২.৪২ To see a world in a grain of sand

To see a world in a grain of sand
And heaven in a wild flower
Hold infinity in the palm of your hand
And eternity in an hour.

টুসকির শব্দটা ঠিক যেন বাজ পড়ার শব্দের মতো, কড়াক। সকলেই চমকে উঠলেন। অবিশ্বাস্য। দুটো আঙুলে এমন ভয়ংকর শব্দ বের করা যায়! যায় তো। এই তো ছোটদাদু করে দেখালেন। সেই শব্দে পণ্ডিতমশাই কেমন যেন হয়ে গেলেন। হরিশঙ্কর আমার কানে কানে বললেন, খেলা খুব জমে গেছে।

হরিশঙ্কর এইভাবে যখন কানে কানে কথা বলেন, তখন আর পিতা বলে মনে হয় না, মনে হয় সমবয়সি প্রিয় এক বন্ধু। মুখে অদ্ভুত সুন্দর পিপারমেন্টের মতো গন্ধ। আমার গুরু স্বামী নির্মলানন্দজি আমাকে বলেছিলেন, মানুষ যখন ইন্দ্রিয় জয় করতে পারে তখন তার ভেতরটা সাত্ত্বিকভাবে ভরে যায়। তখন তার শ্বাসে, তার দেহনির্যাসে সুগন্ধ বেরোয়। হরিশঙ্কর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। মৎস্যগন্ধা, পদ্মগন্ধা শোনাই ছিল। এখন হয়তো দেখছি। ছোটদাদুর শরীর থেকে সবসময় গোলাপের গন্ধ বেরোয়। অবাক অবাক সব কাণ্ড চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। ধন জন মান নয়, সেই সব দিব্যানুভূতি লাভের প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগছে। ক্ষুদ্র সামর্থ্যে কিছুতেই ধরতে পারছি না। ছটফট করেই মরছি।

টুসকির শব্দে পণ্ডিতমশাই কেমন যেন ধোঁয়াটে হয়ে গেলেন। চোখের ভুলও হতে পারে। আমার মন দুর্বল। দুর্বল আমার স্নায়ু। কঠিন ব্যক্তিত্ব সবসময়েই আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। একসময় আমি সম্মোহনকারীর প্রিয় মিডিয়ম ছিলুম। আমাকে সহজে সম্মোহিত করা যেত বলে।

মৃদু আলো। চার পাশে গাছপালা, বাতাসের ঝপর ঝপর শব্দ। ধ্যানস্থ কিছু মানুষ। দূর থেকে ভেসে-আসা আরতির শব্দ। এইসব মিলিয়ে যে মায়া তৈরি হয়েছে, তারই প্রভাবে হয়তো এইরকম মনে হচ্ছে। ছোটদাদু হঠাৎ পণ্ডিতমশাইকে নিয়ে পড়লেন কেন? কৃপা করার হলে আরও ভো অনেকে রয়েছেন। আমি নিজেই তো আছি। দিন না সেই শক্তি, পৃথিবীতে থেকেও যেন পৃথিবীর বাইরে চলে যেতে পারি। অন্ধকারে থেকেও যেন আলোতে সাঁতার কাটতে পারি। কতবার বলেছি। পায়ে ধরেছি। সোডার বোতল খোলার মতো অলৌকিক হাসি ছড়িয়ে বলেছেন, জীবনটাকে নষ্ট করিসনি। মূর্খ অশিক্ষিত অক্ষম গ্রাম্য লোককে আমরা বোকা বানাই, শিষ্য করি, দীক্ষা দিই। ধর্ম একটা জোচ্চুরি ব্যাবসা। আগে দেখা যেত বেদের মেয়ে পাড়ায় পাড়ায় হেঁকে যাচ্ছে, দাঁতের পুকা বের করি। ওঝা এসে ভূত ছাড়াচ্ছে। সর্পাঘাতের চিকিৎসা করছে। সব বাজে। বুজরুকি। ধাপ্পা। কলাটা, মুলোটা পাবার ধান্দা। এসব শিক্ষিত শহুরে মানুষের জন্যে নয়। আমরা কোয়াক। বোকাদের শ্রদ্ধেয়। আমরা ম্যাজিক দেখাই। অসহায় অশিক্ষিত মানুষ ভেলকি দেখে ভুলে যায়। আমরা মিঠাই-মণ্ডা খেয়ে ভুড়ি বাগাই। আমরা চিট। আমাদের ফাঁদে পা দিয়ো না। তোমাদের জগৎ আলাদা। চাকরি করো, সংসার করো, ঘরদোর সাজাও, বিদেশ যাও, ছেলেমেয়ে মানুষ করো। ভগবান-ভগবান করে জীবন নষ্ট কোরো না। ভগবান হলেন অশিক্ষিত দরিদ্র মানুষের অলীকে বিশ্বাস। ভগবান কোনওদিন তোমাদের বৈঠকখানায় চা খেতে আসবেন না।

সে প্রায় তিরস্কারের মতো। ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার মতো। তখনই বুঝেছি, সময় হয়নি। এ জীবনে না-ও হতে পারে। অসুখ। ভীষণ অসুস্থ আমি। এর নাম ভবরোগ। এ রোগ সারবে কীসে! দাওয়াই আছে। কীরকম? স্বাতী নক্ষত্রের জল পড়বে মড়ার মাথার খুলির ওপর। সেই জল একটা ব্যাং খেতে যাবে। সেই ব্যাংকে একটা সাপে তাড়া করবে। ব্যাংকে কামড়াতে গিয়ে সাপের বিষ ওই মড়ার মাথার খুলিতে পড়বে, আর সেই ব্যাংটি পালিয়ে যাবে। সেই বিষজলের একটু খেতে হবে।

এ তো অসম্ভব। না অসম্ভব নয়। ঈশ্বরের শরণাগত হয়ে, ব্যাকুল হয়ে ডাকতে হবে। কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করতে হবে। সেই ব্যাকুলতা আমার নেই। মহাপুরুষ দেখেই বুঝেছেন, এর থাক। আলাদা, জাত আলাদা। ব্যাঙ্কের কাউন্টারে নোট ভাঙাবার কায়দায়, মর্কট বৈরাগ্য ভাঙিয়ে ঈশ্বরপুরিয়া পেতে চায়।

পণ্ডিতমশাই হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে লাগলেন। তারপর কোনওরকমে দাঁড়িয়ে, টলতে টলতে বেরিয়ে গেলেন। ছোটদাদু বললেন, হৃদকমলে বড় ধুম লেগেছে। মজা দেখিছে আমার মন পাগলে। ঘোর লাগিয়ে দিয়েছে ঘোর। এক জালা মদ খাইয়ে দিয়েছি। সুরা পান করি নে আমি সুধা খাই জয় কালী বলে। হঠাৎ ছোটদাদু গান শুরু করলেন, এ মদ যে রসে ভরা। ষড় রিপু চোলাই। করা। যে খায় সে আত্মহারা। মদে তারে খায় না ॥

ছোটদাদু হঠাৎ উঠে পড়লেন।

হরিশঙ্কর বললেন, তুই একাসনে কতক্ষণ বসে আছিস জানিস? ছ’ঘণ্টা।

ছোটদাদু বললেন, এ কিছুই নয়। আমি পরপর তিন দিন একভাবে বসে থাকতে পারি। এর নাম স্থাণু যোগ। আমার গুরু শিখিয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে থাকে। একটা দিন কেটে গেল। সে বেশ মজা। চুপচাপ একভাবে দাঁড়িয়ে আছি, যেন একটা গাছ। অদ্ভুত সব অনুভূতি হতে থাকে। অনুভূতিও তো একটা শিক্ষা।

অবশ্যই। ফিলিংস। তা চললি কোথায়?

চান করব।

কোথায় চান করবি?

পুকুরে।

মোহনদা বললেন, তা হলে একটা লণ্ঠন নিয়ে আসি। একটা নতুন গামছা।

তুমি গামছা দাও। আলোর প্রয়োজন নেই। তারার আলোর প্রদীপ জ্বেলে চলব আমি আমার পথে। পিন্টু, চলো আমার সঙ্গে।

এত ঘনিষ্ঠতা হয়নি আগে। এই প্রথম বাইরের পরিবেশে দেখছি একজন সাধককে। সাধনা সাধক শব্দদুটো শোনাই আছে। মনে হয় খুব পরিচিত। আসলে কিছুই জানি না। কীভাবে ধাপে ধাপে সাধারণ থেকে অসাধারণ একটা স্তরে। থিয়োরি জানি, প্র্যাকটিস জানা নেই।

ছোটদাদু আগে আগে চলেছেন। আমরা পেছন পেছন। আমি আর মোহনদা। ছোটদাদু বললেন, মোহন, তুমি যাও। তোমার আসার প্রয়োজন নেই।

মোহনদা ফিরে গেলেন। মোহনদা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অদ্ভুত একটা কাণ্ড হল। ছোটদাদু অন্ধকার পথে পা ফেলছেন, পা দিয়ে একটা আলো ঠিকরোচ্ছে। যেন টর্চলাইট হাঁটছে, যার ফোকাসটা নীচের দিকে। আমার সবেতেই ভীষণ ভয়। এত পরিচিত একজন মানুষকে ভীষণ অপরিচিত লাগছে। এর নামই কি ডাকিনী বিদ্যা? অস্বাভাবিক একটা আলো। নীল তার রং। সেই আলোয় ঘাস আগাছা স্পষ্ট। ছোট ছোট ব্যাং থমকে আছে লাফ মারার আগে। জ্বলজ্বল করছে ছোট ছোট চোখ। নানারকম পোকা। ছোটদাদু চলেছেন অলৌকিক শরীর নিয়ে। কোন বিজ্ঞানে সম্ভব হচ্ছে। প্রশ্ন আসছে। সাহস হচ্ছে না করার। মানুষটি এখন আমার সম্পূর্ণ অচেনা। মহাকাশ থেকে নেমে আসা মহাজীবের মতো। আলোয় আলোকময় করে হে, রবীন্দ্রনাথের গান মনে পড়ছে, তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ। তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান।

আমাকে সঙ্গে আনার কারণ, আমার অবিশ্বাস ভাঙাবেন। আমি যা পারি না, আমি যা জানি না, আমি যা দেখিনি তা নেই। এই আমার বিশ্বাস। বাকিটা অবিশ্বাস। আমার সামনেই ছোটদাদু। হঠাৎ বললেন, চার পাশে সাদা সাদা সুবাসিত ফুল নেই কেন? ফুল! ফুল!

ভেলকি হয়ে গেল। ফুটফাট, ফুটফাট। ফুলে ভরে গেল। গোয়ালের গন্ধ ভরে গেল কনক চাপার গন্ধে। আমি কি জেগে আছি, না স্বপ্নে ভাবছি! এ কেমন ঘোর! ছোটদাদু জলে নেমে গেলেন। সে আর এক অলৌকিক দৃশ্য। যেন চাঁদ পড়েছে জলে। একটা আলোর শরীর জলের তলা পর্যন্ত ঝিলঝিল করে নেমে গেছে। এত আলো যে দেখতে পাচ্ছি ছোট ছোট মাছ খেলা করছে। কী সুন্দর! স্লেটের মতো কালো আকাশ। খণ্ড খণ্ড তারা। ফুলের গন্ধ। মনে হয় স্বর্গে আছি!

জলে ওই অপূর্ব দৃশ্য দেখে মনে হল কেন আমি ম্যাজিক ভাবছি? আমার সেই শ্লোকটি যে মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। কেন মনে পড়ছে? আমি সম্পূর্ণ আবিষ্ট। আমি কে? আমি কোথায়? সব ভুল। হয়ে যাচ্ছে। প্রভাবের এক বৃত্তের মধ্যে ঢুকে গেছি আমি। যা মনে আসার কথা নয়, তাই মনে আসছে। সেরেছে, ভক্তি আসছে। একটা লীলার মধ্যে ঢুকে গেছি আমি। শ্রীরাধিকা কৃষ্ণকে দেখেছেন। কৃষ্ণ কেমন, বর্ণনা দিচ্ছেন বিশাখাকে : কুরঙ্গমদজিবপুঃ পরিমলোর্মি কৃষ্টাঙ্গনঃ ইত্যাদি। কস্তুরীকে হার মানায় এমন দেহের সুগন্ধের ঢেউ দিয়ে যার আনন পরিমার্জিত, নিজের অস্থিত অষ্টনখে উৎপলের গন্ধযুক্ত, নতুন চাঁদের মতো চন্দনের ও অগুরুর সুগন্ধ যুক্ত হে মদনমোহন।

সেই দৈবী দেহ আর এই দেহ, তফাত কোথায়? এরই নাম যোগবিভূতি। যোগে সবই সম্ভব। ছোটদাদু আমাকে একদিন ছান্দোগ্য উপনিষদ বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন। আমাকে নিয়ে যে চেষ্টা করেননি তা নয়। শ্বেতকেতুর গল্প বলছিলেন। উদ্দালক শ্বেতকেতুকে আদেশ করলেন, ওই জলের পাত্রে এই লবণ খণ্ডটা ফেলে দাও। শ্বেতকেতু আদেশ পালন করলেন। উদ্দালক বললেন, যাও, এইবার তুমি রাতের বিশ্রাম নাও। কাল সকালে আবার দেখা হবে। সকালে শ্বেতকেতু এলেন।

উদ্দালক : সেই লবণ খণ্ডটি যা কাল রাতে তুমি জলে নিক্ষেপ করেছিলে, আমাকে এনে দাও।

পিতার আদেশে পুত্র জলাধারের কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন। লবণ খণ্ড কোথায়! জলে গুলে গেছে।

উদ্দালক : পুত্র, জলের উপরিভাগ আস্বাদন করো। স্বাদ কেমন?

শ্বেতকেতু : পিতা! জলের স্বাদ লবণাক্ত।

উদ্দালক : আচ্ছা, মধ্যভাগের স্বাদ নাও।

শ্বেতকেতু : লবণাক্ত।

উদ্দালক : বেশ, এইবার একেবারে তলার জল গ্রহণ করো!

শ্বেতকেতু : পিতা। এর স্বাদও লবণ মিশ্রিত।

উদ্দালক : পুত্র, পাত্রের সমস্ত জল ফেলে দিয়ে আমার কাছে এসো।

আদেশ পালন করে পিতার কাছে ফিরে এলেন পুত্র। ফিরে এসে বললেন, জল ফেলে দিলেও ওই লবণ সবসময় জলেই থাকবে।

উদ্দালক : পুত্র, এইটাই তোমার শিক্ষণীয়। লবণ দৃশ্যমান নয়। আস্বাদনে তুমি বুঝলে। আবার এও বুঝলে নিক্ষিপ্ত হলেও লবণ জলেই থাকবে। জগৎ-কারণে তিনি দৃশ্যমান নন, কিন্তু প্রতিটি কণায় কণায় তিনি উপস্থিত। প্রতিটি জলবিন্দুতে লবণকণার মতো। অনুভবে তাঁর উপস্থিতি।

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে। হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে, হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।

ছোটদাদু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। আমার, তোমার, তার, সকলের মধ্যেই সেই একের অস্তিত্ব। একটা পাথর তোলো, দেখো তিনি, একটা কাঠ চেরো, সেখানেও তাঁর উপস্থিতি। এই তার-তার বলতে বলতে ছোটদাদুর বড় বড় স্ফটিকের মতো চোখ জলে টলটল করে উঠল। কী ভয়ংকর সেই বিচ্ছেদ বেদনা! পৃথিবীর সমস্ত স্বাদ যেন বিস্বাদ।

ছোটদাদু তখন ছান্দোগ্যের আর একটি শ্লোকে চলে গেলেন। এই শরীর, এ হল আত্মার পুরী। ছোট্ট একটি ঘর আছে সেখানে। পদ্মের মতো তার আকৃতি। সেই ঘরে ছোট্ট একটু স্থান। সেখানে। কী আছে? কে আছে? সেই স্থানটুকুতে আছে সমগ্র বিশ্ব। বিশ্ব কেন? মহাবিশ্ব। চরাচর সৃষ্টি। সবই ওইখানে। স্বর্গ, পৃথিবী, অগ্নি, বাতাস, সূর্য, চন্দ্র, বজ্র, বিদ্যুৎ, তারকারাজি, যা আছে, যা নেই, সবই অবস্থান করছে পদ্মস্থিত এই ছোট্ট স্থানটিতে। মানুষের শরীরেই যদি সব, এই সৃষ্টি, সর্বকাম, সর্ববাসনা, তা হলে দেহের বিনাশে কী হবে! ওই স্থানটুকু, আত্মার ওই পদ্মনিবাসের বিনাশ নেই। কামনা, বাসনা, লয়, প্রলয়, সৃষ্টি, ধ্বংস, রূপ, অরূপ, বিকার, নির্বিকার, এই সোলার সিস্টেম, আরও কোটি সৌরজগৎ, আদিগন্ত, চরাচর, সব অবিনশ্বর।

এই বোধ আসবে কেমন করে? যা তোমার মধ্যেই অবস্থিত তাকে কেন পাওয়া যায় না খুঁজে! তুমি চাও না। মায়া তোমাকে ভুলিয়ে রেখেছে। মহামায়ার এমনি খেলা। এ কেমন জানো, রাম লক্ষ্মণ সীতা। তিনজন চলেছেন। আগে রাম মাঝে সীতা শেষে লক্ষ্মণ। লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পাচ্ছেন না। কেন? মাঝে সীতা আবরণ। মায়া। সীতা সরে না গেলে রামকে দেখা যাবে না। পরমাত্মা হলেন রাম, জীবাত্মা হলেন লক্ষ্মণ, সীতা হলেন মায়া। এই তিন নিয়ে লীলা।

দুটি শোভন-পক্ষ পক্ষী, দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া। একই গাছে বসে আছে দুটি পাখি। গাছ কী? তোমার দেহবৃক্ষ। পাখিদুটি বসে আছে কীভাবে? জড়াজড়ি করে। সযুজা সখায়া। যেন দুই প্রাণের বন্ধু। তাদের মধ্যে একজন সেই গাছের ফল, বিচিত্র আস্বাদযুক্ত ফল, স্বাদু পিপ্পলম অত্তি, ঠুকরে ঠুকরে খায়। সে কী? সেই পাখিটি কে? সেটি হল জীব। ফল কী? সুখদুঃখাত্মক কর্মফল। অন্য পাখিটি কী করে? সে কিছু খায় না, সে শুধু দেখে। দর্শন করে। তিনিই পরমাত্মা। জীবাত্মা পরমাত্মার আশ্রয়ে দেহবৃক্ষে অবস্থান করছে।

তুমি কী করে সেই ব্রহ্মকে ভেদ করবে? অমৃত আস্বাদনের জন্যে ব্রহ্মকে বিদ্ধ করতে হবে। জীবাত্মাকে পরমাত্মায় লীন হতে হবে। তোমার ধনুক কোথায়! কোথায় তোমার শর! প্রণবো ধনুঃ শরো হ্যাঁত্মা। ওঙ্কার সেই ধনু, জীবাত্মাই বাণ আর ব্রহ্মাই সেই বাণের লক্ষ্য। সারাটা দুপুর তার ঘরে। বসে আমাকে পাখি পড়ানোর মতো করে বোঝালেন। তিক্ত সংসার সম্পর্কে অসম্ভব একটা ঘৃণা জাগাবার চেষ্টা করলেন। অন্য ধরনের একটা আকাঙ্ক্ষায় আমাকে জাগ্রত করতে চাইলেন। ওঙ্কার সাধনার প্রাথমিক আভাস দিলেন।

পশ্চিমের অ্যানাটমিস্টরা মাথার মাঝখানে যে জায়গায় পাইনাল বা পিনিয়াল গ্ল্যান্ড আছে বলছেন, যেখান থেকে আমাদের স্বপ্নের উৎপত্তি, সেইখানেই হিন্দুযোগীরা দেখেছেন সহস্রবার। সহস্রদল একটি পদ্ম। জ্যোতির্ময়। সেইটিকে ভেদ করতে হবে প্রণবমন্ত্রে। দুচোখের মাঝখানে ভ্রূ-মধ্যে যে-স্থান, মেয়েরা যেখানে টিপ পরে, অ্যানাটমিতে সেই বিন্দুটির নাম গ্লাবেলা। মনকে ওইখানে রাখো পদ্মাসনে বসে। সুস্থ সুন্দর জীবনের কথা ভাবো। শরীর শিথিল করো। এইবার ভাবো মাথার মাঝখানে একটি ছিদ্র। সেই ছিদ্রে স্থাপিত সহস্রদল এক পদ্ম। সহস্র কান্তমণি। সেই পদ্মে স্থির এক জ্যোতি। এইবার শ্বাসকে আকর্ষণ করে মূলাধার থেকে টেনে তোলো। ওই ছিদ্রটিকে ভরে দাও। চেষ্টা। অনন্ত চেষ্টা। প্রাণায়ামই সব। কুম্ভক অভ্যাস করবে। দমভর বাতাস নেবে, বুক ভরতি করে। ধরে রাখবে যতক্ষণ না কষ্ট হয়। ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়ে আবার নেবে। দিনের চারটে সময়ে কুড়িবার করে এই কুম্ভক করবে। সূর্যোদয়ে, দ্বিপ্রহরে, সায়াহ্নে, মধ্যরাত্রে। তোমার দেহ পবিত্র হবে, সমস্ত মালিন্য দূর হবে। শক্তিতে ভরে যাবে। দেহ সুবাসিত হবে। ত্বক উজ্জ্বল হবে। খিদে বাড়বে, হজম বাড়বে। তোমার কণ্ঠ মধুর হবে। আর কী হবে? নরম গলার স্বরও বহু দূর পর্যন্ত পৌঁছোবে। প্রচণ্ড সাহস বাড়বে। আসবে অসীম কর্মোদ্দীপনা। মানসিকতার অদ্ভুত এক পরিবর্তন আসবে। দুঃখ কষ্ট-নির্যাতন-নিপীড়ন, সংসাররূপ এই দুঃখজলধি তুমি অক্লেশে উত্তীর্ণ হওয়ার শক্তি। পাবে। তোমার আকর্ষণীয়শক্তি, ম্যাগনেটিজম ভীষণ বেড়ে যাবে। সমস্ত মানুষ তোমার প্রতি আকৃষ্ট হবে। তুমি যা বলবে তাই শুনবে, পালন করবে। তুমি রোগমুক্ত, যন্ত্রণামুক্ত হবে; কারণ তখন তুমি মায়ামুক্ত, মোহমুক্ত।

ছোটদাদু এমন লোভ দেখিয়েছিলেন, লোটাকম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি আর কী! মহাজীবনের লোভে ভেতরটা খচরমচর করে উঠল, তারপরে একসময় নেতিয়ে পড়লুম। মনে পড়ে গেল এক মহাত্মার অদ্ভুত কথা; বোল সবহি ঢোল বরাবর,/পোল সবহি মে পুরা। /অবোল তত্ত্ব কো। সমঝাওতনহি/জো সমঝাওত সো কুরা ॥ ঢোলের মধ্যে যেমন ফাঁক বা শূন্য থাকে, সেইরকম বোল বা বাক্যের মধ্যেও ফাঁক থাকে। বাণীর অতীত তত্ত্বকে প্রকাশ করা যায় না। যা প্রকাশ হয় তা মিথ্যা। সার নেই। শ্রীরামকৃষ্ণকে একজন বলেছিলেন, মহাশয় আমাকে সমাধিটা শিখিয়ে দিতে পারেন? শুনে সবাই হেসেছিলেন। সমাধি শেখানো যায় না। শিরোদেশ হল সপ্তমভূমি–সেখানে মন গেলে সমাধি হয়। ব্রহ্মজ্ঞানীর ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ দর্শন হয়, কিন্তু তখন আর শরীর থাকে না। সবসময় বেহুশ, কিছু খেতে পারেন না, মুখে দুধ দিলে গড়িয়ে যায়। ওই ভূমিতে একুশ দিনে মৃত্যু।

বাস্তববাদী হরিশঙ্কর এই প্রসঙ্গে সুন্দর একটি গল্প বলেছিলেন:

এক শহরে এক সিঁদেল চোর বাস করত। সিঁদ কেটে লোকের বাড়িতে চুরি করাই তার পেশা। লোকটির বয়স হল। যুবক ছেলে হঠাৎ একদিন এসে বললে, বাবা, তোমার তো যাওয়ার সময় হল, বিদ্যেটা আমায় শিখিয়ে দিয়ে যাও, আমাকে তো করে খেতে হবে। বাবা বলল, ঠিক আছে, আজই তা হলে চলো আমার সঙ্গে।

গভীর রাতে একটা বাড়ি বেছে নিলে। বড় চোর নিপুণ একটি সিধ কেটে ছেলেকে নিয়ে ঢুকে গেল। ঘরে এসে দেখলে বিশাল এক সিন্দুক। বড় চোর সিন্দুকের তালা খুলে দিয়ে ছেলেকে বললে, ঢোক। সব মালপত্র বেছে বেছে বাইরে ফেল।

বাবার আদেশ। ছেলে ভেতরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে বড় চোর সিন্দুকের ডালা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল। নিঃশব্দে গর্ত দিয়ে বেরিয়ে এল রাস্তায়। তারপর করল কী! বাড়ির গেট ধরে নাড়া দিয়ে চিৎকার করে বলে গেল, তোমাদের বাড়িতে চোর পড়েছে গো।

বাড়িসুদ্ধ সবাই উঠে পড়ল। আলো নিয়ে খোঁজাখুঁজি। স্টোর রুমে গিয়ে দেখলে সবই ঠিক আছে। সিন্দুকও তালা বন্ধ। কোথায় চোর! ঘর ছেড়ে সবাই বেরিয়ে গেল। সব শেষে দাসী। তার হাতে বাতি। সিন্দুকে বন্ধ চোরের ছেলে ভাবছে, সর্বনাশ! বেরোতে না পারলে তো দম আটকে মরতে হবে। সে তখন বারকয়েক খুডুর খুডুর শব্দ করল। দাসী:যেতে গিয়েও ফিরে এল। মরেছে, ইঁদুর ঢুকেছে। সে তখন তাড়াবার জন্যে যেই ডালা খুলেছে, চোরের ছেলে এক লাফে বেরিয়ে এসে, দাসীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আলো নিবিয়ে অন্ধকারে দে চম্পট। দাসীর চিৎকার, চোর চোর! বাড়ির সবাই রাস্তায় নেমে চোরের পেছনে ছুটছে। চোর দেখলে, সে আর পারছে না ছুটে। প্রায় ধরা পড়ে যায় আর কী! পথের পাশেই মস্ত এক ইদারা। চোর দু’হাতে বেশ বড় একটা পাথর তুলে তার মধ্যে ফেলে দিয়ে, আবার ছুটতে লাগল। যারা অনুসরণ করছিল, তারা বোকা বনে গেল। ভাবলে চোর ইদারায় ঝাঁপ মেরেছে।

ভোর হচ্ছে, ছেলে বাড়ি ঢুকল। দেখলে বাবা আয়েশ করে বসে চা খাচ্ছে। ছেলের রাগ অভিমান দুটোই হয়েছে। বাবাকে বললে, তুমি আমার সঙ্গে এইরকম একটা ব্যবহার করতে পারলে?

বাবা হেসে শান্ত গলায় বললে, বোস, আগে বল, তুই কীভাবে ফিরে এলি?

ছেলে সব বললে।

বাবা বললে, পুত্র, তুমি তো সবই শিখে গেছ। এ তো শেখানো যায় না, নিজেকে শিখতে হয়।

হরিশঙ্কর বলেছিলেন, ধর্ম, পথ, নিরাসক্তি, মায়ামুক্তি, সংসার থেকে বেরিয়ে আসার কায়দা শেখানো যায় না, নিজেকে শিখতে হয়।

ছোটদাদুর ভিজে ভারী হাত আমার কাঁধে এসে পড়ল, চলো আমার হয়ে গেছে।

এইবার পট পরিবর্তন। আমি আর বিমলাদি মেলায়। বিমলাদির ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা জায়গায় গ্রামের সব মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। আলোয় আলো। কাঁ কোঁচ নাগরদোলা, পুতুল নাচ। মহাভারতের পালা। দিব না দিব না সূচ্যগ্র মেদিনী। দুই মাতাল টলছে। একজন বলছে, আমি নিমাইচন্দ্র। আর একজন বলছে, চিনি রে শালা। আমি যে নিতাইচন্দ্র। বিমলাদি কাঁধ ধরে বললে, সরে এসো, জাত মাতাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *