দিয়েছে, ব্যক্তিগত স্মৃতি হিসেবে খাতাটা অতীন নিজের কাছে রেখে দিতে পারে, কিন্তু ঐ কবিতাগুলি ছাপানো এখন আদিখ্যেতার মতন মনে হবে। মৃতদের স্মৃতি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে নেই।
খাতাটা সে সঙ্গে নিয়ে যাবে, না এখানে রেখে যাবে, কিংবা আর কারুকে দেবে, সে বিষয়ে অতীন সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। সে নিজে কবিতা সম্পর্কে আগ্রহী নয়, কিন্তু এই কবিতাগুলির মধ্যে তার দাদা যেন এখনও জীবন্ত, দাদার নিজের হাতের লেখা! সে পাতা উল্টে উল্টে কবিতাগুলি পড়তে লাগলো। অধিকাংশ লাইনেরই মানে বোঝা যায় না।
টুনটুনি ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, ছোড়দা, তুমি এখান থেকে চলে যাচ্ছো? খাতাটা বন্ধ করে রেখে অতীন বললো, চলে যাচ্ছি মানে কী? প্রত্যেক মাসেই একবার করে আসবো, এই ঘরটা আমারই থাকবে। খবরদার, আমার কোনো জিনিসে হাত দিবি না। এই নে, একটা কলম নিবি?
টুনটুনিকে চারুচন্দ্র কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। অতীন তাকে দু’একদিন পড়া দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল, টুনটুনির পড়াশুনোর দিকে একেবারেই মন নেই। কী করে সে দেওঘর থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে এসেছে কে জানে!
কয়েকটা পুরোনো খাতা, একটা ছবির বই, এক গাদা পেন্সিল সে দান করে দিল টুনটুনিকে। অতীন জানে, টুনটুনি প্রায়ই তার ঘর থেকে পেন্সিল-কলম চুরি করে। এসব নিয়ে সে কী করে কে জানে?
যথারীতি অতীনের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে টুনটুনি। দুই উরু দিয়ে সে চেপে ধরেছে চেয়ারে বসে থাকা অতীনের কাঁধ। শারীরিক স্পর্শের জন্য সে যেন সব সময় কাঙাল। অতীন তাকে আর প্রশ্রয় দেয় না, তাকে বকুনি দিলেও সে শোনে না।
অতীন গলা চড়িয়ে ডাকলো, মুন্নি, এই মুন্নি।
টুনটুনি এবার খানিকটা সরে গেল। মুন্নি এসে দাঁড়াতেই অতীন জিজ্ঞেস করলো, এই, আমার অনেক খাতায় কিছু কিছু সাদা পাতা রয়ে গেছে দেখছি। তুই নিবি?
তারপরই হঠাৎ মনে পড়ার মতন সে জিজ্ঞেস করলো, হ্যাঁরে মুন্নি, তোরা সাউন্ড অফ মিউজিক দেখিসনি? দারুণ বই! তুই আর টুনটুনি দেখে আয়।
মুন্নি বললো, আহা, আমাদের কে নিয়ে যাবে? মা কি একা একা যেতে দেবে? ফুলদি থাকতে তবু দু’একবার আমাদের নিয়ে গেছে। তোমার তো পাত্তাই পাওয়া যায় না!
–ঠিক আছে, আমি তোদের এটা দেখাবো। টিকিট কেটে হলে বসিয়ে দেবো, আবার ভাঙার সময় নিয়ে আসবো।
মুন্নি মুচকি হেসে বললো, ইস্! এখন চলে যাচ্ছে কি না, তাই হঠাৎ আমাদের জন্য দরদ উথলে উঠেছে। তোমার নিজের বুঝি দেখা হয়ে গেছে?
সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে বলেই অতীনের একটি কথা ভেবে সামান্য অনুতাপ হলো। ছোট বোনটাকে সে কখনো কিছুই দেয়নি। আসলে, ফুলদি থাকতে, মুন্নি ছিল পুরোপুরি তার চার্জে। মুন্নির কথা বলার ধরনটাও অনেকটা ফুলদির মতন।
সে বললো, বড় হয়েছিস, এখন একা একা চলাফেরা করতে শেখ! মুন্নি বললো, ছোড়দা, আমাকে শম্ভু মিত্রর অয়দিপাউসের টিকিট কিনে দিবি? ঐ নাটকটা আমার খুব দেখার ইচ্ছে।
–থিয়েটারের টিকিট তো অনেক দাম! আমি অত পয়সা পাবো কোথায়? মার কাছে চেয়ে দ্যাখ।
–মার কাছে চাইতে হবে না। টিকিটের দাম আমি দেবো, আমি রোজ পাঁচ পয়সা করে জমাই। আমার আর টুনটুনির জন্য দু’খানা টিকিট দশ টাকায় হবে না?
অতীন আর একটা ব্যাপার অনুভব করলো। সে এখান থেকে চলে গেলে এ বাড়িতে থাকবে টুনটুনি আর মুন্নির বয়েসী দুটি মেয়ে। এই বয়েসটা বিপজ্জনক। পাড়াটাও দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ পাড়ায় একটা বখা ছেলের চোখ পড়েছে টুনটুনির ওপর, একদিন টুনটুনিকে কোথায় যেন নিয়ে যেতে চেয়েছিল, অতীন তা টের পেয়ে ছেলেটার কলার ধরে খুব কড়কে দিয়েছে। অতীন চলে যাবার পর আবার যদি ঐ ধরনের ছেলেরা বাড়াবাড়ি করে, তখন কে সামলাবে?
পরক্ষণেই এ চিন্তাটাকে সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে উড়িয়ে দিল। সব পরিবারেই কি ছেলে থাকে? এই সব ঘেঁদো কারণের জন্য কি কেউ বাইরে চাকরি করতে যাবে না? তাছাড়া, সে তো মাঝে মাঝেই কলকাতায় আসবে।
অলির সঙ্গে সে দেখা করতে গেল পরদিন বেলা দশটায়। দোতলায় অফিস ঘরে সে আগে বিমানবিহারীকে খবরটা জানালো। বিমানবিহারী খুশি হলেন না। তাঁর মতে, শিলিগুড়ি অতি বাজে জায়গা। চীন যুদ্ধের পর নর্থ বেঙ্গলে যেমন আর্মির তৎপরতা বেড়েছে, তেমনি যত রাজ্যের ব্যবসায়ীরা গিয়ে ওদিকে ভিড় জমিয়েছে। ওখানে পড়াশুনার পরিবেশ নেই। তা ছাড়া, মফস্বলে একবার চাকরি নিলে আর সহজে কলকাতায় আসা যায় না। অতীনের উচিত ছিল একেবারে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকেই চাকরি শুরু করা। তার জন্য আর দু’তিন বছর অপেক্ষা করে পি-এইচ ডি-টা সেরে নিলে ক্ষতি কী ছিল? সে চাকরি না করলে তাদের সংসার চলছে না, এমন তো নয়! মফস্বলের মাস্টারিতে ক’ পয়সাই বা মাইনে পাবে অতীন, তাকে আলাদা এস্টাব্লিশমেন্ট করতে হবে, নিজের খরচই কুলোতে পারবে কিনা সন্দেহ!
অতীন বিশেষ তর্ক করলো না, হুঁ-হাঁ দিয়ে উঠে গেল। সিঁড়িতে সে পেয়ে গেল বুলিকে। বুলি এখনও ফ্রক ছাড়েনি, শরীরটা বেশ মোটা হয়ে যাচ্ছে তার। অনেকে বলে, বুলির মুখখানা অলির চেয়েও অনেক সুন্দর, কিন্তু আইস ক্রিম আর চকলেট খেয়ে খেয়ে সে তার ফিগার ঠিক রাখতে পারছে না।
বুলি বললো, বাবলুদা, আমি আর দিদি আজ সন্ধেবেলা সাউন্ড অফ মিউজিক দেখতে যাচ্ছি, তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে? চলো, চলো।
অতীন যে সিনেমাটা আগেই দেখে ফেলেছে, সে কথা শুনলে অলি অভিমান করবে। এটা এতক্ষণে খেয়াল হলো অতীনের। কাল সিদ্ধার্থ একবার বলতেই অতীন ছবিটা দেখতে রাজি হয়ে গেল, তখন অলির কথা তার মনে পড়েনি। তবে, ছবিটা দেখতে দেখতে সে জুলি অ্যান্ড্রুজের মুখের সঙ্গে অলির মিল খুঁজে পেয়েছিল।
এখন মিথ্যে কথা বলা ছাড়া উপায় নেই। বুলির কাঁধে হাতে রেখে সে বললো, আমার যে এখন বড্ড কাজ, এখন সিনেমা দেখার একদম সময় নেই, আমি বাইরে চলে যাচ্ছি জানিস তো!
–কোথায়? তুমিও বিলেত যাচ্ছো?
–ভ্যাট! বিলেত যাবো কেন, আমি যাচ্ছি পাহাড়ে, শিলিগুড়িতে, কাছেই দার্জিলিং—
–আজই তো যাচ্ছে না। চলো না সিনেমায়।
আরও অনেক মিথ্যে কথা বলে ভোলাতে হলো বুলিকে। এদের বাড়িতে একটা সুবিধে আছে, দুই বোন সিনেমা দেখতে গেলেও কোনো পুরুষ সঙ্গী লাগে না। টিকিট কাটা হবে অনেক বেশি দামের, বাড়ির গাড়িতে আসবে-যাবে। এইসব বাড়ির মেয়েদের পাড়ার ছেলেরাও ঘাঁটাতে ভয় পায়।
অলির ঘরে তার বন্ধু বর্ষা বসে আছে। বিমানবিহারীর কথাগুলো শুনে অতীনের মনের মধ্যে একটা চাপা রাগ জমেছিল, বর্ষাকে দেখে তার আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়েটি তাকে পছন্দ করে না, অতীন বুঝতে পারে, সেও ওকে দেখতে পারে না। তবু এই বর্ষা কেন ঘনঘন আসে অলির কাছে?
মাথার চুলগুলো কাকের বাসা, শাড়িটা মোচড়ানো, চোখে একটা গোল নিকেলের ফ্রেমের চশমা, এ মেয়েটা যেন কিছুতেই একটুও সাজ-পোশাক করবে না ঠিক করেছে। পমপমও কোনোরকম মেকআপ নেয় না। কিন্তু পমপমের সঙ্গে এ মেয়েটির বেশ তফাত আছে। বর্ষা তার না-সাজাটাই সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায়। কফি হাউসে অতীন গুজব শুনেছে, এই বর্ষা নাকি সাঙ্ঘাতিক পুরুষ-বিদ্বেষী। মনীষ নামে একটা ছেলে এর সঙ্গে প্রেম করতে গিয়েছিল, সকলের সামনে সে মনীষকে অপমান করেছে।
বর্ষার হাতে একটা সিগারেট, সে পা দোলাচ্ছে চেয়ারে বসে। অতীনের দিকে সে তাকালো, কিন্তু কোনো কথা বললো না। দেয়াল-আলমারি খুলে কিছু একটা খুঁজছিল অলি, মুখ ফিরিয়ে বললো, আচ্ছা বাবলুদা, ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশানে কি আছে যে চাকরির ব্যাপারে ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে ডিসক্রিমিনেট করা যাবে?
বাবলু ভুরু কুঁচকে বললো, আমি কনস্টিটিউশান পড়িনি, কী আছে জানি না। তবে অনেক চাকরি আছে, যেমন আর্মি, পুলিশ, দমকল, সেখানে কি আর মেয়েদের নিতে পারে? কেন, কী হয়েছে?
–পুলিশ, দমকল নয়। এই বর্ষা একটা সিগারেট কোম্পানিতে এক্সিকিউটিভ ট্রেইনীর পোস্টে অ্যাপ্লাই করেছিল। ও তো নামের আগে মিস বা শ্রীমতী লেখে না, তাই ওর নাম দেখে বুঝতে পারেনি, ইন্টারভিউতে কল পেয়েছিল, ও হাজির হবার পর ওরা বললো, ঐ পোস্টে মেয়েরা এলিজি নয়। ওর ইন্টারভিউ নিলই না। এটা অন্যায় নয়?
অতীন অবজ্ঞার সঙ্গে বললো, ঐ সিগারেট কম্পানি… ও তো মাল্টিন্যাশনাল কম্পানি, ওরা যা খুশি করতে পারে। ওখানে চাকরির অ্যাপ্লাই করবারই বা কী মানে হয়?
বর্ষা বললো, ওরা মাইনে বেশি দেয়। চাকরি তো টাকার জন্যই। যেখানে বেশি টাকা দেয়
বর্ষার হাতের সিগারেটের গন্ধ পেয়ে অতীনেরও সিগারেটের তেষ্টা পেয়ে গেল, কিন্তু বর্ষা এখানে বসে সিগারেট টানছে বলেই তার ধরাতে ইচ্ছে করলো না। দু’জনে একসঙ্গে সিগারেট টানলে যেন কিছুটা বন্ধুত্ব দেখানো হয়ে যায়। অলির আগে সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারে খুব আপত্তি ছিল।
অলি বললো, বাবলুদা, বর্ষা চাইছে চাকৱির ব্যাপারে মেয়েদের ওপর যে অবিচার করা হয়, তাই নিয়ে একটা আন্দোলন করতে। মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিগুলোর এরকম আস্পর্ধা হবে কেন?
অতীন বললো আন্দোলন মানে তো খবরের কাগজে চিঠি লেখা?
জানলার কাছে গিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা কি উঠবে না? মেয়েটা এত সিগারেট খায় বলেই কি সিগারেট কম্পানিতে চাকরির জন্য এত আগ্রহ। সমাজ ব্যবস্থাটা গোটাটাই বদলাতে না পারলে যে এসব কিছুই বদলানো যায় না। সেটুকু বোঝার মতন বুদ্ধিও এদের নেই।
বর্ষা আর অলি কী সব কথা বলছে, অতীন ঘুরে তাকিয়ে বললো, অলি, তোর সঙ্গে আমার বিশেষ একটা কথা আছে।
স্পষ্ট ইঙ্গিত। অলির মুখটা লালচে হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাবার জন্য সে বললো, বাবলুদা, জানো, আমাকে ফুলদি একটা চিঠি লিখেছে, গ্লাসগো থেকে। এত সুন্দর চিঠি–
অতীনের ভুরু কুঁচকে গেল। ফুলদি চিঠি লিখেছে অলিকে? বাড়িতে ফুলদির দু’খানা চিঠি এসেছে এর মধ্যে। তার মধ্যে বাবলুর নামে আলাদা কোনো চিঠি নেই। যাওয়ার কয়েকদিন আগে ফুলদির সঙ্গে সে ঝগড়া করেছিল। তা বলে ফুলদি তাকে এক লাইনও চিঠি না লিখে অলিকে চিঠি লিখলো?
এরকম ইঙ্গিত পেয়েও বর্ষা এখনো উঠছে না। সমানে পা দুলিয়ে চলেছে। অতীনের সঙ্গে চোখচোখি হতেই বর্ষা হাসি মুখে বললো, আমি এখন যাচ্ছি না। আমি আগে এসেছি, আমার কাজ না হলে আমি যাবো কেন?
অলি বললো, বাবলুদা, তুমি একটু পরে আসবে? বর্ষা এখন মেয়েদের অর্গানাইজেশন তৈরি করতে চায়, সেই নিয়ে কথা বলতে এসেছিল, আমরা একটা নামের লিস্ট করছি… তুমি দুপুরে একবার আসতে পারবে না? তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
অলি যে নিছক ভদ্রতা করেই বর্ষাকে উঠতে বলতে পারছে না, তা অতীন বুঝলো না। সে ওসবের ধার ধারে না। শুধু শিলিগুড়ির চাকরি না, সে অলির সঙ্গে টুনটুনির বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছিল। সে অলিকে একটা স্বীকারোক্তি দিতে চায়। আর কদিন বাদেই সে কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে। এখন অলি এই ফেমিনিস্ট মেয়েটাকে নিয়ে মত্ত?
আর একটাও কথা না বলে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অলিও সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো, অতীনের একটা বাহু ছুঁয়ে সে বললো, এই বাবলুদা, তুমি রাগ করে চলে যাচ্ছো নাকি? তুমি দুপুরবেলা আসবে তো?
রাগের সময় অতীনের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। যে কথা সে বলবে বলে এসেছিল, তার বদলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো সম্পূর্ণ অন্য কথা! সে বেশ জোরে জোরে বললো, তোর বাবা আমাকে কী মনে করে বল তো? আমি কি এ বাড়ির চাকর? তোর বাবা আমার গলায় চেন দিয়ে বেঁধে কলকাতায় ধরে রাখতে চায়?
অলির মুখখানা শুকনো পদ্মপাতার মতন হয়ে গেল। তার বাবার সম্পর্কে এমন কঠোর কথা সে বাবলুদার মুখে কখনো শোনেনি। আবার একথাও ঠিক, কাল তার বাবাও বাবলুদা সম্পর্কে অলিকে কিছু কথা শুনিয়েছেন। বাবলুদার কিছু কিছু কার্যকলাপ বাবার পছন্দ হচ্ছে না।
অসীম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অতীন বললো, তোদের বাড়িতে আর আমার আসতেই ইচ্ছে করে না! আসবো না আর কোনোদিন।