Keep your fears to yourself, share your courage with others.
অদ্ভুত একটা বিষণ্ণ পরিবেশে আমরা থম মেরে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। সামনে কোনও পথ নেই। বরাত আর মানুষ, দু’তরফ হাতিয়ার ধরেছে। মেরে পাট করে দেবে। আমার পিসিমা আর বিমর্ষ ভাইবোনদের পাশে নিজেকে অপরাধীর মতো সুখী ও শৌখিন লাগছে। যেমন ড্রেস, সেইরকম। ভোগীর মতো চেহারা আমার। শ্যাম্পু করা চুল। ফুরফুর কপালে খেলছে। পরিষ্কার, দামি জামাকাপড়। শহরের জল আর দুধেল সাবানে রঙের জেল্লা। মনে শহুরে অহংকার। নিজেকে মনে হচ্ছে ত্রাণমন্ত্রী। বিমানে করে বন্যাদুর্গতদের দেখতে এসেছি। কথা বলতে গেলেই গলায় এসে আটকে যাচ্ছে, বক্তৃতার মতো শোনাবে। বন্ধুগণ! কষ্ট করো, ত্যাগ স্বীকার করো। জীবন হল সংগ্রাম। যেমন। বলেন আর কী ক্ষমতার আসনের নেতারা!
হরিশঙ্কর হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন, পেয়ে গেছি। পথ পেয়ে গেছি।
ছোটদাদু বললেন, তোমার পরিষ্কার মাথা। পথ তো পাবেই। জানতে ইচ্ছে করছে।
আমরা ডেকরেটরকে দিয়ে এই উঠোনে একটা প্যান্ডাল করাব। রাইট নাও। এখনই।
তাতে লাভ?
সেই প্যান্ডেলে আমরা বসবাস করব। পুরো বাজারটাকে তুলে এনে, বেশ বড় মাপের রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া লাগিয়ে দোব। ঘোর উৎসব। পালা করে প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করব।
কী হবে তাতে?
হিংসেয় জ্বলেপুড়ে যাবে সেই মহাসাধক।
তাতে আমাদের কী মঙ্গল হবে হরিশঙ্কর?
পৃথিবীর দুটো দিক। একটা স্পিরিচুয়াল, অন্যটা মেটিরিয়াল। ইট, কাঠ, বালি, পাথর, চুন, সুরকি, দেহবল, অর্থবল, রূপ, যৌবন, ঐশ্বর্য। আমাদের এই লড়াই সেই তামসিকতার বিরুদ্ধে। এখানে। তামসিক ঐশ্বর্যের স্রোত বইয়ে চোখ ঠিকরে দেব। যেখানেই অর্থ সেখানেই লোভীদের ভিড়। মানুষ তো ঐশ্বর্যের পদানত। ক্ষমতার পদানত। এখানে হরিনাম সংকীর্তনে কোনও কাজ হবে না। টাকা, ক্ষমতা, রাজসিক অহংকার।
তারপর! শেষটা কী হবে?
শেষে আমরা এই তালুক, মৌজা সব কিনে নোব।
অত ঘুরপথে না গিয়ে সরাসরি এখনই সেই শয়তানটাকে ডেকে কিনে ফেলো না।
না, ওকে আমি স্যান্ডউইচ করে মারব। চারপাশ থেকে ঘিরব। মামলায় জড়াব। এখান থেকে উৎখাত করবার জন্যে দাঙ্গা করবে। আমি ইচ্ছে করে আহত হব। মার খাব, ডায়েরি করব, মামলা ইকব। নোকটার শেষ দেখে আমি ছাড়ব। আমি ওর সঙ্গে সাংঘাতিক একটা কনফ্রন্টেশনে যেতে চাই। তার মধ্যে পাওয়ার থাকবে, বুদ্ধি থাকবে, কূটনীতি থাকবে, আইন থাকবে, দাঁচ থাকবে। লোকটাকে একেবারে জেরবার করে মারতে হবে।
মশা মারতে কামান দেগে কোনও লাভ আছে? ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ!
হরিশঙ্কর বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, সাবেক আমলের এইরকম একটা যুক্তিই আমি আশা করেছিলুম। পাশকাটানো পরামর্শ। এইভাবেই আমরা লোজ্জা ক্রিমিনালদের বাড়ার সুযোগ করে দিই। জেনে রাখ মহামানবদের মারতে কয়েক সেকেন্ড লাগে, কারণ এক অর্থে তারা নির্বোধ, তারা মানুষকে বিশ্বাসের ব্ল্যাঙ্ক-চেক দিয়ে রেখেছেন।
হরিশঙ্কর গলাটাকে সামান্য বিকৃত করে বললেন, ভালবাসা, প্রেম, বিশ্বপ্রেম, অমৃতস্য পুত্রাঃ! লিভিং ইন এ ফুলস প্যারাডাইস। পণ্ডিতমশাই ঠিকই বলেছেন, পৃথিবীটা শয়তানের। মশা-মাছির মতো মহামানব মরেন, মহাত্মা গান্ধি, লিঙ্কন, মার্টিন লুথার। শ্রীচৈতন্যকে সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দিলে, না জীবন্ত পাঁচিল তুলে দিলে আনারকলির মতো, সে রহস্য আজও রহস্য। অত প্রেম! যিশুখ্রিস্টকে কোলে করে ক্রুশে তুলে দিলে তোমার এই মানুষ শয়তানের দল! বিদ্যাসাগরের গায়ে কাদা ছেটালে। নন্দকুমারের গলায় ফাঁসির দড়ি লটকে দিয়ে এল এক ব্রাহ্মণ। মশা মারা খুবই কঠিন কাজ রে! মশারাই থাকে, সহজে নির্মূল হয় না। তোর আর আমার রক্তেই তাদের প্রজনন, বংশবৃদ্ধি। ঝাকে ঝাকে এই মশাটিকে মারার জন্যে আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করব। আমার এক ফোঁটা রক্ত ইজ ইকুইভ্যালেন্ট টু হিজ ওয়ান বাকেট। এই জেলার এই মাটিতে আমি একটা ইতিহাস সৃষ্টি করে যাব। ফর এজেস টু কাম, মানুষ মনে রাখবে নারী হল শক্তি। শক্তির অপমানে নির্যাতনে ধ্বংস হতে হয়। একথা তোমার শাস্ত্রে আছে। শাস্ত্রেই আছে, হয় না কিছুই। নির্বিচারে নারী-নির্যাতন হয়েই চলেছে। ভাগ্য নিয়ে দেহ নিয়ে খেলা। সেই শাস্ত্রবাক্যের একটা উদাহরণ আমি রেখে যাব। মুরগির মতো সেই জানোয়ারের পালক ছাড়াব। হরিশঙ্কর এখন বিষধর কেউটে। সেই কেউটের লেজে পা পড়েছে।
অশান্ত হরিশঙ্কর পায়চারি শুরু করলেন আবার। ব্যায়াম করা চকচকে শরীর ফুলে উঠেছে। বাঘের মতো বিক্রম। এ সেই ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময়ের চেহারা। রাত বারোটার সময় আমাদের পাড়া আক্রান্ত হল। হাতে একটা শোর্ড নিয়ে হরিশঙ্কর বেরিয়ে এলেন। সেইসময় তিনি ডুমার বই খুব পড়ছেন, থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো, ব্ল্যাক টিউলিপ। সেই শোর্ড ফাঁইটের সুযোগ সেদিন এসেছিল। নেতৃত্ব দেওয়ার কী ক্ষমতা! সমস্ত পাড়া তার পেছনে। ক্লাবের ছেলেরা। হাতে হারোয়া খেলার লাঠি। মরচে-ধরা তরোয়াল। ঘরে ঘরে নারীবাহিনী বঁটি কাটারি হাতে প্রস্তুত। তেমন প্রয়োজন হলে জহরব্রতের জন্যে টিন টিন কেরোসিন মজুত। হরিশঙ্করের নিজের তৈরি মলোটভ ককটেল। বাংলায় বোতল বোমা। স্বদেশি চেতনায় সবাই টগবগ করছে। ইংরেজ দ্বিজাতিতত্ত্বর তরোয়াল চালিয়ে দেশ টুকরো করতে চাইছে। যারা এতকাল পাশাপাশি বসবাস করে এসেছে বন্ধুর মতো, তারাই ধর্মের দোহাই পেড়ে ছুরি ধরেছে। কলকাতায় এক ধর্মের মানুষ স্লোগান দিচ্ছে ঠোঁট মে বিড়ি, মু মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
সেই হরিশঙ্কর আজ বেরিয়ে এসেছেন আবার বাঁকুড়ার মাটিতে। এবার তার স্ট্র্যাটেজি ভিন্ন। ধর্মের নামে কত অধর্ম তিনি দেখেছেন। ধর্মের নামে ব্যভিচার তিনি দেখেছেন। দেখেছেন সাধুর ক্ষমতার লড়াই। দেখেছেন আশ্রমে ভোগের জীবন। দেখেছেন ধনীর খাতির, গরিবের প্রতি অবহেলা, দুঃসহ ঘৃণা। যে কারণে তিনি গুরু গ্রহণ করেননি। পাহাড়ে গেছেন, জঙ্গলে গেছেন, কখনও কোনও আশ্রমে যাননি। কখনও কখনও এই সাধক ছোটমামাকে গুরু হিসেবে মেনেছেন। দীক্ষা গ্রহণ করেননি। অভিমত, কানে ফুসমন্তরে ধার্মিক হওয়া যায় না। ধর্ম মনে গ্রহণ করতে হয়। সেটা একটা টোটাল প্রসেস। কমপ্লিট রূপান্তর। বাঘকে হরিণ হতে হবে। খাদককে হতে হবে খাদ্য। দস্যুকে হতে হবে প্রেমিক। অর্ধমানব অর্ধদানব হলে হবে না।
সেই অশান্ত হরিশঙ্কর সামনে ঘুরপাক খাচ্ছেন। প্রশান্ত ছোটদাদু বসে আছেন ছোটখাটো একটা টিলার মতো। অচঞ্চল। হরিশঙ্কর আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, তা হলে তোমরা আমাকে কেউ সমর্থন করছ না? একলা চলো রে! তাই তো! ছোটদাদু মৃদু হেসে বললেন, ঠিক তা নয়। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে আছি তোর শান্ত হওয়ার অপেক্ষায়। তোর চিন্তা, বোধ, বুদ্ধি সব আচ্ছন্ন হয়ে আছে এই মুহূর্তে। এই ধোঁয়াটা কেটে গেলেই তুই দেখতে পাবি, তোর পথটা কত জটিল। সময় অর্থ শ্রমের অপচয়। তখন তোর মাথা থেকেই অন্য পথ বেরোবে। যা স্বাভাবিক, যুক্তিপূর্ণ।
হরিশঙ্কর কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললেন, আমাদের স্বার্থপরতাই এই পরিবারটাকে অস্তিত্বের শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। কখনও সেভাবে খবর নেওয়া হয়নি। বছরে দু-চারটে পোস্টকার্ড চালাচালি। আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় সকলে কুশলে আছে। প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। উত্তরের অপেক্ষায় রইলুম। হয়ে গেল। কর্তব্য শেষ। পাহাড়ে যাই, সমুদ্রে যাই, লুচি মোহনভোগ খাই। দামোদর পেরিয়ে বোনকে দেখতে আসি না। বিয়ে হয়ে গেছে, আর তার খবর রাখার প্রয়োজন কী? মরল না বাঁচল!
পিসিমা ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়ালেন, ছোড়দা শান্ত হও। ভাগ্য মানতেই হবে। চিরটা কালই তো আমার এইভাবেই কাটছে। তুমি কী করবে! যার সঙ্গে বিয়ে হল, তিনি তো খারাপ ছিলেন না। অসুখেই সব শেষ করে দিলে। ভগবান যাকে মারবেন, মানুষ তার কী করবে! আমি জল আনি, তোমরা হাত-পা ধোও। আমি চা জলখাবারের ব্যবস্থা করি।
হরিশঙ্কর বললেন, সেটা কীভাবে সম্ভব হবে! তোর তো কিছুই নেই। শ্মশানে বসে আছিস ধূমাবতী হয়ে।
তিন দিন আগে গলার চেন বাঁধা রেখে কিছু টাকার জোগাড় করেছিলুম তোমার কাছে যাব বলে। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে যাই কী করে! তাই অপেক্ষা করছিলুম। এখন তোমরা এসে গেছ, আর ভয় কী! নতুন হাঁড়িতে ভাতেভাত চাপাই। দেখি ঘি পাওয়া যায় কি না! চা চিনি কিনে আনি।
হরিশঙ্কর বললেন, তোকে কিছু করতে হবে না। সব আমরা করছি। শুধু সেই রাসকেলটা এখনও আসছে না কেন? লোহা গরম থাকতে থাকতেই ঘা মারতে হয়।
ছোটদাদু বললেন, মুখ হাত পা তো ধুতেই হবে হরিশঙ্কর, আর একটা অবশ্য করণীয় কাজ তুমি ভুলে গেছ। দাঁত মাজা। গাবভ্যারেন্ডার বেড়া দেখতে পাচ্ছি। দাঁতনের অভাব হবে না।
হরিশঙ্কর বললেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। দাঁত মাজাটা বাকি আছে।
দাওয়ার এক পাশে একটা বালতি ছিল। পিসিমা সেই দিকে এগোলেন। ছোটদাদু বললেন, আশা, তোর মেয়েকে বল না। জল আনবে কোথা থেকে? টিউবওয়েল?
ও পারবে না ছোটমামা। পাতকোটা খুব বড় আর অনেক নীচে জল।
তা হলে আমরাই কেন যাই না!
পিসিমা বললেন, তুমি তো জানো আশা কীরকম খাটতে পারে! মাথার চোট আমাকে কাবু করতে পারবে না।
পিসিমা বালতি হাতে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেলেন। হরিশঙ্করের পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা ছুরি বেরোল। বিদেশি জিনিস। শেফিল্ডে তৈরি। চকোলেট রঙের বাঁট। পেতলের কাজ করা। খুবই লোভনীয়। জিনিসটা হরিশঙ্করের বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো। পকেটে পকেটে ঘোরে। ফলকাটা, গাছের ডাল কাটা, সবেতেই লাগে। এইসব কাজে হরিশঙ্করের নিপুণতা তুলনাহীন। সব কাজেই হরিশঙ্কর অসাধারণ দক্ষ। তিনি বলেন, কাজের চেয়ে কাজের ফিনিশই বড় কথা। যেমন শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতি।
হরিশঙ্কর দাঁতনের জন্যে ডাল কাটতে গেলেন। ভেঙে নিলেই হয়। কিন্তু না, তা হবে না, নিখুঁত করে কাটতে হবে। চুলতে হবে। একটা ডাল কেটেছেন। দাঁড়িয়ে আছি পাশে। ডাল থেকে ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরছে। হঠাৎ পিসিমা প্রায় ছুটতে ছুটতে এলেন। মুখে চোখে ভয়ংকর এক আতঙ্ক। যেন ভূত দেখেছেন।
আমাদের কাছে এসে প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলেন।
হরিশঙ্কর বললেন, কী হল আশা? ওরকম করছিস কেন?
পিসিমা ধরাধরা গলায় বললেন, পাতকোর মধ্যে।
পাতকোর মধ্যে কী?
কী একটা রয়েছে।
কী একটা রয়েছে মানে? জল ছাড়া আর কী থাকবে?
একটা মানুষ।
মানুষ। কী করছে মানুষ? চান করছে!
মরা মানুষ।
সেকী?
আমরা সবাই ছুটলুম কুয়োতলার দিকে। শ্যাওলা শ্যাওলা একটা জায়গা। কয়েকটা ইট এলোমেলো পাতা। একপাশে বিশাল একটা ছাইগাদা। বড় বড় মান গাছ। বিশাল একটা কাঁঠাল গাছ। খা খা করে কাক ডাকছে। হঠাৎ একটা কাক ক্রাঙ্ক ক্রাঙ্ক করে ডাকতে লাগল। কাক সাধারণত এইভাবে ডাকে না। ছোটদাদু আমাকে বললেন, শুনছ? ভীষণ অমঙ্গলের ডাক। কাক সব জানিয়ে দেয়। অদ্ভুত এক পাখি। কাকের ডাক নিয়ে আমাদের শাস্ত্রে অভ্রান্ত গবেষণা আছে, কাকতত্ত্ব।
তিন পাশ থেকে আমরা পাতকো দেখতে লাগলুম ঝুঁকে। পাতকোর বেড় বিশাল। ইদারার মতো। তেমনই গভীর। বাঁকুড়া খুব শুকনো জায়গা। জলের খুব কষ্ট। অনেক নীচে জল। সেই জলে ভাসছে সাদা কাপড়। একটা চুলঅলা মাথা। তালের ফোঁপলের মতো। সব তালগোল পাকিয়ে আছে। বেশ বোঝা যায়, ওঠার জন্যে হাঁচোড়পাঁচোড় করে এলিয়ে পড়েছে একসময়। মাথার ওপর সূর্য। ফলার মতো কিরণ পড়েছে। ভেতরটা বেশ স্পষ্ট। দশাসই একজন মানুষের সলিল-সমাধি। জলের ভেতরে একটা লালের আভা।
মানকচুর ঝোপে একটা কিছু ভয়ংকর চকচক করছে। দেখা গেল, সেটা একটা টিনের খাঁড়া। একজোড়া খড়ম পড়ে আছে একপাশে। আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সেই কাক তারস্বরে চিৎকার করছে, ক্রাঙ্ক ক্রাঙ্ক। হরিশঙ্কর যার পালক ছাড়াতে চেয়েছিলেন, সে ওই কূপে মৃত।
প্রথমে কথা বললেন ছোেটদাদু, এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! হয় নিজেই ঝপ মেরে আত্মহত্যা করেছে, না হয় কেউ মেরে ফেলে দিয়ে গেছে। পুলিশ কেসের ব্যাপার।
হরিশঙ্কর বললেন, আমাদের এখন কী করা উচিত?
ছোটদাদু পিসিমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা তো সারাটা রাতই ওই দাওয়ায় ছিলিস, এত বড় একটা জিনিস কুয়োয় পড়ল, তোরা কোনও শব্দ পেলি না।
পিসিমা ভয়ে ভয়ে বললেন, আমরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। আর এটা তো বাড়ির পেছন দিক।
হরিশঙ্কর বললেন, আমাদের এখন থানায় যাওয়া উচিত।
ছোটদাদুর চেহারা, গলা সবই হঠাৎ পালটে গেল। একেবারে অন্য মানুষ। চাপা গলায় বললেন, কোনও চিৎকার চেঁচামেচি না করে সব ওদিকে চলল। মনে করো, তোমরা এটা দেখোনি। তোমরা কিছুই জানো না।
আমরা এইবার চোরের মতো অপরাধীর মতো দাওয়ায় এসে বসলুম। ঝলমলে দিন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে গভীর রাত। গভীর এক ষড়যন্ত্রে বসেছি আমরা। আমরাই যেন খুনি। বেশ বোঝ। যাচ্ছে, হরিশঙ্কর কোনওরকমে নিজের ভয়ংকর উত্তেজনা চেপে রেখেছেন। আমি জানি তিনি কী চাইছেন! এখনই ওই মৃতদেহ তোলার ব্যবস্থা করতে চাইছেন। মানুষটির প্রতি রাগ-দ্বেষ যা ছিল আর নেই। এখন আছে মৃতের প্রতি কর্তব্য, শেষ সংস্কার। মৃতের কোনও জাত নেই। পাপ-পুণ্য নেই।
হরিশঙ্কর বললেন, থানায় খবর দিলে ক্ষতিটা কী? যতই হোক আমাদের একজন আত্মীয়!
ছোটদাদু বললেন, একটু আগেই তো তুমি কীচকবধ করতে চেয়েছিলে।
মৃতের কোনও শত্রু থাকে না।
তুমি যা ভেবেছিলে, এখন কাজে তাই হয়ে গেছে। এখন আমাদের সম্পর্ক–হত আর হত্যাকারী।
হরিশঙ্করের বিস্মিত প্রশ্ন, আমরা হত্যাকারী?
সন্দেহটা প্রথমে আমাদের দিকেই আসবে। পুলিশ আমাকে ধরে টানাটানি করবে। আমাদেরও জড়াবে। এই দাওয়া, ওই ইদারা। অত বড় একটা শরীর পড়ল, শব্দ হল, কেউ শুনতে পেল না। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হবে? আদালত মানবে!
তুমি খুন ভাবছ কেন? অ্যাক্সিডেন্টালি পড়ে যেতেও তো পারে!
ভুলে যেয়ো না আশা বসে আছে শত্ৰুপুরীতে। জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি অতি ভয়ংকর জিনিস। মানুষের আদিম লোভের একটি। এই মৃত্যুর পর এদের জমিজমার কে মালিক হবে? কে হতে চলেছে। তোমাকে একটা কথা বলি, মানবতা, কর্তব্য এইসব ভুলে, এখনই যে যে-অবস্থায় আছ। বেরিয়ে পড়ো, বাঁচতে যদি চাও। বিশাল বিশ্রী এক ঝামেলা আসছে। হরিশঙ্কর, জেল জিনিসটা খুব সুখের নয়। জায়গাটাও খুব খারাপ। স্বদেশি করার সময় আমার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। ভাগ্য ভাল এখনও কেউ আসেনি। আগে এখান থেকে বেরিয়ে চলো, তারপর বলব চক্রান্তটা কী? আমি। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আমার অনুমান মিথ্যে হবার নয়।
হরিশঙ্কর ভয়ংকর অবাক হয়ে বললেন, সেকী পালিয়ে যাব? ভয়ে পালাব?
ছোটদাদু বললেন, কার ভয়ে তুমি পালাচ্ছ হরিশঙ্কর! কেউ কি তোমাকে ভয় দেখিয়েছে?
মানুষ নয়, ভয় দেখাচ্ছে আশঙ্কা।
তুমি ভয়ে পালাচ্ছ না, পালাচ্ছ বুদ্ধিমান বলে। নির্বোধ নয় বলেই আমরা ফাঁদে পা দিচ্ছি না।
আমরা অপরাধী নই, তবু একদল খুনির মতো বেরিয়ে এলুম সেই ভিটে ছেড়ে। কেবলই মনে হচ্ছে, কেউ দেখছে না তো! কেউ হঠাৎ জিজ্ঞেস করবে না তো, যাচ্ছ কোথায়? কেউ ফিরে তাকালে অস্বস্তি হচ্ছে।
ছোটদাদু বললেন, ভাগ্যের পরিহাস। সত্যিই আমাদের অপরাধীর মতোই পালাতে হবে। কারও চোখে যেন না পড়ে যাই। একটু ছাড়া ছাড়া ইটো সবাই। দল তৈরি কোরো না।
হরিশঙ্কর বললেন, আবার কি আমাদের হেঁটেই যেতে হবে? জঙ্গলের পথ ধরে!
না। ও পথের শেষ মাথায় অমঙ্গল বসে আছে। এবার আমরা রেলে ফিরব।
স্টেশনের দিকে এগোেলুম আমরা। আমাদের নিয়ে কারওই তেমন মাথাব্যথা নেই। আমরা চলেছি আমাদের মতো। মনে কিন্তু অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করছে। মৃত্যু মানুষকে কেন এত ভয় দেখায়?