কয়েকদিনের জ্বরেই একেবারে কাবু হয়ে পড়েছে কামাল। এ এক অদ্ভুত ধরনের জ্বর, উত্তাপ ওঠে একশো চার ডিগ্রি, সাড়ে চার ডিগ্রি, শরীরের সবকটি গ্রন্থীতে অসহ্য বেদনা, অথচ ম্যালেরিয়া নয়, শীতের কাঁপুনি নেই। একটা ফিলমের এডিটিং চলছে, কামালের সেখানে উপস্থিত থাকার খুব প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যাওয়ার ক্ষমতা নেই তার। আগামী সপ্তাহে এই ছবির কালার প্রিন্টিং-এর জন্য হংকং যাবার কথা, শুধু সংলাপ-চিত্রনাট্য লেখাই নয়, এই ছবিতেই তার প্রথম পরিচালনার হাতেখড়ি, তাই ঝুঁকি অনেক।
সকালবেলা সে তার বন্ধু জহির রায়হানকে টেলিফোনে অনুরোধ করেছিল এডিটিং ও ডাবিং-এর ব্যাপারে খানিকটা সাহায্য করতে। জহির দেখা করে গেছে কামালের সঙ্গে।
কামালের স্ত্রী হামিদা একটা স্কুলে পড়ায়, দু’দিন সে ছুটি নিয়েছিল, আজ তাকে স্কুলে যেতেই হয়েছে একবার। তার এক চাচাতো বোনের অ্যাডমিশানের ব্যাপার আছে। হামিদা মাথার দিব্যি দিয়ে গেছে, কিছুতেই যেন কামাল বাড়ি থেকে বেরুবার চেষ্টা না করে।
নানা রকম দুশ্চিন্তায় কামালের ঘুম আসছে না, দুপুরটা বিরাট লম্বা মনে হচ্ছে। জানলার বাইরে দুটো কাক ডেকে যাচ্ছে অশ্রান্তভাবে, আগে কখনো কাকের ডাক এত কর্কশ মনে হয়নি কামালের। কাকেরা তো প্রতিদিনই সারাদিন ধরে ডাকে, কিন্তু অন্যদিন কাকের ডাক কানেও আসে না। অতি কষ্টে দু’বার বিছানা ছেড়ে কামাল কাকদুটোকে তাড়াবার চেষ্টা করেছে, ওরা যাবে না। ওদের ডাক ঢাকার জন্যই কামাল বড় রেডিওটা খুললো, সঙ্গে সঙ্গে তার একটা কথা মনে পড়ে গেল, সে কাঁটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধরার চেষ্টা করলো বি বি সি।
একটু পরেই নুরু নামে তাদের বাড়ির কাজের ছেলেটি এসে বললো, ছায়েব, এক মেমছাব আইছেন।
সঙ্গে সঙ্গে কামালের মুখে একটা আশঙ্কার ছায়া পড়লো। অচেনা মহিলা মাত্রই নুরুর কাছে ‘মেমছাব’। স্টুডিও মহলে এতক্ষণে রটে গেছে কামালের অসুস্থতার কথা। পরিচালক হবার পর উঠতি-নায়িকাদের চোখে কামালের দাম বেড়ে গেছে অনেক, কেউ কেউ এই সুযোগে তার বাড়িতে হানা দিতে চাইবেই। কিন্তু হামিদার স্পষ্ট নির্দেশ আছে, বাড়িতে সিনেমার লোকের আনাগোনা চলবে না। বাংলা সিনেমা একেবারেই পছন্দ করে না হামিদা, তার স্বামীর এই পেশাটাও তার মনঃপূত নয়। একদিন সে কাজরী আর আফজলকে বাড়ির দরজা থেকে তাড়িয়েই দিয়েছিল। আজ হামিদা যে-কোনো সময়ে ফিরে আসতে পারে। সে যদি দেখে একা একটি মেয়ে কামালের ঘরে, তা হলে সে তুলকালাম করবে।
কামাল জিজ্ঞেস করলো, মেমসাহেব একা এসেছে, না সাথে কেউ আছে?
নুরু বললো, জী না, মেমছাবের লগে কেউ নাই। মেমছাবের গায়ে কী সোন্দর গন্ধ! দ্যাখতেও খুব খুবছুরৎ!
একা ঘরে, জ্বরতপ্ত কপালে কোনো সুন্দরী রমণীর হাতের স্পর্শ বেশ লোভনীয় মনে হলেও হামিদার মেজাজের কথা ভেবে কামাল তা সম্বরণ করলো। সে ফিসফিস করে বললো, যা, বলে দে, সাহেব ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘরও বন্ধ, উপরে আসা যাবে না। মেমসাহেব চলে গ্যালে দরজা বন্ধ করে দিবি। আর শোন, চারটার সময় আমার দুই একজন দোস্ত আসবে, তাদের যেন আবার ফিরায়ে দিস না।
–দুইজন না একজন?
–দুইজন হইতে পারে, তিনজনও হইতে পারে। পুরুষ মানুষ আসলে ফিরাবি না, বোঝচোস?
–বুঝচি ছাব!
কামাল আবার রেডিওতে বি বি সি নিউজ বুলেটিন শোনায় মন দিল। রাশিয়ার তাসখন্দ থেকে আইয়ুব ফিরে আসার পর পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছে, লাহোর ও লায়ালপুরে ছাত্ররা রাস্তায় গাড়ি পোড়াচ্ছে। ভারতের সঙ্গে আইয়ুবের চুক্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র ক্ষোভ। কাশ্মীর আদায়ের বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা করতে না পেরেও আইয়ুব কোন আক্কেলে ভারতের সঙ্গে হাত মেলাতে গেলেন? তাহলে কিসের জন্য যুদ্ধ হলো, কেন এত রক্তপাত, লোকক্ষয় ও অর্থ ব্যয়? সবই তো ব্যর্থ হলো!
পাকিস্তান রেডিও-তে এই সব খবর শোনা যাবে না। বি বি সি থেকে জানা যাচ্ছে যে পশ্চিম পাকিস্তানী ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে। মোনেম খাঁর ভয়ে ঢাকায় এখনো কিছু গণ্ডগোল শুরু হয়নি। মোনেম খাঁ ভেদবুদ্ধি চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র আন্দোলন একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে।
পাকিস্তানের খবর শুনতে শুনতে অন্য একটা খবর কানে আসায় কামাল আরও উৎকর্ণ হলো।
খানিকবাদে এসে উপস্থিত হলো আলম আর পল্টন। দু’জনেরই মুখ গম্ভীর। পল্টন জিজ্ঞেস করলো, কী রে, কেমন আছিস আজ?
কামাল বললো, একই রকম। তোদের খবর কী বল, গেছিলি শেখ সাহেবের কাছে। দেখা করলেন তিনি?
পল্টন বললো, দেখা তো হলো, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। ভালো করে শুনলোই না আমাদের কথা।
কামালের কপালটা একবার ছুঁয়ে আলম একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। সিগারেট ধরিয়ে বললো, শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি আগে যেমন দেখেছি তার থেকে অনেক বদলে গেছেন। আওয়ামী লীগের সর্বের্সবা হবার পর হঠাৎ যেন অনেকখানি ব্যক্তিত্ব এসেছে, কথাবার্তাও বেশ ডিপ্লোম্যাটিক্যালি বলেন। আমাদের প্রস্তাবটা তুলতে না তুলতেই দু’হাতে কান চাপা দিয়ে বলে উঠলেন, ঐসব বলবা না। আমার সামনে ঐ রকম কথা উচ্চারণও করবা না। আমি পাকিস্তান ভাঙার কোনো মতেই পক্ষপাতী না।
পল্টন বললো, ভাবী তো বাড়িতে নাই দেখলাম। তোর ঐ ছেলেটা চা বানাতে পারবে?
কামাল বললো, ওর হাতের চা খাওয়া যায় না। কেন, শেখ সাহেব, তাদের চা অফার করেন নাই?
পল্টন বললো, করেছিলেন, তবে না করারই মতন। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ততার ভাণ দেখিয়ে বলেছিলেন, চা-পানি কিছু খাবেন? সুতরাং আমরা মাথা নেড়ে না বললাম।
কামাল বললো, হামিদা এখনই এসে পড়বে, তখন চা খাস। শেখ সাহেব তোদের পাত্তাই দিলেন না?
আলম বললো, শেখ সাহেব একটা অদ্ভুত কথা বললেন। পাকিস্তানের ক্যাপিটাল ঢাকায় শিফট করলেই নাকি সব প্রবলেম সম্ভড হয়ে যাবে। উনি বললেন, আমরা বাঙ্গালীরা পাকিস্তানে মেজরিটি, আমরা পাকিস্তান ভাঙতে চাবো কোন দুঃখে? আমরা এবার পাকিস্তানের লায়ন্স শেয়ার আদায় করবো।
পল্টন বললো, উনি চাইলেই আয়ুইব খাঁ বাঙ্গালীর হাতে নিজের হাতের মোয়াটি তুলে দিচ্ছেন আর কি! ঢাকায় ক্যাপিটাল শিফট করার দাবিও তো অনেক পুরানো।
আলম বললো, আমার কেমন যেন মনে হলো, শেখ সাহেবের প্যাটে প্যাটে আরও কিছু মতলব আছে, মুইচকি মুইচকি হাসছিলেন কিন্তু কিছু খুলে বললেন না।
পল্টন বললো, রেডিওটা বন্ধ কর, কী ভ্যাড় ভ্যাড় শুনছিস?
আলম জিজ্ঞেস করলো, ওয়েস্ট পাকিস্তানের আর কিছু খবর আছে?
কামাল রেডিওর নবে হাত দিয়েও বন্ধ না করে দুই বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, বি বি সির নিউজ শুনতেছিলাম, ইন্ডিয়ার খবর।
পল্টন বললো, আমিও সকালে শুনেছি। দশদিন হয়ে গেল ওদের প্রাইম মিনিস্টার লালবাহাদুর শাস্ত্রী মারা গেছেন, এর মধ্যে ইন্ডিয়ায় কোনো মারদাঙ্গা হয় নাই। সিংহাসন দখল করার জন্য লিডারগো মধ্যে কাজিয়া শুরু হয় নাই। আমাদের তুলনায় ইন্ডিয়ার কতখানি এগিয়ে আছে বুঝে দ্যাখ!
কামাল হঠাৎ শ্লেষের সঙ্গে বললো, পল্টন তুই আগে ইন্ডিয়ায় ছিলি, এখনও দেখি ইন্ডিয়ার। জন্য তোর দরদ উথলাইয়া পড়ে।
পল্টন বললো, তুই আমাদের দেশের কথা ভাব তো! প্রাইম মিনিস্টারের সিংহাসন ভারচুয়ালি খালি পড়ে আছে, অথচ লিডারেগো মধ্যে মাথা ফাটাফাটি শুরু হয় নাই, আর্মি জেনারাল এসে জবর দখল করে নাই, এরকম অবস্থা আমাদের দেশে কবে আসবে?
আলম বললো, ডেমোক্রেটিক প্রসেস ওদের ওখানে এখনও কাজ করছে। ইন্ডিয়ানরা আর আমরা একই সব-কনটিনেন্টের মানুষ, আমাদের এখানেই বা আমরা কেন ডেমোক্র্যাসি এস্টাব্লিশ করতে পারবো না?
পল্টন বললো, প্রাইম মিনিস্টারের পোস্টের জন্য ওদের পালামেন্টারি পার্টিতে ইলেকশান হবে। এখন যে টেমপোরারি প্রাইম মিনিস্টার, সেই গুলজারিলাল নন্দ সরে দাঁড়িয়েছে, স্বেচ্ছায় সে সিংহাসন ছেড়ে দিচ্ছে। মোরারজি ভাই দেশাই একজন প্রধান কনটেনডার। ওদিকে ইন্ডিয়ার বিভিন্ন স্টেটের চীফ মিনিস্টাররা অনেকেই প্রপোজ করেছে ইন্দিরা গান্ধীর নাম।
কামাল জিজ্ঞেস করলো, ইন্দিরা গান্ধী কে? নামটা শোনা শোনা, গান্ধীর মাইয়া?
পল্টন বললো, ধেৎ! তুই কিছুই জানোস না। জওহরলাল নেহরুর মেয়ে, সে বিয়ে করেছে আর এক গান্ধীকে। তার সাথে মহাত্মা গান্ধীর কোনো সম্পর্ক নাই। এই ইন্দিরা গান্ধী তো অলরেডি ইন্ডিয়ার একজন মন্ত্রী। আজই ইলেকশানের রেজাল্ট জানা যাবে।
সিঁড়িতে শব্দ করে উঠে এলো হামিদা। অন্য দু’জন অতিথিকে গ্রাহ্য না করে জ্বলন্ত চোখে কামালের দিকে তাকিয়ে সে বললো, গ্যাটের সামনে দুইটা মাইয়া আর একখান ঢ্যামনা খাড়াইয়া আছে দ্যাখলাম, অরা কারা?
কামাল নিরীহ মুখ করে বললো, আমি তো জানি না!
হামিদা ঝঙ্কার দিয়ে বললো, আপনেরে আমি আবার কইয়া দিতেছি, ঐ সিনেমার বান্দরীগুলা যদি এই বাড়িতে ঢোকে আমি তাইলে অগো মুখে নুড়া ঠাইস্যা ধরুম। কপালে আবার সিন্দুরের টিপ পরছে। হিন্দুর–চাটা!
পল্টন দু’হাত তুলে বললো, আরে, আরে, ভাবী আপনার এত অগ্নিমূর্তি ক্যান? আমরা সিরিয়াস ডিসকাশন করতে আছি, শিগগির এটু চা খাওয়ান!
কামাল ক্লিষ্টভাবে বললো, উফ, সাংঘাতিক মাথার বেদনা! এর উপর আর চেঁচাইও না। তোমারে তো আমি বলেই দিয়েছি, কোনো সিনেমার লোকরে বাড়িতে ঢুকতে দিবা না। কেউ যদি এসে পড়ে তো আমার ওপর চোটপাট করো কেন?
হামিদা পল্টনের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনেরাও এখন যান। দ্যাখতে আছেন না মানুষটা কত অসুস্থ! এখন কথা কইতে পারবেন না।
পল্টন হেসে বললো, আরে, আমাদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন, আমরা কি সিনেমার তোক নাকি? আমরা অন্য কথা বলতে এসেছি।
কামাল বললো, হামিদা হইলো মোনেম খাঁর চর, ওর সামনে কিছু বলিস না। আমার বাড়ির মইধ্যে পুরাপুরি মিলিটারি রুল!
পল্টন হামিদার মাথায় একটা হাত রেখে বললো, হাজব্যান্ডের অসুখ হইলে বউয়ের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। ভাবী, আমাগো এই বন্ধুটির সাথে তো আপনার পরিচয় হয় নাই, আলাপ করায়ে দিই, এর নাম ইউসুফ আলম, লন্ডনে থাকে, বিশেষ প্রয়োজনে এসেছে। তা ছাড়া আলম একজন ডাক্তার।
আলম উঠে দাঁড়িয়ে সম্ভ্রমের সঙ্গে হামিদাকে অভিবাদন জানালো।
একটু বাদে হামিদা চা বানাবার জন্য নিচে গেলে তিন বন্ধুতে আবার শুরু হলো আলোচনা।
কামাল আলমকে জিজ্ঞেস করলো, এর পর আর কার কার সাথে দেখা করতে যাবি তোরা?
আলম বললো, আমি শেখ সাহেবের সাথে আবার কথা বলার চেষ্টা করবো। ওঁকে রাজি করানো বিশেষ প্রয়োজন। উনি যদি আন্দোলন সংগঠন করতে পারেন, তাইলে ফান্ডের অভাব হবে না। লন্ডনে আমরা তো আছিই, তাছাড়া ইওরোপে-আমেরিকায় অনেক ইস্ট পাকিস্তানী ছড়ায়ে আছে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইস্ট পাকিস্তানের জন্য তারা অনেকেই মদত দেবে! এখানে নুরুল আমিন, আবুল মনসুর, আতাউর রহমান খান, মানিক মিঞা এনাদের সাথেও আমার দেখা করার ইচ্ছা আছে।
পল্টন বললো, মৌলানা ভাসানীর কাছে গিয়ে তো কোনো লাভ নাই। বাবুল চৌধুরীর কাছে তো শুনলিই, চীনের মুখ চেয়ে ওরা এখন আইয়ুব খানের সাপোর্টার। ওরা শেখ মুজিবকে একেবারে দেখতে পারে না।
কামাল বললো, পল্টন,তুই যে আলমের সাথে সাথে এই সব জায়গায় যাইতাছোস, তুই কিন্তু সাবধানে থাকিস। আলম তো লন্ডনে ফিরে যাবে, কিন্তু মোনেম খাঁর স্পাই যদি তোর পিছনে লাগে
পল্টন বললো, সে আমি গ্রাহ্য করি না। অনেকদিন চুপচাপ ছিলাম, আর কতদিন সহ্য করবো? বাড়িতে বসে বসে মনে মনে শুধু গুমড়াইলে মানসিক রোগ হয়ে যাবে। শয়তানের চ্যালা চামুণ্ডারা দেশটারে উচ্ছন্নে দেবে, আর আমরা শুধু দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরায়ে থাকবো?
আলম বললো, রেডিওটা আবার খোল তো। বি বি সি শুনি।
কামাল রেডিয়ো চালাতেই তিন বন্ধু উৎকর্ণ হলো। নিউজ বুলেটিন শুরু হয়েছে, ইন্ডিয়ার খবরই বেশি। ভারতের প্রধান মন্ত্রীত্বের পদ নিয়ে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিত হয়েছে মোরারজি দেশাই ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে, ভোট গণনা চলছে, একটু পরেই ফলাফল জানা যাবে।
এই সময় নুরু এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আর এক ছাব আইছেন। উফরে আসতে চান না!
কামাল বিরক্ত ভাবে বললো, আঃ! তোরে কইছি না দরজা বন্ধ রাখতে? কারুর সাথে আইজ আমি দ্যাখা করুম না।
নুরু বললো, আপনে যে বললেন, পুরুষ মানুষ হইলে উফরে উঠাইতে!
–যাগো আসার কথা আছিল তারা আইছে। আর কাউর আসার দরকার নাই! তুই যা! আলম বললো, ইন্দিরা গান্ধীই জিতে গেল। মোরারজি পেয়েছে ১৬৯ ভোট আর ইন্দিরা ৩৫৫। ভালো মেজরিটি।
পল্টন বললো, শুধু তাই না, শান, এই মাত্তর কী বললো। হেরে গিয়ে মোরারজি গ্রেসফুলি হার স্বীকার করে নিয়েছে, ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সেও স্বীকার করছে। বি বি সি থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের বয়ঃকনিষ্ঠা অধিশ্বরী হিসাবে অভিনন্দন জানালেন।
কামাল বললো, জওহরলালের মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী। এ কি ডেমোক্র্যাসি না ডাইনাস্টি? এ যে উত্তরাধিকারী সূত্রে সিংহাসন দখল বাবা!
পল্টন বললো, মোটেই তা না। নেহরুর পর ইন্দিরা আসেন নাই। লালবাহাদুর বেঁচে থাকলে ইন্দিরার কোনো চান্স ছিল না। এবারেও ইন্দিরা গান্ধী এসেছেন পার্টির ভোটে জিতে, জোর করে চেয়ার কেড়ে নেন নাই, তারে কেউ উপর থেকে বসায়েও দ্যায় নাই!
আলম বললো, ইমপারশিয়ালি দেখতে গেলে এটা গণতন্ত্রের জয় বলেই ধরতে হবে। নেহরুর মেয়ে হওয়াটা ইন্দিরার ডিসকোয়ালিফিকেশান হতে পারে না। আবার একথাও ঠিক, নেহরুর নামের ম্যাজিকটা উনি অনেকখানি কাজে লাগিয়েছেন। আমরা যেমন বেগম ফতিমা। জিন্নাকে দাঁড় করায়েছিলাম।
কামাল বললো, কিন্তু ফতিমা জিন্না জেততে পারেন নাই।
পল্টন সঙ্গে সঙ্গে বললো, তার কারণ আমাদের ইলেকশানটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে হয় নাই।
চায়ের ট্রে নিয়ে হামিদা ঘরে ঢুকে আলমকে জিজ্ঞেস করলো, কী রকম দ্যাখলেন?
আলম উত্তর দিল, চিন্তার কিছু নাই, এক ধরনের ফ্লু, তিন চার দিন রেস্ট নিতে হবে।
পল্টন অতি উৎসাহের সঙ্গে বললো, ভাবী, নিউজ শোনছেন? ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী।
তার দিকে একটি ঠাণ্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হামিদা বললো, ইন্ডিয়ার কে প্রাইম মিনিস্টার হয়েছে তাতে আমার কী আসে যায়?
–বাঃ, একজন মহিলা এত বড় পোস্টে গেলেন, আপনাদের তো গর্ব হওয়ার কথা। মডার্ন ওয়ার্ল্ডে আর কোনো মহিলা কি কোনো দেশের প্রাইম মিনিস্টার হয়েছেন?
–প্রাইম মিনিস্টারগিরি করা কোনো মহিলার পক্ষে যে যোগ্য কাজ, তা আমি মনে করি। কত মিথ্যা কথা বলতে হবে, সে হিসাব আছে?
আলম হাসতে হাসতে বললো, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি! পলিটিশিয়ানদের প্রধান অস্ত্র!
হামিদা কামালের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে বললো, ইন্ডিয়া থেকে একজন মানুষ এসে নিচে বসে আছে। আপনের কাছে অন্য মানুষ আছে শুনে উপরে আসতে চায় না।
পল্টন বিস্ময়ে ভুরু তুলে বললো, সে কি ভাবী, আপনি আমাদের তাড়ায়ে দিচ্ছিলেন, এখন অন্য মানুষকে বাড়ির মধ্যে অ্যালাউ করলেন কী করে?
কামালও ভুরু কুঁচকে বললো, ইন্ডিয়া থেকে লোক এসেছে? কী করে আসলো? বর্ডার সীল্ড না?
হামিদা পল্টনকে উত্তর দিল, যে এসেছে সে ওনার খালাতো ভাই। তারেও আমি খ্যাদায়ে দেবো নাকি?
কামাল আবার জিজ্ঞেস করলো, কে? শাজাহান নাকি, সত্যি? তারে উপরে পাঠায়ে দাও এখনই। বলল, এরা বাইরের মানুষ না, এরা আমার বিশেষ বন্ধু।
হামিদা নেমে যেতেই কামাল বন্ধুদের বললো, এই শাজাহান কলকাতায় থাকে, বড় ব্যবসায়ী, খুব শিক্ষিত মানুষ। সে কী ভাবে এখন ঢাকায় এলো বুঝতেই পারছি না।
পল্টন বললো, আমরা তা হলে এখন উঠি।
কামাল বললো, আরে বয়, বয়। শাজাহানের কাছ থেকে হয়তো কিছু নতুন খবর শোনা যাবে। তোদের সাথে গল্প-গাছা করে শরীরটা ভালো লাগছে।
শাজাহানকে দেখে আলম ও পল্টন দু’জনেই কয়েক পলক মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতনই সুপুরুষ সে, গাঢ় নীল সুট পরা, কিন্তু মুখোনি গাম্ভীর্য মাখা।
কামাল অন্য দু’জনের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি এলে কী করে শাজাহান ভাই? বডার কী খুলে দিয়েছে নাকি?
শাজাহান বললো, বড়ার বেশ কয়েকদিন হলো খুলে দিয়েছে। ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের প্রিজনার বিনিময় দিয়ে শুরু হয়েছিল, তারপর দু’দেশে যারা আটকা পড়েছিল তাদের যাতায়াতের জন্য, আমিও কিছুদিন জেলে ছিলাম।
–তুমি জেলে ছিলে? কেন?
–কেউ আমার নামে কমপ্লেন করেছিল, আমি পাকিস্তানের স্পাই।
পল্টন বললো, আমাদের এখানেও অনেককে আটকে রেখেছিল। মনিলাল, শম্ভুদের বোধ হয় এখনও ছাড়েনি।
কামাল তপ্তভাবে বললো, শাজাহান ভাইরা সাত আট পুরুষ ধরে কলকাতার মানুষ, ওনারা বাদশা ওয়াজির আলী শা’র সাথে সাথে লক্ষ্ণৌ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন, শাজাহান ভাই কোনোদিন মুসলিম লীগকে সাপোর্ট করেনি।
পল্টন বললো, যুদ্ধের সময় ওরকম কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়ই। শাজাহান ভাই, আপনি কি আজই আসলেন? ইন্ডিয়ার লেটেস্ট খবর শুনেছেন তো? ইন্দিরা গান্ধী আপনাদের প্রাইম মিনিস্টার হয়েছেন।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শাজাহান বললো, শী ইজ ডেফিনিটলি আ বেটার চয়েস। মোরারজি লোকটা অনেক রি-অ্যাকশানারি।
–আপনার কী মনে হয়, একজন মহিলা প্রাইম মিনিস্টার হবার পর ইন্ডিয়ার অবস্থা কিছু পাল্টাবে?
–মাপ করবেন, আমি পলিটিকস নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাই না। আমি বিজনেসম্যান, বিজনেস বুঝি?
–এখানে কোনো বিজনেসের ব্যাপারে এসেছেন?. ইন্ডিয়ার সাথে আবার আমাদের বিজনেস শুরু হচ্ছে নাকি? বইপত্তর তো কিছুই আসে না। টোটালি ব্যান করা হয়েছে।
–নাঃ, আপাতত এখানে কোনো বিজনেসের ব্যাপারে আসিনি।
কামাল জিজ্ঞেস করলো, তুমি উঠেছো কোথায়? কোনো হোটেলে নাকি, না, না, সেসব চলবে না। মালপত্তর আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসো।
শাজাহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আপাতত একটা হোটেলেই আছি। এখানে একটা বাড়ি কিনতে চাই। সেই ব্যাপারে তোমার সাহায্যের দরকার হবে।
–তুমি এখানে বাড়ি কিনবে? কেন? ইন্ডিয়ার সিটিজেন হয়ে কি এখানে সম্পত্তি রাখা যাবে?
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে অনেকটা আপন মনে উচ্চারণ করার ভঙ্গিতে শাজাহান বললো, ভাবছি এখানেই থেকে যাওয়া যায় কি না। ইন্ডিয়াতে আর আমার থাকতে ইচ্ছা করে না। আমার মন ভেঙে গেছে।