When a man is wrapped up in
himself he makes a pretty small package.
বিমলাদির রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ মাথা ঘামালুম। এমনই মাথা, শরীর ঘেমে গেল মাথা ঘামল না। বিমলাদি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। আমার অসহায় অবস্থা দেখে বললেন, এক কাজ করো ভাই, আমি একটা গামলায় কেরোসিন তেল আর খানিকটা ন্যাকড়া নিয়ে আসি। তেলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে বাঁশ মুছলেই যা চাইছ তা উঠে আসবে। ভেজাব আর মুছব। তেলটা কালো হয়ে যাবে। যখন একবারে ঝুল কালো হয়ে যাবে তখন নিয়ে গেলেই হবে। এটা আমার মেয়েলি বুদ্ধি। তোমার মাথায় কী এল!
এর চেয়ে ভাল বুদ্ধি আমার মাথায় আসত না দিদি। আমার বাবাকে আপনার কেমন লাগছে? বিমলাদির চোখে জল এসে গেল। বললেন, আমার যদি এইরকম বাবা থাকতেন! তোমার কী ভাগ্য! বাবার গর্বে নিজের বুকটা দশ হাত হয়ে গেল। শুরু হল আমাদের দিশি বিজ্ঞান। দু’জনেই মোছা শুরু করলুম। কেরোসিন আর কয়লার ঘামের গন্ধে ঘর ভরে গেল। বাঁশ তার পুরনো বর্ণ ফিরে পাচ্ছে ক্রমশই। বিমলাদির ডান হাতের ওপর বাহুতে একটা তাগা। বুকে একটা সোনার হার দুলছে। চমৎকার ঢলঢলে শরীর। ওদিকে ভয়ংকর কাণ্ড চলেছে। হরিশঙ্করের নানা নির্দেশ চাবুকের মতো মোহনদার ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে।
বিমলাদির ফরসা হাত কুচকুচে কালো হয়ে গেল। একবার বোধহয় ভুলে গালে হাত দিয়েছিলেন। কালো ছোপ। আমার হাতের অবস্থা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। কাজের সঙ্গে গল্পও চলেছে আমাদের। আমাদের ছেলেবেলার গল্প। ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প, লাটু খেলার গল্প। বকুনি খাওয়ার গল্প। ওদিকে বেলা পড়ে আসছে। রান্নাঘরের বাইরে ওপাশে একটা বেড়াল ডাকছে ম্যাও ম্যাও করে। আমরা দুজনেই চলে গেলুম আমাদের শৈশবে। মনেই হচ্ছে না, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আমাদের পরিচয়। মনে হচ্ছে দুই সমবয়সি বন্ধু বিকেলে নয়নতারা আর কেষ্টকলি ফুলে ঘেরা। উঠোনে খেলা করতে এসেছি। সেই ছেলেবেলার দিনগুলিতে যেমন হত। শরৎ শেষ হয়ে হেমন্ত আসছে, শিশিরের কাল। মাটি থেকে ভিজেভিজে একটা গন্ধ উঠছে। শিশুমনকে অবাক করে দিয়ে ঘাসের পাড় ধরে ধরে একটা শামুক চলেছে তার বিশাল বাসস্থানটিকে পিঠে নিয়ে। শম্ভকাকার আটচালায় মা দুর্গা। সব মূর্তি বায়না অনুযায়ী বিক্রি হয়ে গেছে, পড়ে আছে এই একটি মা। রায়েদের। বাড়ির পুজো হল না। বিদেশে বড় ছেলে মেমের প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেছে বোধনের দিন। অসময়ের মা দুর্গার দিকে আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকতুম। ওই মুখ, ওই চোখ। নন্তু কিছু ফুল তুলে এনে ভয়ে ভয়ে মায়ের পায়ের ওপর রাখত। আমাদের মনে হত সিংহ জ্যান্ত হয়ে গেল, অসুর যাত্রার দলের জীবনবাবুর মতো হাহা করে হাসছে। পরেশ যেই বলত, ওই দেখ মা দুর্গা কাঁচা তুলছে, আমরা অমনি ভয়ে তিরবেগে মাঠময়দান ভেঙে ছুট লাগাতাম। শঙ্করী আমাদের সঙ্গে তেমন ছুটতে পারত না। নাকি সুরে বলত, আমাকে ফেলে যাসনি ভাই। ছুটতে ছুটতে আমরা গঙ্গার ধারের উঁচু ঢিবিতে সেই বহু প্রাচীন বটগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াতুম, যে-গাছের তলায় অনেক অনেক আগে শ্রীচৈতন্যের নৌকো ভিড়েছিল। তখন এমন শহর তো ছিল না। গ্রাম, একটা-দুটো চালাবাড়ি। সেদিন যে-গ্রামবাসী তার সেবা করেছিলেন নিমাই তাকে যে কথাটি দিয়েছিলেন, সেই পবিত্র গাত্রবাস ঘিরে ছোট্ট একটি মঠ হয়েছে। সন্ধ্যার গঙ্গায় প্রদীপ ভাসানোর মতো শৈশবের একটি দিন ভাসিয়ে দিয়ে যে-যার গৃহে। সঙ্গীদের মধ্যে কেউ বড়লোক, কেউ মধ্যলোক, কেউ নিম্নলোক। এই ভূলোক, দ্যুলোক, খেলার মাঠে সব একাকার। বাড়ি গিয়ে যে-যার অবস্থা ফিরে। পাবে। কেউ খাবে শুকনো রুটি, কেউ খাবে গরম লুচি, কেউ শোবে ভুয়ে, কেউ খাটে নরম বিছানায়। আমরা দুজনেই চলে গেছি শৈশবের ঘোরে। হঠাৎ বহু দূর থেকে একটা গান ভেসে এল। বাতাসের ওঠা-পড়ায় কখনও স্পষ্ট কখনও অস্পষ্ট। সুর খুবই চেনা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা। আমাদের দু’জনেরই কাজ বন্ধ হয়ে গেল।
বিমলাদি বললেন, মেলায় হচ্ছে। এইসময় এখানে একটা বড় মেলা বসে। মঙ্গলচণ্ডীর মেলা। যাবে নাকি দেখতে? খুব জমজমাট। ম্যাজিক, পুতুলনাচ সব আসে। আউসগ্রামের পুতুল। বাঘমুণ্ডির মুখোশ। গ্রামের মেলা তো দেখোনি কোনওদিন।
আপনিও যাবেন?
আপনিটা ছাড়ো। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে আমাদের পরিচয়। হ্যাঁ, আমিও যাব।
তা হলে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিই। হাত চালাই।
আর হয়ে এসেছে।
হোটেলের কোনও বড় পরিবেশক যেন বিশেষ একটা কিছু পরিবেশন করছেন, আমরা সেইভাবে ঝুলকালো তেল-ভরতি গামলাটা পিতা হরিশঙ্করের দরবারে স্থাপন করলুম। তিনি খুশি হয়ে বললেন, আমি জানি বুদ্ধিটা কার মাথায় এসেছিল, বিমলার। একেই বলে গুড ক্যাচ। কনসেনট্রেশনটা ভালই হয়েছে। এইবার এতে একটু পয়েজন, বিষ যোগ করতে হবে। বিমলা, তোমার বাড়িতে বিষাক্ত কী আছে?
আজ্ঞে কাকাবাবু বিষাক্ত তো কিছুই নেই।
হতেই পারে না, ভাল করে ভাবো।
বিমলা অন্যমনস্ক হলেন। হঠাৎ ঝলসে উঠে বললেন, ধুতরো ফল।
ভেরি গুড। নিয়ে এসো আটটা ফল।
বিমলা বললেন, চলো ভাই।
বাগানের দিকে যেতে যেতে ছোটদাদুর দিকে একবার তাকালাম। একমনে নিজের ছোট্ট পকেট বুকে লিখছেন। জানি কী লিখছেন, গান। হয়তো সন্ধের আগেই সুর হয়ে যাবে। রাগরাগিণীর প্রখর জ্ঞান। সুন্দর গলা। সাধক না হয়ে বড় ওস্তাদ হতে পারতেন। বিপ্লবী হয়েছিলেন। শাক্ত বিপ্লবী। হিংসার বিরুদ্ধে হিংসা। দেশবিভাগের দাঙ্গারোধে তার নিঃশব্দ ভূমিকা কেবল আমরাই জানি। ইচ্ছে করলে নামকরা রাঁধুনি হতে পারতেন। হতে পারতেন বিরাট ব্যবসায়ী। সিদ্ধি তার হাতের মুঠোয়। ধুলো ধরে সোনা করার অলৌকিক ক্ষমতা তার আয়ত্তে।
বাগানের শেষ মাথায় কোদাল পড়ার আওয়াজ। মোহনদা মাটি কোপাচ্ছেন। আমাদের দেখে বললেন, আজ খুব জব্দ হয়েছি।
ভদ্রলোক ঘেমে নেয়ে গেছেন। পিতার নিষ্ঠুর ব্যবহারে লজ্জা করছে। একদিনে এতটা অত্যাচার ওই শরীর সহ্য করতে পারবে। আমিই তার হয়ে ক্ষমা চাইলুম, আপনি কিছু মনে করবেন না মোহনদা। ওঁর চরিত্রের এইটাই এক ভয়ংকর দিক।
কোদাল ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মোহনদা বললেন, উনি যে আমার কত উপকার করলেন! আমার চরিত্রের একটা বড় দিক খুলে দিলেন। কত আপনার ভাবলে তবেই এমন করা যায়।
একদিনে এতটা সহ্য হবে মোহনদা?
কাকাবাবু বললেন, সবাই ধর্মদীক্ষা দেয় আমি তোমাকে কর্মদীক্ষা দিলুম। আজ সবই একটু একটু হবে। আমার ভীষণ ভাল লাগছে। চনচনে খিদে।
বাগানের একেবারে শেষপ্রান্তে পোড়ো একটা পাঁচিল। সেইখানে ধুস্তুর গাছের ছোটখাটো একটা জঙ্গল। মহাদেবের প্রিয় গাছ। ভাং আর ধুতরো একসঙ্গে বেটে খেলেই–শিবোহং। সঙ্গে সঙ্গে নির্বাণ। জয় বাবা, বলে গোটা দশেক ফল আমরা ছিঁড়ে নিলুম। কবিরাজি আর অ্যালোপ্যাথি মতে। উই মারা হবে। এই সাধক কীটকুলের প্রতি হরিশঙ্করের অসীম ক্রোধ। আমাদের প্রাচীন প্রাসাদে পিতামহের দুর্লভ গ্রন্থসংগ্রহ শত চেষ্টাতেও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। প্রাচীন সেইসব বই আকারে আকৃতিতে ছিল বিশাল। ওয়েবস্টার ডিকশেনারি প্রায় জলচৌকির মতো। দশ খণ্ড দর্শনের বই একের পর এক সাজালে টুলের উচ্চতা। কোনান ডয়েলের লস্ট ওয়ার্ল্ড, পাতায় পাতায় ছবি। ইউক্লিডের বিশাল জ্যামিতি। স্কটের বই। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কীটস, বায়রন, টেনিসন, মিলটন। উইপোকাদের মাথার ঠিক থাকে! অসীম জ্ঞানভাণ্ডার সীমাহীন তৃষ্ণায় মাটি করে ফেলেছে। শুধু খায়নি, খেয়ে হজম করে ত্যাগ করেছে। পিতার মন্তব্য, জ্ঞান যে একদলা ঝরো ঝরো মাটি ছাড়া। কিছুই নয়, এ তারই রাসায়নিক প্রমাণ। এরপরই সেই বিখ্যাত সংগীত বিভিন্ন রাগ সহযোগে, উই আর ইঁদুরের দেখো ব্যবহার। কাঠ কাটে বস্ত্র কাটে করে ছারখার। এই গান দিয়ে নাকি তবলায় বোল সাধা যায়। ত্রিতাল। তা ধিন ধিন তা।
নরম সবুজ ঘাসের ওপর বিমলাদির পা পড়ছে। একটু উঁচু করে পরা শাড়ি। মনে হচ্ছে বনপথ। ধরে মা লক্ষ্মী চলেছেন হেমন্তের বিকেলে। আর কিছুক্ষণ। বিকেল, রাত, ভোর, নাটক শেষ। যতই কেন তোক না মধুর, যতই ভাল লাগুক, যতই মজে থাক মন, লতা যতই ভাবুক এতদিনে পেয়েছি লতিয়ে ওঠার মতো নির্ভর এক বৃক্ষ, বাউল-সময় একতারাটি বাজাতে বাজাতে এসে বলবে, হেথা নয়, হেথা নয়। তুমি চাইলেই তো হবে না, ভাগ্য তোমাকে দিয়েছে যা, তাই নিতে হবে মেনে। তুমি এখানে, তোমার ইতিহাস ওখানে। আমি জানি, এতদিনে আমার স্নেহশুষ্ক জীবন একটা দিঘির সন্ধান পেয়েছে। সেই কোন শৈশব থেকে মাতৃহারা এক শিশু শাসনের ছায়াহীন মরুভূমিতে উটের মতো চলেছে তো চলেছেই। পিঠে তার উচ্চাশার কুঁজ। মনে তার দুরপনেয় খিদে। একটু ভালবাসা, একটু স্নেহ, কোমল হাতের ছোঁয়া, দুটো মিষ্টি কথা। সেই কবে থেকে কাটাগাছই চিবোচ্ছি। কশ দুটো ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। মাঝে মাঝে একটু ছায়া খেলে যায় জীবনে। মায়ামৃগের মতো ছুটে পালায়। মরূদ্যান আজও মিলল না। সবই মরীচিকা। নিজের মনেই তৈরি করে রেখেছি মায়া মরূদ্যান। মনে মনেই সেখানে সরে যাই। রূপসাগরে তলিয়ে যাওয়ার সাধনা করি। ছোটদাদু শেখাবার চেষ্টা করেছেন ষটচক্রে মনভ্রমণের কৌশল। এগিয়ে যাও। বাইরে নয় ভেতরে। ছোটদাদু গাইবেন, জাগ জাগ জননি/ মূলাধারে নিদ্রাগত কতদিন গত হল কুলকুণ্ডলিনী/ স্বকার্য সাধনে চল মা শিরমধ্যে। পরম শিব যথা সহস্রদল পদ্মে/ করি ষড়চক্র ভেদ ঘুচাও মনের খেদ, চৈতন্যরূপিণী। কাটাকুটি করলে এই ষড়চক্র দেখা যাবে না। সার্জারির বিষয় নয়। এ হল মনের নানা অবস্থার কথা। মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, গুহ্য, লিঙ্গ, নাভি। মন বেশিরভাগ সময় এই অঞ্চলেই ঘোরাঘুরি করে। তাই মানুষ শিশ্নোদরপরায়ণ। হৃদয় হল অনাহতপদ্ম। মনকে ঠেলে এইখানে তুলতে পারলেই অন্য অভিজ্ঞতা। জীবাত্মাকে তখন শিখার মতো দর্শন হয়। চোখ বুজোলেই জ্যোতি। সাধকের সে কী আনন্দ, এ কী! এ কী! পঞ্চম ভূমি হল বিশুদ্ধচক্র। মন এই ভূমিতে গেলে, কেবল ঈশ্বরের কথাই শুনতে ইচ্ছে করে। ষষ্ঠভূমি হল আজ্ঞাচক্র। সেখানে মন গেলে ঈশ্বরদর্শন হয়। কিন্তু যেমন লণ্ঠনের ভিতর আলো, ছুঁতে পারে না, মাঝে কাঁচ ব্যবধান আছে বলে। ছোটদাদু জনকরাজার কথা বলেন, ত্রৈলঙ্গস্বামীর কথা বলেন। জনকরাজা পঞ্চমভূমি থেকে ব্রহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিতেন। তিনি কখনও পঞ্চমভূমি, কখনও ষষ্ঠভূমিতে থাকতেন। ষড়চক্র ভেদের পর সপ্তম ভূমি। সহস্রার। মন সেখানে গেলে মনের লয় হয়। জীবাত্মা পরমাত্মা এক হয়ে যায়। তখন সমাধি। দেহবুদ্ধি চলে যায়, বাহ্যশূন্য হয়, নানা জ্ঞান চলে যায়, বিচার বন্ধ হয়ে যায়। সমাধির পর শেষে একুশ দিনে মৃত্যু হয়।
বিমলাদি কোথা থেকে এক ধরনের মাটি নিয়ে এলেন। বললেন, বেশ করে সারাশরীরে মেখে পুকুরে মারো এক ডুব। তিনিও মাখতে লাগলেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ঝোঁপঝাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে বড়-ছোট ব্যাং। থুপুর থাপুর লাফ চলেছে এদিকে-ওদিকে। ভয় করছে। প্রথম হল সাপ। তারপর মনে হল সাপ মানুষকে একবারই কামড়ায়। বজ্রাঘাত একবারই হয়। অর্থাৎ মানুষ মারা যায়। আমি তো বেঁচে আছি। আর একবার কামড়ালে কী হবে!
বিমলাদি আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, কী ভাই, ভয় করছে খুব! দেখো, পুকুরের জলটা যেন ঠিক একটা আয়না!
দিদি, আমার বাবাকে তো দেখছেন। তার হাতে মানুষ। ভয় থাকলেও বলার উপায় নেই। করলেও বলা যাবে না। মানুষের তিনটি আদিম ভয় আছে, সর্পভয়, অগ্নিভয় ও জলভয়। তিনটেই আমার কাটিয়ে দিয়েছেন।
কীভাবে? সাপ দিয়ে কামড় খাইয়ে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, জলে চুবিয়ে?
সাপ আমাকে এমনি নিজে নিজে এসে দয়া করে কামড়ে গেছে এই কদিন আগেই। জানি না বেঁচে গেছি কীভাবে? মনে হয় এক সন্ন্যাসীর কৃপায়। সে এক অলৌকিক কাহিনি। আগুন আমাকে। ঘিরে থাকে। আমি একটা ল্যাবরেটরিতে কাজ করি। এমন সব জিনিস আগুনে ফোঁটাতে হয় যে-কোনও মুহূর্তে আগুন লেগে গেলেই হল। ভীষণ সাহসের দরকার। আর জল? গঙ্গার ধারে বাড়ি। সাত বছর বয়সেই বাবা কোমরে গামছা বেঁধে জলে ভাসিয়ে রেখে সাঁতার শিখিয়েছেন। বর্ষার গঙ্গায় নৌকো করে এপার ওপার করিয়েছেন। মাঝগঙ্গায় ভীষণ বাতাসে পালের দড়ি ছিঁড়ে গেল। নৌকোর চরকিপাক। যাত্রীরা গেল গেল করে আতঙ্কে চিৎকার করছে। নৌকো প্রায় ডোবে আর কী! পালের দড়ি বাঁধা কোণটা ঝোড়ো হাওয়ায় ফটাস ফটাস করে ছইয়ের ওপর আসছে আর ফিরে ফিরে যাচ্ছে। বাবা আর আমি ছইয়ের ওপর বসেছিলুম। দড়িটা বারেবারে এসে ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছে। পড়ে যাবার ভয়ে আমি গলুইয়ের একটা বাঁশ প্রাণপণে ধরে আছি। মনে মনে ভাবছি, আজই শেষ। যতই সাঁতার জানা থাক, এই উত্তাল নদীতে পড়লেই সব শেষ। বাবা গুনগুন করে গান। গাইছেন। যেন ফুরফুরে বাতাসে পানসি চেপে বেড়াতে চলেছেন! নৌকোর যাত্রীরা যখন ভয়ে। আধমরা, মড়াকান্না শুরু করে দিয়েছে, বাবা খপ করে ডান হাত বাড়িয়ে দড়িটা ধরে ফেললেন। তখন মাঝিরা চিৎকার করছে, বাবু ছেড়ে দিন ছেড়ে দিন, রাখতে পারবেন না। পাল ততক্ষণে ফুলে উঠেছে ভরা বাতাসে। নৌকো ডান দিকে কাত হয়ে তিরবেগে এগোচ্ছে পাড়ের দিকে। হরিশঙ্কর অক্লেশে ধরে আছেন পালের দড়ি। হেডমাঝি এগিয়ে এসে দড়িটা কোনওরকমে খোটার সঙ্গে বেঁধে দিয়ে বললে, মানুষের এমন শক্তি আমি দেখিনি। বাবু আপনি দেবতা। পরে বাবাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম, কী করে এমন করলেন? সোজা বললেন, মনের জোরে। আমার দুঃখটা কোথায় জানেন দিদি, আমি বাবার নখের যোগ্য নই। কিছুই আমি নিতে পারিনি।
দূরে গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। হরিশঙ্কর আর মোহনদা আসছেন। বিমলাদি তাড়াতাড়ি শরীর ঢাকলেন। আমাদের লক্ষও করলেন না। সোজা নেমে গেলেন পুকুরে। হরিশঙ্কর প্রশ্ন করলেন, মাছ ছেড়েছ?
মোহনদা বললেন, আছে কিছু।
কিছু কেন? ভাল করে চাষ করো না কেন? মোহন, তোমার সবই আছে, প্ল্যানিংয়ের অভাব। ইচ্ছে করলে তুমি রুপোর থালায় ভাত খেতে পারো।
আমার আপনার মতো একজন গুরু দরকার।
জানো তো কর্তাভজা সম্প্রদায়ে মন্ত্র দেবার সময় গুরু বলবেন, এখন থেকে মন তোর। নিজের মন নিজে সামলাও। মনকে এগিয়ে নিয়ে যাও। মনই সব। মনেই সব। ওই একই কথা তোমাকেও আমি বলছি–মন তোর।
ঝপাঝপ স্নান সেরে উঠে এলেন দু’জনে। যাওয়ার সময় হরিশঙ্কর আমাদের বলে গেলেন, একটু-আধটু তেলকালি থাকে থাক না। তাড়াতাড়ি সেরে নাও। তোমার তো আবার হাঁচিকাশির ধাত।
একের পর এক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান বেজে যাচ্ছে দূরের সেই মেলায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। যখন আমাদের পরিবার সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছে, সেই সময়, যেন চোখের সামনে দেখতে পেতুম। অধ্যবসায়ী এক মালী উবু হয়ে বসে আছে। একখণ্ড জমি। লোমশ হাত দিয়ে খুঁটে খুঁটে একটি একটি করে ঘাস তুলে যাচ্ছে। হরিশঙ্করের অবাক প্রশ্ন, তুমি কে? উত্তর, আমি মৃত্যু। প্রশ্ন, তুমি কী করছ? আমি নির্মূল করে দিচ্ছি। শুধু দুটি মাত্র ঘাসের ডগা থাকবে। পিতা আর পুত্র। কেন? বিধির বিধান। হরিশঙ্কর পাথরের মতো মুখে বলতেন, তবে তাই হোক। সন্ধ্যার ছায়ান্ধকারে, প্রকৃতি যখন দিবসের তীক্ষ্ণ রেখা হারিয়ে ক্রমশই নরম তলতলে হয়ে আসত, হরিশঙ্কর তখন গাইতেন, সন্ধ্যা হল গো–ও মা, সন্ধ্যা হল, বুকে ধরো/অতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করো। ফিরিয়ে নে মা, ফিরিয়ে নে গো–সব যে কোথায় হারিয়েছে গো…। হঠাৎ একদিন গা ঝাড়া। দিয়ে উঠলেন, তবে রে ষড়যন্ত্র! দয়া! তোমার দয়া কে চায়! কে তুমি! তুমি কার প্রভু! আই চ্যালেঞ্জ ইয়োর অথরিটি। মন্দিরে মন্দিরে অসহায় মানুষের সেবা নিম্, ইউ লাইফলেস গড। মানুষ কেঁদে ভাসাচ্ছে। মাথা ঠুকে ঠুকে ফুলিয়ে ফেলছে। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার। উত্তরের বারান্দায় পিতা হরিশঙ্কর বিসর্জনের রঘুপতির মতো পায়চারি করতেন আর বলতেন, কোথাও সে নাই। উর্ধ্বে নাই, নিম্নে নাই, কোথাও সে নাই, কোথাও সে ছিল না কখনও। সেইসময় হরিশঙ্করের একটা হাত ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আর একটা হাত শেকসপিয়ার। একদিন আমাদের ঠাকুরঘরে মাতামহের পূজিত তারামূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আবৃত্তি শুরু করলেন, দেখো, দেখো, কি করে দাঁড়িয়ে আছে, জড়/পাষাণের স্তূপ, মূঢ় নির্বোধের মতো/মূক, পঙ্গু, অন্ধ ও বধির! তোরি কাছে/সমস্ত ব্যথিত বিশ্ব কাঁদিয়া মরিছে!/পাষাণ চরণে তোর, মহৎ হৃদয়/আপনারে ভাঙিছে আছাড়ি। হা হা হা!/ কোন্ দানবের এই ক্রুর পরিহাস/জগতের মাঝখানে রয়েছে বসিয়া/মা বলিয়া ডাকে যত জীব, হাসে তত/ ঘোরতর অট্টহাস্যে নির্দয় বিদ্রূপ। মূর্তি তুলে গঙ্গার জলে ফেলতে গিয়েছিলেন, মাতামহ ছুটে এসে বোঝাতে লাগলেন, মূর্তিতে কিছু নেই, আছে মানুষের বিশ্বাসে। একটা মূর্তি বিসর্জন দিয়ে কী হবে! হাজার হাজার মানুষের মন থেকে যুগসঞ্চিত বিশ্বাস কি উৎপাটন করতে পারবে? হরিশঙ্কর ভাবলেন, হরিশঙ্কর শান্ত হলেন। অ্যালকোহলিকের মতো হয়ে উঠলেন ওয়াকোহলিক। কাজ, শুধু কাজ। কতরকমের কাজ আবিষ্কার করা যায় প্রতিভা সেই দিকে খেলে গেল।
দামোদরের তীরে এই সন্ধ্যা একে একে আমাকে সেই অতীত ফিরিয়ে দিতে লাগল। একটি মানুষের একক সংগ্রামের ইতিহাস। আমার অতীত কিছু নেই। অজগরের পৃষ্ঠে আরোহণ করে পিন্টু নামক ভেকের ভ্রমণবৃত্তান্ত। একেবারে অর্থহীন একটা জীবন। ঝকঝকে মানিব্যাগ। খোলো, একটাও নোট নেই। একটা বাসের টিকিট। চালক হরিশঙ্কর। জানলার ধারে বসে-থাকা আমি এক সুখী যাত্রী মাত্র।
ভাবালুতা চটকে গেল। হঠাৎ হরিশঙ্কর সেনানায়কের মতো হুংকার ছাড়লেন, উঠাও গাঁঠরি। ছোটদাদু চোখ বুজিয়ে বসে ছিলেন। চোখ না-খুলেই প্রশ্ন করলেন, কী বলতে চাইছিস? বাংলায় বল।
হরিশঙ্কর বললেন, ভীষণ ঘাস-ঘাস লাগছে। একটা আইডিয়া খেলে গেল। শুধুই কর্তব্য আকর্ষণ শূন্য। আমরা একটা জায়গায় যাব। এর মধ্যে বাড়তি কোনও আকর্ষণ আছে?
ছোটদাদু বললেন, কেন নেই? নতুন জায়গা, নতুন দৃশ্য, নতুন মানুষ।
এর বেশি কিছু আছে?
না।
আমি আরও কিছু আকর্ষণ ঢোকাতে চাই।
কীভাবে?
আমি এই যাওয়াটাকে করে তুলব আকর্ষণীয় এক অ্যাডভেঞ্চার। এখনই আমরা বেরিয়ে পড়ব। এই অন্ধকার রাত, বনের পথ, ডাকাতের ভয়। সারারাত আমরা হাঁটব। ভয়ে একজনের বুক ঢিপঢিপ করবে।
কার, আমার?
তোর বুক? ওটা তো পাথরের বেদি। ভয় করবে আমার পুত্রের। ভাগ্য প্রসন্ন হলে ডাকাতের কবলেও পড়তে পারি। ডাকাত, ডাকাতি, চিরকাল শুনেই এসেছি। একটা অভিজ্ঞতা হোক না! ইংরেজিতে একটা কথা আছে হ্যান্ডলিং। ব্যবহারবিধি। স্টোভ, বন্দুক, ক্যামেরা, টেলিস্কোপ, ঘড়ি, এক-একটা জিনিস এক-এক কায়দায় নাড়াচাড়া করতে হয়। ডাকাতকে কীভাবে হ্যান্ডল করতে হয়, সেটা আমরা শিখতে পারব। তুই কোনওদিন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছিস?
না, উলটোটা হয়েছে। ডাকাত আমার পাল্লায় পড়েছে। তারাপীঠে আমার আস্তানায় এসে কান্নাকাটি। বাবা ভাল করে দাও। ডাকাত বলে তো পির নয়! আমরা ডাকাতকে ভয় পেতে পারি, ব্যাধি তো আর ডাকাত-পুলিশ মানে না। দু’পক্ষকেই ধরে। একপাশে থানাদার বসে আছে, পেটে ক্যান্সার। আর একপাশে ভৈরব ডাকাত, ডান অঙ্গে প্যারালিসিস।
হরিশঙ্কর বললেন, নে উঠে পড়। রাতের জঙ্গল একটা দেখার জিনিস। শজারুর নাচ দেখেছিস?
কী শজারু দেখাচ্ছিস! শেষরাতে চাঁদের আলোয় শেয়ালের নাচ দেখেছিস?
তুই হনুমানের ধ্যান দেখেছিস?
তুই রাতচরা রাজহংস দেখেছিস?
উতোর-চাপান আরও কতদূর এগোত কে জানে? সামনে এসে দাঁড়ালেন পণ্ডিতমশাই। একেবারে রাজবেশ। গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি। ভুরভুর আতরের গন্ধ। চোখে কাজল। মুখে পাউডার। সবিনয়ে বললেন, এই আমার অভিসারের সময়। নিজেকে প্রস্তুত করে রাখতে হয়। বলা তো যায় না, দেখা তো হয়ে যেতে পারে। প্রস্তুত ছিলাম না বলে ফিরে চলে গেলে দুঃখের সীমা থাকবে না।
হরিশঙ্কর বললেন, কার অভিসারে চলেছেন? শ্রীরাধিকা?
পণ্ডিতমশাই বসতে বসতে বললেন, গণিতজ্ঞ হয়ে ধরতে পারলেন না? আমি বৈদান্তিক, জ্ঞানমার্গী। মধুর রসের পথ আমার পথ নয়। মৃত্যুর অভিসার। ভোলানাথ আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
ছোটদাদু বললেন, কোন ভোলানাথ? উমার স্বামী?
না মহামান্য। গোয়ালা ভোলানাথ, যে আমাকে নিত্য আধসের করে দুধ সরবরাহ করত। সেই ভোলানাথ সদাসর্বদাই এই জেলার বিখ্যাত গামছা পরিধান করে থাকত। অর্থের অভাব ছিল না, কিন্তু কৃপণ। বারবার বলেছিলুম, ভোলা ব্যাটা, তোর টাকা খাবে কে? সন্ধেবেলায় একটা ধুতি পরার মতো দয়ালু হনা। দিবা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত গামছা সহ্য করা যায়। তারপর নৈব চ। ভোলা গামছা পরেই মারা গেল। কী অগৌরবের কথা! গামছা, ফতুয়া, পকেটে বিড়ির ডিবে। পুষ্পক রথে আরোহণ করে স্বর্গে যায় কে? ভোলা গোয়ালা। স্বর্গের সিংহদুয়ারে অপ্সরাগণ লজ্জায় অধোবদন।
বিষ্ণুপদ মাঠে প্রাতঃকৃত্য করতে করতে চলে গেল। কী অগৌরবের কথা! মানুষ বলে কি আমাদের কোনও মানসম্মান থাকতে নেই মৃত্যুর কাছে! তাই আমার এই রাজবেশ। রজনীতেই আমার মৃত্যু হবে। তারকারাজির পথ বেয়ে চলে যাবে আমার স্বর্গীয় শকট।
ছোটদাদু বললেন, কেমন বৈদান্তিক! মৃত্যুর কথা ভাবছেন?
ভাবব না? মৃত্যুই যে আমাকে ঝকঝকে নতুন সুন্দর পোশাক দেবে। এই শততালি প্রাচীন পোশাক তো আর চলে না। জীর্ণ হয়েছে। আমি এখন তাম্বুলসেবা করব। আমার বিমলা মা কোথায়?
পণ্ডিতমশাই ডাকলেন, বিমলা মা। উত্তর এল, যাই বাবা।
পণ্ডিতমশাই বললেন, আসুন সুধিজন, আমরা বিচারে বসি। বিষয় আপনারাই নির্বাচন করুন।
হরিশঙ্করের মুখেচোখে বুদ্ধির বিদ্যুৎ আভাস। এতক্ষণ বড় বোদা হয়ে ছিলেন। গণিত জ্যামিতি পরিমিতি থেকে দূরে। একদল সহজ-সরল মানুষের অতি সাধারণ জগতে। এখন সামনেই ন্যায় ও দর্শনের এক পণ্ডিত। বুদ্ধির ঘষাঘষির অপূর্ব সুযোগ উপস্থিত। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে এই জীবন উপত্যকায় মানুষ কী দর্শন করে? কাকে দর্শন করে? হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ আমাকে ছুঁয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে কেউ যদি আমাকে গাইতে বলতেন, আমি গেয়ে উঠতুম :
তার হাতে ছিল হাসির ফুলের হার কত রঙে
রঙ করা।
মোর সাথে ছিল দুখের ফলের
ভার অশ্রুর রসে ভরা ॥