পর পর তিনবার সিটি দিয়ে থেমে গেল ট্রেনটা। সেই তীক্ষ্ণ শব্দ যেন মিশমিশে অন্ধকারের মধ্যে আর্তনাদের মতন শোনায়। এই অঞ্চলটায় কোনো বসতি নেই, ট্রেন লাইনের একদিকে ফসল কাটা মাঠ, অন্যদিকে জলা। ইঞ্জিনের জোরালো আলোয় দেখা যাচ্ছে যে দুশো আড়াইশো গজ দূরে লাইনের ওপর সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে মানুষের মতন একটা মূর্তি শুয়ে আছে। তা দেখেই ব্রেক কষেছে ইঞ্জিন ড্রাইভার।
ট্রেনটা থামা মাত্র লাইনের দু’পাশ থেকে উঠে এলো সাত আটটি ছায়া মূর্তি। বজবজ থেকে, আসছে এই মালগাড়ি, কোন্ বগিতে কোন্ মাল আছে, তাও যেন এই ছায়ামূর্তিরা আগে থেকেই জানে। টর্চ জ্বেলে দেখে নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো একই বগিতে। তালা ভাঙতে আধ মিনিটও সময় লাগলো না।
ট্রেনের সামনে এবং পেছন থেকে ড্রাইভার ও গার্ড উঁকি মেরে দেখলো। কী ব্যাপার ঘটছে তা বুঝতে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়, আজ রবিবার, যে-কোনো কারণেই হোক, রবিবার রাতেই এই সব বেশি ঘটে। সশস্ত্র ডাকাতদের প্রতিরোধ করার দায়িত্ব গার্ড বা ইঞ্জিন ড্রাইভারের নয়, গার্ডসাহেব তাঁর লগ বুক খুললেন।
ধুপ ধুপ করে চিনির বস্তাগুলো পড়তে লাগলো মাঠে। সুচরিত তার দলের লোকদের ঠিক দশ মিনিট সময় দিয়েছে। মুঙ্গি, ইয়াসিন, লেটো, পন্টুরা এত দ্রুত হাত চালাচ্ছে যে ততখানি তৎপরতার সঙ্গে ভারতের কোনো কলকারখানায় শ্রমিক কাজ করতে জানে না। অনেকের ধারণা ভারতীয়রা অলস, এই মুহূর্তে এসে তারা সুচরিতের দলটাকে দেখুক তো!
সুচরিত নিজে হাত লাগায় না। তার এক হাতে একটা হুইল, সে সিগারেট টানছে উত্তেজিত ভাবে। এই ট্রেনে কোনো আর্মড গার্ড নেই, সে খবর নেওয়া আছে আগে থেকে, একটাও প্যাসেঞ্জার কামরা নেই, কোনো দিক থেকেই বাধা আসবার সম্ভাবনা নেই, তবু বলা যায় না, এক একদিন পুলিশ হঠাৎ কেরানি দেখাবার জন্য ঠিক সময় হাজির হয় অন্ধকার কুঁড়ে, কাগজে নিজেদের বীরত্বের কাহিনী ছাপাবার জন্য সেদিন তারা গুলি চালায়। পুলিশের মতন এমন নিমকহারাম প্রাণী সুচরিত আর দ্বিতীয় দেখেনি, এরা টাকাও খাবে, আবার মর্জি মতন এক একদিন গুলিও চালাবে।
ইঞ্জিনটার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সুচরিত। ইঞ্জিন ড্রাইভার সম্ভবত তাকে দেখতেও পাচ্ছে, তাতে কিছু যায় আসে না। ঠিক দশ মিনিট পার হতেই সে গার্ড সাহেবের ভঙ্গিতে লম্বা করে হুইল বাজালো। কাজ শেষ, সে এখন ট্রেন ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। লাইনের ওপর সাদা কাপড় জড়ানো মূর্তিটা সরে গেল এই মুহূর্তে, ইঞ্জিন ড্রাইভার আবার সিটি দিল নিয়মমাফিক।
পরিষ্কার কাজ, কোনো ত্রুটি নেই। রেলের লোকেরা সাধারণত পয়সা পেলে বিশ্বাসঘাতকতা করে না। যে-ট্রেন লুঠ হবে, সে-ট্রেন কোনো দিন এক মিনিটও লেট করে আসে না। লুষ্ঠিত হবার জন্য তার ব্যাকুলতা অতি নিখুঁত। এখন ঠিক দশটা পঁচিশ।
মাঠের মধ্যে অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একটি ট্রাক। বস্তাগুলো এবার ট্রাকে ওঠাতে হবে। চিনির দাম এখন সোনার মতন। খোলা বাজারে চিনি উধাও, কন্ট্রোলেও সরকার চিনি দিতে পারছে না। অধিকাংশ র্যাশান শপেই চিনি নেই, মিষ্টির দোকানগুলো বন্ধ হবার উপক্রম। বিয়ে বাড়িতে মিষ্টি খাওয়াবার জন্যও সরকারের কাছে পারমিট চাইতে হয়, তার জন্যও কত ধরাধরি।
বস্তাগুলো লোডিং হচ্ছে অতি সাবলীল দ্রুততার সঙ্গে। সুচরিত অনবরত মাথা ঘোরাচ্ছে এদিক-ওদিক। কোথাও কোনো আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে কি না। তার মাথার মধ্যে একটাই কথা ঘুরছে, পুলিশকে বিশ্বাস নেই, পুলিশকে বিশ্বাস নেই!
কয়েকটা বস্তা তোলা তখনও বাকি, ছায়ামূর্তিগুলির মধ্য থেকে একজন সুচরিতের কাছে এগিয়ে এসে বললো, ওস্তাদ, একটা কথা আছে।
কিছুদিন আগেও সঙ্গীসাথীরা সুচরিতকে শুধু ল্যাঙা বলে ডাকতো। খিদিরপুরের কেসটার পর সে ওস্তাদ হয়েছে। এমনি এমনি দলপতি হওয়া যায় না, তার জন্য মুরোদ লাগে। আর এ লাইনের শ্রেষ্ঠ মুরোদ হচ্ছে ধরা পড়ার পরেও পালাবার ক্ষমতা দেখানো। সেবার ওদের কাজটা ছোটই ছিল, ডক এরিয়া থেকে এক পেটি রিস্টওয়াচ ডেলিভারি আনা। পেটিটা জাহাজ থেকে নামিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবে একজন, সুচরিত আর তার দু’জন সঙ্গী শুধু পেটিটা ডক এরিয়া পার করে আর এক জায়গায় পৌঁছে দেবে। এমন কিছুই না। কিন্তু তিন নম্বর গেটের কাছাকাছি হঠাৎ তিনজন আর্মড গার্ড ওদের ঘিরে ধরলো, বন্দুক উঁচিয়ে বললো, হল্ট! তখন আর কোনো উপায় নেই, হল্ট বলার আগেই যে গুলি চালায়নি, সেই ওদের বাপের ভাগ্য, এবার ভাগ্যে আছে জেলের খিচুড়ি। একজন গার্ড মুঙ্গির পেটে অকারণে কষালো একটা লাথি, ঠিক সেই মুহূর্তে সুচরিত একটা পেটো ঝাড়লো অন্য একজনের ঠিক বুকের ওপর। শুধু তার হাতেই ছিল বন্দুক। লোকটা মরবার আগে গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বার করতে পারেনি। সুচরিতের সেটাই প্রথম খুন এবং নিখুঁত খুন। তিনজন গার্ডকে এক লাইনে রেখেছিল সে। অন্য দু’জন এগিয়ে আসার সময় পায়নি।
পালাবার সময় সুচরিত রিস্টওয়াচের পেটিটাও ফেলে আসেনি। খোঁড়া পায়ে সুচরিত ঠিক মতন দৌড়োতে পারে না, সে ক্যাঙারুর মতন লাফায়, সাঙ্ঘাতিক তার দম, দেড় দু’ মাইল ওরকম একটানা লাফিয়ে চলে আসতে পারে। সে রাতে আলিপুরের আখড়ায় মুঙ্গিরা। সুচরিতকে কাঁধে করে নেচেছিল, মদ খেয়ে চুরচুর মাতাল হয়েছিল এবং তখন থেকেই ওস্তাদ খেতাব দেওয়া হয়েছিল তাকে।
এ-লাইনে একটা অলিখিত নিয়ম আছে, যতই মাথা গরম হোক আর যতই ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকুক, কিন্তু পুলিশের গায়ে হাত দেওয়া চলবে না। পুলিশ বাহিনী নিজ পরিবারের প্রতি অতি বিশ্বস্ত। সামান্য একজন কনস্টেবলের মৃত্যুও পুলিশ বাহিনী সহ্য করে না। পুলিশকে যে মারবে তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই। পুলিশ এমনিতে চোর-ডাকাত-ছিনতাইবাজ-ওয়াগন ব্রেকার ইত্যাদি সকলেরই মোটামুটি সুলুক সন্ধান জানে, কাকে কখন ধরবে বা ধরবে না, সে ব্যাপারে তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে, ওপর থেকে চাপ আছে, কিংবা ধরা-ছাড়ার মধ্যে নানা রকম চুক্তি করা যায়। কিন্তু কোনোক্রমেই কোনো পুলিশের খুন সহ্য করা হবে না, পুলিশকে মেরে এ-লাইনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, এরকম একজনকেও দেখা যাবে না।
সুচরিত তা জানতো এবং সেই রাতেই সে ঠিক করেছিল, এ লাইন থেকে চিরবিদায় নেবে। কিন্তু তার ভাগ্য ভালো, যাকে সে খুন করেছিল, সে পুলিশ নয়, কোনো একটি কোম্পানির গার্ড, পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, সুতরাং তার খুন নিয়ে পুলিশ বাহিনী বিশেষ মাথা ঘামায়নি। শুধু ডক এরিয়া ছাড়তে হয়েছে সুচরিতকে। বাল্লুর ডাক শুনে সুচরিত চমকে উঠে বললো, কী রে?
এই বাল্লু সুচরিতের চেয়ে বছর চারেকের বড়, মাথায় তারই সমান ঢ্যাঙা, একটা চোখ ট্যারা। সে বললো, ওস্তাদ, যাবার পথে দশটা বস্তা গড়িয়ায় কিষেণচাঁদের গোডাউনে নামিয়ে দিয়ে যেতে হবে।
সুচরিত ভুরু বাঁকিয়ে বললো, কেন? কিষেণচাঁদের সঙ্গে তো কোনো কনট্রাক্ট নেই।
বাল্লু বললো, কিষেণচাঁদ খুব করে ধরেছে। গড়িয়া-সোনারপুরের দিকে একদানা চিনি নেই। যা খুশী দাম পাওয়া যাচ্ছে।
যা ভাগ। বস্তাগুলো তোল জলদি। আমি কথার খেলাপ করি না। পুরো ডেলিভারি দমদমে যাবে।
এক ওয়াগনে কতগুলো বস্তা থাকবে তার কি কোনো ঠিক ছিল? দশটা বস্তা কম থাকতে পারে না!
কিষেণচাঁদকে বলবি, আসছে হপ্তায় দেখা যাবে!
শোনো ওস্তাদ, শোনো…
ওঠ ওঠ, আগে লরিতে ওঠ!
দলপতি হিসেবে ট্রাক ড্রাইভারের পাশেই সুচরিতের বসবার কথা। কিন্তু সুচরিত এসে পেছন দিকে তার দলবলের সঙ্গে বস্তাগুলোর ওপরেই বসলো। অসহ্য গুমোটের রাত। এখানে বসলে তবু একটু আরাম পাওয়া যায়। আকাশে জমাট মেঘ, এক একবার একটু-একটু চাঁদের আলো ছিটকে আসছে।
চলন্ত ট্রাকে কেউ কোনো কথা বলছে না। এ কাজে দারুণ উৎকণ্ঠা থাকে, পরিশ্রমও প্রচুর, যতক্ষণ কাজ চলে ততক্ষণ অন্য কোনো বোধ থাকে না, তার পরেই খুব অবসন্ন লাগে। এখন মাল টানার জন্য গলা সকসক করছে সবার, কিন্তু সঙ্গে কিছু নেই। একটা বস্তা ফুটো হয়ে গেছে, তার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে ছাদাটাকে বড় করে নিয়ে, চিনি বার করে করে খাচ্ছে মুঙ্গি আর লেটো।
মাঠের মধ্য দিয়েই অনেকটা যাবার পর ট্রাকটা একটা রাস্তায় উঠলো। একটা কোনো কারখানায় অনেক আলো জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে লেটো বলল, এ আবার কোন দিকে যাচ্ছে?
বাল্লু সুচরিতের দিকে তাকিয়ে বললো, ওস্তাদ, ড্রাইভারকে আমার বলা ছেল, একবার গড়িয়ায় ঘুরে যাবে।
দু’তিনজন অবাক হয়ে একসঙ্গে বললো, গড়িয়া? কেন?
সুচরিত প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে বললো, এই শালা বাল্লুটা মহা এটেলবাজ! বারণ করলাম, তাও শুনলো না! ওর কোন পেয়ারের নাগরকে চিনি খাওয়াবে।
বাল্লু বললো, আমি কিষেণচাঁদকে কথা দিইছি, কিছু না দিতে পারলে আমার প্রেস্টিজ পাংকচার হয়ে যাবে। মালকড়ি ভালো ছাড়বে!
মুঙ্গি বললো, কিন্তু ওস্তাদ, ভাটিয়ার কাছে আমাদের কথার খেলাপ হয়ে যাবে না? ওকে পুরো ডেলিভারি দেবার কথা। এই বাল্লু, হারামি, তুই কিষেণচাঁদের সঙ্গে সিঙ্গল সিঙ্গল কথা বলতে গেলি কেন?
বাল্লু তরপে উঠে বললো, বেশ করিছি! বেশ করিছি! আমার হক আছে।
সুচরিত হাত তুলে বললো, আঃ, ঝগড়া করছিস কেন? যাক গে, বাল্লু বলেছে যখন, দশটা বস্তা নামিয়ে দেবো। কিরে বাল্লু, নগদা দেবে তো?
বাল্লু বললো, হাতে হাতে।
সুচরিত তার কাঁধ চাপড়ে বললো, ঠিক আছে! দে, একটা সিগ্রেট ছাড় তো।
কারখানাটা পার হয়ে যাবার পর রাস্তাটা আবার ফাঁকা। একেবারে শুনশান। একটা সাইকেল রিকশাও চলছে না। রাস্তার ধারে ধারে এদো পুকুর, এখন একটু জ্যোৎস্না পড়ে চকচক করছে জল।
সুচরিত বসে আছে ড্রাইভারের ঠিক পেছন দিকটায়। এবারে সে মুখ ঝুঁকিয়ে বললো, গাড়িটা একটু শ্লো করো তো, আমি একটু হিসি করতে নামবো।
লেটো বললো, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ছেড়ে দাও না!
সুচরিত বললো, নাঃ, নামতে হবে। কী রে বাল্লু, তুই যাবি?
আমার পায়নি কো, তুমি যাও ওস্তাদ!
সেটাই বাল্লুর ইহজীবনের শেষ কথা। সুচরিত হঠাৎ জ্বলন্ত সিগারেটটা চেপে ধরলো বাল্লুর গালে। আচমকা যন্ত্রণায় সে আর্তনাদ করে উঠতেই সুচরিত তার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে বললো, কুত্তার বাচ্চা, আমার কথার ওপর কথা! এত সাহস তোর…
কথা বলতে বলতেই সুচরিত বাল্লুর পেটে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। পুরো বাঁ দিক থেকে ডান দিক। চুলের মুঠি ধরেই বাল্লুর মাথাটা বাইরের দিকে নিয়ে এসে গলাটা চেপে ধরলো ট্রাকের এক পাশের কাঠের দেয়ালে। অর্ধেক বলি দেওয়া পাঁঠার মতন ছটফট করতে করতে বিকট চ্যাঁচাতে লাগলো বাল্লু, তবে দু’তিনবার মাত্র, তার মধ্যেই সুচরিত শেষ করে দিল তাকে।
একটা পা খোঁড়া বলেই বোধ হয় সুচরিতের হাত দুটোয় সাংঘাতিক জোর। সে এবার বাল্লর নিথর শরীরটা উঁচু করে তুলে ছুঁড়ে দিল রাস্তার ধারে। তারপর ট্রাক ড্রাইভারকে বললো, চালাবি? না তুইও ঝাড় খাবি? সোজা দমদম!
অন্যরা চুপ করে বসে আছে, বাল্লুকে সাহায্য করবার জন্য কেউ একটা আঙুলও তোলেনি। কয়েক মিনিট আগে সুচরিত বাল্লুর সঙ্গে হেসে কথা বলছিল, তার কাছে সিগারেট চাইলো, তারপরেই সে ছুরিটা চালিয়ে দিল। সুচরিতের এই বিচিত্র মেজাজটাকেই ওরা ভয় পায়।
সুচরিতের অনুমতি ছাড়াই ট্রাক ড্রাইভারকে গড়িয়ায় যাওয়ার নির্দেশের কথা বাল্লু যেই উচ্চারণ করেছে, সেই মুহূর্তেই সুচরিত মনে মনে তার মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এরকম অবাধ্যতার প্রশ্রয় দিলে দল চালানো যায় না। অন্যরা একটু আগে তাকে হাসতে দেখলেও আসলে সুচরিতের রাগ বড্ড বেশি, যখন তখন চড়াৎ করে চড়ে যায়। বাল্লুকে খতম করার জন্য তার আর একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল। এই রকম ভাবে রাস্তার ওপর, ট্রাক থামিয়ে, রাতও এমন কিছু বেশি নয়, পেটে ছুরি খেলে খানিকটা চ্যাঁচাবেই…কিন্তু সুচরিত আর ধৈর্য রাখতে পারলো না। অবশ্য এইসব রাস্তায় রাত এগারোটাতেই কারুর মৃত্যু আর্তনাদ শুনলেও অন্য কেউ কৌতূহলী হয়ে দেখতে আসবে না।
দুটো চিনির বস্তার ওপর অনেকখানি রক্ত পড়েছে। ভেতরের কিছু চিনি ডেলা পাকিয়ে যাবে। অনেক চিনির সঙ্গে মিশে গেলে তেমন কিছু বোঝা যাবে না, ওরকম কিছু কিছু ডেলা তো থাকেই। এখন চিনি যা আক্রা, এক দানা কেউ ফেলতে চায় না। হয়তো এই চিনি দিয়েই কোনো বিয়ে বাড়িতে তৈরি হবে সন্দেশ-রসগোল্লা, যারা খাবে, তারা কিছু টেরও পাবে না।
ঘামে ভিজে গেছে সুচরিতের সারা গা। এখনও সে ঘামছে গলগল করে। গায়ের জামাটা সে খুলে ফেলে সেটা মুঙ্গির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, যতটা পারিস রক্তটা মুছে ফ্যাল তো এটা দিয়ে!
মুঙ্গির পাশে বসে আছে ইয়াসিন। বাল্লুই তাকে অন্য দল থেকে ছাড়িয়ে এ দলে এনেছে। সে বললো, তুমি ঠিক করেছো, ওস্তাদ! ও শালা অনেকদিন ধরেই তোমার সঙ্গে টক্কর দিচ্ছিল। তুমি কিছু না বললে একদিন আমিই ওকে ঝাড়তুম!
লেটো বললো, গড়িয়ার ঐ কিষেণচাঁদ কী রকম মাল আমি জানি। ওখানে গেলে পুরো ট্রাক হাপিস করে দিত।
তারপর সবাই বললো কিছু না কিছু। এসব হচ্ছে সুচরিতের প্রতি আনুগত্যের শপথ। অবশ্য এটা শুধু আজ রাতের জন্য, কাল রাতেই ওদের মধ্যে কেউ আবার বদলে যেতে পারে।
মাসখানেক গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হলো সুচরিতকে। বাল্লুর একটা ভাইও যে এ-লাইনে আছে, তা আগে কোনোদিন জানা যায়নি। সেই কালু নাকি বদলা নেবার জন্য সুচরিতকে খুঁজছে। দুই ভাইতে ভাব ছিল না মোটেই, ভাব থাকলে তো দু’ভাই মিলে একসঙ্গেই কাজ করতো। একটি রক্ষিতাকে নিয়েই নাকি দুই ভাইয়ে ঝগড়া। কিন্তু এখন বাল্লুর মৃত্যুর পর কালু যদি বদলা নেবার চেষ্টা না করে, তা হলে তার সাকরেদদের কাছে মান থাকে না।
এই সব খবর সুচরিত শুনলো ইয়াসিনের কাছ থেকে। লেকের আস্তানা আগেই ছেড়েছে সুচরিত, এবারে সে ঘাঁটি গাড়লো রাজাবাজারে। এর আগেও একবার তার অভিজ্ঞতা হয়েছে, আত্মগোপন করার জন্য মুসলমান বস্তিই সবচেয়ে ভালো জায়গা। মুসলমান বস্তির খুব ভেতরে পুলিশও ঢুকতে চায় না, হিন্দু গুণ্ডারাও এদিকে এসে হামলা করতে সাহস পায় না, তাতে যখন তখন কমিউনাল রায়টের রূপ নিতে পারে। খাঁটি লাইনের লোকেরা ঐ সব উটকো ঝামেলা এড়িয়ে চলে।
ইয়াসিন তাকে একটা ঘর জোগাড় করে দিয়েছে। এখানে সুচরিতের নাম আবু শেখ। মাসখানেকের মধ্যেই মুখে বেশ দাড়ি গজিয়ে গেছে তার। এই রকম সময়ে দাড়ি রাখাই নিয়ম। পুলিশের দিক থেকে সুচরিতের কোনো ভয় নেই। পুলিশের সঙ্গে বাল্লুর তেমন কিছু আশনাই ছিল না। বাল্লুকে কে মেরেছে, ওদিককার পুলিশ তা জানে, বাল্লুর হত্যাকারীকে যে কালু খুঁজছে তাও তাদের অজানা নয়, এই সব গল্প তাদের কাছে খুব মুখরোচক। বাল্লু খুন হয়েছে বেঙ্গল পুলিশের এরিয়ায়, ক্যালকাটা পুলিশ তা নিয়ে একটুও মাথা ঘামাবে ন। তাদের অন্য কত কাজ আছে।
এই রাজাবাজারের বস্তিতে ইয়াসিন ছাড়াও বজলু আলি নামে আর একজনকে আগে থেকেই চেনে সুচরিত। বজলুর বয়েস বছর তিরিশেক, সে সংসারী মানুষ, তার ঘরে বিবি ও বালবাচ্চা আছে, তার একটা প্রকাশ্য চাকরিও আছে এক দর্জির দোকানে। কিন্তু বজলু খুব গোপনে মেয়ে চালান দেবার কাজ করে। মুর্শিদাবাদের গ্রাম থেকে মেয়ে এনে সোনাগাছির দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। বছর দু’এক আগে মুঙ্গির মারফৎ বজলু এসেছিল তার কাজে সহযোগিতার একটা প্রস্তাব নিয়ে। অনেক ভেবেচিন্তে সুচরিত শেষপর্যন্ত রাজি হয়নি। ও লাইনে লাভ খুব কম। একটা মেয়ের দাম মাত্র আড়াই শো, তিনশো টাকা। বোম্বাই নিয়ে গিয়ে বেচতে পারলে পাঁচশো সাতশো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মাঝখানে খরচখচা আছে।’
সুচরিতকে চিনতে পেরেও বজলু কারুর কাছে মুখ খুললো না, বরং নিজের বাড়িতে একদিন সুচরিতকে দাওয়াত করে খাওয়ালো। একটা মাঠ কোঠায় দোতলায় থাকে বজলু, দর্জির দোকানের কর্মচারি হলেও তার ঘরে রেডিও আছে, খাঁটিয়ার ওপর বেশ বাহারী ফুলছাপ দেওয়া একটা চাঁদর। বেশ খাতিরযত্ন করলো সে সুচরিতকে। তার এই অতিথি বড় গোস্ত খাবে না ভেবে সে নিজের একটি পোষা মুগাঁ জবাই করেছে। সুচরিত অবশ্য সবই খায়।
বজলুর বউকে দেখে সুচরিতের মাথা ঘুরে গেল। তার চেনা এক নারীর সঙ্গে এর মুখের দারুণ মিল। টানা টানা চোখ, চওড়া কপাল, বেশ সুন্দরী এই রেশমা। ঘরে এমন বউ থাকতেও, বজলু মেয়ে-চুরির কারবার চালিয়ে যেতে পারে? কিংবা, এই মেয়েটিকেও কোনো
জায়গা থেকে চুরি করে এনেই শাদী করেছে নাকি? একথা জিজ্ঞেস করা যায় না। কিন্তু রেশমাকে দেখে রীতিমতন কাতর হয়ে পড়লো সুচরিত। প্রথম দর্শনেই প্রেমের মতন। যদিও সে জানে, বজলুর পরিবারের দিকে সে হাত বাড়াতে পারবে না, বজলু তাকে শেষ করে দেবে। বজলু হয়তো তার মতন ছুরি চালাতে জানে না, কিন্তু চোখ দেখলেই বোঝা যায়, বজলু কাকের মতন ধূর্ত, তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়।
রেশমাকে দেখার পর থেকে সুচরিত নারীসঙ্গ কাতর হয়ে পড়লো। কিন্তু এখন কোথাও যাওয়া যাবে না। কালু এখন সবকটা বেশ্যাপল্লীতেই তাকে খুঁজে বেড়াবে। কালুকে একবার দেখা দরকার সুচরিতের, মানুষটার চেহারা ও চোখ মুখ না দেখলে তার ক্ষমতা ঠিক আন্দাজ করা যাবে না। এটা তো ঠিকই যে হয় কালু তাকে মারবে অথবা সে মারবে কালুকে। নিয়তি তাদের একদিন মুখোমুখি দাঁড় করাবেই। অবশ্য, কাল্লু অন্য কোনো লোকের হাতে বা পুলিশের হাতে এরমধ্যে খতম হয়ে যেতে পারে। যেমন, সুচরিতকেও যে-কোনো দিন ধরিয়ে দিতে পারে ইয়াসিন কিংবা বজলু। সুচরিত নিজে কাছে বিশেষ টাকাপয়সা রাখেনি, সেকথা সে জানিয়েও দিয়েছে ওদের দু’জনকে।
কতদিন আর এই একটা বস্তির মধ্যে চুপচাপ শুয়ে বসে কাটানো যায়? সুচরিত একটু একটু বাইরে বেরুতে চাইলে ইয়াসিন নিষেধ করে। বাজার খুব গরম। কালুর অনেক সাঙ্গপাঙ্গ আছে। কালু নাকি লাইনে রটিয়ে দিয়েছে যে ল্যাঙা ওস্তাদটার যে খোঁজ দিতে পারবে, তাকে সে পাঁচশো টাকা ইনাম দেবে। একথা শুনে সুচরিতের মনে হয়, পাঁচশো টাকার লোভে ইয়াসিনই তাকে ধরিয়ে দেবে না তো? এবার জায়গা বদল করতে হবে।
আরও একটা কারণে এই জায়গাটা ছাড়া দরকার। রেশমার চিন্তা তাকে পাগল করে দিচ্ছে। একদিন দুপুরে বজলুর অনুপস্থিতিতে সুচরিত তার বাড়ি গিয়েছিল, রেশমা বেশ সহজ ভাবে কথা বলে, তাকে বিরিয়ানি আর বুরহানি খাওয়ালো। সুচরিতের পাগলের মতন ইচ্ছে করছিল রেশমাকে জড়িয়ে ধরতে, অতি কষ্টে সে নিজেকে দমন করেছে।
দিনের বেলা আস্তে আস্তে বেরুতে শুরু করলো সুচরিত। কোনো কাজকর্ম না থাকলে তার শরীর নিশপিশ করে। কাজের চেয়েও তার বেশি প্রয়োজন আধিপত্য, তার অধীনে পাঁচ-সাত-দশজন লোক থাকবে, সে তাদের ওপর হুকুম চালাবে, এতেই তার বেশি আনন্দ। রাজাবাজারের বস্তিতে সে যেন ইয়াসিন আর বজলুর দয়ার ওপরে আছে। সে এখন একটু প্যাঁচে পড়েছে বলে বজলু আবার তাকে সেই প্রস্তাবটা দিয়েছিল। দুটো মাল নিয়ে যেতে হবে। বোম্বাই। বোম্বাইতে গেলে সুচরিত কিছুদিন নিরাপদে থাকতে পারবে। সুচরিত রাজি হয়নি।
বস্তির মোড়ে একটা ঘোড়ার গাড়ির স্ট্যান্ড। কিছু ঘোড়ার গাড়ি এখনও এই অঞ্চলেই টিকে আছে। এই মোড়ের মাথায় একজন সৌম্যদর্শন মুসলমান ভদ্রলোককে ঘিরে একটা ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে। একে ঘিরে এরকম ভিড় মাঝে মাঝেই দেখে সুচরিত। ভদ্রলোকটি সিল্কের লুঙ্গি ও সিল্কের পাঞ্জাবি পরে, মুখে কাঁচা পাকা দাড়ি, হাতের ঘড়ির ব্যান্ড ও চোখের চশমার ফ্রেম মনে হয় সোনার। সুচরিত কৌতূহলী হয়ে ভিড়ের মধ্যে উঁকি মেরে ভদ্রলোকের কথা শোনার চেষ্টা করলো। একটু শুনেই আগ্রহ চলে গেল তার। ভদ্রলোক ভোটের কথা বলছেন। পলিটিকসের লোক!
হাঁটতে হাঁটতে সুচরিত মানিকতলার কাছে খাল পেরিয়ে আরও খানিকটা চলে গেল এক দুপুরে। কিছুই ঘটলো না, কেউ তাকে পেছন দিক থেকে এসে জাপটে ধরলো না। দিনের আলোয় এসব অবাস্তব মনে হয়।
তার সাহস বেড়ে গেল, পরের দিন সে বাসে শ্যামবাজার এসে, সেখান থেকে বাস বদলে চলে এলো পাতিপুকুরে। সেখানে মহিলা আশ্রমটির সামনে দিয়ে দু’বার হেঁটে গেল আস্তে আস্তে, খুব ইচ্ছে হলো একবার ভেতরে ঢোকার, কিন্তু ঢুকলো না। একটু দূরে বড় রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসলো।
এই আশ্রমটি সুচরিত বছরখানেক আগেই আবিষ্কার করেছে। যাদের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান নেই, তারাই শহরটাকে ভালোভাবে চেনে। কলকাতা ও শহরতলির কোনো অলিগলিই সুচরিতের এখন চিনতে বাকি নেই। উল্টোডাঙ্গা-পাতিপুকুরেও দু’এক রাত্রে রেলের কাজ করতে হয়েছে তাকে, তখন সে অন্য দলের হয়ে কাজ করতো, প্রয়োজনে পালাবার রাস্তা ঠিকঠাক বুঝে নেবার জন্য সে দিনের বেলা এই সব দিকে অনেক ঘোরাঘুরি করে গেছে। তারই মধ্যে একদিন সে দেখেছিল চন্দ্রাকে।
চায়ের দোকানে বসে সুচরিত দেখলো, বাস থেকে নামলেন চন্দ্রার বাবা আনন্দমোহন। তিনি একবার এই দোকানের দিকে তাকালেন, সুচরিতের চোখে চোখও পড়ল, কোনো ভাবান্তর হল না। সুচরিতের চেহারার বদল হয়েছে অনেক, তাছাড়া এখন মুখভর্তি দাড়ি, চিনতে পারার প্রশ্নই ওঠে না। চন্দ্রাও কি তাকে চিনতে পারবে না?
পরপর তিনদিন ঐ চায়ের দোকানে বসে থাকার পর সুচরিত দেখতে পেল চন্দ্রাকে।
আশ্রমের লোহার গেট খুলে গেছে, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, গাড়িতে ওঠার আগে তিনি কথা বলছেন দু’তিনজনের সঙ্গে। গেরুয়া শাড়ি পরা, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। তাঁর গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে, সুচরিতের মনে হলো, এই ক’বছরে তিনি যেন আরও অনেক বেশী সুন্দরী হয়েছেন।
চুম্বক আকৃষ্টের মতন সুচরিত দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এসে, রাস্তা পার হয়ে অনেকটা কাছে। এসে দাঁড়ালো। চন্দ্রার পাশে ঐ যে একজন হাত-পা নেড়ে কথা বলছে, ও সেই মাস্টারটা না? কী যেন নাম ছিল, সুচরিতের মনে পড়ছে না। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রার মুখের
দিকে। চন্দ্রার ঠোঁটে মাখানো হাসি, ঠিক যেন অমৃত। চন্দ্রার মুখের সঙ্গে সত্যিই কিছুটা মিল আছে রেশমার। রেশমাকে দেখে সুচরিতের যে কামনা জেগেছিল, এখনও তার ছুটে গিয়ে চন্দ্রাকে জড়িয়ে ধরার সেরকম একটা অদম্য বাসনা হলো। ঐ হ্যাংলা মাস্টারটার পেটটা ছুরি দিয়ে ফাঁসিয়ে দিলে কেমন হয়?
চন্দ্রামা এবার গাড়িতে উঠলেন, সুচরিতের পাশ দিয়েই গাড়িটা বেরিয়ে গেল, সুচরিতের দিকে তিনি তাকালেনও না। সুচরিতের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে আশ্রম বাড়িটাকে দেখলো ভালো করে, মনে মনে ঠিক করলো, এখানে আবার আসতে হবে তাকে, একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে!
সেই রাতে ইয়াসিন একটা প্রস্তাব দিল তাকে। তাদের পাড়ায় যে সুদর্শন ব্যক্তিটি ভোটের কথা বলতে আসেন, তাঁর নাম আবদুল মান্নান। তিনি তাঁর হয়ে ভোটের কাজ করার জন্য কয়েকজন বিশেষ ধরনের লোক খুঁজছেন। তিনি এমন লোক চান, যারা কোনো কাজেই ভয় পায় না, দরকার হলে বিপক্ষ দলের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস যাদের কাছে।
সুচরিত প্রস্তাবটা উড়িয়ে দিল। সে মাথা নাড়িয়ে বললো, না, না, না, ওসব ফালতু ঝাটের মধ্যে আমি নেই। পলিটিকসের কাজ অতি ছ্যাঁচড়া কাজ, রোজগার মোটে দু’চার পয়সা, কিন্তু ওতে মার্কা মারা হয়ে যেতে হয়! পঞ্চাননতলার হাবু, সে আগে রেলের কাজ করতো, পলিটিকসের দলে ভিড়ে শুধুমুদু একদিন বোমা খেয়ে মরলো! ছাড় তো ওসব কথা!
ইয়াসিন বললো, তুমি বুঝছো না, ওস্তাদ! মান্নান সাহেব মালদার পার্টি, বসিরহাটের হাজার বিঘে জমির মালিক, ভালো পয়সা দেবে! আমাদের জন্য জিপ দেবে, সঙ্গে মাল ঝাল থাকবে, যেদিকে ইচ্ছে ঘোরাঘুরির অসুবিধে নেই। পার্টির ফ্ল্যাগ থাকলে পুলিশেও ধারে কাছে ঘেষবে না।
সুচরিত থমকে গিয়ে বললো, জিপ থাকবে?
একটা জিপের প্রতি তার খুব লোভ। কিছুদিন ধরেই সে ভাবছে একটা জিপ জোগাড় করার কথা। নিজে একটা জিপ চালিয়ে হাওয়ার মতন উড়িয়ে যেখানে খুশী যাবে, ব্যারাকপুর, আসানসোল, ধানবাদ…এইসব ভালো ভালো জায়গা। একটা জিপ থাকলে সে কাল্লুকে পরোয়া করতো?
ইয়াসিন বললো, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য জিপ দেবে বলেছে, মান্নান সাহেবের গাড়ির পেছু পেছু থাকতে হবে আমাদেরকে, বুঝলে না, যদি কেউ অ্যাটাক করে, আমরা সামাল দেবো! তুমি রাজি হয়ে যাও, ওস্তাদ, কতদিন ঘরে বসে থাকবে? মান্নান সাহেবকে আমি তোমার কথা বলেছি, সাহেব বল্লেন কি, রেজাল্ট বেরুবার পর উনি কালুব্যাটাকে লালবাজারে ভরে দেবেন। ব্যস, তোমার কাম ফতে!
জিপের কথা শুনেই সুচরিতের মনটা নরম হয়ে গিয়েছিল, আরও কিছুক্ষণ আলোচনা করার পর সে রাজি হয়ে গেল। সে খোঁড়া, কিন্তু জিপ গাড়ি চালাবার সময় কেউ বুঝবে না যে তার পায়ে খুঁত আছে।
সে জিজ্ঞেস করলো, তুই সাহেবকে আমার কী নাম বলেছিস? আবু শেখ, না সুচরিত মণ্ডল?
ইয়াসিন বললো, তুমি ফের হিন্দু বনে যাও ওস্তাদ। হিন্দু মহাল্লাতেও সাহেবের কামকাজ আছে, তুমি সেসব করতে পারবে, সাহেব বলেছেন সেকথা।
হাতে টুসকি দিয়ে সুচরিত বললো, ঠিক হ্যায়, কাল সকালেই দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেলবো!