২.৬০ অকস্মাৎ মামুনকে গ্রেফতার

যেমন অকস্মাৎ মামুনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেইরকমই হঠাৎ একদিন ছেড়ে দেওয়া হলো তাঁকে। মুক্তি পেয়েই মামুন যেন বেশি বিস্মিত হলেন। অন্যান্য বন্দীদের থেকে আলাদা করে তাঁকে রাখা হয়েছিল আর্মি ক্যানটনমেন্টে। মাসের পর মাস তাঁর ওপর মানসিক ও শারীরিক উৎপীড়ন চলেছে। ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা দিয়ে তাঁকে ভারতের গুপ্তচর সাজাবার চেষ্টা হয়েছিল। মামুন ধরেই নিয়েছিলেন, একা কুকুরকেও ফাঁসী দেবার আগে যেমন একটা বদনাম দিতে হয়, সেই রকমই কিছু চেষ্টা চলছে। জেরার সময় ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মিঃ ওঝা, চিটাগাঙ-এর আওয়ামী লীগ নেতা মানিক চৌধুরী ও স্টুয়ার্ট মুজিবুর রহমান, শেখ মুজিব নয়, অন্য একজন, এদের নাম তোলা হচ্ছিল বারবার। অথচ মামুন এই তিন ব্যক্তিকে কোনোদিন চক্ষেও দেখেন নি।

বিনা ভূমিকায় মামুনকে জেল গেটের বাইরে যেতে দেওয়া হলো। তাঁর পকেটে একটি পয়সা নেই, বাইরে তাঁর জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। ইন্টেলিজেন্স-এর লোকদের অত্যাচারে এবং রক্তামাশায় ভুগে মামুনের শরীরটা শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে, তবু শীতকালের পরিষ্কার আকাশ দেখে তাঁর মনটা আনন্দে ভরে গেল। কী সুন্দর, টাটকা আলো। মুক্তির স্বাদ যে এত সুন্দর, তা জেলখানায় কিছুদিন না কাটালে বোঝা যায় না।

বেলা এখন এগারোটা। আজ ঠিক কী বার বা তারিখ, তা মামুনের খেয়াল নেই। পথের গাড়ি-ঘোড়ার জটলা ও মানুষজনের যাওয়া-আসার ব্যস্ত ভঙ্গি দেখলে ছুটির দিন মনে হয় না। শোনা যাচ্ছে গতিশীল পৃথিবীর একটা গমগম শব্দ।

রাস্তার কোনো মানুষ কি মামুনকে দেখে বুঝতে পারছে যে তিনি এই মাত্র জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন? শুধু কারাবাস থেকে মুক্তি কেন, হয়তো তিনি ফিরে এসেছেন মৃত্যুর সীমান্ত থেকেও। এক সময় সত্যি তাঁর মৃত্যুভয় ধরে গিয়েছিল। ইন্টারোগেশনের সময় অফিসাররা যেমন ভাবে যখন তখন তাঁর মাথার চুল খামচে ধরতো কিংবা শিরদাঁড়ায় লাথি মারতো, তাতে মনে হতো, ঐ সব আঘাতের ফলে হঠাৎ মামুনের মৃত্যু হলেও তারা কিছু পরোয়া করবে না। একটি দিনের জন্যও তাঁকে আদালতে হাজির করানো হয়নি। সুতরাং তাঁর লাশ গায়েব করে ফেলতেও অসুবিধে ছিল না কিছুই।

মামুন নিজের বেশ কয়েকটি কবিতায় মৃত্যুর বন্দনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে মৃত্যুকে সম্বোধন করেছেন বন্ধু বলে, কিন্তু জেলখানার অত্যাচারে যখন এক একবার দারুণ যন্ত্রণা ও অপমানের রূপ ধরে মৃত্যু এসে উঁকি মারতো, তখন মামুন শিউরে উঠতেন, তাঁর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হতো, না, না, না, আমি আরও বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচতে দাও!

হাঁটতে হাঁটতে মামুনের খুব ইচ্ছে করছে, কোনো একজন অচেনা লোকের হাত চেপে ধরে বলতে, ওরে ভাই শোনো, আমি এই মাত্তর জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি, আমি বেঁচে ফিরে এসেছি!

এখন কোথায় যাওয়া যায়? হেনা দু’বার দেখা করার অনুমতি পেয়েছিল, তার কাছ থেকেই মামুন জেনেছেন যে ঢাকায় তাঁদের বাসা তুলে দেওয়া হয়েছে, ফিরোজা বেগম চলে গেছেন মাদারিপুর। আলতাফ আর একদিনও আসেনি। দিনকাল পত্রিকা অফিসে মামুনের নিজস্ব ঘরটির ওপর এখন তাঁর আর কোনো অধিকারই নেই। ঐ ঘরের জানলার পর্দার রংও মামুন নিজে পছন্দ করেছিলেন। এখন তাঁর চেয়ারে অন্য কেউ বসে।

চেনাশুনা কারুর কাছে অযাচিতভাবে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু একটি প্রধান বাস্তব সমস্যা হলো পকেটে একটা আধলাও নেই। বাইরের টাটকা বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে তাঁর স্বাধীন, সুস্থ মানুষের মতন খিদে পেয়ে যাচ্ছে! কতদিন কালো জিরে ফোড়ন দেওয়া মুসুরির ডাল খাওয়া হয়নি।

মামুন সেগুনবাগিচার দিকে হাঁটতে লাগলেন। তাঁর আপার বাসাতে তো একবার যেতেই হবে, হেনা সেখানেই থাকে। এই কয়েকমাসেই রাস্তা ঘাটের চেহারায় কিছু উন্নতি হয়েছে মনে হয়। খানা-খন্দ কম, অনেক নতুন গাড়ির আমদানী হয়েছে দেখা যাচ্ছে। ফুটপাথে বিক্রি হচ্ছে কমলালেবু আর কলা। গতবছর শীতে কমলালেবুর খুব দাম ছিল, এবারে মনে হচ্ছে চালান এসেছে ভালো। পকেটে পয়সা নেই, তবু কমলা লেবু খাওয়ার জন্য কী লোভই যে হলো তাঁর।

মামুনের দুলহাভাই একজন নামজাদা উকিল, তবু তিনি মামুনের জামিনের জন্য একবারও চেষ্টা করেননি তো! কিংবা, চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন? এতবড় একজন উকিল হয়ে জেলে গিয়ে একবার দেখাও করতে পারলেন না? ওখানে অন্যান্য সহবন্দীরা অনেকে বলাবলি করেছে যে, অনেক উকিলই নাকি পলিটিক্যাল আসামীদের কেস নিতে চাইছে না সরকারের বিরাগভাজন হবার ভয়ে। আর্মি রেজিমেন্ট বিচারকরাও নিরপেক্ষ রায় দিতে পারে না, এখন জুডিশিয়ারির হাতেই হাতকড়া।

কিন্তু নিজের জামাইবাবু পর্যন্ত ভয় পেলেন। শামসুল আলমের সঙ্গে মামুনের শুধু আত্মীয়তা নয়, গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। এখন তাঁর বাড়িতে গিয়ে উঠলে তিনি আবার বিব্রত বোধ করবেন না তো?

দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন মামুন। কী অসহায় যে লাগছে তাঁর। দিদির বাড়িতে আগে যখন তখন এসেছেন, মাসের পর মাস এখানে থেকে গেছেন, মলিহা বেগম তাঁর মায়েরই মতন স্নেহময়ী। আজ যদি কেউ তাকে অবাঞ্ছিত মনে করে?

মামুন একবার পেছন দিকে তাকালেন। কেউ কি তাঁকে অনুসরণ করছে? এতক্ষণ এ কথাটা মনে পড়ে নি। জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে ওরা কি এখন নজর রাখতে চায় যে মামুন কোথায় যান, কার সঙ্গে কথা বলেন? আবার একটা বেড়াজাল ফেলে আরও অনেকের সঙ্গে মামুনকে ধরবে?

কিন্তু হেনার সঙ্গে তো দেখা করতেই হবে! দ্বিধা কাটিয়ে মামুন দরজায় ধাক্কা দিলেন।

ভৃত্যটি নতুন। সদ্য গ্রাম থেকে এসেছে মনে হয়, মাথার চুল তেল চুকচুকে, বছর কুড়ি বয়েস। সে জিজ্ঞেস করলো, কারে চাই?

এ বাড়িতে এসে ভৃত্যের কাছে জবাবদিহি করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। মামুন বললেন, সর, আমি উপরে যাবো।

মামুন তার পাশ দিয়ে ঢুকতে যেতেই সে হাত ছড়িয়ে বাধা দিয়ে বললো, ও ছায়েব, ও ছায়েব কই যান? কারে চান আগে কইয়া লন!

মামুনের আর ধৈর্য থাকছে না, ধাক্কা দিয়ে ছেলেটিকে সরিয়ে দেবার ইচ্ছে হলো তাঁর। অতিকষ্টে নিজেকে দমন করে ক্লিষ্ট কণ্ঠে বললেন, ওরে তুই সর, আমি এই বাড়িরই মানুষ, হেনার বাপ।

তারপর সামনে চোখ তুলেই মামুন অনড় হয়ে গেলেন, তাঁর যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলে। একতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে মঞ্জু।

জেলখানা থেকে বেরিয়ে, এতটা পথ হেঁটে এসে পরিচিত মানুষদের মধ্যে মঞ্জকেই প্রথম দেখবেন, এটা মামুনের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। অথচ অস্বাভাবিক তো কিছু নয়। এটা মঞ্জুর বাপের বাড়ি।

মঞ্জুও যেন প্রথমটায় ঠিক বিশ্বাস করতে পারলো না। মামুনের শরীর এমনই শীর্ণ হয়ে গেছে যে মঞ্জু কয়েক মুহূর্ত ভাবলো, অনেকটা তার মামুনমামারই মতন চেহারার একজন আগন্তুক না সত্যিকারের মামুনমামা? তার হাতে একরাশ কাপড় জামা। সে বোধহয় কাঁচতে দিতে যাচ্ছিল, সেগুলো ফেলে সে ছুটে এসে মামুনকে জড়িয়ে ধরে বললো, মামুনমামা, তুমি? তুমি সত্যি ফিরে এসেছো?

মঞ্জুর কণ্ঠস্বর আবেগ, আনন্দ ও কান্নায় মাখা।

মামুন মঞ্জুকে সরিয়ে দিয়ে শুকনো গলায় বললেন, কেমন আছিস রে, মঞ্জু? ছেলেটা ভালো আছে?

মঞ্জু বললো, মামুনমামা, তোমার এ কী চেহারা হয়েছে? তোমায় কবে ছাড়লো? তুমি কার সাথে আসলে?

এসব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মামুন মঞ্জুকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন দোতলায়।

ছোটভাইকে দেখে মলিহা বেগমের আনন্দ ও উচ্ছাসের মধ্যে কোনো খাদ নেই। তিনি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন। হেনা কলেজে গেছে, তিনি তখুনি ভৃত্যটিকে পাঠালেন হেনাকে ডেকে আনার জন্য। আজ তার বাবা জেল থেকে ফিরেছে, আজ হেনার কলেজ করার দরকার নেই।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই মামুন ঠিক করে নিয়েছেন, শামসুল আলম সাহেবের সঙ্গে তিনি খোলাখুলি আলোচনা করে নেবেন। মামুনকে নিয়ে তাঁর যদি সামান্যতম অস্বস্তি বা উদ্বেগ থাকে, তাহলে মামুন এ বাড়িতে এক রাতও কাটাবেন না। তাঁর জন্য তাঁর দিদির স্বামীর পেশার কোনো ক্ষতি হোক, তা তিনি চান না।

জেলের বাইরের প্রথম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মামুন জিজ্ঞেস করলেন, দুলাভাই কোর্ট থেকে কয়টার সময় ফিরবেন?

মলিহা বেগম বললেন, হায় আমার পোড়া কপাল, তুই শোনোস নাই বুঝি? হ্যায় তো আর কোর্টে যায় না, রিটায়ার করছে, এখন সর্বক্ষণই বাসায় থাকে। মাথায় ভূত চাপছে!

মামুন প্রকৃত বিস্মিত হয়ে বললেন, দুলাভাই রিটায়ার করেছেন? কেন? শরীল-গতিক ঠিক আছে তো?

–তা আছে। কিন্তু ঐ যে কইলাম, মাথায় ভূত চাপছে। উপরের ঘরে একা-একা থাকে। আর বিড়বিড়াইয়া নিজের মনে মনে কথা কয়। দুফুরে খাইতে নামবে, তখন তুই কথা কইয়া দেখিস, দ্যাখ যদি বুঝাইতে পারোস কিছু!

অন্যান্য ভাগ্নে ভাগ্নীরা ঘিরে ধরেছে মামুনকে, মঞ্জু এসে বসেছে একেবারে মামুনের মুখোমুখি। সবাই জেলের গল্প শুনতে চায়। মামুনের ক্লান্ত লাগছে খুব। তিনি মঞ্জুর চোখের দিকে একবারও সরাসরি তাকাচ্ছেন না। অন্যদের প্রশ্নের কয়েকটা সামান্য কাটাকাটা উত্তর দেবার পর তিনি মস্তবড় একটা হাই তুলে বললেন, এখন আমি ঘুমাবো।

মামুনকে মুখ ফুটে বলতে হয়নি, আজ এ বাড়িতে রান্না হয়েছে মুসুরির ডাল। তাতে পুরু করে হলুদ মেশানো। এইসব ছোটখাটো প্রাপ্তিগুলি অনেকখানি গুপ্ত সুখ এনে দেয়। গরম ভাত, আলুসেদ্ধ মাখা সর্ষের তেল দিয়ে, শুঁটকি মাছ দিয়ে রান্না কুমড়োর শাক। মাগুর মাছের কালিয়া,এই প্রত্যেকটি খাবারই মামুনের প্রিয়। কিন্তু যতখানি তৃপ্তির সঙ্গে খাবেন ভেবেছিলেন, তা হলো না, জেলের অখাদ্য খেয়ে খেয়ে পেট ও জিভ মরে গেছে, এই খাবারগুলি দেখে লোভ হচ্ছে। কিন্তু গলা দিয়ে নামছে না। অনেকটাই ফেলে ছড়িয়ে, শেষ পাতে একটু ডালে চুমুক দিয়ে মামুন উঠে পড়লেন।

আলম সাহেব এখনও খেতে নামেন নি। বাড়ির বাচ্চারা কয়েকজন গিয়ে তাঁর কাছে মামুনের আগমন বার্তা জানিয়ে এসেছে, কিন্তু তিনি চক্ষু বুজে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ছাদের যে-ঘরটিতে মামুন কিছুদিন থেকে গেছেন, এখন সেখানেই আলম সাহেবের আস্তানা।

দোতলার একটি ঘরে মামুনকে শুতে দেওয়া হলো। বিছানায় একবার গড়িয়ে পড়ার পরও মামুন উঠে এসে দরজাটা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলেন। বাচ্চাদের জন্য নয়, মঞ্জুর জন্য। মঞ্জু নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে বিরলে গল্প করতে চাইবে। সেবা করতে চাইবে। মামুন আর মঞ্জুর সঙ্গে কখনো একা থাকতে চান না। মঞ্জু তাঁর অন্যান্য ভাগ্নে-ভাগ্নীদের মতন একজন, বিশেষ কেউ নয়। মঞ্জুর দাম্পত্য জীবনে আর কোনোদিন মামুনের ছায়া পড়বে না।

মঞ্জু কি এ বাড়িতেই এখন কিছুদিন থাকবে? তাহলে মামুনের আর এখানে থাকা হবে না। একই বাড়িতে থেকে তিনি মঞ্জুকে এড়িয়ে চলবেন কী করে?

জেলখানায় কোনোদিন ভালো ঘুম হতো না। একটানা বড় জোর এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা ঘুম। আজ দুপুরে প্রাণ ভরে ঘুমিয়ে নেবেন ভাবলেন, তবু ঘুম আসছে না। ধপধপে সাদা চাঁদর পাতা নরম বিছানা, তবু যেন গা কুটকুট করছে, মামুন এপাশ ওপাশ করতে লাগলেন বারবার। চোখের সামনে বারবার আসছে মঞ্জর মুখ, বিস্মিত, বিহ্বল, বেদনামাখা মুখ।

একটা কিছু বই পড়তে পারলে সুবিধে হতো। সামনের তাকে অনেকগুলি বই। মামুন উঠে গিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগলেন। অনেকদিন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়েন নি, অনেকবার মানসিক অশান্তির সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েছে।

এই তাকে রবীন্দ্রনাথের বই নেই। এটা সেটা খুঁজতে খুঁজতে তিনি একটা নজরুলের কবিতা সংকলন পেলেন। মাঝখানটা খুলতেই দেখতে পেলেন এই কবিতা :

কত ছল করে যে বারে বারে দেখতে আসে আমায়।
কত বিনা-কাজের ছলে চরণদুটি
আমার দোরেই থামায়।
জানলা-আড়ে চিকের পাশে
দাঁড়ায় এসে কিসের আশে
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে
অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল গাল দুটিকে ঘামায় ।৷…

এ কবিতা মামুনের চেনা, একবার দেওঘর ঘুরে এসে সেখানকার কোনো একটি মেয়েকে। দেখার স্মৃতি ধরে রেখেছেন এই ‘ছকুমারী’ কবিতায় কাজী নজরুল।

আমার দ্বারের কাছটিতে তার ফুটতো লালী গালের টোলে

টলতো চরণ, চাউনী বিবশ…

মামুন হঠাৎ থেমে গেলেন। দরজার বাইরে যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মঞ্জ? তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে … না, না, মনের ভুল। তাছাড়া, মঞ্জু এলেও মামুন এখন দরজা খুলবেন না। তাঁকে ঘুমোতে হবে…

পুরো কবিতার সংকলনটা পড়া হয়ে গেল, তবু মামুনের ঘুম এলো না। দুপুরের নিঃঝুম ভাব কেটে গিয়ে একসময় সারাবাড়িতে জেগে উঠলো বিকেলের কলরব।

খানিক বাদে মামুন নিজেই গেলেন ছাদের ঘরে আলম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। জানুয়ারি মাসের হাওয়া দিচ্ছে, বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, তবু শুধু লুঙ্গি পরে, খালি গায়ে বসে আছেন শামসুল আলম। আগের চেয়ে মোটা হয়েছেন অনেক, তাঁর গৌরবর্ণ যেন ফেটে পড়ছে। মামুন তাঁকে কখনো দাড়ি রাখতে দেখেন নি, সঙ্গীতপ্রিয় আমুদে ধরনের মানুষ ছিলেন, এখন মুখে অযত্ন বর্ধিত দাড়ি। কপালে অনেকগুলি ভাঁজ।

তিনি বললেন, আসো মামুনমিঞা, আসো। তোমার ছাড়া পাওনের খবর দুপুরেই শুনছি। তুমি ঘুমাইয়া পড়ছিলা, আমি যখন খাইতে যাই। আছো কেমন কও! জেলখানায় তোমাগো কোরআন শরীফ পড়তে দিত? নাকি জালিমগুলা তাও দ্যায় নাই?

প্রথমেই এই প্রকার প্রশ্ন শুনে মামুন একটু হকচকিয়ে গেলেন। মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, তা দিত। আপনি…

মামুনের হাত ধরে কাছে টেনে এনে তিনি বড় বড় চোখ মেলে বললেন, তবু ভালো। কোরআন শরীফ পড়লে সব সময় মনে শান্তি পাওয়া যায়। তোমার মনে যে-কোনো প্রশ্ন আসুক, তুমি উত্তর পাবা। কেমন কি না। যেমন ধরো, মক্কায় আবির্ভূত যে সূরা এনাম, তাতে আছে, জিজ্ঞাসা করো। কোন্ বস্তু সাক্ষ্যদান বিষয়ে শ্রেষ্ঠ? তুমি বল, তোমাদের ও আমার মধ্যে ঈশ্বরই সাক্ষী…

পরপর আয়াত বলে যেতে লাগলেন তিনি। মামুনের বিস্ময় ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছিল, তারপর তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝলেন। দুলহাভাই আগে ধর্ম নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না বরং কিছুটা ভোগবাদী নাস্তিক ধরনেরই ছিলেন। একটা বয়েসে মানুষের হঠাৎ ধর্মের দিকে মতি ফেরে। নাস্তিকেরা যখন আস্তিক হয়, তখন সর্বক্ষণ সেই আনন্দেই বিভোর হয়ে থাকে। দেশের ও সমাজের দুঃসময়ে বেশি বেশি করে ধর্মকে আঁকড়ে ধরাও স্বাভাবিক ব্যাপার।

মামুন ভক্তি ভরেই আলম সাহেবের কথাগুলি শুনে যেতে লাগলেন। তারপর একবার একটু ফাঁক পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দুলাভাই, আপনি হঠাৎ ওকালতি ছাড়লেন কেন? এত ভালো পশার ছিল…

উদার ভাবে হেসে আলম সাহেব বললেন, আর ওসবে কী হবে? পয়সা তো যথেষ্ট করেছি। সারা জীবনে কত মিথ্যা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম, এখন যদি সত্যের সন্ধান না করি, তা হইলে পরকালে কী জবাবদিহি করবো? অ্যাঁ? তাছাড়া আরও একটা কথা আছে। আইজকাইল আমি প্রায়ই ঘুমের মধ্যে ফেরেশতা, জিবরাইলরে স্বপন দেখি। আমার সাথে কথা বলেন। আরও কী হয় জানো, জাইগা থাকার সময়ও মাঝে মাঝে আমি কানের মধ্যে ঘণ্টাধ্বনি শোনতে পাই। তারপরই শুনি এক বাণী।

এবারে মামুন চোখ সঙ্কুচিত করে তাকালেন।  

আলম সাহেব মুখ ঝুঁকিয়ে এনে বললেন, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতেছ না? আমার উপর অহী নাজিল হয়।

মামুন খানিকটা দমে গেলেন। এত অল্পদিনে দুলাভাই এতদূর চলে গেছেন? কিন্তু এইসব বিষয়ে তর্ক চলে না। তিনি বুঝতে পারলেন, এর সঙ্গে কোনো কাজের কথা বলা যাবে না এখন।

একটু পরে তিনি ওঠার চেষ্টা করতেই আলম সাহেব তাঁর ঘাড় খামচে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, মামুনমিঞা, তুমি তো অনেক পড়াশুনা করেছো, কও তো “খাতামান নবিয়্যীন”-এর সঠিক অর্থ কী?

মামুন ব্যক্তিজীবনে ধর্মাচরণ তেমন না করলেও ধর্মশাস্ত্রগুলি পাঠ করেছেন মোটামুটি। তবু তিনি বিনীতভাবে বললেন, আমি ও কথার অর্থ জানি না, দুলাভাই। তেমনভাবে পড়াশুনো করার আর সময় পাইলাম কোথায়?

–তুমি বলো, নবুয়তের সিলসিলা কি খতম হয়ে গেছে? পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসবে না?

–এ আপনি কী বলছেন, দুলাভাই? কোরআন-হাদীশ যে পড়েছে, সে-ই তো জানে যে রসুলুল্লাহ (সঃ) শেষ নবী। তিনি অনেকবার বলেছেন, আমার পর আর কোনো নবী নাই আর আমার উম্মতের পর আর কোনো উম্মত নাই।

–মৌলবীরা ভুল ব্যাখ্যা করেছে। তুমি শুনে রাখো আমার কাছে। “খাতামান নবিয়্যীন”-এর অর্থ নবীদের মোহর অর্থাৎ শীলমোহর। রসুলুল্লাহ (সঃ)-এর পর তাঁর মোহরাঙ্কিত হয়ে আরও নবী আসবেন। সেই সময় এসে গেছে!

মামুন এবার ভয় পেয়ে গেলেন। এ যে কাদীয়ানীদের মতন কথাবার্তা। মির্জা গোলাম মহম্মদ কাদিয়ানীর চ্যালারা একসময় এই রকম কথা প্রচার করেছিল। কাদিয়ানীদের কেউ পছন্দ করে না। অনেকে তাদের প্রকৃত মুসলমান বলেও মনে করে না। তারা বিপথগামী।

মামুন বললেন, এরকম কথা উচ্চারণও করবেন না, দুলাভাই। রসুলুল্লহ (সঃ)-এর পর কেউ যদি নিজেকে নবী বলে দাবি করে, তাহলে সে হবে মিথ্যাবাদী, দাজ্জাল, কাজ্জাব! একথা আপনি বাইরে বলতে যাবেন না, বিপদে পড়বেন।

–আলবাৎ বলবো! আমাদের পাকিস্তানের এই দুঃসময়ে একজন নবীর আবির্ভাব হবে, তিনি আমাদের উদ্ধার করবেন! আমি কয়ে দিলাম, তুমি মিলায়ে নিও! আর দেরি নাই, তিনি আসবেন, রাওয়ালপিণ্ডি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সমস্ত মুসলমান তাঁর আদেশে সকলে সমান ভাই ভাই হবে… মুসলমান আর মুসলমানরে মারবে না, শোষণ করবে না…তাঁকে আসতেই হবে, দোয়া করো, মামুনমিঞা, দোয়া করো…

খানিকপরে মামুন যখন উঠে এলেন, তখনও আলম সাহেব চিৎকার করছেন আপন মনে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মামুন।

সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নামতেই মঞ্জুর সঙ্গে দেখা। সে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ এরকম ভাবে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে! আগে যখন মামুন ওপরের ঘরটিতে থাকতেন, তখন কতদিন মঞ্জু এসে তাঁকে গান শুনিয়েছে। সময় কী নিষ্ঠুর, আজ মঞ্জুকে দেখে মামুনের একটা কথা বলতেও ইচ্ছে হলো না।

মঞ্জু জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমার ওপরে রাগ করেছ, মামুন মামা?

মামুন কয়েক ধাপ নামতে নামতে নীরস গলায় বললেন, নারে, রাগ করবো কেন? বাবুল কেমন আছে, সে আসবে আজ?

মঞ্জু মামুনের সঙ্গে সঙ্গে নামেনি, দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। সে বললো, না, সে এ বাড়িতে আসে না। মামুনমামা, সে আর আমাকে দ্যাখে না। আমার সাথে ভালো করে কথা বলে না। আমি নিজে থেকে—

মামুন দ্রুত নামতে লাগলেন, তিনি মঞ্জুর বাকি কথাগুলো শুনতে চান না। মঞ্জুদের দাম্পত্য জীবনের কোনো ব্যাপারেই তিনি থাকতে চান না আর। তবু মঞ্জুর শেষ কথাগুলো ঠিকই তার কানে এলো।

মঞ্জু বললো, আমি নিজে থেকে কিছু বলতে গেলে সে তোমার নামে খোটা দ্যায়। তুমি আমারে ভালোবাসতা, আমার খোঁজ খবর নিতা, তাতেই তার রাগ…

মামুন দু’হাতে কান চাপা দিতে চাইলেন। বাবুলটা কত গাধা? মঞ্জুকে তিনি ভালোবাসতেন ঠিকই, কিন্তু তা কি কোনো অবৈধ ভালোবাসা? এক একজনের ওপর একটু বেশি স্নেহের টান থাকে না? আর তো তিনি ওদের মাঝখানে যাবেন না কথা দিয়েছেন, মনও কঠিন করেছেন, তবু বাবুল কষ্ট দিচ্ছে এই মেয়েটাকে?

মঞ্জুকে সুখী করার তা হলে বোধহয় আর একটাই উপায় আছে। মৃত্যু! এই মুহূর্তে মামুনের বেঁচে থাকার সমস্ত সাধ চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *