চায়ের কাপ তুলে একটা চুমুক দিয়ে খসখসে গলায় বিশ্বনাথ গুহ বললেন, বাপরে, বাপ, কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! বাস চলে না। রিক্সাওয়ালা ব্যাটা পাঁচ টাকা ভাড়া নিল! আট আনা পয়সা পর্যন্ত কমাবে না। একেবারে চশমখোর!
প্রতাপ চিবুকটা বুকে ঠেকিয়ে বসে আছেন। বিশ্বনাথকে দেখেই তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে, তার ওপর বিশ্বনাথ এসেই যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা শুনে প্রমাদ গুনেছেন।
মায়ের মৃত্যুর পর বিশ্বনাথের সঙ্গে প্রায় কোনোই সম্পর্ক রাখেননি প্রতাপ। এককালে এই জামাইবাবুটির সঙ্গে তাঁর যে মধুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে একেবারে। মা যখন মৃত্যুশয্যায় তখনই বিশ্বনাথ বিষয় সম্পত্তির কথা তুলেছিলেন, তারপরেও নানান ছুতোনাতায় তিনি প্রতাপকে দোহন করার কম চেষ্টা করেননি। এককালের বিবাগী, সুর-সাধক বিশ্বনাথ গুহ’র মুখে এখন সব সময় টাকা পয়সার কথা।
দেওঘরের বাড়িটা তো পুরোপুরিই দিয়ে দেওয়া হয়েছে শান্তি–বিশ্বনাথকে, এখন ওঁরা নিজেদের সংসার নিজেরা যেমন করে তোক চালাবেন। মা মারা গেছেন, প্রতাপের আর কোনো দায়িত্ব নেই। এই দুর্দিনে কে আর অন্যের বোঝা টানতে পারে।
দড়ি-পাকানো চেহারা এখন বিশ্বনাথের, ধুতিটা ময়লা, পাঞ্জাবীতে নস্যির দাগ, মুখ ভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। গলার আওয়াজ ভাঙা ভাঙা, তবু অনবরত কথা বলে চলেছেন। চা শেষ করার পর একটা বিড়ি ধরিয়ে তিনি বললেন, নাঃ, এক কাপ চায়ে ঠিক জুৎ হলো না, ও মুন্নিমা, আর একটু চা খাওয়াবি?
দুপুর থেকেই মমতার পেটে ব্যথা। সন্ধ্যের দিকে খুব বেড়েছিল, তাই তুতুল ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। এখন বাড়িতে লোকজন এলে মুন্নি চা-টা করে দিতে পারে।
আজ সন্ধেটা বড় ভালো কেটেছে প্রতাপের, বেশ একটা ফুরফুরে মন নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দরজায় পা দিতে না দিতেই এই মূর্তিমান উপদ্রব, তার ওপর আবার মমতার শরীর খারাপ। বিমানবিহারী, দিলীপকুমার, পরেশ গুহ নিশ্চিত এখন বাড়িতে বসে হাত-পা ছড়িয়ে রেডিও-গ্রামাফোনে গান বাজনা শুনছে। কিংবা বউ ছেলেমেয়ের সঙ্গে গল্প করছে, আর প্রতাপের কপালে এই!
টুনটুনির ভিজে শাড়ী ছাড়াবার জন্য সুপ্রীতি তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের ঘরে। এখন দু’জনেই আবার ফিরে এলেন। দিদিকে দেখে একটু স্বস্তি পেলেন প্রতাপ। একা একা বিশ্বনাথের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে তাঁর একটুও ভালো লাগছিল না।
সুপ্রীতি জিজ্ঞেস করলেন, ও বিশ্বনাথ, তুমি শান্তিকে নিয়ে এলে না কেন? তাকে একা ফেলে এলে?
বিশ্বনাথকে দেখেই প্রতাপ এত বিরক্ত হয়েছিলেন যে মেজদির কথা তাঁর মনে পড়েনি। সত্যিই তো, শান্তি অসহায় ধরনের নারী। অন্য কারুর অবলম্বন ছাড়া সে নিজে যেন দাঁড়াতেই পারে না। সে একা দেওঘরের ঐ বাড়িতে থাকবে কী করে?
বিশ্বনাথ বললেন, পাশের বাড়ির একটা বুড়ি এসে ওর সঙ্গে থাকবে। বাড়ি খালি রেখে সবাই একসাথে আসি কী করে? নিচের তলার ভাড়াটে হারামজাদারা যদি পুরো বাড়িটা দখল করে নেয়? ও শালারা একেই তো ভাড়া দেয় না।
সুপ্রীতি বললেন, টুনটুনি বলছিল, শান্তির নাকি শরীর খারাপ?
বিশ্বনাথ অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, ওরকম শরীর খারাপ তো সারা বছর লেগেই আছে! হাঁটা চলা করতে পারে।
প্রতাপ টুনটুনির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন। হঠাৎ যেন বড় হয়ে গেছে মেয়েটা। আগে তিনি টুনটুনিকে শাড়ী পরা অবস্থায় দেখেছেন কি না মনে করতে পারলেন না। মাতৃবংশের ধারা পেয়েছে। বেশ লম্বা হয়েছে টুনটুনি। রোগা হলেও মুখশ্রীটা সুন্দর। সুপ্রীতির অল্প বয়েসী চেহারার সঙ্গে যেন মিল আছে।
সুপ্রীতি আবার জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটাকে তুমি কলেজে পড়ালে না কেন বিশ্বনাথ?
ভেবেছিলাম তো ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরিতে দেবো। কিন্তু পড়াশুনোয় ওর মাথা নেই, বড়দি।
–আহা-হা মাথা নেই আবার কী? চেষ্টা করে দেখতে। তুমি তো ওকে কলেজে ভর্তি করালেই না। এটা বাপু তোমার অন্যায়।
–আমার না হয় অন্যায়। কিন্তু আপনাদেরও তো বোনঝি। আপনারা কি একবারও খবর নিয়েছেন যে মেয়েটা কলেজে ভর্তি হলো কি হলো না?
কথাটা শুনে প্রতাপের আবার রাগ হয়ে গেল। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বললেন, তোমার মেয়ে, তুমি তাকে কলেজে ভর্তি করতে পারো না। আমরা কেন দায়িত্ব নিতে যাবো? তুমি ওর জন্ম দিতে গিয়েছিলে কেন?
সুপ্রীতি বিশ্বনাথের কাছে কথায় না হেরে গিয়ে বললেন, আমরা আর খবর নেবো কি, তুমি তো চিঠিপত্র লিখতে, কই জানাওনি তো যে টুনটুনি কলেজে ভর্তি হয়নি। আমরা তো ধরেই নিয়েছি যে আমাদের বংশের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবেই।
–তাই তো আপনাদের বংশের মেয়েকে আপনাদের কাছেই রেখে যেতে এসেছি।
প্রতাপ দ্রুত চিন্তা করছেন, বিশ্বনাথ আর তাঁর মেয়েকে থাকতে দেওয়া হবে কোন্ ঘরে। এখন না হয় বাবলুর ঘরটা খালি, কিন্তু বাবলু কাল-পশুই ফিরে আসতে পারে। বাবলুর ঘরটা খুবই ছোট। সেখানে দু জনের শোওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না। বাবলু তার ঘরে অন্য কারুর যখন তখন ঢোকাই পছন্দ করে না। সে এখন সাবালক হয়েছে। সে তো এখন খানিকটা প্রাইভেসি চাইবেই! বিশ্বনাথকে তখন এই বসবার ঘরে বিছানা পেতে দিতে হবে। বসবার ঘরে কারুকে শুতে দেওয়া প্রতাপ একেবারে পছন্দ করেন না। প্রতাপের কাছে লোকজন আসে। বাবলুর বন্ধুরা যখন তখন আসে। মুন্নি-তুতুলেরও বন্ধু আসে। বসবার ঘরে যাকে শুতে দেওয়া হয়, তারও যেমন অস্বস্তি, বাড়ির লোকেরও অস্বস্তি।
বিশ্বনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ব্রাদার, তোমার ট্রামের মাথলি আছে?
–না, কেন বলুন তো?
–কলকাতায় তো অনেকদিন আসিনি। এক সময় অনেকের সঙ্গে চেনাশুনো ছিল। ভাবছি যতজনের সঙ্গে পারি দেখা করে যাবো। ট্রামবাসের যা ভাড়া বেড়েছে, ওফ্! আমাদের সময় দু পয়সা ট্রাম-ভাড়া ছিল, তোমার মনে আছে, ছ’ আনায় পাওয়া যেত অল-ডে টিকেট? তুমি আমায় কাল পাঁচটা টাকা দিও!
প্রতাপ মনে মনে আবার প্রমাদ গুণলেন। বিশ্বনাথ ট্রামবাস ভাড়ার জন্য পয়সা চাইছেন। তার মানে ওঁর দেওঘরে ফিরে যাবার ট্রেন ভাড়া নেই। যাদের ফেরার ভাড়া থাকে না, তাদের ফিরে যাবার তাড়াও থাকে না। উনি তা হলে এখানে কতদিন থাকবেন?
মুন্নি আবার চা বানিয়ে নিয়ে এলো। বিশ্বনাথ তার পিঠে ও মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করলেন। তুতুলকেও ডেকে পাঠালেন তিনি, তুতুলকে বললেন, তুই মা আমার দাঁতটা একটু দেখে দিবি। দাঁতের ব্যথায় বড় কষ্ট পাচ্ছি। শক্ত কিছুই খেতে পারি না।
তুতুল হেসে বললো, আমি তো দাঁতের ডাক্তার নই, মেসোমশাই! ঠিক আছে, আপনাকে বউবাজারে এক ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে যাবো।
বিশ্বনাথ বললেন, সে তুই যা ভালো বুঝবি, আমি তোর হাত-ধরা হয়ে থাকবো। বাঁ চোখটাতেও ভালো দেখি না। ওখানে তো সেরকম চিকিৎসার সুযোগ নেই, তোকেই একটু ব্যবস্থা করে দিতে হবে!
প্রতাপ দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন। স্বার্থপরতার চূড়ান্ত! একবার যখন কলকাতায় এসেছেন বিশ্বনাথ, তখন পরের পয়সায় সব রকম চিকিৎসা করিয়ে নিতে চান। আরও রোগ বেরুবে।
ওঁর টি-বি’র এখন কী অবস্থা? সে সম্পর্কে তো কিছুই বলছেন না।
এক সময় বিশ্বনাথ মেয়েদের বললেন, তোমরা এখন ভেতরে যাও মা, আমরা একটু কাজের কথা বলি?
সুপ্রীতি বললেন, দু বছর কলেজে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে বসে থেকেছে, এখন কী আর কলেজে ভর্তি হয়ে তাল সামলাতে পারবে টুনটুনি?
বিশ্বনাথ মুখটা ঝুঁকিয়ে বললেন, কলেজে পড়ুক না পড়ুক, ওকে এখন আপনাদের কাছেই রাখতে হবে, বড়দি। নইলে জাত-ধর্ম সব যাবে। আপনাদেরও তো ছেলেমেয়ে আছে, তাদের বিয়ে-শাদীর সময়…এখানে মেয়ের জন্য আপনারা একটা ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। আপনারা যা ভালো বুঝবেন, আমাকে দেখাবারও দরকার নেই।
প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের ওদিকেও তো এখন অনেক বাঙালী সেক্স করেছে। ওখানে কোনো পাত্র পেলেন না?
–বিপদের কথা তোমাকে কী বলবো ভাই, ও মেয়ে কিছুতেই বাড়ি থাকতে চায় না। সব সময় টো-টো করে ঘুরে বেড়ায়। এই বয়েসের মেয়ে যে গলার কাঁটা! তোমার দিদিকে তো জানোই, ব্যক্তিত্ব নেই, মেয়েকে সে সামলাতে পারে না, আমিও প্রায় সময়েই বাড়ি থাকি না। কোনোদিন যদি একটা অঘটন ঘটে যায়…আমার বাড়ির ভাড়াটেগুলো একেবারে হারামজাদা, এক পয়সা ভাড়া ঠেকায় না, আবার টুনটুনিকে লোভ দেখায়। দুপুরবেলা ওদের ঘরে গিয়ে বসে থাকে। একদিন মেরে পিঠের চামড়া তুলে দিতে গিয়েছিলাম, তাতে ও আমাকে ধাক্কা মেরে বললো, বেশ করবো, যাবো! বুঝে দ্যাখো! এমনিতে দেখছো তো চুপচাপ, লাজুক, আসলে ও মেয়ে হয়েছে বদমাইসের জাসু!
সুপ্রীতি অপ্রসন্ন ভাবে বললেন, তোমরা ভালো শিক্ষা দিতে পারো নি।
বিশ্বনাথ বললেন, দোষ আমাদের দিতে পারেন ঠিকই। আপনারাও দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। আপনাদের মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, আদর দিয়ে দিয়ে ওর মাথা খেয়েছেন। আমাদের কোনো কথা তিনি শুনতেন না। আমি বাঙালী-অবাঙালী মানি না। একটা ভালো মতন ছেলে পেলে দেওঘরের বাড়ি বিক্রি করেও ওর বিয়ে দিয়ে দিতাম। কিন্তু সুশিক্ষিত বা ভালো বংশের ছেলে না হলে আমি কিছুতেই বিয়ে দেবো না, বরং মেয়ের গলা টিপে মেরে জলে ভাসিয়ে দেবো। তোমরা তো জানো না, ওদেশে অনেক ছেলেই বাঙালী মেয়ে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু তাদের গ্রামে একটি করে বউ আছে আগে থেকেই।
সে রাতে প্রতাপের মেজাজটা খারাপ হয়েই রইলো।
পরদিন মমতা অনেকটা সুস্থ বোধ করলেন। টুনটুনিকে এ বাড়িতে রাখার বিষয়ে মমতা ও সুপ্রীতির সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনা করলেন প্রতাপ। মমতা ও সুপ্রীতি দু’ জনেই টুনটুনিকে এ বাড়িতে রেখে দেওয়ার পক্ষে। বিশ্বনাথ যেভাবে অনুরোধ করছেন, তাতে না বলা যায় না। দেওঘরে থাকলে মেয়েটা গোল্লায় যাবে। এই বংশেরই তো মেয়ে।
দিদি ও স্ত্রীর যুক্তি প্রতাপ অস্বীকার করতে পারেন না। তবু তাঁর মন ঠিক সায় দেয় না। টুনটুনির প্রতি তাঁর স্নেহ জন্মায়নি। তা ছাড়া বাড়িতে আর একটি মানুষ বাড়বে, তার একটা খরচ আছে। সব ঠাট বজায় রেখে কীভাবে যে খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন, তা শুধু প্রতাপই জানেন।
প্রতাপের আসল আপত্তি, টুনটুনির ছুতো ধরে বিশ্বনাথ গুহ এখানে প্রায়ই যাতায়াত শুরু করবেন।
কিন্তু এই সব আপত্তির একটিও মুখে প্রকাশ করা যায় না।
বিশ্বনাথ টুনটুনিকে প্রায় এক বস্ত্রে নিয়ে এসেছেন। প্রায় পালিয়ে আসার মতন। আসল ব্যাপার হয়তো আরও কিছু ঘটেছে, বিশ্বনাথ তা খুলে বলছেন না। মমতার দু’ খানা শাড়ী দেওয়া হয়েছে টুনটুনিকে। কিন্তু তার জন্য সায়া-ব্লাউজ কেনা দরকার এখনই। তার পায়ের চটিটা টায়ারের, কলকাতার কোনো ভদ্র মেয়ে ঐ চটি ব্যবহার করে না।
বিশ্বনাথ গুহকে নিয়ে তুতুলকে কয়েকদিন ঘুরতে হলো ডেন্টিস্ট ও চোখের ডাক্তারের কাছে। বিশ্বনাথ পকেট থেকে একটাও পয়সা বার করেন না। বরং রাস্তায় বেরিয়ে তিনি তুতুলের কাছে আবদার করেন, অনেকদিন কুলপি মালাই খাইনি। খাওয়াবি, মা? হ্যাঁরে, দ্বারিক ঘোষের দোকানে কচুরি ডাল পাওয়া যায় এখনও? আঃ, ওদের ডালটার যা স্বাদ ছিল না, এখনও জিভে লেগে আছে।
তুতুলের উপার্জন অতি সামান্য। পাশ করার পর দু মাস পি আর সি এ করার পর সে এখন হাউস স্টাফ হয়ে কিছু মাইনে পাচ্ছে, পঁচাত্তর টাকা। না, না, পুরো পঁচাত্তর নয়। তার বন্ধুরা বলে, আমাদের মাইনে চুয়াত্তর টাকা নব্বই পয়সা! দশ পয়সা কেটে নেয় রেভিনিউ স্ট্যাম্পের বাবদে। তুতুলের সহপাঠীদের মধ্যে যারা অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে এসেছে, তারা মাসের প্রথমে ঐ টাকা পেয়ে একদিনে উড়িয়ে দেয় দল মিলে চিনে হোটেলে খেয়ে। আর তুতুলের মতন যারা, তাদের ঐ টাকাতেই সারা মাস চালাতে হয় টিপে টিপে।
বিশ্বনাথের জন্য চার পাঁচ দিনেই তুতুলের সব টাকা খরচ হয়ে গেল। তারপরেও তাঁর আবদারের শেষ নেই। তিনি সিনেমা দেখতে চান, গানের জলসা শুনতে যেতে চান। অনেকদিন পর কলকাতায় এসে তিনি যেন আদেখলা হয়ে গেছেন।
রাস্তায় বেরিয়ে এক পা-ও হাঁটতে চান না তিনি। তাঁর রিক্সা চাই। যে-কোনো পুরুষ মানুষের স্পর্শে তুতুলের অস্বস্তি হয়, বিশ্বনাথ তার কাঁধে হাত রাখেন।
শুধু টাকা পয়সার অসুবিধের জন্যই নয়, তুতুলের সময়ও নষ্ট হচ্ছে খুব। বিশ্বনাথের ব্যবহার অবুঝের মতন। শেষ পর্যন্ত তুতুল মায়ের কাছে খুব সংকোচের সঙ্গে অভিযোগ জানালো। তুতুল হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে পারছে না। একদিন বিশ্বনাথকে সে হাসপাতালে ডিউটিতে যাবার কথা বলতে বিশ্বনাথও তার সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে সর্বক্ষণ বসে ছিলেন।
সুপ্রীতি বাধ্য হয়ে বিশ্বনাথকে তুতুলের কাজের কথা বুঝিয়ে বললেন এবং তাকে কুড়িটা টাকা দিলেন। তবু ভয়ের চোটে তুতুল ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
টুনটুনিকে নিয়েও সমস্যা হলো। টুনটুনি আসবার পর থেকেই মুন্নি আর তুতুলের দু একটা ছোটখাটো জিনিস হারাচ্ছে। ওগুলি যে টুনটুনিই নিয়ে লুকিয়ে রাখছে, তা অতি স্পষ্ট। এতই সামান্য সব জিনিস, লবঙ্গের কৌটো কিংবা নকল পাথরের দুল, ওসব টুনটুনি চাইলেই ওরা দিয়ে দিত। তুতুল বা মুন্নি টের পেয়ে গেলেও কিছু বলে না, কিন্তু ওদের ভয়, বাবলু এসে পড়লে, তার ঘর থেকে কোনো জিনিস সরালে সে চেঁচিয়ে সারা বাড়ি মাথায় করবে। এর মধ্যেই বাবলুর ঘর থেকে টুনটুনি কিছু সরিয়েছে কি না কে জানে!
মমতা একদিন টুনটুনিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন কালীঘাট মন্দিরের কাছে বাজার করতে। টুনটুনি কলকাতা শহরে কিছুই প্রায় দেখেনি। কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে সে তার বয়েসের তুলনায় অনেক বেশি ছেলেমানুষ হয়ে পড়ে। এমনকি ট্রাম চলতে দেখলেও সে সবিস্ময়ে তাকায়।
মমতার মায়া হয়। মেয়েটা তো আসলে এখনও ছেলেমানুষ, কতই বা বয়েস, কুড়িও পূর্ণ হয়নি। ওকে আস্তে আস্তে চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল এই সব দেখিয়ে দিতে হবে।
হারিয়ে যাবার ভয়ে টুনটুনি মমতার আঁচল চেপে ধরে আছে। মমতা ওকে রঙীন কাঁচের চুড়ি কিনে দিলেন, পায়ের নোখের জন্য নেলপালিশ কিনে দিলেন, আইসক্রিম খাওয়ালেন।
বাড়ি ফেরার পথে টুনটুনি ফিকফিক ফিকফিক করে হেসে বললো, মামী, এই দ্যাখো!
আঁচলের তলা থেকে সে একটি ছোট পাউডারের কৌটো বার করলো। মমতা স্তম্ভিত। এত সরল, লাজুক আর ভীতু মনে হচ্ছিল মেয়েটাকে, তার এই কাণ্ড। দোকান থেকে পাউডারের কৌটো চুরি করেছে?
মমতা নিজের ছেলেমেয়েদের আদর করলেও শাসন করতে কখনো কার্পণ্য করেননি। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে টুনটুনির দিকে কঠোরভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোর পাউডার দরকার ছিল, বললি না কেন আমায়?
টুনটুনি শরীর মুচড়ে বললো, এইটার তো দাম লাগলো না?
–দাম না দিয়ে দোকান থেকে জিনিস নিলে তাকে কী বলে তুই জানিস না? তোর মামা কী কাজ করেন, তা জানিস? তোর মামা এই সব চোরদের জেলে দেয়। এরকম করলে তুই কলকাতায় থাকতে পারবি না! তোর মামা যদি একবার শোনে…
টুনটুনি সঙ্গে সঙ্গে মমতার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বললো, মামী, আর কোনোদিন করবো না, তুমি মামাকে বলে দিও না!
মমতা তবু ছাড়লেন না। টুনটুনিকে নিয়ে ফিরে গেলেন কালীঘাট মন্দিরের কাছে। সেই দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, যা, ফেরৎ দিয়ে আয়। বলবি, ভুল করে নিয়ে গিয়েছিলি।
বাড়ি ফিরে তিনি সুপ্রীতিকে এই ঘটনাটা বলতেই সুপ্রীতি জানালেন যে ও মেয়ের যে হাত-টান স্বভাব তা তিনিও লক্ষ্য করেছেন। ওকে চোখে চোখে রাখতে হবে।
টুনটুনির নামে তিনি প্রতাপের কাছে নালিশ করলেন না বটে, কিন্তু দু একদিন পরেই মমতা প্রতাপকে আর একটি বিষয় জানালেন। কানু মাঝে মাঝেই দুপুরের দিকে আসে। আগেরদিন এসে সে বলেছে যে বিশ্বনাথ তাকে খুব বিরক্ত করছেন। এর আগে দেওঘর থেকে বিশ্বনাথ প্রায়ই কানুর কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছেন। কানু দিয়েছিল দু একবার। এখন তিনি মেয়ের বিয়ের কথা বলে ছ হাজার টাকা চেয়েছেন। মেয়ের বিয়ে নাকি ঠিক হয়ে গেছে। কানু এখন অত টাকা দিতে পারবে না। কানু আরও খবর পেয়েছে যে, কানুর বাড়িতে বসেই নতুন দু জন ভদ্রলোকের সঙ্গে বিশ্বনাথের আলাপ হয়েছিল, বিশ্বনাথ সেই দুই ভদ্রলোকের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে টাকার জন্য জ্বালাতন করেছেন।
প্রতাপ প্রথমটা হুঁ হাঁ করে শুনছিলেন, হঠাৎ মাথা তুলে উত্তেজিতভাবে বললেন, উনি বিমানবিহারীর বাড়িও যাতায়াত করছেন শুনলুম। বিমানের কাছেও টাকা চেয়েছেন নাকি?
এ কথাটা মনে আসা মাত্র প্রতাপ বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে। আদালত থেকে ফিরে তাঁর জলখাবারও খাওয়া হয়নি। মমতার অনুরোধেও কর্ণপাত করলেন না।
বিমানবিহারী প্রথমে কিছুতেই স্বীকার করতে চান না। না, না, ওসব কিছু না বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেন অনেকবার। কিন্তু প্রতাপ ছাড়বার পাত্র নন, প্রচুর জেরা শোনার অভ্যেস আছে তাঁর।
শেষ পর্যন্ত জানা গেল যে বিশ্বনাথ এখানে মেয়ের বিয়ের বদলে স্ত্রীর অসুখের প্রসঙ্গ তুলে কিছু টাকা ধার চেয়েছিলেন। বিমানবিহারী তাকে দুশো টাকা ধার দিয়েছেন।
প্রতাপ হুকুমের সুরে বললেন, বিমান, ভাউচার বার করো! আমার নামে দুশো টাকা লেখো। আমি এক্ষুনি তোমার টাকা শোধ করে দিতে চাই।
বিমানবিহারী বললেন, আহা, ব্যস্ত হচ্ছো কেন? সামান্য টাকা, পরে একটা কিছু ব্যবস্থা হবে।
প্রতাপ বললেন, আমার কাছে সামান্য নয়। তুমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে এক্ষুনি কেটে নাও!
বিমানবিহারী জানেন, প্রতাপের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। তাঁর এই গোঁয়ার বন্ধুটিকে তিনি এক কাপ চা খাওয়াবার জন্যও আর ধরে রাখতে পারলেন না। ভাউচারে সই করেই প্রতাপ হন হন করে বেরিয়ে গেলেন।
বিশ্বনাথ গুহ বাড়িতে ছিলেন না। প্রতাপ বাইরের ঘরে বসে রইলেন ঠায়। বিশ্বনাথ বাড়ি ফেরা মাত্র ভেতরের দিকের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, বসুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে।
প্রতাপ একসময়ে বিশ্বনাথকে ওস্তাদজী বলে ডাকতেন। এখন সেই খোনা-গলার ভাঙাচুরো মানুষটিকে এ সম্বোধন করলে তা ব্যঙ্গের মতন শোনাবে।
তিনি রাগের চেয়ে বেশি দুঃখিত গলায় বললেন, বিশ্বনাথবাবু, আপনার নামে আমি এসব কী শুনছি? আপনি আমারই বাড়িতে থেকে লোকজনের কাছে টাকা চেয়ে বেড়াচ্ছেন? আপনার নিজের মানসম্মান না হয় বিসর্জন দিয়েছেন, কিন্তু আমার একটা মানসম্মান জ্ঞান এখনো টিকে আছে, যারা আমার বন্ধু, আপনি আমায় কিছু না জানিয়ে তাদের কাছে গিয়ে…এমনকি আপনার জন্য কানু এসে এ বাড়িতে কথা শুনিয়ে যায়…
বিশ্বনাথ চোখ পিটপিট করে শুনতে লাগলেন, প্রতাপের গলার উত্থান-পতন শুনেও তিনি বিশেষ বিচলিত হলেন না। প্রতাপ একটু থামতেই তিনি বললেন, তুমি আসল কথাটা বলতে পারছে না ব্রাদার। আসল কথাটা হলো আমি ভিক্ষে করছি। হ্যাঁ, ভিক্ষেই তো করছি। নানান কথার ছলনায় ভুলিয়ে…তবেই বুঝে দ্যাখো, পোড়া পেটের জন্য মানুষ কি না করে? ভিক্ষে না করলে খাবো কি বলতে পারো? দেওঘরে একটা শুধু বাড়ি আছে, আর একটা পয়সা রোজগার নেই। ভাড়াটেগুলো গাজুয়ারি করে পয়সা দেয় না, তাদের সঙ্গে লাঠালাঠি করার সামর্থ্য আমার নেই। মেয়েটাকে এখানে গছিয়ে গেলাম, আমরা আর দুটি প্রাণী, বেঁচে থাকতে হবে তো?
জামাটা খুলে নিজের পেটের ওপর হাত রেখে আবার বললেন, এই যে, এইটিই সব কিছু। পেট কোনো যুক্তি শোনে না। ক্ষুধাই হলো মায়া, ক্ষুধাই ঈশ্বর। শ্মশানে যাবার আগে কিছুতেই আকাঙ্ক্ষা মরে না। কী করি বলো, ব্রাদার!