২.৬২ সারারাত ঘুমোতে পারেনি তুতুল

সারারাত ভালো করে ঘুমোতে পারেনি তুতুল। দু’কানে অবিরল শুনতে পাচ্ছিল বিমানের গোঁ গোঁ ধ্বনি, তাছাড়া কূল-কিনারাহীন দুশ্চিন্তা। চিন্ময়ীও জেগেই ছিলেন মনে হয়, কিন্তু ছটফট করেননি। জানলার সব পর্দা টানা, সকালের আলো ফুটলেও বোঝা যাবে না। তুতুল এক সময় বেড সুইচ টিপে ঘড়ি দেখল। পৌনে সাতটা, তার মানে তো রীতিমতন সকাল, তুতুলের ছ’টার মধ্যে উঠে পড়া অভ্যেস। সে ধড়মড় করে নেমে পড়লো খাট থেকে। চিন্ময়ীর চক্ষু বোজা, নিঃশ্বাস পড়ছে সমান ভাবে, বোধ হয় ভোরের দিকে তাঁর একটু ঘুম এসেছে।

ঘরের দরজা খুলে বেরুতে গিয়ে তুতুল একটু দ্বিধা করলো। সে শাড়ি পরেই শুয়েছিল। বিলেতের মেয়েরা কি সবাই সকালবেলা হাউস কোট কিংবা ড্রেসিং গাউন পরে? কাল অমলাকে সে বাড়িতে ঐ রকমই একটা পোশাক পরে থাকতে দেখেছে। তুতুলের ওসব কিছু নেই। তাহলে কি হবে? এখানে এসে কোনো আদব-কায়দা ভুল না হয়ে যায়, সেই ভয় তুতুলের সব সময়। কিন্তু তাকে তো এখন বাথরুমে যেতেই হবে। দরজায় কান রেখে সে শুনলো, বাইরে কোনো শব্দ নেই, সে দরজাটা খুলে ফেললো!

সারা বাড়ি একেবারে নিস্তব্ধ, বাড়ির কেউ এখনো জাগেনি মনে হয়। বিলেতে সবাই তো বেশ সকাল সকাল স্কুল-কলেজে, অফিসে যায়। এরা কেউ যাবে না? আজ কী বার, আজ বুধবার, ছুটির দিন তো নয়। বসবার ঘরে এসে তুতুল ভারি পদাটা সরিয়ে বাইরেটা একটু দেখলো, এবং চমকে উঠলো। ঘড়িটা কি সে ভুল দেখেছে, এখনও ভোর হয়নি? না, বসবার ঘরের একটা ঘড়িতেও একই সময়। বাইরেটা এখনও রীতিমতন অন্ধকার, ছির ছির করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে, রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। বিলেতে তার প্রথম সকাল, কিন্তু আকাশের অবস্থা দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়।

এখন সকাল সাতটা, তার মানে কলকাতায় দুপুর। ঝকঝক করছে রোদ, রাস্তায় কত মানুষ, রান্নাঘরে এতক্ষণে মা কিংবা মামীমার রান্না প্রায় শেষ, বাবলু নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে নেই, মুন্নি কলেজে গেছে, টুনটুনি সারা বাড়ি ঘুরঘুর করছে…স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছে তুতুল, তবু কলকাতা কত দূরে!

মাকে চিঠি লিখতে হবে, সবাইকে চিঠি দিতে হবে। কাল তো একটুও সময় পাওয়া যায়নি। কয়েকখানা এরোগ্রাম কিনতে হবে, কত দাম লাগবে কে জানে, তুতুলের কাছে আছে মাত্র তিন পাউণ্ড।

ঝনঝন করে টেলিফোনটা বেজে উঠতেই দারুণ চমকে কেঁপে উঠলো তুতুল। সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ থাকে বলে বাইরের কোনো শব্দ শোনা যায় না, সারা বাড়িতেই কোনো শব্দ নেই। টেলিফোনের শব্দটা তাই এত জোরালো মনে হয়। তুতুল কোনোদিন এত নিস্তব্ধ বাড়িতে থাকেনি।

ফোনটা দেওয়ালের গায়ে, সেটা বেজেই চলেছে। তুতুল প্রথমে ভাবলো, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ উঠে এসে ধরবে, কিন্তু কেউ এলো না। বেশ কয়েকবার বাজবার পর ফোনটা থেমে গেল, কয়েক মুহূর্ত বাদে আবার বাজতে শুরু করলো। তুতুল ফোনটা তুলতে ভয় পাচ্ছে। সাহেব-মেমদের উচ্চারণই সে বুঝতে পারবে না, তারা কিছু জানতে চাইলেও সে উত্তর দিতে পারবে না!

তবু ফোনটা জেদীভাবে বেজে চলেছে, একটা কিছু করা দরকার। অনেক দ্বিধা ও সঙ্কোচের। সঙ্গে তুতুল ফোনটা তুললো। তারপরেই দারুণ বিস্ময়! হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফ দিয়ে চলে এলো গলায়।

ফোনের ওপাশে একটি ভারি পুরুষ কণ্ঠস্বর প্রথমে টেলিফোন নাম্বারটা মিলিয়ে নিয়ে তারপর পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, বহ্নিশিখা সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

তুতুল আমতা আমতা করে বললো, আমি–আমি বহ্নিশিখা সরকার।

–ও, বহ্নিশিখা, মানে তুতুল! কেমন আছো? কেমন লাগছে লণ্ডন? খুব প্যাঁচপেচে বৃষ্টি না? আর সারাদিন অন্ধকার? আমি কে বলছি বুঝতে পারছো তো? ত্রিদিব, তোমার মামা না, কাকা কী যেন হই…প্রতাপ চিঠিতে লিখেছেন তোমার এখানে আসার কথা…

প্লেন থেকে নামবার পর এই প্রথম তুতুলের একটা সুন্দর অনুভূতি হলো। পিকলুবাবলুদের ত্রিদিব মামা, তারও মামা, অতি চমৎকার মানুষ। তিনি যে বিলেতের টেলিফোনে কথা বলছেন তা বোঝাই যায় না। অতি স্বাভাবিক স্বর, পরিষ্কার বাংলা।

ত্রিদিব প্রথমে কলকাতার প্রত্যেকের খবরাখবর নিলেন। তারপর বললেন, তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, বলো ততুল? ডাক্তারি পাস করে এসেছো শুনলুম, এফ আর সি এস করবে কোথায়, লণ্ডনে?

তুতুলের সামনে কোনো ভবিষ্যতের ছবি নেই। জয়দীপের জন্য সে এসেছে, জয়দীপকে যদি তাঁর মা কলকাতায় ফেরত নিয়ে যান, তা হলে তুতুল কী করবে? সেও ফিরে যাবে, না এখানে থাকবে? এখানে কোথায় থাকবে?

তুতুল বললো, এখনো কিছু ঠিক করিনি।

ত্রিদিব বললেন, প্রথমে এক কাজ করো, ব্রিটিশ মেডিক্যাল জানাল এক কপি জোগাড় করে নাও। ওতে দেখবে অনেক চাকরির বিজ্ঞাপন থাকে, দেখেশুনে একটা অ্যাপ্লাই করে দাও, তোমাদের চাকরি পেতে অসুবিধা হবে না। তারপর তুমি পড়াশুনোর জন্য তৈরি হয়ে আস্তে আস্তে…তার আগে কয়েকটা দিন গ্লাসগোতে আমার কাছে এসে থেকে যাও না! গ্লাসগো এমন কিছু ভালো জায়গা নয় অবশ্য, বেশ নোংরা, আর বাতাসে সর্বক্ষণ ধোঁওয়া। তবে এখানে এখনো রোদ আছে। চলে এসো কয়েকটা দিনের জন্য…কলকাতা থেকে এতদূরে প্রথম এলে, বিলেতে এসে প্রথম প্রথম একটা কালচার শক লাগে, অনেক কিছুই তো অন্যরকম কবে আসবে বলো? আমি শনিবার লণ্ডনে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসতে পারি।

তুতুলের মনে হলো, ত্রিদিবমামার কাছে কয়েকদিন থাকলে তার ভালোই লাগবে, ত্রিদিবমামা নিজেদের লোক, এখানে চিন্ময়ীর দাদার বাড়িতে প্রথম থেকেই তার বেশ অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু জয়দীপের ব্যাপারটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত সে কী করে যাওয়ার কথা বলবে? সে বললো, ত্রিদিবমামা, এখানে আমার এক বন্ধু অসুস্থ.-হাসপাতালে আছে…এখন কয়েকটা দিন–

–ঠিক আছে, আমাকে পরে জানিও, আমার টেলিফোন নাম্বারটা লিখে নাও, আর শোনো, তোমার কাছে পয়সাকড়ি নিশ্চয়ই কিছু নেই, ইণ্ডিয়া গভর্নমেন্ট তো মাত্র তিন পাউণ্ড হাতে খুঁজে দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়…আমি তোমাকে একশো পাউণ্ডের ড্রাফট আজই পাঠিয়ে দিচ্ছি, পরে যখন অনেক টাকা রোজগার করবে, তখন শোধ দিও।

ফোনটা রেখে দেবার পরই তুতুলের মনে পড়লো সুলেখার কথা। সুলেখার চেয়ে বেশি লাবণ্যময়ী কোনো রমণীকে এ পর্যন্ত দেখেনি তুতুল, সেই সুলেখা কেন গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরলেন? এত ভালো যাঁর স্বামী…ত্রিদিবমামাকে কিছু বলতে হলো না, তিনি নিজে থেকেই তুতুলের সমস্যাগুলো বুঝে নিয়ে…ইস, সুলেখাও যদি এখানে থাকতেন, তাহলে যেমন করেই হোক দু’একদিনের মধ্যে তুতুল একবার গ্লাসগো ঘুরে আসতো।

মুখ ফেরাতেই তুতুল দেখলো বেসমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে রঞ্জন। মুখে কাঁচা ঘুম ভাঙার বিরক্তি, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, তার গায়ে একটা ড্রেসিং গাউন জড়ানো। তুতুলের দিকে তাকিয়ে সে বললো, মর্নিং’। তুতুল বললো, গুড মর্নিং?

–ওয়াজ দা ফোন রিংগিং?

–ইয়েস।

–হুঁ কলড? ডিড় য়ু নোট ডাউন দা নেইম অ্যাণ্ড দা নাম্বার?

–ফোনে আমাকেই ডাকছিলো…গ্লাসগো থেকে, আমাদের একজন আত্মীয়-ত্রিদিব মিত্র। রঞ্জন ভুরু কুঁচকে কয়েক লহমা তাকিয়ে রইলো তুতুলের দিকে। তারপর বিস্ময়ের সঙ্গে বললো, তোমার ফোন কল? কী করে আমাদের ফোন নাম্বার জানলো? য়ু র্যাং হিম ফাস্ট?

–না, আমি আগে ফোন করিনি?

–হাউ ডিড হি নো আওয়ার নাম্বার?

–তা জানি না। আমি জিজ্ঞেস করিনি!

–ট্রিডিব মিট্রা ফ্রম গ্লাসগো? ডোন্ট থিংক আই হ্যাভ হার্ড দা নেইম বিফোর… তুতুলের কান গরম হয়ে গেল। টেলিফোন করতে পয়সা খরচ হয়, রঞ্জন কি ভাবছে যে সে চুপিচুপি ভোরবেলা উঠে টেলিফোন করে ওদের পয়সা খরচ করিয়ে দিচ্ছে?

মাথার চুল খামচে ধরে রঞ্জন বললো, উ, বেসমেন্টে যা ঠাণ্ডা–মা রাত্তিরবেলা হিটিং অফ করে করে দিয়েছে তোমার ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

তুতুল আবার অপরাধ বোধ করলো। তারা এসেছে বলেই রঞ্জনকে মাটিরতলার ঘরে শুতে হচ্ছে। কলকাতায় থাকতে সে অনেকবার, শুনেছে যে বিলেতে জয়দীপের মামার নিজস্ব খুব বড় বাড়ি আছে। কলকাতায় বসে, খুব বড় বাড়ি’ শুনলে মনে হয়, অন্তত আটদশখানা ঘর, টানা টানা বারান্দা, তিন-চারটে বাথরুম…

রঞ্জন এবার হেসে উঠে বললো, য়ু লুক হ্যাঁপি আফটার টকিং টু দ্যা ম্যান অ্যাট গ্লাসগো! ইজ হি কামিং টু মীট য়ু?

তুতুল মাথা নেড়ে বললেন, না। আমার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন।

–তুমি এত ভোরে উঠেছো, কফি-তেষ্টা পেয়েছে বঝি? ইউ কুড প্রিপেয়ার ইওর ওউন কফি! এদেশে যার যখন যেটা দরকার হয়, নিজেই বানিয়ে নেয়।

–আমি গ্যাসের উনুন জ্বালাতে জানি না।

–গ্যাসের উনুন? ওঃ হো! কলকাতায় বুঝি গ্যাসে রান্না হয় না? কয়লার চুল্লি এখনো চলছে? এসো, শিখিয়ে দিচ্ছি!

প্রথম থেকেই রঞ্জন তাকে তুমি বলছে। অথচ রঞ্জন তার চেয়ে বয়েসে বছর দু’এক বড় হবে। ইংরেজিতে তুমি-আপনি ভেদ নেই, সেই জন্য? ওর বন্ধু আলম কিন্তু তাকে আপনিই বলে, অবশ্য আলম এত ইংরেজিও বলে না।

রান্না ঘরে এসে রঞ্জন গ্যাস জ্বালিয়ে কেটলি চাপালো। সিঙ্কে কিছু এঁটো বাসনপত্র পড়ে আছে, সেগুলো ধুতে গিয়ে সে মুখ ফিরিয়ে বললো, তুমিও এসে হাত লাগাও। এদেশে তো ঝি-চাকর পাওয়া যায় না। এসব কাজ নিজেদেরই করতে হয়।

তুতুল বললো, আপনি সরুন, আমি ধুয়ে দিচ্ছি। রঞ্জন তবু তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তাকে সাবানের ব্যবহার শেখাতে লাগলো। রান্নাঘরটি ছোট, কোনো পুরুষ মানুষের এত কাছাকাছি দাঁড়াতে তুতুলের খুবই অস্বস্তি হয়। রঞ্জন কি ইচ্ছে করে তার গা ছুঁয়ে দিচ্ছে? নাকি এদেশে নারী-পুরুষে এত সহজ মেলামেশা যে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না?

কেটলিটা এক সময় বাঁশীর মতন বেজে উঠলো। হুইশলিং কেল, তুতুল বইতে পড়েছে, এই তা হলে সেই? জল গরম হয়ে গেলেই এ রকম শব্দ হয়।

দুখানা পেল্লায় সাইজের মগে রঞ্জন কফি বানালো। কালো কফি, নিজে একটা নিয়ে বসে সে তুতুলকে বললো, তুমি যদি দুধ-চিনি মেশাতে চাও, ফ্রিজ খুলে দুধ বার করো, আর কাবার্ডে দ্যাখো চিনি আছে।

মেডিক্যাল কলেজ ক্যান্টিনে তুতুল কয়েকবার কফি খেয়েছে বটে, কিন্তু কফির স্বাদ তার ভালো লাগে না। এতখানি কফি তাকে খেতে হবে? সকালবেলা তার চা খেতে ইচ্ছে করে। এদের বাড়িতে বোধ হয় চায়ের পাট নেই। বিলেতে ভালো চায়ের খুব দাম, তুতুল আগেই শুনেছে। চিন্ময়ী কয়েক প্যাকেট চা নিয়ে এসেছেন…কিন্তু তুতুল মুখ ফুটে চায়ের কথা বলতে পারলো না।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে রঞ্জন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তুতুলের দিকে। তুতুল মুখ নিচু করে রইলো। একটু বাদে রঞ্জন লঘু হাস্য করে বললো, ইউ আর আ প্রীটি গার্ল। টেল মি সামথিং, আর য়ু এনগেইজড টু জয়দীপ?

তুতুল ঠিক জয়দীপের কথাই ভাবছিল। একটু চমকে উঠলেও সে মুখ না তুলে দু’দিকে মাথা দোলালো।

–ইউ আর আ ডকটর ইয়োরসেলফ। টেল মী, জয়দীপের কণ্ডিশান কী রকম দেখলে? তুতুল এবারও মাথা তুললো না, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না।

–হি ইজ ডেসটি টু ডাই। ম্যাটার অফ মাথস, ইফ নট উইক। শুধু শুধু অনেক টাকা খরচ হবে কিন্তু এ রোগের চিকিৎসা নেই। তুমি এখন…

রঞ্জনের কথা শেষ হলো না, সিঁড়ি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে এলো প্রথমে তার ছোট বোন, তারপর তার বাবা। এরপর বাড়িতে যেন একটা খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কে আগে বাথরুমে যাবে, কে দাড়ি কামাবে, কে বেকফ্রাস্ট বানাবে…অমলা নামলেন সবার শেষে, একমাত্র তাঁকেই বাইরে যেতে হবে না। তুতুল গিয়ে চিন্ময়ীকে ডেকে নিয়ে এলো। বাড়ির কর্তা ও ছেলেমেয়ে দুটি তৈরি হয়ে নিল আধ ঘণ্টার মধ্যে, অমরনাথ ছুটলেন টাই বাঁধতে বাঁধতে, রঞ্জনের হাতে আধ-খাওয়া স্যাণ্ডউইচ। যাবার সময় রঞ্জন বলে গেল, তার বন্ধু আলম এসে সকালে ওদের। হাসপাতালে নিয়ে যাবে।

অসাধারণ ব্যক্তিত্ব চিন্ময়ীর। ছেলের অবস্থা দেখে তিনি ভেতরে ভেতরে কতটা ভেঙে পড়েছেন না পড়েছেন, তার কোনো চিহ্ন নেই বাইরে। ব্রেকফাস্ট টেবলে বসে তিনি ফলের রস খেলেন, কলা আর দুধ দিয়ে কর্নফ্লেক্স খেলেন কিন্তু স্যাণ্ডউইচ প্রত্যাখ্যান করলেন। অমলার সঙ্গে চালিয়ে গেলেন টুকিটাকি কথা। অমলাও একবারও জয়দীপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন না। চিন্ময়ীও সে সম্পর্কে কিছু বললেন না। এরা দু’জনে স্কুলের সহপাঠিনী হলেও এদের দু’জনের যে মনের মিল নেই, তা বুঝতে অসুবিধে হল না তুতুলের।

একসময় অমলা বললেন, তোমরা স্নান-টান করে তৈরি হয়ে নাও, আলম এসে পড়বে। আমি আজ ওয়াশিং মেশিনটা চালাবো, তোমাদের ময়লা জামা কাপড় যা আছে দিয়ে দাও।

অমলা বেসমেন্টে নেমে যাবার পর চিন্ময়ী বললেন, আমি আজ সকালে হাসপাতালে যাবো না, ঐ ছেলেটি এলে তুমি ঘুরে এসো, বহ্নিশিখা।

–আপনি যাবেন না, মাসীমা?

–না। এখানে দু’এক জায়গা থেকে টাকা পাওয়ার কথা আছে, এরা পাউণ্ড দিলে আমি দেশে গিয়ে রুপিতে শোধ করে দেবো, সেই টেলিফোন করতে হবে। আমি মন ঠিক করে ফেলেছি, বহ্নিশিখা। খোকনকে এখানে রেখে লাভ নেই। কাল তোমরা চলে যাবার পর আমি টেলিফোনে ওর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি।

–এতদিন জয়দীপের কী চিকিৎসা হয়েছে, মাসীমা?

–সে কথা এখন আর বলে লাভ নেই। কিন্তু বহ্নিশিখা, তোমাকে আমি জোর করে নিয়ে এলুম, তুমি কী করবে? এখানে থেকে যাবে? একলা একলা থাকতে পারবে? পড়াশুনোর খরচ চালাবে কী করে?

–আপনি বললে আমি ফিরে যেতে পারি আপনার সঙ্গে।

–তুমি ফির গেলে তোমার মায়ের কাছে আমি মুখ দেখাবো কেমন করে? তোমার মামা খরচপত্র করে তোমাকে পাঠিয়েছেন।

–মাসীমা, আমি শেষপর্যন্ত জয়দীপের সঙ্গে থাকতে চাই।

চিন্ময়ী বেশ কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তুতুলের দিকে। তাঁর চোখ আস্তে আস্তে জলে ভরে গেল। তুতুলও আর কান্না সামলাতে পারলো না। সে এই মাত্র একটা মিথ্যে কথা বলেছে। সে যে বলল, শেষপর্যন্ত জয়দীপের সঙ্গে থাকতে চায়, এই কথাটার মধ্যে বিশ্বাসের জোর নেই। জয়দীপের জন্য তার অনুভূতি কখনো তেমন তীব্র হয়নি। সে লণ্ডনে এসেছে একটি মাতৃহৃদয়কে সান্ত্বনা দিতে, এখনো সে যে ফিরে যাবার কথা বলল, তা জয়দীপের জন্য নয়। চিন্ময়ীকে আশ্বস্ত করার জন্য।

চিন্ময়ী উঠে এসে তুতুলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তুমি যে এই কথাটা বললে, সেটাই তো যথেষ্ট, বহ্নিশিখা! আমি মা হয়েও বলছি, তুমি লণ্ডনে যখন এসেই পড়েছো, একটা কিছু ডিগ্রী না নিয়ে তোমার ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। জয়দীপের জন্য তোমার ফিরে যাওয়া-না তা আর দরকার নেই। আজই খোকনকে এসব কথা কিছু বলল নাসর ব্যবস্থা করতে দু’চারদিন সময় লাগবে!

আলম একটু বাদেই এসে পড়ল একটা লাল রঙের গাড়ি নিয়ে। বাইরে খুব ঠাণ্ডা, তাই অমলার ওভারকোট আজও ধার করতে হল। সেই সঙ্গে গরম মোজা এবং জুতো। তুতুল চটি ছাড়া কিছু আনেনি।

গাড়িতে আলম তাকে নানারকম প্রশ্ন করে যেতে লাগল, তুতুল শুধু হ্যাঁ কিংবা না ছাড়া কিছুই বলতে পারছে না। তার মনের মধ্যে একটা উথাল-পাথাল চলছে। সে কি ফিরে যাবে, না এখানে থাকবে? এখানে সে একা থাকবে কী করে? জয়দীপের মামার বাড়িতে সে কিছুতেই থাকতে পারবে না।

কয়েকটা ফাঁকি এর মধ্যেই ধরা পড়ে গেছে। সবাই জানতো যে জয়দীপের মামা বিলেতে বড় ডাক্তার, দারুণ বড়লোক, মস্ত বড় বাড়ি, সেখানে জয়দীপ একবার পৌঁছোলেই তার চিকিৎসার সব রকম ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বিলেত…ডাক্তার মামা…খোদ লণ্ডন শহরে নিজস্ব বাড়ি…এসব শুনলেই একটা মোহময় ছবি ফুটে ওঠে। আসলে, জয়দীপের মামা অমরনাথ বিলেতে এসেও সুবিধে করতে পারেননি, নিজস্ব প্র্যাকটিসের বদলে তাঁকে চাকরি নিতে হয়েছে। এলোমেলো স্বভাবের জন্য তাঁকে ঘন ঘন চাকরি বদলাতে হয়। তাঁর অবস্থা মোটেই ভালো নয়, বাড়ির মর্টগেজ শোধ হয়নি, তাছাড়া তিনি অ্যালকোহলিক। তাঁর এক ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। বড় ছেলে রঞ্জন একটি মেম বিয়ে করেছিল, একটি বাচ্চা সমেত তার বউ ডিভোর্স নিয়েছে এক বছর আগে, সেই বউকে অ্যালিমনি দিতে হয়। অমলা শ্বশুরবাড়ির লোকদের আসা বিশেষ পছন্দ করেন না, তাঁর বাপেরবাড়ির লোকজন এখানে প্রায়ই আসে, আগামী সপ্তাহে তার দাদা-বৌদির আসার কথা আছে। চিন্ময়ী ও তুতুল এ বাড়িতে প্রায় অবাঞ্ছিত অতিথি। চিন্ময়ী ভেবেছিলেন তিনি তাঁর দাদার বাড়িতে আসছেন নিজস্ব অধিকারে, আসলে তাঁর দাদার কোনো ব্যক্তিত্বই নেই।

হাসপাতালে জয়দীপের ক্যাবিনের দরজা বন্ধ, বাইরে একটা বোর্ড টাঙানো, ‘সরি, নো ভিজিটর’! তুতুলকে বাইরে দাঁড় করিয়ে আলম তবু দরজা ঠেলে ঢুকে গেল। তুতুল ওভারকোটটা খুলে ফেলল, বাইরে ঠাণ্ডা, ভেতরে ঢুকলেই গরম লাগে। বারান্দা দিয়ে ডাক্তার নার্সরা দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, এদেশে কেউ আস্তে হাঁটে না, শীতের দেশের মানুষের স্বভাবই এই।

আলম একটু বাদে বেরিয়ে এসে বলল, দু’জন পেশেন্টকেই সিডেটিভ দিয়ে রেখেছে। একবার ভেতরে গিয়ে দেখে আসবেন? আমি নার্সকে বলেছি।

তুতুল বলল, থাক। বিকেলে আবার আসব।

হাসপাতালের চত্বরে প্রায় শ’খানেক গাড়ি। এরই মধ্যে আলম ভুলে গেছে, কোথায় সে গাড়িটা রেখেছে। গাড়িটা খুঁজতে খুঁজতে সে তুতুলকে জিজ্ঞেস করলো, এখনই বাসায় ফিরবেন, না আমার সাথে এক জাগায় যাবেন?

–কোথায়?

–নর্থ লণ্ডনে হাইবেরি হিল-এ আমাদের একটা আস্তানা আছে। সে বাড়ির নাম ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’। সেখানে গ্যালে অনেকের সঙ্গে আলাপ-সালাপ হবে। সেখানে সবাই বাংলায় কথা কয়। অ্যাট হোম ফিল করবেন। আপনার দেশ ছিল কোথায়?

–দেশ…মানে বাড়ি? আমাদের বাড়ি কলকাতায়…আগে ছিল বরানগর।

–ও কলকাত্তাইয়া মাইয়া? কোনো ইস্টবেঙ্গল কানেকশান নাই?

–আমার মায়ের দেশ…মানে মামাবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে।

–ও, তবে তো হাফ বাঙাল! পূর্ববঙ্গে কোথায়?

–বিক্রমপুর জেলায়, মালখানগরে। আমি অবশ্য সেখানে খুব ছোটবেলায় একবারই গেছি।

–মালখানগরের বোস?

–না, আমার মামাবাড়ির ওঁরা মজুমদার। আপনি চেনেন মালখানগর?

–আমাদের বাড়িও ঐ কাছাকাছিই। লাল রঙের গাড়িটা খুঁজে পেয়ে, দরজা খুলে সামনের সীটে বসলো দু’জনে। আলম একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, আপনি কি অনেক ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে এসেছেন, না চাকরি-বাকরি করার দরকার হবে?

–যদি এখানে থাকি, তা হলে চাকরি করতেই হবে।

–যদি মানে? এসেছেন যখন একটা ডিগ্রি করে যাবেন না? আমি যে সাজারির সাথে অ্যাটাল্ড, সেখানে সামনের সপ্তাহে একটা পোস্ট খালি হবে। সাজারি মানে বুঝলেন তো? দেশে যাকে ডাক্তারের চেম্বার বলে, এখানে তারই নাম সাজারি। চার-পাঁচজন ডাক্তার মিলে এক সাথে…একজন আমেরিকায় চলে যাচ্ছে, সেইখানে আপনার জন্য কথা বলতে পারি, আমি আছি তো, একজন চেনা লোক থাকলে আপনার সুবিধে হবে।

–তা তো নিশ্চয়ই।

–থাকবেন কোথায়? ঐ রঞ্জনদের বাড়ি? যদি পৃথক থাকতে চান, আমাদের ঐ ইস্ট পাকিস্তান হাউজে একটা রুমের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। ওখানে কিছু ছাত্র থাকে।

–ইস্ট পাকিস্তান হাউসে আমার জায়গা হবে কী করে? আমি তো পাকিস্তানী নই।

–আমাগো অত শুচিবাই নাই। তাছাড়া আপনি তো হাফ বাঙাল। চলুন, রুমটা দেখে আসবেন, লণ্ডন শহরটাও খানিকটা দেখা হবে।

–কিন্তু…বাড়ি না ফিরলে মাসীমা চিন্তা করবেন।

–ওখানে পৌঁছে টেলিফোন করে দেবো। চিন্তার কী আছে? আপনি পানিতে পড়েন নাই। আমিও বাঘ কিংবা সিংহ না।

হা হা করে হেসে উঠে আলম স্টার্ট দিল গাড়িতে। বৃষ্টি থেমেছে’একটু, কিন্তু এখানে ওখানে কুয়াশা। একটু দূরের জিনিস দেখা যায় না। তবু এরই মধ্যে রাস্তায় অনেক গাড়ি।

আলম বললো, এখনও টেমস নদী দ্যাখেন নাই তো? চলেন ওয়াটালু ব্রীজের উপর দিয়ে একটু ঘুরে যাই। ফগ-এর জন্য কিছুই দ্যাখতে পাবেন না ভালো করে। পাশেই টেমস নদী, আমাদের বুড়ি গঙ্গার থেকেও অনেক ছোট, মনে করেন একখান খাল, তার উপরেই কতকগুলো ব্রীজ।

–সকালে আপনার ছুটি থাকে?

–ঠিক ছুটি বলা যায় না। আমি সাজারিতে যাই বিকালে, সকালের দিকটায়, ‘এসিয়ান টাইড’ আর ‘পূর্ব বাংলা’ নামে দুইটা কাগজ বার করি আমরা, সেই কাগজের কাজ দেখাশোনা করতে হয়। কিছু কিছু পলিটিক্যাল কাজকর্মের সাথেও যোগ আছে আমার। আমাদের ইস্ট পাকিস্তানের পলিটিক্যাল সিচুয়েশন সম্পর্কে কিছু ধারণা আছে আপনার?

কুণ্ঠিতভাবে তুতুল বলল, না, বিশেষ কিছু জানি না।

আলমের এমনিতেই মুখখানা হাসি মাখানো, তার ওপর যখন তখন সে জোরে জোরে হেসে ওঠে। সিগারেট টানে একটার পর একটা। গাড়ির সুইচগুলোর কাছেই কী একটা টিপে দিয়ে কয়েক সেকেণ্ড বাদে বার করে আনে, সেটার মুখটা লাল গনগনে। সেটা দিয়েই সিগারেট ধরায়। এরকম লাইটার তুতু। আগে দেখেনি।

আলম বললো, এবারে জানবেন। কলকাতার কাগজে, ইণ্ডিয়ার কোনো কাগজেই আমাদের ওদিককার খবর কিছু থাকে না প্রায়। ব্রিটিশ কাগজে খবর পাবেন। তাছাড়া আমাদের মুখপত্র তো আছেই। আমাদের ওখানে অবস্থা খুব খারাপ। সাংঘাতিক রিপ্রেশন চলছে। আমি এখানে থাকলে আপনার কলেজ-টলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিতাম সব, কিন্তু দিন পনেরোর মধ্যেই আমাকে একবার ঢাকায় যেতে হবে। কবে ফিরবো, বলা যায় না। ঢাকায় আমি পাসোনা নন গ্রাটা, পুলিশ একবার আমারে পাইলে ছাড়বে না। আমার দুইখান পাসপোর্ট, এবারে অন্য একটা নামে যাবো। তবু যদি ধরে ব্যাটারা!

–এরকম বিপদ হতে পারে জেনেও…যাচ্ছেন কেন? কারুর অসুখ বুঝি?

–ঠিকই কইছেন, পুরা দেশটারই অসুখ। আমরা তো এখানে বেশ ভালোই আছি, তাই না। রোজগারপাতি ভালোই করি, মদ-মুদ খাই, ফুর্তি-ফাতা করি, তবু মাথার মইধ্যে একটা পোকা কামড়ায়, দুঃখিনী দেশ আমারে টানে, আমার বাংলা দেশেই যেন আমার নিয়তি বাঁধা।

হঠাৎ কথা থামিয়ে, একটা ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামিয়ে, তুতুলের দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে সে প্রায় আপনমনেই বললো, একটুখানি আলাপেই আপনাকে এত সব কথা বলছি কেন কে জানে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *