2 of 3

২.৪৪ ঝোঁকের মাথায় প্রতাপ

ঝোঁকের মাথায় প্রতাপ বাড়ি ফেরার পথে একটা মস্ত বড় ইলিশ মাছ কিনে ফেললেন। বিমানবিহারীর বাড়ি থেকে প্রতাপ হেঁটেই ফিরছিলেন, রাত প্রায় ন’টা, জগুবাবুর বাজারের সামনে, ফুটপাথেই একজন ইলিশ নিয়ে বসেছিল, ঝুড়িতে মাত্র পাঁচটা মাছ। আর কিছু নয়, মাছগুলোর সাইজ দেখেই প্রতাপকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। মাছের দেশের মানুষ, সত্যিকারের ভালো মাছ দেখলে চোখ আটকে যাবেই।

প্রত্যেকটি ইলিশই অন্তত পৌনে দু’ কেজি ওজন হবে, চওড়া পিঠ, সরু পেট, আঁশের চকচকে ভাব দেখলেই বোঝা যায় বেশ টাটকা। এরকম নিখুঁত গড়নের ইলিশ সহসা বাজারে ওঠে না। বিক্রেতাটি বললো, আরমানি ঘাটের ইলিশ, বাবু, মাত্তর এক ঘণ্টা আগে ধরা পড়েছে!

রাত ন’টার সময় এত বড় একটা ইলিশ কেনার কোনো মানে হয় না, তবু প্রতাপ নড়তে পারছিলেন না। এরকম একটা ভালো জিনিসকে কি অবহেলা করা যায়? সরস্বতী পুজো পার হয়ে গেছে, এখন পেটে ডিম নেই, স্বাদ খুব ভাল হবে। একসময় প্রতাপদের বাড়িতে প্রত্যেক সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ আসতো, তখন তাঁদের পরিবারে অনেক মানুষ ছিল, ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া হতো।

দরাদরি করার আগে ঝট করে একটা বাল্যস্মৃতি মনে পড়ে গেল। তখন প্রতাপের বয়েস কত হবে, তের কিংবা চোদ্দ, বাবার সঙ্গে কোথায় যেন নৌকো করে যাওয়া হচ্ছিল, আরিচা ঘাটে ইলিশ মাছের নৌকো দেখে বাবা দরাদরি শুরু করে দিলেন। সেই ইলিশগুলো কি এই রকমই বড় ছিল? প্রতাপের বাবা কক্ষনো কম জিনিস কিনতে পারতেন না, সামান্য একটু দরের সুবিধে হবে বলে তিনি এক হালি অর্থাৎ চারখানা ইলিশ কিনে ফেললেন। সুহাসিনী আঁতকে উঠে বলেছিলেন, এত মাছ কে খাবে? বাবা অম্লান বদনে উত্তর দিয়েছিলেন, শুধু নিজেদেরই খেতে হবে তার কী মানে আছে, অন্যদের দেবে, বাসেদের বাড়ি, চক্রবর্তীদের বাড়ি পাঠাবে! তাই-ই হয়েছিল শেষ পর্যন্ত, প্রায় মাঝ রাত্তিরে প্রতিবেশীদের ঘুম ভাঙিয়ে মাছ পাঠানো হয়েছিল এবং তাঁরা খুশীও হয়েছিলেন।

ছাত্র বয়েসে, প্রতাপের সঙ্গে তাঁর বাড়ির লোকদের প্রায়ই ইলিশ বিষয়ে তর্ক হতো। পদ্মার ইলিশ ভালো না গঙ্গার ইলিশ? প্রতাপ কলকাতার ছাত্র, তিনি বলতেন, পদ্মার ইলিশ অনেক বেশি পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সত্যিকারের ভালো স্বাদ গঙ্গার ইলিশের, বিশেষত বাগবাজারের ঘাটের। প্রতাপের বাবা, মা, দিদিরা হৈ হৈ করে উঠতেন একথা শুনে। সুহাসিনী ঠাট্টা করে বলতেন, ঘটিরা তো ইলিশ খাইতে জানেই না, কয় কি না, হাতে ত্যাল লাগে। আরে মরণ, ইলিশ খাইয়া যদি দুইদিন হাতে সেই ত্যালের গন্ধ না থাকে, তয় আবার সেডা ইলিশ কিসে?

প্রতাপ একবার ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় দুটি গঙ্গার ইলিশ কাটিয়ে, নুন-হলুদ মাখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, রান্নার পর সুহাসিনী মুখে একটা টুকরো ঠেকিয়ে থু থু করলেন এমন যে তাঁর আর কিছুই খাওয়া হলো না, অন্যরা কেউ সে মাছ ছুঁয়েও দেখলো না!

তবু প্রতাপ এখনো গঙ্গার ইলিশের ভক্ত। একবার তিনি ভাবলেন, ঝুড়ির পাঁচটা ইলিশই কিনে নেবেন। তাঁর পকেটে আজ টাকা আছে। এই মাছগুলো যদি আজ রাত্তিরেই বিক্রি না হয়, বরফ চাপা দিয়ে রেখে দেওয়া হয় কাল সকালের জন্য, তখন তার স্বাদ হবে একেবারেই ভিন্ন, সেটা হবে এই সৌন্দর্য্যময় ইলিশগুলির প্রতি অপমান। ইলিশের প্রাণ থাকে জলের তলায়। জল থেকে তোলা মাত্র তার প্রাণ বিসর্জন হয়। সুতরাং তারপর যতই দেরি হবে, ততই সে অন্যরকম হয়ে যাবে।

পকেটে পয়সা থাকলেও যথেচ্ছ খরচ করার দিন আর নেই। পুরনো আমলের মেজাজ মাঝে মাঝে চাড়া দিয়ে উঠলেও তা দমন করতে হয়। তাছাড়া, এখন পাঁচটা ইলিশ নিয়ে কোন বাড়ি বাড়ি পৌঁছোবেন প্রতাপ? একজোড়া কেনা যেতে পারে, একটা দিয়ে আসা যায় বিমানবিহারীকে, সে দশটার আগে খেতে বসে না, গরম গরম মাছ ভাজা…।

শেষ পর্যন্ত প্রতাপ একটাই কিনলেন। রাত হলেও দাম মোটেই কম নয়, ছ’টাকা করে সের চেয়েছিল, অনেক ধস্তাধস্তি করে এক সের আটশো ওজনের মাছটি দশ টাকায় রফা হলো। বিমানবিহারীর বাড়ি মাছ পৌঁছোবার ব্যাপারটায় প্রতাপ সঙ্কোচ বোধ করলেন, কোনদিন তিনি এরকম করেননি, আজ হঠাৎ একটা মাছ হাতে করে নিয়ে গেলে বিমানবিহারী নিশ্চিত হাসতেন। বিমানবিহারী খুব একটা মাছের ভক্তও নন।

ইলিশটির কানকোয় সুতলি বেঁধে প্রতাপের হাতে ঝুলিয়ে দিল মাছওয়ালাটি। এমন ভাবে মাছ নিয়ে রাত্তিরবেলা প্রতাপ বহুদিন বাড়ি ফেরেননি। একেবারে বাড়ির কাছে পৌঁছে প্রতাপের লজ্জা লজ্জা বোধ হলো। মমতার কী প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে! এখন প্রতাপের খেয়াল হলো যে সুপ্রীতির অসুখের সময় যে রাধুনীটিকে রাখা হয়েছিল, সে কাজ ছেড়ে চলে গেছে। সুপ্রীতি এখন ভালো হয়ে উঠলেও সন্ধের পর আঁশ ছোঁবেন না। মমতাকেই মাছটা কুটতে হবে, রাঁধতে হবে। বাঙাল বাড়ির বউ হলেও মমতার বাপের বাড়ির লোকেরা সঠিক অর্থে বাঙাল নয়, ইলিশ মাছ দেখলে মমতার চোখ চকচক করে না, যে-কোনো মাছই এক টুকরোর বেশি দু টুকরো খেতে সাধ হয় না তাঁর।

প্রতাপের দৃঢ় ধারণা, মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই খুশী হতেন। বিধবা হবার পর দীর্ঘকাল পর্যন্ত সুহাসিনী প্রত্যেকদিন বাজার এলে আগ্রহের সঙ্গে দেখতেন যে কী মাছ এসেছে। ছেলে, ভালোবাসে বলে মাছ রান্না করে দিতেও তাঁর দ্বিধা ছিল না। দেওঘরে প্রতাপরা গেলে সুহাসিনী অনেকবার মাছ বেঁধেছেন, প্রতাপকে যাতে মাছের মুড়োটা দেওয়া হয় সেজন্য তিনি পরিবেশনেরও সময়ও দাঁড়িয়ে থাকতেন।

আজকের মাছটা একজন কেউ জোর করে প্রতাপকে গছিয়ে দিয়েছে। মমতাকে এইরকম বললে কেমন হয়? দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এরকম একবার চিন্তা করলেন প্রতাপ। কিন্তু এই সব ছোটখাটো মিথ্যে কথাও তাঁর মুখে আসে না, তিনি ঠিক বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলতে পারবেন না। সুতরাং দরজা খোলার পর, নিটোল একটা শিল্পের মতন ইলিশটা উঁচু করে দেখিয়ে প্রতাপ বললেন, জানো, এত ভালো মাছটা দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। এরকম মাছ আজকাল দেখতেই পাওয়া যায় না।

মমতা খুশী হননি একটুও, তাঁর বিস্ময়ই বেশি। অনেকটা ভুরু তুলে তিনি বললেন, এত বড় মাছ তুমি নিয়ে এসেছো, এত রাত্তিরে, কে খাবে?

প্রতাপ বললেন, কেন, সবাই খাবে? কী এমন রাত হয়েছে?

মমতা বললেন, ছেলেমেয়েরা এই একটু আগে খেয়ে নিয়েছে!

–তাতে কী হয়েছে। গরম গরম মাছ ভাজা ঠিক খেয়ে নেবে।

বসবার ঘরের দরজা বন্ধ, ভেতরে আলো জ্বলছে। ঐ ঘরটি আপাতত অতীনের দুর্গ, অন্য কারু প্রবেশ নিষেধ। পাশের সরু বারান্দাটা দিয়ে ভেতরে আসবার পর মমতা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এতই যদি তোমার মাছ খাওয়ার লোভ, তাহলে একটা রেফ্রিজারেটার কেনা উচিত!

লোভ কথাটা প্রতাপের ব্যবহার করা ঠিক হয়নি, ঐ শব্দটি মমতা প্রতাপের বিরুদ্ধে বারবার অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করার জন্য পেয়ে গেলেন। প্রতাপের মতন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের এরকম লোভ থাকতে নেই।

প্রতাপ তবু মমতাকে খুশী করার জন্য বললেন, হাতে হঠাৎ অনেকগুলো টাকা এসে গেল বুঝলে, বিমানের কম্পানি থেকে অনেকদিন কিছু নিইনি, আজও কিছু অনুবাদের কাজ করে দিলাম। সব সুষ্ঠু সওয়া দুশো টাকা পাওয়া গেল।

–ঐ টাকা বাজে খরচ না করে রেফ্রিজারেটারের জন্য জমানো উচিত ছিল। যে বাড়িতে কারু কোনো খাওয়ার সময়ের ঠিক নেই…

–বাঃ, তাহলে একদিন একটু বাজে খরচ করব না?

আজকের মাছগুলো দেখে বহুদিন আগে আরিচা ঘাটে তাঁর বাবার মাছ কেনার দৃশ্য যে মনে পড়ে গিয়েছিল, সে কথা এখন মমতাকে বলে লাভ নেই। একটা মাছেই এই, প্রতাপ যদি পাঁচটা ইলিশই কিনে ফেলতেন, তাহলে কী হতো!

নিজের দল ভারি করার জন্য প্রতাপ গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দিদি কোথায়? দিদি ঘুমিয়ে পড়েছে?

বাল্যস্মৃতিতে ফিরে যাওয়ায় প্রতাপ বিস্মৃত হলেন যে সুপ্রীতি আর আগের মতন নেই। সুপ্রীতি নিজের দরজা খুলে বাইরে আসতেই প্রতাপ উৎসাহের সঙ্গে বললেন, দিদি, দেখেছো, দেখেছো, কী রকম টাটকা মাছ!

সুপ্রীতির পরনে কালো পাড়ের শাড়ি, মাথার চুলে হঠাৎ সাদা ছোপ লেগেছে, মুখোনি বিষণ্ণ। তিনি হঠাৎ শিউড়ে উঠে বললেন, ইঃ, খোকন, এই রাতে এত বড় একটা মাছ আনলি! মমোকে কী বিপদে ফেললি বলতো! ওকে এখন রান্না করতে হবে।

মমতা বললেন, রান্না করলেই বা খাবে কে? মাছ কেনার তো একটা সময় আছে, ছেলেমেয়েরা একটু আগে খেয়ে উঠলো।

সুপ্রীতি বললেন, তুতুল তো ইলিশ মাছ খেতেই চায় না!

প্রতাপ একবার বাথরুমের পাশের নর্দমাটার দিকে তাকালেন। তাঁর মাথায় হঠাৎ রাগ চড়ে যায়। মাছটা নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দেবেন,? এখন রাগের থেকে অভিমানটাই হলো বেশি। স্ত্রী ও দিদির সঙ্গে মায়ের এই তফাত! মা থাকলে… ছেলে শখ করে একটা জিনিস এনেছে, যতই অসুবিধে হোক, ঠিক রান্না করে দিতেন। কী এমন বেশি রাত হয়েছে।

নর্দমায় ছুঁড়ে দিলেন না বটে, প্রতাপ সেখানেই নামিয়ে রাখলেন মাছটা।

মমতা জিজ্ঞেস করলেন, কাল সকাল পর্যন্ত রেখে দেওয়া যায় না?

প্রতাপ গম্ভীরভাবে বললেন, তোমাদের যা খুশী করো।

প্রতাপের এই স্বরটা মমতা চেনেন, কোমরে আঁচল গুঁজে তিনি মাছ কুটতে বসলেন। সুপ্রীতি বললেন, তুতুলকে ডেকে দেবো, ও তোমাকে সাহায্য করবে?

মমতা বললেন, না, ওকে ডাকতে হবে না। সারাদিন হাসপাতালে ডিউটি দিয়ে এসেছে মেয়েটা…

এক ঘণ্টা বাদে খেতে ডাকা হলো প্রতাপকে। সারা বাড়িতে ম ম করছে ইলিশ মাছের তেলের গন্ধ। অথচ বাড়িটা কেমন যেন নিস্তব্ধ। অন্যদিনের তুলনায় আজ যে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটছে, সে সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের কোনো আগ্রহ নেই?

মাছটা দেখে প্রতাপের যতখানি পছন্দ হয়েছিল, মাছ খাওয়ায় ততটা লোভ নেই প্রতাপের। পেটুকের মতন আট-দশ খানা মাছ খাওয়া তাঁর স্বভাবে নেই, বড় জোর দু’তিন পীস খেতে পারেন। তিনি ভেবেছিলেন, সবাই মিলে আনন্দ করে খাওয়া হবে, ছেলেমেয়েরা উৎসাহে হই চই করবে, কেউ বলবে, আমাকে বড় পেটির মাছটা দাও… প্রতাপদের ছেলেবেলায় যেমন হতো, খেতে বসে আর ধৈর্য থাকতো না, মাছ ভাজার থালা আসতে না আসতেই শেষ!

ভাত আর ডালের বাটির সঙ্গে প্রতাপকে দু’খানা মাছ ভাজা দেওয়া হয়েছে, একটি পেটি আর একটা গাদা। এই রকম টাটকা ইলিশ ভাজতে গেলেই যে তেল বেরোয় তা অতি উপাদেয়, প্রতাপ লক্ষ করলেন, সেই তেল তাঁকে দেওয়া হলো না। ইলিশ মাছের পেটের মধ্যে যে তেলটা থাকে, সেটা ভাজা খাওয়া প্রতাপের অতি প্রিয়, মমতা বোধহয় সেটা ফেলেই দিয়েছেন!

মমতা একটা বড় থালা ভর্তি আট দশখানা মাছভাজা এনে বললেন, এত মাছ কে খাবে বলো তো? আরও তো একগাদা রয়েছে! তুতুল কিছুতেই খেতে চাইলো না, ওর গন্ধ লাগে। মুন্নি ঘুমিয়ে পড়েছে, ডেকে তুলে কত খাওয়াবার চেষ্টা করলুম, আধখানা কোনোরকমে খেয়ে আবার চোখ বুজে ফেললো, জোর করে কি খাওয়ানো যায়?

রাত্রের রান্না আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়, মমতাকে এত রাতে কোনোদিন রাঁধতে হয় না। আগুনের আঁচে মুখখানা লালচে হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য কোনো রাগের ভাব নেই। মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা।

মমতার দিকে দু’এক পলক তাকিয়ে প্রতাপ বললেন, বাবলু? বাবলুকে দাওনি?

খেতে আসবার সময়েও প্রতাপ দেখেছেন বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে। বাবলু পড়ছে।

মমতা এবারে খানিকটা যেন ভয় পেয়ে বললেন, বাবলুও খাবে না বললো, কাল সকালে

প্রতাপ অবাক হলেন। বাবলু মাছ ভালোবাসে তিনি জানেন, খেতে বসে রোজই বাবলু আগে জিজ্ঞেস করে, আজ কী মাছ? সেই বাবলু এত ভালো মাছ খাবে না!

মমতা বললেন, বাবলু অনেক রাত জেগে পড়ে তো, পেট হালকা রাখতে চায়, খাওয়ার সময়েও তো মাত্র দু’খানা রুটি খেয়েছে, ইলিশ মাছ খেলে পেট গরম হবে!

প্রতাপ বললেন, দূর! ঐ বয়েসের ছেলের আবার পেট গরম কী? তুমি বলেছো, ভালো ইলিশ?

–হ্যাঁ, বলেছি।

–বাবলু নিশ্চয়ই ঠিক বোঝেনি, দাঁড়াও আমি বাবলুকে ডাকছি।

–না, ওকে ডেকো না! প্রতাপ মমতার দিকে একটা অদ্ভুত চাহনি দিলেন। ছেলেকে তিনি ডাকবেন, তাতে মমতার আপত্তি কিসের?

পরীক্ষার দু’তিন সপ্তাহ আগে বাবলু পুরোপুরি বদলে যায়, বইয়ের পাতায় চোখ রেখে রেখে চোখ ক্ষইয়ে ফেলে একেবারে, বাড়ি থেকে বেরুতেও চায় না। এই সময়টায় তার মেজাজটাও তিরিক্ষি হয়ে থাকে। মমতার সেইটাই ভয়।

প্রতাপ এঁটো হাতে উঠে গিয়ে বসবার ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলেন, বাবলু, বাবলু!

দরজা খুলতে একটু দেরি হলো। প্রতাপ ভাবলেন, রাত জাগার জন্য বাবলু বোধ হয় সিগারেট-টিগারেট খায়, তাই দরজা বন্ধ রেখেছে। বাবলুর থেকেও কম বয়েসে প্রতাপ সিগারেট ধরেছিলেন, তাই ছেলের সিগারেট টানায় তিনি দোষের কিছু দেখেন না। বাবলু তো দরজা খোলা রেখেও সিগারেট টানতে পারে, মমতাকে এই কথাটা বলে দিতে হবে।

প্রথমেই দরজা না খুলে বাবলু জিজ্ঞেস করলো, কে?

প্রতাপ বললেন, আমি রে, আমি! একটু খোল তো!

বাবলু আবার বললো, কী, বলো না?

–তুই একবার দরজাটা খুলতে পারছিস না?

দরজাটা খোলার সত্যি খানিকটা অসুবিধে আছে বাবলুর। রাত জাগার সে একটা নিজস্ব উপায় বার করেছে। সে সব জামা-কাপড় খুলে ফেলে। হঠাৎ প্রচণ্ড গরম পড়ে গেছে, ঘামে গেঞ্জি ভিজে যায়, পা-জামা পর্যন্ত চট চট করে, তাই বাবলু একা ঘরে কিছু গায়ে রাখতে চায় না। সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সে বই হাতে নিয়ে সারা ঘর পায়চারি করে। এই অবস্থায় যে-কেউ তাকে দেখলেই ভাববে পাগল, মাথার চুল উস্কোখুস্কো, চোখ দুটি জ্বলজ্বলে, তার ছিপছিপে লম্বা শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত থাকে না। দরজা-জানলা সব সে নিচ্ছিদ্রভাবে বন্ধ করে রাখে, যাতে বাইরের কোনো আওয়াজ না আসে।

কিছু একটা বিপদের কথা ভেবেই দ্রুত পোশাক পরে নিয়ে বাবলু দরজা খুলে বললো, কী হয়েছে?

প্রতাপ বললেন, আজ খুব ভালো মাছ এনেছি। কয়েকখানা খেয়ে যা। আমাদের সঙ্গে একটু বসবি আয়!

এক ঝলক রাগ এসে গেল বাবলুর মুখে। কিন্তু সে বাবার মুখের সামনে চেঁচিয়ে কথা বলে না। পেছনে মায়ের দিকে একপলক ঝাঁঝ চোখে তাকিয়ে সে শান্তভাবে বাবাকে বললো, বাবা, আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আর কিছু খাবো না।

প্রতাপ বললেন, সে তো অনেকক্ষণ আগে খেয়েছিস। এখন ক’খানা মাছ ভাজা খাবি, তাতে কী আছে!

–এখন আর আমি খেতে পারবো না, বাবা।

–একবার এসেই দ্যাখ না, খুব ভালো মাছ, এরকম ইলিশ বাজারে চট করে দেখাই যায়।

–আমার পেট ভর্তি, মাকে তো বলেইছি, আর রাত্তিবে আমি কিছু খেতে পারবো না।

–এত মাছ আনলুম, সব নষ্ট হবে?

বাঃ, নষ্ট হবে বলে আমাকে জোর করে খেতে হবে? পরীক্ষার আগে আমি পড়বো, না শুধু খাবো?

শেষের কথাটায় প্রতাপ গলা চড়িয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী বাবলুও কণ্ঠস্বর উচ্চগ্রামে তুলেছে। নিজেরটা প্রতাপ শুনলেন না, ছেলেরটাই তাঁর কানে যেন একটা ঝাঁপটা মারলো।

তিনি আস্তে আস্তে বললেন, ও, খাবি না! আচ্ছা থাকা।

প্রতাপ ফিরে এলেন খাওয়ার টেবিলে। নিঃশব্দে দুগ্রাস ভাত মুখে তুললেন, তাঁর মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেছে। মাছটাও খেতে একটুও ভালো লাগছে না।

অন্য দিকে কথা ফেরাবার জন্য প্রতাপ মমতাকে বললো, তুমিও খেতে বসে যাও, দেরি করছো কেন?

মমতা বললেন, একটু পরে বসবো… একবার চট করে গা ধুয়ে নেবো, ইলিশ মাছ ভাজলে সমস্ত শরীরে আঁশটে গন্ধ হয়ে যায়। শোনো, ঝোলটোল করিনি কিন্তু, অর্ধেকটা ভেজেছি, বাকিটা হলুদ মাখিয়ে রেখে দেবো কালকের জন্য। যা গরম পড়েছে, থাকবে?

প্রতাপ মৃদু গলায় বললেন, পাশের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও না! ওরা একবার মিষ্টি না কী যেন দিয়েছিল!

–তা বলে এত রাত্রে মাছ পাঠানো যায়? তুমি কি পাগল হয়েছে? তুমি নিজে চাও দিয়ে এসো, আমি পারবো না!

–মমো, মাছটা নিয়ে এসে তোমাদের খুব বিপদে ফেলে দিয়েছি, তাই না? আমার হঠাৎ যদি একদিন একটা কিছু সাধ আহ্লাদ হয়, তার কোনো দাম নেই তোমাদের কাছে! আমি শুধু টাকা রোজগার করে যাবো তোমাদের জন্য!

এবারে মমতা তীব্র অভিমানের সঙ্গে বললেন, তুমি এই কথা বলছো? এত রাতে আমি তোমার জন্য মাছ কুটে, রান্না করে দিইনি? কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে, কয়লার উনুন জ্বেলে… তোমার মাছ খেতে লোভ হয়েছে, তুমি খাও না কত খাবে। যদি চাও তো আরও ভেজে দিতে পারি!

–আমার লোভ!

প্রতাপ আর থাকতে পারলেন না, সম্পূর্ণ ভাতের থালাটা ধরে উল্টে দিলেন। তারপর মাছের প্লেটটা ফেলে দিলেন মাটিতে!.

পর মুহূর্তেই তাঁর অনুশোচনা হলো। ইদানীং তিনি এরকম রাগের প্রদর্শন করেন না। জগুবাবুর বাজারের সামনে এক মাছওয়ালার ঝুড়িতে কয়েকটা টাটকা ইলিশ দেখে প্রতাপের বাবার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল, সেই স্মৃতিটাই যত নষ্টের মূল! ঐ সব স্মৃতি মুছে না ফেললে এখনকার জীবনে আর শান্তি নেই।

তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আই অ্যাম সরি।

দু’জনে দু’জনের দিকে সোজা তাকিয়ে রইলেন বেশ কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর মমতা অনুত্তেজিতভাবে বললেন, ঠিক আছে বসো, আরও ভাত এনে দিচ্ছি, আর কয়েকখানা মাছ। ভেজে দিচ্ছি তাড়াতাড়ি।

প্রতাপ উদাসীন ভাবে বললেন, না, আর খাবো না, যথেষ্ট হয়েছে।

হাত ধুয়ে তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে।

প্রতাপের থালা ওল্টাবার শব্দে সুপ্রীতি বেরিয়ে এসেছিলেন। সব বুঝেও তিনি কিছু বললেন, আবার ফিরে গেলেন। ইচ্ছে থাকলেও তিনি মমতাকে সাহায্য করতে পারবেন না এঁটো তুলতে, মাছ-মাংসে হাত ছোঁয়াতে এখন তাঁর গা ঘিনঘিন করে। রামনাথ স্বামী নামে এক গুরুর কাছে দীক্ষা নেবার পর আমিষের প্রতি তাঁর ঘৃণা হঠাৎ বেড়ে গেছে।

মমতা পুরো খাবার ঘরটা পরিষ্কার করে, মাছগুলো ফেলে দিলেন রাস্তার আস্তাকুঁড়ে; বাড়ির মধ্যে রাখলে গন্ধ হবে। তারপর তিনি বাথরুমে গিয়ে শুধু গা ধোওয়ার বদলে স্নান করলেন। ভালো করে। আর তাঁর একটুও খাওয়ার ইচ্ছে নেই, তবু খেতে বসলেন এবং নিজের জন্য একটি গাদার মাছ ভেজেও নিলেন। বস্তুত মমতাই সবচেয়ে ভালো করে খেলেন মাছটা। ইলিশ মাছের প্রতি তাঁর বিশেষ ভালোবাসা নেই, কিন্তু প্রতাপের কথা ভেবেই খেলেন।

শোওয়ার ঘর সিগারেটের গন্ধে ভরপুর। অন্তত তিন চারটি সিগারেট টেনে কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন প্রতাপ। মমতা ইচ্ছে করেই এতক্ষণ এ ঘরে আসেননি। একটা কথা বললেই ঝগড়া বেঁধে যেত। উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন প্রতাপ, মমতা জানেন,ঐটা রাগের ভঙ্গি, ঠিক শিশুদের মতন। তাঁর স্বামীর চরিত্রে এখনো অনেক ছেলেমানুষী রয়ে গেছে। আজকের কাণ্ডটাও প্রতাপের ছেলেমানুষী ছাড়া আর কী? এত রাত্রে একটা অত বড় ইলিশ আনলেই বাড়ির সকলকে সেটা আহ্লাদ করে খেতে হবে? অত বড় একটা মাছ কেনার আগে, বাড়িতে যে ফ্রিজ নেই সেকথা ভাবা উচিত ছিল!

বাবলুর ওপরেই বা রাগ করার কী মানে হয়? সে বেচারি এখন দিন রাত জেগে পাগলের মতন পড়ছে, এটাই ওর স্বভাব, প্রত্যেক পরীক্ষার আগে এরকম করে। এভাবে পড়লে শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে। খাওয়াদাওয়া সাবধানেই তো করা উচিত। অন্য কিছু খেতে চায় না বাবলু, দুধ ভালোবাসে, কাল থেকে ওর জন্য দুধ বাড়িয়ে দিতে হবে।

অনেক রাত পর্যন্ত মমতার ঘুম এলো না। ঠিক তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই, ওরকম তেলালো ইলিশ খেয়ে তাঁর অম্বল হয়ে গেছে।

জোয়ানের আরক খাবার জন্য আবার উঠতে হলো মমতাকে। তাঁর যে আলসারের ধাত আছে, একথা প্রতাপের মনে থাকে না।

ওষুধ খাবার পর মমতা ঘড়ি দেখলেন। তার পর বাইরে এসে উঁকি দিয়ে দেখলেন বাবলুর ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। আলো জ্বেলেই ঘুমিয়ে পড়লো নাকি? এই গরমে ও সব জানলাও বন্ধ করে রাখে কেন?

তিনি বেরিয়ে এসে ও ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়ে চাপা গলায় ডাকলেন, বাবলু, এই বাবলু!

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, আবার কী হলো?

মমতা বললেন, এখনো ঘুমোস নি? এবার শুয়ে পড়, আর পড়তে হবে না, শরীর খারাপ করবে।

–ঠিক আছে, মা তুমি যাও!

–না। তুই শো এবার। কটা বাজে জানিস? পৌনে তিনটে!

এবারে বাবলু প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললো, আঃ, মা, যাও না, কেন বিরক্ত করছে আমাকে?

অন্ধকার বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন মমতা। তাঁর স্বামীর মেজাজ সর্বক্ষণ চড়া, কখন যে রাগারাগি করবেন তার ঠিক নেই। নিজের বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করেছেন যে ছেলেকে, সেও আজকাল যখন তখন ধমকায়। বাড়িতে সবসময় একটা চাপা অশান্তি। সুপ্রীতিও আজকাল প্রায়ই রাগ করে কথা বন্ধ করে দেন। এসব হচ্ছে কেন? টাকার টানাটানি, আগেকার মতন স্বচ্ছল অবস্থা নেই, সেই জন্য? আগেকার মানে তো অনেকদিন আগেকার। মমতাও তো বেশ অবস্থাপন্ন বাড়ি থেকেই এসেছেন, কিন্তু এতদিনে তিনি সব কিছু মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু মালখানগরের এই এরা এখনো পুরোনো গর্বের কথা ভুলতে পারে না। এত টানাটানির মধ্যেও প্রতাপ দশ টাকা খরচ করে একটা ইলিশ নিয়ে এলেন, যা কেউ খেলই না! তারও যেন সব দোষ মমতার।

অভিমান, বিষাদ ও অনুশোচনা নিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মমতা আবার বসবার ঘরের দরজায় মৃদু চাপড় দিয়ে কাতর গলায় বললেন, বাবলু, লক্ষ্মীসোনা, এবার ঘুমিয়ে পড়। আমার কথা শোন! ও বাবলু, আজ থাক, শরীরকে কষ্ট দিলে কি পড়াশুনো হয়, না কিছু মনে থাকে!

বাবলু কোনো উত্তর দিল না। সে এর মধ্যেই ঘুমে ঢলে পড়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *