২.৫৯ পুরোনো গাড়িটার বদলে

পুরোনো গাড়িটার বদলে কিছুদিন আগে একটা নতুন ফিয়াট গাড়ি কিনেছেন বিমানবিহারী। ভেতরে এখনও নতুন নতুন গন্ধ। পুরোনো বুড়ো ড্রাইভারটি এখনো রয়ে গেছে, সে কিছুক্ষণ পর পরই একটা পালকের ঝাড়ন দিয়ে গাড়িটা মুছে নেয়।

চমৎকার শীতের অপরাহু, রাস্তায় নিশ্চিন্ত মানুষের মুখ, কোনো কিছুই দেখে বোঝার উপায় নেই যে আজ ময়দানে একটা খণ্ড প্রলয় ঘটে গেছে। তবে দু একটা রাস্তার মোড়ে যুবকদের জটলা, তারা আলোচনা করছে ঐ ভাঙা খেলার।

বিমানবিহারী বললেন, এখন স্টেডিয়ামের দিকে গিয়ে কোনো লাভ নেই। আগে বরং ঐ কৌশিকের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখা যাক। কী বলো?

এইভাবে বিমানবিহারীর সঙ্গে বেরুবার একটুও ইচ্ছে ছিল না প্রতাপের। শুধু শুধু বিমানকে ব্যতিব্যস্ত করা। বন্ধুর গাড়িতে চেপে ছেলেকে খুঁজতে যাওয়া … সত্যি কি সেরকম কিছু ঘটেছে? হয়তো একটু পরেই বাবলু বাড়িতে ফিরে আসবে। মমতা আর সুপ্রীতির যুক্তিহীন। আশঙ্কার জন্যই প্রতাপকে বেরুতে হলো।

প্রতাপ বললেন, আমার ছেলেটা বুঝলে বিমান, যদিও বড় হয়েছে, কিন্তু এখনও ছেলেমানুষের মতন রয়ে গেছে। ধুড়ুম ধাডুম করে দরজা জানলা বন্ধ করে, খিদে পেলেই চাচায়, আবার এক একদিন নাওয়া খাওয়া ভুলে বাইরে কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এম এস সি পাস করলো, কিন্তু এখনও ম্যাচিওরিটি আসেনি।

বিমানবিহারী বললেন, যতদিন ছেলেমানুষ থাকা যায়, ততই তো ভালো। এরপর একবার সংসারের ঘানিতে জুতলেই তো … আমরাও ধরো না কেন, আমাদের বাবা-কাকাদের মতন অতটা বুড়ো হয়েছি কি? আমার বাবা আমার মতন এই বয়েসে হাতে ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন, মাথার চুল প্রায় সাদা। আমার তবু কিছু চুল পেকেছে, তোমার মাথাটি তো এখনও দিব্যি কালো রয়েছে, প্রতাপ! কলপ টলপ মাখো নাকি?

–আরে যাঃ! চুলে কলপ মাখবো কাকে ভোলাতে? তবে আমারও চুল পাতলা হয়ে আসছে।

–বাবলুকে আই এ এস পরীক্ষায় বসাবে নাকি? মেরিটোরিয়াস ছেলে, ও ঠিক পেরে যাবে।

–ওর মা ওকে একবার সাজেস্ট করেছিল, তাতে মায়ের ওপর ওর কি চোটপাট! ও নাকি কোনোদিন সরকারি চাকরি করবে না। আজকালকার ছেলেদের জোর করে কিছু করানো যায় কি?

–সরকারি চাকরি করবে না …যদি বেঙ্গল কেমিক্যালে ঢুকতে চায়, আমি চেষ্টা করতে পারি। রাজশেখর বসু মশাইয়ের সঙ্গে আমার বিশেষ জানাশুনো ছিল, সেই সূত্রে ওখানকার অনেককেই চিনি।

–আমার ইচ্ছে, চাকরিতে ঢোকার আগে পি-এইচ ডি করুক।

–পি-এইচ ডি যদি করতেই হয় …এদেশে করবে? ভালো রেজাল্ট করেছে, অনায়াসে বিদেশের কোনো ইউনিভারসিটিতে চান্স পেয়ে যেতে পারে। আজকাল তো দলে দলে ছেলেমেয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।

–ওর মা’র মুখে শুনেছি, ওর বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি আছে।

–ওর মা’র মুখে শুনেছো …কেন, তুমি ওকে নিজে জিজ্ঞেস করতে পার না?

–এই একটা দুঃখের ব্যাপার হয়েছে, বিমান, ছেলেটা সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলতেই চায় না। আমাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। হয়তো আমারই দোষ, অল্পবয়সে একটু বেশি শাসন করেছি, খুবই দুরন্ত ছিল তো, পড়াশুনোয় একেবারে মন ছিল না।

–পড়াশুনোয় মন ছিল না, কিন্তু প্রত্যেকটা পরীক্ষাতেই রেজাল্ট ভালো করেছে।

–সেটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার! সারা বছর পড়ে না …ওর মায়ের সঙ্গে যেমন মাঝে মাঝেই ঝগড়া হয়, আবার মায়ের সঙ্গেই মনের কথা হয়, আমাকে কিছু বলতে চায় না।

কৌশিকদের বাড়ির কাছাকাছি গাড়িটা থামলো। মমতা কৌশিকদের ঠিকানা বলে দিয়েছিলেন, ছেলের কাছে তিনি কৌশিকদের বাড়ির বর্ণনাও শুনেছেন। পুরোনো আমলের বাড়ি, সামনে কোলাপসিবল গেট, একপাশে একটা বড় কদমফুলের গাছ।

বিমানবিহারীকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে প্রতাপ নামলেন। এখন দুপুর পৌনে তিনটে। এই সময় কারুর বাড়িতে এসে ডাকাডাকি করা কি ঠিক? এ বাড়ির অন্য কেউ প্রতাপকে চেনে না, এমনকি কৌশিকের সঙ্গেও তার কোনোদিন একটাও কথা হয়নি। বসবার ঘরে ছেলের বন্ধুদের দেখে তিনি গম্ভীর ভাবে ভেতরে ঢুকে যান, ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার কথা কোনোদিন তার মনে আসেনি। বাবলুর বন্ধুরাও তাকে দেখলে আড়ষ্ট হয়ে চুপ করে বসে থাকে।

প্রতাপ দারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তার অহমিকা প্রবল, তিনি অযাচিতভাবে এ বাড়িতে এসেছেন, এমন দুপুরবেলা বিরক্ত করার জন্য যদি এ বাড়ির কেউ প্রথমেই তার সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করে?

গেটের পাশে একটি কলিং বেল আছে। অনেকখানি দ্বিধা নিয়ে প্রতাপ সেখানে আঙুল রাখলেন। ছেলের খোঁজ নিতে এসেছেন বটে, কিন্তু প্রতাপের মনের একটা অংশ চাইছে, বাবলু যেন এখানে না থাকে! এম এস সি পাস করা ছেলে বাবাকে এইভাবে ছুটে আসতে দেখলে কি খুশী হবে? তার আত্মসম্মানে লাগতে পারে। একমাত্র মায়ের মন এইসব বোঝে না।

দু তিনবার বেল বাজবার পর দোতলার বারান্দা থেকে একটি তরুণী মেয়ে রেলিং-এ অনেকখানি ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো, কে? এই যে, ওপরে তাকান, কী চাই?

প্রতাপ যেন একজন ফেরিওয়ালা। তার মুখ লালচে হয়ে গেছে, তবু শান্তভাবে তিনি বললেন, কৌশিক আছে কী? তার সঙ্গে একটু কথা বলতাম।

তরুণীটি বললো, কৌশিক তো নেই, বেরিয়ে গেছে।

প্রতাপ সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্ত হলেন। কৌশিক নেই, বাবলুও এখানে নেই, যাক বাচা গেল, প্রতাপ এখন ওদের মুখোমুখি হতে চাইছিলেন না। দোতলার তরুণীটি প্রতাপকে ফিরতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কৌশিককে কিছু বলতে হবে। কী? আপনার নাম?

প্রতাপ মাথা নেড়ে বললেন, আমার নাম শুনে চিনতে পারবে না, দরকার নেই…

–এই যে, শুনুন, রাস্তার উল্টোদিকে, ঐ যে হলদে বাড়িটার পাশে একজন মুচি বসে আছে, তাকে একটু ডেকে দেবেন, প্লীজ!

তরুণীটির অনুরোধ প্রতাপ মান্য করবেন অবশ্যই। তরুণীটি প্রতাপকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করছে। এরপর প্রতাপ যখন গাড়িতে উঠবেন, তখন সে লজ্জা পেয়ে যায় যদি! বিস্মিত বিমানবিহারীর চোখের সামনে দিয়ে প্রতাপ রাস্তা পার হয়ে মুচিটিকে নির্দেশ দিলেন, তারপর ধীরে-সুস্থে একটি সিগারেট ধরালেন। তরুণীটি যাতে দেখতে না পায়, তিনি মুখ ফিরিয়ে আছেন অন্যদিকে।

গাড়িতে ফিরে আসার পর বিমানবিহারী জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো?

–কৌশিক বাড়িতে নেই বললো।

–বাবলু এসেছিল এখানে?

–তা জিজ্ঞেস করিনি।

–বাঃ, সে কথাটা জিজ্ঞেস করলে না? বাবলু আর ঐ ছেলেটি যদি একসঙ্গে বেরিয়ে থাকে …যাও, একবার বাবলুর কথাটা জিজ্ঞেস করে এসো

-–থাক, দরকার নেই। এখানে নেই যখন…

বিমানবিহারী একটু চিন্তা করে বললেন, চলো, আমার বাড়িতে যাই। আমার জন্যও ওরা হয়তো চিন্তা করতে পারে, রেডিওতে খবর শুনেছে নিশ্চয়ই, বাবলুও থাকতে পারে ওখানে, অলির সঙ্গে তো প্রায়ই গল্প করতে আসে।

গাড়ি আবার ঘুরলো, প্রতাপের একটা কথা মনে পড়লো, বাবলু না-ফেরা পর্যন্ত মমতা না খেয়ে থাকবেন। মমতার আলসার আছে, বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকা তার পক্ষে ঠিক নয়। বাবলুর হয়তো কিছুই হয়নি, সে কোথাও বসে আড্ডা দিচ্ছে, কিন্তু দুপুরে বাড়িতে এসে খাবে কি খাবে না, সে কথা কেন বলে যায়নি হতভাগা ছেলেটা?

বিমানবিহারী আবার বললেন, বাবলু কোনো পলিটিক্যাল পার্টিতে যোগ দিয়েছে নাকি, তুমি কিছু জানেন?

প্রতাপ দু দিকে মাথা নাড়লেন।

–অলির সঙ্গে প্রায়ই পলিটিক্স নিয়ে তর্ক করে, আমি মাঝে মাঝে শুনতে পাই। উঃ, এক এক সময় এমন চাচামেচি করে ঝগড়া লাগায় দু’জনে, ঠিক যেন পিঠোপিঠি ভাই বোন!

প্রতাপ একটু হেসে উঠলেন। অলিকে তার খুবই পছন্দ, এমন শান্ত, শ্রীময়ী মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। সেও চেঁচিয়ে ঝগড়া করতে জানে নাকি? মমতার মাথায় সম্প্রতি একটা চিন্তা ঘুরছে, ছেলে এম এস সি পাস করেছে, দু’ এক বছরের মধ্যে তার বিয়ের কথা ভাবতে হবে, অলির সঙ্গে বাবলুর ছেলেবেলা থেকে বন্ধুত্ব, অলির সঙ্গেই বিয়ে হলে সবদিক থেকেই চমৎকার হয়, যদি বিমানবিহারীদের আপত্তি না থাকে এই বিষয়ে প্রতাপ কি বিমানবিহারীর সঙ্গে একটু আলোচনা করতে পারেন না?

প্রতাপ তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। বাবলুর বিয়ে নিয়ে তিনি এখন একটুও মাথা ঘামাতে চান না। আগে পড়াশুনো শেষ করুক, চাকরি বাকরিতে ঢুকুক …তা ছাড়া বিমানবিহারীর কাছে তিনি কিছুতেই এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারবেন না। কোনো রকম প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারেন না প্রতাপ, নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে তো নয়ই। অলির বিয়ে সম্পর্কে বিমানবিহারী ও কল্যাণী যদি অন্যরকম চিন্তা করে থাকেন? তাদের এই দুই পরিবারের অবস্থা সমান নয়। কল্যাণী কোনো ধনী পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইতেই পারেন …অলি আর বাবলু দু’জনেই লেখাপড়া শিখেছে, তারা নিজেরা যদি ঠিক করে, কিংবা বিমানবিহারী ও কল্যাণীর কাছ থেকে যদি কোনো প্রস্তাব আসে …তার আগে প্রতাপ নিজে থেকে মুখ ফুটে কিছুতেই কিছু বলবেন না।

বিমানবিহারী এইমাত্র বললেন, অলি আর বাবলু পিঠোপিঠি ভাই-বোনের মতন! তা হলে বোধ হয় বিমানবিহারীর চিন্তা অন্যরকম!

ভবানীপুরে পৌঁছে দোতলার ঘরেই দেখতে পাওয়া গেল অলিকে। ছুটির দিনেও সে অফিস ঘরে বসে পাণ্ডুলিপি সংশোধন করছে। টেবিলের ওপর অনেক কাগজপত্র ছড়ানো, অলির হাতে একটা পুরোনো আমলের গেরুয়া রঙের মোটা পার্কার কলম।

বাবলু এখানে নেই। আজ সে এ বাড়িতে আসেনি।

বিমানবিহারী বললেন, অলি, আমাদের জন্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করবি? জগদীশটা বোধ হয় ঘুমোচ্ছে।

অলি উঠে যেতেই বিমানবিহারী বললেন, পঁড়াও, লালবাজারে একটা ফোন করি। ধরো, কোনো কারণে বাবলু যদি খেলার মাঠে ইনজিওরড় হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকে, ওদের কাছে নিশ্চয়ই লিস্ট থাকবে!

প্রতাপ বললেন, না, না, তার দরকার নেই। এত ব্যস্ত হবার কোনো মানে হয় না। শক্ত সমর্থ ছেলে …খেলার মাঠে গিয়ে থাকলেও সে নিশ্চয়ই একা যায়নি, কিছু একটা হয়ে থাকলে অন্য কেউ না কেউ নিশ্চয়ই খবর দিত।

বিমানবিহারী তবু লালবাজারে তার পরিচিত ডি সি ডি ডি ওয়ান-কে ফোন করলেন, কিন্তু কোনো সুবিধে হলো না, ছুটির দিনে ডি সি ডি ডি নেই অফিসে, এমার্জেন্সি সেল থেকেও হতাহতদের লিস্ট দিতে পারলো না, এখনও তাদের হাতে আসেনি।

বিমানবিহারী ফোন রেখে দিয়ে বললেন, দাঁড়াও, চা-টা খেয়ে নিই, তারপর পি জি হাসপাতালে যাওয়া যাবে, কাছেই তো, ওখানেই প্রথমে নিয়ে আসবে, কিংবা মেডিক্যাল কলেজে …

প্রতাপ এবারে প্রবল আপত্তি করলেন, বিমানবিহারীকে তিনি আর মোটেই ব্যতিব্যস্ত করতে চান না, বিমানবিহারী পেট্রল পুড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ঘুরবেন সারা কলকাতা, এরও কোনো মানে হয় না। পেট্রলের দামও তো কম না!

প্রতাপ বললেন, হয়তো আমরা বাড়াবাড়ি করছি, এতক্ষণে বাবলু বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুমোচ্ছে। আগে আমি একবার বাড়ি যাই, বুঝলে, যদি দেখি সন্ধের মধ্যেও ফিরলো না, তারপর না হয় তোমাকে আবার খবর দেবো …তুমি এর মধ্যে অলিকে কিছু বলল না, ও বেচারি শুধু শুধু চিন্তা করবে…

চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লেন প্রতাপ।

বিমানবিহারী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও তার গাড়ি ব্যবহার করতে খুবই লজ্জা বোধ করছিলেন তিনি। টাকা পয়সার ব্যাপারটা কিছুতেই ভোলা যায় না। ল কলেজে পড়ার সময় যখন বিমানবিহারীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়, তখন প্রতাপদের অবস্থা বেশি সচ্ছল ছিল। বিমানবিহারীদের কৃষ্ণনগরের বাড়ির চেয়ে মালখানগরে প্রতাপদের বাড়ি ছিল অনেক বড়, ছাত্র বয়েসে প্রতাপ বেশ ভালো টাকা হাতখরচ পেতেন, বন্ধুদের চপ কাটলেট খাওয়াতেন ফারপো হোটেলে। আজ বিমানবিহারীকে তেলাপিয়া মাছ খাওয়াতে হলো।

বাড়ি ফিরে যদি দেখা যায়, বাবলু এখনও খেতে আসেনি, তা হলে মমতা সুপ্রীতিকে কী সান্ত্বনা দেবেন প্রতাপ? তিনি নিজে খুব একটা উদ্বেগ বোধ করছেন না। খেলার মাঠে গেলে বাবলু সেকথা নিশ্চয়ই বলে যেত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে এই খেলা দেখার জন্য সারা কলকাতা পাগল হয়ে উঠেছিল, টিকিট ব্ল্যাক হয়েছে, সেই খেলার টিকিট জোগাড় করতে পারলে বাবলু কি সে কথা বাড়িতে জানাতো না? আজ দুপুরে খেতে আসতে পারেনি, নিশ্চয়ই কোথাও আটকে গেছে, কোনো বন্ধুর বাড়িতে জোর করে খেয়ে নিতে বলেছে, টেলিফোন তো নেই যে খবর দেবে!

মমতা বা সুপ্রীতি এইসব যুক্তি মানতে চাইবে না। বাবলুর আড়ালে ছায়া হয়ে দাঁড়াবে পিকলু। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। কত সামান্য, তুচ্ছ কারণে চিরকালের মতন হারিয়ে গেল পিকলুর মতন একটা প্রাণবন্ত ছেলে। এরকম দুর্ঘটনা তো ঘটে! আজ বেশি করে পিকলুর কথা মনে পড়বে আবার। বাবলুকে বাঁচাতে গিয়েই পিকলু চলে গেছে। বাবলু বোঝে না যে তার মায়ের কাছে তার দাদার অভাবটাও পূরণ করতে হবে তাকেই, তার দ্বিগুণ দায়িত্ব। ছেলেটার এই কাণ্ডজ্ঞান হলো না এ পর্যন্ত।

পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ মুছলেন প্রতাপ। নিজেই তিনি অবাক হলেন, পিকলুর কথা মনে পড়ায় হঠাৎ চোখে জল এসে গেল তাঁর, এত বছর পরেও? পুত্রস্নেহের টান এমন প্রবল হয়? তিনি কিন্তু পিকলুকে ভুলে যেতেই চান। যে চিরকালের মতন হারিয়ে গেছে, তার স্মৃতি আকড়ে ধরে রাখার কোনো মানে হয় না। মমতার আপত্তি সত্ত্বেও শয়নকক্ষ থেকে পিকলুর ছবি সরিয়ে রেখেছেন তিনি।

বাড়ির দিকে যেতে পা উঠছে না প্রতাপের। মমতা ও সুপ্রীতি একসঙ্গে কান্নাকাটি শুরু করলে তিনি সামলাবেন কী করে? বকাবকি করতে হবে। কিন্তু আর কোথায়ই বা বাবলুর ঘেঁজে তিনি যাবেন এখন? হাসপাতালে যাওয়ার একেবারেই প্রবৃত্তি নেই তার।

প্রতাপ যে বাসে উঠলেন, সেই বাসেই বসে আছে বাবলু। সঙ্গে দু’জন বন্ধু। তাদের মধ্যে। কৌশিক নেই, পেছনদিকের লম্বা টানা সিটটায় বসে বাবলু তাদের সঙ্গে গল্পে মত্ত। বাবলু নিজে থেকেই বাবাকে দেখতে না পেলে প্রতাপ ছেলের সঙ্গে তখুনি কথা বলতেন না। দুশ্চিন্তার অবসান হলেই মন সবসময় ফুর্তিতে ভরে ওঠে না। অনেক সময় তীব্র রাগ হয়। প্রতাপ ঠিক করলেন, বাবলু বাড়ির স্টপে নামে কিনা সেটা তিনি আগে লক্ষ করবেন। কিন্তু বাসে বেশি ভিড় নেই, বাবলু তাঁকে দেখতে পেয়েছে।

গল্প থামিয়ে অবাকভাবে বাবলু জিজ্ঞেস করলো, বাবা, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

প্রতাপ উদাসীনভাবে বললেন, এই এদিকে, বিমানদের বাড়িতে।

বাবলুর দুই বন্ধু তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মেসোমশাই, আপনি এখানে এসে বসুন।

বাবলুও উঠে দাঁড়িয়েছে, প্রতাপ বুঝলেন, আপত্তি করে লাভ নেই, ছেলের বন্ধুরা তাকে পঁড়িয়ে থাকতে দেবে না, যদিও বাড়ি বেশি দূরে নয়।

প্রতাপ বসলেন, বাকি জায়গাটাতে অন্য দুই বন্ধুও বসলো, বাবলুই পঁড়িয়ে রইলো। বাবলু পরিচয় করিয়ে দিল, তার দুই বন্ধুর নাম অলোক আর সিদ্ধার্থ। অলোক তাকে মেলোমশাই বলে ডেকেছে, সিদ্ধার্থ বললো, কাকাবাবু, আজ খেলার মাঠে কী কাণ্ড হয়েছে শুনেছেন? …গারফিল্ড সোবার্স ময়দান দিয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়েছে, হেল্প হেল্প! আর রোহন কানহাই নাকি ভয়ের চোটে গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল!

প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা খেলা দেখতে গিয়েছিলে?

সিদ্ধার্থ আর অলোক দু’জনেই শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ওরা টিকিট পায়নি, ওদের হস্টেলের কয়েকটি ছেলে গিয়েছিল রঞ্জি স্টেডিয়ামে, তাদের মধ্যে একজনের হাত ভেঙেছে, একজনের কাঁধের ওপরে এসে পড়েছে টিয়ার গ্যাসের সেল … ওরাও পুলিশের কয়েকজনকে শুইয়ে দিয়েছে মাটিতে …

বাড়ির কাছাকাছি এসে প্রতাপ উঠে দাঁড়ালেন। বাবলু যদি নামতে না চায় তিনি কিছু বলবেন না। বাড়িতে গিয়ে বাবলুর খবরটা দিলেই তো হলো। ছেলের যদি বাড়ি ফেরার মন না থাকে, তিনি জোর করতে যাবেন কেন?

বাবলুও নামলো প্রতাপের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু বাবার পাশাপাশি না হেঁটে সে রইলো এক পা পিছিয়ে। রাস্তার লোক দেখে ভাববে, ওরা দু’জন অচেনা মানুষ, আলাদা পথচারী।

একটু পরে বাবলু মৃদুগলায় বললো, বাবা, আমি শিলিগুড়ি কলেজে একটা লেকচারারের পোস্টের অফার পেয়েছি। নেবো?

প্রতাপ মুখ ফিরিয়ে বললেন, কলেজে পড়ানোর চাকরি? তুই পি এইচ ডি করবি না?

–চাকরি পাওয়া এখন দারুণ শক্ত ব্যাপার। এটা পাচ্ছি যখন …পি-এইচ ডি পরেও করা যায়!

–মফস্বলের চাকরি, তুই পারবি?

–আমার নর্থ বেঙ্গল খুব ভালো লাগে। এই যে আমার বন্ধু সিদ্ধার্থ, ওর দাদা ঐ কলেজের প্রিন্সিপাল, কেমিস্ট্রির একটা পোস্ট খালি হয়েছে …এই রকম চান্স সহজে পাওয়া যায় না

–চাকরিই যদি করতে হয়, তা হলে কলকাতায় চেষ্টা করা যেতে পারে, তোর বিমানকাকা বলছিল বেঙ্গল কেমিক্যালের কথা …তুই কলেজে পড়াতে পারবি?

–চেষ্টা করে দেখি অন্তত কয়েক মাস। ভালো না লাগলে ছেড়ে দেবো।

–তোর মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে দ্যাখ।

–সকালে শিবপুরে চলে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম দুপুরের আগেই ফিরবো …ওদের হস্টেলে আজ খিচুড়ি আর ফ্রায়েড প্রণ হয়েছিল, ওরা জোর করে ধরে রাখলো, না খাইয়ে ছাড়লো না, এমন চমৎকার খিচুড়ি হয়েছিল, অনেকদিন এরকম খাইনি …ওদের রুটি খেতে হয় না, ওদের হস্টেলের জন্য চালের কোটা আছে। নর্থ বেঙ্গলেও শুনলুম চাল পাওয়া যায়।

প্রতাপ আর কোনো মন্তব্য করলেন না। বাড়ির মধ্যে ঢুকে রান্না ঘরের দিকে এক পলক দৃষ্টি দিয়েই তিনি বুঝলেন, মমতা এবং সুপ্রীতি এখনো না খেয়ে রয়েছেন। বাবলু ঢুকে গেল বাথরুমে।

প্রতাপ শোওয়ার ঘরে আসতেই মমতা বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, বাবলু? বাবলু কোথায়?

প্রতাপ ধীর স্বরে বললেন, তোমার ছেলে ফিরে এসেছে।

মমতার কপালটা ফর্সা হয়ে গেল, চোখে জ্বলে উঠলো আলো। কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠলো কৃতজ্ঞতা। তিনি এগিয়ে এসে স্বামীর হাত ধরে বললেন, তুমি বাবলুকে খুঁজে আনলে? কোথায় ছিল? কৌশিকদের বাড়িতে যেতে তো এতক্ষণ লাগে না…

প্রতাপ বললেন, না, আমি খুঁজে আনিনি। ও বাড়িতেই ফিরছিল, আমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলো।

মমতার মুখের দিকে বেশ কয়েক পলক স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলেন প্রতাপ। তারপর মিনতি মাখা কণ্ঠে বললেন, আমি যে ওকে খুঁজতে গিয়েছিলাম, সে কথা ওকে বলবার দরকার নেই। বলো না কিন্তু। বলো না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *