2 of 3

২.৪৭ অ্যালুমিনিয়ামের বাটি

একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটি ভর্তি মাছের ঝোল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো মঞ্জু। একতলার রান্নাঘরে ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ হচ্ছে, তা শুনে বুঝলো যে মনিরাদের এখনও খাওয়া দাওয়া হয়নি। কে এসে একেবারে রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো, এই নে, এটা রাখ।

নিচের এই ঘরটি এক সময় নোকরের ঘর ছিল, একটি মাত্র উত্তরের জানলা, প্রচণ্ড গরম। মনিরার সারা মুখ ঘামে ভরা। একটা কস্তা ডুরে তাঁতের শাড়ি পরে আছে সে, শাড়িটা বেশ ময়লা।

দুঃখিত মুখ তুলে সে বললো, আবার কী আনছেন, আপা? কেন যে আপনে…

–নে, ধর আগে। দেখিস, গরম…

–এতগুলি মাছকে খাবে?

মঞ্জু দেখলো, কড়াইতে কী একটা শাক চড়িয়েছে মনিরা। মঞ্জু শাকপাতা বিশেষ চেনে না, তাদের বাড়িতে কেউ ওসব খায়ও না। মনিরা একদিন গল্প করেছিল, পাশের পাড়ার বড় উকিল সইফুদ্দিন চৌধুরীদের বাড়ির পেছনের পুকুর ধারে কলমী শাক ফলে থাকতে দেখে সে কোঁচর ভর্তি তুলে এনেছে। বিনা পয়সায় হয়ে গেল। মঞ্জুর ধারণা, বিনা পয়সায় যা পাওয়া যায়, তা আগাছা, তা মানুষের খাদ্য নয়। পুকুর ধারে তো গরু-ছাগলে এসব খায়। মনিরার কর্মী শাকের গল্প শুনে মঞ্জুর কষ্ট হয়েছিল।

আর একদিন মঞ্জু দেখেছিল, মনিরা লাউয়ের খোসা আর আলুর খোসা ভাজছে। ঐ ফেলে দেবার জিনিসগুলো কোনদিন কারুকে ভেজে খেতে দেখেনি মঞ্জু।

আজ মনিরা বেঁধেছে, ভাত, ডাল, আর একটা লাউয়ের ঘন্ট, কড়াইতে চাপানো শাকটাই তার শেষ পদ। মঞ্জু চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। সিরাজুলের মতন একটা জোয়ান ছেলে এই খেয়ে রোগা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সিরাজুলকে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে বাবুল। দিন-কাল পত্রিকা অফিসে সে একটা প্রুফরিডারের চাকরিও পেয়েছে। দিনেরবেলা কলেজ, রাত্তিরে কাজ। প্রুফরিডারের চাকরির মাইনে সামান্য হলেও সিরাজুলের আত্মসম্মান বোধ আছে, বাবুলদের কাছে সে পুরোপুরি আশ্রিত হয়ে থাকতে চায় না, মঞ্জু প্রথম থেকে অনুরোধ করলেও সে অন্নদাস হতে রাজি হয়নি। ওরা দু’জনে আলাদা রান্না করে খায়।

ওই অল্প বয়স্ক দম্পতিকে মঞ্জু খুব কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করে। সকালে ওরা নাস্তার সময়েও ভাত খায়, পান্তা ভাত। একটু পেঁয়াজ কাঁচা মরিচ আর শুধু ভাত। তারপর দুপুরে ভাত খায়, রাত্তিরেও ভাত খায়। সঙ্গে সামান্য কিছু ভাজি আর সবজি। মাছ-মাংসের নামগন্ধ নেই, বড়জোর দু-একদিন আন্ডার ঝোল। একদিন দুপুরে মনিরা শুঁটকি মাছ রান্না করেছিল, ঠিক সেইদিনই সে সময়ে এ বাড়িতে আলতাফ এসে উপস্থিত। গন্ধ পেয়ে সে বাড়ি মাথায় করে তুললো।

মঞ্জর শ্বশুর বাড়িতে শুঁটকি মাছ খাওয়ার চল নেই। আলতাফ বাবুলদের স্বভাবে বেশ শহুরে শহুরে ভাব, আলতাফ তো এখন পুরোদস্তুর সাহেব। এ বাড়িতে সিরাজুল-মনিরাকে থাকতে দিতে আলতাফ আপত্তি করেনি, তা বলে বাড়িটাকে ভাড়াটে বাড়ি বানিয়ে তোলা চলবে না। শুঁটকি মাছ ফাচ রান্না করা চলবে না, সদর দরজা দিয়ে দেখা যায় এমন জায়গায় শায়া লুঙ্গি মেলা চলবে না, স্বামী-স্ত্রীর কথা কাটাকাটির সময় দরজা-জানলা বন্ধ রাখতে হবে, পাড়া-প্রতিবেশীদের শোনানো চলবে না।

এরপর মঞ্জু কতবার মনিরাকে অনুরোধ করেছে শুঁটকি মাছ রান্না করার জন্য, সে নিজে খেতে চেয়েছে, তবু মনিরার জেদ, সে আর একদিনও শুঁটকি রাঁধেনি। মনিরাদের জামা কাপড় সে ছাদে শুকোতে দিতে বলেছে, কিন্তু মনিরা ছাদে যায় না, বোধ হয় জামা-কাপড় কাঁচেই না। ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কখনো কথা কাটাকাটি হয় কি না, তাও টের পায় না মঞ্জু।

আলতাফ অবশ্য নির্দয় নয়। সিরাজুলকে সে নিজে ডেকে তাদের পত্রিকায় চাকরি করে দিয়েছে, মনিরাকেও সে হোটেলে একটা কাজ দিতে চেয়েছিল। মনিরার কম বয়েস সে চটপট কাজ শিখে নিতে পারবে, প্রথম কিছুদিন সে হোটেলের ঘরে ঘরে বিছানার চাঁদর, বালিশের ওয়াড়, বাথরুমের তোয়ালে বদল করার কাজ করবে, তারপর সে স্টোরকীপারের পদে প্রমোশন পেতে পারে। তখন অনেক মাইনে হবে। কিন্তু সিরাজুল তার স্ত্রীকে চাকরি করতে পাঠাতে রাজি হয়নি।

তা হলেও, এ বাড়িতে এলেই আলতাফ একবার করে ওদের খোঁজ খবর নেয়। গত মাসেও আলতাফ সিরাজুলকে একটা প্রস্তাব দিয়েছে। নিউ এস্কাটনে আলতাফ নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট বাড়ি বানাচ্ছে, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, সিরাজুল ইচ্ছে করলে সেই বাড়ির কেয়ারটেকার হয়ে থাকতে পারে, সেখানে তারা দুখানা ঘর পাবে এবং কোনো ভাড়া লাগবে না।

সিরাজুল তাতেও রাজি হয়নি, সে বলেছে যে বাবুলভাইয়ের কাছ থেকে সে পড়াশুনা দেখে-বুঝে নেয় প্রায়ই, সেইজন্য সে বাবুলভাইয়ের থেকে দূরে থাকতে চায় না।

বাবুল অবশ্য মঞ্জুকে বলেছে যে কলেজী শিক্ষা পাওয়ার জন্য সিরাজুল নোয়াখালি থেকে ঢাকা চলে এলেও তার লেখাপড়া শেখার আশা খুবই কম। তার স্কুলের শিক্ষার ভিতই খুব কাঁচা, তার ওপর দু-তিন বছর গ্যাপ গেছে। ছেলেটার ইচ্ছে আছে খুবই, গোঁয়ারের মতন মুখস্ত করতে পারে কিন্তু বেশিক্ষণ পড়ার সময়ও তো তার নেই। গরিবের ছেলে যদি ছাত্রজীবনেই সংসারী হয় তাহলে তার লেখাপড়া শেখার শখ অনেকটা কাটা মুণ্ডের দিবাস্বপ্নের মতন।

প্রথম কিছুদিন বাবুল নিজেই খুব গরজ করে সিরাজুলকে নিয়ে পড়াতে বসিয়েছে, এখন সে সিরাজলুকে এড়িয়ে চলে। তার ধারণা, ওকে সারাজীবন ঐ প্রুফ রিডার হয়েই কাটাতে হবে, একটা ডিগ্রি জোগাড় করতে না পারলে সে সাব-এডিটরও হবে না!

একমাত্র মঞ্জুই হাল ছাড়েনি। সিরাজুলের উদ্দীপনাময় মুখ ও মনিরার সরল, জেদী জেদী ভাব দেখলে তার মায়া হয়। মনিরার বয়েস সবে মাত্র সতেরো আর সিরাজুলের একুশ, তারা নিতান্তই গ্রাম্য তরুণ-তরুণী, কিন্তু মোটেই তারা অতি সাধারণ নয়। তাদের চরিত্রে কোথাও একটা বিশেষ জোর আছে, সবরকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেই তারা হাসি মুখে থাকতে পারে।

একটা কাঁঠাল কাঠের পিড়ি টেনে নিয়ে বসে পড়ে মঞ্জু বললো, আরে ছেমরি, মুখখানা যে তোর কালিবর্ণ হয়ে গেল, এত মন দিয়া কী ছাই ঘাসপাতা রানতেছোস?

মনিরা বললো, এগুলা চেঁকি শাঁক, আপনেরা খান না, আপা?

মঞ্জু হেসে বললো, আমাগো পাকের ঘরে এইসব হাবিজাবি ঢোকে না, বাবুরা মাছ আর গোস্ত ছাড়া কোনো ভেজিটেবলই পছন্দ করেন না। কোন এক রাইটারের গল্পে যেন ভেঁকির শাকের কথা পড়ছিলাম, খাওয়া তো দূরে থাক, দেখি নাই কখনো। দে তো, একটু চাইখ্যা দেখি!

–আপনে খাবেন আপা? কী যে কন! আপনেগো খাওনের মতন না, আমি ভালো রানতেও জানি না!

–তুই দে তো ছেমরি!

মনিরা খুব শঙ্কুচিত বোধ করে। মঞ্জু মাঝে মাঝেই এসে তার হাতের রান্না কিছু না কিছু খেতে চায়। এইসব কি দেওয়া যায় ওকে? তাছাড়া কোন পাত্রে দেবে, তাদের ঘরে অতি শস্তার কলাইকরা কয়েকটা থালা গেলাস ছাড়া আর কিছু নেই।

বাবুল চৌধুরীর জীবিকা অধ্যাপনা হলেও সে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইনের টাকায় তাকে সংসার চালাতে হয় না। তাদের টাঙ্গাইলের বাড়ি থেকে সারা বছরের খোরাকি চাল আসে। চিড়ে-খই-গুড় আসে। ঘি আসে, কখনও কখনও মাছও আসে। তাছাড়া ঢাকা শহরেই বাবুলদের পরিবারের আর দুটি বাড়ি আছে অফিস পাড়ায়, তার ভাড়ার একটা অংশ পায় বাবুল। মঞ্জুও এসেছে সচ্ছল পরিবার থেকে। ওদের চেহারার জৌলুসই অন্যরকম। গ্রামে থাকার সময় মনিরার কাছে এইরকম চেহারার মানুষরা ছিল, অতি দূরের মানুষ, আর এখন এক অপরূপ সুন্দরী বড়লোকের বউ কি না তার রান্নাঘরে পিড়িতে বসে তার হাতের রান্না খেতে চাইছে!

কড়াইটা উনুন থেকে নামিয়ে মনিরা জিজ্ঞেস করলো, শুধা শুধা খাবেন, না দুগগা ভাত দিয়া খাবেন?

–দে, একটু ভাত দে!

একটি কলাইকড়া থালায় খানিকটা ভাত, চেঁকির শাক আর লাউয়ের ঘন্ট বেড়ে দিল মনিরা। এদের দুটিই মাত্র থালা। এখন যদি সিরাজুল এসে পড়ে তাহলে মনিরার নিজের খাওয়ার জন্য এই থালা মেজে নিতে হবে। ওপরতলায় মঞ্জুর সংসারে থালাবাসন অজস্র, আগেকার বড় বড় কাঁসার থালা, এখনকার স্টেইনলেস স্টীল ও চিনেমাটির প্লেট, তার থেকে কয়েকখানা এদের অনায়াসে দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু মঞ্জু বুঝে গেছে, এদের অযাচিতভাবে সাহায্য করতে গেলেও এরা নেবে না। সিরাজুল মনিরার এই তেজটাও মঞ্জুর পছন্দ হয়।

মঞ্জু বললো, লাউয়ের রান্নাটা তো বেশ ভালো হয়েছে রে! জিরা ফোঁড়ন দিয়েছিস বুঝি?

–না, আপা, কিছুই দিই নাই। চেঁকির শাকটা বুঝি ভালো লাগলো না?

–কেমন যেন কাঠি কাঠি!

মনিরা চোখ গোলগোল করে বললো, খাইছে! তাইলে বোধ হয় এগুলা পাগলা চেঁকি! আমি চেনতে পারি নাই!

–পাগলা চেঁকি! সে আবার কী?

–দুই রকম চেঁকির শাক আছে। পাগলা চেঁকির কোনো শোয়াদ নাই।

–এগুলাও তুই দীঘির ধার থিকা উঠাইয়া আনছোস বুঝি?

মনিরা লাজুক ভাবে হাসলো। দিনেরবেলা সে বিশেষ বাড়ি থেকে বেরোয় না। ভোরবেলা, সিরাজুলের ঘুম ভাঙার আগে, সে এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরে আসে, কোনো মাঠ থেকে নিয়ে আসা নিমপাতা, কোনো রাস্তার ধার থেকে ডুমুর, কোনো বাগান থেকে কাঁচা তেঁতুল।

মঞ্জু বললো, তুই অতটুক একটা ছেমরি, তুই অ্যাতসব জানলি ক্যামনে রে? আমি তো পাগলা চেঁকির নামই শুনি নাই।

–আমরা তো গ্রামের মাইয়া, আপা।

সিরাজুল তাকে বলে ভাবী, মনিরা বলে আপা। মঞ্জুর অনেক ভাই বোন, আপা ডাকটি শুনতেই সে বেশি অভ্যস্ত।

সদর দরজা দিয়ে কে যেন ঢুকলো, মনিরা’ উৎসুক ভাবে দেখতে গেল বাইরে বেরিয়ে। সে ফিরে এলো একটু বাদে, তার মুখের শুকনো ভাবটা দেখেই মঞ্জু বুঝলো, সিরাজুল আসেনি।

–কে আসলো রে?

–বাবুল সাহেব। আমি পানি দিতেছি, হাত ধুয়ে ন্যান।

মঞ্জু ভুরু কুঁচকে একটুক্ষণ চিন্তা করলো। বাবুল চৌধুরী সাড়ে দশটা-এগারোটায় ভাত খেয়ে বেরিয়ে যায়, দুপুর-বিকেলে কোনোদিনই বাড়ি আসে না, কোনো কোনোদিন রাত ন’টা দশটার আগে ফেরেই না, মাঝখানে খিদে পেলে কোনো দোকানে কিছু খেয়ে নেয়। সিরাজুল নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে সকাল ন’টার মধ্যে, দশটা থেকে তার ক্লাস; যেহেতু বাইরে খাওয়ার পয়সা থাকে না তার, তাই প্রত্যেকদিন দুপুরে বাড়িতে খেতে আসে। আজ তার আসার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।

মঞ্জু যে বাটি ভর্তি করে মাছ এনেছে, তার মধ্যে রয়েছে মস্ত বড় একটা কালা মাছের মুড়ো। আলতাফ হোটেল থেকে প্রায়ই মাছ পাঠায়, তাদের বিলেতি ধাঁচের হোটেলে মাছের মুড়োর খদ্দের নেই বলেই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। অত বড় মুড়ো ফ্রিজে রাখার অসুবিধে বলেই মঞ্জু নিচে নিয়ে এসেছে, এরকম একটা ব্যাখ্যা একটু আগেই মনিরাকে শোনাতে হয়েছে।

এবারে সে মুড়োটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো, ঐইটা তোরা দুইজনে ভাগ করে খাবি। মনিরা বললো, আমি মুড়া খাই না। ও তো পুরুষ মাইনসে খায়। আপা, সাহেব আসছেন, আপনে উপরে যান এবার।

–দাঁড়া! আমি কি সাহেবের কেনা বাঁদী নাকি, তিনি যখন-তখন আইলেই আমারে গিয়া পদসেবা করতে হবে?

মনিরা আবার বিস্ফারিত চোখে তাকায়। সিরাজুল ও তার কাছে বাবুল একজন পীর-সদৃশ পুরুষ। বাবুল তাদের অনেক উপকার করেছে বলেই নয়, বাবুলের মধ্যে যে একটুও দেখানেপনার ভাব নেই, সেটাই তাদের মনে বেশি শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। আলতাফের মতন বাবুল কখনো উঁচু থেকে কথা বলে না। বাবুলের জন্য এরা দু’জন প্রাণ দিতেও প্রস্তুত।

ওপর থেকে বাবুলের ডাক শোনা গেল, সেফু, সেফু!

মনিরা বললো, ওই যে সাহেব ডাকছেন।

মঞ্জু দুষ্টুমী করে বললো, আমাকে তো না, সেফুকে ডাকছে। তুই কি আমাকেও চাকরানীর সমান ভাবিস নাকি?

এই সব বাড়ির কর্তারা যে স্ত্রীর নাম ধরে ডাকার বদলে ঝি-চাকরের নাম ধরেই চেঁচিয়ে ডাকেন, মনিরা তা জানে। মঞ্জুর ব্যবহার দেখে ক্রমশই সে অবাক হচ্ছে।

রান্নাঘরের এক কোণে মঞ্জু হাত ধুয়ে নিল। নিজের আঁচলেই মুছে নিল হাত। ওপরে তাদের পিংক টালি বসানো বাথরুমে বেসিন ও তোয়ালের রংও পিংক। তবু মঞ্জু যেন মনিরার এই দমবন্ধ করা রান্নাঘরেই সময় কাটাতে পছন্দ করছে।

এরপর একটা রিনরিনে শিশুকণ্ঠে আম্মা আম্মা ডাক শুনে মঞ্জু চঞ্চল হয়ে উঠলো। স্বামী নয়, ছেলের ডাকেই মঞ্জু ওপরে উঠে গেল দ্রুত।

সিঁড়ির মাঝামাঝি নেমে এসেছে সুখু, মঞ্জু তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, কী রে?

–আব্বু তোমায় ডাকছে!

মায়ের কোলে সে থাকতে চায় না এখন। সে সেফুর সঙ্গে লুডো খেলছিল। মঞ্জু ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে শয়নকক্ষে গেল।

জুতোও খোলেনি বাবুল, জানলার ধারে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে চোখের সামনে বই মেলে ধরেছে।

সঙ্গে সঙ্গে রাগ হয়ে গেল মঞ্জুর। বাড়িতে ফিরেই যদি বই পড়তে হয়, তা হলে মঞ্জুকে ডাকা কেন? কিছুদিন ধরেই মঞ্জু লক্ষ করছে, বাবুলের মধ্যে একটা উদাসীন ভাব। বাবুল চৌধুরীর চরিত্রে রূঢ়তা বা অভদ্রতা একটুও নেই, তবু সে যেন অতি সূক্ষ্মভাবে মঞ্জুকে অবজ্ঞা করে চলেছে। কেন, তার কারণ কিছুই জানে না মঞ্জু।

মঞ্জু কয়েক মুহূর্ত আড় চোখে তাকালো তার স্বামীর দিকে। বাবুল কথা না বললে সেও কথা বলবে না। সে হঠাৎ দেয়াল আলমারি গুছোতে শুরু করলো। আলমারিটার একটা পাল্লা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসে, সেটা আবার খুলতে গেলে ধড়াম করে শব্দ হলো।

এবার চকিতে সে ফিরে তাকিয়ে দেখলো বাবুল বই নামিয়ে রেখেছে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতে বাবুল বললো, কী? মঞ্জুও বললো, কী?

–বিলকিস বেগমের আজ মেজাজ ঠিক নাই মনে হচ্ছে?

–তুমি হঠাৎ দুপুরবেলা বাসায় ফিরলে যে?

–দেখতে এলাম, তুমি দুপুরটা কেমনভাবে কাটাও! প্রত্যেকদিন লম্বা লম্বা দুপুর। মঞ্জু জ্বলন্ত চোখে বললো, ও, চেক করতে এলে যে আমি দুপুরগুলা কোনো নাগরের সাথে বেড়রুমের দরজা বন্ধ করে কাটাই কি না?

বাবুলের ফর্সা মুখোনি সঙ্গে সঙ্গে কালিমাময় হয়ে গেল, চোখের নিচে নেমে এলো মেঘের ছায়া। সে মঞ্জুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো অপলক কয়েক মুহূর্ত। যেন অনন্তকাল।

টাঙ্গাইল থেকে সন্তোষের রাজবাড়িতে যাবার পথে এক তরুণীর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল, তার মুখমণ্ডল ছিল বিষণ্ণ, সে যেন তার বুকের শূন্যতা ভুলে যাবার জন্য একটা আশ্রয় খুঁজছিল। তারপর থেকে কটা বছর আর পার হয়েছে? সময় এমনই নিষ্ঠুর?

একই সঙ্গে অভিমান ও আহত মর্যাদার সঙ্গে দৃঢ়তা মিশিয়ে বাবুল বললো, ছিঃ মঞ্জু!

সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুর অনুতাপ হলো। সে জানে, বাবুল একেবারেই কোনো খারাপ শব্দ সহ্য করতে পারে না। যেন ঠিক শারীরিক আঘাত পায়। নাগর’ শব্দটা ব্যবহার করা মঞ্জুর উচিত হয়নি, এই শব্দটি সে সদ্য একটি উপন্যাসে পড়েছে বলেই মনে এসে গেছে। একজন ইন্ডিয়ান রাইটারের লেখা বই, বাজে, বাজে, মঞ্জু ওসব বই আর কোনোদিন পড়বে না।

সঙ্গে সঙ্গে তো আর ক্ষমা প্রার্থনা করা যায় না, তাই মঞ্জু কণ্ঠস্বর বদলে জিজ্ঞেস করলো, তুমি চা খাবে?

–ওরকম কথা তুমি বললে কেন, মঞ্জু?

–যাঃ, আমি বুঝি একটু ঠাট্টা করতে পারি না?

–এটা ঠাট্টা? ও, ঠিক আছে। মঞ্জু, এখানে এসে একটু বসো। সন্ধেবেলা বাড়িতে প্রায়ই কোনো না কোনো অতিথি আসে, তোমার সঙ্গে ঠিক মতন কথা বলা যায় না।

–কে আসে?

–কেউ না কেউ আসে, বাঃ, বাড়িতে লোকজন তো আসবেই…রাত্তিরে যখন আমি ফিরি, তোমার তখন ঘুম পায়, বিশেষ কিছু কথা হয় না, সেই জন্য এখন…

সন্ধেবেলা কেউ না কেউ আসে, এর মধ্যে যেন একটু খোঁচা আছে, সেটাই মঞ্জুর গায়ে লাগলো। বাবুল যে তাকে এখন নিভৃতে কিছু বলতে চায়, তাতে সে গুরুত্ব দিল না।

–তুমি হঠাৎ চলে এলে, ক্লাস নাই?

–ছাত্ররা স্ট্রাইক করেছে, আজ বিরাট মিছিল।

–সিরাজুল এখনো ফেরে নাই, মনিরাবেচারী না খেয়ে বসে আছে।

–ও, মঞ্জু, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। গত দু তিন মাস ধরে আমি খবর পাচ্ছি, সিরাজুল বেশ একজন নামজাদা ছাত্র নেতা হয়ে উঠেছে।

–ছাত্র নেতা?

–কার যে কোন্ দিকে গুণ থাকে সব সময় বোঝা যায় না। আমি ভেবেছিলাম ওর লেখাপড়া বেশিদূর হবে না। কিন্তু ওর সংগঠনের বিশেষ ক্ষমতা আছে। গ্রামে থাকতে এই গুণটা প্রকাশ পায়নি। এখন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে এসে…আজ তো বিরাট মিছিল, শেখ মুজিবর রহমানকে সরকার পর পর কয়েকবার গ্রেফতার করলো, সেই প্রতিবাদে, যে-কোনো সময় ভায়োলেন্ট হয়ে যেতে পারে…আবার কলেজ ইউনিভার্সিটি যে কতদিনের জন্য বন্ধ হবে।

–সিরাজুল আছে ঐ মিছিলে?

–থাকাই তো সম্ভব! সে এখন লীডার, পড়াশুনো ওর হবে না, ঐ মিছিলটিছিলই করবে।

–তুমি বুঝি ছাত্র বয়েসে মিছিল করোনাই! একবার মাথা ফাটিয়েছিলে না?

–ও, হ্যাঁ, তা ঠিক।

–তুমি এত ঠাণ্ডা ভাবে কথা বলছো কী করে। সিরাজুল মিছিলে গেছে, যদি লাঠি বা গুলি চলে…মনিরা বেচারি একা বসে আছে, খায়নি দায়নি…সিরাজুলেরও শরীর ভালো না।

–ঠিক বলেছো, সিরাজুলকে দেখতেই তাগড়া কিন্তু ভেতরটা ঝাঁঝরা। এই তাগৎ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়বে কী করে?

–তা হলে এখন কী হবে?

–এখন কী হবে মানে? তোমার সাথে আমার অন্য কথা ছিল, কিন্তু এখন সিরাজুল বিষয়েই আমরা আলাপ-আলোচনা করে যাবো? সে একটা হুজুগে মেতে মিছিলে গিয়ে লাফাচ্ছে, সেজন্য আমরা দায়ি হবো? আওয়ামী লীগের একজন লীডারকে সরকার গ্রেফতার করেছে, তা নিয়ে ছাত্রদের এত উত্তেজিত হবার কী কারণ আছে? এখনকার ছাত্ররা টোট্যাল দেশটার কথা চিন্তা করে না!

–তা বলে মনিরা ভাতের থালা নিয়ে বসে থাকবে, সিরাজুল কখন ফেরে না ফেরে, যদি পুলিস ওরে জেলে নিয়া যায়, মনিরা না খেয়ে বসেই থাকবে।

–খুবই মর্মন্তুদ পিকচার। যে-কোনো নভেলিস্ট পেলে লুফে নিতো। কিন্তু মঞ্জু, পৃথিবীটা এরকমই নিষ্ঠুর! শুধু আমাদের এই ইস্ট পাকিস্তানেই না, বহু দৈশে, তুমি ভাবো তো ভিয়েনামের কথা! এই মুহূর্তে সেখানে কী চলেছে; বর্বর মার্কিনীরা সতেরো হাজার মাইল দূর থেকে এসে…বোমা, গুলি, গ্যাস নিয়ে…সে দেশে কত মা, কত স্ত্রী তাদের সন্তান বা স্বামীর পথ চেয়ে বসে আছে।

–আমি ভিয়েত্রম চিনি না। কিন্তু আমি যদি পুরুষমানুষ হতাম

–কী বললে, তুমি…পুরুষ মানুষ? তুমি পুরুষ মানুষ হলে কয়েকজন লোক খুবই দুঃখ পেত…পৃথিবীতে পুরুষ মানুষ আছে কোটি কোটি, কিন্তু বিলকিস বেগম মাত্র একটিই…সে যাই হোক, তুমি যদি দিয়ে বললে…তুমি পুরুষ মানুষ হলে কী করতে?

–আমি পুরুষ মানুষ হলে আমি এক্ষুনি বেরিয়ে গিয়ে সিরাজুলের খবর করতাম। তার যদি কিছু হয়…

–আই সাপোজ, ইউ আর রাইট, মঞ্জু! যে-কোনো পুরুষ মানুষেরই উচিত…উৎকণ্ঠিতা পত্নী বসে আছে…তার স্বামীর খোঁজ করা।

বাবুল উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পলক নিজের ঘরটি মমতাভরে দেখে নিল। সে প্যান্ট-শার্ট পরা, জুতো-মোজা খুলে রেখেছিল, সেগুলো পরে নিল দ্রুত। প্যান্টের পকেট থাবড়ে দেখে নিল পার্শটা ঠিক আছে কিনা।

তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু কৌতুকের হাসির সঙ্গে বললো, সিরাজুলের খোঁজ না নিয়ে আমি ফিরছি না। হয়তো আমারও ফিরতে দেরি হবে। একেবারেই যদি না ফিরি আজ রাত আটটা নটার মধ্যে, তাহলে তোমার মামুনমামার কাছে খোঁজ নিও। উনি নিশ্চয়ই লেটেস্ট ক্যাজুয়ালিটি আর অ্যারেস্টেডের ফিগার জানবেন। বাই-ই মঞ্জু, তুমি চা খাওয়াতে চেয়েছিলে, সেটা পাওনা রইলো।

হঠাৎ মঞ্জুর বুকটা ধক করে উঠলো। বাবুলের গলার আওয়াজটা অন্য রকম, যেন ইস্পাতের শব্দের মতন। মামুনমামার নামটা বললো সে চিবিয়ে চিবিয়ে। কী হয়েছে বাবুলের, ৬১২

মামুনমামার ওপর এত রাগ কেন? না, আজ মঞ্জুরই দোষ বেশী। বাবুল অসময়ে বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল। মঞ্জু তা না শুনেই সিরাজুলের নাম করে তাকে উত্যক্ত করতে লাগলো। আর একটু পরে গেলেই বা কী হতো! এমনকি স্বামীকে সে এক কাপ চাও খেতে দিল না?

অনুতাপে কেঁপে উঠে মঞ্জু ছুটে এসে বললো, দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি খুব জলদি চা বানিয়ে আনছি! একটু বসে যাও!

স্বামীর হাত ধরতে যাচ্ছিল মঞ্জু, বাবুল তা ধরতে দিল না। আর একবার গাঢ় ভাবে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালো, কোনো কথা বললো না। তারপর ব্যস্তভাবে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *