He that looks not before, finds himself behind
শিশুকে যেভাবে ভুলিয়ে শান্ত করে তার আকর্ষণের ক্ষেত্র থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়, মোহনবাবু ঠিক সেইভাবে হরিশঙ্কর ও ছোটদাদুকে নিয়ে এলেন। বিমলাদি দাওয়ায় বসে আছেন আপনার ভাবে বিভোর হয়ে। পিন্টু লাল মেঝের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে, দু’হাতের ভরে চিবুক রেখে গভীর মনোযোগে কী একটা বই পড়ছে। পেছনের পা দুটো হাঁটুর কাছ থেকে মুড়ে ওপরে তোলা।
আমাদের ফিরতে দেখে বিমলাদি তাড়াতাড়ি উঠে এগিয়ে এসে বললেন, আপনাদের ভারী দেরি হয়ে গেল আজ। কত বেলা হয়ে গেছে!
ছোটদাদু বললেন, কিচ্ছু ভাবিসনি মা, আমরা সব চারটের পার্টি। সকাল সকাল খায় রোগীরা।
পিন্টু অদ্ভুত কায়দায় গড়িয়ে মেঝে থেকে ঝপ করে উঠে বললে, ছোটমামা, তুমিও ছোট ছেলের মতো হারিয়ে যাও! হারিয়ে গেলে কী করতে হয় জানো? মামার নাম বলবে, আর বাড়ির ঠিকানা। তোমার মামা আছে তো?
বিমলাদির দিকে তাকাতেই করুণ মুখে একঝলক হাসি এনে বললেন, ছেলের পাকাঁপাকা কথা শোনো।
ব্যাপারটা খুবই দুঃখের। বাবার পরিচয়ে পরিচিত হবার উপায় নেই। মামার পরিচয়ই সব। শিশু জানে না তার জীবনের দুর্ভাগ্যটা কোথায়! যখন জানবে তখন সে একটা বেদনারই উত্তরাধিকারী হবে। পুরো ইতিহাস আমার জানা হবে না। তবে যদি ধর্মের কারণে বিচ্ছেদ হয়ে থাকে, তা হলে বিমলাদির কাছে আমার নিরুচ্চার প্রশ্ন, সংসার করতে গিয়েছিলেন কেন? এমন সুন্দর এক শিশুর জীবন কেন নষ্ট করলেন! পণ্ডিতমশাই ঠিক, পৃথিবী শয়তানের। এখানে ভগবানও সময় সময় শয়তানের রূপ ধরেন। না কি শয়তান ধরেন ভগবানের রূপ!
আমরা লাইন দিয়ে খেতে বসেছি। এমন সময় মোহনদার এক পরিচিত এসে জানিয়ে গেলেন, দামোদর ভয়াবহ চেহারা ধারণ করেছে। জল বাড়তে বাড়তে একেবারে টইটম্বুর। যে-কোনও সময় কূল ছাপিয়ে যাবে।
হরিশঙ্কর সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ আগ্রহে বললেন, তার মানে বন্যা! বন্যা হলে আমি কিন্তু থেকে যাব! দুর্ভিক্ষ দেখেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি, দাঙ্গা দেখেছি, ভূমিকম্প দেখেছি, মহামারী দেখেছি। দুটো জিনিস দেখা হয়নি, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত আর বন্যা।
মোহনদা বললেন, সে ভারী সুন্দর! কোনওরকমে বেঁচে গেলে অভিজ্ঞতার মতো অভিজ্ঞতা। শুধু জল আর জল। সব সমান। এ পাড়া ও পাড়া নেই সব একাকার। গাছপালা সব ছোট ছোট, ঝোঁপের মতো। বাড়ির চালগুলো শুধু জেগে আছে। সেই চালে বসে আছি আমি। শুধু আমি একা নই, আমার সঙ্গে গোরু আছে, ছাগল আছে, হাঁস-মুরগি আছে, সাপ আছে। ঘরে ঘরে মানুষ নেই, শুধু জল কলকল করছে। এরই মধ্যে ঘর ভাঙবে। ঝুপ করে দেয়াল ধসে পড়ে চালাটা ভাসতে ভাসতে চলে যাবে। না খাদ্য, না জল। এরই মাঝে আসবে নৌকো, হয় সেনাবাহিনীর না হয় মিশনের। অনেক দিন না-খাওয়ার পর খাওয়া, মরতে মরতে বেঁচে ওঠার কী আনন্দ। মরে না গেলে একটা অভিজ্ঞতা। বিহারে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, বন্যা হলেও হতে পারে। আপনাদের ভাগ্যে থাকলে দেখা হবে। বন্যা আমাদের গা সওয়া। হলেই হল।
হরিশঙ্কর বললেন, একবার নদীর ধারটা ঘুরে এলে হয়!
ছোটদাদু বললেন, তুই কোনওরকমে আগে খাওয়াটা শেষ কর। নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হবে তো! সে অভিজ্ঞতাটা খুব সুখের হবে না। আমার সাধারণ বুদ্ধি যা বলে। যতটা পারো পেটে নিয়ে নাও। এমনও হতে পারে সাতদিন কিছু জুটল না।
বিমলাদি পরিবেশন করতে করতে বললেন, এখন বন্যা হবে না। আরও পরে হলেও হতে পারে। মাসখানেক পরে। এ জল আমাদের বাগান পর্যন্ত এসে সরে যাবে। বড়জোর এই উঠোনটা। ভরে যাবে। এ দাওয়া থেকে ও দাওয়া জল ভেঙে ভেঙে যেতে হবে।
পিন্টু বলল, দেখবে কত মাছ আসবে। সাপ আসবে সুন্দর সুন্দর।
ছোটদাদু বললেন, অপূর্ব আহার হল। বিমলা মা আমার চমৎকার বেঁধেছে। এতসব করলে কখন?
মোহনদা বললেন, বিমলা ভীষণ ভাল রাঁধে। ওর রান্নার জন্যেই আমার খদ্দের। মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পায়।
পিতা হরিশঙ্করের কানে কানে বললুম, কিছু তো কেনা হল না! উপহার!
হরিশঙ্কর চুপিচুপি বললেন, ব্যবস্থা হয়েছে একটা।
আমি আরও ফিসফিস করে বললুম, কী ব্যবস্থা?
ছোটমামার পকেটে একটা সোনার মাদুলি ছিল তারা মায়ের চরণের ফুল ভরা। এর চেয়ে ভাল জিনিস আর কী হতে পারে! ধর্মের সংসার, বেশ মানিয়ে গেছে।
ছোটদাদু ভীষণ পান ভালবাসেন। দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে বসেছেন। পেছনে পরিষ্কার ওয়াড়ে-ঢাকা বেঁটে মোটা তাকিয়া, সামনে পানের ডিবেতে সাজা পান। পাশে গোল ছোট্ট ডিবেতে চুন। আর একটা কৌটোয় জরদা। ছোটদাদু চারপাশ আলো করে বসে আছেন। হরিশঙ্কর কবি হয়ে গেছেন। গাছ, আকাশ, নদী, পাখি। সামনেই বাঁশঝাড়। হরিশঙ্কর বাঁশঝাড় ভীষণ ভালবাসেন। কচি, মসৃণ, তেলা বাঁশ তার কাছে কবিতার মতো সুন্দর।
হরিশঙ্কর বললেন, একটাই অভাব। একটা ছোট পাহাড় থাকলে বেশ হত।
ছোটদাদু বললেন, বাকি জীবনটা এখানে কাটালে কেমন হয়? আমাদের তো কোথাও কোনও বন্ধন নেই। বড় শান্তির জায়গা। একটা পঞ্চমুণ্ডীর আসন পেতে বসে পড়ো কাজের কাজে।
হরিশঙ্কর বললেন, বসতে হলে হিমালয়ের কোলেই বসা ভাল।
হিমালয় হল শিবের, বিষ্ণুর। তারার সাধনা গরম ছাড়া হয় না। কঁকুরে মাটি, জলের অভাব, ফোঁসকা পড়ানো ভীষণ গরম, একটা বেলগাছ, পাশেই মহাশ্মশান, হোমের আগুন, তবেই না তার। আবির্ভাব! বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এই হল পীঠস্থান। চল না, আমার সঙ্গে একদিন শ্মশানে বসবি।
হরিশঙ্কর বললেন, শ্মশান করেছি হৃদি, শ্মশানবাসিনী শ্যামা, নাচবি সেথা নিরবধি। আমি আর শ্মশানে গিয়ে কী করব? আমার জীবনটাই তো শ্মশান। প্রহরে প্রহরে স্মৃতির শৃগালের হুক্কাহুয়া। হরি বাঁচ, আরও বাঁচ। প্রতিদিন মরে মরে বাঁচ। মৃত্যুর হায়না রবীন্দ্রনাথের মতোই আমার জীবন নিয়ে খেলা করেছে। তার সেই অপূর্ব গান নিজেকে গেয়ে শোনাই, গরব মম হরেছ, প্রভু, দিয়েছ বহু লাজ/কেমনে মুখ সমুখে তব তুলিব আমি আজ। মুখুজ্যেমশাই, এর দাদু প্রেমিকের একটা গান। গাইতেন। গেঁথে আছে আমার মনে। সুরটাও ছিল অসাধারণ, পরজবাহার। মন দিয়ে শোন, তুই তো গান লিখিস। বিশাল বিশ্বফলকে আঁকিছু প্রতিপলকে/সীমা করি লোকালোকে, মহামোহ রাগ সারে ॥ আশারূপ মহাহ্রদে পড়ে যায় ধরিতে চাঁদে/কেহ কাঁদে মনের খেদে, মত্ত কেহ অহংকারে/ কেহ আনন্দে মগন পেয়ে তনয়-রতন/কেহ অশ্রু বিসর্জন করে মৃত সুত হেরে ॥ কল্পনা-পাদপতলে বসেছে কেউ কুতূহলে। কেহ ভাসে সকল ফেলে অকালে কাল-স্রোতনীরে/এ আকৃতির এমনি রীতি অসত্যে সত্য প্রতীতি। দেখ, আমি নাস্তিক। দেবদেবীতে আমার বিশ্বাস নেই। জীবন হল যাপনের জিনিস। যেমন কম্বল। গায়ে দাও। ছাতা মাথায় দাও। জুতো পায়ে দাও। মানুষ হল বদ্ধ উন্মাদ। একটা মাছি তৈরি করার ক্ষমতা নেই, ডজন ডজন দেবতা তৈরি করে বসে আছে। আমি নিৎসের মতোই মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি নিজেকে, মানুষ ভগবানের মারাত্মক ভুল, না ভগবান মানুষের মারাত্মক ভুল। বিশ্বাস মানুষের মনে ঢোকানো যায় না, বিশ্বাস মানুষের মনে তৈরি হয়। ফুলের মতো ফুটে ওঠে। ঘাসের মতো অনায়াসে গজায়।
হরিশঙ্কর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কেন অকারণে এত বকছি! প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পথে হাঁটবে। পথের শেষে খুঁজে পাবে বেঁচে থাকার উপলব্ধি। এত যুক্তিতর্কের কী প্রয়োজন! কুকুরের লেজ বাঁকা, বাঁকাই থাকবে। ঘোড়ার লেজ সোজা ঝুলে থাকবে চামরের মতো। শত চেষ্টাতেও তার পরিবর্তন হবে না। বাজে না বকে, যাই দেখে আসি প্রকৃতির খেলা। দামোদরের জল কত দূর এল! পথে উঠে পড়েছে কি না?
মোহনদা বললেন, পণ্ডিতমশাইয়ের টোলে যাবেন না? বললেন যে, খুব তর্ক হবে!
হরিশঙ্কর উদাস মুখে বললেন, কী হবে অহংকারের কাঠি-নৃত্য করে? যুগ বদলে গেছে। শ্রীচৈতন্যের প্রেমের যুগ, শঙ্করের মেধার যুগ, বুদ্ধের বিচারের যুগ, প্রসাদের ভক্তির যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন চলেছে শিশ্নোদরের যুগ। খাও-দাও শুয়ে পড়ো কাঁথা মুড়ি দিয়ে।
ঘোটদাদু বললেন, বিকেলটা তো কাটাতে হবে! পণ্ডিতমশাইয়ের আশ্রমটা ভারী সুন্দর। তর্ক না হোক দুদণ্ড বসা তো যাবে।
হরিশঙ্কর কী ভাবলেন, চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, আজই আমাদের চলে যাওয়া উচিত ছিল। একটা কাজের জন্যে আমরা অনেকটা সময় খরচ করে ফেললুম।
ছোটদাদু বললেন, আমরা কি আর করলুম! যাঁর ইচ্ছায় জগৎ-সংসার চলছে, তিনিই করাচ্ছেন।
মোহনদা বললেন, আপনারা যে-দিকটায় যাবেন, সেদিকে বিশাল একটা জঙ্গল পড়বে। দুর্গাপুর হওয়ার পর, যত ডাকাত ছিল সব চলে এসেছে ওই তল্লাটে। কী দরকার, রাত্তিরবেলা ঝুঁকি নিয়ে! কাল সকালে যাবেন। একটা রাতের তো ব্যাপার। আপনারা মহাপুরুষ। একদিনের জন্যে আপনাদের একটু সঙ্গ করি। সকালে বলেছিলেন, লুচি-কুমড়োর ছক্কা খাবেন, রাতে সেইটাই হবে মহামায়ার ভোগ। একটু পুজো হবে, আরতি হবে। আমাদের দুঃখের জীবনে আর কী আছে! একটা আশা নিয়ে বেঁচে থাকি।
ছোটদাদু বললেন, মহামায়া?
মোহনদা বললেন, সে এক কাহিনি! সেবার বন্যা হয়ে গেল জোর। জল নেমে গেল। আমরা নেমে এলুম ডাঙা থেকে। ভিজে ভিজে তিন জ্বর। বাড়িঘর মাটি ভরতি। কোনওরকমে একটুখানি পরিষ্কার করে পড়ে আছি একপাশে। চোখ খুলতে পারছি না, পাশ ফিরতে পারছি না। রাত প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। সে আমার স্বপ্ন, না আপনারা যাকে দর্শন বলেন, তা-ই বুঝতে পারলুম না। কুচকুচে কালো এক দেবীমূর্তি। আমার মাথার শিয়রে দাঁড়িয়ে বলছেন, হাত ধর। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলুম। ভোরবেলা ঘুম ভাঙল। দেখি হাতের পাশে বালিমাটির ওপর ছোট্ট এক দেবীমূর্তি শুয়ে আছেন। পণ্ডিতমশাই দেখে বললেন, মহামায়া। সেই থেকে সংসারে বেশ যেন একটা আঁট এসেছে। মনটা আর আগের মতো টলে না। সহ্য করার শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। পুজো আমি। শিখিনি। যা পারি তা-ই করি নিজের মতো করে।
ছোটদাদু বললেন, এসব কথা কারওকে কোনওদিন বলবে না। চেপে রাখবে নিজের ভেতর। চারপাশে কত অবিশ্বাসী আছে, তোমার সহজ সরল বিশ্বাস ভেঙে দেবে।
মোহনদা বললেন, আপনারা মহাপুরুষ, তাই আপনাদেরই বললুম।
কৃপা দয়া এইসব অযাচিত আসে। হয়তো পূর্বজন্মের কর্মফল। ছোটদাদু বললেন।
হরিশঙ্কর বললেন, ওই একটা জিনিস আমি মানি, কর্মফল।
এক খিলি পান মুখে ফেলে ছোটদাদু বললেন, কেন মানো? তুমি কি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করো?
হরিশঙ্কর বললেন, কর্মফল হল চাষবাসের ব্যাপার, এগ্রিকালচার, সেই কারণেই মানি। বীজ যেমন বুনবে সেইরকম ফসল তুলবে। যেমন কর্ম তেমন ফল। এ জন্মে না পেলে পরের জন্মে সেইটাই হবে তোমার ভাগ্য, ডেস্টিনি। তুমি বুঝতেই পারবে না কোথা দিয়ে কী হয়ে যাবে!
ছোটদাদু বেশ আঁকিয়ে বসলেন। তাকিয়াটা টেনে নিলেন কোলে। মজলিশি মানুষ। দুঃখ, সুখ কোনও কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। জ্ঞাতি শত্রুর অভাব নেই। তারা যা-তা অপবাদ রটায়। ভণ্ড বলে। বিষয়সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অশান্তি করে। ছোটদাদু গ্রাহ্যই করেন না। কী সব ঘেউ ঘেউ করছে, কান না দিলেই হল। তুলসীদাসের মতো, হস্তী চলে বাজারমে কুত্তা ভুখে। হাজার/সাধুনকে দুর্ভাব নহি যও নিন্দে সংসার ॥ সবসময় একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব। মানিকজোড় বলে। হরিশঙ্কর আর ছোটদাদু সেই মানিকজোড়।
তাকিয়াটা কোলে টেনে নিয়ে ছোটদাদু বললেন, সেই গল্পটা শোনো। গভীর বন। মাঝরাত। এক তান্ত্রিক জবরদস্ত আয়োজন করে শবসাধনায় বসেছেন এক গাছতলায়। কারণবারি, ফুল, ছোলাভাজা। শব জাগলে তাকে ভোলাভাজা খাওয়াতে হবে। শবকে স্নান করিয়ে সাধক তার বুকে চেপে বসে খুব জপ করছেন। ওদিকে গাছের ডালে একজন উঠে বসে আছে। সে পথিক। রাত হয়ে গেছে দেখে বাঘের ভয়ে ডালে উঠে বসে আছে। শবসাধনায় সাধক অনেক বিভীষিকা দেখে। সাহস করে বসে থাকতে হয়। সাহস থাকলে সিদ্ধি, ভয় পেলেই মৃত্যু। শবই ঘাড় মটকে দেবে। সাধক সেই বিভীষিকা দেখতে শুরু করেছেন। ভয়ে এমন অবস্থা, ভাবছেন নেমে পড়ে দৌড় লাগাবেন কি না! এমন সময় কোথা থেকে বিশাল এক বাঘ এসে তন্ত্রসাধকের ঘাড় কামড়ে ধরে তুলে নিয়ে চলে গেল। পথিক বসে আছে গাছের ডালে। সে সব দেখছে। নীচে শুয়ে আছে শব। পূজার উপকরণ। প্রস্তুত। সে তখন আস্তে আস্তে নেমে এল গাছ থেকে। খুব ইচ্ছে হল, দেখাই যাক না, বসে কী হয়। আচমন করে বসে গেল শবের ওপর। একটু জপ করতে করতেই মায়ের দর্শন। সামনেই মা ভগবতী। তিনি বললেন, আমি তোমার ওপর প্রসন্ন হয়েছি, তুমি বর নাও। মা’র পাদপদ্মে প্রণত হয়ে সে বললে,, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তোমার কাণ্ড দেখে অবাক হয়েছি! যে-সাধক এত খেটে, এত আয়োজন করে, এতদিন ধরে তোমার সাধনা করছিল, তাকে তোমার দয়া হল না! আর আমি কিছু জানি না, শুনি না, সাধনহীন, ভজনহীন, জ্ঞানহীন, ভক্তিহীন, আমার ওপর এত কৃপা হল মা? ভগবতী হাসতে হাসতে বললেন, বাছা! তোমার জন্মান্তরের কথা স্মরণ নেই, তুমি জন্ম জন্ম আমার তপস্যা করেছিলে, সেই সাধনবলে তুমি বসতেনা-বসতেই আমার দর্শন পেলে। এখন বলল, কী বর তুমি চাও? এই হল কর্মফল। একটা বোকা, নিরেট, গাধামাকা লোক সিংহাসনে বসে। সবাইকে হুকুম করছে, আর বুদ্ধিমান বিচক্ষণ জ্ঞানী গুণী মানুষ হা অন্ন হা অন্ন করে পরের দাসত্ব করছে। বাংলায় একটা সুন্দর প্রবাদ আছে, কপালগুণে ঘি-ভাত, কপাল দোষে কী ভাত।
মোহনদা বললেন, আমার অবস্থাটাই দেখুন না। কোন ঘরের ছেলে আজ কোথায় নেমে কী কাজ করছি!
হরিশঙ্কর একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তাতে কী হয়েছে? সৎপথে সত্তাবে উপার্জন করার জন্যে যে-কোনও জীবিকাই গ্রহণ করা যায়। এতে অসম্মানের কিছু নেই।
মোহনদা বললেন, না, আমি বলছি ভাগ্যের কথা। মানে আমার ভাগ্যটা চিরকালই তেমন সুবিধের নয়। আমার জীবনে কিছুই তেমন হতে চায় না। কত লোকের কত কী হয়!
শোনো, ভাগ্যে বিশ্বাস করো শুধু শব্দটা পালটে নাও। ভাগ্যের জায়গায় বসাও কর্ম। যত খাটবে ততই তোমার বরাত ফিরবে। আমিও ভাগ্য বিশ্বাস করি। যত খাঁটি ততই আমার ভাগ্য ফিরে যায়। খাটলে খাঁটিয়া, আরও খাটলে খাট, আরও খাটলে সিংহাসন।
মোহনদা বললেন, আমিও তো কম খাঁটি না!
হরিশঙ্করের স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে ওঠা দেখে ছোটদাদু ভয় পেয়ে গেলেন, কী হল?
হরিশঙ্কর কোনও কথা না বলে সোজা চলে গেলেন দাওয়ার উত্তরপ্রান্তে। সেখানে দাঁড়িয়ে মোহনদাকে ডাকলেন। মোহনদা বেশ থেবড়ে বসেছিলেন দেয়ালে পিঠ দিয়ে। ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে গেলেন। হরিশঙ্কর মোহনদার কাঁধে হাত রেখে বললেন, এটা কী?
ছোটদাদু বললেন, দেখে এসো তো, ওখানে মোহনের কোন ভাগ্য খেলা করছে? সৌভাগ্য না। দুর্ভাগ্য! খোলার চাল। বাঁশের বাতা। বাঁশের খোটা বেয়ে পুরু হয়ে উইপোকা নেমেছে। যেন উইয়ের নদী। মূলধারা থেকে শাখা-প্রশাখা খেলে গেছে। কিছু শুড় আবার হিলহিলিয়ে মাথা তুলেছে, অশুভ অঙ্গুলি-সংকেতের মতো। দেখলেই গা শিউরে ওঠে।
হরিশঙ্কর বললেন, এটা কী মোহন?
মোহনদা চমকে উঠলেন, এ তো উই ধরেছে।
এটা উই নয় মোহন, এ তোমার আলস্য। আর এই আলস্যই তোমার ভাগ্য তৈরি করছে। আরও দেখবে?
হরিশঙ্কর মোহনকে নিয়ে তরতরিয়ে আরও কিছুটা উত্তরে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ওপরে তাকাও।
মোহন ওপরে তাকালেন, ভাল করে দেখে বললেন, ঘুণপোকা ধরেছে।
এরপর কী হবে? একদিন আচমকা ভেঙে পড়বে। ওই বাচ্চা ছেলেটাই এখানে বেশি খেলা করে। পড়লে তার মাথাতেই পড়বে। সেটা ভাগ্য? না তোমার আলস্য?
মোহন মুখ কাচুমাচু করে বললেন, আজ্ঞে বাঁশ তো, ঘুণ আর উইপোকা ধরে ধরে আনে!
একটা টুল নিয়ে এসো।
টুল কী করবে?
তোমাকে যা বলছি তাই করো।
হরিশঙ্কর আমাকে বললেন, বিমলাকে ডেকে আনে।
আমি জানি পিতা হরিশঙ্কর কী করতে চাইছেন! উেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বিমলাদি বাড়ির পেছন দিকে বাসন মাজছিলেন। পিঠে ছড়িয়ে আছে এলো চুল। গুনগুন করে গান গাইছেন আর একটা লোহার কড়া শালপাতা ছাই দিয়ে ঘসঘস করে ঘষছেন। ঝকঝকে হয়ে গেছে, তবুও ঘষে যাচ্ছেন।
বিমলাদি!
চমকে ফিরে তাকালেন, বলল ভাই। জল খাবে বুঝি?
আজ্ঞে না, বাবা আপনাকে একবার ডাকছেন।
বিমলাদি বললেন, আমার হাতে একটু জল ঢেলে দেবে ভাই?
সামনেই বালতি আর মগ। ফরসা গোল গোল হাতদুটো সামনে এগিয়ে দিলেন। সাবধানে জল ঢালতে লাগলুম। আমার পেছনেই একটা চালতা গাছ। ছায়া ছড়িয়ে আছে। একটা দোয়েল বেলা শেষের গান গাইছে। একটু পরেই উজ্জ্বল একটা দিনের মৃত্যু হবে। সেই দুঃখ পাখির ঠোঁটে গান হয়ে ঝরছে।
বিমলাদি বেশবাস ঠিক করে হরিশঙ্করের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, কাকাবাবু!
আমাকে একটা খুন্তি এনে দাও। কেরোসিন তেল আছে?
বিমলাদি একটু অবাক হয়ে বললেন, ঘি-ও আছে।
এইবার হরিশঙ্করের অবাক হবার পালা। তিনি বললেন, ঘি কী হরে মা?
রাতে লুচি খাবেন তো!
তুমি কি ভাবলে কেরোসিন তেল দিয়ে লুচি ভাজব বলে খুন্তি চাইছি?
আমি ঠিক ধরতে পারছি না কাকাবাবু।
তোমাকে ধরতে হবে না, যা চাইছি নিয়ে এসো। সময় নষ্ট কোরো না।
মোহনদা বীর হনুমানের মতো একটা টুল মাথায় করে এলেন কোথা থেকে। মালকোচা মারা ধুতি। টুলটা বেশ বড় আর ভারী। হরিশঙ্করের সামনে নামিয়ে রেখে হাঁপাতে লাগলেন। যে-টুল দু’হাতে তুলেও মোহনদা কাপছিলেন, সেই টুল হরিশঙ্কর এক হাতে অক্লেশে তুলে ঠিকমতো জায়গায় নিয়ে গেলেন। এই হলেন হরিশঙ্কর! কখন যে কোন শক্তি প্রকাশ পাবে! কখনও মেধা, কখনও দেহ! কখনও সূক্ষ্ম দেহ-বোধ। একেবারে পূর্ণমানব।
মোহনদা বললেন, এক হাতে তুললেন কী করে! আমি যে দু’হাতে ধরেও কেঁপেছি।
হরিশঙ্কর বললেন, তোমার ব্লাড সুগার হয়েছে মোহন। তাই ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছ। তোমার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অঙ্কটা কী দাঁড়াচ্ছে জানো, আলস্য থেকে সুগার, সুগার থেকে আলস্য, আলস্য থেকে উই আর ঘুণ, ভাগ্যের কাঠামো বিধ্বস্ত।
হরিশঙ্কর টক করে টুলে উঠে পড়লেন। বিমলাদি বললেন, সাবধান সাবধান, টুলে উঠছেন কেন? হরিশঙ্কর কোনওরকম উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। খুন্তি দিয়ে উইপোকা চাঁচতে শুরু করলেন। চাবড়া চাবড়া উইমাটি ঝরে ঝরে পড়ছে। মোটা মোটা সাদা সাদা উইপোকা।
বিমলাদি বললেন, আপনি নেমে আসুন কাকাবাবু, আমি করছি।
নীচের দিক থেকে হরিশঙ্করের মুখ অন্যরকম দেখাচ্ছে। স্পার্টানদের মতো। কাজ করতে করতেই বললেন, দীক্ষা দেওয়ার মতো তোমাদের লজ্জা দিয়ে যাই। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা ঠাকুরঘরে বসে ভগবানের পায়ে ফুল চড়ালে, ভগবান এসে তোমার এইসব কাজ কোনওদিন করে দেবেন না।– ওই দিকটা একটু কম করে এই দিকটা একটু বেশি করে করো। বাড়িতে কোদাল আছে?
মোহনদা বললেন, আজ্ঞে আছে। একজোড়া আছে।
রেডি করে রাখো। এরপরই লাগবে।
হঠাৎ হরিশঙ্কর টুল থেকে টুক করে নেমে এলেন। নেমে এসে বললেন, মোহন, এইবার তুমি ওঠো। তোমার কাজ তোমাকেই করতে হবে। ঠিক আমি যেভাবে চাচছিলুম তুমিও সেইভাবে চাচো। আমি ততক্ষণ একটা নুটি তৈরি করি, কেরোসিন লাগাতে হবে। বিমলা, বেশ মোটা দেখে একটা কাঠি জোগাড় করে আনেনা।
মোহনদা বললেন, কাকাবাবু, আমাকে যে দোকানে যেতে হবে!
এক ঘণ্টা পরে যাবে। বিকেলের দিকে তেমন খদ্দের হয় না, তুমি না বললেও আমি জানি।
মোহনদা থমথমে মুখে টুলে উঠে পড়লেন। ছোটদাদু বসে বসে হাসছেন। আমি কাছে যেতেই বললেন, তোমার বাবা একটা চরিত্র! কেমন নজর দেখলে! বসে বসেই লক্ষ করেছে। মোহনের আজ দফারফা।
ছেলেবেলায় রবিবার হলেই আমার ভয় করত। খাটতে খাটতে শেষবেলায় মনে হত আমি একটা গাধা।
কেরোসিনের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ হরিশঙ্কর আমাকে ডাকলেন, কেমিস্ট্রির ছাত্র তো! বলতে পারো বিমলার রান্নাঘরের ভেতর দিকের চালের বাঁশে কী আছে?
প্রথমে মনে হল বলি, টিকটিকি, গিরগিটি, হেলে সাপ। তারপরেই মনে হল ওটা কেমিস্ট্রি নয়। ঝট করে মাথায় এসে গেল, বললুম, কোলটার।
কেউ কিছু পারলে ঐশ্বরিক আনন্দে হরিশঙ্করের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মোটা টাকার লটারি পেলেও তার এত আনন্দ হবে না। আমার উত্তর শুনে তিনি ছেলেমানুষের মতো চিৎকার করে উঠলেন, গুড, ভেরি গুড। যাও, তুমি আর বিমলা গিয়ে কিছুটা কালেক্ট করে আনেনা।
মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, কীভাবে?
মাথা খাটাও মাথা। নেসেসিটি ইজ দি মাদার অফ ইনভেনশন।