২.৪৭ An animal with some instincts of a God

An animal with some instincts of a God,
His life a story too common to be told.

হরিশঙ্কর বেশ নিজের মনেই হাঁটছিলেন, হঠাৎ থেমে পড়লেন। পাদমেকং ন গচ্ছামি। ছোটদাদু বললেন, আবার কী সমস্যা?

হরিশঙ্কর বললেন, কোনও পরিস্থিতি থেকে কখনও আমি পলায়ন করিনি, আর সবচেয়ে বড় কথা হল, টুথ ইজ টুথ। সত্য হল, আমরা খুনি নই, তা হলে আমরা কেন সিচুয়েশন ফেস করব না! দিস ইজ কাওয়ার্ডিস!

ছোটদাদুর মুখে খেলা করে গেল সেই উদ্ভাসিত হাসি। আমরা গ্রামের সীমানার বাইরে চলে এসেছি। মন্দির, মসজিদ, পাম্প হাউস সব পেছনে ফেলে এসেছি। ফেলে এসেছি সায়েবকুটি বলে বিশাল এক বাগানবাড়ি। স্বদেশি আমলের চরকা প্রতিষ্ঠান। এখন যেখানে মেয়েদের তাঁত শেখানো হয়। হাতের কাজ শেখানো হয়। স্বদেশি কাগজ আর সাবান তৈরি হয়। সব পেছনে ফেলে এখন আমরা শুধু প্রান্তরে। রোদে চারপাশ দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কী দুর্গতি আমাদের! চামড়া পুড়ে কালো হয়ে আসছে।

ছোটদাদু বললেন, আমরা ওই ছায়ায় একটু বসি। তোদের একটু বোঝানো দরকার পরিস্থিতিটা কী দাঁড়িয়েছে। খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়।

বাঁ পাশে মাঠের মাঝখানে ঝকড়া একটা গাছ। ভাঙা একটা ঘর। কোনও সময় কিছু একটা ছিল। আমরা সেই দিকে এগিয়ে চললুম। হরিশঙ্কর লক্ষ্মী ছেলের মতো কেন এগিয়ে যাচ্ছেন আমি জানি। ওই ভাঙা বাড়ি। একটা সমাধি মতো রয়েছে পাশে। অতীত ডাকছে ইশারায়, ডাকছে অখ্যাত ইতিহাস। কেউ ছিল একদিন। কে তিনি? হরিশঙ্করের জানা চাই। লতাপাতার ইতিহাসে পড়ে আছে কারও পরিত্যক্ত সংসার। আমরা সকলেই বসে পড়লুম হরিশঙ্কর ছাড়া। তিনি সেই ভগ্ন কুটিরের ইতিউতি উঁকি মারতে লাগলেন।

ছোটদাদু বললেন, তুই তাড়াতাড়ি তোর অনুসন্ধান শেষ করে এদিকে আয়।

হরিশঙ্কর খুঁজে খুঁজে ঠিক একটা প্রস্তরফলক আবিষ্কার করলেন। উদ্ভাসিত মুখে বললেন, পেয়ে গেছি। সবই অস্পষ্ট, নামটা কোনওরকমে পড়া যায়, স্বামী তপানন্দ। এখানেও সন্ন্যাসী। ধর্মের এলাকা থেকে বেরোবার উপায় নেই। যেদিকেই যাও ধর্ম।

ছোটদাদু বললেন, বেশ হয়েছে, এখন চলে এসো।

হরিশঙ্কর এসে বসেই বললেন, তপানন্দ কে?

ছোটদাদু বললেন, নিশ্চয় কোনও সন্ন্যাসী।

তার চেলারা কোথায়? এইভাবে একটা সাধনপীঠ নষ্ট হয়ে গেল!

কত পীঠ এইভাবে নষ্ট হয়, ও নিয়ে মাথা খারাপ করার দরকার নেই। তুমি আসল সমস্যায় এসো।

হরিশঙ্কর গুছিয়ে বসলেন। ছোটদাদু পিসিমাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আশা, তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল, তুই তোর ঠাকুরপোকে ঠেলে ফেলে দিসনি তো?

হরিশঙ্কর লাফিয়ে উঠলেন, সে কী? আশা ঠেলে ফেলবে কেন? আশা খুনি? অসম্ভব! তুমি ভুল পথে যাচ্ছ। ঠিক হচ্ছে না।

পিসিমার মুখ ভয়ে সাদা। থেমে থেমে বললেন, এ তুমি কী বলছ ছোটমামা! অত বড় একটা মানুষকে ঠেলে ফেলা সম্ভব!

মাতালকে ফেলা সম্ভব। বিয়ের আগে পর্যন্ত তুই ডাকাবুকো ছিলিস। সত্যি কথা বল। তুই খুব রাগী। রেগে গেলে তোর জ্ঞান থাকে না। একবার তুই আমাদের জানলার গরাদ বাঁকিয়ে দিয়েছিলিস।

পিসিমা ছোটদাদুর গায়ে হাত দিয়ে বললেন, বিশ্বাস করো, তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, আমি কিচ্ছু জানি না।

তুই কোনও শব্দ পাসনি।

সত্যি পাইনি।

ছোটদাদু ছেলে আর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা কোনও শব্দ পাসনি?

তিনজনেই বললে, না। কোনও শব্দ শোনেনি।

হরিশঙ্কর বললেন, তুই কোনও ক্রিমিন্যাল ল-ইয়ার হলে মিজারেবলি ফেল করতিস। এটা একটা জেরা হচ্ছে?

ছোটদাদু বললেন, এদের ঘুম তা হলে কুম্ভকর্ণের ঘুম।

বলেই ছোটদাদু লাফিয়ে উঠলেন। আমি ভাবলুম পিঁপড়ে কামড়েছে। না, তা নয়।

ছোটদাদু বললেন, ইদারায় তা হলে একজন নয়, দু’জন পড়েছে!

হরিশঙ্কর বললেন, ফ্যান্টাসটিক ইম্যাজিনেশন। একা রামে রক্ষা নেই, দোসর লক্ষ্মণ। আর একজন কে? এ ধারণাটা তোর এল কোথা থেকে?

আমি একটা লাল কাপড় দেখতে পেয়েছি। সেটা একটা শাড়ির অংশ।

তার মানে?

মানে ভৈরব আর ভৈরবী দু’জনে জড়াজড়ি করে পড়েছে।

অসম্ভব। দু’জনের জায়গা হতেই পারে না।

অবশ্যই পারে। একজনের ওপর আর একজন। ঘটনাটা আমি দেখতে পাচ্ছি। ওই ভৈরবী ঠেলে ফেলে দিচ্ছিল। ভৈরব তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরেছিল। একজনের ভারে আর একজনও তলিয়ে গেল।

হরিশঙ্কর হাসলেন, তোর কাব্যপ্রতিভা আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু গোয়েন্দা গল্প লেখার ক্ষমতা একেবারেই নেই। দু’জন পড়ল, যে-কোনও একজন তার ঘাড়ে পা রেখে উঠে দাঁড়াত। সে বেঁচে থাকত। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করত। বেশ! হাতে পাঁজি মঙ্গলবার করে তো লাভ নেই, চলো তা হলে, ফিরে গিয়ে থানায় ইনফর্ম করি। দেখা যাক ক’জন ওঠে, একজন না দু’জন। কেস কোথায়। গড়ায় চলো দেখি।

একটা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে অত বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া যায় না। যদি ভৈরবী ইঁদারায় থাকে, আশার ওপর পুলিশের সন্দেহ পড়বে না। আর ভৈরবী যদি বেঁচে থাকে, আশাকে নিয়ে টানাটানি হবেই।

কেন হবে?

খুব সহজ। পুরো সম্পত্তিটা ভৈরবী দানপত্র করে নিয়েছে।

যদি সম্পত্তিটা নিজের নামে করিয়েই নিয়ে থাকে তা হলে খুনের কী প্রয়োজন?

দখল নেবার জন্যে।

শোন, তুই আধ্যাত্মিক লাইনের লোক, জাগতিক ব্যাপারে মাথা ঘামাসনি। শোন, আশাকে নিয়ে তোরা কলকাতায় চলে যা, আমি ব্যাপারটার শেষ দেখে যাই।

তোকে আর শেষ দেখতে হবে না। অনেক কিছু আছে যার শেষটা না দেখাই ভাল।

আমার এই পালিয়ে যাওয়াটা ভাল লাগছে না। ভীরু কাপুরুষ মনে হচ্ছে নিজেকে।

কিছুকাল আগে তুই ছেলেকে ছেড়ে পালিয়েছিলিস।

ওটা পালানো নয়, ওটা ছিল শিক্ষা দেওয়া। স্বাবলম্বী করার শিক্ষা। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা।

ঠিক আছে, এখন চল। আমাদের যাত্রা শুরু করা যাক।

শোন, তোর ভুল ধারণাটা ভেঙে দিই। ইদারায় একজনই আছে। দু’জন নয়। দেহটা ভাসছে। তলায় আর একটা দেহ থাকলে ওইভাবে ভাসতে পারত না। জলের উর্ধচাপ অতটা কাজ করতে পারত না। দিস ইজ সায়েন্স। আনন্দের কারণ নেই। ভৈরবী বেঁচেই আছে।

পিসিমা বললেন, ছোড়দা, আমরা চলে গেলে কোনও অন্যায় হবে না। তুমি আর ওই গ্রামের নোংরামির সঙ্গে জড়িয়ে পোড় না। সবাই গেজেল আর মাতাল। আমাদেরই জমি চারপাশ থেকে দখল করে বসে আছে। ওখানে বেড়া চলে চলে বেড়ায়। আজ দেখলে ওখানে, সকালে উঠে দেখলে। তিন হাত সরে এসেছে তোমার জমির ভেতরে। ক্ষমতা থাকে লড়াই করো। মাথা ফাটাফাটি, রক্তগঙ্গা। ওই ইদারাটা ওকে টানত। কেন জানো তো! সাত বছর আগে বুড়ো বাপকে পাঁজাকোলা করে ওর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল, বুড়ো মরছে না বলে। মদের ঘোরে। তারপর থেকেই মাঝরাতে ইদারার পাড়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে কাদত, বাবা, তুমি কী করছ ওখানে! উঠে এসো। তোমার জন্যে কাঠালি কলা এনেছি। ও তো আগে এইরকম ছিল না। মিলিটারিতে কাজ করত। এতখানি চেহারা ছিল। তারপর অসৎসঙ্গে পড়ে, মদ, ভাং, জুয়ায় এইরকম হয়ে গেল। আত্মহত্যাই করেছে ছোড়দা। মনটা তো খুব নরম ছিল।

আমরা আবার রাস্তায় এসে উঠলুম। আমাদের মুখ স্টেশনের দিকে। হরিশঙ্করের মুখ ছেড়ে আসা গ্রামের দিকে। ছোটদাদু ভাবলেন হরিশঙ্কর দিক ভুল করেছেন। বললেন, তুই যে উলটো দিকে চললি। স্টেশন তো এই দিকে!

হরিশঙ্কর চলা শুরু করে দিয়েছেন। চলতে চলতে বললেন, দিক ভুল করিনি। যেদিকে যাওয়ার সেই দিকেই চলেছি। ফলো মি।

ছোটদাদু ভীষণ অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করতে চাইছে বলো তো?

কিছুই বুঝতে পারছি না।

এতক্ষণ ধরে এতভাবে বোঝালুম, কিছুই ঢুকল না কানে!

দ্রুত এগিয়ে গেলেন ছোটদাদু, কী করতে চাইছিস?

হরিশঙ্কর বললেন, তুমি মামলায় হেরে গেছ। আমাকে অনুসরণ করো।

অনুসরণ করে?

সোজা থানায়। আমরা ছ’জন। ওরা ছিল দু’জন। এখন একজন। একা সেই ভৈরবী। আমরা হেরে যাব? তোমাকে দেখাতে চাই, সত্যের জয়। তুমি ধার্মিক, ঐশী শক্তির অধিকারী। তোমাকে দেখাতে চাই ধর্মের জয়। চোরের মতো পা টিপে টিপে পালাব। পালিয়েও শান্তি নেই, সর্বক্ষণ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। এই বুঝি পুলিশ এল। ধরে নিয়ে গেল খুনের দায়ে। তোমার কোনও ভয় নেই। আমার সঙ্গে চলো। আমার আত্মবিশ্বাস জয়ী হবেই। আমি যদি এই সিচ্যুয়েশন ফেস না করি, আমার বিবেক আমাকে সারাজীবন ঘুমোত দেবে না। বিবেক হল মেরুদণ্ড। তোমার এত কেন ভয়!

ছোটদাদু কিছুক্ষণ গুম মেরে রইলেন। তারপর বললেন, ঠিক বলেছিস। ভীরুতাই পাপ। ভীরুতাই অধর্ম। যা হবার তা হবে। চলো, লেট আস ফেস দি সিচুয়েশন।

আবার মাইল দুয়েক হাঁটতে হবে ভেবে আমার কান্না পেয়ে গেল। সারারাত জেগে। চান হয়নি। দানাপানি পড়েনি পেটে। রোদে সব ঝলসে যাচ্ছে। এই উদ্বেগ, এই উৎকণ্ঠা। জীবনের এইসব মুহূর্তে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। ঘটনা থেকে পালাতে না পারলে দেহ থেকেই পালানো ভাল। সে উপায়ও তো নেই। মৃত্যু ও হরিশঙ্কর সমান একগুঁয়ে। কারও কথা শোনে না। থানা, হাসপাতাল, সরকারি দপ্তর, কোর্টকাছারি, আমার ভেতরে অদ্ভুত এক অসুস্থ ভাব আনে। কী কুক্ষণেই আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম। ছোটদাদু এমন একজন অলৌকিক পুরুষ। মা কালীর সঙ্গে যার সরাসরি যোগাযোগ, তার শক্তিও বেকায়দা। মানুষ যে-ঘটনা ঘটাবে, যে-চক্রান্তে ফেলবে, সেখান থেকে বের করার ক্ষমতা ভগবানের নেই। ভগবান অতিশয় শৌখিন এক বড়বাবু। সুখীর সঙ্গ করেন। যে-মানুষ বিপদে পড়েছে তাকে বিপদের বিচারেই ছেড়ে দেন। ভাল যার হয় তার নিজের শক্তিতেই হয়। আশ্রমের ছবি মন্দিরের ছবি চোখের সামনে ভাসছে। একদল আর্ত কাতর নরনারী। জীবনের মুড়ো ঝাটায় ক্ষতবিক্ষত। মন্দির, দাঁতব্য চিকিৎসালয়, বড়লোকের চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, এক চেহারা। মানুষ চাইতে এসেছে। শেষের দুটোয় তবু কিছু মেলে। প্রথমটায় সবই ফক্কা। বসে বসে নিজের বুড়ো আঙুল চোষো।

হঠাৎ হরিশঙ্কর আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, কেন এমন বিরস বদন হেরি সখী। বড় বিপদে পড়েছ তাই না? কোথায় তোমার সুখশয্যা! সুদৃশ্য স্নানঘর, সুগন্ধী সাবান! Soak your life in a gallon of danger, spice it with powder of time and slowly roast it in the fire of your courage and enjoy a good dinner. বুঝলে কিছু? এক গ্যালন বিপদে জীবনটাকে চোবাও, চূর্ণ সময়ের মশলা মেলাও, সাহসের আঁচে ধীরে ধীরে রোস্ট করো, বসে যাও জীবনের মহাভোজে। আজ তাই হবে। তোমাদের সন্দেশ মারা ফুরফুরে আধ্যাত্মিকতার কোনও স্থান নেই রক্তমাংসের পৃথিবীতে। ওটা এক ধরনের রোমান্টিকতা। বড়বাবুদের বিলাসিতা। লাঙল, কোদাল, কুড়ল, খোস্তা, ছোরাছুরি, কাড়াকাড়ি, ছেঁড়াছিড়ি, এই হল জীবন। কোথায় গেল তোমাদের হিউমার? মুখ দেখে মনে হচ্ছে বধ্যভূমির দিকে চলেছ! এসো গান ধরো, জগৎজননী জাগিয়াছে আজি, জয় মা তারিণী গাও রে,বাজাও ডঙ্কা, নাহিকো শঙ্কা, ঘুচে গেছে ভবভয় রে ॥

হরিশঙ্কর নিজেই গাইছেন। এই অবস্থায় গলায় সুর আসছে! কোন উৎস থেকে এই ভয়ংকর শক্তি আসে! আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। ছোটদাদু কি পরাজিত হলেন হরিশঙ্করের জীবনবেদের কাছে? তন্ত্র-মন্ত্র সব বোগাস? আমরা দেখতে দেখতে থানার চৌহদ্দির মধ্যে এসে ঢুকলুম। বিশাল একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ঝিলমিল করে আলোর বিলিব্যবস্থা করছে। ঢনঢনে একটা জিপ গাড়ি জরদগব প্রশাসকের মতো একপাশে পড়ে আছে। একজন হাবিলদার বগলে লাঠি চেপে হাতের তালুতে খইনি ডলছে। আমাদের দেখে ফটাস ফটাস করে তিনবার চাপড় মারলে, সাদা চুনের গুঁড়ো উড়ে গেল খানিক।

কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় পিসিমারা থমকে দাঁড়ালেন। আমরা তিনজন এগিয়ে গেলুম। হরিশঙ্কর হঠাৎ আমাকে বললেন, মনে করো আমি নেই, তুমি কেসটা হ্যান্ডল করো তো!

ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। এ যে দেখি বিপদের ওপর বিপদ। ডবল বিপদ। তবু মনে হল হেরে যাব? মনে পড়ে গেল হরিশঙ্করের পুরনো শিক্ষা! লেখাপড়ায় লাগাতে বলেছিলেন– সবসময় ভাববে তুমি একজন অথরিটি। তুমি কারও চেয়ে কম যাও না। কেউ তোমার চেয়ে শক্তিশালী নয়। হারার আগে হেরে যাবে না। লড়াই করে হারো, হারবে। আমি ভয় করব না ভয় করব না/ দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না ॥/ তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে। তুফান মেলে–

এগিয়ে গেলুম সেই কনস্টেবলের দিকে। বেশ বড় একটা গোঁফের মালিক, কিন্তু গলাটা ভীষণ সরু। যতটা কঠোর হবেন ভেবেছিলুম ততটা কঠোর নন। মোটা লাঠিটা শুধুমাত্র প্রভুত্বের প্রতীক। গরম বাতাস, কৃষ্ণচূড়ার ঝিলিমিলি ছায়া। অসম্ভব সরু গলায় প্রশ্ন এল, কী চাই?

অফিসার ইনচার্জের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

কী কেস!

একটু থতমত খেয়ে গেলুম। কেসটা কী? কী বলব? হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমরা কলকাতা থেকে আসছি।

কনস্টেবল অবাক করে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাদের তো আসার কথা ছিল। এত দেরি হল!

অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে হরিশঙ্করের দিকে তাকালাম। ছোটদাদু হাসছেন মৃদু মৃদু। কী উত্তর দোব? হয়তো অন্য কারও আসার কথা।

কনস্টেবল বললেন, যান যান, তাড়াতাড়ি যান। অফিসঘরে অপেক্ষা করছেন।

একটু আগে কেসটা যাই থাক, এখন আরও জটিল হয়ে গেল। কে আসবে, কারা আসবে! সম্মানিত ওপরঅলা কেউ? এসে পড়েছি আমরা। প্রথমে খাতির। তারপর যেই জানবেন, আমরা তারা নই, তখনই ভয়ংকর অবহেলা। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। বলতেও পারছি না। অহংকারের বাধা!

হঠাৎ ছোটদাদু এগিয়ে গেলেন। এক মাথা কঁচাপাকা কোকড়া কোকড়া চুল। ধবধবে সাদা টুইলের শার্ট রোদে ঝলসাচ্ছে। অপরাজেয় ছোটদাদু। পেছনে আমরা। হরিশঙ্কর অবিচলিত। দেখে মনে হচ্ছে, কোনও ঘটনার মধ্যেই তিনি আর নেই। থেকেও না-থাকাটা হরিশঙ্করের সাধনা। এ আমি আগেও দেখেছি অজস্রবার।

রক পেরিয়ে অফিস। থানার অফিস যেমন হয়। কেঁদো টেবিল। গোদা চেয়ার। অসম্ভব সুন্দর ইউনিফর্ম পরা একজন মানুষ বসে আছেন। সামনে খোলা খাতা। একপাশে ব্যাটন, আর একপাশে টুপি। আমরা ঢোকামাত্রই বললেন, আসুন, আসুন। আপনারা এই বাঁকুড়ার অজ-শহরে?

ছোটদাদু চেয়ার টেনে আর এক অফিসারের মতো বসতে বসতে বললেন, আপনি যাদের কথা ভাবছেন আমরা কিন্তু তারা নই।

অফিসার বললেন, আপনারাই। আপনি তারাপীঠের মহাসাধক। আপনার লেখা বই আমার বাবা পড়েন। আমার ছোটভাই জেসপের ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতায় থাকে। তাকে আপনি গত বছর দীক্ষা দিয়েছেন।

ছোটদাদু বললেন, আমরা আসব জানলেন কী করে?

ওইখানে একটু পুলিশি বুদ্ধি আছে। আপনারা সকালে যে-দোকানে জিলিপি আর চা খেয়েছেন, সেই দোকানে রোজ আমাকেও একবার যেতে হয়। সেরা খাবার। সেখানে গিয়ে শুনলুম, আপনারা গ্রামে ঢুকেছেন। তা থানায় কেন আসবেন! হঠাৎ স্কুলের হেডমাস্টারমশাই তারিণীবাবু খবর আনলেন রাধাবাবুর ইঁদারায় মৃতদেহ। আরও বললেন, তিন ভদ্রলোকের সঙ্গে রাধাবাবুর পরিবার ছেলেমেয়ে নিয়ে স্টেশনের দিকে গেলেন। আবার এও বললেন, রাধাবাবুর ভাই গতরাতে রাধাবাবুর বিধবা পত্নীকে বেধড়ক পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। ঘর থেকে টেনে বাইরে ফেলে দিয়ে দোরতাড়ায় তালা মেরে হাওয়া হয়ে গেছে। এইবার আমার ডিডাকশন, ঝামেলার ভয়ে প্রথমে আপনারা পালাতে চাইবেন, তারপর আপনাদের বিবেক আর বুদ্ধি কাজ করবে। আপনারা ফিরে আসবেন। কোথায় আসবেন? থানায় আসবেন। এমন সময় আমাদের হেড কনস্টেবল এসে জানাল, আপনারা আসছেন। সে আপনাদের ওভারটেক করে জিপে করে আসছিল।

হরিশঙ্কর বললেন, ওয়ান্ডারফুল! পারফেক্ট ম্যাথমেটিক্স। আমি ভাবলুম অলৌকিক কোনও দূত এসে আপনাকে খবর দিয়েছে।

অফিসার বললেন, আপনি? আপনার পরিচয়?

ছোটদাদু বললেন, আমার ভাগনে।

অফিসার হুংকার ছাড়লেন, উদাস!

উদাস যে কারও নাম হতে পারে, ভাবা যায় না। কুচকুচে কালো একটি ছেলে ঘরে এল। চায়ের হুকুম হল। পুলিশ ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলে গেছেন। ডেডবডি তুলতে সময় লাগবে কিছুক্ষণ। তারপর যাবে পোস্টমর্টমে।

ছোটদাদু বললেন, আমার ভাগনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেমেয়ে নিয়ে।

অফিসার বললেন, এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি আমার কোয়ার্টারে।

হরিশঙ্কর বললেন, সেটা যে বড় অস্বস্তিকর হবে আপনার পরিবার-পরিজনের পক্ষে। আচ্ছা কোনওরকমে তালা ভেঙে ওদের গৃহপ্রবেশ করানো যায় না?

অফিসার চেয়ার ছেড়ে উঠেছিলেন, আবার বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ ভাবলেন। ভেবে বললেন, তালাটা ভাঙলে কী এমন বেআইনি হবে! প্রপার্টিটা কার?

হরিশঙ্কর বললেন, রাধা ভাইকে লিখে দিয়েছিল এটুকু জানি। তারপর কার হাতে গেছে জানি না। তবে এর মধ্যে কে এক ভৈরবী আছে।

ও সব ভৈরবী-টেরবি আমরা গ্রাহ্য করি না। আমরা আইন দেখব। তালা ভাঙার অধিকার পুলিশের আছে। অনুসন্ধান সার্চ আমাকে করতেই হবে। এটা যদি মার্ডার কেস হয়?

হরিশঙ্কর বললেন, মার্ডার হতে পারে?

সবই হতে পারে। পুলিশ লাইনে থেকে বুঝেছি, পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়। টাকার জন্যে মানুষ পারে না এমন কাজ নেই। সব পারে।

প্রায় মগের মতো আকার এক একটা কাপের। স্ট্রেচারের মতোই বড় ট্রে-তে চেপে চলে এল চা। চায়ে চান করা যায়। এদিকে খালি পেটে চো চা শব্দ হচ্ছে।

অফিসার বললেন, তাড়াতাড়ি শেষ করে নিন। চায়ের সঙ্গে আর কিছুই দেওয়া গেল না।

আমরা কোঁত কোঁত করে চা শেষ করলুম। জিপ আমাদের নিয়ে চলল ঘটনাস্থলের দিকে। বেশ ভিড় জমে গেছে। দেহ সবে তোলা হয়েছে ইঁদারা থেকে। মাঝারি গড়নের একজন মানুষ। কঁকড়া চুল। গলায় জড়ানো লাল একটা কাপড়ের টুকরো। ঠোঁট ফাঁক। গাজলা বেরিয়েছে। হাতের মুঠোয় শক্ত করে কী একটা ধরা। দেহটা উঠোনে চিত হয়ে পড়ে আছে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক তারিণীবাবুর সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, একটা মহৎ পরিবার এইভাবে শেষ হয়ে গেল। নেশাভাং মানুষকে কোন দুর্গতির দিকে নিয়ে যায়! কী ছেলে ছিল! শেষ পরিণতিটা কী হল!

তাঁর আক্ষেপ শোনার মতো কেউ নেই। ভয়ংকর কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। পুলিশের নানা ফ্যাচাং। কোথায় কী পড়ে আছে, তার অনুসন্ধান। খাঁড়া, খড়ম। বিড়ির টুকরো। পায়ের ছাপ। সেই ছাপে আমাদের পা আছে। দাওয়া থেকে ইঁদারার দূরত্ব। শুরু হল জেরা। কী ক্লান্তিকর ঘটনা। এরই নাম তল্লাশ। খাতায় লেখা হচ্ছে মৃতের বর্ণনা। মিডিয়াম বিল্ড। ফেয়ার কমপ্লেকশনড। লং কারলি হেয়ার। হাইট। বার্থমার্ক। পার্টেড লিপস, ফোমিং। বালজিং আইজ। ঘাস্টলি স্টেয়ার। ক্লেঞ্চড ফিস্ট। ব্রুইজ, কাটস, ল্যাসিরেশন। সোলেন টেস্টিকলস। ডিস্টেন্ডেড স্টম্যাক। ফেন্ট রেড স্পট অন দি ফোরহেড, নট ব্লাড। রাইগার মরটিস হ্যাঁজ স্টার্টেড। বর্ণনার শেষ নেই।

রামশঙ্কর, কুম্ভকার। তিনি কাল মৃতকে কখন দেখেছেন? কী অবস্থায় দেখেছেন? প্রসাদ রায়, পুরোহিত। কাল শেষ কথা কখন বলেছেন, কী বলেছেন? আমরা প্রথম এসে কী দেখেছি? ইঁদারায় প্রথম কে দেখে? কী অবস্থায় দেখেছে? আমরা কী দেখলুম? আমরা কেন এলুম? কী জন্যে এলুম? কাল রাতে কোথায় ছিলুম? প্রশ্নের পর প্রশ্ন।

অবশেষে চাদর- চাপা দেহ চলে গেল পুলিশের হেফাজতে। অফিসার কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন, এইবার তালাটা ভাঙা যাক। তারিণীবাবু, আপনি সাক্ষী থাকুন।

একটা চাড় মারতেই তালা খুলে গেল। দরজাটা খোলার সময় কবজায় কিচ করে একটা শব্দ হল। ঢুকতে গিয়ে সবাই থমকে গেলেন। তারিণীবাবু, অফিসার, সহকারী সবাই। ঘরটা বেশ বড়ই। চাপা আলো থমথম করছে। সামনেই লাল মেঝেতে স্বাস্থ্যবান এক মহিলার মৃতদেহ চিত হয়ে পড়ে। আছে। পরনে লাল টকটকে কাপড়। গলার ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে বুকের কাছটা দগদগে লাল। এলোচুল ছড়িয়ে আছে চারপাশে। কপালে বিশাল লাল টিপ। ফরসা টকটকে রং। কশ বেয়ে পিলপিল করে নেমে আসছে কালো পিঁপড়ের দল। পা দুটো দুপাশে ছড়ানো। এক হাতের মুঠোয় একটা তাবিজ। অফিসার বললেন, ঘাস্টলি মার্ডার। গ্যাপিং উন্ড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *