If you ever need a helping hand
You will find one at the end of your arm.
অতিশয় ভরসার কথা। বনপথে গভীর রাতে আতঙ্ক বুকে নিয়ে সেই অচেনা গ্রামের দিকে আর যেতে হবে না। পণ্ডিতমশাই হঠাৎ কামজয়ের প্রসঙ্গ পেড়েছেন। একটু আগে বেশ একটু মজা হল, দুগ্ধধবল একটি গাভী কোথা থেকে হটরপটর করে উঠোনে এসে দাঁড়াল। ছোটদাদু দেখেই বললেন, এই যে এসেছ, তোমাকেই আমি স্মরণ করছিলুম মা।
গোরু অমনি আমুদে চোখে ছোটদাদুর দিকে তাকিয়ে গদগদ একটি ডাক ছাড়ল, হাম্বা।
ছোটদাদু বললেন, হ্যাঁ মা।
গোরু বললে, হাম্বা।
মা আর হাম্বা এই চলতে লাগল। সে এক অপূর্ব ঐকতান। সন্ধ্যার মগ্ন পরিবেশ চনমন করে উঠল। মহামায়ার পূজার ঘণ্টার টিংলিং শব্দ। বিমলাদির উনুনের ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশমুখী। পাতার ফাঁকে ধকধকে সন্ধ্যাতারা। আমরা নিঃস্তব্ধ। মানুষে আর পশুতে অদ্ভুত বাক্যালাপ।
বিমলাদি ছুটে এলেন, ব্যাপারটা কী? তাঁদের গোরু তো কোনওদিন এমন উল্লাসে ডাকাডাকি করে না। আজ কী হল?
তার বিস্ময় প্রশ্ন হবার আগেই ছোটদাদু বললেন, তোমরা বুঝবে না মা, আমাদের অন্তরের কথা। কিছু হল। ওর সবটাই তো মা। দুগ্ধবতী জননী আমার। যাও দুধ দোয়ার ব্যবস্থা করো। তারপর ভরতি এক গেলাস চা।
ছোটদাদু গোরুকে বললেন, যাও মা, আজ একটু বেশি দুধ দিয়ে, বাড়িতে অনেক অতিথি। গোরু আহ্লাদের শেষ ডাকটি ডেকে গোয়ালের দিকে চলে গেল হেলতে দুলতে, ভার-ভরন্ত চালে।
এই ঘটনা দেখে পণ্ডিতমশাই মুগ্ধ হয়ে বললেন, আপনি অবশ্যই সাধনজগতে অগ্রসর হয়েছেন। শ্রবণ, দর্শন, আস্বাদন ইত্যাদি হয়েছে। আচ্ছা বলতে পারেন, কাম কি জয় করা যায়? কামই তো বড় শত্রু।
হরিশঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আজ্ঞে না, যায় না। ঈশ্বর যদি কোথাও থাকেন, তিনিও তা চান না, কারণ তা হলে তাঁর যাবতীয় পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। কামই মানুষের জাগ্রত অবস্থা।
পণ্ডিতমশাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হল না। নিদ্রাতেও কাম। কিছু করতে চাওয়াটাই কামনা। স্বপ্ন কামোথিত।
হরিশঙ্কর বললেন, মানুষের জাগ্রত অবস্থা ও নিদ্রিত অবস্থার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। চেতনা নিদ্রিত হয় না। ঢেউ থাকলেও সমুদ্র, না থাকলেও সমুদ্র। জল আর বরফে যে তফাত তা আমাদের দৃষ্টিতে। বুদ্ধিতে দুই সমান। জলই বরফ, বরফই জল। একমাত্র মৃত্যুতেই চিরনিদ্রা, চেতনার মৃত্যু। আমাকে জাগতে হবে এই কামনা নিয়েই মানুষ নিদ্রিত হয় আর ঠিক সময়ে জেগে ওঠে। কেন জাগতে হবে? সে এক কামনাপুঞ্জ, জীবিকা অর্জন করতে হবে, আহার করতে হবে, শরীরের চর্চা করতে হবে, শরীর রক্ষা করতে হবে। নিজের নিরাপত্তার তাগিদেই জাগরণ। এইবার আপনি খণ্ডন করুন।
পণ্ডিতমশাই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। অবশেষে বললেন, মহাশয়, আপনি তো প্রকারান্তরে আমাকেই সমর্থন করলেন। আমি শুধু মানুষের দুটি অবস্থাভেদের কথা বলেছিলুম, জাগ্রত সচল অবস্থা, নিদ্রিত অচল অবস্থা। আপনি সে দুটিকে এক করে দিলেন। বেশ দিন। কিন্তু মূল প্রশ্ন, কাম কি জয় করা যায়? তা রয়েই গেল।
না যায় না। অসাধ্য।
পণ্ডিতমশাই ছোটদাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি মহাসাধক। আপনার অভিমত?
ছোটদাদু বললেন, তার আগে সমাধান করুন নিদ্রা কাকে বলে, জাগরণ কাকে বলে?
পণ্ডিতমশাই বললেন, চেতনার আচ্ছন্ন অবস্থাই হল নিদ্রা। নিদ্রার দুটি ভেদ, ক্লান্তিতে নিদ্রা আবার মোহনিদ্রা। বিচার যেখানে অবসিত। এ সবই হল তামসিক নিদ্রা। এর পাশেই আছে যোগনিদ্রা। অর্থাৎ চেতনা জাগ্রত অবস্থা থেকে অধোগমন করলে তামসিক, উধ্বগমন করলে যোগারূঢ়। অর্থাৎ সমুদ্রে যদি তলিয়ে যাই তা হলে এক, আর যদি মহাকাশে উড়ে যাই, তা হলে। আর এক। অর্থাৎ দুটি অবস্থাই বাস্তবচ্যুত অবস্থা। একটি অন্ধকার, অন্যটি আলোকিত। একটিতে তামসিক অভিজ্ঞতা অন্যটিতে সাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ নিদ্রা হল দেহগত চেতনার নিমজ্জন অথবা অতিজাগরণ। অর্থাৎ…।
হরিশঙ্কর বললেন, অর্থাৎ নিদ্রা হল স্লিপ। একটা বিছানা, একটা বালিশ, এক গেলাস জল খেয়ে পা তুলে শুয়ে পড়ো। নিদ্রা দু’রকমের, এক নাক ডাকিয়ে ঘুম, আর এক নিঃশব্দে ঘুম। পেট গরমে স্বপ্ন, পেট ঠান্ডায় নিঃস্বপ্ন? মিটে গেল ঝামেলা।
ছোটদাদু বললেন, শয়ন, অর্থাৎ শ-এ অন। অর্থাৎ অন শ শ মানে চিতা। অর্থাৎ চিতায় ওঠার নাম শয়ন। শয্যা হল অস্থায়ী মৃত্যুর চিতা। আর শ্মশানে মহানিদ্রার চিতা। আমাদের তন্ত্রে শয্যা হল শ্মশান। সেই কারণে শয্যায় সাধনের বিধান।
হরিশঙ্কর বললেন, আমাদের কর্মতন্ত্রে নিদ্রা হল তামসিকতা। নিদ্রা হল আলস্য। ব্যাড হ্যাবিট। অনেকে জেগেও ঘুমোতে পারে।
এইবার এসো বৎস, কামনা বাসনার নিদ্রার অর্থ হল যোগভূমিতে জাগরণ, সাধকের উঠে বসা। ছোটদাদু বললেন।
পণ্ডিতমশাই বললেন, এই কামনা বাসনার নিদ্রা কেমন করে সম্ভব?
হরিশঙ্কর বললেন, খুব সহজ, একটা ল্যাঙোট পরুন। দুটো থান ইট একহাত এক বিঘত দূরে স্থাপন করে পঞ্চাশবার ডন, দরজার একটি পাল্লা ধরে একশোবার বৈঠক। এতেও যদি মন উসখুস করে তা হলে পঞ্চাশবার মুগুর ভাজুন, মনের তামসিকতা দূর হয়ে যাবে। এতেও যদি না যায়, কুড়ুল দিয়ে কাঠ চেলা করুন।
পণ্ডিতমশাই বললেন, অতিশয় দানবীয় পদ্ধতি। বুদ্ধিমান মানবীয় পদ্ধতির কথা জানতে চাই।
ছোটদাদু বললেন, সে পথ হল বিচারের পথ। বিচার করুন। প্রথম বিচার, কে চায়?
পণ্ডিতমশাই: আমি চাই।
ছোটদাদু: কোন আমি?
পণ্ডিতমশাই: অহং, অর্থাৎ যে-আমি দেহবোধ জাগায়।
ছোটদাদু: তা হলে ভোগ করতে চায় দেহ। দেহের ক্ষমতা কতটুকু! এইখানেই বিচারের শুরু। দেহের পক্ষে কতটুকু কতদিন ভোগ করা সম্ভব?
হরিশঙ্কর: অর্থহীন আলোচনা। এই আত্মা-প্রশ্ন মানুষের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছেন মহামানবেরা অনাদিকাল ধরে। সো হোয়াট, তাতে আমাদের বয়েই গেল। যতটুকু ভোগ সম্ভব, ততটুকুই করব, যতটুকু করা যাবে না, তার জন্য আক্ষেপ করব। লালচ বড় বালাই, জেনেও লালসায় ঘি ঢালব। তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই ॥ মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ চাই। এই হল সাধারণ মানুষ, কিন্তু অসাধারণ রবীন্দ্রনাথ কোথায় গেলেন? শোনো তা হলে, তোরা পাবার জিনিস হাটে কিনিস, রাখিস ঘরে ভরে। যারে যায় না পাওয়া তারি হাওয়া লাগল কেন মোরে ॥ এই হাওয়াটা কে লাগাবে ভাই? যে- হাওয়া গায়ে লাগলে রবীন্দ্রনাথের মতো বলা যায়, আমি আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই। আমি আপন-মনে মাঠে বনে উধাও হয়ে যাই । নিজের ভেতর থেকে কামনা বাসনার অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকে নিজেকে বের করে এনে উধাও করে দাও। সিনেমার হিরো-হিরোইনের মতো টুলুলুলু করে গাছের ফাঁকে ফাঁকে নাচানাচি নয়, মনে মুক্তি। মহামান্য নৈয়ায়িক পাত্ৰাধার তৈল কি তৈলাধার পাত্র এবংবিধ বিচারে অশ্বডিম্ব হবে। বসে বসে নিতম্ব ভারী করে আসুন নৃত্য করি। ফক্সট্রট ট্যাঙ্গো, কোনটা আপনি জানেন?
পণ্ডিতমশাই: মহামান্য! আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?
ছোটদাদু: অবশ্যই নয়। যত মত তত পথ। মূল কথা হল ভুলে থাকা। ভাবে থাকা। ঘোরে থাকা। ও ওর নিজের ভাবে, নিজের ঘোরে আছে। পথ খুঁজে পেয়েছে। ওর কোনও কামনা বাসনা নেই। মায়ামুক্ত অঘোর।
হরিশঙ্কর: মোটেই না। কামনা বাসনায় জরজর হয়ে আছি। সবচেয়ে বড় কামনা, ছেলেটা যেন আমার মানুষ হয়। ছোট কামনা, এখনও কেন চা আসছে না!
ছোটদাদু: ওটা কামনা নয় আকাঙ্ক্ষা। দুটোই তোমার আত্মিক চাওয়া। না পেলে তুমি পাগল হবে না, পেলে তোমার একটাই লাভ, আত্মিক তৃপ্তি। যাকে আমরা ভোগ বলি তাতে তৃপ্তি নেই, শুধুই অতৃপ্তি। আত্মিক সুখে তৃপ্তি, দেহসুখে অতৃপ্তি।
বিমলাদি একটা থালার ওপর চারটে গেলাস সাজিয়ে আসরে প্রবেশ করলেন। প্রায় নাচের ভঙ্গিতে। ছোটদাদু বললেন, এসেছে এসেছে। বহু প্রতীক্ষিত সেই চা এসেছে। হরিশঙ্কর তাড়াতাড়ি উঠে থালাটা ধরে নিলেন। ছোটদাদু বললেন, পিন্টু, কাজটা তোমারই করা উচিত ছিল।
বাবা এত তাড়াতাড়ি উঠলেন যে আমি হেরে গেলুম।
হরিশঙ্কর বললেন, একেই বলে রিফ্লেক্স। ওর একটু তানানানা স্বভাব। স্লাগিশ।
বিমলাদি বললেন, আপনি আমার ভাইটাকে কেবল বকেন!
হরিশঙ্কর বললেন, যুবক হবে চিতাবাঘের মতো। তিরের মতো, ইস্পাতের মতো। স্প্রিংয়ের মতো। সনি লিস্টনের মতো।
ছোটদাদু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, চমৎকার। তারপর হরিশঙ্করকে বললেন, সনি লিস্টনকে টানলি কেন?
হরিশঙ্কর গেলাসের গোলে পড়ে গেছেন। একটা গেলাসে সাদা দুধ। বিমলাদি বললেন, ওটা পণ্ডিতমশাইয়ের দুধসাবু।
হরিশঙ্কর হাসিতে ফেটে পড়লেন, দুধসাবু! রোগীর খাদ্য শিশুর পথ্য! চা খেলে কী হত পণ্ডিতমশাই?
আমি যে চায়ে অভ্যস্ত নই।
ঠিক আছে, আজ যখন হয়েছে খেয়ে দেখুন না, ভেষজ পদার্থ।
যকৃৎ খারাপ হয়ে যাবে।
হায় নৈয়ায়িক! এখনও ভয়! খান, সাবু খেয়ে আরও একশো বছর বাঁচুন!
পণ্ডিতমশাই কাতর কণ্ঠে বললেন, মহাশয়, জীবনের আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। আপনার পুত্রের মতো আমার একমাত্র পুত্রটি চলে গেল। স্ত্রী গত। জননী আজও জীবিত। দুটি সেবার কারণে এই অক্ষম জীবন ধারণ, জননীর সেবা ও শাস্ত্রসেবা। এই দুধসাবুটুকুই আমার রাতের আহার। আমার বিমলামায়ের ব্যবস্থা। আরও একটু আছে। যাওয়ার সময় সেইটুকু নিয়ে যাব। আমার মা খাবেন। এর মধ্যে আমার কোনও বাঁচার আকাঙ্ক্ষা নেই। আমি যেতেই চাই।
হরিশঙ্কর কিছুমাত্র অপদস্থ না হয়ে বললেন, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেন পণ্ডিতমশাই।
পণ্ডিতমশাই বললেন, পরীক্ষা? আমাকে আপনি কী পরীক্ষা করছিলেন?
আপনি জীবনের সত্যে উপনীত হতে পেরেছেন কি না! কতটা স্বাবলম্বী আপনি? আপনার ব্যক্তিত্বের ততুটি যথেষ্ট দৃঢ় কি না! দেখলুম না, আপনার মান ও অভিমান দুটিই প্রখর, যথেষ্ট রোমান্টিক। আপনার হরমোন বিভাজনে স্ত্রী হরমোনের প্রাচুর্যই বেশি। ন্যায়, বেদান্ত, স্মৃতি, শ্রুতির পরিবর্তে কাব্য, অলংকার, রসশাস্ত্র প্রভৃতির মধ্যে আপনার বিচরণ বাঞ্ছনীয় ছিল। মানুষের মধ্যে জাতিতে আপনি লতা, বৃক্ষ নন। আপনি অবলম্বন খোঁজেন। আপনি দুঃখবিলাসী। সহানুভূতিভোজী। সর্বোপরি আপনার ভোগবাসনার নিবৃত্তি হয়নি। আপনার উচিত এই সাধক, ওই। যে চায়ের গেলাসে নিরাসক্ত চুমুক দিচ্ছেন, আর মৃদু মৃদু হাসছেন, ওঁর শরণ নেওয়া। জীবনের অবশিষ্ট পথ কোন যষ্ঠি অবলম্বন করে হাঁটবেন, কীভাবে সত্যদর্শন হবে, ওই মহাপুরুষই বলতে পারবেন। হয়তো আপনার কারণেই তাঁর এই আকস্মিক আগমন। আপনি কষ্টে আছেন। পণ্ডিতমশাই। আপনি আপনার কোনও একটি অপরাধ ভুলতে চাইছেন।
ছোটদাদু হাসতে হাসতে বললেন, কাছাকাছি যেতে পেরেছিস হরিশঙ্কর। এক একটা মানুষ হল অনধিত এক একটা বই। শুধুমাত্র মলাটটা আমরা দেখতে পাই। নাম লেখা। ভেতরে অধ্যায়ের পর অধ্যায়, ঘটনার ঘনঘটা। তুমি মলাটের ভেতর কিছুটা ঢুকতে পেরেছ। এঁর জীবনের চারটি অপরাধ, স্ত্রীর প্রতি অবহেলা, কৃপণতার জন্যে পুত্রের মৃত্যু, যৌবনে মাতাকে অসম্মান, অবশেষে এক বিধবার সম্পত্তি গ্রাস। এ ছাড়া কোনও এক সময় গোপনে গণিকাগমন ও মদ্যপান।
পণ্ডিতমশাই কোনওরকমে গেলাসটি নামিয়ে রেখে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। মুখে ভয়ংকর এক যন্ত্রণার ছায়া। ভীষণ খারাপ লাগল। কেন ছোটদাদু এমন করেন! শক্তি আছে বলেই কি, যেখানে সেখানে তার অপপ্রয়োগ করতে হবে? কী প্রয়োজন ছিল মানুষের ভেতর থেকে মানুষকে টেনে বের করার? বেশ তো হচ্ছিল দাবাখেলার মতো কথার খেলা। মগজের চালাচালি। পণ্ডিতমশাইকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলুম। ভীত পশুর মতো কাঁপছেন।
ছোটদাদু বললেন, মন আর মুখ এক করবেন। মা বললে জননীই ভাববেন। শুধু শরীর নয়, মনেও ভোগ হয়। রমণের চিন্তাতেও রমণ হয়। স্বপাকে স্বর্গলাভ হয় না, স্ববশে হয়। জীবনদীপ নির্বাপিত হবার প্রাক্ মুহূর্ত পর্যন্ত নারীসম্ভোগ ইচ্ছা থাকে। জীব যোনিসভৃত। অবচেতনার গভীরে সেই চেতনা সুপ্ত। আপনি কী করবেন আমিই বা কী করব? বারেবারে প্রশ্ন করছিলেন কামজয়ী কি হওয়া যায়? অর্থাৎ ওই রিপুটি প্রৌঢ়কেও পীড়া দিচ্ছে। যায় না মহামান্য। মহাভারতকার কী বলছেন? ইন্দ্রিয়ানাঞ্চ পঞ্চানাং মনস্যে হৃদয়স্যচ। মনে পড়ছে পণ্ডিতমশাই ভীমসেন বলছেন যুধিষ্ঠিরকে! রূপাদি বিষয়ে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মন ও বুদ্ধির যে প্রীতি, যে ভাললাগা, তারই নাম কাম। ধর্ম, অর্থ, কাম জীবনে তিনটির উপাসনাই প্রয়োজন। সেইটাই বাস্তব পরামর্শ। শুধু ধর্ম শুধু অর্থ শুধু কাম এক ধরনের অসুস্থতা, অস্বাভাবিকতা। মানুষের একটি দিনকে তিন ভাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন বেদব্যাস। ধর্মং পূর্বে ধনং মধ্যে জঘন্য কামমাচরেৎ। দিনের প্রথম ভাগে কর্ম। কর্ম অর্থে ধর্মকর্ম। মধ্যম ভাগে অর্থ, অন্তিম ভাগে কাম। এই হল প্রতিদিনের অনুশাসন। কিন্তু কতদিন? বেদব্যাস বলছেন, আয়ুকেও ভাগ করো। সেখানে কী? কামং পূর্বে ধনং মধ্যে জঘন্যে ধর্মমাচরেৎ। পণ্ডিতমশাই বিধান বদলে গেল। যুবাবস্থায় কাম, প্রৌঢ়াবস্থায় অর্থ, আর বৃদ্ধাবস্থায় ধর্ম। আপনার জীবন কি সেইভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে? আপনি আফিং সেবা করেন কেন?
পণ্ডিতমশাই আবার চমকালেন। ভয়ে ভয়ে বললেন, আমার বংশের ধারা।
আপনি জ্ঞানী। আপনি তো জানেন আফিংয়ে বুদ্ধিনাশ হয়!
আমার ভ্ৰম, আমি যৌবনকে স্থায়ী করতে চেয়েছি। আমি কামাসক্ত পণ্ডিত।
ছোটদাদু বললেন, আপনার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। আর কয়েকটা বছর মাত্র। কবে তা আমি জানি, কিন্তু বলা নিষেধ। আর কৃপণতায় কী কাজ? দু’হাতে মায়ের সেবায় ব্যয় করুন। প্রতিদিন একবার করে মৃত্যুচিন্তা করবেন। মনে মনে গাইবেন, দিন যে আগত দেখি। আর করবেন দেহভ্রমণ। সেটা কী? আসনে স্থির হয়ে বসবেন। মেরুদণ্ড সোজা। দেহ শিথিল। ভাববেন আপনি নগ্ন। চোখ মুদিত। প্রথমে চিন্তা করবেন, এই আমার পা, এই আমার শিথিল লিঙ্গ, উদর, বক্ষ, গলা, দুটো জরাগ্রস্ত হাত, মুখ, মস্তক বিরলকেশ, দ্যুতিহীন দুই চোখ, দুটো কান, মনে মনে নিজের দেহের পরিমাপ করবেন, চিন্তা করবেন পরিবেশ। ঘর, বাহির, গ্রাম, নগর, বিশ্ব, মহাকাশ, বিন্দুর মতো তিলের মতো হারিয়ে যাবেন। কীসের অহংকার, কার সঞ্চয়, কী ভোগ, কতটুকু ভোগ! চিন্তা করবেন বিশাল এক জ্যোতিঃপুঞ্জ। অসংখ্য আলোক বিন্দুর একটি হলেন আপনি, নিমেষে বিলীন হয়ে গেলেন। এরই নাম ধ্যান। একান্তভাবে এই চিন্তায় নিমগ্ন হবেন। মনে রাখবেন তুলসীদাসজির একটি কথা : মালা জপে শালা, কর জপে ভাই। ম ম জপে যো, ওসকো বলিহারি যাই ॥ ভণ্ড মালাজপকারীকে শ্যালক বললেও ক্ষতি নেই, সংযতচিত্তে করে অর্থাৎ আঙুলে যাঁরা জপ করেন, তাঁদের ভ্রাতা বলা যায়, আর মনে মনে যাঁরা জপাদি সাধন করেন তাঁরাই বলিহারি। পুজোর চেয়ে জপ বড়, জপের চেয়ে ধ্যান বড়। আচ্ছা, এই নিন একটা লবঙ্গ খান।
পণ্ডিতমশাই ফ্যালফ্যালে মুখে বললেন, এখনই?
ছোটদাদুর চেহারা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। বিশাল মর্মর মূর্তির মতো আকৃতি। না, কোনও চোখের ভুল নয়। সবাই দেখছেন। গম্ভীর মুখে বললেন, বিলম্বে লাভ কী?
লবঙ্গটা হাতে নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, চিবিয়ে খাব?
কচমচ করে।
পণ্ডিতমশাই লবঙ্গ চিবোচ্ছেন। আমি জানি এর মধ্যে অবশ্যই কোনও রহস্য আছে, বিজ্ঞানে যার ধরাছোঁয়া পাওয়া যাবে না। লৌকিক আর অলৌকিক মিলে জীবন আর জগৎ রহস্যময়। রহস্য আছে বলেই রহস্য শব্দের উৎপত্তি। লৌকিক আছে বলেই অলৌকিক।
পণ্ডিতমশাই ঢোঁক গিলে বললেন, হয়ে গেল। চলে গেল পেটে। এখন কী হবে?
ধীরে ধীরে কিছু একটা হবে।
সামান্য লবঙ্গে?
মটরের দানার মতো সামান্য একটা আফিংয়ের গুলিতে কী হয় পণ্ডিতমশাই! সেটা জ্ঞাত, তাই আপনার সন্দেহ হচ্ছে না, এটা আপনার কাছে অজ্ঞাত, তাই আপনার সন্দেহ। এই হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। পণ্ডিতমশাই, এটা কী?
ছোটদাদু চায়ের গেলাসটা তুলে ধরলেন।
পণ্ডিতমশাই বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? গেলাস!
আমি যদি বলি গেলাসের আকার বিশিষ্ট একটুকরো শূন্যতা!
পণ্ডিতমশাই একটু ভেবে বললেন, তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে। আধার ও আধেয়। আধার ভাঙলে কী থাকে? আধেয় অর্থাৎ শূন্যতা। এখন আকার সত্য না নিরাকার সত্য? যা ভেঙে যায়, যা থাকে ন’, আর না-থাকার পর যা থাকে, তার মধ্যে কোনটা সত্য ও শ্বাশ্বত!
যার মধ্যে বসে আছে এই সৃষ্টি বা এই সৃষ্টির মধ্যে যা আছে, অর্থাৎ যা আমাতেও আছে। আপনাতেও আছে, যা এই ঘরের বাহিরেও আছে ভেতরেও আছে, তার অনুভূতি কেমন লাগে। দেখুন তো পণ্ডিতপ্রবর।
ছোটদাদু টকাস করে একটা টুসকি মারলেন।