লণ্ডন শহরে পা দিয়ে তুতুলের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, এই তবে লণ্ডন! লণ্ডন শহরটি যে ঠিক কী রকম হবে, সে সম্পর্কে তুতুলের মনে স্পষ্ট কোনো ছবি ছিল না। পত্র পত্রিকার ছবিতে কিংবা কয়েকটি ব্রিটিশ ফিমে সে টুকরো টুকরো লণ্ডন আগে দেখেছে, কিন্তু তাতেও কোনো ধারণা গড়ে ওঠে না। ছেলেবেলা থেকেই সে নানা লোকের মুখে লণ্ডন বা বিলেত
নামটি এমন ভক্তির সঙ্গে উচ্চারিত হতে শুনেছে, যাতে তার মনে হয়েছিল সাহেবদের এই দেশটি বোধ হয় স্বর্গ-টর্গর মতন কিছু একটা হবে।
জয়দীপের মা চিন্ময়ী আগে একবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, তাঁর সঙ্গে বিমান যাত্রায় তুতুলের কোনো অসুবিধে হয়নি। হিথরো এয়ারপোর্টে কাস্টমস বেরিয়ার থেকে বেরিয়ে আসার পর সামনের একটি ভিড়ের দিকে তাকিয়ে চিন্ময়ী বলেছিলেন, ওই তো আমার দাদার ছেলে রঞ্জন!
রঞ্জনের বয়েস পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর, ধূসর রঙের ফ্ল্যানেলের সুট পরা, গলায় চওড়া মেরুন রঙের টাই, তার গায়ের রং যেমন ফসা, হাবভাবও তেমনি সাহেবী সাহেবী। তার সঙ্গে একজন বন্ধু এসেছে, রঞ্জন পরিচয় করিয়ে দিল, ওর নাম সিরাজুল আলম খান, সে একজন ডাক্তার এবং জি পি। এই সিরাজুল আলম একটা বুক খোলা শার্ট পরে আছে। তার ওপর রেইন কোট জড়ানো।
তুতুলের কেন যেন আগে থেকে মনে হয়েছিল, লণ্ডন শহরে বাংলায় কথা বলা যায় না। সাহেবরা বাংলা শুনলে রাগ করবে। ইংরিজি বলা সম্পর্কেই তুতুলের মনে জমে ছিল রাজ্যের দ্বিধা আর আশঙ্কা। ইংরিজিতে কথা বলা তো তার অভ্যেস নেই, ঠিক সময়ে ঠিক শব্দটি মনে পড়তে চায় না। কিন্তু এখানে অন্য অনেকেই, যারা আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের নিতে এসেছে, তারা দিব্যি হিন্দী, গুজরাটি, বাংলায় কলকল করে কথা বলে যাচ্ছে। আলম নামের লোকটি এক গাল হেসে পূর্ব বাংলার ভাষায় তুতুলকে বললো, দ্যান আপনার লাগেজটা আমারে দ্যান!
তুতুলের কাঁধে একটি ভারি ব্যাগ, তবু সে সেটা নিজেই কাছে রাখতে চাইলো, সদ্য পরিচিত এক ব্যক্তিকে দিয়ে সে তার ব্যাগ বহন করাতে চায় না। আলম দু’তিন বার অনুরোধ করলেও তুতুল লাজুকভাবে বললো, না না, ঠিক আছে।
রঞ্জন চিন্ময়ীর ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বললো, পিসীমা, জয়দীপ ভালো আছে, খুব কুইক রিকভারি হচ্ছে, বাবা এয়ারপোর্টে আসতে পারলেন না। হি হ্যাঁজ অ্যান ইমপর্টান্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট। কথা বলতে বলতে ওরা এগিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে। তুতুল মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিমানবন্দরের মানুষজনদের দেখছিল ভালো করে, এত ভারতীয়দের উপস্থিতি দেখে সে বিস্মিত হচ্ছিল, হঠাৎ তার শাড়ীর আঁচলে যেন কার পা পড়লো, একজন মানুষের ধাক্কা, তার ব্যাগটাও গলে নেমে এলো কাঁধ থেকে। একইসঙ্গে শাড়ী ও ব্যাগটা সামলাতে গিয়ে সে পারলো না, সে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সামনের দিকে। একেবারে সোজাসুজি আছাড় খেয়ে পড়লে কী লজ্জার ব্যাপারই হতো, তুতুল একেবারে মরমে মরে যেত, কিন্তু সে পড়বার আগেই তাকে ধরে ফেললো আলম। ক্ষিপ্র হাতে তুতুলের ডানবাহু ও পিঠ ধরে সামলে নিয়ে সে ফিসফিস করে বললো, কিছু হয় নাই, লজ্জার কিছু নাই। প্রথম প্রথম এইরকম একটু হয়, এই দ্যাশে কেউ কাউরে দ্যাখে না, ধাক্কা মাইরা শুধু ‘সরি’ কইয়া চইল্যা যায়। বললাম না, আপনার ব্যাগটা আমারে দ্যান।
চিন্ময়ী রঞ্জনের সঙ্গে কথা বলায় নিমগ্ন ছিলেন, তিনি এই ছোট ঘটনাটা দেখতে পেলেন না। আলমকে নীরব দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা জানালো তুতুল।
আলম জিজ্ঞেস করলো, আপনিও ডাক্তারির ছাত্রী শুনলাম?
তুতুল যে এম বি বি এস পাশ করেছে সে কথা আর জানালো না, মাথা নাড়লো শুধু। এখনও লজ্জায় তার শরীর কাঁপছে।
এয়ারপোর্টের মধ্যে বেশ গরম ছিল, বাইরে বেরুতেই কনকনে শীতের হাওয়া ঝাঁপটা মারলো চোখেমুখে। তুতুলের ওভারকোট নেই, সে পরে আছে দুটো সোয়েটার, তবু সে কেঁপে উঠলো শীতে।
তাড়াতাড়ি একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়া হলো। কালো রঙের চৌকো ধরনের গাড়ি, সামনের সীট ও পেছনের সীটের মাঝখানে কাঁচের দেওয়াল। তুতুলের ধারণা ছিল সব ট্যাক্সিতেই বুঝি হলুদ রং থাকে। চারজন যাত্রী তোলার ব্যাপারে ট্যাক্সি ড্রাইভারের আপত্তি ছিল, রঞ্জন তার সঙ্গে কী একটা চুক্তি করলো। গাড়ির মধ্যে আর অতটা ঠাণ্ডা নেই।
শহরতলি অঞ্চলটা বেশ সুন্দর লাগছিল তুতুলের। বেশ মিষ্টি মিষ্টি চেহারার বাড়ি, চওড়া রাস্তার দু’পাশে গাছ। তুতুল জানলা দিয়ে অবাক চোখ মেলে দেখছে, রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বলতে গেলে। শুধু গাড়ি। সে তাহলে সত্যিই বিলেতে চলে এসেছে, এখন থেকে। কলকাতা কত দূর!
শহরে ঢোকার পরই তার আবার মনে হলো, এই লণ্ডন!
এমন কিছু অচেনা বা রোমহর্ষক তো লাগছে না। লাল রঙের ডবল ডেকার বাস, বাড়িগুলোর আকারও চেনা চেনা, কলকাতার ডালহাউসি, পার্ক স্ট্রিট, এমনকি ভবানীপুরের সঙ্গেও বেশ মিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নেমেছে, রাস্তায় এখন অসংখ্য কালো ছাতা, সাহেব-মেমদের মধ্যে মধ্যে এক একটি শাড়ী পরা মহিলা কিংবা মুখভর্তি দাড়িগোঁফ ও মাথায় পাগড়িপরা সদারজীদের দেখে সে চমকে চমকে উঠছে।
তুতুল জানতো, জয়দীপের মামার বাড়ি বেল সাইজ পার্কে। সে মনে মনে ছবি এঁকে রেখেছিল, বিরাট একটি পার্কের পাশে হবে সেই বাড়ি। ট্যাক্সিটা কিন্তু বেশ কয়েকটা ছোট ছোট রাস্তা ঘুরে থামলো একটা বাড়ির সামনে। তার আশেপাশে কোনো পার্ক নেই।
রাস্তাটি মহিম হালদার স্ট্রিটের মতনই সরু। ফুটপাথে অসংখ্য ঝরাপাতা। পাশাপাশি সব বাড়িগুলিই প্রায় একরকম দেখতে। প্রত্যেক বাড়ির সামনেই কয়েক ধাপ সিঁড়ি, তারপর দরজা। সেই সিঁড়ির দু’পাশে কয়েকটা গোলাপ ফুলের গাছ। তিন চারটি নিগ্রো ছেলে সেই রাস্তায় একটা ফুটবল পেটাচ্ছে।
ট্যাক্সি থেকে নেমেই রঞ্জন তুতুলকে বললো, চটপট বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ো, নইলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
আলম সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজার বেল বাজালো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে দিল একটি কিশোরী মেয়ে, তার এক হাতে একটা চকোলেট বার। একগাল হেসে সে বললো, ওয়েলকাম টু লান্! ডিড য়ু হ্যাভ আ নাইস জার্নি?
তারপরই সে গলা চড়িয়ে বললো, মামি, দা গেস্ট হ্যাভ অ্যারাইড, উইল য়ু প্লীজ কাম ডাউন?
ওপরতলা থেকে উত্তর এলো, ওয়ান মোমেন্ট, ডিয়ার!
এতক্ষণ বাদে তুতুলের বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো। এইবার জয়দীপের সঙ্গে দেখা হবে। জয়দীপকে সে প্রথম কী কথা বলবে? জয়দীপের মামা-মামীমা যদি ভাবেন, তুতুল কে হয় জয়দীপের? সে কলকাতা থেকে এতদূর উড়ে এসেছে কেন?
মালপত্র ভেতরে পৌঁছে দেবার পর তুতুল আর চিন্ময়ীকে আলম বলল, আমি এবার চলি! আমাকে সাজারিতে যেতে হবে! বাই-ই!
রঞ্জন পাশের একটা বসবার ঘর দেখিয়ে বললো, পিসিমা, এইখানে বসুন আপনারা, টেইক সাম রেস্ট, মা আপনাদের ঘরটা প্রিপেয়ার করে দেবেন।
চিন্ময়ী সে ঘরে না ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, জয়দীপ কোন ঘরে? আমি আগে সেখানে যাবো!
রঞ্জন চট করে উত্তর না দিয়ে বসবার ঘরের সোফা থেকে অদৃশ্য ধুলো ঝাড়তে লাগলো। ম্যান্টল পীস থেকে একটা ঘড়ি তুলে নিয়ে দম দিল।
চিন্ময়ী আবার বললেন, রঞ্জু, খোকা কোন ঘরে আছে, আমাকে সেখানে নিয়ে চল!
রঞ্জন এবার মুখ ফিরিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো চিন্ময়ীর দিকে। তারপর বললো, পিসিমা, সরি, তোমাকে আগেই ডিসক্লোজ করিনি, বাবা অ্যাডভাইজড মী টু ডু সো, তোমরা খানিকটা রেস্ট নেবার পর, মানে এতখানি জার্নি করে এসেছো তো, এখন কিছুটা রেস্ট করে না নিলে…
চিন্ময়ী তীক্ষ্ণগলায় জিজ্ঞেস করলেন, খোকার কী হয়েছে? রঞ্জু…
রঞ্জন সারা শরীর মুচড়ে বললো, না না, জয়দীপ ভালো আছে। হিজ কণ্ডিশান ইজ মিরাকুলাসলি ইমপ্রুভিং, তবে দু’দিন আগে তাকে হসপিটালাইজড করা হয়েছে, হি ইজ আণ্ডারগোয়িং কেমোথেরাপি ট্রিটমেন্ট, বাড়িতে ঠিক সুবিধে হয় না, অনেক প্যারাফারনেলিয়া আছে তো।
চিন্ময়ী অস্ফুট গলায় বললেন, খোকা হাসপাতালে? দাদা যে আমাকে লিখেছিল বাড়িতেই…
রঞ্জন বললো, আগে বাড়িতে রেখেই ট্রিটমেন্ট চলছিল, কিন্তু এখন এই স্টেজে কেমোথেরাপি না করালে… তা ছাড়া তোমরা আসছো, বাড়িতে সবার অ্যাকোমোডেশানের কোয়েশ্চেন আছে…হসপিটালে হি উইল গেট দা বেস্ট অ্যাটেনশন।
চিন্ময়ী আচ্ছন্নভাবে বললেন, চল, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল।
রঞ্জন বলল, এখনই তো যাওয়া যাবে না, ভিজিটিং হাওয়ার্স ছাড়া।
তুতুল আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে। জয়দীপ হাসপাতালে আছে শুনে তারও বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। অবশ্য এটা ঠিক কেমোথেরাপির জন্য হাসপাতালই উপযুক্ত, বিলেতের হাসপাতালে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা খুব ভালো। কিন্তু জয়দীপ যদি হাসপাতালে থাকে, তাহলে তো তাকে তুতুলের সেবা করার প্রশ্ন আসে না! হাসপাতালে সে কতক্ষণ জয়দীপের পাশে থাকতে পারবে!
ওপরের সিঁড়ি দিয়ে এবারে নেমে এলেন ড্রেসিং গাউনপরা একজন মোটাসোটা মহিলা। এমনই ফর্সা তিনি যে তুতুলের প্রথমে মনে হলো মেমসাহেব নাকি? তারপরেই নজরে পড়লো, তাঁর মাথার চুল ভারতীয়দের মতো কালো।
তিনি নিচে এসে চিন্ময়ীর হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, কেমন আছো, চিনু? জার্নিতে কষ্ট হয়নি তো? ওঃ, যা ব্যাড ওয়েদার চলছে লণ্ডনে, রেইনিং অল দা টাইম, ইউ নো, দু’একদিনের মধ্যেই ইঁট উইল স্টার্ট স্নোয়িং… তোমরা একটু ওয়াশ করে নেবে? ইউ মাস্ট বী স্টারভিং। প্লেনে যা বিচ্ছিরি খাবার দেয়, আমি তোমাদের জন্য ইণ্ডিয়ান ফুড কুক করে রেখেছি
চিন্ময়ী তুতুলকে দেখিয়ে বললেন, অমলা, এই মেয়েটির নাম বহ্নিশিখা সরকার, জয়দীপের সঙ্গে পাস করেছে।
অমলা সঙ্গে সঙ্গে তুতুলের দিকে ফিরে বললেন, অফ কোর্স। তুমি তো এর কথা লিখেছিলে, শী উইল স্টে উইথ আস, তুমি ভাই জুতোটুতো খোলো…
তুতুল আগেই শুনেছিল, চিন্ময়ীর এক স্কুলের বান্ধবীর সঙ্গে তাঁর দাদার বিয়ে হয়েছিল। সেইজন্যই চিন্ময়ী একে বৌদি না বলে নাম ধরে ডাকলেন। চিন্ময়ীর দাদা অমরনাথ বিলেত থেকেই ডাক্তারি পাস করে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন, সেখানেই বিয়ে করেছেন, কিন্তু কলকাতায় প্র্যাকটিস জমাতে না পেরে সপরিবারে চলে এসেছিলেন এদেশে, বারো-তের বছর আগে।
অমলা এমন উচ্ছ্বসিত ভাবে কথা বলতে লাগলেন, ওদের রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে খেতে বসিয়ে দিয়ে লণ্ডনে কী কী খাবার পাওয়া যায় এবং যায় না সে বিষয়ে আলোচনা শুরু করলেন, যেন চিন্ময়ী ও তুতুল দেশভ্রমণের জন্য এসেছে এখানে।
রান্নাঘর ও খাবারঘর একইসঙ্গে জোড়া। গোল ডাইনিং টেলে ছটি চেয়ার। কে কোন চেয়ারে বসবে তাও বলে দিলেন অমলা। তুতুল বুঝলো, এদেশের খাবার ঘরে যে-কোনো চেয়ারে বসা যায় না। টেল ম্যাটের ওপর একটা করে প্লেট ও সাইড ডিশ দিয়ে তার ওপর কাগজের রুমাল সাজিয়ে, অমলা তাঁর ছেলেকে বললেন, রন, টু ডে ইজ ইয়োর টার্ন টু ওয়াশ দা পটস অ্যাণ্ড প্যানস, ডোন্ট ফরগেট… তারপর চিন্ময়ী ও তুতুলের দিকে যুগপৎ তাকিয়ে বললেন, জানো তো, এদেশে এই একটা বিচ্ছিরি নিয়ম, আফটার ইউ ফিনিশ ইয়োর ফুড, ইউ ডোন্ট লীভ ইয়োর প্লেইটস অ্যাণ্ড গ্লাসেস অন দ্যা টেল, নিজেরটা নিজেকেই ধুতে হয়, ঝি-চাকর তো পাওয়া যায় না এদেশে।
একটুখানি দেখেই তুতুলের মনে হলো, অমলার কথা বলার ধরনটা বেশ কৃত্রিম, চিন্ময়ীর প্রতি তাঁর ব্যবহার স্কুলের বান্ধবীর মতন তো নয়ই, একজন নিকট আত্মীয়কে অনেকদিন পর কাছে পাওয়ার কোনো আন্তরিক আনন্দও তাতে নেই। বাড়ির মধ্যেও অনাবশ্যক ইংরিজি বলছেন তিনি, সেই ইংরিজিতেও ছোট ছোট ভুল।
প্রথমে দুটি গেলাসে ফলের রস দিয়ে তিনি বললেন, এপ্রিকট জুস, আগে খেয়েছো, চিনু? দ্যাখো, আই থিংক ইউ উইল লাইক ইট! তোমরা চীজ খাও তো? আমি চীজ দিয়ে কারি বেঁধেছি, আমার ছেলেমেয়েদের খুব ফেভারিট ডিশ!
ফলের রসের গেলাসটা ঠোঁটের কাছে এনেও স্পর্শ না করে নামিয়ে রেখে চিন্ময়ী বললেন, আমার এখন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, অমলা। জয়দীপ হাসপাতালে…আমি জানতুম …ওকে কখন দেখতে যাবো?
অমলা বললেন, হাসপাতালটা বেশি দূর নয়, টিউবে মাত্র তিনটে স্টেশন, বাট ইউ কান্ট গো দেয়ার এনি টাইম ইউ লাইক, ইউ নো, ভিজিটিং আওয়ার্স ছাড়া…
–কটায় ভিজিটিং আওয়ার?
–কখন রে, রঞ্জন?
রান্নাঘরে ডেকচি মাজতে মাজতে রঞ্জন উত্তর দিল, ফোর থার্টি। ইউ হ্যাভ টু ওয়েইট অ্যানাদার হাওয়ার…
তুতুলেরও কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। জীবনের প্রথম বিমান যাত্রায় তার মাথায় যেন এখনো একটা ঘোর লেগে আছে। দুটো কান দিয়ে মাঝে মাঝে ফুস ফুস করে বেরুচ্ছে হাওয়া। প্লেনে চাপতে হয়েছিল মাঝরাত্রে। সকালবেলা প্লেনের বাথরুমের সামনে যাত্রীদের লাইন দেখে সে প্রাতঃকৃত্য সারতে পারেনি, শরীরটা নোংরা নোংরা লাগছে। এতদূরের পথ পাড়ি দিয়ে আসার পর সে ভেবেছিল, এ বাড়িতে একটা নিজস্ব ঘর পেয়ে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবে, জামা কাপড় ছেড়ে স্নান করবে…। কিন্তু এখনও তাদের ঘর দেখিয়ে দেওয়া হয়নি, প্রথমেই এনে বসিয়ে দেওয়া হলো খাবার টেবিলে, এটা তুতুলের অদ্ভুত লাগছে। এ দেশে বুঝি এরকমই নিয়ম।
চিন্ময়ী কিছুই খেলেন না, তুতুলকে বাধ্য হয়ে কিছু মুখে দিতে হলো, তারপর সবাই মিলে এলো বসবার ঘরে। অমলা বললেন, তোমরা একটু টি ভি দ্যাখো, ততক্ষণে আমি তোমাদের বেডরুমটা…
এটা চিন্ময়ীর দাদার বাড়ি, তবু তিনি এ বাড়িতে অতিথি। তিনি গম্ভীর হয়ে আছেন। টি ভি জিনিসটা আগে দেখেনি তুতুল, রঞ্জন সেটা চালিয়ে দিল, তাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের একটা ফিলম দেখানো হচ্ছে, একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তুতুল আর কোনো আগ্রহ বোধ করলো না।
একটা ব্যাপারে তুতুলের খটকা লাগলো। চিন্ময়ী যে আজ লণ্ডনে এসে পৌঁছোবেন, তা তো অনেক আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তবু তাঁর জন্য থাকার ঘর আগে ঠিক করে রাখা হয়নি? এ বাড়িতে পৌঁছোবার দেড়ঘণ্টার মধ্যেও তারা বসার ঘর ও খাবার ঘর ছাড়া আর কিছুই দেখেনি।
একটু পরে অমলা এসে ওদের ডেকে নিয়ে গেলেন সিঁড়ির পাশের একটা ঘরে। বেশ ঘোট ঘর, কলকাতায় তুতুল আর মুন্নির ঘরটার মতনই। জানলায় সাদা লেসের পদা। দেওয়ালের র্যাকে প্রচুর বই। একপাশে একটি মাঝারি সাইজের খাট, ঘরটায় পুরুষ-পুরুষ গন্ধ।
অমলা বললেন, তোমাদের দু’জনকে এ ঘরে স্কুইজ করে থাকতে হবে, একটু কষ্ট হবে হয়তো, এটা আমার ছেলের ঘর চিন্ময়ী ঘরটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, রঞ্জুর ঘর? তাহলে রঞ্জু কোথায় শোবে?
–ও কটা দিন বেসমেন্টে ঘুমোবে।
-তোমার আর এক ছেলে, শংকর, সে কোথায়? তাকে দেখছি না?
–সে এখন এ বাড়িতে থাকে না!
–জয়দীপ কোন্ ঘরে থাকতো?
–ওপরে দুটো ঘর আছে, বুঝলে, জয়দীপ কিছুদিন ওপরের ঘরে ছিল, কিন্তু আমার মেয়ে নীটা, সে বড় হচ্ছে, শী নিড়স সাম প্রাইভেসি, তাই জয়দীপকে এ ঘরেই রাখা হয়েছিল খানিকবাদে অমলা বেরিয়ে যাবার পর চিন্ময়ী দেওয়ালে একটি ছবি দেখার ছলে তুতুলের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালেন। মাত্র দু’বার হেঁচকির মতন সামান্য কান্নার আওয়াজ শোনা গেল, তারপর শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছে তিনি মুখ ফিরিয়ে তুতুলকে বললেন, জামা কাপড় বদলাবে তো বদলে নাও, হাসপাতালে যাবার সময় হয়ে গেছে।
এবারে আর ট্যাক্সি নয়, টিউব ট্রেন। প্রথম টিউব ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতাও তুতুলের এমন কিছু অসামান্য মনে হলো না। সব কিছুই তো অন্য ট্রেনের মতন, শুধু মাটির নিচ দিয়ে যাওয়া। তুতুল ভেবেছিল, কলকাতার বাস-ট্রামের মতন এদেশে কেউ দাঁড়িয়ে যায় না। তা তো ঠিক নয়, ট্রেনে বেশ ভিড়, অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজ পড়ছে, ওঠা ও নামার সময় রীতিমতো ঠ্যালাঠেলি।
অমলা বা তাঁর মেয়ে আসেনি, রঞ্জনই ওদের পথ প্রদর্শক। রঞ্জনকে আজ অফিস থেকে ছুটি নিতে হয়েছে। হাসপাতালে ঢোকার মুখে রঞ্জন চিন্ময়ীকে বললো, ইয়ে…পিসিমা… এদেশের হাসপাতালে কেউ চেঁচিয়ে কথা বলে না, কান্নাকাটিও করে না।
কথাটা শুনে বেশ বিরক্ত বোধ করলো তুতুল। রঞ্জন কি তার পিসিমাকে ঠিক মতন চেনে? চিন্ময়ীর মতন বিদুষী মহিলা কি কলকাতার হাসপাতালে গিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলেন, না কান্নাকাটি করেন?
লিফট দিয়ে তিনতলায় উঠে, লম্বা করাইডোর দিয়ে হেঁটে একেবারে কোণের একটি ঘরে ঢুকলো রঞ্জন। দরজার কাছে দাঁড়িয়েই থমকে গেল তুতুল। ক্যাবিন বটে কিন্তু জয়দীপের নিজস্ব নয়। দুটি বেড। প্রথম বেডটিতে শুয়ে আছে একজন বিশালাকায় কালো মানুষ, তাকে ঘিরে রয়েছে তার আত্মীয় স্বজন। তাদের ভেদ করে জয়দীপকে প্রথমে দেখাই গেল না।
এই একটা ছোট ঘরে, অন্য লোকজনদের সামনে সে জয়দীপের সঙ্গে কী কথা বলবে? জয়দীপকে চেনাই যায় না। অমন চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল তার, লম্বা চওড়া পুরুষ, হঠাৎ যেন গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে। তার মুখখানা মসীবর্ণ। চিন্ময়ী প্রথমে এগিয়ে গিয়ে শুধু বললেন, খোকন…। জয়দীপ তার মায়ের হাত চেপে ধরে চোখ দিয়ে তুতুলকে খুঁজতে লাগলো। তুতুল চিন্ময়ীর পাশে এসে দাঁড়াতে জয়দীপ তার মাকে ছেড়ে তুতুলের দিকে হাত বাড়ালো, তুতুল তার কম্পিত হাত রাখলো জয়দীপের বুকে। তার মনে হলো, সে নিজেই বুঝি ভদ্রতা রক্ষা করতে পারবে না, হঠাৎ তার গলা দিয়ে তীব্র কান্নার আওয়াজ বেরিয়ে আসবে!
ফ্যাসফেসে হয়ে গেছে জয়দীপের গলার আওয়াজ, সে বললো, আমি ভালো আছি! কলকাতার খবর কী? হেমকান্তি, শিখা ওরা কেমন আছে।
অমলা বা রঞ্জন একবারও কলকাতার কোনো খবর জিজ্ঞেস করেনি। কলকাতার কোনো একজন মানুষের কথাও জানতে চায়নি।
পাশের নিগ্রো পরিবার বেশ জোরে জোরে কথা বলছে। একজন একটি বিয়ারের টিন খুলে তাদের রুগীকে খাওয়ালো। চিন্ময়ী আর তুতুলকে রেখে রঞ্জন সিগারেট খেতে বেরিয়ে গেছে। ওরা প্রায় নিঃশব্দ হয়ে বসে রইলো জয়দীপের পাশে। আশ্চর্য মনের জোর চিন্ময়ীর, ছেলের কাছে এসে একবারও চোখ ভেজেনি তার। একটু বাদে তিনি বললেন, বহ্নিশিখা, তুমি খোকনের কাছে একটু একা থাকো, আমি বাইরে দাঁড়াই।
একা একা কী কথা বলবে তুতুল? জয়দীপ একবার জিজ্ঞেস করলো তোমাকে কি মা জোর করে ধরে এনেছে? তুমি টিকিটের টাকা ফেরত দিয়েছো শুনলাম…
তুতুল জোরে জোরে মাথা নাড়লো। তারপর বললো, তুমি বেশি কথা বলো না।
পাশের বেডের রুগীকে একজন স্বাস্থ্যবতী মহিলা অন্যদের সামনেই ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে, সেদিকে চোখ পড়তেই লজ্জায় অরুণবর্ণ হয়ে গেল তুতুলের মুখ। জয়দীপ নিজের হাতটা তুলে দিল তুতুলের গালের ওপর।
এতদূর থেকে আসা, তবু জয়দীপের সঙ্গে বিশেষ কোনো কথাই হলো না। পাশের রুগীটি দুতিনদিন পরেই ছাড়া পাবে, সেই আনন্দে তার আত্মীয়স্বজন বেশী উচ্ছ্বসিত। দু একবার অবশ্য তারা চিন্ময়ী আর তুতুলের দিকে ফিরে বললো, স্যরি! একটু গলা নামিয়ে কথা বলার চেষ্টাও করলো তারা, মিনিট খানেক বাদেই আবার যে কে সেই!
চিন্ময়ী আর তুতুল একটি-দুটি বাক্য বিনিময় করতে লাগলো জয়দীপের সঙ্গে। বাকি সময় চুপ করে চেয়ে থাকা। তুতুল ভালো করে তাকাতে পারছে না জয়দীপের দিকে। সেই মুখ। থেকে জীবনের আভা অনেকখানি মিলিয়ে গেছে।
বিদায় নেবার আগে তুতুল জয়দীপের হাতে ছোঁয়ালো তার ঠাণ্ডা ওষ্ঠ।
বাড়ি ফেরার পর দেখা হলো অমরনাথের সঙ্গে। তিনি নিজে ডাক্তার হলেও নিজস্ব প্র্যাকটিস নেই, চাকরি করেন একটি ওষুধের ফার্মে। বেশ দীর্ঘকায় পুরুষ, হঠাৎ মোটা হতে শুরু করেছেন মনে হয়, চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। এক একজন মানুষ থাকে, যাদের কোনো পোশাকেই ঠিক মানায় না, অমরনাথও সেইরকম। সুটটা তার গায়ে যেন ঢলঢল করছে। টাইয়ের গিট আলগা, তার দাড়ি কামানো মুখেও গলার কাছে কিছু পাকা দাড়ির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।
অমরনাথ ইংরিজি ব্যবহার করেন না বিশেষ। বসবার ঘরের সোফায় এলিয়ে বসে তিনি বললেন, বুঝলি চিনু, আজকের দিনটাতেই এমন কাজ পড়ে গেল, এক ব্যাটা আইরিশ সাহেব আজই এসে স্টক টেকিং করার জন্য যাক তোদের অসুবিধে হয়নি তো কিছু? প্লেনটা তো লেট করেছে আড়াই ঘণ্টা, তারপর তোরা এমন সময় এলি, সারাদিন প্যাঁচপেচে বৃষ্টি। এ কথা বলতে বলতে অমরনাথ পাশের সোফায় পা তুলে দিতেই অমলা ধমক দিয়ে বললেন, হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? তোমার ন্যাস্টি হ্যাঁভিটগুলো কিছুতেই যাবে না।
স্ত্রীর কথা শুনে পা নামালেন বটে অমরনাথ, কিন্তু উল্টে ধমক দিয়ে বললেন, টি ভি’টা বন্ধ কর না, কী ভ্যাজর-ভ্যাজর শুনছো…
অমলা বললেন, আজ একটা সিরিয়াল আছে, এটা আমি মিস করি না…
–তা বলে আমার বোন এসেছে এতদিন বাদে, তার সঙ্গে কথা বলতে পারবো না? আস্তে করো, আমার বোতল আর গেলাস এনে দাও?
–ইউ গেট ইয়োর ওউন ড্রিংকস।
অমরনাথ উঠে গিয়ে একটা কাবার্ড খুলে একটা হুইস্কির বোতল আনলেন। গেলাসে অনেকখানি ঢেলে একটা বড় চুমুক দিয়ে বললেন, সারাদিন এমন গাধার খাটুনি গেছে, এই শালা আইরিশগুলো এমন খচ্চর হয়–
ঘরের এক কোণ থেকে ছোট মেয়ে নীটা বললো, ড্যাডি, মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গোয়েজ! চিন্ময়ী যেন স্তব্ধ হয়ে গেছেন। হুঁ-হাঁ ছাড়া কিছুই বলছেন না। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর অমরনাথ দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ও, আজ তো আবার নেমন্তন্ন আছে, চিনু, তোরা তৈরি হয়ে নে। উপেন মিত্তিরকে মনে আছে তো। বাবার বন্ধু ছিলেন, তার ছেলে কল্যাণ এখানে বড় চাকরি করে, তোরা আজ আসছিস শুনে পার্টিতে ডেকেছে। চল আর বেশি দেরি করা যাবে না, যেতে হবে সেই সাউথ লণ্ডনে।
তুতুল শিউরে উঠলো কথাটা শুনে। কলকাতা থেকে আজই এসে পৌঁছেছেন চিন্ময়ী। হাসাতালে অতখানি অসুস্থ ছেলেকে দেখার পর তিনি এখন নেমন্তন্ন খেতে যাবেন? অথচ অমরনাথ এমনভাবে বললেন কথাটা, যেন এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
চিন্ময়ী মৃদু গলায় বললেন, দাদা, আমি আজ খুব ক্লান্ত, আমি আজ কোথাও যাবো না! কিন্তু তুতুল ছাড়া পেল না। সে অনেকবার না না বললেও অমরনাথ তার আপত্তি গ্রাহ্যই করলেন না, প্রায় জোর করেই তুতুলকে নিয়ে গেলেন। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা বলে তুতুলকে পরিয়ে দেওয়া হলো অমলার একটা ওভারকোট।
কল্যাণ মিত্রের বাড়ির পার্টিতে চোদ্দপনেরো জন নারী-পুরুষ, সকলেই অতিরিক্ত সুসজ্জিত, এ বাড়িটাও অনেক বেশি সাজানো। এক কোণে খোলা হয়েছে বার কাউন্টার, প্রত্যেকের হাতে নানারকম মদের গেলাস, এরকম কোনো পার্টিতে তুতুল কখনো যায়নি, সে সিনেমায় দেখেছে। কল্যাণ মিত্রের স্ত্রী গায়ত্রী অবশ্য বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে আলাপ করলেন তুতুলের সঙ্গে। আলাপ হলো আরও দু’জন মহিলার সঙ্গে। মেয়েরা কেউ কেউ বীয়ার বা ওয়াইন নিয়েছে, তুতুল নিল কোকাকোলা।
একটু পরে সেখানে এসে ঢুকলো আলম, তার সঙ্গে শিরিন নামে একটি ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে। একমাত্র আলমের গলাতেই টাই নেই। সে সোজা তুতুলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী, ঘুম পাইতেছে না? জেট ল্যাগ হয় নাই?
তুতুল দু’দিকে মাথা নাড়ালো।
আলম ধপাস করে তার পাশে বসে পড়ে বলল, মিস সরকার, না বহ্নিশিখা দেবী, কী নামে ডাকব আপনাকে?
তুতুল বলল, যেটা আপনার খুশি!
–আমারে আপনি শুধু আলম কবেন, আমি বহ্নিশিখা বলে ডাকবো, ঠিক আছে?
তুতুল ঘাড় হেলালো। আলম তার সঙ্গের মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, শিরিন, তুমি এনার পাশে বসো, ভদ্রমহিলা নতুন আসছেন। একটু অস্বস্তি ফিল করবেন তো বটেই, তুমি একটু লণ্ডনের হালচাল বুঝাইয়া দাও!
তুতুলের অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে। শিরিনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও সে চোখ মেলে রাখতে পারছে না।
এখানে কেউ জয়দীপের নাম একবারও উচ্চারণ করেনি। এই সব পার্টিতে অসুখের আলোচনা করা বোধ হয় নিষেধ।
খাবার দেওয়া হলো রাত এগারোটার পর। সে খাওয়া যেন আর শেষ হতেই চায় না। খাওয়ার চেয়ে গল্প আর হাসাহাসি হচ্ছে বেশী। এমন সব লোকের নাম নিয়ে অন্যরা গল্প করছে, যাদের কারুকেই তুতুল চেনে না, সে কিছু বুঝতেও পারছে না। শিরিন আর আলম চলে গেছে ডিনার না খেয়েই, তারপর আর তুতুলের সঙ্গে কেউ কথা বলে না।
বাড়ি ফিরতে রাত একটা হলো। অমরনাথ বেশ মাতাল হয়ে গেছেন, তাই গাড়ি চালালেন অমলা। আসবার সময় তুতুল গাড়িতে ঘুমে ঢুলতে লাগলো, অধিক রাতে লণ্ডন নগরের দৃশ্য তার দেখা হলো না।
চিন্ময়ী তখনও জেগে আছেন তুতুলের জন্য। বিছানার ওপর সোজা হয়ে বসা, তাঁর হাতে একটা বই। এক নজর দেখেই তুতুল বুঝতে পারলো, সারা সন্ধে তিনি একা একা কেঁদেছেন। চোখদুটি ফোলা।
কিন্তু এখন তাঁর কণ্ঠস্বরে কোনো জড়তা নেই। তুতুলকে তিনি দরজাটা বন্ধ করে দেবার ইঙ্গিত করলেন। তারপর বললেন, বহ্নিশিখা, আমি একটা জিনিস ঠিক করেছি, তোমাকে এতদূরে শুধু শুধু নিয়ে এলাম, কিন্তু উপায় নেই, আমি জয়দীপকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।
তুতুল কিছু বলার আগেই তিনি আবার বললেন, তোমার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, তা আমি দেখবো। একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আজ ভালো করে ঘুমিয়ে নাও…
তারপর তিনি তুতুলের একখানা হাত শক্ত করে চেপে ধরে মাথা নীচু করে রইলেন।