২.৫০ The flowers fall for all our yearning

The flowers fall for all our yearning;
Grasses grow, regardless of our dislike.

মাতুল জয়নারায়ণ আর আমি একই বিছানায়। মুকু মশারি ফেলে গুঁজে দিয়ে গেছে। শৌখিন জয়নারায়ণের জন্যে বিছানাটাকে যতদূর সম্ভব পরিপাটি করেছে। বালিশে পরিচ্ছন্ন তোয়ালের ঢাকা। মাথার কাছে একটা টুলে চাপা দিয়ে গেছে এক গেলাস জল। ছোট একটা পেতলের পদ্মকাটা বাটিতে লবঙ্গ, বড় এলাচ। মাঝরাতে জয়নারায়ণের কাশি হয়; তখন প্রয়োজন হতে পারে। মুকুর নজর সব দিকে।

বিছানায় আমরা দুজনে গড়াচ্ছি, বাইরে গড়াচ্ছে রাত। রাতের ভেলায় ভেসে চলেছে জীবজগৎ, নতুন দিনের কূলে। দু’জনেই চিত।

মাতুল জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোন পাশে শুস?

সাধারণত বাঁ পাশে।

ধনুক হয়ে যাস?

না, স্ট্রেট।

তোর নাক ডাকে?

মনে হয় না।

আমার নাকে এফ শার্পে তারার সা বাজে, সিসি করে। তখন আমাকে ঠেলে দিবি।

আমি তো এখনই ঘুমিয়ে পড়ব মামা।

হাই পিচ সাউন্ডে তোর যদি ঘুম ভেঙে যায় তা হলে আমাকে ঠেলে দিবি। জানিস তো, সারারাত আমি গান গাই। স্বপ্নে। বিশাল বিশাল সব আসর। মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠন। এপাশে ওপাশে জাফরির কাজ। চারটে তানপুরা, সুরমণ্ডল, তবলায় আল্লারাখা, সারেঙ্গিতে লজ্জন খান, চারপাশে সমঝদার শ্রোতা। ধরেছি মারুবেহাগ।

মাতুল হঠাৎ একটা ইংরেজি কবিতা ধরলেন।

There they stand, the innumerable stars,
Shinning in order like a living hymn, written in light.

নীরব রইলেন কিছুক্ষণ। ফরসা কপালে আলতো পড়ে আছে বাঁ হাত। পূর্ণ চন্দ্রের আলো মাথার কাছের জানলা দিয়ে মুখে এসে পড়েছে। জয়নারায়ণকে অবিকল কবি কিটসের মতো দেখতে। দুধসাদা একটা ধুতি দু’ভাজ করে লুঙ্গির মতো পরেছেন। ধবধবে সাদা গেঞ্জি। শরীরের ত্বক এত পাতলা যে ছোট ছোট শিরা আর ধমনীর রক্তস্রোত গোলাপি আভা ছাড়ে। খুব সাবধানে সংগ্রহে রাখার মতো একজন পরিপূর্ণ শিল্পী।

মাতুল আপন মনে গুনগুন করে খাম্বাজ আলাপ করতে লাগলেন। আমি জেগে থাকার অনেক চেষ্টা করেও একসময় ঘুমিয়ে পড়লুম। কতক্ষণ নিদ্রায় পাথরের একটা বাটির মতো তলিয়ে ছিলুম জানি না। হঠাৎ একটা ধাতব শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। যেন পেল্লায় এক ঘড়ি বাজল কোথাও। শব্দটা মনে হয় পাশের ঘরে হল। মাতুল ধারে শুয়েছিলেন, আমি দেয়ালের দিকে। অনেকক্ষণ হিসেব করলুম, অতল নিদ্রায় শান্ত শোলার মতো একটি মানুষকে না জাগিয়ে কীভাবে ভূতলে অবতীর্ণ হওয়া যায়! টপকাতে হবে। সাবধানে পায়ের ওপর দিয়ে শরীর স্পর্শ না করে মেঝেতে নেমে মশারিটা আবার খুঁজছি, জয়নারায়ণ বললেন, একটা কিছু হাতে নিয়ে বেরোও, চোর হতে পারে! জয়নারায়ণ নিদ্রা আর জাগ্রত অবস্থার পাতলা স্তরে অবস্থান করছিলেন, পা ডোবে না এমন জলে নৌকো বাওয়ার মতো। চোরের ভয় ধরিয়ে দিলেন। মুহূর্তের জন্য থমকে যেতে হল। অতীতের ঘটনা মনে পড়ে গেল। চোরের সঙ্গে শুভদৃষ্টি বিনিময়। চোর পঁড়িয়ে আছে জানলার শার্সির বাইরে, আমি ঘরে। দু’জনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। প্রথমে আমি ভেবেছিলুম, ওটা আমারই প্রতিবিম্ব। হঠাৎ খেয়াল হল তা কী করে হয়! আমার নাক তো অমন নয়। আমার ভুরু আছে, প্রতিবিম্বের ভুরু নেই। রং কালো। চোখদুটো মরামরা। ওটা তো আমি নই। তখনই আমি চোর চোর বলে চিৎকার করলুম চোর লজ্জায়, আমার ভয় পাওয়ায় লজ্জায় দোতলার কার্নিস থেকে এক লাফ মেরে একতলায় পড়ে পাঁচিল টপকে ছুটে পালাল। চোরের দোষ কেউ দিলে না, সকলে আমাকেই তিরস্কার করতে লাগল, তুই চিৎকার করলি কেন ইডিয়েট! চোর এলে নিজে চোর হতে হয়। পা টিপে টিপে পেছন দিক থেকে গিয়ে জাপটে ধরতে হয়। ধরেছি প্রভু! আর তোমাকে ছাড়ব না। যত বলি, কার্নিসের তো পেছন নেই। তার সবটাই তো সামনে। কেউ মানতে চায় না। তখন বললে, তা হলে নেমে গিয়ে লুফে নিলে না কেন! চোর যেন ক্রিকেট বল! ওভার বাউন্ডারির মারে আসছিল, ব্রাডম্যানের মতো ক্যাচ করব আমি। সিদ্ধান্ত হল, আমার মতো ভিতু এর চেয়ে আর কী করতে পারে!

দরজা খুলছি, জয়নারায়ণ বললেন, আগেই ঝট করে বেরোসনি। মাথাটা এগিয়ে দিয়ে বাইরেটা দেখে নে। কত বড় চোর। ধরার শক্তি তোর আছে কি না! চোর ধরা প্রায় মাছ ধরার মতোই।

বাইরের দালান চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। রুপোর তবক মোড়া। দেয়ালে ঠাকুরদার অয়েল পেন্টিং চন্দ্রালোকিত মধ্যরাত্রে রহস্যমণ্ডিত হয়ে জীবন্ত। ভিক্টোরিয়ান চেয়ারে আসীন গম্ভীর এক পুরুষ। হাতে আড়াআড়ি একটি ছড়ি। সেকালের সুখ্যাত প্রখ্যাত এক শিক্ষক। একালে তাঁর জীবিত ছাত্ররা শ্রদ্ধায় মাথা নত করেন। তাঁর পৌত্র বলে অযাচিত স্নেহ করেন।

সেই মায়াময় দালানে অন্ধের মতো এক কিশোর টাল খাচ্ছে। পা লেগে গলা উঁচু মোরাবাদি ফুলদানি উলটে পড়েছে একপাশে। এই মাঝরাতে আমার পিসতুতো ভাই কী করতে চাইছে। দিগজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বলেই মনে হয়! নীচে নামার সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে। সাবধানে দরজা খুলে এগিয়ে গেলুম।

কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলুম, কোথায় যাচ্ছ?

চমকে ফিরে তাকাল, ভয়ে ভয়ে বললে, আমি ছোট বাইরে করব।

ওদিকে নয়, বাথরুম এই দিকে।

ভাই বাথরুমে ঢুকেছে। পঁড়িয়ে আছি। দালানের একেবারে শেষ ঘরে চাপা গলায় দু’জনে কথা বলছেন। অনুচ্চ কণ্ঠে মন্ত্রপাঠের শব্দের মতো। যেন রাজকীয় দুটো ভোমরা ঘরে ঢুকে আছে। ভাইকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ পঁড়িয়ে রইলুম। রাতের অন্ধ পাখির মতো তার অনিশ্চিত ঘোরাফেরা মনে বড় দাগ ফেলে গেল। শীর্ণ এক কিশোর, সহায়-সম্বলহীন। আমাকে এই আঁধারে চালায় কে গো! এইরকম একটি সচল প্রশ্ন। বাইরে চাঁদের আলোর মুশায়েরা চলেছে। বৃক্ষ, লতা, গুল্ম অপ্সরার মতো বাতাসে নাচছে। নিস্তব্ধ চরাচর। মনে হচ্ছে, বৃহৎ এক স্বপ্নের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। ঘুমের জগতেই জেগে উঠেছি অশরীরী হয়ে। পায়ে পায়ে এগোতে লাগলুম শব্দ লক্ষ করে। ঠাকুরদার অয়েল পেন্টিং যেন ফিসফিস করে ডাকলেন, পিন্টু! চললে কোথায়! নিদ নাহি আঁখিপাতে! আমি তো আপনাকে দেখিনি কোনওদিন, কিন্তু আপনি ওমনিপ্রেজেন্ট। যেখানেই যাই আপনার নাম।

দালানের শেষ ঘর। দরজার পাল্লা আধ-ভেজানো। দু’জনের কথা বলার শব্দ আরও স্পষ্ট। বাইরের দিকে তাকালুম, রুপোর আঁচল উড়িয়ে সুন্দরী রাত বিশ্বসভায় নাচছে। কোনও কবি কোথাও লিখছেন,

কাল চৌধভি কি রাত থি,
সফর রাহা, চর্যা তেরা
কুছ নে কহা ইয়ে চাঁদ হ্যায়,
কুছ নে কহা চেহেরা তেরা ॥

হরিশঙ্কর যথার্থই বলতেন, রাত কত রহস্যময়। যারা ঘুমিয়ে কাটায় তাদের মতো বঞ্চিত আর কেউ নেই। সমস্ত অপ্রাণ বস্তুও রাতে প্রাণ পায়। সামান্য একটা চেয়ার, দেয়াল, ছড়ি, বেড়ানোর ছবি, সব জীবন্ত। দূর থেকে একটা চেয়ারকে দেখো। শূন্য ঘর, শূন্য টেবিল, শূন্য চেয়ার, দেয়ালে পূর্বপুরুষের একটি ছবি। সেই ছবি থেকে নিঃশব্দে তিনি নেমে এলেন। চেয়ারে বসলেন। চারপাশে তাকালেন। হয়তো হাসলেন, নয়তো রাগত। অদৃশ্য কাগজে লিখে গেলেন, অদৃশ্য চিঠি। তোমরা ঠিক পথে চলছ না। আমি যা চাইনি, তোমরা ঠিক সেইটাই করছ। আমার ধারা তোমরা ঘুরিয়ে দিতে চাইছ। আদর্শ-ভ্রষ্ট হচ্ছ! কিংবা তিনি কোনও নির্দেশ দিলেন। ভয় পেয়ো না। সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকো। তোমাকে অপমান করেছে করুক, প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা কোরো না, তাতে তুমি নিজেই অপরাধী হবে। একা হয়ে যাবে। গডস জাস্টিস, ডিভাইন প্রোটেকশন আর পাবে না। অথবা লিখবেন, প্রিয়জনের অসুস্থতায় তুমি বিচলিত। অসহায় বোধ করছ? প্রার্থনা করো। নিজেকে বোঝাও, জন্ম, মৃত্যু তোমার হাতে নেই। ধৈর্য, সহ্য এই তোমার হাতিয়ার। বি কাম, বি পেশেন্ট, সারেন্ডার।

তিনি তোমার জন্যে সব লিখে যাবেন, দূরে দাঁড়িয়ে তুমি শুধু অনুভব করো। মধ্যরাতের নিথর বায়ুমণ্ডলে ভেসে আসছে ভিন্ন জগতের বার্তা। তুমি ধরার চেষ্টা করো। গুড সোল এই সময়ে ঘুরে বেড়ান তোমাকে সাহায্য করার জন্যে। শুদ্ধ মনে তুমি তা গ্রহণ করো। তোমার সেক্স, তোমার পারসেপশনকে অসীম করো। দেহসীমাকে লঙঘন করো। সূক্ষ্ম থেকে অতিসূক্ষ্ম হয়ে চেষ্টা করো আই অফ দি নিডল দিয়ে গলে যেতে। আদার ওয়ার্লডে যাওয়ার পথ ভারী সূক্ষ্ম। পথ আছে। সেটা স্থূল নয়। ভেরি মাইক্রসকোপিক। চেষ্টা করতে হবে, আঁকুপাঁকু করতে হবে। এই জগতের নিয়মে সে জগৎ চলে না। সেখানে টাইম সাইকল ভিন্ন। সেখানে গ্রাভিটি নেই। সে জলে লোহা ভাসে, শোলা ডুবে যায়। হরিশঙ্কর এমারসনকে উদ্ধৃত করবেন, Great men are they who see that spiritual is stronger than any material force, that thoughts rule the world.

হঠাৎ পেছনে একটা খসখস শব্দ হল। ভয়ে চমকে উঠেছি। সাদা একটা মূর্তি। মাতুল জয়নারায়ণ। কাছে এসে চাপা স্বরে বললেন, কী রে, চোর পালিয়েছে?

চোর নয়, পিসতুতো ভাই।

তা তুই এখানে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন চাঁদের আলোয়! জানিস না চাঁদের আলোয় অ্যানিমিয়া হয়। ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় বোঝাতে চাইলুম, চুপ করুন।

কানের কাছে মুখ এনে বললেন, কেন রে?

ঘরের ভেতর গুঞ্জন।

মাতুল শুনলেন। বললেন, চল না যাই। কেন বঞ্চিত হব চরণে!

দরজাটা ধীরে খোলা হল। ভেতরটা প্রথমেই দেখা গেল না। ডান দিক থেকে একটা দেয়াল দরজার দিকে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। তৈরি করেছে বড় মাপের একটা খাঁজ। সেই অংশে হরিশঙ্করের নিজস্ব ল্যাবরেটরি। লম্বা একটা টেবিল। অ্যালুমিনিয়ামের পাত মোড়া। টেস্টটিউব, ফ্লাস্ক, জার, ব্যুরেট, ডিক্যান্টার, ডিস্টিলেশন ফ্লাস্ক, স্পিরিট বার্নার, কেমিক্যালস, রিজেন্ট বটল, ছোট একটা হাপর। রাতের পর রাত এখানে কাজ চলে। ভেষজ কিছু একটা তৈরি করতে চাইছেন। একটা আমি জানি, দুরারোগ্য একজিমার ওষুধ।

বাঁ দিকে ঘুরতেই ঘরের ভেতরটা দেখা গেল। জানলার দিকে মুখ করে মেঝেতে আসন পেতে পাশাপাশি বসে আছেন ছোটদাদু আর হরিশঙ্কর। দুধের মতো চাঁদের আলোয় দু’জনে ভাসছেন। দু’জনের নাভির কাছ থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ উঠছে। ওঙ্কারের সঙ্গে আরও কিছু জড়িয়ে আছে। সেই শব্দে আমার বুকের কাছটা কাঁপছে, রোম খাড়া হয়ে উঠছে।

জয়নারায়ণ কানে কানে বললেন, অনাহত ধ্বনি।

আমরা সেই অপূর্ব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি পাথরের মূর্তির মতো। এইসময় তো বিরক্ত করা উচিত হবে না। জয়নারায়ণ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানেই বসে পড়লেন। আমিও বসে পড়লুম। বসেই মনে হল, যে ভূমিতে বসেছি সেটাও প্রসারিত সংকুচিত হচ্ছে। যেন বিশালের বুকের ওপর বসে আছি।

জয়নারায়ণ এই প্রলোভন থেকে আর সরে থাকতে পারলেন না। নাভির কাছ থেকে ওম বলে একটা শব্দ তুললেন। মাতুলের সুরের সঙ্গে ওঁদের সুর মিলে ঘরে এমন একটা রেজোনেন্স তৈরি হল ওপাশের টেবিলে রাখা কাঁচের সব জিনিসপত্র ঝনঝন করে উঠল। মনে হল আমার মাথাটায় ভেতর থেকে চিড় ধরে যাবে। বেলের মতো ফটাস করে ফেটে যাবে। আমার আধার অতি ক্ষুদ্র। গুড়গুড়ে ভয়ে সিঁটিয়ে গেলুম। মরে যাব না তো! জয়নারায়ণকে আর কে পায়? নাভি উন্মোচিত হয়েছে। স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞাচক্র ভেদ করে সহস্রারে ফেটে পড়ছে শব্দ। অদ্ভুত তার কম্পন। শরীর ঝিঁঝি পোকার মতো থিরথির করে কাঁপছে। জয়নারায়ণ সব ভুলে ভৈঁরোতে ধরলেন সেই বিখ্যাত গান :

মা মা রবে মন সুখে মন ত্রিতন্ত্রী বাজাও রে,
মায়ের রচিত সুমধুর বীণা বাজায়ে মা নাম গাও রে।
স্মরিয়ে ধূর্জটি মন্দ্র হতে উঠি, মধ্যগ্রামে যাও মন রে,
ক্রমে তারাপুরে উঠে তার স্বরে, তারা তারা ধ্বনি করো রে ॥

ভৈরবের অলৌকিক চলন। ষড়জ থেকে পঞ্চমে উঠে, কোমল মধ্যম শুদ্ধ গান্ধার কোমল ঋষভ স্পর্শ করে আবার ষড়জে নেমে আসছে। ঐশ্বরিক সুর লহরী। দুই যোগীর সাধন ভঙ্গ হল। তারা উঠে এলেন। বসে পড়লেন জয়নারায়ণের সামনে। জয়নারায়ণের কণ্ঠ ইস্পাতের ফলার মতো উদারা মুদারা তারায় অনায়াসে বিচরণ করছে। জয়নারায়ণ গাইছেন,

মিলায়ে অকার উকার মকার, মা নামের অগ্রে দিয়ে অলংকার
বাজাও সাধের বীণা বারবার, ভুবন কম্পিত করো রে।
মূলাধারে আছে নিদ্রিতা যোগিনী, নতমুখে সেই শিব সোহাগিনী,
তব বীণার ঝংকারে সুষুপ্তা দেবীরে, জাগায়ে প্রসন্না করো রে।
গঙ্গা যমুনা সরস্বতী ঘেরি, সার্ধ ত্রিকোটী তন্ত্রী সারি সারি,
বাজিছে নিয়ত মা মা করি, তব বীণার ভিতরে শুনো রে;
দীন রাম বলে মন কোরো নাকো হেলা, বাজাও সাধের বীণা এইবেলা
অজপা ফুরালে বীণা ফেলে যাবে আনন্দে আনন্দ নগরে।

ঝকঝকে মেঝে থেকে চাঁদের আলো ঠিকরে জয়নারায়ণের ঝিনুকের মতো মুখে পড়েছে। মনে হচ্ছে দেবতার মুখ। এক ফোঁটা, দুফোঁটা, জলের মুক্তোদানা গাল বেয়ে নামছে, যেন গাছের পাতা। ভোরের শিশির ঝরাচ্ছে। গান শেষ করে জয়নারায়ণ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ছোটদাদু তাঁকে। জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি মহাসাধক। এইবার তোমার সব চলে যাবে জয়, অর্থ, বিত্ত, ভোগ, দেহসুখ, থাকবে শুধু তোমার মাতৃনাম। জেনে নাও, এই তোমার শেষ জন্ম। তুমি হলে সুরলোকের। গান্ধার। রিক্ত হয়ে সুরের ভেলায় চড়ে চলে যাবে পূর্ণের কূলে।

জয়নারায়ণ বললেন, তাই হোক। তবে তাই হোক।

চন্দ্রালোকের ঘনত্ব কমছে। আগামী দিন জল ঢালতে শুরু করেছে দুধে। বিশ্বপ্রসবিনী এক আশ্চর্য কামধেনু। আমরা আমাদের উল্লাসে অন্যান্য ঘুমন্ত প্রাণীদের কথা ভুলেই গিয়েছিলুম। ধীরে দরজা খুলে মুকু এসে একপাশে বসল। শেষরাতের ঘুম-ভাঙা মেয়েদের দেখলে মনে হয় রাতের ট্রেনে বিদেশ যাচ্ছি সুখের সুটকেস নিয়ে। মুকুর আয়ত চোখে নিদ্রার তলানি। বাসি মুখ প্রসন্ন। শাড়ি নিভাজ নয়। গোল গোল ফরসা হাতে সোনার চুড়ির চেকনাই।

ঘোটদাদু বেশ আয়েশ করে বসেছেন খুশি খুশি মুখে। আসনে বসলেই এঁদের বিশ্রাম হয়ে যায়। হরিশঙ্কর প্রসন্ন। মনে হল এইবার কিছু প্রশ্ন করা যেতে পারে, এমন পরিবেশ, এই সুযোগ আর হয়তো আসবে না জীবনে। জানতে চাইলুম, কেমন করে একজন মানুষকে দেখেই তিনি তার। সম্পর্কে গড়গড় করে সবকিছু বলে যান? এর কি কোনও বিজ্ঞান আছে!

ছোটদাদুর মুখে হাসি খেলে গেল। বললেন, অবশ্যই আছে। প্র্যাকটিক্যাল সায়েন্স। করে পেতে হবে, অর্থাৎ কৃপা। শুদ্ধ, পবিত্র, নিষ্কাম জীবন যাপন করলেই এই শক্তি অর্জন করা যায়। অহংকার খুলে বেরিয়ে আসতে পারলেই যে-কোনও মানুষের জীবনে প্রবেশ করা যায়। অন্যের উনুনের ধোঁয়া যেভাবে বাড়িতে ঢোকে সেইভাবে তোমার মনও অন্যের মনে ঢুকে যেতে পারে। তুমি তখন অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সবই দেখতে পাবে ছবির মতো। তা হলে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের একটি গল্প শোনো। মহাত্মা রামচন্দ্র দত্ত ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তমণ্ডলীর একজন। একদিন তিনি চলেছেন দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুরকে দর্শন করবেন। শ্যামবাজারের পোলের কাছে ময়রার দোকান থেকে কয়েক পয়সার জিলিপি কিনেছেন। জিলিপি কিনে ঘোড়ার গাড়িতে উঠেছেন। গাড়ি ছাড়বে। কোথা থেকে ছ-সাত বছর বয়েসের এক মুসলমান ছেলে এসে বলছে, বাবু একটা জিলিপি। রামচন্দ্র কিছুতেই তাকে জিলিপি দেবেন না। জিলিপি কিনেছেন ঠাকুরের জন্যে। তাকে কেন দেবেন! গাড়ি চলতে শুরু করল। নাছোড়বান্দা ছেলেটি পেছন পেছন ছুটছে। হঠাৎ রামবাবুর মনে হল, এ হয়তো ভগবানের ছলনা। ভগবান পরীক্ষা করছেন। তার মনে পড়ে গেল সেই গল্পটি, এক সাধু রুটি তৈরি করে একটু ঘি আনতে গেছেন। এসে দেখেন, একটা কুকুর রুটি মুখে করে পালাচ্ছে। সাধু তার পেছন পেছন দৌড়োচ্ছেন আর বলছেন, রাম অপেক্ষা করো, রুটিগুলোয় ঘি মাখিয়ে দিই। মনে হওয়ামাত্রই রামবাবু একটা জিলিপি তুলে ছেলেটিকে ছুঁড়ে দিলেন। দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছে এই ঘটনা তিনি আর কাউকে বললেন না। বিকেলবেলা শ্রীরামকৃষ্ণ জিজ্ঞেস করলেন, রাম, তুমি আমার জন্যে। কী এনেছ? রামবাবু ভয়ে ভয়ে জিলিপির ঠোঙাটি তার সামনে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠাকুর। বাঁ হাতে জিলিপিগুলো চটকে হাত ধুয়ে ফেললেন। খেলেনও না, কিছু বললেন না। পরে একদিন রামবাবুর বন্ধুস্থানীয় একজনকে বলেছিলেন, ওদের সাবধান করে দিয়ো, দ্রব্যের অগ্রভাগ বেরিয়ে গেলে, সে জিনিস আর ঠাকুরের সেবায় ব্যবহার করা যায় না।

ঠাকুর কীভাবে জেনেছিলেন! মনকে যদি বিশ্বমন, চোখকে যদি বিশালের চোখ করা যায়, তা হলে সবই জানা যায়। একবার ঠাকুরের এক ভক্তের পালিতা কন্যার কলেরা হয়েছে। তিনি রামকৃষ্ণকে স্মরণ করছেন। ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত। অর্থাৎ শোনা যায়। বহু দূর থেকেও শোনা যায় ভক্তের কাতর ডাক। সে ডাক কান শোনে না, শোনে মন। তুমি যে-বিজ্ঞান জানতে চাইছ, সে বিজ্ঞান হল, মনের নিয়ন্ত্রণ। এদিকে কিছু করলে ওদিকে কিছু হয়। যেমন ঘটি মাজলে ঝকঝকে হয়, আয়নার কাঁচ পরিষ্কার করলে নিজের মুখ আরও পরিষ্কার দেখা যায়। যেমন গ্রামোফোনের স্টাইলাস পরিষ্কার করলে রেকর্ডের শব্দ আরও ঝনঝনে শোনায়। যেমন দূরবিনে চোখ রাখলে অনেক দূর দেখা যায়। এ-ও তাই। এর মধ্যে অলৌকিক যা, সেটা হল এক ধরনের জীবনযাপন। নাক বুজে থাকলে গন্ধ পাবে না, কানে খোল থাকলে শব্দ পাবে না। ব্যাপারটা হল খুলে দেওয়া, খুলে যাওয়া।

হরিশঙ্কর বললেন, ওপনিং আপ।

ছোটদাদু বললেন, এই বিজ্ঞান রবীন্দ্রনাথের সেই সুন্দর গানে একেবারে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে,

না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে
দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি–পেয়েছি আঁধার রাতে ॥
না দেখিবে তারে, পরশিবে না গো, তারি পানে প্রাণ মেলে দিয়ে জাগো
তারায় তারায় রবে তারি বাণী, কুসুমে ফুটিবে প্রাতে ॥

বৃষ্টিতে পড়ে থাকলে ভিজবে, রোদে ফেলে রাখলে পুড়বে, ফুলের বাগানে রাখলে সুগন্ধ পাবে, মাছের বেপারী হলে আঁশগন্ধ নেবে নাকে, সংসারে সংসারীর কোলাহল, মন্দিরে মন্ত্র, আরতির ঘন্টা, নিজেকে রাখা এইটাই হল বিজ্ঞান। মিনারে রাখলে আলো, বাতাস, দূরদর্শন, পাতালে অন্ধকার। কাকে রাখবে? দেহ নয়। এ বিজ্ঞানের সম্পর্ক দেহের সঙ্গে নয়, সে হল ভোগবিজ্ঞান, এ হল মনের ব্যাপার, মনোবিজ্ঞান।

প্রশ্ন করলুম, দামোদরের তীরের সেই গ্রামের পুকুরে আপনি যখন গভীর অন্ধকারে স্নান করতে যাচ্ছিলেন তখন আপনার পায়ের কাছে অলৌকিক আলো দেখেছি। সেটা কী?

আজ তুমি সবই জেনে নিতে চাইছ! তা নাও। আর তো তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না। আর আমার কণ্ঠও রুদ্ধ হয়ে যাবে। কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।

হরিশঙ্কর বললেন, তার মানে?

ছোটদাদু হাসলেন। গানের বাকি অংশটা শোনালেন,

এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানেগানে ॥
রাজার পথে লোক ছুটেছে, বেচা কেনার হাঁক উঠেছে
আমার ছুটি অবেলাতেই দিন-দুপুরের মধ্যখানে
কাজের মাঝে ডাক পড়েছে কেন যে তা কেইবা জানে ॥

হরিশঙ্কর অধৈর্য হয়ে বললেন, রহস্যটা কী?

রহস্য! এই পথে এক কাঁকড়া বিছে আছে। তার নাম কর্কট। শেষ সংগীত সেই লেখে। সে হল ঈশ্বরের দূত। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কী হয়েছিল হরি?

হরিশঙ্কর কেমন যেন আতঙ্কিত হলেন, তার মানে ক্যান্সার! তোর ক্যান্সার হবে?

হবে কী! হয়ে আছে।

সেকী! আমরা জানি না!

জানালে তো জানবি! কাল, কাল কেন আজই বলি, ভোর তো হয়েই এল। আজ বেলা বারোটার সময় আমার স্বর বন্ধ হয়ে যাবে। আর ঠিক এক মাস পরে আমার স্বরনালী ফেটে যাবে। ইট উইল ওপন আপা আমি ধীরে নিঃশব্দে বিলীন হয়ে যাব মহাকালে।

জয়নারায়ণ বললেন, তা কী করে হয়? আমাদের ফেলে চলে যাবেন? আমরা চিকিৎসা করাব।

ছোটদাদু বললেন, কর্কটের কোনও চিকিৎসা নেই। সারেন্ডারই চিকিৎসা। শুনে রাখো, আজ এই ঘরে এই মুহূর্তে আমরা যারা বসেছি জলসায়, সকলেই ওই একই আশীর্বাদে দেহমুক্ত হব। তোমার হবে প্রসট্রেটে, হরির হবে ইসোফেগাসে, পিন্টুর হবে লিভারে, মুকুর হবে ব্লাডে। নদীর এপার থেকে একটি একটি করে খুলে যাবে তরী। আগে আর পরে। এই পথের এই পরিণতি, মন খারাপ কোরো না। মনে দুটো আকার যোগ করো, হয়ে যাবে মানা। মন, মান, মানো, মানা, এই হল ম-এর শব্দরূপ। এখন পিন্টুর প্রশ্নের উত্তর, শোনো পিন্টু, যোগ মানে নিজের শক্তিবলয়ের সঙ্গে সম্যক সংযোগ। যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তা আছে এই দেহভাণ্ডে। তুমি বসে আছ ভূমিতে। তোমার মাথার চাঁদি, তার পরেই আকাশ। এই তো তোমার বিস্তৃতি। আকাশ মানে অবকাশ মানে আভাস মানে অক্লেশ মানে অশেষ। গুহ্য থেকে মস্তক-শীর্ষ, সাতটি ভূমি। সপ্তভূমিতে সহস্রার। সেই সহস্রদলকমলে পরমশিব, পরমাত্মা। কুণ্ডলিনীদেবী সেই পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের বাসনায় সদা ছটফট করছেন। পিন্টু, রমণ বাইরে নেই, আছে জীবের ভেতরে। যোনি দেহনিম্নে নেই আছে দেহশীর্ষে। কুণ্ডলিনী দেবী কখনও ভেক, কখনও মীন, কখনও বা মর্কট গতিতে মূলাধার থেকে সহস্রারে উঠছেন, নামছেন। পরমশিব কুণ্ডলিনীশক্তির আশ্রয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হতে চাইছেন। দেখছেন চিদাকাশে বিবিধ নাম রূপ-বিশিষ্ট বিশ্ব বুদবুদের মতো ফুটছে ফাটছে। কখনও তিনি সচ্চিদানন্দ সাগরে লীন হয়ে যাচ্ছেন। পিন্টু, সাধন ছাড়া এই উপলব্ধি কথার কথা। রাজপথ বাইরে নেই আছে ভেতরে। স্বর্গ, মর্ত, পাতাল এই ভেতরে। ভেতর থেকে বাইরে যেতে হয়। দু’জন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী পাহাড়তলিতে হাঁটছেন। গুরু আর শিষ্য। হঠাৎ এক সার হাঁস উড়ে গেল। গুরু শিষ্যকে জিজ্ঞেস করলেন, কী গেল? শিষ্য বললে, বুনো হাঁস। উড়ে যাচ্ছে কোথায়? শিষ্য বললে, প্রভু ওরা উড়ে চলে গেছে। গুরু সঙ্গে সঙ্গে শিষ্যের নাক খামচে ধরে মোচড়াতে লাগলেন। শিষ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল। গুরু বললেন, এই যে তুমি বললে উড়ে চলে গেছে। আমি দেখছি, শুরু থেকেই তারা এখানেই রয়েছে।

পিন্টু এর মানে কী? মন দেহেই বদ্ধ। দেহ ছেড়ে উড়তে পারে না, জানে না, অভ্যাস নেই। পারলে বলতে পারত হংসবলাকা কোথায় উড়ে যায়! জানতে পারত জীব কোথা হতে এসে কোথা ভেসে যায়। ছোটদাদু হঠাৎ ধ্যানস্থ। নীরব সরবতায় ঘর ভরে গেল। চাঁদ তুলে নিয়েছে লোটানো আঁচল। সূর্যসারথির স্বর্ণ ছায়ার মৃদু আভাস পূর্ব গবাক্ষে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *