২.৪৫ কোথায় পালাবে তুমি

কোথায় পালাবে তুমি তোমারই এ স্মৃতির পাহাড়
অগস্ত্যেরও কাছে কখনও সে নোয়ায়নি ঘাড় ॥

হরিশঙ্কর হনহন করে এগোচ্ছেন। ডাকাতদের সভা তাকে টানছে। একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়েছেন। আমাকে প্রায়ই বলেন, নিজেকে বিপদের মধ্যে ফেলবে, কষ্টের মধ্যে ফেলবে, ঝুঁকি নেবে, বেরিয়ে আসবে লড়াই করে। একটু ক্ষতবিক্ষত হবে, হয়তো মরতে মরতে বেঁচে যাবে; কিন্তু বাঁচাটা শিখবে। পাখির মা বাচ্চাকে ওড়া শেখায়, দেখেছ নিশ্চয়? ডানার জোর নেই, কাক তাড়া করছে, পাখি উড়তে শিখছে। একটা-দুটো মরেও যেতে পারে। তবু এইটাই নিয়ম। বিপদের চেয়ে বড় শিক্ষক কেউ নেই। আলতো জীবন ওয়ার্থলেস জীবন। লিভ লাইক এ হিরো। স্বামী বিবেকানন্দের ওই ছবিটা দেখেছ? বুকে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন বীর সন্ন্যাসী। জীবনের সামনে ওই হল জীবনের দাঁড়াবার ভঙ্গি দৃপ্ত, বেপরোয়া। লক্ষ লক্ষ ছায়ার শরীর! দুঃখরাশি জগতে ছড়ায়,/নাচে তারা উন্মাদ তাণ্ডবে; মৃত্যুরূপা মা আমার আয়!/করালি! করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিশ্বাসে প্রশ্বাসে তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মাণ্ড বিনাশে!/ কালী, তুই প্রলয়রূপিণী, আয় মা গো আয় মোর পাশে।/ সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,/কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।

সন্ন্যাসী হবার প্রয়োজন নেই, সাহসী হও। হরিশঙ্কর রবীন্দ্রনাথের গলায় গাইতে লাগলেন, ভয় হতে তব অভয়মাঝে নূতন জনম দাও হে ॥ দীনতা হতে অক্ষয় ধনে, সংশয় হতে সত্যসদনে জড়তা হতে নবীন জীবনে নূতন জনম দাও হে । হরিশঙ্কর যা বিশ্বাস করেন, তা প্রতিফলিত করেন নিজের জীবনে। আমি তা পারি না। এক ধাতুতে গড়া হরিশঙ্কর, ছোটদাদু সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধাতুতে।

ছোটদাদু আমাকে ছেড়ে জোর কদমে হরিশঙ্করকে ধরে ফেললেন। আমি একটু পেছনে। চিরটাকালই আমি একটু গদাইলশকর ধরনের। খুব জোরে হাঁটতে পারি না। ভূত আর ডাকাতের ভয়ে চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব জোরে হাঁটার। তবু হাত দুয়েকের ব্যবধান। ভেতরটা হাঁকপাক করছে। স্বপ্নেও আমার একই অবস্থা হয়। ভয়ের পরিবেশে সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি দৌড়োনার চেষ্টা করছি, কিন্তু পা চলছে না। শেষে হামাগুড়ি দিয়ে এগোবার চেষ্টা করছি চতুষ্পদ প্রাণীর মতো। তাও পারছি না। শেষে কান্না। আর তখনই ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় পড়ে থাকে পাথরের মতো ভারী একটা শরীর।

দুজনের বাক্যালাপ কানে আসছে।

ছোটদাদু: ডাকাতদের কী বলে সম্ভাষণ করবি? গুড মর্নিং।

হরিশঙ্কর: অবশ্যই। সেইটাই তো ফর্মালিটি।

ছোটদাদু: কিছু নজরানা দিবি নাকি?

হরিশঙ্কর: ইনসাল্ট করা হবে। ডাকাতরা গ্রহণ করে না, কেড়ে নেয়। যার যা ধর্ম। সামনে গিয়ে দাঁড়াব। হকচকিয়ে যাবে। না চাইতেই শিকার।

ছোটদাদু: তারপর কী হবে?

হরিশঙ্কর: তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। হয় ঝটপটি, না হয় বন্ধুত্ব।

দেখা গেল চারজন সাঁওতাল শুকনো পাতায় আগুন জ্বেলে কী একটা পোড়াচ্ছে। হরিশঙ্কর ভয়ংকর হতাশ হলেন। আগুনে ঝলসাচ্ছে বুনো একটা খরগোশ। ব্রেকফাস্টের আয়োজন। দৃশ্যটা সহ্য করতে পারলেন না হরিশঙ্কর। মনে হল, পারলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু নিজেই সিদ্ধান্তে এলেন– খরগোশ ইজ ডেড বাই দিস টাইম। সাদা ধবধবে একটা খরগোশ, গোল গোল উজ্জ্বল। দুটো লাল চোখ, সৃষ্টির সৌন্দর্যশালার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনের একটি, লাল আগুনে ঝলসে কালো।

হরিশঙ্কর প্রায় ছুটে পালিয়ে গেলেন। সাঁওতাল চারজন আমাদের গ্রাহ্যই করল না। একপাশে একটা বাঁশি পড়ে আছে, অদুরেই শুয়ে আছে শ্রান্ত তিরধনুক। সংগীত, হিংসা, ক্ষুধা, অগ্নি, সম্পূর্ণ এক জীবনদর্শন। সেই দর্শনে আতঙ্কিত হরিশঙ্কর বুদ্ধের মতো পলাতক।

ভোর হয়ে আসছে। গাছের পাতায় সামান্য সামান্য রুপোলি আলোর হেঁয়া, যেন রাতের কেশপাশে দিনের বার্ধক্যের স্পর্শ। টিট টিট করে একটা পাখি দামি ঘড়ির অ্যালার্মের মতো বেজেই থেমে গেল।

ছোটদাদু আবার হরিশঙ্করের পাশে চলে গেছেন। দু’জনের বাক্যালাপ কানে আসছে। পায়ের তলায় শুকনো পাতার মচমচ শব্দ।

ছোটদাদু: ছুটে পালিয়ে এলি!

হরিশঙ্কর: সহ্য করা শক্ত। ন্যাচারাল ডেথ স্ট্যান্ড করা যায়, হত্যা অসহ্য। খরগোশ, পাখি, প্রজাপতি, আমার প্রিয় প্রাণী।

ছোটদাদু: জীবই তো জীবের আহার।

হরিশঙ্কর: এ হল মানুষের কথা। মানুষের সব কথাই মানুষের নিজের স্বার্থে।

ঘোটদাদু: আহা! দর্শন থেকেই তো দর্শন।

হরিশঙ্কর: ঠিকই। কিলার্স ফিলোজফি। একদল বুদ্ধিমান, লোভী, ক্ষুধার্ত মানুষ জ্ঞানের কথা ধর্মের কথা দর্শনের কথা বলছে। সবই আপেক্ষিক, রিলেটিভ, সেলফিশ। কোনওটাই আমি বিশ্বাস করি না। নিজের কোলে ঝোলটানা কথা। সময়ের লাইব্রেরিতে ভাবনার সেলফ, দর্শনের পাখির বাসা, উড়ে গিয়ে বসলেই হল। আশ্রয়ের অভাব নেই। খুনিরও যুক্তির অভাব নেই। বুদ্ধই আমার আশ্রয়। নিরীশ্বরবাদী। বুদ্ধ কী বলছেন শোন।

হরিশঙ্কর নিমেষে এক ভাবলোকে চলে গেলেন। বিশাল বিশাল গাছ। মাথায় ভোরের আলো ধরেছে। অন্ধকার চুঁইয়ে চুঁইয়ে নীচে নামছে। ঝিঁঝির কলরোল। পাখির টুইট টুইট। ধ্রুপদের মতো একটা পরিবেশ। হরিশঙ্কর বলছেন, জন্ম এক যন্ত্রণা, ক্ষয় এক যন্ত্রণা, রোগ এক যন্ত্রণা, মৃত্যুও এক যন্ত্রণা, দুঃখ, শোক, কাতরতা, বিলাপ, হতাশা, শুধু যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা। যা পছন্দ করি না তার মধ্যে পড়ে থাকা যন্ত্রণা, যা পছন্দ করি তার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াও এক যন্ত্রণা। যা পেতে চাই তা না পাওয়া এক যন্ত্রণা, এই দেহ, পঞ্চভূতের এই পিণ্ড যা শুধু ভোগ করতে চায়, সব যন্ত্রণার উৎস এই। দেহ। তার আবার জীবনদর্শন! দর্শনের কথা আমাকে বলিসনি। যন্ত্রণার কথা বল, বল দুঃখের কথা।

ছোটদাদু প্রসঙ্গ থেকে সরে গেলেন। বললেন, ভোর হল। বেশ তাজা লাগছে। ভোরের ফোঁটা ফুলের মতো। একটা অভাব বোধ করছি, এইসময় এক কাপ গরম চা পেলে বেশ হত।

চল, সামনেই গ্রাম, কিছু মেলে কিনা দেখি।

গরম জিলিপি আর মোটা চা।

আমরা তরতর করে এগিয়ে চললুম। সিনেমা শেষ হওয়ার মতো ঝপ করে জঙ্গল শেষ হয়ে গেল। বিশাল একটা ডাঙা। কোথা থেকে শীর্ণ একটা নদী জেগে উঠেছে। অপূর্ব দৃশ্য। রুপোর মতো আলো। ছোটদাদু মিছরির মতো মিষ্টিগলায় গেয়ে উঠলেন, তব চরণ ধোয়াবে শারদ-শিশির, শেফালি অর্ঘ্য দেবে/ ধরণী শ্যামল আসন বিছাবে, তুমি আসিবে যবে/ রক্ত ঊষাতে সিন্দুরের টিপ পরাবে মা তোর ভালে/ চাঁদিমা আরতি দিয়ে যাবে মাগো সুনীল গগন-তলে ॥ কত শতশত কমল কুমারী তোমারে পূজিতে চাহে। দিকে দিকে তব আগমন-গীতি দোয়েল শ্যামা গাহে ॥

হরিশঙ্করের রাত-জাগা সাত্ত্বিক মুখে অদ্ভুত একটা ভাব খেলা করছে। বিশাল প্রান্তর, শীর্ণ নদী, ভিজে ঘাস আর ওই গান। স্বাভাবিক জগতের। ভেতর থেকে আর একটা অন্য জগৎ বেরিয়ে এল। গানটা যেন ঠিক এই পরিবেশে এই সময়ে গাইবার জন্যেই রচিত হয়েছিল। ভৈরবীর মন কেমন করানো সুরে। জীবনের সব ভোর যদি এইভাবেই হত!

একটা কাজ করা যাক, নদীর জলে মুখ ধুয়ে নেওয়া যাক। হরিশঙ্কর বললেন।

ছোটদাদু বললেন, প্রকৃতির বড় কাজ কি সারার প্রয়োজন আছে কারও?

হরিশঙ্কর বললেন, আমার ডাক আসেনি।

ছোটদাদু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার?

ফাঁকা মাঠে প্রকৃতির ডাক? অসম্ভব ব্যাপার। ভাবাই যায় না। আমরা নদীর কিনারে চলে এলুম। টলটলে জল। অসম্ভব ঠান্ডা। দূর আকাশে ধূসর হয়ে আছে শুশুনিয়া। চানটা করে নিতে পারলে মন্দ হত না। ছোটখাটো একটা আলোচনাও হল। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল, অতটা সময় দেওয়া যাবে না। লটঘট ব্যাপার। এইবার আমাদের এগোতে হবে মিলিটারি কায়দায়, দ্রুত পায়ে। মনে রাখতে হবে, আমরা চলেছি একটা পরিবারকে উদ্ধার করতে। বেড়াবার বিলাসিতা করতে নয়।

ডাঙাটা পেরিয়ে আসতেই একটা গ্রাম পাওয়া গেল। একটু শ্রীহীন। গাছের তলায় উনুন। উনুনে সাতসকালেই গুড় জ্বাল দিচ্ছে একদল নারী-পুরুষ। তালের গুড় তৈরি হচ্ছে। জায়গাটা পেরিয়ে এসে আমরা একটা পিচের রাস্তায় উঠলুম। হেলেদুলে কাঁচকোঁচ শব্দে একটা গোরুর গাড়ি। চলেছে। মনে হয় একটু পরেই গঞ্জের মতো কোনও জায়গা পাওয়া যেতে পারে। পাকা বাড়ি দেখতে পাচ্ছি। একটা ফুটবল খেলার মাঠ। উচ্চ বিদ্যালয়। সাইকেল আরোহী। সরকারি দপ্তর।

দোকানও পাওয়া গেল। পাওয়া গেল গরম জিলিপি আর মোটা চা।

ছোটদাদু বললেন, জিলিপি কিন্তু জোলাপের কাজ করে। সেই বুঝে খেয়ো।

হরিশঙ্কর বললেন, জিলিপির লোভ আমার নেই। চা হলেই হবে।

ছোটদাদু বললেন, এনার্জির জন্যে প্রয়োজন। সারারাত আমরা হেঁটেছি। রেলের ইঞ্জিন হলে এতক্ষণে কতটা কয়লা খেত!

বাইরে খাওয়া হরিশঙ্কর একেবারে পছন্দ করেন না, কিন্তু উপায় নেই। সেই জিলিপি আর চা। বাবু-খদ্দের দেখে দোকানদারের খুব খাতির। গরমজলে তিন-তিনবার গেলাস ধোয়া হয়ে গেল। বেশ মজবুত চা এসে গেল। পাকা রাস্তা গঞ্জের বুক ফেঁড়ে দৌড় মেরেছে বিহারের দিকে। তারই পাশে এই দোকান। বেশ পরিচ্ছন্ন। দোকানের মালিক একসময় সেনাবাহিনীতে ছিলেন। হরিশঙ্করের সঙ্গে জমে গেল খুব। শ্রম, নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা, এই তিন হল মন্ত্র। পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা যেমন অদৃশ্য আকর্ষণে ঘুরছে, মানুষ মানুষের চারপাশে ঘুরছে স্বার্থের টানে। যতক্ষণ স্বার্থ ততক্ষণই প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা। স্বার্থ ফুরোলেই তুমি কে? কে তোমার! বিবেক আর কর্তব্য ভুলো না। প্রত্যাশায় জলাঞ্জলি। সুখের চাবিকাঠি।

দুজনে মেতে উঠেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলোচনায়। নেতাজি, আই এন এ, হিটলার, ব্লিৎসক্রিগ। দু’জনের আলোচনা শুনলে মনে হবে, দু’জনে এইমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরলেন। দোকানের মালিক তিন-তিনবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন শুনে হরিশঙ্করের ভীষণ দুঃখ। সেইভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি তিনি কেন হতে পারলেন না! বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করেছেন। সেই সুযোগ একবারই এসেছিল বেনারসে। ছাত্রজীবনে। কাশীর বাড়ির তিনতলার ছাদে বাঁদরের সঙ্গে যুদ্ধ। একটা নয়, একদল। সুগ্রীব ভার্সাস হরিশঙ্কর। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে হরিশঙ্কর আর বানরাধিপ জড়াজড়ি করে গড়াতে গড়াতে সোজা একতলায়। জয়পরাজয়ের মীমাংসা হয়নি রেফারির অভাবে। হরিশঙ্করকে তিন দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। ফিরে এসেছিলেন নাকের ওপরে কপালের মাঝখানে নিখুঁত অর্ধচন্দ্রাকৃতি একটি ক্ষতচিহ্ন নিয়ে। সেই চিহ্নটি স্থায়ী হয়ে আছে। সকলেই বলেন, শুভ চিহ্ন। শিবের দান।

ভদ্রলোক প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশ দিলেন। আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেখানে একটি আশ্রমে আধুনিক থাকার ব্যবস্থা আছে। আমরা ইচ্ছে করলে থাকতে পারি। ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা পথে নামলুম।

পাকা রাস্তার সুখ বেশিক্ষণ সহ্য হল না। নেমে আসতে হল কাঁচা পথে। ধানখেত, গমখেত, আমবাগান। পুকুর। এ দেশ হল পুকুর-থানার দেশ। বেশ কিছুটা হাঁটার পর আমরা এসে গেলুম সেই গ্রামে। অজ গাঁ নয়। বড়মানুষের বসবাস আছে। বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষই কলকাতায় চাকরি করেন। পাকা বাড়ির সংখ্যা কম নয়। বড় স্কুল, হাসপাতাল আছে।

রাধাবিনোদবাবুর বাড়ি বলতে সকলেই চিনতে পারলেন। সুপুরুষ আলাপী মানুষ ছিলেন তিনি। উপকারী, দাতা। তবে? এই তবেটাই মারাত্মক। ছোট ভাইটা একটা জানোয়ার। যাবতীয় বদগুণের অধিকারী। কালীসাধকের ভেকধারী অকৃত্রিম এক শয়তান। বিয়ে করেননি। একজন ভৈরবী আছেন। সেই ভৈরবীই ওঠ-বোস করায়। সে দৃশ্য জীবনে ভোলার নয়। মানুষের হাতে মানুষের নির্যাতন। একটা উঠোন। উঠোন পেরিয়ে দাওয়া। চারজন প্রাণী হতাশ হয়ে বসে আছে। ছোট ছোট দুটি মেয়ে একটি ছেলে আর আমার পিসিমা। পিসিমার মাথায় পুরু একটা ব্যান্ডেজ। চারজন বসে আছেন, যাঁদের কাছে সবদিনই একরকম। কোনও আশার বাণী বহন করে আনে না। শুধু যন্ত্রণাই। যন্ত্রণারই রকমফের।

পিসিমা আমাদের দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন, ছোড়দা তোমরা? ছোটমামা তুমিও এসেছ? পিসিমাকে অবিকল শ্ৰীশ্ৰীসারদামায়ের মতো দেখতে।

ছোটদাদু বললেন, আশা, মাথাটা ফাটালি কী করে?

আমাদের আগমন যেন ভোরের সূর্যের আলো। সেই আলো খেলছে আমার পিসিমার মুখে। কোনও উত্তর নেই। নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন। ইতস্তত করছেন। বড়মেয়ে জবাব দিল, ওই জানোয়ারটা চেলা কাঠ মেরে মায়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। সাতটা সেলাই পড়েছে।

পিসিমা মেয়েকে ধমক দিলেন, ছিঃ, কাকাকে জানোয়ার বলতে নেই কাঁদু।

না, বলবে না! মেয়ে যেন মা দুর্গা! কথায় সাংঘাতিক তেজ।

হরিশঙ্কর দপ করে উঠলেন, কোথায় সেই সোয়াইন? আমি আজ কীচক বধ করব।

ছোটদাদু বললেন, অতটা উত্তেজিত হোসনি। মাথা ঠান্ডা রাখ। আগে দেখতে হচ্ছে ওর শক্তি কতটা? দলবল কতটা ভারী?

হরিশঙ্কর বললেন, দল! যে নারীর গায়ে হাত তোলে সে কাওয়ার্ড। তার দলে যদি একশোজনও থাকে, মেরে ছাতু করে দেব। সে শক্তি আমার আছে। আই ক্যান ফাঁইট।

ছোটদাদু বললেন, আমি জানি তুমি তা পারো। তবে আমাদের আইনের কথা ভাবতে হবে। ফৌজদারি মামলায় জড়িয়ে পড়লে চলবে না।

মামলা? এই মাথা ফাটানোর মামলা হবে না? তাকে তো এখনই অ্যারেস্ট করানো যায়।

না, যায় না। এখন আর যায় না। কারণ সঙ্গে সঙ্গে থানায় ডায়েরি করা হয়নি। তা ছাড়া এটা তার এলাকা। সাক্ষীসাবুদের প্রশ্ন আছে। হঠকারিতায় ফল ভাল হবে না। ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দে।

তুই কী করবি? লবঙ্গ খাওয়াবি? কুলকুণ্ডলিনী জাগাবি?

কী করব তা জানি না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

শোন, ধর্ম হল শৌখিন জিনিস। ফুল বেলপাতায় শয়তান সন্তুষ্ট হয় না। শয়তানের প্রয়োজন বেধড়ক ধোলাই।

প্রয়োজন হলে তাই হবে। তার আগে ভাবা দরকার আমাদের প্ল্যানটা কী? আমরা এখানে এসেছি কী কারণে?

এসেছি আমার বোনকে উদ্ধার করতে।

এই তো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, উদ্ধার করো।

তার আগে এই মারের আমি বদলা নোব। হরিশঙ্করের একটাই মন্ত্র, টিট ফর ট্যাট।

উত্তেজনায় তুই ভুলে গেছিস, আশাকে আমরা এখানে প্রতিষ্ঠিত করতে এসেছি। ওর বিষয়সম্পত্তি পাওনাগণ্ডা আমরা বুঝে নিতে এসেছি।

পিসিমা বললেন, সে তো আর হবার উপায় নেই ছোটমামা। সবই তো সই করিয়ে নিয়েছে।

কে সই করেছে?

এদের বাবা।

হরিশঙ্কর বললেন, তা হলে তো হয়েই গেছে। ফিনিশড্‌।

ছোটদাদু বললেন, তোরা দাওয়ায় বসে আছিস? ঘরে তালা? ব্যাপারটা কী?

কাল রাতে মেরে বের করে দিয়েছে আমাদের। ঘরে ঢুকতে দেবে না।

হরিশঙ্কর বললেন, তোদের জিনিসপত্তর?

পিসিমা করুণ হেসে বললেন, কী-ই বা আছে ছোড়দা! যা আছে সব ওই ঘরে বন্ধ।

সারারাত এইখানে আছিস?

কী করব ছোড়দা? আর তো কোনও উপায় নেই।

গ্রামের আর সব মানুষ কি মরে গেছে?

তাদের হাত করে ফেলেছে। সবাই ভয় পায়। তন্ত্রমন্ত্র তুকতাক করে তো, হাতে খাঁড়া নিয়ে। ঘোরে।

হরিশঙ্কর একটা হুংকার ছাড়লেন, তন্ত্রের নিকুচি করেছে। ভাঙো তালা।

ছোটদাদু বললেন, সেখানেও একটা আইনগত সমস্যা আছে রে? প্রপার্টি তো তার।

হরিশঙ্কর আগুনের মতো উত্তপ্ত, বললেন, আইন তা হলে সবসময় অপরাধীর দিকেই থাকবে! আর আমরা কেবল ধর্মের লেজ নাড়ব! এই দেশ থেকে যেদিন ধর্ম যাবে সেইদিন থেকে আমরা সুখে থাকব। তা হলে চলল সেই রাসকেলটাকে আগে খুঁজে বের করি। পাড়া-প্রতিবেশীকে ডাকি। ছোটদাদু দাওয়ার একপাশে বসে পড়লেন। হরিশঙ্কর উঠোনে খানিক পায়চারি করে নিলেন সম্রাটের মতো। আমার শরীরে আর কোনও বল নেই। একটা ঠেলা মারলেই পড়ে যাব। সারারাত জেগে, তার ওপর ওই প্রচণ্ড হাঁটা। পায়ের খিল খুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। ছোটদাদুর পাশে থপাস করে বসে পড়লুম। জেলিফিশের মতো। আমার ভাইবোনেরা কেউই আমার সঙ্গে কথা বলছে না। সেই কতকাল আগে যখন ছাত্র ছিলুম তখন একবারই দেখা হয়েছিল কলকাতায়। বয়েস তখন খুবই কম। একেবারেই শিশু। তিনজনে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এখন কেউই আর শিশু নয়। বড় বোন কিশোরী। তারপরে সবাই বছরের ব্যবধানে সাজানো। অর্থাৎ মাথায় মাথায়।

হরিশঙ্কর পঁড়িয়ে পড়লেন। ছোটদাদুকে বললেন, তা হলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে, আমরা এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে বসে থাকব সেই ধর্মাবতার, সেই মদ্যাবতারের আবির্ভাবের অপেক্ষায়! তিনি এসে কৃপা বর্ষণ করবেন!

পিসিমা বললেন, সে তো এখন সেই বাগদিপাড়ায় তার সেই মেয়েমানুষের ঘরে আছে। বারোটার আগে আসছে না। আসবে তার চেলাচামুণ্ডা নিয়ে। এই উঠোনেই হয়তো ছাগবলি হবে। ওরাই রাঁধবে। গেলাসে গেলাসে মদ ঢালা হবে। তখন আর আমরা ত্রিসীমানায় থাকি না। লাল ঢ্যালা ঢ্যালা চোখ। বিশ্রী গালাগাল। হাত ধরে টানাটানি।

হরিশঙ্কর বললেন, এখানে তোদের আপনার লোক বলে কি কেউ নেই! জ্ঞাত-গুষ্টি সব মরে গেছে? না রাধা এমন ব্যবহার করে গেছে যে কেউই আর তোদের ছায়া মাড়ায় না?

কার অত সাহস আছে ছোড়দা! সকলেই ছেলেপুলে নিয়ে সংসার করে। তুকতাক করে দিলে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে যাবে।

হরিশঙ্কর হাঁটুতে চাপড় মেরে বললে, উঃ, দেশটা কী কুসংস্কারে পড়ে আছে! জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্ল্যানিং সব ব্যর্থ। এই অন্ধকারে কিছুই ঢুকতে পারছে না। তা হলে তোদের আর এখানে রেখে লাভ কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *